প্রাণী হিসাবে আমাদের সকলের মধ্যে বুদ্ধত্ব লাভ করার সম্ভাবনা এবং উপাদান রয়েছে। সকলের প্রতি মৈত্রীপূর্ণ ও করুণাময় হতে সক্ষম হওয়ায় আমরা সে সবকিছু জানতে ও বুঝতে সমর্থ। এর পাশাপাশি তাদের সাথে নিখুঁতভাবে ভাব বা মতবিনিময় করতে সক্ষম এবং তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি ও নির্বাণ লাভের জন্য দক্ষতার সঙ্গে সহায়তাও করতে সক্ষম। তবে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সেই সম্ভাবনা গুলিকে অনুভব বা উপলব্ধি করতে সক্ষম নই। সেরকম কেন হয়েছে এবং কীভাবে আমরা সেগুলি উপলব্ধি করতে পারি? সেই পথে তান্ত্রিক অভিষেক গ্রহণ করাই হল প্রথম পদক্ষেপ।
‘সত্ত্ব’ হলেন একটি জীবিত প্রাণী এবং ইচ্ছা বা মনোভাব, তার কর্ম নির্ভর করে তার উদ্দেশ্যের উপর। তাকে এই জন্মে বা পরজন্মে সেই কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। তবে সত্য হিসেবে আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর অর্থ হল, আমাদের মন, হৃদয়, কার্যকর ভাবে যোগাযোগের ক্ষমতা, আমাদের কর্ম, দেহ ইত্যাদি সবই সীমিত। আচরণগত কার্য-কারণ সম্পর্ক, স্ব-পর এবং সকল ধর্ম কীভাবে অস্তিত্বে রয়েছে এই বিষয়ে আমাদের অনাদি অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি হল এই সীমাবদ্ধতার কারণ। বাস্তবতার এই মৌলিক সত্য সম্পর্কে ‘অবিদ্যা’ আমরা বিভ্রান্তিমূলক আবেগের অনুভব করি (ক্লেশ সঞ্চয় করি)। এগুলির প্রভাবে আমরা যথেচ্ছ কর্ম করি, আর কার্মিক সম্ভাবনা তৈরী করি যা আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত সংসারে পুনর্জন্ম নিতে বাধ্য ক’রে তোলে। জন্ম জন্মান্তরে আমরা দুঃখ, কষ্ট, হতাশায় ভুগি, আমাদের সুখ ক্ষণস্থায়ী হয় আর সর্বশেষে অসন্তোষই পাই। এমনকি, আমরা যদি কাউকে সাহায্য করতে চাই, আমাদের শিক্ষা বা উপদেশের ফল কী হবে, সে সম্পর্কে কোন ধারণা থাকে না। আমাদের সাহায্য কী হতে পারে অনুমানেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকে।
এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের মধ্যে কি এমন উপাদান রয়েছে যা আমাদের সহায়তা করতে পারে? আমাদের সকলের কাছে শরীর, কর্ম ক্ষমতা, যোগাযোগের ক্ষমতা, বিষয় বস্তুকে বোঝার ক্ষমতা এবং অপরের প্রতি সদর্থক অনুভূতি এবং সেবা করারও ইচ্ছা রয়েছে। ক্ষমতাগুলি এখন সীমিত হলেও তাদের বর্ধন করা সম্ভব। এর কারণ হল আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টির ইতিবাচক সম্ভাবনা, সাধারণভাবে যাকে পুণ্য বলা হয়। বর্তমানে আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি এবং আমাদের নিজেকে উন্নত করার মত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা রয়েছে, এই হল তার প্রামাণিক সত্য। আমাদের কিছু বুদ্ধি এবং অনুধাবনের ক্ষমতাও রয়েছে, তা না হলে কী ক’রে কিছু করতে হয় সেটা জানতে সক্ষম হতাম না। সামগ্রিকভাবে এই সমস্ত গুণগুলিকে বলা হয় ‘তথাগতগর্ভ'। স্ব সামর্থে তাদের অসীমিত রূপে বিবর্ধিত করা যায় এরাই আমাদের ‘প্রবুদ্ধ’ তথাগতগর্ভের উপাদান।
এছাড়াও তথাগত গর্ভের সঙ্গে রয়েছে কিছু ‘প্রকৃতিস্থ’ উপাদান যা সর্বদা একই থাকে এবং বিবর্ধিত করা যায় এবং এমন প্রবুদ্ধ উপাদানগুলির বিকাশে সাহায্য করে। এগুলির মধ্যে রয়েছে চিত্তের মৌলিক শুদ্ধতা, ব্যক্তি হিসাবে আমাদের কায়-বাক্, চিত্ত সহ সকল বস্তুর শূন্যতা।
