ভূমিকা
আমরা যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শাক্যমুনি বুদ্ধকে খুঁজে বের করতে চাই তখন আমরা দেখতে পাই যে, বুদ্ধের জীবন কাহিনীর অনেকগুলি আলাদা সংস্করণ রয়েছে। তখন ব্যাপারটা এই এসে দাঁড়ায় যে, আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি- তারা সবাই কি একই ব্যক্তির কথা বলছেন? এটি উত্তর দেওয়ার জন্য একটা সাধারণ প্রশ্ন নয়।
মহাযান দ্বারা বিস্তৃতভাবে উপস্থাপিত বুদ্ধের পরিচয় বুদ্ধের জীবনের অন্য একটি সংস্করণ। এটি থেরবাদের সংস্করণ থেকে একটু আলাদা। থেরবাদ সংস্করণে বুদ্ধকে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব রূপে দেখানো হয়েছে, যা সাধারণতঃ খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৬৬ থেকে ৪৮৫ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আলোকিত হয়েছিলেন বা বোধিলাভ করেছিলেন, আর মৃত্যুর পরে তাঁর ধারাবাহিকতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। পালি ক্যাননে উপস্থাপিত কাহিনীর উপরে মহাযান সংস্করণটি আরও বিশদে ফুটিয়ে তুলেছে এবং বর্ণনা করেছে যে, কীভাবে বুদ্ধ অসংখ্য জীবনকাল আগে বোধি লাভ করেছিলেন এবং শাক্যমুনি রূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। কীভাবে বোধি লাভ করা যায় সেটা অন্যদের দেখানোর জন্য যে, এই পৃথিবীতে তিনি আলোকিত হওয়ার বারোটি উদাহরণ প্রস্তুত করেছিলেন। পাশাপাশি মৃত্যুর সময় তাঁর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে যাতে তিনি আরও বহু জগতে অবতরিত হতে পারেন, সকল সত্ত্বদের উপদেশ দিতে পারেন এবং কল্যাণ করতে পারেন।
বুদ্ধের জীবনের আর একটি সংস্করণ হ’ল যেটা আমরা তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে দেখতে পাই। এই সংস্করণে বুদ্ধ একসাথে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। এই রূপগুলি, যা “ধ্যান দেবতা” হিসাবে পরিচিত, যাদের বিভিন্ন বর্ণ, অসংখ্য বাহু, মুখ এবং পা রয়েছে, যা সমস্ত বুদ্ধের উপলব্ধির বিভিন্ন দিককে উপস্থাপন করে। বুদ্ধ এই বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েও তিনি একই সাথে একটি মানব রূপে উপদেশ দেন, উদাহরণ স্বরূপ, ভারতে অবস্থিত গৃধ্রকূট পর্বত যেখানে তিনি সূত্রগুলির উপরেও উপদেশ দিয়েছিলেন।
নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের মধ্যে বুদ্ধের জীবন
উক্ত বিভিন্ন সংস্করণগুলি, যা উপসংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করেও বিভ্রান্ত মনে হয়। সুতরাং বুদ্ধ আসলে কে ছিলেন? এই বিভিন্ন সংস্করণগুলি বোঝার জন্য আমাদের প্রাথমিক মূল তত্ত্বটি জানতে হবে যা, সর্বপ্রথমে বুদ্ধের জীবনের প্রতিটি সংস্করণ বৌদ্ধধর্মের নির্দিষ্ট দিক অনুযায়ী অর্থাৎ এক নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের মধ্যে ধর্মগ্রন্থগুলির উপর উপদেশ দিয়েছেন। পালি ক্যাননে বর্ণিত বুদ্ধের বিবরণটি থেরবাদ ধর্মের প্রেক্ষাপটে উপদিষ্ট। সুতরাং এটা কোনও বোধগম্য তৈরী করে না যে, একই বুদ্ধ সাধারণ মহাযান এবং তন্ত্র বিষয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন।
মহাযান গ্রন্থে বর্ণিত বুদ্ধের ধরণটি “ঐতিহাসিক বুদ্ধ” নয় (অর্থাৎ যিনি এক জীবনে বোধিলাভ করেছিলেন এবং যার ধারাবাহিকতা মৃত্যুর পরে শেষ হয়েছিল।) তন্ত্রধর্মে বর্ণিত বুদ্ধের ধরণের প্রসঙ্গে এটাও সত্য।
সংক্ষেপে বুদ্ধের জীবন বা প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার সময়, একটি বৌদ্ধ নীতি মাথায় রাখতে হবে যে, বিভিন্ন বচনে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে বা সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে সেটা একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গেই বুঝতে হবে। একই বিষয়কে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিবেচনা করার আরেকটা উপায় হচ্ছে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা, যেমন- আমার দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে এই উপাদানটি সম্পর্কে কী ব্যবহার শিখছি? বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পথে এই উপাদানটির লাভ কী?
