এসইই শিক্ষাঃ সামাজিক দক্ষতার বিকাশ

সামাজিক, আবেগপ্রবণ এবং নৈতিক শিক্ষা, ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, সংক্ষিপ্ত ফ্রেম ওয়ার্ক

সামাজিক, আবেগপ্রবণ এবং নৈতিক (এসইই) শিক্ষাটি ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত লারনিং সেন্টার ফর কনটেমপ্লেটিভ সাইন্স অ্যান্ড কমপ্যাশন বেস্‌ড এথিক্স দ্বারা বিকশিত একটি কর্মসূচী। এর লক্ষ্য হল আবেগপ্রবণ ভাবে সুস্থ এবং নৈতিক ভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সামাজিক গোষ্ঠী এবং বৃহত্তর সমাজকে লালন-পালন করা। এর দ্বিতীয় অংশে, এসইই লারনিং- সামাজিক দক্ষতার বিকাশের অন্তর্গত, আমরা অপরের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মঙ্গল ও সম্প্রীতির উন্নতি করে একাধিক সামাজিক দক্ষতার বিকাশ করতে শিখি।

আবেগপ্রবণ সাক্ষরতার দক্ষতা এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণের যে দক্ষতাগুলি আমরা ব্যক্তিগত কর্মক্ষেত্রে শিখি সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের পক্ষে খুব উপকার হয় যখন আমরা জীবনের মাধ্যমে অগ্রসর হই। তবে মানুষ যেমন স্বভাবগত ভাবে সামাজিক তেমনি এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা অন্যের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। আগে একটা ধারণা ছিল যে সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলি জন্মগত এবং অপরিবর্তনীয়, কিন্তু সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ক্রমবর্ধমান ভাবে পরামর্শ দিচ্ছে যে সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলি অধ্যয়ন করে, অনুধাবন করে এবং উদ্দেশ্যকৃত অনুশীলনের মাধ্যমে বিকাশ করা যেতে পারে। সামাজিক বলতে আমাদের তাৎক্ষণিক আন্তঃব্যক্তিগত পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়। এর পাশাপাশি স্কুল, অফিস, পরিবার বা আশপাশের ছোট-ছোট সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াকেও বোঝায়। বড় আকারের সম্প্রদায়গুলিতে একটা শহর, একটা সমাজ অথবা পুরো পৃথিবী, এগুলি তৃতীয় এবং চূড়ান্ত কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত।

সচেতনতা, করুণা এবং একটা সামাজিক প্রসঙ্গে নিযুক্তি

শুধুমাত্র নিজের পরিবর্তে অপরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছাড়া সামাজিক কর্মক্ষেত্রটি অনেক দিক থেকে ব্যক্তিগত কর্মক্ষেত্রের সমান। আবার আমরা সচেতনতা, করুণা এবং নিযুক্তির মতো তিনটি মাত্রার মাধ্যমে চলাচল করি। এখানে সচেতনতার অর্থ হল অপরের বুনিয়াদী সচেতনতার পাশাপাশি নিজেদেরকে সামাজিক জীব হিসাবে সচেতন করা অর্থাৎ আমরা অপরের সাথে সম্বন্ধ-স্থাপন করে জীবিত আছি, আমাদের অপরের প্রয়োজন আছে এবং আমাদের ক্রিয়া-কলাপগুলি অপরকে প্রভাবিত করে। মানুষ হিসাবে আমাদের মধ্যে কী সাদৃশ্যপূর্ণ এবং কী আমাদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা করে তার বোধগম্যতা এই সচেতনতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। করুণা যেটাকে অন্তর্ভুক্ত করে সেটা হল বর্তমানে অপরকে এবং তাদের আবেগকে বুঝতে ব্যক্তিগত কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানকে ব্যবহার করা হয় যাতে আমরা কম প্রতিক্রিয়াশীল এবং বিচারমূলক হই। আমরা এই অন্তর্দৃষ্টিটি কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা, উদারতা (দান) এবং নম্রতার মতো অন্যান্য সামাজিক বৈশিষ্ট্য বিকাশ করার জন্য ব্যবহার করি। সর্বশেষে, নিযুক্তি মাত্রায় এই সচেতনতা এবং অন্তর্দৃষ্টিকে একসাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এই শেখার জন্য যে কীভাবে অপরের সাথে ইতিবাচক এবং গঠনমূলক সম্বন্ধ-স্থাপন করা যায়। অতএব, সামাজিক কর্মক্ষেত্রে তিনটি উপাদান বিবেচনা করা যেতে পারে, যথা-

