জ্ঞান-বিধির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ

বিষয়বস্তুকে আমরা যেভাবে বুঝতে পারি সে বিষয়ে ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের সৌত্রান্ত্রিক পরম্পরার মতবাদকে তিব্বতী গেলুগ পরম্পরা সাত প্রকারে বিশ্লেষণ করেছে। সেগুলি হলঃ

  1. প্রত্যক্ষ জ্ঞান
  2. অনুমান জ্ঞান
  3. পরিচ্ছিন্ন জ্ঞান
  4. অনিয়ত জ্ঞান
  5. মনঃ পরীক্ষা
  6. সন্দেহ বা বিচিকিৎসা
  7. মিথ্যাদৃষ্টি/ মিথ্যাজ্ঞান

কোন বস্তু বা বিষয়কে চিহ্নিত করতে পারা একটি অত্যাবশ্যক দক্ষতা এবং আমরা কী জানি বা না জানি বলে মনে করি না তার মূল্যায়ন করতে সেটা আমাদের সক্ষম করে তোলে। কারণ কোন-কোন সময় আমাদের মন ভুল ধারণা এবং সমারোপ জাতীয় চিন্তায় জট পাকিয়ে থাকে যার বাস্তবের সাথে বেশী সম্পর্ক থাকে না। এইভাবে আমরা স্ব-পরের পক্ষে সমস্যা সৃষ্টি করি। বিশেষ ক’রে যখন আমরা কোন সিদ্ধান্ত নিই বা কোন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি যা ভুল অথবা অপরিণত অবস্থাকেই কোন বিষয়ে আগে থেকেই কোন মনগড়া ধারণা পোষণ করি; তখন সেটা দেখা যায়।

উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন আমাদের কোন একজন বন্ধু আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য রাস্তা দিয়ে আসছে কিন্তু আমরা চোখে চশমা পরিনি, তখন যদি আমরা রাস্তার দিকে তাকাই আমরা দেখব একটা আবছা অবয়ব এগিয়ে আসছে। আমাদের দৃষ্টি বিকৃত হয়ে থাকে। প্রকৃত অবস্থায় কিন্তু কোন আবছা অবয়ব আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে না।

এবার যদি আমরা চশমা পরে নিই এবং পুনরায় রাস্তার দিকে তাকাই হয়তো দেখব লোকটি অনেকটা দূরে আছে এবং তাকে চিনতে পারছি না। আমাদের চাক্ষুষ জ্ঞান এই দৃষ্টিতে বৈধ যে একটি লোক হেঁটে আসছে কিন্তু তিনি আমাদের বন্ধু কি না সেটার সম্পর্কে নিশ্চিত নই। যদি আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের দৃষ্টি নিশ্চিত নয়, তাহলে কে আসছেন সে বিষয়ে বৈধভাবে নিশ্চিত হতে হলে লোকটিকে আরও এগিয়ে আসতে হবে, তখন তাকে চিনতে পারব। আমরা সেক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব এবং আগে থেকেই কোন মনগড়া ধারণা পোষণ করব না।

আমরা আশা করতে পারি যে তিনি আমাদের বন্ধু এবং সেইজন্য আমরা কল্পনা তৈরী করি তিনিই আমাদের মহিলা বন্ধু এবং আমাদের ধারণায় একজন মহিলার অবয়ব কল্পনা করি যিনি রাস্তা দিয়ে আসছেন। কিন্তু ব্যক্তিটির বিষয়ে এই কাল্পনিক জ্ঞান অনেকটা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মতো হলেও সেটা বৈধ নয়। আমরা বিভ্রান্ত হই। আমাদের কাল্পনিক জ্ঞান আমাদের বোকা বানায় এবং ভাবিয়ে তোলে যে ইনি আমাদের বন্ধুই হবেন, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ভুলও হতে পারে।

