শাক্যমুনি বুদ্ধের জীবনী

21:05
পরম্পরার উপর নির্ভর করে বুদ্ধকে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে দেখা যেতে পারে, যিনি নিজের অসাধারণ প্রচেষ্টায় মুক্তি লাভ করেছিলেন। অথবা একজন ইতিমধ্যে বোধি লাভ করা সত্ত্ব, যিনি ২৫০০ বছর আগে বোধি লাভ করার পথ দেখানোর জন্য কার্যকলাপ (লীলা) প্রকাশ করেছিলেন। এখানে আমরা বুদ্ধের জীবনীকে লক্ষ্য ক’রে দেখি যে, আমাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক পথের জন্য আমরা কী ধরণের অনুপ্রেরণা অর্জন করতে পারি।

পারম্পারিক তিথি অনুযায়ী শাক্যমুনি বুদ্ধ, যিনি গৌতম বুদ্ধ নামেও পরিচিত, যিনি উত্তর ভারতে ৫৬৬ থেকে ৪৮৫ সাল অবধি বসবাস করেছিলেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ উৎসে তাঁর জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিবরণ রয়েছে এবং পাশাপাশি আরও বিশদ সময় ধীরে-ধীরে প্রদর্শিত হয়। বুদ্ধের মৃত্যুর মাত্র তিন শতাব্দী পরে প্রথম বৌদ্ধ সাহিত্যের রচনা লেখা হয়েছিল, যা দেখে এই বিবরণের অনেকের যথার্থতা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও, অন্যদের তুলনায় পরবর্তী সময়ে লিখিত আকারে নির্দিষ্ট বিশদ প্রকাশের কারণে তাদের বৈধতা গণ্য না করার পর্যাপ্ত কারণ দেখা যায় না, কারণ অনেকে মৌখিক আকারে অতিক্রম করে যেতে পারতেন।

সাধরণতঃ বুদ্ধসহ মহান বৌদ্ধ আচার্যদের পারম্পারিক জীবনীগুলি শুধু ঐতিহাসিক রেকর্ডের জন্য নয়, বরং শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে সংকলন করা হয়েছিল। আর সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় যে, জীবনীগুলি এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে বৌদ্ধ অনুগামীদের মুক্তি ও বোধি লাভের জন্য আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে পথ প্রদর্শন করা যায় এবং অনুপ্রাণিত করা যায়। বুদ্ধের জীবনী থেকে লাভ অর্জন করার জন্য আমাদের এটিকে ঐ প্রসঙ্গে বুঝতে হবে এবং এর থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তার বিশ্লেষণ করতে হবে।

বুদ্ধের জীবনের উৎস

বুদ্ধের জীবনের প্রাথমিকতম উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে, থেরবাদ শাস্ত্রের মধ্যে মজ্ঝিম নিকায়ে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি পালি সুত্ত এবং বিভিন্ন হীনযান নিকায়ে অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুদের নিয়ম সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বিনয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলির প্রত্যেকটিই বুদ্ধের জীবন বৃত্তান্তের কিছু অংশ প্রস্তুত করে।

প্রথম বিস্তৃত বিবরণটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে হীনযানের মহাসাংঘিক নিকায়ের “মহাবস্তু” নামক বৌদ্ধ কাব্য রচনায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থটি যা ত্রিপিটকের বাইরে ছিল, উদাহরণ স্বরূপ, খুঁটিনাটি যুক্ত করেছিল যে, বুদ্ধ এক রাজপরিবারে এক রাজপুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। “ললিতবিস্তর” নামক এই ধরণের আরও একটি কাব্য রচনা হীনযানের সর্বাস্তিবাদ নিকায়ের সাহিত্যে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের মহাযান সংস্করণগুলি পূর্ববর্তী সংস্করণটিকে অনুকরণ করা এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, সেগুলির ভিত্তিতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে যে, শাক্যমুনি বহু কল্প পূর্বে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন। যুবরাজ সিদ্ধার্থ রূপে উদ্ভূত হওয়াটা অপরকে বোধি লাভ করতে পথ প্রদর্শন করার জন্য নির্দেশ মাত্র ছিল।

শেষ পর্যন্ত এদের মধ্যে কয়েকটি জীবনী ত্রিপিটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রথম শতাব্দীতে কবি অশ্বঘোষ দ্বারা রচিত “বুদ্ধচরিত” সবচেয়ে বিখ্যাত। অন্যান্য সংস্করণ গুলি পরে তন্ত্রেও দেখা গিয়েছে, যেমনকি চক্রসম্বর সাহিত্যে। সেখানে আমরা বিবরণটি পেয়েছি যে, শাক্যমুনি যখন প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের উপর উপদেশ দিচ্ছেন, বুদ্ধ একই সাথে বজ্রধর রূপে উদ্ভূত হয়েছেন এবং তন্ত্রের উপর উপদেশ দিয়েছেন।

প্রতিটি বিবরণ থেকে আমরা কিছু শিখতে পারি এবং অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি। যাইহোক, আসুন আমরা প্রাথমিক ভাবে সংস্করণগুলি দেখি যা ঐতিহাসিক বুদ্ধকে চিত্রিত করে।

বুদ্ধের জন্ম, প্রারম্ভিক জীবন এবং ত্যাগ

প্রথম দিকের বিবরণ অনুযায়ী শাক্যমুনি বর্তমান ভারত ও নেপালের সীমান্তবর্তীতে অবস্থিত শাক্য রাজ্যে, যার রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু, এক অভিজাত, ধনী, যোদ্ধা বা ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে শাক্যমুনি একটা রাজপরিবারে রাজপুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর রাজপুত্রীয় জন্ম ও সিদ্ধার্থ নামের কোনও উল্লেখ নেই। এটা পরে দেখতে পাওয়া যায়। তার পিতা ছিলেন শুদ্ধোদন, তবে মায়ের নাম মায়াদেবী কেবল পরবর্তী সংস্করণগুলিতেই প্রকাশ পেয়েছে, যেমনটি পাওয়া যায় স্বপ্নে মায়াদেবীর দক্ষিণ দিক দিয়ে ছয়টি দাঁত যুক্ত দৈব হাতির প্রবেশের পর তার মায়ের অলৌকিক গর্ভধারণের বিবরণ এবং ঋষি অসিতের ভবিষ্যবাণী যে, তিনি হয় একজন মহান রাজা বা একজন মহান ঋষি হয়ে উঠবেন। এর পরে কপিলাবস্তু থেকে কিছু দূরে অবস্থিত লুম্বিনীবনে মায়ের দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে বুদ্ধের শুদ্ধ জন্মের বিবরণও পাওয়া যায়। সেখানে তিনি জন্মের পর সাতবার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “আমি এসেছি”। পাশাপাশি তাঁর বাল্যাবস্থাতেই মায়ের দেহাবসান।

