ধ্বংসাত্মক আচরণের সংজ্ঞা
নৈতিকতার প্রতিটি ব্যবস্থায় কী গ্রহণযোগ্য এবং কী গ্রহণযোগ্য নয় তার বিভিন্ন ধারণার ভিত্তিতে ধ্বংসাত্মক আচরণের নিজস্ব তালিকা আছে। ধর্মীয় এবং নাগরিক ব্যবস্থা স্বর্গীয় কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রপ্রধান বা কোন ধরণের আইনসভা থেকে প্রাপ্ত আইনের উপর ভিত্তি করে। আমরা যখন সেটা অমান্য করি তখন আমরা দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাই এবং আমাদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে যখন আমরা আনুগত্য হই তখন আমাদের স্বর্গে বা এই জীবনে একটা নিরাপদ ও ঐক্যতান সমাজ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। মানবতাবাদী ব্যবস্থাগুলি অন্যের ক্ষতি না করার দিকে মনোনিবেশ করে তবে এতেও সমস্যা আছে। আমরা কি সবসময় বিচার করতে পারি যে, কোনটা সত্যিই ক্ষতিকারক বা কোনটা কারও পক্ষে সহায়ক? উদাহরণস্বরূপ, কারও প্রতি চিৎকার করাটা তাদের অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে আবার এটা তাদের কোন বিপদ এড়াতেও সহায়তা করতে পারে।
বৌদ্ধ নৈতিকতা আত্মবিধ্বংসী আচরণ থেকে বিরত থাকার উপর জোর দেয়, বিশেষ করে এমন ভাবে কর্ম করা থেকে যা অবশেষে আমাদের ক্ষতি করে। ধরুন, আমরা যদি ঐ ড্রাইভারটির দিকে চিৎকার করি যে আমাদেরকে রাস্তা পাস করে দেওয়ার চেষ্টা করুন এটা আমাদের এক মুহুর্তের জন্য একটু ভালো অনুভূতি যোগাতে পারে কিন্তু এটা আমাদের মনকে অস্থিরও করে তোলে এবং আমাদের শক্তিকেও নাড়া দেয়। এরফলে হতে পারে আমরা আমাদের মানসিক শান্তি হারিয়ে ফেলতে পারি। আমরা যখন চিৎকার করার অভ্যাস তৈরী করি তখন মন খারাপ না করে কোন অসুবিধা সহ্য করতে আমরা অক্ষম হয়ে উঠি। এটা শুধু অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্ককেই নয় বরং আমাদের নিজের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে।
অন্যদিকে যখন আমাদের আচরণ অন্যদের প্রতি প্রকৃত উদ্বেগ অর্থাৎ মৈত্রী, করুণা এবং জ্ঞান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় আমরা স্বাভাবিকভাবে চিৎকার করা থেকে বিরত থাকি এমনকি যদি আমরা এটা করার মতো বোধ করি, আমরা অনুগ্রহ পূর্বক সেই ড্রাইভারটিকে যেতে দিতে পারি। এরফলে ড্রাইভারটি সন্তুষ্ট বোধ করে এবং আমাদেরও উপকার হয়। মূলতঃ সুখী মনের অধিকারী হয়ে আমরা শান্ত হই এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকি। চিৎকার এবং হতাশার সমাপ্তি পর্যন্ত আমরা আমাদের ইচ্ছাকে দমন করি না বরং আমরা দেখতে পাই যে রাস্তায় প্রত্যেকেই সমানভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছতে চায় এবং সেইজন্য আমরা আমাদের একটা রেস বা দৌড় প্রতিযোগীতা আয়োজন করার চেষ্টা করার ব্যর্থতা এবং অর্থহীনতা বুঝতে পারি।
বৌদ্ধধর্ম ধ্বংসাত্মক আচরণকে সংঘাতজনক আবেগ এবং নেতিবাচক অভ্যাসের প্রভাবের অধীনে বাধ্যতামূলক ভাবে কর্ম করা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। কোনটা ক্ষতিকারক এবং কোনটা সহায়ক আমরা তার সঠিকভাবে পার্থক্য বা বিচার করি না কারণ আমরা সবচেয়ে ভালোটা জানিই না অথবা সম্ভবতঃ আমরা জানি কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও আত্মনিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি অভাব