অধ্যবসায়ের পরিপূর্ণতা : বীর্য পারমিতা

তিব্বতীরা বলেন যে একটা একগুঁয়ে গাধাকে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়াটা যত কঠিন পুণ্যবান হওয়াটা তত কঠিন। আর একটা শিলাখণ্ডকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে গড়িয়ে দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক কর্ম করাটা তত সহজ। আমরা যতই ধৈর্যশালী, উদার বা জ্ঞানী হই না কেন, যদি আমরা অলসতার উপর বিজয় লাভ না করতে পারি তাহলে আমরা কারও কল্যাণ করতে পারব না। বীরত্বপূর্ণ সাহস এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আমাদের বোধিলাভ করা এবং অন্য সমস্ত প্রাণীদের কল্যাণ করার জন্য আমাদের খোঁজ সম্পাদন করতে যোদ্ধাদের মতো যেকোন আভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকি।

ভূমিকা

ছয়টি সুদূর-প্রসারী মনোভাব (পারমিতা)- এর মধ্যে চতুর্থটি হল অধ্যবসায় বা বীর্যপারমিতা। এটিকে একটি মানসিক অবস্থারূপে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা পূর্ণ শক্তির সাথে গঠনমূলক কর্মে নিযুক্ত হয় এবং তার জন্য প্রচেষ্টা বজায় রাখে। তবে এটা শুধু ইতিবাচক কর্মে লিপ্ত থাকার চেয়েও আরও বেশি কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে হার না মানার বীরত্বপূর্ণ সাহস এবং গঠনমূলক কিছু করার প্রতি আনন্দের অনুভূতি।

এটা সত্যিই কঠোর পরিশ্রমী মনোভাব বিকাশ করার বিষয় নয়, যেখানে আমরা আমাদের কাজকে ঘৃণা করি, তবে দায়িত্ব-বোধ, অপরাধ-বোধ এবং বাধ্য-বাধকতা অথবা এই ধরণের কিছু কারণবশতঃ সেগুলি সম্পাদন করি। পাশাপাশি এটা কাজ-পাগলের মতো যান্ত্রিক ভাবে প্রতিদিন কাজ করতে যেতে হয় না। এটা তাই নয় যেটাকে আমরা ‘স্বল্পমেয়াদি উৎসাহ’ বলি, যেখানে আমরা সত্যিই কিছু করতে উৎসাহী হই, তারজন্য নিজের সর্বস্ব শক্তি ব্যবহার করি আর এক সপ্তাহের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দিই। পরিবর্তে, আমরা এখানে টেকসই প্রচেষ্টা এবং উৎসাহ সম্পর্কে কথা বলছি এবং এইজন্য এটাকে অধ্যবসায়ও বলা হয়। এটা টেকসই, এর কারণ হল আমরা যা করি সেটা আমরা উপভোগ করি অর্থাৎ যে সমস্ত ইতিবাচক কর্ম আছে, যেগুলিতে আমরা যুক্ত হই, আমরা সেগুলি উপভোগ করি। বীরত্বপূর্ণ সাহসের সাথে সংযুক্ত অধ্যবসায় হল অলসতা এবং  গড়িমসির প্রবল প্রতিপক্ষ।

বর্মসম অধ্যবসায় 

অধ্যবসায়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে প্রথমটি হল বর্মসম অধ্যবসায়। এটা হল অনবরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা, তাতে সময় যত বেশি লাগুক না কেন বা সেটা যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন। যা কিছুই ঘটুক না কেন আমরা তাতে না অলস হব, না নিরুৎসাহিত হব। যদি আমরা জেনে যাই যে ধর্মের পথটা সত্যি, সত্যিই অনেক সময় নেবে এবং যদি পরকল্যাণ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য এমনকি আমরা নরকেও যেতে ইচ্ছুক হই তাহলে সম্ভাব্য ছোটো–ছোটো সমস্যার কারণে অলস বা নিরুৎসাহিত হওয়া অসম্ভব। ঐ সময় আমাদের কাছে থাকে একটি বর্মসম মনোভাব, “যাই হোক না কেন, যা কিছুই ঘটুক না কেন, সেটা আমাকে বিচলিত করতে পারবে না”। এই ধরণের বীরত্বপূর্ণ সাহস আমাদের যে কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে রক্ষা করে, কারণ আমরা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে থাকি যে, পরিস্থিতি যতই কঠিন হয়ে উঠুক না কেন অথবা সময় যতই লাগুক না কেন, আমরা সেটা করেই ছাড়ব।