একজন নবযুবকের মতো বুদ্ধ আনন্দে জীবন-যাপন করতে লাগলেন। যশোধরা নামক একজন মহিলার সাথে তাঁর বিবাহ হল এবং তাদের একত্রে রাহুল নামে একটা পুত্র হয়। ২৯ বছর বয়সে বুদ্ধ তাঁর পারিবারিক জীবন এবং রাজপরিবার ত্যাগ করেন এবং একজন পরিব্রাজক আধ্যাত্মিক অন্বেষী হয়ে গেলেন।

তার সমাজ এবং সময়ের প্রসঙ্গের মধ্যে বুদ্ধের প্রব্রজ্যা গ্রহণের দিকে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধ যখন আধ্যাত্মিক অন্বেষী হওয়ার জন্য চলে গেলেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে কঠিন এবং দারিদ্রের জীবনে ত্যাগ করে চলে যান নি। তাদের অবশ্যই ধনী ও বর্ধিত পরিবার দ্বারা যত্ন নেওয়া হতো। বুদ্ধও ক্ষত্রিয় বংশের একজন সদস্য ছিলেন অর্থাৎ তাকে অবশ্যই একদিন যুদ্ধে নামার জন্য তার পরিবারকে ছেড়ে যেতে হতো, যেমনটি একজন মানুষের স্বীকৃত হয়েছিল।

বাহ্যিক শত্রুদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করা যেতে পারে, তবে আসল যুদ্ধটা হ’ল আমাদের আভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং বুদ্ধ এই যুদ্ধটা করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বুদ্ধ দ্বারা উক্ত উদ্দেশ্যের জন্য তাঁর পরিবারকে ত্যাগ করাটা এই বোঝায় যে, আধ্যাত্মিক অন্বেষীর দায়িত্ব তাঁর নিজের সম্পূর্ণ জীবনকে সাধনায় নিয়োজিত করা। আধুনিক বিশ্বে যদি আমরা আমাদের পরিবারকে ত্যাগ ক’রে ভিক্ষু হয়ে যেতাম, তাহলে আমাদের নিশ্চিত করতে হতো যে, তাদের ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া হয়। এর অর্থ কেবল আমাদের অংশীদার এবং সন্তানরা নয়, বরং আমাদের বৃদ্ধ মা-বাবাকেও বোঝায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসাবে, আমরা আমাদের পরিবার ত্যাগ করি বা না করি, আমাদের দায়িত্ব হ’ল- আনন্দের প্রতি আসক্তিকে পরাভূত ক’রে আমাদের দুঃখকে কম করা, যেমনটা বুদ্ধ করেছিলেন।

বুদ্ধ জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, পুনর্জন্ম, বিষন্নতা এবং বিভ্রান্তির স্বভাবকে বোঝার মাধ্যমে দুঃখকে পরাভূত করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী গল্পগুলিতে, বুদ্ধকে তাঁর রথচালক ছন্ন (ছন্দক) দ্বারা প্রাসাদ ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয়। শহরে, বুদ্ধ অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং মৃত ব্যক্তিদের পাশাপাশি তপস্বীদের দেখতে পেয়েছিলেন, যার প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা ছন্ন দিয়েছিলেন। এইভাবে বুদ্ধ দুঃখকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, যা প্রত্যেককে ভোগ করতে হয় এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা করার চেষ্টা করতে হয়েছিল।

এই পর্ব যেখানে বুদ্ধ তাঁর রথচালকের কাছ থেকে আধ্যাত্মিক পথে সহযোগিতা পেয়েছিলেন এবং এটা অর্জুনকে কৃষ্ণ দ্বারা তার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যোদ্ধা হিসাবে তার কর্তব্য সম্পর্কে ভাগবত গীতার বিবরণ সমান্তরাল। বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের আরামদায়ক জীবনের পাঁচিল অতিক্রম ক’রে সত্যকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করার গভীরতর তাৎপর্য দেখতে পাই। রথটিকে মনের যান রূপে চিত্রিত ক’রে রথচালকের কথারূপী চালনশক্তি দ্বারা মুক্তির দিকে অর্থাৎ বাস্তবতার খোঁজের জন্য নিয়ে যেতে দেখা যায়।

বুদ্ধের অধ্যয়ন এবং বোধি লাভ

ব্রহ্মচরিত, পরিব্রাজক ও আধ্যাত্মিক অন্বেষী হিসাবে বুদ্ধ দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে মানসিক স্থিতিশীলতা এবং অরূপী সমাপত্তি লাভ করার পদ্ধতি গুলি অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি পূর্ণ সমাধির গভীর অবস্থার সর্বোচ্চ স্তর লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে তিনি আর স্থুল দুঃখ, এমনকি সাধারণ পার্থিব সুখ অনুভব করেননি, তবে তিনি তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। তিনি দেখলেন যে, এই অবস্থাগুলি তাকে দূষিত অনুভূতি থেকে কেবল অস্থায়ী স্বস্তি প্রদান করেছে, স্থায়ী স্বস্তি নয়; তারা নিশ্চয়ই গভীরতর, সার্বজনীন দুঃখগুলি বিনাশ করেনি, যেগুলি তিনি বিনাশ করতে চেয়েছিলেন। পাঁচ জন সহচরদের সাথে, তিনি তখন কঠোর তপস্যা করলেন কিন্তু সেটাও অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের (সংসার) সাথে যুক্ত গভীরতর সমস্যাগুলি নাশ করতে পারল না। কেবল পরবর্তী বিবরণীতেই দেখা যায় যে, বুদ্ধ নৈরঞ্জনা নদীর তীরে কুমারী সুজাতা দ্বারা অর্পিত এক বাটি ক্ষীর গ্রহণের সাথে ছয় বছরের উপবাস ভঙ্গ করেন। আমাদের জন্য বুদ্ধের উদাহরণ এই বোঝায় যে, কেবল পূর্ণ শান্ত বা ধ্যানের উচ্চ অবস্থায় পৌঁছে গেলে আমাদের তাতে সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়, বরং ড্রাগনের মতো কৃত্রিম উপায়কে ছেড়ে দেওয়া উচিত। গভীর সমাধিতে গুটিয়ে নেওয়া, চরম অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে নির্যাতন বা শাস্তি দেওয়াটাও এর সমাধান নয়। আমাদের অবশ্যই মুক্তি ও বোধি লাভের সমস্ত পথে যেতে হবে এবং আমাদের উক্ত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক উপায়ের প্রতি কখনই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়।