ধরা যাক, আমাদের মন কোন রকম বিচার বিবেচনা না করে সহজ জ্ঞানের ভিত্তিতে আমাদের শুধু আশা করলেই হবে না যে যিনি আসছেন তিনি আমাদের সেই বন্ধুটিই হবেন বরং আমরা তার অনুমান করতে পারি। আমরা ভাবলাম ওর নিকটে আসার দরকার নেই, নিশ্চিত হবার জন্য অপেক্ষাও করতে হবে না। যুক্তি দিয়ে আমরা এভাবে সমাধান করি যে, এই সময় আমাদের বন্ধুর দেখা করতে আসার কথা ছিল এবং যে মহিলাটি আসছেন সেটি তিনিই হবেন। আমাদের বন্ধু হলেন একজন মহিলা এবং এখনই তার আসার কথা ছিল। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই মহিলাটি নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধু।

আমরা যদি দৃঢ় নিশ্চিত হই যে তিনিই আমাদের বন্ধু কিন্তু তিনি হলেন না, তাহলে আমাদের অনুমান ভুল হয়ে যায়। যদি আমরা প্রকৃত অর্থেই নিশ্চিত না হয়ে থাকি কিন্তু অনুমান করি যে তিনিই আমাদের বন্ধু হবেন এবং তাই যদি হয়, তাহলে আমরা খুব ভাল অনুমান করেছিলাম। তবে আমাদের মনঃপরীক্ষা বৈধ যুক্তি নির্ভর ছিল না। আমরা সেটাকে একটি অবৈধ যুক্তির উপর ভিত্তি করেছিলাম, যে আমাদের বন্ধু তার এখন আমাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। একজন মহিলা আমাদের দিকে হেঁটে আসছেন। তিনি আমার বন্ধু হবেন, কারণ আমাদের বন্ধুটিও মহিলা আর তার এখনই আসার কথা ছিল।

যাইহোক, আমাদের বন্ধুই আসছেন নাকি অন্য কেউ এমন অনিশ্চিতও হতে পারি। এই দুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে দোলাচলেও পড়তে পারি এবং সেটা আমাদের পক্ষে অস্বস্তিকর হবে। এই অবস্থায় আমরা কিছুটা অনিরাপদ বোধ করব কেননা মহিলাটি কে হবেন সেটা আমাদের হাতে নেই। আমরা সেরকম অনুভব করি, কারণ অনিশ্চয়তার মানসিক উপাদানের (চেতসিক) সঙ্গে দোদুল্যমানের মত অনিশ্চয়তা আসলে মনের অশান্ত অবস্থা। এটি আমাদের মনের শান্তি বিঘ্নিত করে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। হতে পারে, আমরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চিন্তিত হতে লাগব।

আমাদের বন্ধু যখন অনেক দূরে থাকেন এবং তাকে দূর থেকে বৈধভাবে চেনার উপায় থাকে না, আমরা তখন কী দেখি? আমরা কি তখন এক মুহুর্তের জন্য কোন রঙিন অবয়ব দেখি এবং তারপরে অপর একটি ভিন্ন রঙিন অবয়ব দেখি? না, আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় দেখি যা আমাদের সাধারণ বুদ্ধির ভিত্তিতে ওকে দেখা, শোনা, গন্ধ নেওয়া, স্পর্শ এবং স্বাদ গ্রহণও করা বলা যেতে পারে এবং সেটা এক সেকেন্ডের জন্য নয় বরং সেটা অনেকক্ষণ থাকতে পারে। না, বিষয়ের দৃষ্টিতে সেটা একটা শরীর, একটা মানব শরীর, একটা নারী মানব। আমরা কি রাস্তায় একটা শরীরকে হাঁটতে দেখি? না, আমরা শরীরের উপর একজন মানবকে দেখি। তাহলে, কোন ব্যক্তি কি শুধুমাত্র একটা শরীর? না, ব্যক্তি হল একটা সম্পূর্ণ বিষয় এবং আমাদের সাধারণ জ্ঞান অনুসারে যার মধ্যে থাকে চিত্ত, আবেগ অনুভূতি ইত্যাদি আর সেটা একটা লম্বা সময় পর্যন্ত টিকে থাকে।