আমরা একদিকে যত দেরীতে বোধিলাভ করার আশা করি এটা ততই তাড়াতাড়ি লাভ হয়। অন্যদিকে আমরা যদি এটাকে অবিলম্বে এবং সহজে লাভ করার আশা করি তাহলে চিরকাল লেগে যাবে। অনেক মহান গ্রন্থ এবং আচার্যরা বলেছেন যে, আমরা যদি তাৎক্ষণিক এবং সহজ বোধিলাভের কামনা করি তাহলে মূলতঃ এটা হবে আমাদের নিজের স্বার্থপরতা এবং অলসতার লক্ষণ। আমরা তৎকাল ফলের কামনা করি কিন্তু আমরা পরোপকারের জন্য বেশি সময় ব্যয় করি না। আমরা শুধু বোধিলাভের সুস্বাদু মিষ্টি প্রাপ্ত করতে চাই। মূলতঃ আমরা হলাম অলস। আমরা এর সাথে যুক্ত কঠোর পরিশ্রম করতে চাই না। আমরা বোধিকে বিক্রিতে লাভ করতে চাই এবং যতটা সম্ভব সস্তায় পেতে চাই। কিন্তু এই ধরনের আকাঙ্খাটি কখনোই কার্যকর হয় না।

আমরা যখন করুণা ভাবনার সাথে এই মনোভাব বিকাশ করি, “আমি তিন অসংখ্য কল্প পর্যন্ত পরকল্যাণের জন্য ইতিবাচক শক্তি নির্মাণ করব” তখন বীরত্বপূর্ণ সাহসের বিশাল লক্ষ্যটি আরও দ্রুত বোধিলাভ করতে সহায়ক হয়।

গঠনমূলক কর্মে অধ্যবসায়ের প্রয়োগ

দ্বিতীয় প্রকারের অধ্যবসায় হল- বোধিলাভের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিবাচক শক্তি নির্মাণের জন্য ইতিবাচক ও গঠনমূলক কর্মে যুক্ত হওয়ার দৃঢ় প্রচেষ্টা। এর অর্থ হল আমরা আমাদের প্রারম্ভিক অনুশীলন, যেমন ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম ইত্যাদি করতে অলস হই না অথবা অলস হই না শ্রবণ, চিন্তন এবং মনন করতে। আমাদের এসব কিছু করার দরকার হয় এবং আমাদেরকে সেগুলি সহর্ষে করা উচিত। 

সীমাবদ্ধ প্রাণীদের কল্যাণার্থে কর্ম করার অধ্যবসায়

তৃতীয় প্রকারের অধ্যবসায় হল দৃঢ় প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা অপরকে সহায়তা এবং উপকার করার জন্য কর্মরত হই। এর অন্তর্গত চারটি পদ্ধতিকে (চতুঃসংগ্রহবস্তু) গণনা করা হয় যার দ্বারা আমরা অন্য সকলকে আমাদের ইতিবাচক প্রভাবে নিয়ে আসতে পারি এবং সুদূরপ্রসারী নৈতিক শৃঙ্খলায় অন্তর্ভুক্ত এগারো প্রকারের মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হয় যাদের সহায়তার জন্য কাজ করতে হয়। তবে তারা একেবারে অভিন্ন নয়। মূলতঃ এখানে এর অর্থ হল এই ধরণের মানুষদের বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সক্রিয় ভাবে সহায়তা করা যা এই অধ্যবসায়ের সাথে উপযুক্ত। আমরা প্রসন্ন ভাবনার সাথে এই কাজ গুলি করি আর অপরকে উপকার করতে সক্ষম হওয়ার ফলে খুব খুশি বোধ করি। তদতিরিক্ত, যত কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হোক না কেন আমরা ধৈর্যের সাথে সেটা সহ্য করি এবং নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলার মাধ্যমে আমরা সমস্ত বিরক্তিকর আবেগগুলি ত্যাগ করি, যে আবেগ আমাদের বাস্তবে পরহিত করতে বাধা সৃষ্টি করে। এটা স্পষ্ট যে কীভাবে বিভিন্ন সুদূরপ্রসারী মনোভাব একে-অপরকে সহায়তা করে।