থাকে। লোভ এবং ক্রোধ, এগুলি হল প্রধান বিরক্তিকর আবেগ। এগুলির সাথে আছে আমাদের কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করার পরিণতি সম্পর্কে নির্বোধতা, কারণ এগুলি ঐ সমস্যা সৃষ্টিকারী আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। সর্বোপরি প্রায়শই আমাদের স্ব-মূল্যবোধের অনুভূতি হয় না এবং সেইজন্য আমরা কীভাবে আচরণ করি সে বিষয়ে মোটেই পরোয়া করি না। যাইহোক না কেন আমাদের একটা মনোভাব আছে যেখানে আমরা কয়েকটা অতি মাত্রায় বস্তু ব্যতীত অন্য কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। যেমন- আমরা কেমন পরিধান ধারণ করি, আমাদের চুলটা দেখতে কেমন লাগে, কে আমাদের বন্ধু ইত্যাদি। আমরা অবশ্যই পরোয়া করি না যে আমাদের আচরণ কীভাবে আমাদের প্রজন্মের উপর অথবা আমাদের লিঙ্গ, বর্ণ, জাতীয়তা, ধর্ম বা আমরা কোন গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তাতে প্রতিফলিত করে। আমাদের মধ্যে স্ব-মর্যাদা এবং আত্ম-সম্মানের অভাব আছে।
দশটি ধ্বংসাত্মক কর্মের পারম্পারিক তালিকা
অনেক শারীরিক, বাচিক এবং মানসিক ক্রিয়া আছে যেগুলি হল ধ্বংসাত্মক। বৌদ্ধধর্ম দশটিকে সবচেয়ে ক্ষতিকারক রূপে বর্ণনা করে। এগুলি ক্ষতিকারক কারণ তারা প্রায়শই বিরক্তিকর অনুভূতি, নির্লজ্জতা, বিব্রতের অভাব এবং অযত্নশীলতা থেকে উত্থাপিত হয়। এগুলি গভীরভাবে অন্তর্নিবদ্ধ অভ্যাস থেকে উদিত হয়। ফলস্বরূপ আমাদের নেতিবাচক প্রবণতাগুলিকে শক্তিশালী করে তোলে। দীর্ঘমেয়াদে আমাদের ধ্বংসাত্মক আচরণের ফলে একটা অসুখী জীবন গড়ে তোলে যেখানে আমরা নিজেরাই অনবরত সমস্যার সৃষ্টি করে চলি।
তিনপ্রকারের শারীরিক আচরণ যেগুলি হ’ল ধ্বংসাত্মকঃ
১। প্রাণাতিপ্রাত- অন্য ব্যক্তি থেকে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড় পর্যন্ত। এরফলে আমরা যাকে অপ্রীতিকর মনে করি এমন কোন কিছুর প্রতি আমাদের ধৈর্য থাকে না; আমরা পছন্দ করি না এমন কোন কিছুর প্রতি আমাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জাগে যে এটাকে উদ্ভাবন করা এবং ধ্বংস করা দরকার; প্রায়শই আমরা মারামারিতে যুক্ত হই।
২। অদত্তাদান- চুরি করা, আমরা যা ধার করেছি সেটাকে ফেরত না দেওয়া, বিনা অনুমতিতে অন্য কারও কোন বস্তু ব্যবহার করা ইত্যাদি। পরিণামস্বরূপ, আমরা সর্বদা দরিদ্র এবং ক্ষতিগ্রস্থ বোধ করি; কেউ আমাদের কোন কিছু ঋণ দেয় না; অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক মূলতঃ পারস্পরিক শোষণের ভিত্তিতে পরিণত হয়।
৩। অব্রহ্মচর্য- ধর্ষণ, ব্যভিচার, অজাচার ইত্যাদি। ফলস্বরূপ আমাদের যৌন সম্পর্ক বেশীরভাগ স্বল্পমেয়াদী হয় এবং আমরা ও আমাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী উভয়ই একে অপরকে আপত্তি জানায়; আমরা মূলতঃ অপ্রীতিকর জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠি।
বাচিক আচরণ চার প্রকারের হয় যেগুলি হ’ল ধ্বংসাত্মকঃ
১। মৃষাবাদ (মিথ্যা কথা বলা)- জেনেশুনে যা অসত্য সেটা বলা, অন্যকে বিভ্রান্ত করা ইত্যাদি। এর ফলে আমরা যা কিছু বলি কেউ সেটা বিশ্বাস করে না বা আস্থা দেখায় না। ঠিক তেমনই অন্যরা যা কিছু বলে আমরা তাতে বিশ্বাস করি না। আমরা বাস্তবতা এবং আমাদের নিজের মন গড়া বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম হয়ে উঠি।
