দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা এবং মূল্যের প্রয়োগকে “প্রযুক্ত নৈতিকতা” বলা হয়। এর জন্য আধুনিক শব্দ হতে পারে “জীবন-শিক্ষা”। এই জীবন-শিক্ষা উভয়ই ব্যক্তিগত হতাশা ও সামাজিক অস্থিরতার দ্বৈত চ্যালেঞ্জের সমাধান প্রদান করে। ব্যক্তিগত স্তরে এটা একজন মানুষকে নিজের জীবন সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করে, অন্যদিকে সামাজিক স্তরে উন্নতি ও বিকাশের জন্য অপরিহার্যদের সাথে কীভাবে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরী করা যায় সেটা শিখতে সহায়তা করে। এখানে সার্বজনীন নৈতিকতা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে।
আমরা এই ধরণের নৈতিকতা কোথায় পাই? এগুলি আমরা ধর্ম-নিরপেক্ষ উৎস থেকে প্রাপ্ত করতে পারি, যেমন- অ্যারিস্টটল অথবা জন্.এফ. কেনেডির মতো নেতা, যিনি বলেছিলেন, “আপনার দেশ আপনার জন্য কী করতে পারে সেটা জিজ্ঞাসা করবেন না, বরং আপনি আপনার দেশের জন্য কী করতে পারবেন সেটা ভাবুন।” আমরা সেগুলি ধর্ম থেকেও প্রাপ্ত করতে পারি। যেহেতু কিছু লোক যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে পারে যে ধর্ম শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, এই বিষয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ধর্মের দুটি দিক আছেঃ ব্রহ্মবিদ্যাগত দিক যা ধর্মকে ধর্ম থেকে আলাদা করে, আর অন্যদিকে আছে নৈতিক ব্যবস্থা যেগুলি সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে সার্বজনীন। যেহেতু আমরা তাদের সকলের কাছ থেকে জীবনের মূল নীতিগুলি প্রাপ্ত করি, অতএব আমি যোগ করব যে ধর্মগুলিও সার্বজনীন প্রযুক্ত নৈতিকতা গঠনে ভূমিকা পালন করে।
মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শান্তি ও আধ্যাত্মিকতা কেন্দ্রে আমরা প্রযুক্ত নৈতিকতার জন্য ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত বিকাশ করেছি। মৌলানাজী সাপ্তাহিক ছুটিতে গত সতেরো বছর ধরে ক্লাস চালাচ্ছেন। আমরা হাজার-হাজার জীবন-শিক্ষক তৈরী করেছি। তারা প্রথমে মূল নীতিগুলি নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করেছিলেন এবং তারপরে সেগুলির সম্পর্কে অন্যদের জানাতে বাইরে বেরিয়েছিলেন। সেটাই হল তাই যা শিক্ষকদের করা দরকার। তাদের প্রথমে নিজেদেরকে মূল নীতিগুলি নিজের উপর প্রয়োগ করতে হবে এবং সেটা করা নিয়মিত ভাবে চালিয়ে যেতে হবে। এটা একটা আজীবন প্রক্রিয়া। আমরা শুরু করি এবং তারপরে আমরা যেমন ভাবে এগিয়ে যাই আমরা শিক্ষার্থীদের একই মূল নীতিগুলি প্রয়োগ করতেও সহায়তা করি।
আমরা যা বিকাশ করেছি সেটা একটা সমাধান। সমসাময়িক বিশ্বে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় সে সম্পর্কে আমি গবেষণা করেছি। গবেষণার ভিত্তিতে আমি বুঝতে পেরেছি যে ব্যক্তিদের শান্তির সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করা দরকার। যখন এটা ঘটে তখন তারা বৌদ্ধিকভাবে বিকাশ লাভ করে, স্বয়ং শান্তিময় হয়ে ওঠে এবং তারা সমাজে শান্তি, অগ্রগতি আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখে। এটা আন্তর্জাতিক ভাবে দেশকে বিকশিত করে তোলে।
এই লক্ষ্যে আমরা একটা ব্যক্তিত্ব বিকাশের কর্মসূচী তৈরী করেছি যা থেকে আমি তিনটি মূল নীতি শেয়ার করতে চাই। এই মূল নীতিগুলি ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় নীতি উভয় থেকেই তৈরী করেঃ