আমাদের চিত্ত শুদ্ধ, এই দৃষ্টিতে যে চিত্ত প্রকৃতিগতভাবেই এই সীমাবদ্ধতার মলীনতা থেকে নির্লিপ্ত। অন্যদিকে শূন্যতা হল সংসারের সব কিছুই স্বভাবতঃ শূন্যতা। আমাদের মন বা চিত্তকেই ধরা যাক, আদিকাল থেকেই এবং ভবিষ্যতেও স্বভাবতঃ সংসারের সমস্ত বিষয় থেকে মুক্ত থাকে। কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয় না এবং সব সময় সীমিত অবস্থাতেই থাকে। এই ধরণের সত্যতঃ সিদ্ধ হওয়া অসম্ভব। কারণ পূর্ণ অনুপস্থিতি, সবকিছুর স্বভাবশূন্যতা এবং আমাদের চিত্তের মৌলিক বিশুদ্ধতা আর সমস্ত তথাগতগর্ভের গুণাবলীর জন্য উক্ত সীমাবদ্ধতাকে আমরা একেবারে দূর করে বুদ্ধত্ব লাভে সমর্থ।
তান্ত্রিক অভিষেক হল একটি অনুষ্ঠান যা আমাদের প্রবুদ্ধ তথাগতগর্ভের উপাদান গুলিকে কার্যকর করে। সেগুলিকে আরও বেশি ক’রে বিকশিত ক’রে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সম্ভাব্য বীজ রোপন করে। তান্ত্রিক অভিষেক গ্রহণের জন্য শুধুমাত্র একজন যোগ্য তান্ত্রিক গুরু পেলেই চলবে না, আমাদেরও সঠিকার্থে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে প্রস্তুত হতে হবে। সঠিক প্রস্তুতির অর্থ হল, আমাদের জীবনকে একটি নিরাপদ দিশা দেওয়া অর্থাৎ শরণ গমন করা। বুদ্ধ, ধর্ম এবং উচ্চ উপলব্ধিকৃত আর্য সংঘ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যদিও সাংবৃতিক স্তরে ধর্ম বলতে বুদ্ধের উপদেশাবলীকে বোঝায়, তবে এর গভীর তাৎপর্য হল ওই বুদ্ধ বাণীকে অনুসরণ ক’রে আমরা যা লাভ করি সেটাকে বোঝায়। আমরা একটি অবস্থা লাভ করি, যেখানে আমাদের চিত্ত সন্ততি থেকে দুঃখ ও তার সমস্ত কারণ চিরতরে উন্মূলন যায় এবং তার পরিবর্তে সে অবস্থা থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধিগুলি আমাদের মন বা চিত্তকে পরিপূর্ণ করে। বুদ্ধ হলেন তাঁরা যাঁদের চিত্ত-সম্পত্তিতে নিরোধসত্য এবং চিত্তের মার্গসত্য (সত্য জ্ঞান) যা পরিচালনা করে বা যা হল মার্গ-সত্যের ফল। আর যাদের মধ্যে সেটা আংশিক রয়েছে ওরা হলেন আর্য সংঘ।
আমাদের জীবনে সঠিক শরণ ছাড়াও একেবারে মৌলিক স্তরে কিছু ত্যাগও থাকা প্রয়োজন। এর মানে হল, এই অনিয়ন্ত্রিত পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় মানসিক সংকল্প। কারণ আমরা এসব থেকে মুক্তি পেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হই। আমরা দুঃখ সত্য ও তার কারণ সমূহ সত্য থেকেও মুক্ত হতে ইচ্ছা পোষণ করি, যা আমাদের প্রতিটি পুনর্জন্মে দেহ এবং মনকে সীমিত ক’রে রাখে।
তদতিরিক্ত, আমাদের সম্ভাব্য বুদ্ধের বীজকে (তথাগতগর্ভ) কার্যকর করতে অন্ততঃ প্রাথমিক স্তরে বোধিচিত্তের লক্ষ্য থাকতেই হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা স্ব-অবস্থারূপী বুদ্ধত্ব লাভের জন্য যে অবস্থা এখনও লাভ হয়নি, দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তথাগতগর্ভের উপর নির্ভর ক’রে সেটা লাভ করা যেতে পারে। এই অবস্থা লাভ করাই আমাদের লক্ষ্য আর এর কারণ হল অন্যরা যাতে অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তি লাভ করতে পারে এবং বোধি লাভ করতে পারে তার জন্য সর্বোত্তম ভাবে সহায়তা করতে সক্ষম হওয়া। তারপর এরকম লক্ষ্য এই ধরণের লক্ষ্য ভিত্তি করে সকলের প্রতি সম মৈত্রী ও করুণা আর সার্বজনীন দায়িত্ব নিয়ে সকলের সেবার উপর।