বুদ্ধ তপস্যা প্রত্যাখ্যান করার পর, ভয় কাটিয়ে ওঠার জন্য একা জঙ্গলে ধ্যান করতে চলে গিয়েছিলেন। সমস্ত ভয়ের মূল হ’ল- অসম্ভব ভাবে বিদ্যমান “আমি”- গ্রহ বা ধারণা এবং তার চেয়েও শক্তিশালী বিষয়টা হ’ল- আত্ম-লালিত মনোভাবকে উপলব্ধি করা, যা আমাদের আনন্দ এবং বিনোদনের জন্য বাধ্যতামূলক খোঁজকে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং দশম শতাব্দীর ভারতীয় আচার্য ধর্মরক্ষিত “তীক্ষ্ণাস্ত্রচক্র”-এ যে সমস্ত বোধিসত্ত্বরা কাম, ক্রোধ এবং মোহ রূপী বিষাক্ত আবেগ গুলিকে ব্যবহার করেন এবং রূপান্তরিত করেন তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে বিষাক্ত বৃক্ষের জঙ্গলে বিচরিত ময়ূরের চিত্র ব্যবহার করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য হ’ল- তাদের আত্ম-লালিত মনোভাব এবং অসম্ভব “আমি”- গ্রহকে পরাভূত করা।

অনেক ধ্যানের পর, ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধ সম্বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। পরবর্তী বিবরণ গুলি এই বিশদটি প্রস্তুত করে যে, মার নামক ঈর্ষান্বিত দেবতাদের সাথে সাফল্যের সাথে লড়াই করার পর তিনি বর্তমান বুদ্ধগয়ায় অবস্থিত বোধি বৃক্ষের নীচে বোধি লাভ করেছিলেন। উক্ত মার বুদ্ধের ধ্যানে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আরও ভয়ঙ্কর এবং প্ররোচিত রূপ আবির্ভূত করেছিল।

প্রথম দিকের বিবরণীতে, বুদ্ধ তিন প্রকারের জ্ঞান অর্জন ক’রে পূর্ণ বোধি লাভ করেছিলেন, যথা- তাঁর নিজের সমস্ত অতীত জীবনের জ্ঞান, অন্য সকলের কর্ম ও পুনর্জন্মের জ্ঞান এবং চার আর্যসত্যের জ্ঞান। পরবর্তী বিবরণগুলি ব্যাখ্যা করে যে, বোধি লাভের সাথে তিনি সর্বজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।

উপদেশ এবং বৌদ্ধ সংঘের প্রতিষ্ঠা

বোধিলাভের পর বুদ্ধ অন্যদের এটা (বোধি) লাভ করার উপায় সম্পর্কে ধর্মোপদেশ দিতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন, কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর ধর্মোপদেশকে কেউ বুঝতে সক্ষম হবে না। তবে ভারতীয় দেবতা ব্রহ্মা, জগতের স্রষ্টা এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে ধর্মোপদেশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ব্রহ্মা অনুরোধ করে তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি যদি উপদেশ না দেন তাহলে জগতের অসীম ক্ষতি হবে এবং শুধু কয়েকজন মানুষই তাঁর বাণী বুঝতে সক্ষম হবে।

এই বিবরণটি একটি ব্যঙ্গাত্মক উপাদান হতে পারে, যা বুদ্ধের উপদেশকে শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত দেয়। এটা তাঁর সময়ের পারম্পারিক ভারতীয় আধ্যাত্মিক পরম্পরা দ্বারা পদ্ধতিগুলি অতিক্রম করেছিল। এমনকি যদি সর্বোচ্চ দেবতারাও স্বীকার করে নেয় যে, বুদ্ধের উপদেশগুলি জগতের প্রয়োজন, কারণ তারা স্বয়ং প্রত্যেক প্রাণীর দুঃখ স্থায়ী ভাবে সমাপ্ত করার জন্য পদ্ধতিগুলি অভাব বোধ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে এই উপদেশগুলি কতটুকু প্রয়োজন তার সম্পর্কে কী বলা দরকার। তদুপরি বৌদ্ধ চিত্রগুলিতে ব্রহ্মা দাম্ভিক অহংকারকে প্রতিনিধিত্ব করে; তিনি সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, এই ভুল বিশ্বাসটি একটি বিভ্রান্তির রূপকে চিহ্নিত করে যে, একটা অসম্ভব রূপে অস্তিমান “আমি” বিদ্যমান আছে, এবং জীবনের প্রত্যেকটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ধরণের বিশ্বাস অবশ্যম্ভাবী রূপে হতাশা এবং দুঃখ নিয়ে আসে। আমরা আসলে কীভাবে জীবিত আছি সে সম্পর্কে শুধু বুদ্ধের উপদেশগুলিই দুঃখ সত্যের নিরোধ এবং তার সমুদয় সত্যের উপায় প্রদান করে।

ব্রহ্মা এবং ইন্দ্রের অনুরোধ গ্রহণ ক’রে বুদ্ধ সারনাথে প্রস্থান করেছিলেন এবং মৃগদাবে তিনি তাঁর পাঁচ প্রাক্তন সহচরকে চার আর্যসত্যের উপর উপদেশ দিয়েছিলেন। বৌদ্ধ চিত্রে মৃগ সৌম্যর প্রতীক চিহ্নিত করে এবং এইভাবে বুদ্ধ কামপিন্ডপাতান্ত (ভোগসুখ শ্রেয়ঃ বিধান) এবং ক্লান্তপাতান্ত (কঠোর তপশ্চর্যা) নামক দুটি অন্ত রহিত সৌম্য উপায় সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন।