তিন প্রকারের অলসতা 

অলসতা তিন প্রকারের হয় যা আমাদের অধ্যবসায়ে বাধা সৃষ্টি করে। অধ্যবসায়ের অনুশীলন এবং বিকাশের জন্য আমাদের অলসতাকে কাটিয়ে উঠতে হবে।

১. নিচেষ্টতা  এবং গড়িমসির অলসতা 

আমাদের মধ্যে অনেকেরই হাতে-কলমে এই ধরণের অলসতার অভিজ্ঞতা আছে। এটা হল যে আমরা সবসময় একটা কাজকে পরের দিন করব বলে গড়িমসি করতে চাই। এটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের মৃত্যু এবং অনিত্যতা সম্পর্কে চিন্তা করা এবং ধ্যান ভাবনা করা উচিত। আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা অবশ্যই মারা যাব, তবে মৃত্যু যে কখন আসবে সে বিষয়ে আমাদের কাছে তার কোনো ইঙ্গিত একেবারেই নেই। আর এই মূল্যবান মানবজীবন যা আমাদের আশ্চর্যজনক কর্ম করার সুযোগ প্রদান করে সেটাকে পুনরায় প্রাপ্ত করা কঠিন। আমার প্রিয় জেন ধাঁধাঁ হল, “মৃত্যু যে কোন সময় আসতে পারে। নিশ্চিত হয়ে থাকুন”। এই উক্তিটির উপর বিচার করা ভাল। এটা সত্যি যে মৃত্যু যেকোন সময় আঘাত হানতে পারে। তবে আমরা যদি এটাকে নিয়ে খুব চিন্তিত, বিচলিত এবং উত্তেজিত হই তাহলে আমরা কখনোই কিছু সম্পাদন করতে পারবো না। আমরা ভাবব, “আমাকে আজকেই সবকিছু করে ফেলতে হবে।” এই ভেবে আমরা ধর্মান্ধ হয়ে যাই যেটা কোনো কাজে লাগে না। হ্যাঁ, আমাদের মৃত্যু হবে এবং এটা যে কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে, তবে আমরা যদি এই জীবনকে সদ্ব্যবহার করতে চাই তাহলে আমাদের এই দুটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। যদি আমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ মৃত্যুর বিষয়ে তীব্র ভয় থাকে তাহলে আমরা সবসময় অনুভব করব যে আমরা কখনও পর্যাপ্ত সময় পাব না।

২. তুচ্ছতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার অলসতা

দ্বিতীয় প্রকারের অলসতা হল তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি আসক্ত থাকা যা আমাদের মধ্যে অনেকেই সহজে বুঝতে পারে না। আমরা টি.ভি দেখতে, গালগপ্পো করতে এবং বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, খেলাধুলার সম্পর্কে কথা বলতে আর এই ধরণের অনেককিছু করতে করতে সময় নষ্ট করি। এই জিনিসগুলি সময়ের অপচয় হিসাবে বিচার করা হয় এবং এটি মূলতঃ অলসতার একটি রূপ। সহজভাবে বলতে গেলে, ধ্যান-ভাবনা করার চেয়ে টিভির সামনে বসে থাকা বেশি সহজ। ঠিক? আমরা আমাদের অলসতার কারণে এই ধরণের সাধারণ জাগতিক জিনিসগুলির প্রতি আসক্ত হই। আর এমন কিছু করতে চাই না যা এর থেকে বেশি কঠিন, তবে বেশি অর্থবহ।