২। পৈশুন্য (বিভাজনমূলক ভাবে কথা বলা)- অন্যের সম্পর্কে খারাপ কথা বলা যাতে তারা একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা তাদের শত্রুতা অথবা বিপর্যয়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, আমাদের বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় না কারণ আমাদের বন্ধুরা সন্দেহ করে যে, তাদের পিছনে তাদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলে থাকি; আমাদের কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকে না। এর ফলে আমরা বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ বোধ করি।
৩। পারুষ্য বচন (কঠোরভাবে কথা বলা)- এমনভাবে কথা বলা যা অন্যের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। পরিণামস্বরূপ, মানুষ আমাদের অপছন্দ করে এবং ত্যাগ দেয়। আমাদের সাথে থাকা সত্ত্বেও তারা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না এবং প্রায়শই তারা বলে যে আমাদের কাছে অপ্রীতিকর জিনিসটা আবার ফিরে এসেছে।
৪। সম্ভিন্নপ্রলাপ (নিরর্থক বক-বক করা)- অনর্থক কথা-বার্তার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের ও অন্য লোকেদের সময় নষ্ট করা; অন্যরা যখন ইতিবাচক কিছু করে তখন আমরা আমাদের অর্থহীন কথা-বার্তা দ্বারা বাধা সৃষ্টি করি। ফলস্বরূপ, কেউ আমাদের গুরুত্ব সহকারে নেয় না। আমরা কোনও কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে অক্ষম হয়ে যাই; আমরা অর্থপূর্ণ কোনও কিছুই সাধন করতে পারি না।
চিন্তা-ভাবনা করার তিনটি উপায় রয়েছে যেগুলি হ’ল ধ্বংসাত্মকঃ
১। লোভের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- হিংসার কারণে, আবেশের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা এবং পরিকল্পনা করা যে, অন্যের মধ্যে বিদ্যমান কোনও জিনিস বা কোনও গুণ কীভাবে লাভ করা যায় বা আরও উন্নতি করা যায় বা সেটাকে অতিক্রম করা যায়। এর ফলে আমাদের মধ্যে কখনই মানসিক শান্তি জাগে না বা আনন্দ বোধ হয় না, কারণ আমরা সর্বদা অন্যের সাফল্য সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তায় পীড়িত হই।
২। বিদ্বেষের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- কীভাবে অন্য কাউকে আঘাত করা যায় অথবা তারা যা বলেছে বা করেছে সেগুলি কীভাবে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হয় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও ষড়যন্ত্র করা। এর ফলে আমরা কখনও নিরাপদ বোধ করি না বা স্বচ্ছন্দ থাকতে পারি না; আমরা নিয়মিতভাবে পাগলপনা ভাব এবং ভয়ে-ভয়ে জীবন-যাপন করি; আমরা ভয়ে থাকি যে অন্যরাও আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
৩। বিকৃতি এবং বিরোধিতার সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- কেবল একগুঁয়েমি হয়ে এমন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করা যা সত্য এবং সঠিকের বিপরীত, বরং তার পাশাপাশি অন্যদের সাথে আমাদের মনে বিতর্ক জাগে যারা আমাদের সাথে একমত নয় এবং আক্রমণাত্মক পদ্ধতিতে তাদের নত করে দেওয়া। পরিণামস্বরূপ, আমরা সঙ্কীর্ণ মনের মানুষ হয়ে যাই; কোনও সহায়ক পরামর্শ বা উপদেশ সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়, আমাদের হৃদয় একইভাবে অন্যের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, সবসময় শুধু নিজেদের কথা ভাবি এবং সেটা সঠিক মনে করি; আমরা এইভাবে মূর্খ এবং বোকা হয়ে থাকি।
