তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিক অভিষেকগুলি আমাদের মধ্যে বুদ্ধত্বের জন্য যেসমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে সেটাকে উদ্বুদ্ধ করতে আর প্রাপ্ত কর্তাও তার গুরুর পাশাপাশি সম্পর্কিত বুদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে একটি প্রবল সংযোগ তৈরী করতে ব্যবহার করা হয়। একজন পূর্ণ যোগ্য গুরুর সাথে কোন একটি অভিষেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলে, কোন নির্দিষ্ট সাধনায় প্রবৃত্ত হওয়ার অনুমতি লাভ করা যায় যা পূর্ণ বোধি লাভ না করা পর্যন্ত বোধিলাভের বীজকে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে উৎসাহিত করে।

তান্ত্রিক অভিষেককে অন্য শব্দে ক্ষমতায়নও বলা হয় যা তিব্বতী ভাষায় ওয়াং নামে পরিচিত। এটি একটি অনুষ্ঠান যা বুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাকে সক্রিয় ক’রে তোলে। এটি আমাদের বুদ্ধ-প্রকৃতি (তথাগতগর্ভ)-এর উপাদানগুলিকে উদ্দীপিত করে অর্থাৎ আমাদের সকলের মধ্যে যে মৌলিক কাজের উপকরণগুলি রয়েছে যা আমাদের সাধারণ শরীর, বাক্‌, চিত্ত, কর্ম এবং ভালো গুণাবলীকে বুদ্ধের গুণাবলীতে রূপান্তরিত করতে পারে। একই সাথে অন্যদের বিকাশের সহায়তা করে এবং অপরের সম্ভাবনার বীজ বপন করে। আমাদের সকলের কাছে যে কারণগুলি রয়েছে সেগুলি নিম্নলিখিত বিষয়ে অন্তর্ভুক্তঃ

  • প্রবুদ্ধ (বিকশিত) তথাগতগর্ভের বৈশিষ্ট্য- এগুলি হল সেই কারণ যেগুলি বৃদ্ধির জন্য উদ্দীপিত হতে পারে, যেমন- আমাদের ইতিবাচক শক্তি বা সম্ভাবনার নেটওয়ার্ক এবং আমাদের গভীর সচেতনতা। এগুলি প্রায়শই আমাদের পুন্যসম্ভার এবং জ্ঞেয়সম্ভার রূপে অনুবাদ করা হয়।
  • স্বভাবস্থ (প্রকৃতিস্থ) তথাগতগর্ভের বৈশিষ্ট্য- এগুলি হল সেই কারণ যা আমাদের বিবর্তনের সমস্ত পর্যায়ে সবসময় একইরকম ভাবে বিদ্যমান থাকে, যেমন- আমাদের চিত্ত-সন্ততির শূন্যতা যা প্রকৃতপক্ষে রূপান্তরকে সক্ষম ক’রে তোলে। কিছু পরম্পরা অনুসারে আমাদের মানসিক ক্রিয়া-কলাপের সাংবৃতিক স্বভাবও এতে অন্তর্ভুক্ত।

অভিষেক গ্রহণ করার জন্য আমাদের শুধুমাত্র একজন পূর্ণ যোগ্য তান্ত্রিক গুরুর প্রয়োজন তা নয়, তার সাথে আমাদের সঠিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে আর নির্ধারিত কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। এখানে সঠিক প্রস্তুতির অর্থ হল সর্বপ্রথম আমাদের শরণ-গমন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এর অর্থ হল আমাদের সক্রিয়ভাবে বুদ্ধ, ধর্ম এবং অত্যন্ত উপলব্ধিকৃত সংঘ দ্বারা নির্দেশিত বিষয়ের শরণে গমন করতে হবে। যদিও সাংবৃতিক স্তরে ধর্ম বলতে বৌদ্ধ শিক্ষাকে বোঝায় তবে গভীর স্তরে এটি সেটাকে বোঝায় যা আমরা উক্ত শিক্ষাকে অনুসরণ ক’রে লাভ করি। আমরা এমন একটি অবস্থা লাভ করি যেখানে আমাদের চিত্ত-সন্ততি থেকে সমস্ত দুঃখ এবং দুঃখের কারণগুলি চিরতরে নির্মুল হয়ে যায়। এরফলে আমরা যে উপলব্ধি এবং ফলাফল অর্জন করি তার কারণে আমাদের চিত্ত পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বুদ্ধগণই হলেন তারা যাদের চিত্ত-সন্ততি এই নিরোধ সত্যে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে আর চিত্তের মার্গ সত্য অর্থাৎ জ্ঞান সত্য হল সেই মাধ্যম যা উক্ত ফলের দিকে পরিচালিত করে। আর্য সংঘ হলেন তারা যারা সেটাকে আংশিকভাবে লাভ করেছেন।

