পাশ্চাত্য জগতে প্রায়শই তন্ত্রকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে, এর মধ্যে বিশেষ ক’রে রহস্যময় কিছু নেই। তন্ত্র একটি শক্তিশালী যন্ত্র প্রয়োগ করে যা আমরা সকলেই উপলব্ধি করতে পারি অর্থাৎ আমাদের কল্পনা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান মতবাদে একটি দৃঢ় আধার সহ উন্নত সাধকদের জন্য তন্ত্র হল দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে বুদ্ধত্বরূপী এমন একটি অবস্থা প্রাপ্ত করার উপায় যা প্রাপ্ত ক’রে তাঁরা সমস্ত সত্ত্বদের সর্বাধিক কল্যাণ করতে পারেন।

তন্ত্র সাধনার ভিত্তি

তন্ত্র হল বোধিলাভ করার জন্য একটি উন্নত মানের মহাযান সাধনা। ‘মার্গ-ক্রম’ (লাম-রিম) উপদেশে অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সূত্র অনুশীলনের দৃঢ় আধারের ভিত্তিতে এটি সাধনা করা হয়। সেগুলির মধ্যে বিশেষ ক’রে গুরুত্বপূর্ণ হলঃ

  • শরণ-গমণ
  • সমস্ত দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার সংকল্প (নির্যাণ/ত্যাগ)
  • কঠোর নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা (শীল)
  • বোধিচিত্তের লক্ষ্য (সকল সত্ত্বের উদ্দেশ্যে বোধি লাভ করা)
  • ষট্‌ পারমিতা, বিশেষ করে
  • সমাধি
  • শূন্যতা সম্পর্কিত প্রজ্ঞা

একবার যখন একজন সাধক তাঁর অধ্যয়ন এবং এই সমস্ত বিষয়ের প্রশিক্ষণে স্থিতিশীলতা অর্জন ক’রে ফেলেন আর একবার যখন তার পূর্বযোগ (প্রাথমিক সাধনা) পূর্ণ হয়ে যায় তিনি তন্ত্র সাধনায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হন। নেতিবাচক সম্ভাবনাগুলিকে শুদ্ধ করতে এবং সাধনায় সাফল্যের জন্য ইতিবাচক সম্ভাবনাগুলি তৈরী করতে পূর্বযোগ (প্রাথমিক সাধনাগুলি) গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধক তন্ত্র সাধনা করতে চান কারণ তাঁর করুণা এবং বোধিচিত্তের লক্ষ্য এতটাই গভীর এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে সূত্র-পদ্ধতির মাধ্যমে বোধিলাভ করতে যে প্রচুর সময় নেয় সেটা তিনি ধৈর্য রাখতে পারেন না। তন্ত্র হল একটি অত্যন্ত কার্যকরী সামগ্রিক পদ্ধতিতে সমস্ত সূত্র-অনুশীলনকে একত্রিত করার পদ্ধতি। 

তন্ত্র শব্দের অর্থ

সংস্কৃত শব্দ ‘তন্ত্র’-এর অর্থ হল ‘প্রসারিত কিছু’ অর্থাৎ উক্ত শব্দের দুটি অর্থ যা প্রসারিত হয়ে আছে। এটি হল একটি তাঁতের উপর সুতোর পাটার উপর প্রসারিত এমন কিছু। তন্ত্র-সাধনা হল সেই পাটা যার উপর সমস্ত সূত্র সম্পর্কিত অনুশীলনগুলিকে একসাথে বুনতে হয়। ‘প্রসারিত’-এর তাৎপর্য হল একটি চিরন্তন সন্ততি, যার কোন শুরু এবং শেষ থাকে না। সাধারণতঃ এটি আমাদের চিত্ত-সন্ততিকে বোঝায়। আমাদের ব্যক্তিগত চিত্ত-সন্ততি অর্থাৎ জীবনের বিষয়গত অভিজ্ঞতার সন্ততি বা ধারাবাহিকতা। এই সন্ততির মধ্যে একটি কায়, বাক্‌ (যোগাযোগের কিছু মাধ্যম), চিত্ত, কার্যকলাপ এবং নিজ ও পর উভয়কে বোঝা ও যত্ন নেওয়া (আত্ম সংরক্ষণ এবং প্রজাতির সংরক্ষণের প্রবৃত্তি)-এর মতো ভালো গুণাবলী অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের সকলের মধ্যে এই দিকগুলি কোন না কোন আকারে আছে এবং প্রত্যেকটি জীবনে কোন না কোন স্তরে উন্নয়ন হয়েছে। এই বিভিন্ন বিষয়গুলি এবং চিত্ত-সন্ততির শূন্যতা (কোন অসম্ভব উপায়ে অনস্তিমান) এবং এই কারণগুলিকে আরও বিকশিত করার জন্য প্রবুদ্ধ করা যেতে পারে এবং সেগুলিকে বলা হয় ‘তথাগতগর্ভের কারণ’। সেগুলি একটি চিরন্তন সন্ততি দ্বারা গঠিত যাকে তন্ত্র বলা হয়।

বস্তুতন্ত্র, মার্গতন্ত্র এবং ফলতন্ত্র

আমাদের প্রতিটি সন্ততির তিনটি পর্যায় আছেঃ বস্তু, মার্গ (পথ) এবং ফল-স্তর। বস্তুতন্ত্রের স্তর বলতে প্রত্যেকটি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্ত জীবনকালের (সংসার) সাধারণ আকারে অনাদি সন্ততিকে বোঝায়। আমরা, অন্যরা এবং অন্যান্য সবকিছু কীভাবে অস্তিত্বে আছে তার সম্পর্কে অজ্ঞানতা আর বিরক্তিকর আবেগ (ক্লেশ) এবং বাধ্যতামূলক কার্মিক আচরণ, এইগুলি আমাদের সাধারণ রূপ গঠন করে। এই বিভ্রান্তির কারণে দিকভ্রমিত হওয়ায় বিভিন্ন ধরণের দুঃখে পরিপূর্ণ এই সন্ততি নিজেকে চিরস্থায়ী করে এবং চিরকালের জন্য এই আধারের স্তরে চলতে থাকে। যতক্ষণ না আমরা এই বিভ্রান্তিকে দূর করার (শুদ্ধিকরণ করার) জন্য কিছু না করি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বস্তু স্তরের তন্ত্রকে অশুদ্ধরূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

ফল স্তরের তন্ত্র বলতে আমাদের সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ স্বভাবের উপাদানগুলির অশেষ সন্ততিকে বোঝায়। এটি বর্তমানে পূর্ণ বোধিপ্রাপ্ত বুদ্ধের কায়, বাক্‌, চিত্ত, কার্যকলাপ এবং ভালো গুণাবলী আকারে বিদ্যমান থাকে।

মার্গ-স্তরের তন্ত্র বলতে আংশিকভাবে বিশুদ্ধ সন্ততিকে বোঝায়, যা আমাদের চিত্ত-সন্ততিকে তার ভিত্তি থেকে ফল স্তরে নিয়ে আসার জন্য মধ্যস্থকারী ক্রম হিসাবে কাজ করে। আমরা বর্তমানে আমাদের শরীর এবং অন্যান্য অনেক কিছু, যা এখন বুদ্ধের মূর্তি (ইষ্টদেবতা, তান্ত্রিক দেবতা) আকারকে বুদ্ধরূপে কল্পনা করি। আমরা এই অনুশীলনটি করি যখন আমরা উপলব্ধি করি যে আমরা যা কিছু কল্পনা করছি সেটা এমন একটি স্তর যা এখন সেই আকারে পরিণত হচ্ছে না, তবে পরিণত হতে পারবে যখন আমরা তথাগতগর্ভের উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ করব। নিজেদেরকে বুদ্ধের আকারে কল্পনা করার প্রক্রিয়ারূপে যে তন্ত্র সাধনা আছে সেটাকে বলা হয় ‘ফলযান’। আমরা বর্তমানে এই সাধনাটি এমন পদ্ধতিতে করি সেটি ফলের অনুরূপ হয় যেটা আমরা অর্জন করব। 

একাধিক অঙ্গ

মার্গতন্ত্র সাধনার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে যে বুদ্ধ-মূর্তিরূপে কল্পনা করি তাদের একাধিক মুখ, হাত এবং পা থাকে। এগুলি হল তন্ত্রের পাটা সুতো, কারণ সেগুলির উপর আমরা বুনি যা তারা উপস্থাপন করে। প্রতিটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য ‘মার্গ-ক্রম’-এর সূত্র শিক্ষার একটি ভিন্ন দিক উপস্থাপন করে। উদাহরণ স্বরূপ, সেখানে ছয়টি হাত থাকার তাৎপর্য একসাথে ছয়টি পারমিতাকে উপস্থাপন করা। ছয়টি পারমিতা হল- দান, নৈতিক স্বশৃঙ্খলা (শীল), ক্ষান্তি (ধৈর্য), বীর্য (অধ্যাবসায়), ধ্যান (মানসিক স্থিতিশীলতা) এবং প্রজ্ঞা। গ্রাফিক আকারে এই ছয়টি দৃষ্টিভঙ্গিকে আলম্বন করার মাধ্যমে আমরা বিমূর্তভাবে অনুশীলন করার চেষ্টা করার চেয়ে অনেক সহজে এবং একই সাথে সেগুলির সম্পর্কে সচেতন থাকতে সক্ষম হই।