শীঘ্রই বারাণসীর নিকট থেকে বেশ কয়েকজন যুবক, যারা কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করছিল, তারা বুদ্ধের সাথে যোগ দিল। তাদের মাতা-পিতারা গৃহস্থ শিষ্য হয়ে গেল এবং দান-ভিক্ষা দ্বারা দলটিকে সমর্থন করতে শুরু করল। যে কোনও সদস্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত এবং যোগ্য হয়ে গিয়েছিল। তাকে অন্যদেরকে উপদেশ দেওয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। এইভাবে বুদ্ধের ভিক্ষু গোষ্ঠী অনুগামীরা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং শীঘ্রই তারা বিভিন্ন স্থানে পৃথক-পৃথক বসতি স্থাপন করলেন এবং ভিক্ষু-সংঘ গঠন করলেন।

বুদ্ধ ব্যবহারিক নির্দেশিকা অনুসারে এই ভিক্ষু সংঘগুলিকে গঠন করেছিলেন। ভিক্ষুরা, যদি আমরা এই শব্দটি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহার করতে পারি, প্রার্থীদের সংঘ গুলিতে যোগদানের স্বীকৃতি দিতে পারত, তবে ধর্ম নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে তাদের কিছু বিধিনিষেধ অনুসরণ করতে হয়েছিল। সুতরাং এই সময় বুদ্ধ অপরাধীদের রাজসেবায় কর্মরত সেনাবাহিনী, দাসত্ব থেকে মুক্তি না পাওয়া দাসদের এবং কুষ্ঠরোগের মতো সংক্রামক রোগীদের ভিক্ষু সংঘে যোগদানের অনুমতি দেননি। এছাড়াও ২০ বছরের কম বয়সী কাউকে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বুদ্ধ সমস্যা এড়াতে চেয়েছিলেন এবং জনগণের মধ্যে সংঘের প্রতি সম্মান আর ধর্ম-উপদেশকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন। এটা দেখায় যে, বুদ্ধের অনুগামী হিসাবে আমাদের স্থানীয় রীতি গুলির প্রতি সশ্রদ্ধ হওয়া এবং শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করা প্রয়োজন যাতে মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখে এবং বিনিময়ে এর প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়। 

শীঘ্রই বুদ্ধ মগধে ফিরে যান। মগধ ছিল সেই রাজ্যের রাজধানী যেখানে বুদ্ধগয়া অবস্থিত। তাঁকে রাজধানী নগর রাজগৃহে (আধুনিক রাজগীর) রাজা বিম্বিসার দ্বারা আমন্ত্রিত করা হয়েছিল। তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক ও শিষ্য হয়েছিলেন। সেখানে শারিপুত্র এবং মোদ্গল্যায়নপুত্রও বুদ্ধের ক্রমবর্ধনমান সংঘে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর নিকটতম শিষ্য হয়েছিলেন।

বোধি লাভের এক বছরের মধ্যেই বুদ্ধ তাঁর বাড়ি কপিলাবস্তু ফিরে যান। সেখানে তাঁর পুত্র রাহুল সংঘে যোগ দেন। বুদ্ধের অর্ধ ভাই সুদর্শন নন্দ ইতিমধ্যে গৃহত্যাগ ক’রে সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন যে, বংশ-পরম্পরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তাই তিনি বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে কোনো পুত্রকে ভিক্ষু সংঘে যোগ দিতে হলে তার মাতা-পিতার সম্মতি থাকতে হবে। বুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে একমত হলেন। এই বিবৃতির মূল বিষয়টি এই নয় যে, এটা বুদ্ধের পক্ষে তাঁর পিতার প্রতি নিষ্ঠুরতা হিসাবে দেখা যেতে পারে, বরং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি, বিশেষতঃ আমাদের পরিবারগুলির মধ্যে অসুস্থতা সৃষ্টি না করার গুরুত্ব দেখার জন্য।

বুদ্ধের পরিবারের সাথে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার পরবর্তী বিশদ বিবরণ হ’ল- তাঁর “ত্রায়ত্রিংশ” নামক স্বর্গে ভ্রমণ করার জন্য বহুমুখী শক্তির প্রয়োগ করা, যা কিছু উৎস অনুযায়ী “তুষিত” নামক স্বর্গ উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত স্বর্গে তাঁর মা পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে ধর্ম-উপদেশ দেওয়ার জন্য তিনি সেখানে ভ্রমণ করেছিলেন। এটা মাতৃ স্নেহের সদ্ব্যবহারের প্রশংসা করা এবং মাতৃঋণ পরিশোধের গুরুত্ব নির্দেশ করে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের বৃদ্ধি

বুদ্ধের ভিক্ষুদের প্রাথমিক সংঘ গুলি ছোট ছিল এবং তাতে ২০ জনের বেশী পুরুষ ছিল না। প্রত্যেকটি সংঘ স্বায়ত্তশাসিত ছিল এবং ভিক্ষুদের জন্য নির্ধারিত সীমানা অনুসরণ করে ভিক্ষা করতেন। প্রত্যেকটি সংঘের কাজ-কর্ম ও সিদ্ধান্ত গুলি কোনও মতবিরোধ এড়াতে তাঁর সদস্যদের মধ্যে ঐক্যমত ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এবং কোনও ব্যক্তির একক কর্তৃত্ব হিসাবে গ্রহণ করা হতো না। বুদ্ধ তাদের ধর্ম-উপদেশকে কর্তৃত্ব হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রয়োজনবশতঃ ভিক্ষুদের নিয়ম-শৃঙ্খলা (শীল) পরিবর্তন করা যেতে পারে, তবে যে কোনও পরিবর্তন সামগ্রিক ভাবে সংঘের ঐক্যমতের ভিত্তিতে করতে হয়েছিল।