বিভিন্ন প্রসঙ্গে শাক্যমুনি বুদ্ধের জীবন দেখে আমরা আশাবাদী হয়ে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি এড়াতে পারি- বুদ্ধ কি সত্যিই মহাযান সূত্রের উপর উপদেশ দিয়েছিলেন? তিনি কি সত্যিই তন্ত্রোপদেশ দিয়েছিলেন? বুদ্ধের সময়ে, যেহেতু উপদেশগুলি কেবল মৌখিক ভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল এবং কিছুই লেখা হয়নি, অতএব বৌদ্ধদের মধ্যে বুদ্ধ মহাযান এবং তন্ত্র বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন কি না তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। একটা বড় বিতর্ক সম্পর্কে মহান ভারতীয় আচার্য শান্তিদেব রচিত “বোধিচর্যাবতার”-এ উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, “আপনারা হীনযানবাদীরা (থেরবাদ ইত্যাদি) যে কারণেই আমাদের মহাযান সূত্রকে অপ্রামাণিক ঘোষণা করেছেন, তাতে আমিও ঠিক একই কারণ প্রয়োগ করতে পারি যে, আপনাদের শিক্ষাও অপ্রামাণিক ঘোষণা করুন।” অন্য কথায়, হীনযান ও মহাযান উভয় নিকায়ই বলে যে, তাদের বচন মৌখিক পরম্পরা রূপে সঞ্চারিত। সুতরাং থেরবাদরা যদি মহাযানবাদীদের বলে, “আপনাদের বচন সত্য নয় কারণ সেগুলি বুদ্ধ দ্বারা উপদিষ্ট নয় আর সেগুলি পরবর্তী কালে এসেছিল,” তাহলে তো মহাযানীরাও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, “একই জিনিস আপনাদের ক্ষেত্রেও সত্য। আপনাদের বচনগুলিও তো মৌখিক পরম্পরার মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং লেখা হয়েছিল অনেক পরে। সুতরাং আমাদের শিক্ষাগুলি যদি প্রামাণিক না হয়, তাহলে আপনাদের গুলিও নয়।”
এর আগে এই প্রবন্ধে আরও একটি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, থেরবাদ এবং মহাযান উভয় প্রসঙ্গেই বুদ্ধের ভিন্ন ধারণা রয়েছে। থেরবাদ শ্রেণীর বুদ্ধ থেরবাদ ধর্মোপদেশ দিয়েছেন এবং মহাযান শ্রেণীর বুদ্ধ মহাযান ধর্মোপদেশ দিয়েছেন। তিনটি পরম্পরার মধ্যে এই প্রসঙ্গগুলি থেকে অর্থাৎ হীনযানের প্রতিনিধি হিসাবে থেরবাদ, মহাযান সূত্রের পরম্পরা এবং মহাযান তান্ত্রিক পরম্পরা থেকে আমরা বুদ্ধের সাধারণ জীবন সম্পর্কে জানতে পারি।
বুদ্ধের সময়
প্রথমে আমাদের জিজ্ঞাসা করা দরকার- বুদ্ধ কখন জীবিত ছিলেন? তিনি একটি নির্দিষ্ট সমাজে একটি সময়কালে বসবাস করেছিলেন অর্থাৎ একটি নির্ধারিত প্রসঙ্গে। সেই সমাজে ইতিমধ্যে কিছু বুনিয়াদি বিশ্বাস ছিল যা বুদ্ধ সম্বোধন করেছিল। এই বিশ্বাস ব্যবস্থার মধ্যেই সমস্ত ভারতীয় চিন্তার পদ্ধতিতে প্রাপ্ত প্রাথমিক আলোচ্য বিষয়গুলি সেই সময় উপস্থিত ছিল এবং ইতিহাস জুড়ে বিকশিত হয়েছিল। বুদ্ধ এই আলোচ্য বিষয়গুলির ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেমন- পুনর্জন্ম যা কর্ম (ব্যক্তিগত কর্ম) অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। সমস্ত ভারতীয় পরম্পরা সাধারণতঃ বলে যে, জ্ঞান বা বাস্তবতার বোধগম্য এমন একটি পদ্ধতি যা কাউকে পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত হতে সক্ষম করে তোলে। বুদ্ধ তৎকালীন বিভিন্ন দর্শন ও ধর্মের উত্তর নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে তার সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য মনন করেছিলেন, ধ্যান করেছিলেন এবং বিভিন্ন অনুশীলন করেছিলেন।