  • আন্তঃব্যক্তিগত সচেতনতা
  • অপরের প্রতি করুণা
  • সম্পর্কের দক্ষতা

আন্তঃব্যক্তিগত সচেতনতা

যদি আমাদের সকলেরই সংকীর্ণ স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, তাহলে অপরের সাথে মনের সর্বোত্তম আগ্রহ সহ সম্বন্ধ-স্থাপন করার প্রশিক্ষণ হল একটি দক্ষতা যা সময়ের সাথে সাথে শেখা যায়। এটা শুধু অপরের অনেক উপকার হয় তা নয়, বরং এরফলে নিজেরও অনেক উপকার হয়। উদাহরণ স্বরূপ, অপরের জন্য উপলব্ধি বোধ করাটা কল্যাণের অনুভূতি লাভ করার পাশাপাশি আন্তঃব্যক্তিগত সংযোগের অনুভূতি প্রবল করে। আন্তঃব্যক্তিগত সচেতনতাকে তিনটি মূল বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ঃ

  • আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা
  • অন্যদের সাথে আমাদের অংশীদারী বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা
  • বিভিন্নতা এবং পার্থক্যতার উপলব্ধি

আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা বলতে আমাদের সহজাত সামাজিক প্রকৃতি এবং অন্যের গুরুত্ব আর আমাদের জীবনে তারা যে ভূমিকা পালন করে সেটাকে চিহ্নিত করার ক্ষমতাকে বোঝায়। অন্যের সাথে আমাদের অংশীদারী বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা বলতে বোঝায় আমরা মৌলিক স্তরে অন্যদের সাথে যা শেয়ার করি সেটা উপলব্ধি করা অন্তর্ভুক্ত, যেমন- সুখের কামনা করা এবং দুঃখ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হওয়া। সর্বশেষে, বিভিন্নতা এবং পার্থক্যের উপলব্ধি করা হল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বৈচিত্র, স্বাতন্ত্র এবং পার্থক্যকে সম্মান করা এবং তারা যেভাবে আমাদের সামুহিক জীবনে যুক্ত হয় সেটাকে দেখা।

অন্যদের সামাজিক বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা

যেমন একটা প্রবাদ রয়েছে, “কোন মানুষই একটা দ্বীপ নয়।” বাস্তবতাটা হল আমরা (মানুষ) হলাম সামাজিক প্রাণী। অন্যান্য অসংখ্য মানুষ আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আমরা সেটা উপলব্ধি করি বা না করি সেটা আলাদা ব্যাপার। অন্যের অস্তিত্ব রয়েছে এবং তারা এই বিশ্বকে বিষয়ের মতো অনুভব করে যেমন কিনা আমরা করি। এই ধরণের মূল ঘটনা মাঝে-মাঝে আমাদের হাতছাড়া হতে পারে। এটি আমাদের ভাবনার জালে পড়তে খুব সহজ করে তোলে যে আমাদের মধ্যে আছে শুধু চাহিদা এবং প্রয়োজন, যাদের যত্ন নেওয়া দরকার ইত্যাদি।

