প্রাচীনকালে সম্ভবতঃ লিঙ্গ-বৈষম্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যাইহোক, সভ্যতার বিকাশের সাথে-সাথে সমাজকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শক্তি এবং প্রভাব একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ফলস্বরূপ, পুরুষরা বৃহত্তর শারীরিক শক্তির কারণে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা এবং বুদ্ধি আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। তবে আজকাল স্নেহ এবং উষ্ণ হৃদয় দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষা ও বুদ্ধির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে অভিমুখ করতে বাধা দেওয়ার জন্য ঐ দুটি গুণের প্রয়োজন। এইভাবে নারীদের এখন আরও প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ সম্ভবতঃ জৈবিক কারণগুলির ভিত্তিতে তারা স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষদের তুলনায় আরও সহজে স্নেহ এবং উষ্ণ হৃদয় বিকাশ করতে সক্ষম হয়। এই গুণগুলি তাদের গর্ভে শিশুদের বহন এবং সাধারণতঃ সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রাথমিক লালন-পালন করার কারণ থেকে উদ্ভূত হয়।
ঐতিহ্যগত ভাবে যুদ্ধ পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যেহেতু শারীরিক ভাবে তাদের আক্রমণাত্মক আচরণে সুসজ্জিত বলে মনে হয়। অন্যদিকে নারীরা অপরের অস্বস্তি এবং পীড়ার প্রতি বেশি যত্নশীল এবং বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। যদিও পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে আগ্রাসন এবং উষ্ণ হৃদয়ের সমান সম্ভাবনা থাকে, তাহলেও তাদের মধ্যে পার্থক্যটি বোঝা যায় যখন ঐ দুটির মধ্যে যেটি বেশি সহজে প্রকাশ পায়। সুতরাং, যদি বিশ্ব নেতাগণ সংখ্যা গরিষ্ঠ নারী হতেন তাহলে সম্ভবতঃ যুদ্ধের ঝুঁকি কম হত এবং বৈশ্বিক উদ্বেগের ভিত্তিতে আরও বেশি সহযোগিতা পাওয়া যেত। যদিও এক্ষেত্রে কিছু নারীরা অবশ্যই কঠোর হতে পারে। আমার মতে নারীদের প্রতি সহানুভূতি আছে, কিন্তু তাদের শুধু চিৎকার করা উচিত নয়। সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখার জন্য তাদের অবশ্যই প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কখনো-কখনো ধর্মে পুরুষের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী নামক সংবরগুলি সমান এবং এতে একই অধিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও এটাই বাস্তব কিন্তু সামাজিক প্রথার কারণে কিছু-কিছু আচার-অনুষ্ঠানে ভিক্ষুরা প্রথমে যান তবে বুদ্ধ উভয় সংঘকে সমানভাবে মৌলিক অধিকার দিয়েছেন। ভিক্ষুণী সংবর (দীক্ষা) পুনর্জীবিত করা যায় কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা ক’রে লাভ নেই, প্রশ্নটি হল শুধু বিনয়ের প্রেক্ষাপটে কীভাবে সেটা সঠিকভাবে করা যায়।