রাজা বিম্বিসার পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, বুদ্ধ অন্যান্য আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী, যেমন- জৈনদের, যারা ত্রিমাসিক সম্মেলন করেছিলেন, তাদের কিছু রীতি-নীতি গ্রহণ করতে পারেন। এই রীতি অনুযায়ী আধ্যাত্মিক সংঘের সদস্যরা চন্দ্রমার প্রতিটি ত্রৈমাসিক পর্বের শুরুতে উপদেশগুলি আলোচনা করার জন্য একত্রিত হতো। বুদ্ধ একমত হয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, কালের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে তিনি পরামর্শের জন্য উন্মুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক সংঘের অনেক দিক আর তাঁর উপদেশের পরিকাঠামো তৈরির কাজ শেষ করেছিলেন জৈনদের পরে। জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর বুদ্ধের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে জীবিত ছিলেন।

শারিপুত্রও বুদ্ধকে ভিক্ষুদের নিয়ম-শৃঙ্খলার (শীল) একটি কোডের জন্য বিধি তৈরী করতে বলেছিলেন। বুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কোনও নির্দিষ্ট সমস্যা উৎপন্ন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভাল। এর কারণ হ’ল তখন তারা কোনও অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য সংবর (শপথ) প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই নীতিটি স্বাভাবিক ভাবে ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ যারা এগুলি করে তাদের পক্ষে সেগুলি ক্ষতিকারক এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ও নির্দিষ্ট কারণে কিছু লোকের জন্য নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ কর্ম, উভয়কেই অনুসরণ করা হয়েছিল। সুতরাং শৃঙ্খলার বিধিগুলি (বিনয়) বাস্তববাদী এবং প্রণয়নমূলক তদর্থক ছিল; পাশাপাশি বুদ্ধের প্রধান বিবেচনা গুলির সমস্যা দূর করার জন্য নির্ধারিত ছিল, অপরাধের কারণ হওয়ার জন্য নয়।

শৃঙ্খলার নিয়মের ভিত্তিতে বুদ্ধ তখন ত্রৈমাসিক ভিক্ষুর সমাবেশে সংবর (শপথ) পাঠের সূচনা করেছিলেন। সেখানে ভিক্ষুরা প্রকাশ্যে স্বীকার করত যদি তারা কোনও নিয়ম ভঙ্গ করে থাকত। সংঘ থেকে বহিষ্কার করাটা সবচেয়ে মারাত্মক লঙ্ঘনের জন্য অনুসরণ করা হয়েছিল, অন্যথা কেবলমাত্র আবেক্ষণের অপমান। পরবর্তী কালে এই সভাগুলি কেবল দ্বিমাসিক ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তারপরে বুদ্ধ তিন মাসের বর্ষাবাস সাধনা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ সময় ভিক্ষুরা এক স্থানে নিবাস করতেন এবং যে কোনও ভ্রমণ ত্যাগ করতেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ফসলের ক্ষতি হওয়া থেকে ভিক্ষুদের রক্ষা করা, কারণ যখন রাস্তা-ঘাট প্লাবিত হয়ে যেত তখন ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হতো। এই পরিণতিই স্থির মঠগুলি প্রতিষ্ঠা করে যেটা ব্যবহারিক ছিল। আবার এই উন্নয়নটি উত্থাপিত গৃহস্থ সম্প্রদায়ের ক্ষতি যাতে না ঘটে তার জন্য এবং তাদের সম্মান অর্জনের জন্যও উত্থিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বর্ষাবাস সাধনা থেকে শুরু ক’রে বুদ্ধ ২৫টি গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছিলেন কৌশল দেশের রাজধানী শ্রাবস্তীর বাইরে জেতবন নামক উপবনে। এখানে অনাথপিন্ডদ্‌ নামক বণিক বুদ্ধ ও তাঁর ভিক্ষুদের জন্য একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন এবং রাজা প্রসেনজিৎ সংঘের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। জেতবনের এই বিহারটি বুদ্ধের জীবনের অনেক বড়-বড় ঘটনার সাক্ষী ছিল এবং সম্ভবতঃ সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ঋদ্ধি বলের প্রতিযোগিতায় তৎকালীন ছয় জন অ-বৌদ্ধ (তৈর্থিক) নিকায়ের নেতাদের পরাজয়।

যদিও আজকাল আমাদের মধ্যে কেউ ঋদ্ধির কৌশল প্রদর্শন করতে সক্ষম হতে পারি না। তাহলেও তাঁর বিরোধীদের পরাজিত করার জন্য যুক্তিবাদীর চেয়ে বুদ্ধের সেগুলি প্রয়োগ করাটা এই বোঝায় যে, যখন অন্যের মন যুক্তির কারণে বন্ধ হয়ে যায় তখন আমাদের বোঝার বৈধতা সম্পর্কে তাদের বোঝানোর সর্বোত্তম উপায় হ’ল কর্ম এবং আচরণের মাধ্যমে আমাদের উপলব্ধির স্তরটি প্রদর্শন করা। ইংরাজীতেও আমাদের কাছে এই ধরণের প্রবাদ বাক্য আছে, “শব্দের চেয়ে ক্রিয়া বেশী জোরে কথা বলে।”

বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘের স্থাপন

পরবর্তীকালে তাঁর উপদেশ জীবনে, বুদ্ধ তাঁর মাসী মহাপ্রজাপতির অনুরোধে বৈশালীতে ভিক্ষুণীদের একটা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমে তিনি এই ধরণের সংঘ স্থাপন করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, এটা সম্ভব হবে যদি ভিক্ষুদের চেয়ে ভিক্ষুণীদের জন্য বেশী সংবর (শীল) নির্ধারণ করেন। এটা নির্ধারণ করার সময় বুদ্ধ এই কথা বলেন নি যে, স্ত্রীরা পুরুষদের চেয়ে বেশী অবিনয়ী বা অননুশাসিত ছিল এবং তার জন্য বেশী সংবর (শপথ) ধারণ ক’রে আরও বেশী বিনয়ী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। বরং তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, কোনও স্ত্রী সংঘ প্রতিষ্ঠা করলে তাঁর উপদেশের দুর্নীতি ও অকাল সমাপ্তি হবে। সর্বোপরি, বুদ্ধ সংঘের প্রতি বড় আকারের অসম্মান এড়াতে চেয়েছিলেন এবং তাই জন্য ভিক্ষুণী সংঘের অনৈতিক আচরণ সন্দেহের উর্ধ্বে থাকা প্রয়োজন।