ধরাযাক, আমাদের দিকে যিনি হেঁটে আসছেন আসলে আমাদের বন্ধু মেরি। আমরা যখন তাকে দেখি, তখন কি আমরা কোন ব্যক্তিকে দেখি, না মেরিকে দেখি? যাকে আমরা দেখছি তিনি অন্য কেউ নন, আসলে তিনি মেরি। যদি আমরা জিজ্ঞাসা করি যে তিনি কে, তিনি সহমত হবেন এবং অন্যরাও একমত হবেন যারা তাকে চেনেন। কিন্তু যখন তিনি আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকেন এবং তাকে চেনা যায় না তখন যাকে আমরা দেখছি তিনি মেরি কি না তা জানি না। যাইহোক, আমরা মেরিকে দেখছি। আমরা অপর কোন ব্যক্তিকে দেখছি না এবং কাউকে দেখছি না তা নয়।

যখন আমাদের বন্ধুটি খুবই কাছে আসেন এবং আমরা বৈধভাবে দেখতে পাই যে তিনি মেরি তখন তিনি যে মেরি সেটা কীভাবে বুঝতে পারি? কল্পনার মাধ্যমে ঐ বিশেষ ব্যক্তিটিকে আমরা জানতাম। এর অর্থ হল, মানসিক ধারণার মাধ্যমে আমরা ঐ বিশেষ ব্যক্তির চিহ্নিতকরণ তৈরী করি। যখনই আমরা তার দেহটি দেখি, তার কণ্ঠস্বর শুনি অথবা তার দেহের কোন অংশ স্পর্শ করি, তখন তিনি কী করছেন বা বলছেন অথবা আমাদের কী অনুভূতি হল, সেসব কিছুই একজন বিশেষ ব্যক্তির পরিচায়ক বলে আমরা ধরে নিই। ধারণা গঠনের এই পর্যায় হল স্থির, তার কোন পরিবর্তন হয় না। আমরা কী দেখছি বা তিনি কি করছেন এতে কোন বিশেষ পার্থক্য হয় না। এছাড়াও চিহ্নিত করণের এই পর্যায়টির সঙ্গে ‘মেরি’ নামটিও যুক্ত হয়ে থাকে। যখনই আমরা তাকে দেখি বা শুনি অথবা তাকে স্পর্শ করি আমরা তাকে এই নামে চিনতে পারি।

ইনি যে মেরি সেটা আমাদের মন-মস্তিষ্ক কীভাবে ধরে নেয়? আমরা যে ব্যক্তিকে দেখি তার কিছু অসাধারণ বা সকলের মধ্যে পাওয়া যায় না এমন কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করি এবং ‘মেরি’ এর কিছু যৌগিক বৈশিষ্ট্যও চিহ্নিত করে ফেলি (পঞ্চস্কন্ধাত্মক বৈশিষ্ট্য, রূপ ইত্যাদি) যা অন্যদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আর যৌগিক বৈশিষ্ট্য হল এমন একটি বস্তু যা সকলের মধ্যে থাকলেও একটি শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যখনই আমরা মেরিকে দেখব, কথা বলব বা তার বিষয়ে চিন্তা করব এই স্কন্ধাত্মক যৌগিক বিষয়গুলি সবসময় থাকবে। যুক্তির উপর নির্ভর করে আমরা অনুমান করব যে ইনি হলেন মেরি। যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে এই এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি থাকে এবং তার সঙ্গে এই এই যৌগিক বৈশিষ্ট্যগুলি যুক্ত হয় তবেই তিনি উক্ত শ্রেণীর মেরি হবেন।