শরণ-গমনের পাশাপাশি আমাদের কিছু স্তরের ত্যাগ অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক পুনর্জন্ম (সংসার) থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প থাকা দরকার। আমরা যখন এর থেকে মুক্ত হতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হই তখন আমরা দুঃখ সত্য এবং তার প্রকৃত কারণ যা আমাদের শরীর, বাক্‌, মন, কার্যকলাপ এবং ভাল গুণাবলীকে প্রত্যেক জন্মে সীমাবদ্ধ ক’রে রাখে সেগুলিকে ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হই।

এছাড়াও প্রকৃতপক্ষে আমাদের তথাগতগর্ভের সম্ভাবনাগুলিকে সক্রিয় করার জন্য বোধিচিত্ত লক্ষ্যের একটি মৌলিক স্তর থাকা দরকার যেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব বোধি অবস্থার উপর অবলম্বন করি যা এখনও প্রাপ্ত হয়নি। তবে সেটা তথাগতগর্ভের ভিত্তিতে প্রাপ্ত হতে পারে। এই স্তরটিকে লাভ করাই হল আমাদের লক্ষ্য আর এটা করার কারণ হল অন্য সকল সত্ত্বদের তাদের অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পেতে এবং বোধিলাভের অবস্থায় পৌঁছতে সর্বোত্তমভাবে সহায়তা করতে সক্ষম হওয়া। এই ধরণের লক্ষ্য প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি তীব্র এবং সমান মৈত্রী ওকরুণা আর তাদের সকলকে সহায়তা করার জন্য সার্বজনীন দায়িত্ব গ্রহণের উপর ভিত্তি করে।

অবশেষে আমাদের মধ্যে শূন্যতার জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ আমরা, অন্যরা, সংসার, মোক্ষ, বোধি ইত্যাদি সবকিছু অনাদিকাল থেকে স্বভাবগতভাবে অনস্তিমান (শূন্য)। তাদের মধ্যে কোনটাই বিচ্ছিন্নভাবে অস্তিমান নেই, হেতু, ফল, কল্পনাগত শ্রেণী থেকে আলাদা স্বাধীনভাবে অস্তিমান নয়। প্রকৃতপক্ষে তন্ত্র কীভাবে আমাদের বোধিলাভ করায় সেই বিষয়েও আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা দরকার। আর তার সাথে উপযুক্ত প্রক্রিয়া এবং আমাদের নির্দেশনা করার জন্য গুরুর ক্ষমতার উপর আস্থা থাকা দরকার।

চারটি শ্রেণীর মধ্যে যেকোন একটির অভিষেকের সময় আমরা বোধিসত্ত্ব সংবর গ্রহণ করি আর দুটি উচ্চ শ্রেণীর তন্ত্রের অভিষেকের সময় আমরা গ্রহণ করি তান্ত্রিক সংবর।