তবে সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধ নিয়ম (শীল) প্রণয়ন করতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অপ্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হলে কম কিছু বাতিল করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এমন একটি নীতি যা দুটি সত্যের গতিশীল- গভীরতম সত্য এবং তবুও স্থানীয়দের সাথে মিল রেখে সাংবৃতিক সত্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। যদিও গভীরতম সত্যে ভিক্ষুণী সংঘ থাকা মোটেই সমস্যা ছিল না, কিন্তু তৎকালীন সাধারণ মানুষ বৌদ্ধ উপদেশের উপর নজর রাখার জন্য ভিক্ষুণীদের আরও শৃঙ্খলার নিয়ম থাকা প্রয়োজন ছিল। গভীর সত্যের ভিত্তিতে, সমাজ কী বলল বা ভাবল সেটা বিবেচ্য নয়, কিন্তু সাংবৃতির সত্যের আধারে বৌদ্ধ সংঘের পক্ষে জন সাধারণের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং আধুনিক যুগে যে সমাজে বৌদ্ধধর্মের প্রতি অসম্মান বয়ে আনে, যদি কোনও ভিক্ষুণী বা সাধারণ ভাবে নারীদের বা কোনও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বৌদ্ধ রীতি-নীতি দ্বারা কু-সংস্কার দেখানো হয় তাহলে বুদ্ধের চেতনা তাদের সময়ের আদর্শ অনুযায়ী সংশোধন করা হবে।

সর্বোপরি, সহনশীলতা এবং করুণা বুদ্ধের উপদেশের প্রধান সুর হয়ে উঠেছে। উদাহরণ স্বরূপ, বুদ্ধ নতুন শিষ্যদের, যারা পূর্বে অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমর্থন করেছিলেন, তাদের সেই সম্প্রদায়ের সমর্থন অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করেছিলেন। বৌদ্ধ সংঘের মধ্যে যেমন- কেউ অসুস্থ হলে, তিনি সদস্যদের একে-অপরের যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ তারা সবাই বৌদ্ধ পরিবারের সদস্য ছিল। এটি সকল গৃহস্থ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুজ্ঞা।

বুদ্ধের উপদেশমূলক পদ্ধতি

বুদ্ধ মৌখিক নির্দেশ এবং তাঁর জীবন্ত উদাহরণ, উভয় পদ্ধতি দ্বারা অন্যদের উপদেশ দিয়েছিলেন। মৌখিক নির্দেশের জন্য তিনি দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন যা নির্ভর করত যে, তিনি একটি গোষ্ঠীকে উপদেশ দিচ্ছিলেন না একজন ব্যক্তিকে। গোষ্ঠী গুলির উপস্থিতিতে বুদ্ধ তাঁর উপদেশ ব্যাখ্যা করতেন একটা কথোপকথনের আকারে। প্রায়শই প্রতিটি বিষয়কে বিভিন্ন শব্দ দিয়ে পুনরাবৃত্তি করতেন যাতে শ্রোতারা এটি আরও ভালভাবে বুঝতে পারে এবং মনে রাখতে পারে। একটি ব্যক্তিগত নির্দেশ দেওয়ার সময় যা সাধারণতঃ গৃহস্থ পরিবারে ভোজন গ্রহণ করার পর, যেখানে তাঁকে এবং তাঁর ভিক্ষুদের মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো, বুদ্ধ ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন। তিনি কখনই কোনও শ্রোতার দৃষ্টির বিরোধিতা বা চ্যালেঞ্জ করতেন না, বরং তাদের অবস্থান গ্রহণ করতেন এবং শ্রোতাদের তাদের নিজেদের ধারণা স্পষ্ট করতে সহায়তা করার জন্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। এইভাবে বুদ্ধ সেই ব্যক্তিকে তার অবস্থানের উন্নতি করতে এবং ধীরে-ধীরে বাস্তবতার গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে পরিচালিত করতেন। একটা উদাহরণ হ’ল- বুদ্ধ যখন একজন ব্রাহ্মণ বর্ণের একজন অহঙ্কারী সদস্যকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বটা যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করে সেই বর্ণ থেকে আসে না, বরং একজন ব্যক্তির ভাল গুণাবলী থেকে বিকাশ ঘটে।

আরও একটি উদাহরণ হ’ল- বুদ্ধ দ্বারা একজন প্রিয়জন-বিয়োগ মাকে নির্দেশ দেওয়া, যিনি তার মৃত শিশুকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন আর বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তার সন্তানকে পুনর্জীবিত করেন। উত্তরে বুদ্ধ তাকে এমন একটি বাড়ি থেকে একটা সরিষার বীজ আনতে বলেছিলেন যেখানে কখনও কারও মৃত্যু ঘটেনি। সে যদি সেটা আনতে পারে তাহলে তিনি দেখবেন যে, তিনি কী করতে পারবেন। মহিলাটি ঘরে-ঘরে গেলেন এবং জানলেন যে, প্রত্যেক বাড়িতে কেউ না কেউ মারা গেছে। ফলে আস্তে-আস্তে তার বোধগম্য হ’ল যে, একদিন প্রত্যেককে অবশ্যই মারা যেতে হবে এবং এইভাবে আরও মনের শান্তিতে সে তার সন্তানের শবদাহ করতে সক্ষম হয়েছিল।

বুদ্ধের উপদেশ পদ্ধতিটি আমাদের দেখায় যে, ব্যক্তির পৃথক মুখোমুখিতে সহায়তা করার জন্য সংঘাতমূলক না হওয়া ভাল। সবথেকে কার্যকর উপায় হ’ল তাদের নিজেদেরকে চিন্তা-ভাবনা করতে সহায়তা করা। কিন্তু মানুষের গোষ্ঠীকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বিষয়গুলি সোজা ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা ভাল।

বুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং ভাঙন (ভিক্ষুদের মধ্যে ভাঙন)

বুদ্ধের মৃত্যুর সাত বছর আগে, তার কাকাতো ভাই দেবদত্ত সংঘের প্রধান হিসাবে বুদ্ধের স্থান নেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন। একইভাবে যুবরাজ অজাতশত্রু তার পিতা রাজা বিম্বিসারের স্থান নিয়ে মগধের শাসক হিসাবে প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। অর্থাৎ এইভাবে তারা দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। অজাতশত্রু বিম্বিসারকে একবার হত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ রাজা তাঁর পুত্রের স্বার্থে সিংহাসন ত্যাগ করেন। অজাতশত্রুর সাফল্য দেখে দেবদত্ত তাকে বুদ্ধকে হত্যা করার জন্য বলেছিলেন, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