শুরুতে আমরা সেই ব্যক্তিদের অনুধাবন করা শুরু করতে পারি যারা আমাদের একটা আকার দিয়েছেন বা সৃষ্টি করেছেন, যারা আমাদের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে চলে এবং ভবিষ্যতেও প্রভাবিত করবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের মাতা-পিতা বা অন্যদের কথা ভাবতে পারি। যারা আমাদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা প্রদান করেছেন এবং এখনও করেন। অন্যরা আমাদের সাহচর্য প্রদান করেন। বিস্তৃত স্তরে ভাবলে, অসংখ্য মানুষ খাদ্য উৎপাদন করে যা আমরা খাই এবং পোষাক নির্মাণ করে যা আমরা পরি। এই বিষয়গুলির উপর অনুধাবন করে অন্যের প্রশংসা, তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং করুণা বিকাশ করার ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

অন্যদের সাথে আমাদের অংশীদারী বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করা

অন্যের অস্তিত্ব আছে এবং আমাদের জন্য সাহচর্য প্রদান করে, এর বাইরেও আমাদের মেনে নেওয়া উচিত যে তাদেরও আবেগপ্রবণ জীবন আছে। আমাদের মৌলিক সাদৃশ্যগুলির স্বীকৃতি দিয়ে এখানে অন্যের মৌলিক উপলব্ধি বাড়ানো হয়। আর কোন পার্থক্য আমাদেরকে তাদের প্রশংসা করা থেকে বিরত রাখার প্রয়োজন হয় না। আমরা যেসব সাদৃশ্যগুলিতে মনোনিবেশ করি সেটা হল আমাদের প্রাথমিক মানবীয় অভিজ্ঞতা। এগুলি সব লোকজনের কাছে সাধারণ। অন্যেরা ঠিক আমাদের মতোই তাদের মঙ্গল হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে এবং অসুবিধা ও দুঃখ চায় না। তাদেরও আবেগপূর্ণ জীবন আছে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে চাহিদা, প্রয়োজন, ভয়, আশা এবং এরকম আরও অনেক কিছু। তারা অসুস্থ হয়, তাদের আছে সীমাবদ্ধতা, তারা বাধার মধ্যে চলে আর আনন্দ এবং বাধা-বিঘ্ন অনুভব করে। এই সাদৃশ্যগুলির স্বীকৃতি হল এমন একটি দক্ষতা যা বিকাশ করা যায় এবং অভ্যাসগত করা যায়।

মনের মানচিত্র এবং প্রথম-ব্যক্তির আবেগপ্রবণ সচেতনতা সহ আমরা যখন একবার আবেগপ্রবণ সাক্ষরতার একটি নির্দিষ্ট মানদন্ড বিকাশ করি তখন অন্যের সাথে আমরা যে সাদৃশ্যগুলি শেয়ার করি সেটাকে লক্ষ্য করা সহজ। একই সময়ে, অন্যরা কীভাবে আমাদের মতো নয় সেগুলি আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। যদিও প্রত্যেকের চাহিদা, প্রয়োজন, ভয় এবং আশা আছে, তবে তারা সেই জিনিসগুলি চায় না, প্রয়োজন বোধ করে না বা ভয় পায় না যেটা আমাদের মধ্যে আছে বা আমরা করি। এই সত্যটি স্বীকার করতে হবে এবং তার সম্মান করতে হবে। তদুপরি, অন্যের জীবনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং জ্ঞান আছে। যার সবকিছুই প্রশংসা করা যায়। আমাদের সাদৃশ্যগুলির প্রশংসা করার সময় আমাদের পার্থক্যগুলি উপলব্ধি করাটা আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের সম্পর্কে বোধগম্যতা তৈরী করে যা সম্পর্কের দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে কাজ করে।

বিভিন্নতা এবং পার্থক্যের প্রশংসা

অপরের সাথে আমাদের শেয়ার করা বাস্তবতার একটা অংশ হল আমরা সকলেই অনন্য এবং আলাদা। এর সাথে-সাথে আমরা এমন সামাজিক গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত যার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা লালন-পালন, আলাদা পারিবারিক পরিবেশ এবং এক অনন্য অভিজ্ঞতা আছে, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব এবং আকাঙ্খাকে গঠন করে।