১) একটা ইতিবাচক মনোভাব
প্রথমটি হল ইতিবাচক মনোভাব বা ইতিবাচক মানসিকতা। কারাগারে বন্দী দুজন লোকের একটা গল্প আছে। যারা জানালা দিয়ে খিলের পিছন থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একজন শুধু দেখতে পায় কাদা আর অন্যজন দেখে তারা। এর অর্থ হল বিভিন্ন ব্যক্তি একই পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে পারে, কিন্তু আমরা নিজেরাই নেতিবাচক হওয়া পছন্দ করতে পারি এবং কাদাও দেখতে পারি, অথবা পরিস্থিতি যে সুযোগটি উপস্থাপন করে সেটা দেখার জন্য বাছাই করতে পারি। আমরা যত দৃষ্টিকোণ বিকশিত করব সেটা আমাদের সুযোগকে দেখতে সহায়তা করবে।
২) ইতিবাচক আচরণ
দ্বিতীয়টি হল ইতিবাচক আচরণ। সব ধর্মে নৈতিকতার সুবর্ণ নিয়ম আছে। খ্রীষ্টান ধর্মে যেমন রয়েছে, “অপরের প্রতি যেমন ব্যবহার করা উচিত, তেমনই করুন আপনার প্রতিও।” এর অর্থ আমরা ঠিক জানি যে, আমি অপরের কাছ থেকে ঠিক কী ধরণের আচরণের আশা করি। আমাদেরকে খুব বেশি নৈতিক নিয়ম শেখানোর প্রয়োজন নেই, তবে আমরা যেমন আচরণ করি ঠিক অন্যরাও যেন আমাদের প্রতি তেমন আচরণ করে। আমরা অপরকে দেওয়া (দান) শুরু করি এবং আমরা জানি, কাউকে দিলে, পরিবর্তে আমরাও পাই। আমরা পাই আমাদের অধিকার, আমাদের মানবতা- সবকিছু।
৩) শান্তি এবং অহিংসা
আমার গবেষণা অনুসারে সমস্ত নৈতিকতার সারমর্মটি শান্তিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এটা শুভেচ্ছা, সম্মান ও ক্ষমার মতো জীবনের সমস্ত ইতিবাচক মূলনীতিগুলির একটি ছাতার গম্বুজ। এইভাবে সেসব কিছুই শান্তি এবং অহিংসার ছত্রছায়ায় আসতে পারে। আমরা যখন এই মূলনীতিগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি তখন আমরা কেবল নিজের উন্নতি এবং বিকাশ করি না, বরং আমরা সমাজে অগ্রগতির অবদানকারী হয়ে উঠতেও সহায়তা করি।
আমি মনে করি যে, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও যদি এই ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করেন তাহলে এটা উপকারী হয়ে উঠবে। রামানুজন কলেজে ইতিমধ্যে আমাদেরকে তাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে এই মডিউল গুলি নিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলেন সেটা খুব সফলও হয়েছে। এটাকে আরও প্রসার করার জন্য শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রটি স্কুলগুলির উদ্দেশ্যে পাঠ্যক্রম তৈরী করেছে, যেমন- আমাদের “We, the Living (আমরা, সজীব) পাঠ্যক্রম”, যেখানে পাঠ্যক্রমের বই, গবেষণা উপাদান এবং প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষকদের উপাদান উপলব্ধ রয়েছে। কলেজ এবং ক্যাম্পাসগুলির জন্য আমরা, “শান্তির সংস্কৃতি” পাঠ্যক্রম তৈরী করেছি যেটাকে আমরা রামানুজন কলেজে প্রবর্ত্তন করার জন্য আশাবাদী। অফ ক্যাম্পাস ব্যক্তি এবং নিগম গুলির জন্য আমরা “Good Life Program (শুভ জীবন কর্মসূচী)” বিকাশ করছি। এই কর্মসূচীগুলির মাধ্যমে আমরা এগুলিকে বিশ্বের কাছে নিয়ে যেতে চাই। আমরা সমগ্র ভারতে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আন্তর্জাতিক ভাবে আমরা এগুলিকে অনলাইনে রাখছি যাতে আমাদের কেন্দ্রগুলি এবং সেখানকার জীবন শিক্ষকগণ এগুলি আরও গ্রহণ করতে পারে। আমি আশা করি এটা জীবন শিক্ষক এবং নীতিবিদদের বিকাশের পক্ষে একটা ছোট্ট পদক্ষেপ হবে। এইভাবে আমরা বৌদ্ধিকভাবে নিজেরাই বিকাশ লাভ করতে পারি এবং অগ্রগতি ও বিকাশের সহায়ক হতে পারি।