আচার্য শান্তরক্ষিত তিব্বতে মূলসর্বাস্তিবাদ পরম্পরা অনুযায়ী ভিক্ষু দীক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন। যদিও তাঁর শিষ্য-মন্ডলীর মধ্যে সকল ভারতীয়ই পুরুষ ছিলেন তবে যেহেতু ভিক্ষুণী সংঘের জন্য দ্বয় সংঘের প্রয়োজন হয় তাই তিনি ভিক্ষুণী পরম্পরা প্রবর্তন করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে কয়েকজন তিব্বতী লামা তাদের মায়েদের ভিক্ষুণী দীক্ষা প্রদান করেছিলেন কিন্তু বিনয়ের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সেগুলিকে প্রামাণিক দীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করা হত না। ১৯৫৯ সাল থেকে আমি অনুভব করেছি যে ভিক্ষুণী মঠের শিক্ষার মান ভিক্ষু মঠের মতো উন্নতি করা দরকার। আমি এটা প্রণয়ন করেছি এবং আজ আমাদের কাছে ভিক্ষুণীদের মধ্যে অনেক শিক্ষিতা ভিক্ষুণী আছেন। তবে ভিক্ষুণী দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আমি একা কাজ করতে পারি না। এই প্রশ্নটির জন্য বিনয় অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এখনও আমাদের কাছে এই প্রশ্নটিকে অন্যান্য বৌদ্ধ পরম্পরার সাথে মিলিয়ে আলোচনা করার সুযোগ আছে, যেমন- চীনা, কোরিয়ান এবং ভিয়েতনামী পরম্পরা। এই পরম্পরাগুলিতে এখনও ভিক্ষুণী দীক্ষা প্রচলিত আছে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই ডজন তিব্বতী নারীরা ধর্মগুপ্তক পরম্পরা অনুসারে ভিক্ষুণী দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। কেউ এখন অস্বীকার করেন না যে তারা এখন ভিক্ষুণী।
বিগত ত্রিশ বছর ধরে আমরা মূলসর্বাস্তিবাদ এবং ধর্মগুপ্তক বিনয়-গ্রন্থের উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু বিনয় এই দুটি সংস্কৃত ভিত্তিক পরম্পরার পাশাপাশি পালি পরম্পরায় উপলব্ধ রয়েছে, তাই এই তিনটি বিনয় পরম্পরার সংঘ-স্থবিরদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে এবং তাদের অভিজ্ঞতার বিনিময় করতে একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কায় ভিক্ষুণী দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং থাইল্যান্ডেও এটি প্রতিষ্ঠিত করার আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও আরও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে যাতে আমরা আচার্য শান্তরক্ষিতের ব্যর্থতার প্রতিকার করতে সক্ষম হই। তবে একজন ব্যক্তি হিসাবে এই সমস্যাটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। সেটি বিনয় পদ্ধতির অনুকূল হবে না। আমার শুধুমাত্র গবেষণা শুরু করার ক্ষমতা আছে।
আমরা সকলেই ঐ সমস্ত তিব্বতী এবং পশ্চিমী ভিক্ষুণী, যাঁরা ধর্মগুপ্তক ভিক্ষুণী দীক্ষা লাভ করেছেন, তাদেরকে ধর্মগুপ্তক ভিক্ষুণী হিসাবে গ্রহণ করি এবং সনাক্ত করি। এটি কোন সমস্যা নয়। বিষয়টি হল মূলসর্বাস্তিবাদ বিনয় অনুসারে ভিক্ষুণী দীক্ষা প্রদান করার উপায় খোঁজ করা। এখানে বুদ্ধকে জীবিত থাকার প্রয়োজন ছিল তাহলে আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম। আমি যদি বুদ্ধ হতাম তাহলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম কিন্তু সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমি বুদ্ধ নই। কিছু বিষয়ে আমি একজন স্বৈরশাসক হিসাবে কাজকর্ম করতে পারি তবে বিনয়ের ক্ষেত্রে নয়। আমি যেটা করতে পারি সেটা হল শিক্ষা প্রদান করা, যে তিব্বতী ভিক্ষুণীরা সংঘের ত্রিবিধ আচার-অনুষ্ঠান পালন করার উদ্দেশ্যে ধর্মগুপ্তক পরম্পরায় দলবদ্ধ রূপে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাদেরকে। ঐ তিনটি অনুষ্ঠান হল- দ্বি-মাসিক পোষধ অনুষ্ঠান, বর্ষাবাস (বর্ষোপনয়িক) অনুষ্ঠান এবং প্রবারণ অনুষ্ঠান। তবে দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা একেবারে একটা