সুতরাং বৈচিত্র আমাদের শেয়ার করা বাস্তবতার একটা অংশ। এটার এইভাবে উপলব্ধি করা যায় যে এমনকিছু যা আমাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে একত্রিত করতে পারে। পার্থক্য এবং বৈচিত্র যেভাবে আমাদের সামুহিক জীবনে অবদান রাখে তার সম্মান করা আমাদের ক্রমবর্ধমান বহুবিত্ত এবং বিশ্বায়িত বিশ্বের এক প্রকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতা। এটি প্রকৃত সহানুভূতি এবং করুণার জন্য একটা আধার গড়ে তোলে।

অন্যের প্রতি করুণা

সমস্ত সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং অবদান উভয়ই অন্যের প্রতি করুণা বিকাশ করা থেকে উৎপন্ন হয়। আন্তঃব্যক্তিগত সচেতনতা বিস্তৃত সামাজিক বৈশিষ্ট্য উৎপাদনের পথ প্রশস্ত করার সময় করুণা সেটাকে একটি নৈতিক প্রসঙ্গে প্রযুক্ত হতে সহায়তা করে। অন্যের প্রতি করুণা বিকাশের তিনটি উপায় আছেঃ

  • প্রসঙ্গে অন্যের অনুভূতি এবং আবেগগুলিকে বোঝা
  • দয়া ও করুণার প্রশংসা এবং বিকাশ
  • অন্যান্য নৈতিক স্বভাবের প্রশংসা এবং বিকাশ

প্রসঙ্গে অন্যের অনুভূতি এবং আবেগগুলিকে বোঝা

আমাদের নিজস্ব আবেগগুলি বুঝতে না পারাটা আত্ম-বিচারের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ঐভাবে আমরা যখন অন্য লোকজনদের এমন ভাবে আচরণ করতে দেখি যা আমরা বুঝতে পারি না বা অনুমোদন করি না, তখন আমরা স্বাভাবিক ভাবেই রায়ের সাথেই প্রতিক্রিয়া জানাই। একই ভাবে আবেগগুলি কীভাবে চাহিদা এবং প্রয়োজন থেকে উত্থাপিত হয় তার বোধগম্যতাটি স্ব-গ্রহণযোগ্যতা এবং স্ব-করুণার দিকে পরিচালিত করে। এই প্রক্রিয়াটি অন্যের দিকে তাকানোর সময় একইভাবে কাজ করে।

আমরা যদি বুঝতে পারি যে অন্য ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপগুলি আবেগের কারণে অনুপ্রাণিত হয় এবং এই আবেগগুলি একটি প্রসঙ্গে এবং অন্তর্নিহিত প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত হয় তাহলে সেটা ক্রোধ এবং বিচারের পরিবর্তে সহানুভূতি এবং করুণার দিকে পরিচালিত করতে পারে। এখানে উদ্দেশ্যটি অনুপযুক্ত আচরণকে ক্ষমা করার জন্য নয়, বরং মানবিক স্তরে তাদেরকে এবং তাদের অনুভূতিকে বোঝার জন্য নির্ধারিত হয়।

দয়া ও করুণার প্রশংসা এবং বিকাশ

এটা স্পষ্ট বলে মনে হতে পারে যে আমাদের নিষ্ঠুরতার পরিবর্তে করুণার মূল্য দেওয়া উচিত, তবুও এর মূল সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ। আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে এবং ঐতিহাসিক উদাহরণগুলি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা কীভাবে নিজেরা সবসময় করুণাকে গুরুত্ব দিইনি। ইতিহাস জুড়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যেখানে মানুষ অন্যের নিষ্ঠুরতা গ্রহণ করে নিয়েছে বা তাদের নিজস্ব নিষ্ঠুর কাজকে খারিজ করে দিয়েছে।