যদি আমরা ভুলবশতঃ ভাবি যে তিনি ছিলেন সুজান তাহলে মেরিকে যখন দূর থেকে দেখলাম তখন সুজানের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলির শ্রেণীতেই তাকে দেখেছি। বিবেচনা ভুল করায় আমরা মেরির অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা একান্তই মেরির, তা সুজানের বৈশিষ্ট্য মনে করেছি। তার ভিত্তিতে আমরা ভুলবশতঃ অনুমান করি যে ইনি সুজান। এর কারণ হল আমাদের পূর্ববর্তী যুক্তি যে সুজানের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি এরকম ছিল, সেটা ভুল ছিল। এই ভুলের কারণে আমরা মেরিকে সুজানের শ্রেণীতে ফেলেছি বা অন্যকথায় বলতে গেলে আমরা সুজানকে মেরিতে প্রক্ষেপণ করেছি। মেরিকে সুজান ভাবায় আমাদের ধারণাগত জ্ঞানটি ভ্রান্তিজনক ছিল। যদিও তিনি দেখতে সুজানের মতো, কিন্তু সেটা সঠিক ছিল না।

মেরি যখন কাছে আসে তখন আমরা তাকে সঠিকভাবে চিনতে পারি যে তিনি মেরি, সুজান নন। তিনি সুজানের ধারণা অস্বীকার করে দেয়। কীভাবে আমাদের মধ্যে তার জ্ঞান হয়? প্রথমতঃ, যদি আমরা সুজানকে আগেই দেখে থাকি তবে ইনি যে সুজান নন সেটা জানতে পারি। যদি তাকে আগে থেকে না জানি তাহলে ইনি সুজান নন সেটা বলতে পারব না, তখন ইনি মেরি ‘সুজান নন’ এটুকুই বুঝতে পারব। আমরা যখন দেখে নিশ্চিত হই যে ইনি মেরি অন্য কেউ নন এই বোধে সুজান সহ অন্যদের অস্বীকার করি। যখন পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে দেখি ইনি মেরি তখন পূর্বেকার ধারণা যা ছিল- ইনি হয়তো সুজান সেটা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করি। প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা মেরিকে স্পষ্টতর চিনতে পারা, একই সঙ্গে ইনি সুজান নন এই বোধ নিহিত থাকে, এবং ইনি মেরি ছাড়া অন্য কেউ নন এরকম উপায়ে আমরা মেরিকে পূর্ণতঃ চিনতে পারি। পূর্ণতঃ বা নিশ্চিন্ত বলতে বোঝায় যে মেরি আমাদের জ্ঞানে উদয় হয়। জ্ঞানে অস্পষ্টভাবে নিহিত থাকার অর্থ হল ইনি সুজান নন বা অন্য কেউ নয়। মেরি ছাড়া সুজান বা অন্য কারও অনুপস্থিতিতে কোন শূন্যতার উদয় প্রকৃতপক্ষে হয় না।

তাছাড়া আমরা যখন শুরুতেই চিনতে পারি যে ইনি হলেন মেরি, তখন আমাদের অনুমানের কাল্পনিক জ্ঞানটি একেবারে তাজা থাকে। আমরা চিন্তা করিঃ “ও, ওই তো মেরি আসছে। এরপর আমরা আর সক্রিয়ভাবে কোন অনুমান করি না। এখন আমাদের মধ্যে জাগলো পরিচ্ছিন্ন জ্ঞান এবং তাই জানতে পারলাম ইনি মেরি এবং আমাদের জ্ঞানটি আর একেবারে তাজা রইল না। আমরা জানি যে ইনি মেরি, কিন্তু আমাদের এই জ্ঞান আর সচেতন থাকে না যেমন প্রথমে উপলব্ধি করার ছিল।

জ্ঞানের সাতটি পথ বা মার্গ এবং কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেটা কার্যকর ও চিহ্নিত করতে সহায়ক হয় সেটা উক্ত উদাহরণগুলি ব্যক্ত করে।

Top