ভিন্ন বিষয়। যদিও আমি কামনা করি যে এই কাজটা হোক তবে এরজন্য প্রয়োজন বরিষ্ঠ ভিক্ষুদের অনুমতি। এই বিষয়ে অনেকে প্রবল প্রতিরোধের প্রস্তাব পেশ করেছেন। সেখানে কোন সর্বসন্মতি নেই আর এটাই হল সমস্যা। যাইহোক, আমি অবিলম্বে চীনা ভাষা থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা সংঘের এই তিনটি আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মগুপ্তক সংস্করণের জন্য উপযুক্ত গ্রন্থ উপলব্ধ করাতে পারি। কেউ এর বিরোধিতা করতে পারবে না।
অন্যান্য দিকগুলির ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি আলোচনার প্রয়োজন আছে। অন্যান্য বৌদ্ধ পরম্পরায় সংঘের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। তাই উক্ত প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে এই সভাটি একটি সহায়ক পর্যায়। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে আমি আন্তর্জাতিক সংঘের প্রবীণ মন্ডলীদের ভারতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তাদেরকে সেই সংকীর্ণ মনের তিব্বতী প্রবীণদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে দিই যারা মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেন।
আজ যদি বুদ্ধ এখানে থাকতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি অনুমতি দিতেন। কিন্তু আমি বুদ্ধের মতো কাজ করতে পারি না। যদিও অষ্টম শতাব্দী থেকে তিব্বতে ভিক্ষুত্ববাদ প্রচলিত হয়ে চলেছে। কিন্তু সেখানে কখনও ভিক্ষুণী ছিল না যারা সংঘের এই তিনটি আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছিল। তাই এবার এটি হবে। তবে এই দীক্ষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে।
এই বছর ভিক্ষুণী সংঘের এই তিনটি আচার-অনুষ্ঠান শুরু করা একটু কঠিন হতে পারে, কিন্তু আগামী বছরের মধ্যে আমাদের শুরু করা উচিত। ভিক্ষুণী প্রাতিমোক্ষ ইতিমধ্যেই চীনা ভাষা থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা হয়ে গিয়েছে। সেটি ত্রিশ থেকে চল্লিশ পৃষ্ঠার মধ্যে সংগৃহীত। তিব্বতী ধর্মগুপ্তক পরম্পরার ভিক্ষুণীগণদের এটিকে মুখস্থ করতে হবে। তবে সংঘের তিনটি অনুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রকৃত অনুষ্ঠান-গ্রন্থগুলি অনুবাদ করা দরকার।
যদিও তিব্বতী ভিক্ষুণীগণ মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী হিসাবে দীক্ষা লাভ করতে ইচ্ছুক হবেন, তবে ধর্মগুপ্তক ভিক্ষুণী দীক্ষাকে মূলসর্বাস্তিবাদ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। যদি এই দুটি বিনিময় যোগ্য হতো তাহলে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে মহাসাংঘিক ভিক্ষু দীক্ষা প্রদান না করার জন্য বলা হতো না। (খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাজা বোধিপ্রভ (জাঙ্ছুব হোদ্) দ্বারা যখন ভারতীয় আচার্য অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তখন রাজার পিতামহ রাজা জ্ঞানপ্রভ (য়েশে হোদ্) ইতিমধ্যেই মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষার পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। পরবর্তীকালে পূর্ব ভারতীয় আচার্য ধর্মপালের পরিদর্শনের সময়ও সেটা করা হয়েছিল। ঐ সময় অতীশকে মহাসংঘের ভিক্ষু দীক্ষা প্রদান না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল কেননা তার কারণে তিব্বতে দুটি বিনয় পরম্পরা প্রবর্তিত হয়ে যেত।