  • বোধিসত্ত্ব সংবর- অন্যদের সর্বোত্তমভাবে সাহায্য করতে আমাদের বাধা সৃষ্টি করে এমন আচরণ ত্যাগ করতে বোধিসত্ত্ব সংবর গ্রহণ করা হয়।
  • আমাদের তান্ত্রিক অনুশীলনে সাফল্যের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এমন আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার উপায়গুলি ত্যাগ করতে তান্ত্রিক সংবর গ্রহণ করা হয়।

এই সংবরগুলি গ্রহণ করার জন্য আমাদের পূর্ণ অভিপ্রায় সহ সচেতনভাবে গ্রহণ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা বোধিলাভের সমস্ত পথ অনুসরণ করতে পারি। সেগুলিকে ধারণ ক’রে রাখার ভিত্তি হল প্রাতিমোক্ষ সংবরের কিছু স্তরের মাধ্যমে অর্জিত নৈতিক স্বশৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ। উদাহরণ স্বরূপ, জীবহত্যা, চুরি, মিথ্যা কথা, মাদক গ্রহণ এবং ব্যভিচার থেকে বিরত থাকার গৃহস্থ সংবর যেগুলি মুক্তি লাভের জন্য অনুপযুক্ত। অভিষেক সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠানে অনেকগুলি অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত থাকে। সেগুলির মধ্যে প্রত্যেকটিতে আমাদের তান্ত্রিক গুরুকে বুদ্ধ মূর্তি (ইষ্টদেব) রূপে, আমাদের পরিবেশকে মন্ডল প্রাসাদ হিসাবে এবং নিজেদেরকে বিভিন্ন বুদ্ধ-মূর্তি হিসাবে অবলম্বন করতে হয়। উক্ত অবলম্বিত বিভিন্ন বুদ্ধ-মূর্তিগুলি আমাদের হবু বোধি অবস্থাকে নির্দেশ করে যেটাকে আমরা বোধিচিত্তের সাথে লাভ করার জন্য লক্ষ্য স্থাপন করি। এমনকি আমরা যদি এগুলির স্পষ্টভাবে অবলম্বন না করতে পারি তাহলেও আমাদের অন্তত অনুভব করতে হবে যে আমাদের তান্ত্রিক গুরু, আমাদের পরিবেশ এবং স্বয়ং আমরা এই শুদ্ধরূপে অবস্থান করে আছি।

অভিষেকের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের কল্পনা করতে হবে যে আমরা শূন্যতার উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ ক’রে একটি সুখী মানসিক অবস্থা অনুভব করছি। যদিও আমরা এটি খুব ভালভাবে করতে সক্ষম হতে নাও পারি তাহলেও আমাদের অন্তত ভাবতে হবে যে যা কিছু ঘটছে সেগুলির কোনটিই হেতু, ফল, অংশ এবং সেগুলির জন্য শব্দ এবং ধারণা যা বোঝায় তদনুরূপ সেগুলি স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নেই। আমরা যখন সেগুলির শূন্যতার এই বাস্তবটি নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিই তখন আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত যে সেগুলি একই রকম। শূন্যতা সম্পর্কে আনন্দময় জ্ঞানের এই সচেতন অভিজ্ঞতাই প্রকৃতপক্ষে আমাদের বিকশিত তথাগতগর্ভের উপাদানগুলিকে সক্রিয় ক’রে তোলে, তাদের আরও বৃদ্ধি পেতে উদ্দিপীত করে এবং সম্ভাবনার আরও বেশি বীজ বপন করে। অতএব, এই ধরণের মানসিক অবস্থা উৎপন্ন করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এইভাবে আমরা শুধুমাত্র সাক্ষ্য হওয়ার পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে অভিষেক লাভ করব।