বুদ্ধের সময় ভারতে স্বৈরচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা তীব্র আন্দোলন চলছিল। ঐ সময় এখানে বিভিন্ন ধরণের রাজ্য ছিল যেখানে বণিকরা ধনী হয়ে উঠছিল, তাদের ধন-সম্পদ রাজাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে লেগেছিল। প্রত্যুত্তরে রাজারা হয়ে উঠছিল আরও বেশি স্বৈরচারী। সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে ছোট-ছোট প্রজাতন্ত্ররূপে বেশি শ্রেণীবিন্যাসমূলক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা হতে শুরু হয়েছিল। এই প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে (বা কাছাকাছি) বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিও এই ব্যবস্থার কারণে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি তার ভিক্ষু সংঘও সেখানে স্থাপনা করেছিলেন, যেখানে সকল সদস্যগণদের যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হতো।
এছাড়াও সেইসময় জনগণের একটা আন্দোলন চলছিল যারা আচার-অনুষ্ঠান এবং পুরোহিত ইত্যাদি সহ প্রাচীন বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, যে ধর্মটি ঐ প্রজাতন্ত্র এবং স্বৈরচারী সহ সকলেই অনুসরণ করত। প্রতিক্রিয়াশীলরা ছিলেন “শ্রমণ” অর্থাৎ প্রব্রজিত সন্ন্যাসী অথবা সমাজকে পরিত্যক্ত ব্যক্তি যারা সমাজকে ত্যাগ করে বনে বিচরণ করতেন, ধ্যান ভাবনা করতেন এবং তাদের আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য প্রচেষ্টারত থাকতেন। এই ধরণের আন্দোলনের প্রতিনিধিগণ শুধু বুদ্ধকেই নয় বরং অন্যান্য দার্শনিক গোষ্ঠী এবং অনুগামীদের ঐ আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যদি কেউ আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে চায় অর্থাৎ সত্যের খোঁজের জন্য স্বাধীন হতে চায় তাহলে তাকে কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমাজকে প্রত্যাহার করে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। একবার যদি আমরা অনুভব করি যে আমরা সত্যকে খুঁজে পেয়েছি তাহলে তখন সেটাকে অন্যের উপর শ্রেণীবিন্যাস এবং স্বৈরচারী পদ্ধতিতে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয় বরং সেটাকে আরও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা উচিত।
জীবনীগুলির উদ্দেশ্য এবং বৈধতা
বৌদ্ধ প্রসঙ্গে ভারতীয় বা তিব্বতী জীবনীগুলি শুধু সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা ছাড়াও একজন মহান ব্যক্তির জীবন কাহিনীর কিছু নির্দিষ্ট বিষয় শেখানো এবং চিত্রিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই প্রসঙ্গে একজন মহান ধার্মিক ব্যক্তির জীবন হ’ল- অন্যকে অনুপ্রাণিত করা। এই জন্য পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীটির অংশগুলি বেশ চমৎকার বলে মনে হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বুদ্ধের জীবন থেকে, যখন তাঁর মায়ের একটি স্বপ্নের মধ্যে ছয়টি দাঁত সম্পন্ন সাদা হাতির সাথে দেখা হয়েছিল বা বুদ্ধ যখন তাঁর মায়ের পাশ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সাতটি পদক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন- “এই যে আমি!” ভারতীয়/ তিব্বতী দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীটির ঐতিহাসিক ভাবে সঠিক ছিল কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয়টি হল- কাহিনীটি আসলে দর্শকদের জন্য কী উপস্থাপন করে বা শেখায়। বুদ্ধ আসলে কী