আরও, যদি ধর্মগুপ্তক দীক্ষা মূলসর্বাস্তিবাদ দীক্ষা হতো তাহলে থেরবাদ দীক্ষাও মূলসর্বাস্তিবাদী দীক্ষা হয়ে যেত। কিন্তু সেরকম হলেও সেটা অযৌক্তিক হবে। আমাদের মূল সর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষাকে বিশুদ্ধভাবে মূলসর্বাস্তিবাদ বিনয় অনুসারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তাহলে এই শীতে আসুন আমরা এরসাথে সম্পর্কিত একটি সম্মেলনে আয়োজন করি তবে সেটা হবে ভারতে, বিশেষ ক’রে বুদ্ধগয়া, সারনাথ অথবা দিল্লীতে। হামবার্গ সম্মেলনের যোগদানকারী আন্তর্জাতিক প্রবীণ সংঘ ছাড়াও আমরা সমস্ত শীর্ষ তিব্বতী সংঘ নেতাদের এবং চারটি তিব্বতী পরম্পরার প্রধান মঠের সমস্ত মঠাধ্যক্ষদের আমন্ত্রণ জানাব, এমনকি বোনপোদেরকেও। বোনপো পরম্পরায় এখনও ভিক্ষুণী আছে। আমরা সব মিলিয়ে প্রায় একশ জন প্রবীণ এবং পরম শ্রদ্ধেয় ভিক্ষু পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানাব। তারপর আমি আন্তর্জাতিক সংঘ প্রবীণদের কাছে অনুরোধ করব যে ভিক্ষুণী দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাদের যুক্তিসঙ্গত বিচার ব্যক্তিগত ভাবে পেশ করেন। এটা খুবই উপকারী হবে। আমরা তিব্বতীরা এই ধরণের সম্মেলনের জন্য অর্থ যোগান দেব এবং সিদ্ধান্ত নেব যে এটিই আয়োজন করতে কারা শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।
বিগত ছাব্বিশ শতক জুড়ে অভিধর্মের পালি এবং সংস্কৃত সংস্করণের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য বিকশিত হয়েছে। আচার্য নাগার্জুন কিছু বিষয় স্পষ্ট করেছেন; পরীক্ষার ভিত্তিতে এই দুটি পরম্পরার মধ্যে অনেক সুস্পষ্ট পার্থক্য করা যেতে পারে। সেই চেতনায় আমরা বুদ্ধ-বচনকে পরীক্ষা করার স্বাধীনতা পেতেই পারি। উদাহরণ স্বরূপ, সুমেরু পর্বত, পৃথিবী সমতল এবং সূর্য ও চাঁদ প্রায় একই আকারের এবং পৃথিবী থেকে প্রায় একই দূরত্বে রয়েছে। এগুলি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি লাসাতে আমার নিজের গৃহশিক্ষকও আমার দূরবীণের মাধ্যমে চাঁদের উপর পর্বতের ছায়া দেখেছিলেন এবং তাদের একমত হতে হয়েছিল যে চাঁদ তার নিজস্ব আলো দেয় না, যেমনটি অভিধর্ম দাবী করে। সুতরাং, নাগার্জুনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সংঘ নিয়ে কোন আলোচনার প্রয়োজন নেই। সূত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য তবে বিনয়ের ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিনয় গ্রন্থের সমস্ত অনুবাদ সর্বজ্ঞকে প্রণাম করা দিয়ে শুরু হয়। এর অর্থ হল বুদ্ধ নিজেই গ্রন্থগুলিকে প্রমাণিত করেছেন, যেহেতু শুধুমাত্র একজন সর্বজ্ঞ বুদ্ধই জানেন কোন্ কোন্ কর্মগুলি অনুশীলন করণীয় এবং কোন্ কোন্ কর্মগুলি পরিত্যাজ্য। অন্যদিকে অভিধর্মগ্রন্থে মঞ্জুশ্রীকে প্রণাম করা হয়েছে। এছাড়াও বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর একটি সংগীতির আয়োজন করা হয়েছিল এবং তার মাধ্যমে বিনয়ে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। বুদ্ধ এটি করার অনুমতি দিয়েছেন এবং সেইজন্য সেখানে অন্যান্য বিন্দু বাড়ানো যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা তিব্বতীরা বোধিসত্ত্বযান