করুণা একটি শক্তিশালী নীতি যা আমাদের অনেক উপকার করতে পারে, তবে শুধু আমাদের মনকে করুণাময় হতে আদেশ দেওয়াটা কার্যকর হয় না। করুণা কী এবং কী নয় সেটা আমাদের বুঝতে হবে এবং আমরা এটা বিকাশ করার মতো একটা বিষয় হিসাবে মূল্য দিতে পারি। করুণার দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে দয়ার সাথে অন্যের প্রতি মনোযোগী ও যত্নশীল মনোভাব গড়ে তোলাটা সহজ হয়।

অন্যের দুঃখ প্রশমনের ইচ্ছাকে করুণা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যদিও অনেকে করুণাকে মানব অস্তিত্বের প্রধান দিক হিসাবে দেখে না, তবে গবেষণা করুণার জৈবিক মূলকে নির্দেশ করে। সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের জীবিত থাকার জন্য মাতৃ যত্ন প্রয়োজন হয়। এর কারণ হল তারা জন্মের পর নিজের থেকে জীবিত থাকতে পারে না। মানুষ সহ বিভিন্ন প্রজাতির পরার্থবাদী আচরণ একটা পারস্পরিক বন্ধন তৈরী করে যা জীবিত থাকার জন্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয় স্তরেই উন্নতি লাভ করে। সুতরাং বিভিন্ন উপায়ে করুণা হল জীবিত থাকার একটা বিষয়। এটি ব্যাখ্যা করে যে কেন খুব অল্প বয়স থেকেই মানুষের মধ্যে দয়ার প্রতি দৃঢ় অগ্রাধিকার থাকে এবং আমরা কেন করুণার প্রতি এত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাই, এমনকি শারীরবৃত্তিয় স্তরেও।

অন্যান্য নৈতিক স্বভাবের প্রশংসা ও বিকাশ করা

করুণাকে বাদ দিয়ে আমরা কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা, সন্তুষ্টি, নম্রতা, ধৈর্য সহ আরও অনেক কিছু সহজাত স্বভাব গড়ে তুলতে পারি। এই সমস্ত নৈতিক স্বভাবের মধ্যে সাধারণ বিষয়টা হচ্ছে সেগুলি হল আধ্যাত্মিক সম্পদ অর্থাৎ ভৌতিক সম্পদ বা কৃতিত্বের চেয়ে তারা আমাদের জীবনে বেশী উপকার এবং সুখ নিয়ে আসে। মূল্যবান মানুষ হওয়া এবং সেটা কীভাবে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলে, তার প্রশংসা করাটা হল এই ধারণার বিপরীত যে আত্ম-উন্নতি এবং সম্পত্তির অধিগ্রহণ সেটা হল দীর্ঘমেয়াদী সন্তুষ্টি এবং সুখের চাবিকাঠি। এই আভ্যন্তরীণ গুণাবলী যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। গবেষণা দেখায় যে একটা নির্দিষ্ট স্তরের ভৌতিক হিতের পরেও জীবন সন্তুষ্টিকে ত্যাগ করে দেয়। তবে শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যেও কৃতজ্ঞতা এবং সুখের মধ্যে একটা দৃঢ় সংযোগ থেকে যায়। কৃতজ্ঞতা শুধু জীবনে অধিক সন্তুষ্টির দিকে পরিচালিত করে না, এটা ছাড়াও সামাজিক মাধ্যম বিজ্ঞাপন এবং দুরদর্শনের মাধ্যমে প্রদত্ত ভৌতিকবাদী বা বস্তুবাদী বার্তাগুলির একটি শক্তিশালী প্রতিষেধকও হতে পারে।