আমাদের ধর্মীয় পটভূমি বা বিশ্বাস নির্বিশেষে, যে সুখী জীবন-যাপন করতে চায় তাকে এই দশটি কর্ম থেকে বিরত থাকা প্রাসঙ্গিক।
ধ্বংসাত্মক আচরণের দশটি বিস্তৃত বিভাগ-
দশটি ধ্বংসাত্মক কর্ম পরামর্শ দেয় যে, আমাদের দশটি বিস্তৃত বিভাগের আচরণ ত্যাগ করা দরকার। আমাদের আচরণ এবং তাদের পরিণতি সম্পর্কে আমাদের যতটা সম্ভব বিস্তৃতভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। এখানে ভাবার জন্য কয়েকটি উদাহরণ প্রস্তুত করা হয়েছে, তবে আমি নিশ্চিত যে, আমরা প্রত্যেকে এই তালিকা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি।
১। প্রাণাতিপাত- মানুষকে রুক্ষভাবে মারধর করা এবং তাদের সাথে রুক্ষভাবে আচরণ করা; যখন কোনও ব্যক্তির শারীরিক কাজ করার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখন তাকে সেই কাজ করার জন্য সহায়তা করতে উপেক্ষা করা; অসুস্থ বা প্রবীণ ব্যক্তির সাথে খুব দ্রুত হাঁটাচলা করা এবং শারীরিক স্তরে ক্ষতি করা; পরিবেশ দূষণ করা ও যারা ধূমপান করে না তাদের সান্নিধ্যে ধূমপান করা, বিশেষ করে বাচ্চাদের সান্নিধ্যে।
২। অদত্তাদান- ইন্টারনেট থেকে অবৈধভাবে উপাদান ডাউনলোড করা, অন্যের রচনা চুরি করা, প্রতারণা করা, কর ফাঁকি দেওয়া, অন্যের গোপনীয়তায় আক্রমণ করা, এমনকি জিজ্ঞাসা না করে নিজের সঙ্গীর বা বন্ধুর প্লেট থেকে স্বাদ গ্রহণ করা।
৩। ব্যভিচার- কাউকে যৌন হয়রানি করা, প্রেম করার সময় সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তার উপেক্ষা করা এবং খুব কম বা বেশি স্নেহ প্রদর্শন করা।
৪। মৃষাবাদ- কাউকে আমাদের সত্য অনুভূতি বা তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতারণা করা।
৫। পৈশুন্য- ইতিবাচক বা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এমন কোন কিছুর সমালোচনা করা যে কেউ এর সাথে জড়িত বা কিছু করার পরিকল্পনা করছে এবং তাদের এতে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করা।
৬। পারুষ্য বচন- মানুষের দিকে চিৎকার করা, আক্রমণাত্মক সুরে কথা বলা; যখন কেউ আবেগগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তার প্রতি অসহানুভূতিশীলতার সাথে এবং সমালোচনামূলক ভাবে কথা বলা; অনুপযুক্ত সংঘের মধ্যে বা অনুপযুক্ত সময়ে বাজে বা বিদ্রুপমূলক ভাষা ব্যবহার করা।
৭। সম্ভিন্নপ্রলাপ- অপরের আত্মবিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং অপরের কাছে তাদের অন্তরঙ্গ গোপনীয়তা প্রকাশ করা; তুচ্ছ বিষয় সম্পর্কে অন্যকে বার্তা পাঠানো বা বার্তা দেওয়া, বিশেষ করে মধ্য রাতে; আমাদের দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছ বিষয় সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটো ছাড়া এবং মন্তব্য করা; অন্যরা যা বলে তাকে সেটা শেষ করার আগেই বাধা দেওয়া এবং গম্ভীর কথোপকথনের সময় নির্বোধ মন্তব্য করা বা বোকামী কথা বলা।