এবং তন্ত্রযান অনুশীলন করি। যেখানে তাদের নিজস্ব সংবর আছে। তাদের মধ্যে কিছু বিষয় এবং শিক্ষা পরস্পর এবং বিনয় বিরোধী। এই ধরণের বিষয়ে উচ্চতর সংবর শ্রেণীগুলিকে নিম্নগুলির পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একুশতম শতাব্দীতে যুদ্ধের ধারণাটি পুরনো হয়ে গিয়েছে। এর পরিবর্তে যেকোন বিরোধীতার নিষ্পত্তির জন্য আমাদের সংলাপ প্রয়োজন। আর তারজন্য বুদ্ধি যথেষ্ট নয়। অন্যদের হিতের জন্য আমাদের আন্তরিকতা এবং গভীর আগ্রহেরও প্রয়োজন। আন্তরিক সংলাপের জন্য করুণা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জৈবিক বিষয়ের কারণে নারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি বেশি সংবেদনশীলতা থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, বেশিরভাগ নারীরাই জবাই বা কসাই হয় না। অতএব, আন্তর্জাতিক আলোচনার জন্য নারীদের উপস্থিতি খুবই প্রয়োজন আর এরজন্য আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে।
চার প্রকারের শিষ্য নিয়ে গঠিত বুদ্ধের সংঘে আছে ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, উপাসক এবং উপাসিকা। স্পষ্টতই নারী এবং পুরুষ সমান ভূমিকা পালন করে তবে বর্তমানে তিব্বতীদের মধ্যে চতুর্বিদ সংঘ অসম্পূর্ণ। মূল্যবান মানব জন্মের আটটি এবং দশটি গুণের মধ্যে একটি হল মধ্যদেশে জন্মগ্রহণ করা যেটাকে ভৌগলিকভাবে বা আধ্যাত্মিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ভৌগলিক দৃষ্টিতে তিব্বতকে মধ্যদেশ রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। আধ্যাত্মিকভাবে সংজ্ঞায়িত ভূমির ক্ষেত্রে এটি এমন একটি দেশ বা স্থান যেখানে শিষ্যদের চারটি শ্রেণী সম্পূর্ণ থাকে। স্পষ্টতই, ভিক্ষুণী ছাড়া সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেক তিব্বতীরা বলেন যে যদি ভিক্ষুরা উপস্থিত থাকে তাহলে সেটা একটা মধ্যদেশ হয়ে যাবে, যেহেতু চারটি শ্রেণীর মধ্যে ভিক্ষু শ্রেণী সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি মধ্যদেশের উপমা এবং মূল্যবান মানব জন্মের উপমাকে সংজ্ঞায়িত করে। তিব্বতের পূর্ববর্তী আচার্যদের এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
কোন সংঘও দলের সঙ্গে পরামর্শ না ক’রে আমি তিব্বতী ভিক্ষুণীদের মধ্যে শিক্ষার উন্নতির সূচনা করতে পারি। আমি এটি করেছি এবং ইতিমধ্যে অনেক ভিক্ষুণীরা পান্ডিত্যের উচ্চস্তরে পৌঁছেও গিয়েছেন। মুন্ডগোদে অবস্থিত মঠগুলিতে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে আমাদের অবশ্যই গেশেমা (স্ত্রী গেশে) পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যদিও কয়েকজন প্রবীণ ভিক্ষুরা আপত্তি করেছিলেন কিন্তু আমি তাদের বলেছিলাম বুদ্ধ নারী এবং পুরুষদের ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী হওয়ার সমান অধিকার দিয়েছেন, তাহলে? গেশে এবং গেশেমা হওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকার নয় কেন? আমার মনে হয় সমস্যাটি হল এই প্রবীণ ভিক্ষুগণ এই ধরণের চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত নয়।