এর অর্থ এই নয় যে আমরা বিনোদন এবং শিথিলতাকরণের জন্য বিরাম দেব না, কারণ আমাদের নিজেদেরকে পুনর্জ্জীবিত করার জন্য মাঝে-মাঝে এটা প্রয়োজন হয়। তবে আসল কথাটি হল এর প্রতি আসক্ত না হওয়া আর অলসতার পরিমাপ অত্যধিক বেশি বাড়ানো উচিত নয়। আমরা সবসময় একটা বিরতি নিতে পারি, বেড়াতে যেতে পারি, টি.ভি. শো দেখতে পারি, কিন্তু সেগুলির প্রতি আসক্ত হওয়া একেবারে উচিত নয়। যখন বিনোদন করা পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়ে যায় তখন আমরা আরও বেশি ইতিবাচক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারি।

তুচ্ছতাকে আঁকড়ে ধরে রাখা থেকে কাটিয়ে ওঠার সর্বোত্তম উপায় হল ভৌতিক সাফল্য এবং ক্রিয়াকলাপ থেকে আমরা যে আনন্দ এবং সুখ লাভ করি সেটা কখনোই আমাদের স্থায়ী সুখ প্রদান করতে পারে না, এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আমরা যতই সিনেমা দেখি না কেন, যশস্বী ব্যক্তিদের কাছে যতই গালগপ্পো করি না কেন অথবা আমরা যতই বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করি না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না: এটা কখনোই আমাদের বিন্দুমাত্র স্থায়ী সুখ প্রদান করতে পারে না। এই স্থায়ী সুখ প্রাপ্ত করার একমাত্র উপায় হল ধর্ম-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যে প্রশিক্ষণ আমাদের ঐ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। আমরা আমাদের সম্পূর্ণ সময়কে, একটা বলকে জালে জড়ানোর প্রশিক্ষণে ব্যয় করতে পারি, কিন্তু সেটা আমাদের কখনোই এর চেয়ে ভালো পুনর্জন্ম জোগাতে পারে না।

সুতরাং নিজেদের বোঝার প্রধান বিষয়টি হল কোন কিছুর প্রতি আসক্ত না হাওয়া। আমরা শিথিলকরণ বা বিশ্রামের জন্য অবশ্যই কিছু করতেই পারি এবং সেটা করা ভালোও কিন্তু ঐ ক্রিয়াকলাপের প্রতি আসক্ত হওয়া এবং আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা তার জন্য ব্যয় করে দেওয়াটা হল সময়ের অপচয় মাত্র, কারণ আমরা আরও গঠনমূলক কিছু করতে অলস হয়ে পড়ি। এই ধরণের অলসতা আমাদের পক্ষে গঠনমূলক কোন কিছু করে আনন্দিত হওয়া সত্যিই একটা বাধা।

 ৩. নিরুৎসাহিত হওয়ার অলসতা (অবমাননা অলসতা)

তৃতীয় প্রকারের অলসতা সেটাকে বলা হয় যেখানে আমাদের মধ্যে অক্ষম হওয়ার ভ্রম থাকে, যে বিষয়গুলি আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন এবং আমরা কখনোই এটা করতে সক্ষম হব না আর এই জন্যই আমরা নিরুৎসাহিত হই। আমরা কতবার চিন্তা-ভাবনা করবঃ “আমি তো এর জন্যে চেষ্টাও করব না এমনকি আমার মতো কেউ কি এটা করতে পারে?” বোধিলাভের মতো একটা মহান লক্ষ্য, ভয়ংকর মনে হতে পারে কিন্তু তার জন্যে চেষ্টা না করাটাই হল অলসতার একটা রূপ।

এর উপর বিজয়লাভ করার জন্য আমাদের প্রয়োজন তথাগতগর্ভকে স্মরণ করা। এর অর্থ হল আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে বিভিন্ন অদ্ভুত গুণাবলী এবং সম্ভাবনা আছে যা আমরা পরিপূর্ণ করতে পারি। যদি অনেক মানুষ আছে যারা চুইংগাম বিক্রি করে সামান্য লাভ অর্জন করার জন্য সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করতে সক্ষম হয় অথবা কে জানে তারা আর কী কী বিক্রি করে, তাহলে আমাদের মধ্যে অবশ্যই এত ক্ষমতা আছে যে সময়কে কাজে লাগিয়ে আমরা আরও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কিছু অর্জন করতে পারি। আমরা যদি মাত্র নব্বই মিনিটের সঙ্গীত অনুষ্ঠানের টিকিট পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের কখনোই ভাবা উচিত নয় যে আমরা এমন গঠনমূলক কিছু করতে অক্ষম, যা আমাদের বোধিলাভের মত চিরস্থায়ী লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়।