অন্যান্য লোকজন আমাদের অনেক ভাবে উপকার করেন। ঐ উপকারগুলি যা আমরা অনুভব করি সেগুলি সবই যে ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয় তার কোন মানে নেই। অন্যরা যেটা করেনি আমরা তারও প্রশংসা করতে পারি, যেমন- তারা চুরি করেনি, ক্ষতি করেনি বা অপমান করেনি। আরও উন্নত স্তরে, অন্যরা যখন ক্ষতিকারক ভাবে কর্ম করে তখন আমরা যে উপকার লাভ করি তার উপলব্ধি করাও আমরা শিখতে পারি। আমরা এমন ব্যক্তিদের উদাহরণের বিষয়েও অধ্যয়ন করতে পারি যারা দুঃখ ভোগ করে এবং চরম কষ্টের সাথে জীবনযাপন করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগুলিকে পরিবর্তন করতে এবং আরও সুখী ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারিচালিত করে। যদিও অন্যের ভুল আচরণকে আমাদের ক্ষমা করা উচিত নয়, তবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের এই ক্ষমতা ক্রোধ, বিরক্তি এবং বিদ্বেষকে ত্যাগ করার একটা শক্তিশালী উপায়। অন্যরা যেভাবে আমাদের উপকার করে সেগুলির সম্পর্কে আমাদের অন্বেষণের ফলস্বরূপ একটা অকৃত্রিম এবং কৃতজ্ঞতার চিরস্থায়ী বোধ গড়ে উঠতে পারে। ফলে এটা একটা শক্তিশালী বন্ধন এবং অন্যদের সাথে সংযোগ হিসাবে কাজ করে।

আমরা যখন স্ব-কেন্দ্রিক মনোভাবের অসুবিধাগুলি অনুধাবন করি এবং কীভাবে আমাদের নিজের সুখ ও হিত অন্যদের দ্বারা দেখানো অসংখ্য দয়ার উপর নির্ভর করে সেটা যখন ভাবব তখন আমরা স্বাভাবিক ভাবেই অনুভব করব।

এখানে আমাদের সহানুভূতিও গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটা অন্যের সুখ ও দুঃখ সহ অভিজ্ঞতা এবং সংবেদনশীল হওয়ার ক্ষমতাকে বোঝায়। আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষজন স্বয়ংক্রিয় ভাবে আমাদের বন্ধু ও প্রিয়জনের সাথে সহানুভূতি বোধ করে, তবে এটাকে বিস্তৃত এবং নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য প্রসারিত করা সম্ভব। আমরা যখন মৌলিক ভাবে ভাগ করা আমাদের সাদৃশ্যের জ্ঞানের সাথে সহানুভূতি সংযুক্ত করি তখন একটি আসল সহানুভূতির উদয় হতে পারে যা পক্ষপাতের কারণে কম সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদের সাথে সহানুভূতি পূর্বক সম্বন্ধ-স্থাপন করা বলতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করাকে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, “এই ব্যক্তিটি স্বার্থপর,” এই কথাটি না বলার পরিবর্তে আমরা বলতে পারি, “তার আচরণ স্বার্থপর রূপে বিবেচনা করা যেতে পারে।” আমাদের এই স্বভাব ঐ ব্যক্তিকে স্থায়ী ভাবে স্বার্থপর হিসাবে না দেখতে সহায়তা করে এবং নিঃস্বার্থ হওয়ার সময় আমাদেরকে তার দিকে নজর দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত হতে দেয়। এমনকি আমাদের আচরণ যদি সহানুভূতি এবং করুণার উপর আধারিত থাকে তাহলে কখন-কখন আমাদের ক্রিয়াকলাপগুলি প্রকৃতপক্ষে বিপরীত প্রমাণও করে। হতে পারে তখন আমাদের উদ্দেশ্যটা ভালো থাকে তাসত্ত্বেও অজান্তেই নিজের এবং অন্যদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারি। কোন দক্ষতা মূর্ত এবং স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভালোভাবে শিখে আমরা সেটাকে সক্রিয়ভাবে অনুশীলন করতে পারি। এরকম চারটি দিক রয়েছে যার বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করতে পারিঃ

  • সতেজ বা জোরালো শ্রবণ
  • দক্ষ যোগাযোগ
  • অন্যদের সাহায্য করা
  • দ্বন্দ্ব রূপান্তর