ষাটের দশকের গোড়ায় আমি শুধু ভিক্ষুদেরই নয়, ভিক্ষুণীদেরও ডেকেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম যে তারাও দ্বিমাসিক পোষধ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে। ঐ বছরগুলিতে সেখানে কোন ভিক্ষুণী ছিল না যদিও সাধারণতঃ শ্রামণেরিকাদের ভিক্ষু-পোষধে অনুমতি দেওয়া হয় না। তবে আমার গৃহশিক্ষক তাদের অনুমোদন করেছিলেন। সুতরাং আমরা এটার সূচনা করতে শুরু করেছিলাম। দক্ষিণ ভারতের মঠগুলিতে এই নিয়ে বেশ কিছু ব্যঙ্গাত্মক আপত্তি দেখা দিয়েছিল। যেহেতু ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীরা একসঙ্গে এর আগে কখনোও পোষধ অনুষ্ঠান পালন করেননি। তবে এর কারণে কোন ভিক্ষু বস্ত্র ত্যাগ করেননি।
সত্তর দশক থেকে কিছু তিব্বতীরা চীনা পরম্পরা থেকে ভিক্ষুণী দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। আমার তাইওয়ান সফরের একটি প্রধান কারণ ছিল নিজের জন্য সেখানে ভিক্ষুণী পরম্পরা এবং সেখানকার পরিস্থিতি দেখা। আমি লোবসাঙ্ ছেরিঙকে ভিক্ষুণী সংবর বিষয়ে গবেষণা করার জন্য নিযুক্ত করেছিলাম এবং তিনি কুড়ি বছর ধরে এটি করেছেন।। আমরা এরজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমি প্রধান চীনা প্রব্রজিত ভিক্ষুদের একটি আন্তর্জাতিক সংঘ সভার আয়োজনের জন্য অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তারা সেটা করতে পারেনি। পিপলস্ রিপাবলিক অফ চায়না থেকে উদ্ভূত অসুবিধা ও জটিলতার কারণে আমি নিজেও এই ধরণের সভা আয়োজন করতে পারি না। আমার মনে হয়েছিল যে যদি অন্য কোন সংস্থা এমন একটি সভার আয়োজন করত তাহলে সেটা ভালো হতো। অতএব, আমি জামপা ছোডোনকে সেটা করতে বলেছিলাম। সেই হিসাবে একজন স্বাধীন ভিক্ষু যেটা করতে পারতেন সেটা করা হয়েছে। এখন আমাদের প্রবীণ তিব্বতী ভিক্ষুদের কাছ থেকে বিস্তৃত ভিক্ষু ঐক্যমত প্রয়োজন।
শ্রামণের ভিক্ষু এবং শ্রামণেরী ভিক্ষুণী দীক্ষায় এইরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে প্রত্যেককে শ্রদ্ধার সঠিক বিষয়গুলি জানা উচিত। এই দীক্ষা অনুযায়ী যদিও সংবরের ভিত্তিতে ভিক্ষুণীরা শ্রেষ্ঠ, তবুও নতুন শ্রামণের ভিক্ষুদের জন্য তারা শ্রদ্ধার বিষয় হতে পারে না। বোধিসত্ত্ব এবং তন্ত্র সংবর, বিশেষ ক’রে নারীদের অবজ্ঞা না করার তন্ত্র বিষয়টি মাথায় রেখে এটিকেও নতুন ক’রে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এই বিনয় বিন্দুটিকে রাখা একটু অসুবিধাজনক। সুতরাং সংবরের তিনটি সেট রাখার জন্য কিছু ছোটো-খাটো বিষয়ও সংশোধন করা দরকার। আর মূলসর্বাস্তিবাদী ভিক্ষুণী সংবর গ্রহণের আগে তার সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য যারা ধর্মগুপ্তক পরম্পরায় ভিক্ষুণী হয়েছেন তাঁরা সেগুলি পড়তে এবং অধ্যয়ন করতে পারেন। যদিও তাদের ধর্মগুপ্তক পরম্পরা অনুসারে আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। যাইহোক, অভিক্ষুণীদের ক্ষেত্রে এই সংবর বিষয়ে অধ্যয়ন করা নিয়ে এখনও সমস্যা রয়েছে।
এই সমস্ত পরিবর্তন করার সময় বিশেষ ক’রে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা পুনঃ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি শুধুমাত্র কয়েকজন তিব্বতী সংঘের দ্বারা করা হবে না। আমাদের অবশ্যই সংঘের মধ্যে বিভাজন এড়াতে হবে। আমাদের সামগ্রিকভাবে তিব্বতী সংঘের মধ্যে একটি বিপূল ঐক্যমতের প্রয়োজন আর সেইজন্য আমরা সেইদিকে আরও বেশি পদক্ষেপ নিচ্ছি। আপনাদের সকলকে প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ!