ভারতে ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠা

02:53

বুদ্ধ নিজে শুধুমাত্র এই শব্দগুলি “এই-ভিক্ষু (এখানে এসো, ভিক্ষুগণ)” পাঠ ক’রে সর্বপ্রথম ভিক্ষু দীক্ষা প্রদান করেছিলেন। এইভাবে যখন একটি পর্যাপ্ত সংখ্যক ভিক্ষুদের দীক্ষিত করা হল, তিনি স্বয়ং ভিক্ষুদের দ্বারা উপসম্পদ/ উপসম্পদা (ঞেন্‌-পার জোগ্‌পা) দীক্ষা স্থাপন করলেন।

বহু পারম্পারিক বিবরণ অনুযায়ী, যদিও বুদ্ধের মাসী মহাপ্রজাপতি গৌতমী (পালি. মহাপজাপতি গোতমি) বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে ভিক্ষুণী দীক্ষা প্রদান করার জন্য, কিন্তু শুরুর দিকে তিনি তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, মহাপ্রজাপতি পাঁচ’শ জন স্ত্রীদের সাথে মস্তক মুন্ডণ করলেন এবং পীত বস্ত্র ধারণ ক’রে গৃহহীন প্রব্রজিতা (পালি. পব্বজ্জা) রূপে তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন। তারপর প্রজাপতি যখন দ্বিতীয় বার এবং তৃতীয় বার দীক্ষার জন্য অনুরোধ করলেন, তিনি তখনও সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ তার পক্ষ নিয়ে মধ্যস্থতা করলেন। 

চতুর্থবার অনুরোধ করার পর বুদ্ধ এই শর্তে রাজী হন যে তিনি (মহাপ্রজাপতি) এবং হবু ভিক্ষুণীগণদের আটটি গুরু-ধর্ম (পালি. গরু-ধম্ম) পালন করবেন। এরমধ্যে ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুণী সংবর যতদিন পালন করা হোক না কেন ভিক্ষুদের থেকে ভিক্ষুণীরা সবসময় নিম্ন পদ মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। তৎকালীন ভারতের সাংস্কৃতির মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বুদ্ধ এই ধরণের বিধিনিষেধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে সংঘের প্রতি সমাজের অসম্মান এড়ানো যায়। এছাড়াও তিনি ভিক্ষুণীদের রক্ষা করা এবং গৃহস্থদের পক্ষ থেকে সম্মান নিশ্চিত করার জন্যও তিনি উক্ত বিধিনিষেধ প্রবর্তিত করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে নারীরা সর্বপ্রথম তাদের পিতা, তারপর তাদের স্বামী এবং অবশেষে তাদের পুত্রদের নিরাপত্তা/ তত্ত্বাবধানে থাকত। অবিবাহিতা নারীদের পতিতা বলে মনে করা হতো। বিনয়ে ভিক্ষুণী সম্পর্কিত এরকম অনেক ঘটনা আছে যেখানে তাদের পতিতা বলা হয়েছে কারণ তারা কোন পুরুষ আত্মীয়ের নিরাপত্তায় ছিল না। ভিক্ষু সংঘের সাথে ভিক্ষুণী সংঘকে যুক্ত করার পদক্ষেপটি  তাদের একক মর্যাদাকে সমাজের চোখে সম্মানজনক ক’রে তুলেছিল।

কিছু পরম্পরা অনুসারে আটটি গরু-ধম্ম গ্রহণ করার সাথে সর্বপ্রথম ভিক্ষুণী সংবর গঠিত হয়েছিল। অন্য পরম্পরা অনুযায়ী ভগবান বুদ্ধ আনন্দের নেতৃত্বে মহাপ্রজাপতি এবং তার পাঁচশত জন স্ত্রী অনুগামীদেরকে দশজন ভিক্ষুদের কাছে দায়িত্ব ভার দিয়েছিলেন। উভয় ক্ষেত্রেই ভিক্ষুণী দীক্ষার প্রক্রিয়াটি দশজন ভিক্ষু সমুদয় দ্বারা করা হয়েছিল। সাধারণতঃ এই দীক্ষা-প্রক্রিয়াটি ‘একক ভিক্ষু সংঘ দীক্ষা’ নামে পরিচিত। এই দীক্ষা প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের অন্তরায়িক ধর্ম (পালি. অন্তরায়িক ধম্ম) সম্বন্ধীয় প্রশ্নের একটি সূচী জিজ্ঞাসা করা হয়। অন্তরায়িক ধর্ম বলতে এমন কিছু যা ভিক্ষুণীদের সম্পূর্ণ সংবর সমূহকে পালন করতে বাধা সৃষ্টি করে। ভিক্ষু দীক্ষার সময় প্রার্থীদের যে সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয় সেগুলি ছাড়াও সেই প্রার্থী একজন নারী হওয়ার কারণে এরমধ্যে তার দেহতত্ত্ব সম্পর্কিত আরও অনেক প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত থাকে।

যখন কিছু ভিক্ষুণী প্রার্থীরা ভিক্ষুদের ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করলেন তখন বুদ্ধ তাদের জন্য ‘দ্বয় সংঘ দীক্ষা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ভিক্ষুণী সংঘ সর্বপ্রথম প্রার্থী ভিক্ষুণী হতে পারবে কিনা তার উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন করা হতো। একই দিনের পরবর্তী সময়ে একটি যৌথ সভা গঠনের জন্য ভিক্ষুণী সংঘরা ভিক্ষু সংঘে যোগদান করেন। সেখানে ভিক্ষু সংঘ দীক্ষা প্রদান করেন আর ভিক্ষুণী সংঘ সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকেন।

প্রথমদিকে ভিক্ষু সংঘের সংবরে অন্তর্ভুক্ত ছিল শুধুমাত্র প্রকৃতি-সাবদ্য থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ শারীরিক এবং বাচসিক ক্রিয়া যা সকলের জন্য ক্ষতিকারক তাতে সে গৃহস্থ হোক অথবা দীক্ষিত ব্যক্তি। তবে দীক্ষিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এতে ব্রহ্মচর্য সংবর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে-সাথে বুদ্ধ ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সংবর প্রণয়ন  করলেন। এতে অন্তর্ভুক্ত করলেন প্রজ্ঞপ্তি-সাবদ্য অর্থাৎ শারীরিক এবং বাচসিক ক্রিয়া প্রতিটি সমাজের অসম্মান এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দীক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এই ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারী করার অধিকার শুধুমাত্র বুদ্ধেরই ছিল। ভিক্ষুদের চেয়ে ভিক্ষুণীরা বেশি দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন কারণ প্রত্যেকটি অতিরিক্ত সংবর একটি নির্দিষ্ট ঘটনার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ঘটনা একজন ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুণীর অনুচিত আচরণের সাথে যুক্ত ছিল। ভিক্ষুণীদের সংবর গুলিতে ভিক্ষুদের সাথে ভিক্ষুণীদের মিথস্ক্রিয়ায় সাথে জড়িত অনুচিত আচরণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে ভিক্ষু সংবরে পারস্পরিক শর্তাবলী অন্তর্ভুক্ত হয় না।  

Top