তদুপরি, শূন্যতা সম্বন্ধেও আমাদের প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। যেমন, স্ব-পর, সংসার, মুক্তি, বুদ্ধত্ব এসব কিছু আদি থেকেই স্বভাবতঃ শূন্য। এদের কেউ একক স্বাধীনভাবে অস্তিত্বে নেই, এমনকি কার্য-কারণ বা হেতু-প্রত্যয় সম্পর্ক ও আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনার ধারণাত্মক বিষয়ও এতে অন্তর্ভুক্ত। এরপর তন্ত্র সাধনা কীভাবে আমাদের বুদ্ধত্ব লাভ করাতে পারে তার সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান আর তান্ত্রিক পদ্ধতি ও গুরুর শিক্ষা দানের দক্ষতা ইত্যাদির উপরও আস্থা থাকা প্রয়োজন।
কালচক্র তন্ত্রের মতো অনুত্তর তন্ত্রের অভিষেক গ্রহণ করার সময় আমরা বোধিসত্ত্ব সম্বর ও তান্ত্রিক সম্বর গ্রহণ করি। অপরকে খুব ভালোভাবে সাহায্য করতে আমাদের আচরণ যেন বাধা সৃষ্টি না করে সেরকম সদাচরণ হল বোধিসত্ত সম্বর। আমাদের চিন্তা-ভাবনা যেন তান্ত্রিক সাধনার বাধা না হয়, সেরকম সম্বর হল তান্ত্রিক সাধনা। এই সম্বরগুলি গ্রহণ করার সময় সচেতনভাবে এগুলি এই ধরণের পূর্ণ উদ্দেশ্যের সাথে গ্রহণ করতে হবে যে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত এগুলি যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করব। সম্বরগুলি রক্ষা করার ভিত্তি হচ্ছে নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা যা প্রাতিমোক্ষ সম্বরের পালন। উদাহরণস্বরূপ, উপাসকগণ প্রাণীহত্যা, চুরি, মিথ্যা কথা বলা, নেশাদ্রব্য গ্রহণ ও ব্যভিচার যা মোক্ষ লাভের।
দীক্ষা অনুষ্ঠানের কয়েকটি পর্যায় আছে, যার প্রতিটিতে জটিল দৃশ্যায়ন থাকে, যেমন- গুরুকে বুদ্ধরূপে (ইষ্ঠ দেবতারূপে) দর্শন করা, আমাদের পরিবেশকে (চারপাশ ও ভূমিকে) মন্ডল এবং ঐ বুদ্ধের ভূমি আকারে দেখা আর নিজেদেরকে নানা রকম বুদ্ধের আকারে দর্শন করা যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধত্বের অবস্থা দর্শায়। এসব আমরা বোধিচিত্তের দ্বারা লাভ করতে লক্ষ্য স্থাপন করি। এমনকি যদি আমরা পরিষ্কারভাবে দৃশ্যায়ন নাও করতে পারি, তাহলেও অন্ততঃ আমাদের তান্ত্রিক গুরু, চারিদিকের ভূমি এবং নিজেকে শুদ্ধ রূপে রয়েছে সেটা অনুভব করতে হবে।
অভিষেকের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের কল্পনা করতে হবে যে আমরা শূন্যতার অভিমুখী হয়ে সুখী মনকে অনুভব করছি। যদিও আমরা সেটা ভালোভাবে নাও করতে পারি, তবুও অন্ততঃ এইটুকু ভাবতে হবে যে যা কিছু ঘটছে তা স্বয়ম্ভু ঘটছে না। এমনকি তাদের পরিচায়ক শব্দ ও ধারণাও নয়। সবই কার্যকারণ বা হেতু-প্রত্যয় সাপেক্ষ। যখন আমরা নিজেকে শূন্যতার এই সত্যতা স্মরণ করিয়ে দিই, এই সত্যটি বুঝে আনন্দের অনুভূতি বা উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শূন্যতার এই সুখী সচেতন অনুভবই প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রবুদ্ধ তথাগতগর্ভের উপাদান গুলিকে কার্যকর করে, বিবর্তন করতে সাহায্য করে এবং সম্ভাবনার বহু বীজ বপন করে। অতএব, চিত্তের সেরকম অবস্থার জাগরণের জন্য আমাদের অবশ্যই যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এইভাবে আমরা প্রকৃতপক্ষে অভিষেক গ্রহণ করি, সাধারণ দ্রষ্টা হিসেবে নয়।