হতাশ দেবদত্ত তখন নিজেকে বুদ্ধের চেয়েও “পবিত্র” বলে দাবি ক’রে বুদ্ধের কাছ থেকে ভিক্ষুদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন আর শৃঙ্খলার নিয়মাবলী আরও কঠোর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিশুদ্ধিমার্গ (পালিঃ বিসুদ্ধিমগ্‌গ) অনুযায়ী, খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর থেরবাদ আচার্য বুদ্ধঘোষ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয় যে, দেবদত্তের নতুন প্রস্তাবগুলি হ’লঃ

  • ছেড়া কাপড় তালি দিয়ে পরা।
  • মাত্র তিনটি বস্ত্র ধারণ করা।
  • কেবল ভিক্ষাটনে বাইরে যাওয়া এবং কখনই ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ গ্রহণ না করা।
  • ভিক্ষাটনে যাওয়ার সময় কোনও বাড়ি না এড়ানো।
  • ভিক্ষা যা কিছু সংগ্রহ হয় তা একসাথে বসে খাওয়া।
  • কেবল ভিক্ষা-পাত্র থেকেই খাওয়া।
  • অন্য সব খাবার অস্বীকার করা।
  • শুধু অরণ্যেই বাস করা।
  • বৃক্ষের নীচে বাস করা
  • ঘরের ভিতরে নয়, খোলা বাতাসে জীবন-যাপন করা।
  • অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্মশানে থাকা।
  • ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্যত্র ঘুরতে বেড়াতে গেলে যে ব্যক্তি যে জায়গা পাবে তাকে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা।
  • বসে থাকা অবস্থায় ঘুমানো, কখনই শুয়ে না ঘুমানো।

বুদ্ধ বলেছিলেন যে, ভিক্ষুরা যদি এই অতিরিক্ত শৃঙ্খলার নিয়ম অনুসরণ করতে চান তাহলে এটা একেবারে ঠিক, তবে প্রত্যেকের পক্ষে বাধ্যতামূলক করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। বেশ কয়েকজন ভিক্ষু দেবদত্তকে অনুসরণ করতে পছন্দ করলেন এবং সেই জন্য তারা তাদের নিজস্ব সংঘ গঠনের জন্য বৌদ্ধ সংঘকে ত্যাগ ক’রে চলে গেলেন।

থেরবাদ নিকায়ে, দেবদত্ত যে অতিরিক্ত শৃঙ্খলাগুলি নির্ধারণ করেছিলেন তাদের বলা হয় “পালিত অনুশীলনের ১৩টি শাখা”। আরণ্যিক ভিক্ষু পরম্পরা, যেমনটি এখনও আধুনিক সময়ে উদাহরণ স্বরূপ থাইল্যান্ডে পাওয়া যায় এবং এটা এই প্রথা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। বুদ্ধের শিষ্য মহাকাশ্যপ ছিলেন সবথেকে বিখ্যাত অনুশীলনকারী যিনি এই কঠোরতর শৃঙ্খলা অনুসরণ করেছিলেন। এর বেশীর ভাগ আজ হিন্দু রীতিতে পরিব্রাজক পবিত্র পুরুষ, সাধুদের বিচরণ করতে দেখা যায়। তাদের অনুশীলন বুদ্ধের সময়ের পরিব্রাজক আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের বিচরণ করার পরম্পরার ধারাবাহিকতা বলে মনে হয়।

মহাযান নিকায়গুলিতেও পালিত অনুশীলনের ১২টি বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ তালিকা রয়েছে। এই তালিকাটি “ভিক্ষাটনের জন্য যাওয়ার সময় কোনও ঘর এড়িয়ে না যাওয়া” এটাকে বাদ দেয় এবং তার পরিবর্তে “আবর্জনা ফেলিবার পাত্রে ত্যাগ করা বস্ত্র ধারণ করা” এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; এবং “ভিক্ষাটনে যাওয়া” আর “কেবল নিজের ভিক্ষা-পাত্র থেকে ভোজন গ্রহণ করা” এই দুটিকে একটা হিসাবে গণ্য। এই নিয়ম–শৃঙ্খলার বেশীর ভাগ অংশই পরে মহাযান বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মে অন্তর্ভুক্ত মহাসিদ্ধ পরম্পরাতে অনুসরণ করা হয়েছিল।

অন্য একটা সংঘ গঠন করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা আধুনিক কথায় সম্ভবতঃ পৃথক ধর্ম-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার সমস্যা ছিল না। এই কাজটি করার কারণে পাঁচটি আনন্তর্য (জঘন্য) অপরাধের মধ্যে একটি “ভিক্ষু সংঘের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা” হিসাবে দেখা যায়নি। দেবদত্ত এই ধরণের বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন, কারণ যে গোষ্ঠী ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং যারা তাকে অনুসরণ করেছিল তারা বুদ্ধের ভিক্ষু সংঘের প্রতি চরম ক্ষতিকারক সংকল্প নিয়েছিল এবং তাদের তীব্র সমালোচনা করেছিল। কিছু বিবরণ অনুযায়ী এই বিভেদ সৃষ্টির খারাপ সংকল্পটি কয়েক শতাব্দী ধরে চলেছিল।

এই বিভেদ সৃষ্টির বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, বুদ্ধ অত্যন্ত সহনশীল ছিলেন, এবং মোটেই মৌলবাদী ছিলেন না। যদি তাঁর অনুগামীরা তাদের জন্য নির্ধারিত নিয়মের চেয়ে আরও বেশী কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়ম অবলম্বন করতে চাইতেন তাহলে সেটা ঠিক ছিল এবং যদি তাদের কোনও ইচ্ছা না থাকত তাহলে সেটাও ঠিক ছিল। বুদ্ধ যা উপদেশ দিয়েছিলেন, তা অনুধাবন করার জন্য কাউকে কখনও বাধ্য করা হয়নি। কোনও ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী যদি ভিক্ষু সংঘ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তাহলে সেটাও ঠিক ছিল। তবে যেটা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক ছিল সেটা হ’ল বৌদ্ধ সংঘ, বিশেষ ক’রে ভিক্ষু সংঘকে দু’বার বা আরও বেশী দলে বিভক্ত করা যা খারাপ ইচ্ছা পোষণ ক’রে এবং একে-অপরকে সম্মানহানি আর ক্ষতি করার চেষ্টা করা। এমনকি এরপরে একটি অন্য দলে যোগ দেওয়া এবং বিদ্বেষ প্রচারে অংশ গ্রহণ করা খুবই ক্ষতিকর। তবে যদি কোনও দল ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকারক ক্রিয়ায় লিপ্ত থাকে বা ক্ষতিকারক শৃঙ্খলা অনুসরণ করে, তাহলে করুণা লোককে সেই দলে যোগদানের বিপদগুলির বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়। তবে উদ্দেশ্যটি কখনই ক্রোধ, দ্বেষ বা প্রতিশোধের ইচ্ছার সাথে মিশ্রিত হওয়া উচিত নয়।