করেছিলেন বা তাঁর অনুগামীদের মধ্যে কী ঘটেছিল, সেটা খুঁজে বের করার জন্য আমরা ঐতিহাসিক ভাবে বুদ্ধের জীবনকে একত্রিত করতে চায় কিনা, সেটাই হল প্রাসঙ্গিক। অথবা আমরা কোন ভারতীয় বা তিব্বতী কীভাবে এটা পড়তে পারি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীটি দেখতে চায়। প্রতিটি প্রসঙ্গে জীবন বৃত্তান্তটি হল- আমাদের কিছু শেখানো, কোন উপায় অন্যটির চেয়ে বেশি বৈধ নয়। বৌদ্ধ চিন্তা-ভাবনা কীভাবে কাজ করে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন স্তরের বিষয়গুলি বুঝতে সক্ষম হওয়া এবং এর মধ্যে অনেকগুলি পুরোপুরি বৈধ হতে পারে সেটা বিবেচনা করা; এটি বাস্তবে কি ছিল তার একাধিক সত্যতা রয়েছে।
বৌদ্ধ সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হল তরল পদার্থ। মানুষের কাছে এই তরল পদার্থটি জলের মতো দেখায়; ক্ষুধার্ত ভূতদের কাছে দেখতে পুঁজের মতো লাগে; নরকের প্রাণীদের কাছে এটা অ্যাসিডের মতো দেখায়; দেবতাদের কাছে দেখতে অমৃতের মতো। কোনটা সঠিক? বৌদ্ধ চিন্তার পদ্ধতি অনুযায়ী এগুলি সবই সঠিক, কারণ কোন কিছুর বৈধতা কেবল একটা নির্দিষ্ট প্রসঙ্গেই আপেক্ষিক।
অন্য আরও একটা উদাহরণ হ’ল পারিবারিক থেরাপির একটি শাখায় যাকে প্রাসঙ্গিক থেরাপি বলা হয়। এর মধ্যে একটা পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তাদের অবস্থার সংস্করণ বর্ণনা করতে বলা হয়। বাবা একটা সংস্করণ শোনান, মা অন্য একটা এবং সন্তানরা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব সংস্করণ শোনায়। এই সংস্করণগুলির প্রত্যেকটাই সঠিক এবং সম্মান দেওয়া হয়, কারণ পরিবারের সদস্যরা সবাই তাদের নিজস্ব নিরিখে পরিস্থিতি অনুভব করে। এটিই হ’ল বৌদ্ধ চিন্তার পদ্ধতি এবং এটিকে বুদ্ধের জীবন বৃত্তান্তে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আমরা যদি বৃত্তান্তটি বিভিন্ন ভাবে পড়ি, তাহলে প্রতিটি সংস্করণ সঠিক হবে এবং আমাদের কিছু শিখিয়ে দেবে।
বুদ্ধের জীবনের মূল বিষয়গুলি এবং আমাদের অনুশীলনের সাথে প্রাসঙ্গিক
বুদ্ধ একটি সুবিধা সম্পন্ন ও ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তিনি রাজপুত্র ছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্কিত) এবং সেই জন্য তিনি ভাল শিক্ষা সহ অনেক আনন্দ ও সুবিধা উপভোগ করেছেন। তিনি বিবাহ করেছিলেন আর একটা পুত্রও হয়েছিল। পেশার দিক থেকে তাঁকে প্রজাতন্ত্রের প্রধান হিসাবে তাঁর পিতার অবস্থান গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বুদ্ধ শ্রামণ-আন্দোলনের অনুগামী হয়ে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখানে জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে, বুদ্ধ তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের ত্যাগ ক’রে চলে যাওয়ার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিলেন না। ভারতীয় সমাজে স্ত্রী ও শিশুদের দাদু-দিদা এবং অন্যান্য সদস্যদের বর্ধিত পরিবারগুলির মধ্যে যত্ন নেওয়া হয়। এছাড়াও বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল ক্ষত্রিয় বর্ণে, এমন একটা বর্ণ যেখানে পুরুষরা যুদ্ধের জন্য গৃহত্যাগ করে যেতে হয়। বুদ্ধ নিজের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন এবং সেটা অভ্যন্তরীণ একটি অবিদ্যা এবং বিশৃঙ্খল আবেগগুলির বিরুদ্ধে।
বুদ্ধের পারিবারিক জীবন ত্যাগের সিদ্ধান্ত আমাদের শিখিয়েছে যে, সত্যের খোঁজ অর্থাৎ পুনর্জন্ম বা মানসিক ও আবেগমূলক দুঃখের মতো দুঃখের সমাপ্তি তো একটা ভাল অবস্থা (অবস্থান), যেটা ক্ষমতা এবং অর্থ লাভ করার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। নিজের জন্য ক্ষমতা এবং অর্থের কামনার চেয়ে সার্বজনীন ব্যক্তিগত সমস্যার, যেমন- ক্রোধ, লোভ স্বার্থপরতা ইত্যাদি অথবা সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধান কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় সেটা বোঝা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের জীবন আমাদের এই শিক্ষা দেয়।
পরম পুজ্য দালাই লামা বলেছেন যে, আধ্যাত্মিক জীবনের একশো শতাংশ অনুসরণ করা প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল- আপনার জীবনের গুণ এবং আপনার চারপাশের মানুষের জীবন। বুদ্ধ পুরোপুরি একটা রথে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে (ভাগবত গীতার একটি উদাহরণ) এবং জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর মতো বিভিন্ন ধরণের দুঃখ আর পরিব্রাজক যেসব রাজপ্রাসাদে দৃশ্যমান ছিল না, সেসব কিছু প্রত্যক্ষ ক’রে আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করেছিলেন।
বুদ্ধের জীবনের এই বিভিন্ন বৃত্তান্তের প্রতীক জাঙ্গীয়ান তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে যেখানে ধন-সম্পত্তি ও কাম্-সুখ দ্বারা বুদ্ধকে এতটাই অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি জগতের দুঃখ দেখতে পারছেন না। আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনা হিসাবে তিনি যখন তার রথে চড়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসেন কেবল তখনই তাকে দুঃখ দেখানো হয় এবং তিনি সমস্ত সমস্যা উপলব্ধি করেন যা প্রত্যেকের মুখোমুখি হয়।
বুদ্ধের জীবন বৃত্তান্ত এবং বৌদ্ধধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল- অনুশীলন বা সাধনার ক্ষেত্রে ধর্মান্ধতার চূড়ান্ত পথে না যাওয়া। রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার পর বুদ্ধ নিবিড় ধ্যান এবং অত্যন্ত কঠোর তপশ্চর্যায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, যেখানে তিনি কার্যত নিজেকে অনাহারে ভুগিয়েছিলেন। বৃক্ষের নীচে বসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই অভ্যাসগুলি কোনো ভাবেই উপকারী নয়। অতএব তিনি উপবাস ভঙ্গ করে রাখাল মেয়ের কাছ থেকে দই (য়োগহার্ট) গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় চিন্তায় একটি গাভী (দই, দুধ) মাতৃত্বের মৈত্রী এবং করুণাকে উপস্থাপন করে। অতএব এটা একটা প্রতীক যে, গাভী প্রদত্ত পদার্থ বুদ্ধকে অর্পণ করা হয়েছিল যা আমাদের এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেয় এবং করুণা আত্মগ্লানি থেকে জাগ্রত করে, যা আমাদের সঠিক উপায় সন্ধান করতে সক্ষম করে তোলে। আর এই উপায়টি সার্বজনীন দুঃখের সাথে সম্পর্কিত।
বোধিলাভের ঠিক আগে, বুদ্ধ বোধি বৃক্ষের নীচে বসে আছেন (ভারতীয় চিন্তা-ধারায় পবিত্র গাছগুলি হ’ল একটা সাধারণ বিষয়) এবং সেখানে মার আবির্ভূত হয়। মার, মৃত্যুর সংস্কৃত শব্দ, প্রতিবন্ধকতা, বাধা ও প্রলোভন ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব করে। এর থেকে আমরা দেখতে পাই যে, বুদ্ধও বোধি লাভ করার ঠিক আগে ইতিবাচক কিছু অর্জন করতে চেষ্টা করার আগে প্রতিবন্ধকতা ও বাধা-বিঘ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
বুদ্ধ বোধি লাভ করার ঠিক আগে আধ্যাত্মিক ভাবে অত্যন্ত উন্নত ছিলেন। ঐ মুহুর্তে তিনি একজন সম্পূর্ণ শিক্ষানবীশ থেকে শুরু করে আলোকিত সত্ত্বায় পরিণত হননি। এমনকি তাঁর সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা ও বাধা-বিঘ্ন আরও দৃঢ় ভাবে উপস্থিত হয়েছিল। বুদ্ধকে যেমন বাধা-বিঘ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যেটা তার উদ্দেশ্য লাভে বাধার সৃষ্টি করেছিল, আমরাও তাই করি। আসলে আমরা যতটা ইতিবাচক কর্ম সম্পাদন করার চেষ্টা করি, ততবেশি বাধা-বিঘ্ন ঘটতে থাকে। অতএব এখানে উপদেশটি হল- আমাদের কখনও নিরুৎসাহিত হওয়া উচিত নয়, বরং যোদ্ধার মতো শক্তির সাথে বাধাগুলির মধ্য দিয়ে লড়াই করা উচিত। বুদ্ধ এই ধারণার সাথে সম্পর্কিত যে, তিনি যোদ্ধা বা ক্ষত্রিয় জাতি থেকে এসেছিলেন। এটা সত্য যে, আমাদের ক্লেশ, ভয় ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াইটা হল একটা আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ।
জ্ঞানী হয়ে ওঠার পর বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে দ্বিধায় পড়েছিলেন। তিনি ভাবছিলেন যে, পৃথিবীতে তাঁর ধর্মকে বুঝতে কে সক্ষম হবে। যাইহোক, যেহেতু তাকে ধর্মোপদেশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সুতরাং তিনি ভেবেছিলেন যে, এবার তিনি চেষ্টা করবেন। এখানে এই ধারণাটা আমাদের শেখায় যে, অন্যদের ধর্মোপদেশ দেওয়া বা ব্যাখ্যা করা এমনকি যদি আমাদের পক্ষেও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয় তা সত্ত্বেও আমাদের করুণার সাথে সেটা করা উচিত, তবে এটা কঠিন হতে পারে। অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার পরে, বহু মানুষ বুদ্ধকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন এবং এখান থেকেই উত্থিত হয় ভিক্ষুবাদ। শুরুতে কোনো ভিক্ষু সংক্রান্ত নিয়ম ছিল না। তবে যেহেতু ভিক্ষুরা সমাজে বাস করত তাই একটা সংঘ এবং সমাজে বসবাসের সমস্যাগুলি এড়িয়ে চলার জন্য “বিনয়” নামে পরিচিত শৃঙ্খলার বিভিন্ন বিধি চালু করা হয়েছিল। এই নিয়মগুলি যিনি তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার দ্বারা তৈরি করা হয়নি, বরং সমস্যা সামনে আসার সাথে সাথেই চালু করা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, ভিক্ষুরা যখন ভিক্ষাবৃত্তির জন্য বেরোত (সেই সময়ের শ্রামণ প্রথা) তখন ভিক্ষুরা লোভী হয়ে যেত। মানুষের এই ভাবনাটা এড়ানোর জন্য নিয়মগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, ভিক্ষুরা কোথাও ভোজনের জন্য জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না; যা দেওয়া হতো তারা সেটাই গ্রহণ করতে পারত; তারা খাবার সঞ্চয় করে রাখতে পারত না; তারা আরও বেশি পরিমাণের জন্য জিজ্ঞাসা করতে পারত না ইত্যাদি। এই বিধিগুলি নিশ্চিত করেছিল যে, সমাজ ভিক্ষুদের অস্বীকার করবে না এবং সেগুলি আজও আমাদের জন্য বৈধ।
শুরুতে বুদ্ধ স্ত্রীদের ভিক্ষু সংঘে অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেছিলেন। কারণ তিনি চিন্তিত ছিলেন যে, সমাজ হয়ত ভাববে পুরুষ ও স্ত্রীরা একসাথে অনুপযুক্ত ভাবে বনে বসবাস করবে, কিন্তু অবশেষে তিনি যখন স্ত্রীদের সংঘ হিসাবে গ্রহণ করলেন, কিন্তু তার সাথে তিনি সু-নির্দিষ্ট বিধি তৈরি করলেন যাতে সমাজ তাদের সম্পর্কে ভুল-ভ্রান্ত ধারণা না তৈরি করে। যেমন- ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীকে একসাথে থাকতে দেওয়া হতো না, একজন ভিক্ষুণীকে সর্বদা উপস্থিত থাকতে হতো কিন্তু তারা একই আসন বা বিছানায় বসতে পারত না। এই নিয়মগুলি আমাদের শেখায় যে, একদিকে বুদ্ধ সত্যের খোঁজের জন্য সমাজের সমস্ত গৌরবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং অন্যদিকে তিনি সমাজকে ভুল ধারণাও দিতে চাননি। যদিও কেউ সমাজের সমস্ত নীতির সাথে তার নিজস্ব মূল্যবোধগুলির সাথে একমত হতে পারে না। তবুও আপনি সমাজকে বিচ্ছিন্ন করতে চান না। এটি এমন রাজনীতিবিদদের সাথে সম্পর্কিত যাদের আজকাল কূটনীতিক হওয়া শিখতে হবে, সমাজের মূল্যবোধগুলি কী সেটা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করা সত্ত্বেও, তারা কীভাবে আপত্তিজনক আচরণ করতে পারবে না বা ভিত্তিহীন সন্দেহ তৈরি করতে না পারবে সেটা বুঝতে হবে।
দেবদত্ত ছিলেন বুদ্ধের কাকাতো ভাই। তিনি বুদ্ধকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন এবং সর্বদা তাঁকে সমস্যায় ফেলতেন। আসলে আপনি যদি পালি ক্যাননকে আরও বেশী ক’রে দেখেন তাহলে দেখবেন যে, অনেক লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল এবং তাঁকে অপছন্দ করত। এটা আমাদের একটি মূল্যবান শিক্ষা দেয় যে, বুদ্ধকে অপছন্দ করা হয়েছিল কারণ তিনি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেন নি। তাই যদি হয়, তাহলে আমরা কীভাবে পারব? অতএব অন্যরা যদি আমাদের অপছন্দ করে এবং আমরা যদি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে না পারি, তাহলে অবশ্যই বাস্তববাদী হওয়া উচিত এবং হতাশ বোধ করা উচিত নয়।
জীবনীগুলিতে যখন বুদ্ধের দেহত্যাগের কথা বলা হয়, তখন আনন্দের (বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য) কাছে বুদ্ধের দেহত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি সেটা করেননি আর বুদ্ধের জীবন সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এটা আমাদের শেখায় যে, বুদ্ধ কেবল তখনই প্রবচন দেন যখন তাকে অনুরোধ করা হয় এবং তিনি কেবল তখনই অবস্থান করেন যখন তাকে অনুরোধ করা হয়। কেউ যদি তাকে অবস্থান হওয়া না দেখতে চায় তাহলে তিনি চলে যান। আমরা এটা নিজের মধ্যে প্রয়োগ করতে পারি যে, মানুষ যদি আমাদের সহায়তা গ্রহণ করতে না চায় বা আমাদের প্রয়োজন না মনে করে, আমরা অবশ্যই তাদের উপর নিজেকে চাপিয়ে দেব না। তারা ছাড়া আরও অনেকে আছে যারা আরও গ্রহণ যোগ্য হতে পারে এবং আমাদের সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করতে পারে।
উপসংহার
আমরা বহুকোণ থেকে বুদ্ধের জীবনকে দেখতে পারি। আমরা সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য খোঁজ করার চেষ্টা করতে পারি যা ইতিহাসের পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণের প্রেক্ষাপটে বৈধতা থাকলেও নির্দিষ্ট তারিখ বা বছর সম্পর্কে আমাদের কোনও নিশ্চয়তা অর্জন করতে সক্ষম ক’রে তোলে না। অথবা যে কথায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন চিহ্নের নিরিখে যে পাঠগুলি শিখতে পারি তার দিকে নজর দিতে পারি, যেমন জাঙ্গিয়ান বিশ্লেষণে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য- এটা কী নির্দেশ করে? এটা কী প্রতিনিধিত্ব করে?