সতেজ বা জোরালো শ্রবণ

সতেজ শ্রবণ করার অর্থ হল উন্মুক্ত মন দিয়ে অন্যের কথা শোনা এবং আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়ার কারনে বন্ধ না হয়ে যাওয়া। এটা অন্য ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রশংসার উপর আধারিত। এমনকি যদি তাদের মতামত আমাদের নিজস্ব মতামত থেকে আলাদাও হয় তাহলেও শ্রবণ করা উচিত। আমরা “গভীর শ্রবণ” ব্যায়ামের মাধ্যমে সতেজ শ্রবণ অনুশীলন করতে পারি। সেখানে আমরা একেবারে কয়েক মিনিটের জন্য কোন রকমের মন্তব্য বা রায় ছাড়াই অপরকে শ্রবণ করার চেষ্টা করি, অথবা আমরা এমন লোকজনদের দেখতে বা শুনতে পারি যাদের সাথে আমরা সম্মতি নাও জানাতে পারি কিন্তু পরে আমরা আবেগপ্রবণ ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে তারা যা বলে সেটা শব্দান্তরে প্রকাশ করতে বা পুনরায় বিবরণ দিতে বিরতি দিই।

সতেজ শ্রবণ করা মানে এমনভাবে শ্রবণ করা উচিত যা শুধু পৃষ্ঠস্তরের সামগ্রীতেই মনোযোগ দেওয়াকে বোঝায় না বরং অন্তর্নিহিত চাহিদা এবং আকাঙ্খাগুলিকে বোঝায় যেটা লোকে যা বলে তার বিষয়বস্তু বোঝার জন্য প্রসঙ্গ প্রদান করতে পারে।

দক্ষ যোগাযোগ

শ্রবণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তবে আমরা যা বলতে চাই সেটা আমাদের এমনভাবে বোঝাতে সক্ষম হতে হবে যা বিবেচ্য, ফলদায়ক এবং নিজের ও অন্যদের কাছে ক্ষমতানীয় “যোগাযোগের ক্ষমতায়ন” ধারণাটি কেবল আমাদের নিজেদের সম্মানজনক ভাবে ও স্পষ্টভাবে কথা বলার ক্ষমতাকে বোঝায় না, বরং অন্যদেরকেও বোঝায় যারা তাদের জন্য কথা বলতে সক্ষম নাও হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে শাস্ত্রার্থ করতে পছন্দ করতে পারি এবং আমরা সাধারণতঃ যে পক্ষের সাথে একমত না হই সেই পক্ষকে বেছে নিতে পারি। যেহেতু মানুষ হিসাবে আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা আছে যে যারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করে আমরা তাদের মতকে অবৈধ মনে করি এবং অমানুষে পরিণত করি, সুতরাং এই ধরণের অনুশীলনগুলি নম্রতা, বৌদ্ধিক কৌতুহল এবং সাধারণ মানবিকতাবোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

অন্যদের সাহায্য করা

শ্রবণ করা এবং যোগাযোগ করাটা হল একটা মৌলিক বিষয়। অন্যকে সাহায্য করার অসংখ্য উপায় আছে। তবে অন্যকে সাহায্য করাটা অন্যের প্রয়োজনের সাথে সর্বদা যথাযথ হওয়া উচিত এবং এটা আমাদের নিজস্ব সামর্থ্যের সাথেও সমানুপাতিক থাকা উচিত। সেবা পরিষেবা থেকে স্বেচ্ছাসেবী পর্যন্ত “দয়ার ক্ষেত্রে এলোমেলো আচরণ” সম্পর্কিত গবেষণা দেখায় যে সাহায্য প্রাপ্ত করার চেয়ে সাহায্য প্রদান করলে তাতে আমাদের নিজেদের হিতের ক্ষেত্রে বেশী অবদান থাকে।

আমরা অন্যকে সাহায্য করার প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করার জন্য সময় নিতে পারি। আমরা ভাবতে পারি, এটা করার সময় আমরা কেমন অনুভব করি, এর থেকে আমরা কী শিখি, কীভাবে আমরা এটাকে উন্নত করতে পারি এবং আমরা যাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি তাদের উপর এর কী প্রভাব পড়ে। সর্বশেষে, আমরা অন্বেষণ করতে পারি যে কী ধরণের সাহায্য অন্যের দীর্ঘমেয়াদী সাহায্যের জন্য প্রয়োজন যেটা অতিমাত্রায় প্রদর্শিত হয়।

দ্বন্দ্ব রূপান্তর

আমরা অনিবার্য ভাবে সারাজীবন জুড়ে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হই। দ্বন্দ্ব জিনিসটা নিজের থেকে অগত্যা খারাপ নয়। কিন্তু নিজের এবং অপরের জন্য দ্বন্দ্ব পরিচালনা করতে শেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। দ্বন্দ্ব সমাধান করাটা পরিস্থিতি এবং সম্পর্কের পরিবর্তনের দিকে যাওয়ার একমাত্র অংশ যা উভয়ের পক্ষে হিতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এরজন্য আমাদের দ্বন্দ্বের প্রতি গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে আর সক্ষম হতে হবে সহযোগীতা, পুনর্মিলন ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের সুবিধা জোগানোর ক্ষেত্রে।

আভ্যন্তরীণ শান্তি বাহ্যিক শান্তির ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। তেমনই আভ্যন্তরীণ পুনর্মিলনের ফলে বাহ্যিক পুনর্মিলনও হতে পারে। আমাদের আভ্যন্তরীণ বিশ্বের সাথে কাজ করা সফল দ্বন্দ্ব রূপান্তরের সম্ভাবনা সর্বাধিক করে তোলে। নম্রতা, সহানুভূতি, করুণা, ক্ষমা, নিরপেক্ষতা এবং আমাদের শেয়ার করা সাধারণ মানবতার উপলব্ধি ছাড়া দ্বন্দ্বের রূপান্তর এবং সমাধান কঠিন, যদি অসম্ভব নাও হয়। এই দক্ষতাগুলি যেখানে উপস্থিত থাকে সেখানে দ্বন্দ্বের সমাধানের দায়িত্বের সাথে যুক্ত সব পক্ষের একটি গভীর এবং সত্যি রূপান্তরকারী অভিজ্ঞতা হতে পারে।

সারাংশ

এই পাঠ্যক্রমের প্রথম অংশে নিজেকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা আবেগপ্রবণ সাক্ষরতার বিকাশ করি। এর দ্বিতীয় অংশে আমরা অপরের সাথে যুক্ত থাকার জন্য এই বোধগম্যতাকে প্রয়োগ করি। এখানে অপরের সাথে যুক্ত থাকা বলতে আমাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং পরিচিতদের বোঝায় যাদের সাথে আমরা মুখোমুখি হই। সম্পর্কের দক্ষতার বিকাশটি দয়া ও করুণার নীতির সাথে আবদ্ধ। একবার যদি আমরা এগুলির পর্যাপ্ত অনুশীলন করি তাহলে সামাজিক দক্ষতা কেবল কৌশলের একটি সেটে সীমাবদ্ধ থেকে যায় না বরং সেগুলি অন্যদের প্রতি আমাদের উপলব্ধি এবং উদ্বেগের একটি প্রাকৃতিক পরিণতিতে রূপান্তরিত হয়। আমরা যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিজ্ঞতা অর্জন করি এবং যখন ইতিবাচক কৌশলগুলি গ্রহণ ও অনুশীলন করি তখন আমাদের সম্পর্ক শুধু আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ হয় না বরং আমরা আরও সুখী এবং পরিপূর্ণ হয়ে উঠি।


আপনি যদি আরও গভীরে যেতে চান তাহলে এসইই লারনিং ফ্রেম ওয়ার্কের (SEE Learning Framework) সম্পূর্ণ সংস্করণটি পড়ুন এবং সেন্টার ফর কনটেমপ্লেটিভ সাইন্স অ্যান্ড কমপ্যাশন বেস্‌ড নৈতিকতার অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে অধ্যয়ন করুন।

Top