একটি নির্দিষ্ট বুদ্ধমূর্তি সাধনার অভিষেক লাভ করার পর আমরা আরও একটি আচারবিধি লাভ করতে পারি যেটা ‘অনুমোদন’ (জেনাঙ্‌) নামে পরিচিত। আমার প্রধান গুরু চেনশাব সেরকোঙ্‌ রিনপোছে ব্যাখ্যা করতেন যে ‘অভিষেক’ যদি একটি তরোয়াল ধারণের মতো হয় তাহলে ‘অনুমোদন’ হবে সেটিকে তীক্ষ্ণ করার মতো। এই আচার বিধির সময় আমরা আমাদের সংবর পুনর্নিশ্চিত করি এবং অনুভব করি যে আমাদের শরীর, বাক্‌, চিত্ত এবং তিনটিই একসাথে একত্রিত হয়ে আরও উন্নতি হয়েছে। গেলুগপা পরম্পরা অনুযায়ী আমরা সহজেই অভিষেক এবং অনুমোদনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারিঃ আগেরটি তান্ত্রিক গুরুর নিকটে উপস্থাপিত মন্ডল প্রাসাদের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। অন্যদিকে অপরটি একটি বলির (তোরমা) মাধ্যমে প্রদান করা হয় যেটিকে বুদ্ধমূর্তি রূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়।

অভিষেক লাভ করার পর আমরা নিজেদেরকে বুদ্ধমূর্তি আকারে কল্পনা করার ক্ষমতা অর্জন করি। চোংখাপার মতে আমরা যদি পূর্ণ ‘অভিষেক’ লাভ করার আগে শুধুমাত্র ‘অনুমোদন’ লাভ করি তাহলে ধ্যান সাধনাকালে আমরা শুধু আমাদের সামনে চিত্রটিকে কল্পনা করার জন্য অনুমতি পাই। কিন্তু আমরা যদি একই শ্রেণী অথবা উচ্চতর শ্রেণীর অভিষেক লাভ করি, যেমন- বুদ্ধমূর্তিকে কল্পনা করা তাহলে সেই বুদ্ধমূর্তিটির জন্য আগে থেকে কোন অভিষেক লাভ নাও করে থাকি তাহলেও আমাদের নিজেদেরকে সেইরূপে কল্পনা করার অনুমতি দেওয়া হয়।

আমরা ‘অভিষেক’ বা ‘অনুমোদন’ লাভ করি অথবা না করি, আমাদের তান্ত্রিক গুরু আমাদের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে সেটা আমরা আনন্দের সাথে গ্রহণ করি। সর্বোপরি আমাদের উদ্দেশ্য হল অগ্রসর হওয়া। আমরা যদি শুধুমাত্র একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসাবে বা তথাকথিত ‘অধিষ্ঠান (আশীর্বাদ)’ অথবা আমাদের সংবরকে সতেজ করার জন্য উপস্থিত হই কিন্তু আচার-অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করি তাহলে উক্ত তন্ত্র সাধনার প্রতি আমাদের কোন প্রতিবদ্ধতা থাকে না। যাইহোক, আমরা যদি মুক্ত মনের হই তাহলে আমরা জীবনে একজন দয়ালু এবং জ্ঞানী ব্যক্তি হওয়ার প্রেরণা লাভ করি।

সারাংশ

উক্ত বিষয়গুলি যতই অস্পষ্ট হোক না কেন আমাদের সকলের মধ্যে বোধি লাভ করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রয়েছে। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী তান্ত্রিক অভিষেক ঐ সরঞ্জামগুলিকে উন্মোচন করতে সহায়তা করে এবং আমাদের অনাগত বোধি লাভের বীজ ছড়িয়ে দেয়।

অভিষেক বিভিন্ন প্রকারের হয়। প্রত্যেকটি তিব্বতী বৌদ্ধ পরম্পরা নির্দিষ্ট দেবতার সাধনার প্রচার করে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য একটাইঃ প্রাপ্ত কর্তা, যোগ্য গুরু এবং বুদ্ধমূর্তির মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন গড়ে তোলা। সক্রিয়ভাবে অভিষেকে অংশগ্রহণ করার অর্থ হল নিজেকে উন্নত করার জন্য একটি জীবনব্যাপী প্রতিবদ্ধতার সূচনা করা আর সমস্ত প্রাণীর কল্যাণের জন্য কাজ করা।

Top