আমরা বৃহত্তর মহাযান প্রসঙ্গে বুদ্ধের উপস্থাপনা সহ তাঁর জীবনকে দেখতে পারি। সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, বুদ্ধ বহু কল্প পূর্বে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন এবং সার্বজনীনতার মহাযান বিষয়বস্তুর উপর উপদেশ দিয়েছেন আর অনেক জীবনকাল ধরে অন্যদের উপকৃত করেছেন। এটা আমাদের এই শেখায় যে, আমরা এখন যা করছি তা আমাদের পূর্ববর্তী সমস্ত প্রজন্মের ফলাফল এবং আমরা যদি ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতের সমস্ত প্রজন্মের বিবেচনা করতে হবে।
তান্ত্রিক উপস্থাপনায়, বুদ্ধ এক জায়গায় গভীর দর্শনের উপর প্রবচন দিচ্ছেন এবং অন্য জায়গায় তিনি চারটি মুখ নিয়ে আবির্ভূত হন, যার থেকে প্রত্যেকে একই সাথে কিছু পৃথক প্রবচন দিচ্ছেন। এটা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, বুদ্ধের প্রবচন বা শিক্ষার যে সমস্ত দিক আমরা ইতিহাস জুড়ে পাই সেগুলি একই উৎস বা মৌলিক ধারণা থেকে একসাথে খাপ খায় এবং আলাদা ভাবে উপস্থাপন করা যায়।
আমরা থেরবাদ উপস্থাপনা, মহাযান সূত্র উপস্থাপনা বা মহাযান তান্ত্রিক উপস্থাপনা, যা কিছুই বিবেচনা করি না কেন, আমরা কিন্তু বুদ্ধের বিভিন্ন ধরণের উপদেশের মধ্যে বিদ্যমান মূল নীতিগুলি পাই। এই সমস্ত উপস্থাপনাগুলিতে এমন মৌলিক নীতি রয়েছে যা বুদ্ধের আকৃতি বা চিত্রগুলির বিভিন্ন বাহু, পা এবং মুখের সংখ্যা দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়। বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষাগুলি ছিল চার অর্যসত্যের পরিপ্রেক্ষিতে যা আমরা বলতে পারি তাঁর চারটি মুখকে প্রতিনিধিত্ব করে। বুদ্ধের জীবনীর এই উপস্থাপনটি প্রকৃত পাঠযোগ্য তথ্যগুলির ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি, বরং প্রতিটি উপস্থাপনার প্রয়োগ এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজ করতে আমাদের সহায়তা করার জন্য। এই তদন্ত থেকে আমরা এই উপাদানের আরও গম্ভীর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হই।
সারাংশ
বুদ্ধের জীবনীর তিনটি সংস্করণ রয়েছেঃ থেরবাদ উপস্থাপনা, মহাযান সূত্র এবং তান্ত্রিক উপস্থাপনা। এই উপস্থাপনাগুলি পরস্পর বিরোধপূর্ণ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে যুক্তির মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি যে, প্রত্যেককে আলাদা-আলাদা প্রসঙ্গে শেখানো হয়। এই ভিন্ন-ভিন্ন উপস্থাপনাগুলি আমাদের অনুপ্রেরণা প্রদানের জন্য ও শেখানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমরা যদি বুদ্ধের বৃত্তান্তটি পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, তিনি একটা নির্দিষ্ট সমাজের মধ্যেই বাস করতেন। সেখানে একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা ছিল যা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুগুলি ব্যাখ্যা করে যে, কীভাবে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা যেতে পারে। উক্ত ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট হয়ে বুদ্ধ একটি শ্রেণীবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে সত্যের উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। নিজের বাড়ি ও পরিবারের সুখ ত্যাগ ক’রে তিনি তাঁর আভ্যন্তরীণ ক্লেশের সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন। এটা তপস্যা-সাধনার মাধ্যমে নয়, বরং সার্বজনীন দুঃখের সাথে করুণার মাধ্যমে লাভ হয়েছিল। বুদ্ধকে প্রচন্ড বাধা-বিঘ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিন্তু এসব কিছু তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। একবার বোধি লাভ ক’রে ওঠার পরে তিনি করুণাপূর্বক ধর্মোপদেশ দেওয়ার অনুরোধটি পূর্ণ করেন। বুদ্ধের অনুগামীদের জন্য ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীদের নিয়ে ভিক্ষু সংঘ এমন বিধি দ্বারা গঠিত হয়েছিল যা সমাজের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে প্রতিষ্টিত হয়েছিল।