অধ্যবসায়ী বিকাশ করার চারটি অবলম্বন

শান্তিদেব চারটি অবলম্বন বর্ণনা করেছেন যা আমাদের অধ্যবসায় বিকাশে সাহায্য করে।

১. দৃঢ় বিশ্বাস

ধর্মের ইতিবাচক গুণাবলী এবং তার অনুশীলনের লাভের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জাগার ফলে সেটাকে অনুশীলন করার জন্যে আমরা দৃঢ় উদ্দেশ্য বিকাশ করি।

২. অবিচলতা এবং আত্মগর্ব 

আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং তথাগতগর্ভের বোধগম্যতার উপর আধারিত অবিচলতা এবং স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। আমরা যখন তথাগতগর্ভ অর্থাৎ যখন আমাদের সকলের মধ্যে বিদ্যমান মৌলিক সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশ্বাস, তখন আমাদের মধ্যে সয়ংক্রিয় ভাবে অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস জাগবে যাকে শান্তিদেব “গর্ব” অথবা “আত্মগর্ব” রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। যদি আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে আমরা আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি স্থির এবং অবিচল থাকবো। এমন পরিস্থতিতে উত্থান এবং পতন যাই হোক না কেন আমরা বীরত্বপূর্ণ সাহসের সাথে তারজন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।

৩. আনন্দ

তৃতীয় অবলম্বনটি হল আমরা যা কিছু করি তার প্রতি আনন্দ অনুভব করা। আমরা জীবনে যা কিছু করি তার প্রতি তৃপ্তি এবং সন্তুষ্টির অনুভব জাগানো। নিজের বিকাশের জন্য কাজ করার পক্ষে এবং সন্তুষ্টির এটা হল সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক এবং সন্তোষজনক বস্তু। আমরা যখন এটা করি তখন সেটা আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই মহানন্দ বোধ করায়।

৪. যেতে দেওয়া

শেষ অবলম্বনটি হল কখন বিশ্রাম নিতে হবে সেটা জানা। আমাদের এমন প্রচেষ্টা করলে হবে না যেখানে আমরা সবকিছু করা ছেড়ে দিই এবং যেটা করি তার দিকে ফিরে যাওয়ার সাহস জোগাতে পারব না। আমাদের একটা মধ্যম পথ বেছে নিতে হবে যাতে আমরা আমাদের উপর কঠিন বোঝা চাপিয়ে না দিই এবং নিজেরা একটা শিশুর মত আচরণ না করি। এর অর্থ এই নয়, যে মুহূর্তে আমরা ক্লান্ত বোধ করি তখনই আমাদের বিরাম দেওয়ার জন্যে শুয়ে পড়া উচিত।

তবুও পরম পূজ্য দালাই লামার স্বর্গীয় কনিষ্ঠ শিক্ষক ঠ্রিজাঙ্‌ রিনপোছে বলেছেন যে, আমরা যখন খুব খারাপ, নেতিবাচক মেজাজে থাকি এবং কোন ধার্মিক পদ্ধতি আমাদের সহায়তা করছে বলে মনে হয় না, এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভালো পথ একটু শুয়ে থাকা। পরে যখন আমরা জেগে উঠবো তখন আমদের মেজাজ অন্য রকম হবে, অর্থাৎ ফুরফুরে হবে আর এটা হয় শুধু একটু শুয়ে থাকার স্বভাবের কারণে। এটা একটা খুবই ব্যবহারিক পরামর্শ।

বীরত্বপূর্ণ সাহস বিকাশের আরও দুটি কারণ

শান্তিদেব আরও দুটি সহায়ক কারণ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।