বুদ্ধের মৃত্যু

যদিও মুক্তি লাভের পরেও বুদ্ধ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সাধারণ মৃত্যু ব্যতীত ছিলেন, তবুও ৮১ বছর বয়সে বুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁর অনুগামীদের অনিত্যতার বিষয়ে উপদেশ দেওয়ার জন্য দেহত্যাগ করাটা উপকারী হবে। এটা করার আগে, তিনি তাঁর পরিচারক আনন্দকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন এই অনুরোধটা করার জন্য যে, তিনি আরও বেশী সময় জীবিত থাকুক এবং ধর্ম-উপদেশ দিক। কিন্তু বুদ্ধ যে সঙ্কেতটা দিয়েছিলেন আনন্দ সেটা বুঝতে পারেননি। এটা এই দেখায় যে, বুদ্ধ কেবল তখনই উপদেশ প্রদান করেন যখন তাঁকে অনুরোধ করা হয়, আর যদি কেউ অনুরোধ না করে বা আগ্রহ না দেখায় তাহলে তিনি অন্য কোথাও চলে যান, যেখানে তিনি আরও বেশী উপকারী হতে পারেন। একজন শাস্তার উপস্থিতি এবং তাঁর উপদেশ শিষ্যদের উপর নির্ভর করে।

তৎকালীন কুশীনগরে চুন্দ নামক একজন পৃষ্ঠপোষকের বাড়িতে বুদ্ধ এবং তাঁর ভিক্ষুদের ভোজনের জন্য আপ্যায়ন করা হয়েছিল। ভোজন গ্রহণ ক’রে বুদ্ধ গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুশয্যায় আসীন হয়ে তিনি তাঁর ভিক্ষুদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তাদের যদি কোনও সন্দেহ বা উত্তর না পাওয়া প্রশ্ন থাকে তাহলে তাদের তাঁর ধর্ম-উপদেশ এবং তাদের নৈতিক অনুশাসনের উপর নির্ভর করা উচিত, যা তাদের শাস্তা (শিক্ষক) হবেন। বুদ্ধ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই নিজের থেকে নিজের বা উপদেশগুলি থেকে জিনিসগুলি বের করে নিতে হবে, কারণ সমস্ত উত্তর দেওয়ার কোনও পরম কর্তৃত্ব থাকবেন না। তারপরে বুদ্ধ মারা গেলেন।

চুন্দ পুরোপুরি উন্মাদগ্রস্ত হয়ে গেলেন এই ভেবে যে, তিনি বুদ্ধকে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু আনন্দ তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন যে, বাস্তবে তিনি বুদ্ধকে তাঁর মৃত্যুর আগে তার শেষ ভোজন অর্পন করেছিলেন এবং সেই কারণে তিনি মহা-ইতিবাচক শক্তি বা “পুণ্য” অর্জন করেছেন।

এরপরে বুদ্ধের শবদাহ করা হয়েছিল এবং তাঁর অস্থিগুলি স্তুপে অস্থি-স্মৃতিস্তম্ভ-স্থাপন করা হয়েছিল। উক্ত স্মৃতিস্তম্ভগুলি বিশেষ করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যে স্থানগুলিতে চারটি বৌদ্ধ তীর্থস্থল হয়ে উঠেছে।

  • লুম্বিনী- যেখানে বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল।
  • বুদ্ধগয়া- যেখানে বুদ্ধ বোধি লাভ করেছিলেন।
  • সারনাথ- যেখানে তিনি প্রথম ধর্ম-উপদেশ দিয়েছিলেন।
  • কুশীনগর- যেখানে তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন।

সারাংশ

বিভিন্ন বৌদ্ধ পরম্পরা বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন বিবরণ শেখায়। তাদের পার্থক্য গুলি এই দেখায় যে, প্রতিটি পরম্পরা কীভাবে বুদ্ধ সম্পর্কে কল্পনা করে এবং আমরা তাঁর উদাহরণ থেকে কী শিখতে পারি।

  • হীনযান সংস্করণ- এই সংস্করণ গুলি কেবল ঐতিহাসিক বুদ্ধের কথা বলে। বুদ্ধ কীভাবে বোধি লাভ পর্যন্ত পৌঁছনোর জন্য নিজের উপর কঠোর ভাবে কাজ করেছিলেন। সেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে, সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরাও এটা করতে পারি এবং এটা আমরা নিজেরাই চেষ্টা করতে শিখি।
  • সাধারণ মহাযান সংস্করণ- বুদ্ধ ইতিমধ্যে বহু কল্প পূর্বে বোধিলাভ করে ফেলেছেন। ১২টি আলোকিত কৃত্য (লীলা) প্রদর্শন ক’রে তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, বোধি সকলের জন্য চিরকাল কর্ম করে।
  • অনুত্তরযোগ-তন্ত্র সংস্করণ- প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র এবং তন্ত্রের উপর উপদেশ দেওয়ার জন্য বুদ্ধ এককালে শাক্যমুনি বুদ্ধ এবং বজ্রধর রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এটা দেখায় যে, তন্ত্র অনুশীলন পুরোপুরি শূন্যতা সম্পর্কিত মাধ্যমিক উপদেশের উপর আধারিত।

সুতরাং, আমরা বুদ্ধের জীবনের প্রত্যেকটি সংস্করণ থেকে অনেক উপকারী জিনিস শিখতে পারি এবং বিভিন্ন স্তরে অনুপ্রেরণা অর্জন করতে পারি।

Top