পূর্বযোগ (প্রাথমিক অনুশীলন)

এই ধরণের বহু অঙ্গরূপে নিজেদের কল্পনা করার সময় আমরা ধ্যান-সাধনা এবং দৈনন্দিন জীবন উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের ইতিবাচক শক্তি এবং গভীর সচেতনতার (পুণ্যসম্ভার এবং জ্ঞেয় সম্ভার) নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সাধনায় প্রবৃত্ত হই। আমরা অন্যদের মৈত্রী এবং করুণার সাথে সহায়তা করি আর প্রত্যেকের এবং তারসাথে সম্পর্কিত সমস্ত কিছুর শূন্যতার উপর কল্পনা করি। এই দুটি নেটওয়ার্কও হল তথাগতগর্ভের কারণ। তাদের শক্তিই আমাদের অন্যান্য তথাগতগর্ভের কারণগুলিকে বস্তু, মার্গ অথবা ফলের স্তরের কাজ করে। অতএব, এই নেটওয়ার্কগুলিকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আমরা মৌলিক তন্ত্র সাধনার জন্য চেষ্টা করার আগে প্রণাম এবং বজ্রসত্ত্ব-শুদ্ধির (শতাক্ষর জপ) মতো প্রাথমিক সাধনায় যুক্ত হই।

অভিষেক

একটি বুদ্ধের মূর্তির আকারে নিজেকে বুদ্ধরূপে কল্পনা করার জন্য আমাদের একজন যোগ্য তান্ত্রিক গুরুর কাছ থেকে অভিষেক লাভ করা প্রয়োজন হয়। আমরা এটা তখনই করতে পারি যদি কিনা আমরা পূর্বে প্রয়োজনীয় সূত্রের অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের সাথে প্রাথমিক অনুশীলন সম্পন্ন ক’রে নিজেদেরকে যথেষ্ট ভাবে প্রস্তুত ক’রে রাখি। তান্ত্রিক গুরু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সময় আমরা যে কল্পনা ক’রে থাকি তার শক্তির মাধ্যমে আমাদের তথাগতগর্ভের উপাদানগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বুদ্ধের মধ্যে বিদ্যমান গুণাবলীরূপে রূপান্তর হতে শুরু হয়। নির্বিঘ্নরূপে রূপান্তরিত হতে নিশ্চিত করার জন্য আমরা এমন ভাবে কর্ম করি, কথা বলি অথবা চিন্তা-ভাবনা করি যার কারণে আমরা আমাদের সাধনার ক্ষতি থেকে এড়ানোর জন্য সম্বর (ব্রত) গ্রহণ করি। এই সম্বর অন্তর্ভুক্ত থাকে নৈতিক স্বশৃঙ্খলা (শীল) সম্বর, বোধিসত্ত্ব সম্বর এবং তান্ত্রিক সম্বর। সচেতন হয়ে এই সম্বরগুলি গ্রহণ না করলে আমরা অভিষেক লাভ করতে পারি না আর যতটা সম্ভব বিশুদ্ধ ভাবে ধারণ না করলে প্রকৃত তন্ত্র সাধনা সম্ভব হয় না।

সারাংশ

যৌন ক্রিয়া-কলাপ অথবা আচার-অনুষ্ঠানের সাথে কিছু কর্ম করা ব্যতীত তন্ত্র আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনা জাগ্রত করার জন্য একটি অত্যন্ত উন্নত এবং জটিল ব্যবস্থা প্রস্তুত করে। তন্ত্র সাধনাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। আমরা যখন সক্রিয়ভাবে তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানে যুক্ত হই তখন আমরা আমাদের অবশিষ্ট জীবনে সম্বর পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে পড়ি। এই কারণে তন্ত্র সাধনা তখনই শুরু করা উচিত যখন আমরা বৌদ্ধধর্মের মতবাদ সম্পর্কিত একটি দৃঢ় আধার তৈরী করতে পারি, বিশেষ ক’রে সকল সত্ত্বের জন্য সার্বজনীন মৈত্রী এবং করুণার আধার আর শূন্যতা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান।

উন্নত সাধকদের জন্য তন্ত্র হল মনের একটি পারমাণবিক বোমার মতো। যদি সঠিকভাবে অনুশীলন বা সাধনা করা হয়, তাহলে এটি অহংকার এবং আত্ম-লালনশীল মনকে ধ্বংস ক’রে দেবে আর সাধককে দ্রুত বোধিলাভের দিকে নিয়ে যাবে, যেখানে তিনি সমস্ত সত্ত্বের জন্য অবিশ্বাস্য এবং দীর্ঘস্থায়ী উপকারী হয়ে উঠবেন।

Top