১. সহজেই স্বীকৃতি গ্রহণ করা 

প্রথমটি হল আমাদের অনুশীলনের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটাকে সহজে গ্রহণ করা এবং যেটা ত্যগ করা প্রয়োজন সেটাকে মেনে নেওয়া। তদতিরিক্ত, আমাদের একসাথে যুক্ত কঠোর পরিশ্রমকে গ্রহণ করতে হবে। সেগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য এদের মধ্যে প্রত্যেকটি বিন্দু বাস্তবসম্মত ভাবে পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে আর নির্ভর করে আমাদের দক্ষতার উপর। এরপর আমাদের মেনে নিতে হবে যে অপরকে সহায়তা করা এবং বোধিলাভ করার জন্য বাস্তবে আমাদের গঠনমূলক কর্ম করার প্রয়োজন। আমরা স্বীকার করি যে সেখানে এমন কিছু আছে যেগুলি আমাদের করা বন্ধ করতে হবে এবং সেই পথটি কঠিন পরিস্থিতিতে পূর্ণ থাকবে।

নিজেদের ক্ষমতা এবং বাস্তবের সাথে বাস্তবসম্মত ভাবে যা কিছু যুক্ত আমরা সেগুলিকে জেনেশুনে মেনে নিই এবং তার দায়িত্ব নিজেদের উপর গ্রহণ করি। আমাদের মধ্যে অবাস্তব মনোভাব থাকা উচিত নয়। আমরা যদি এক লাখ বার ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম করার পরিকল্পনা করি তাহলে আমাদের জানতে হবে যে কাজটা মোটেই সহজ নয়। আমাদের পায়ে ব্যথা হবে হাতের তালু ক্ষতবিক্ষত হবে এবং আমরা অবশ্যই ক্লান্ত হয়ে পড়ব। সুতরাং ওই সময় আমরা নিজেদেরকে এর লাভ সম্পর্কে স্মরণ করাই।

এমন কী রকমের কাজ আছে যেটা আমাদের করা বন্ধ করতে হবে? শুরুতে এটা করার জন্য আমাদের সময় বের করতে হবে আর এটা যথেষ্ট কঠিন হতে পারে অর্থাৎ সময় বের করার জন্য শুধু আমাদের বাদ দিতে হবে। আমরা নিজেদেরকে সততার সাথে পরীক্ষা করে দেখি, “আমি কি এটা করতে পারি?” আমরা তার সাথে যুক্ত বাস্তবতাকে গ্রহণ করি এবং আনন্দ ও উৎসাহের সাথে তার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করি।

২. নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্ত করা

বীরত্বপূর্ণ অধ্যবসায়ের বিকাশের জন্যে শান্তিদেবের দ্বিতীয় বক্তব্যটি হল, একবার যখন আমাদের মধ্যে উপরোক্ত বিষয়গুলি গ্রহণ করার বাস্তব মনোভাব জাগে তখন আমরা সেটাকে নিজেদের উপর প্রয়োগ করার নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্ত করি। ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে আমরা কেবল নিজেদেরকে পুরনো পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করতে দিই না, বিশেষ করে অলসতার মাধ্যমে। আমরা নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্ত করি এবং নিজেদেরকে ইতিবাচক কাজে যুক্ত করি যেটা আমরা সম্পাদন করতে চাই। যেমনটি আমরা ইংরেজীতে বলব “পুট আওয়ার হার্ট ইনটু ইট” অর্থাৎ আমরা এতে পুরোদমে লেগে পড়ি।

সারাংশ

আমরা যখন বাস্তবে ধর্ম অনুশীলনের লাভ সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে যাই এবং দেখতে পাই যে এর অনুশীলন থেকে প্রাপ্ত সুখ হল অতুলনীয়, তখন এর জন্যে অধ্যবসায়তা স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়। আমাদের জীবনে কী ঘটছে বা না ঘটছে সেটা বিবেচনার বিষয় নয়, যদি আমাদের সাথে দৃঢ় প্রেরণার সাথে দৃঢ় অধ্যবসায়তা থাকে তাহলে একজন শূরবীরের মত আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করব।

আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময় সবথেকে বড় যে বাধাটি পথে আসে অধ্যবসায়তা সেটাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে আর সেই বাধাটি হল অলসতা। এখানে যে পদ্ধতিগুলি বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলি শুধু বোধিলাভের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়, বরং আজীবন আমাদের সাংসারিক লক্ষ্যগুলির ক্ষেত্রেও প্রয়োজন।

Top