৮। লোভের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- এইরকম আশা করা যে আমরা রেঁস্তোরায় যে ব্যক্তির সাথে খাচ্ছিলাম সে আমাকে তার খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা এবং পাণীয় বস্তুর চুমুক দেওয়ার সুযোগ দেবে যা কিছু সে আদেশ দিয়েছে; সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের বিষয়ে যে সমস্ত কিছু উত্তেজনাপূর্ণ এবং আশ্চর্যজনক ফটো এবং লেখা ছাপে সেই পোষ্টগুলো দেখে দুঃখ বোধ করা আর ঈর্ষাপূর্বক চিন্তা করা যে কীভাবে আমি জনপ্রিয় এবং সুখী হতে পারি।
৯। বিদ্বেষের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- যখন কেউ আমাদের অশ্লীল বা নিষ্ঠুর কিছু বলে আমরা বাক্শূন্য হয়ে যাই এবং পরে মনে-মনে ভাবতে লাগি ঐ কথার প্রতি উত্তরে আমার কী বলা উচিত ছিল যা সেই ব্যক্তিকে আঘাত করত।
১০। বিকৃতি এবং বিরোধিতার সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- আমরা কিছু করতে পারি এমন কিছু করার জন্য যখন ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করে বা করার চেষ্টা করে যেটার সম্পর্কে আমরা অনুভব করি যে আমরা নিজেরাই পরিচালনা করতে পারি তখন সেটাকে নেতিবাচক মনে করা বা প্রতিকূলভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। কিছু ক্ষেত্রে যা ক্ষতিকারক নয় সেই বিষয়ে উন্নতি করার চেষ্টা করাটা বোকামী মনে করা এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা।
নিজেদের প্রতি ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করা আমরা
আমাদের প্রতি যেভাবে আচরণ করি সেগুলি ঠিক একইভাবে ধ্বংসাত্মক হতে পারে যখন আমাদের আচরণকে অন্যের দিকে লক্ষ্য করা হয়। সুখী জীবন-যাপন করার জন্য আমাদেরকে এই নেতিবাচক নিদর্শনগুলি সনাক্ত করতে হবে এবং সেগুলিকে সংশোধন করার জন্য কাজ করতে হবে। পুনরায় কর্ম করার দশটি ধ্বংসাত্মক উপায় যা আমাদের পরামর্শ দেয় যে আমাদের কোন ধরণের আচরণ বন্ধ করতে হবে।
১। প্রাণাতিপাত- অত্যধিক পরিশ্রম করে, স্বল্প খাবার খেয়ে, ব্যায়াম না করে বা পর্যাপ্ত না ঘুমিয়ে শারীরিকভাবে নিজেদের সাথে খারাপ আচরণ করা।
২। অদত্তাদান- তুচ্ছ বস্তুর উপর অর্থ অপচয় করা বা কৃপণতা করা, বা নিজের জন্য কম ব্যয় করা যেটা দরকার হয় না।
৩। ব্যভিচার- এমন যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া যা আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে বা অশ্লীল রচনার মাধ্যমে আমাদের মনকে দূষিত করা।
৪। মৃষাবাদ- আমাদের অনুভূতি বা অনুপ্রেরণা সম্পর্কে নিজেদের ফাঁকি দেওয়া।
৫। পৈশুন্য- এমন অশ্লীলভাবে কথা বলা, যেমন- সর্বক্ষণ অভিযোগ করা, যার ফলে অন্যরা আমাদের সাথে থাকাটা অপ্রীতিকর মনে করে এবং তারা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করে দেয়।
৬। পারুষ্য বচন- মৌখিকভাবে নিজেদের গালাগালি দেওয়া।
৭। সম্ভিন্নপ্রলাপ- আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নির্বিচারে কথা বলা; সন্দেহ বা উদ্বেগ প্রকাশ করা; সোশ্যাল মিডিয়া, চৈতন্যহীন ভিডিও গেম খেলা, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট দেখে বহু সময় নষ্ট করা।
৮। লোভের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- নিখুঁত হওয়ার কারণে কীভাবে নিজেদের অতিক্রম করা যায় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।
৯। বিদ্বেষের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- দোষের সাথে ভাবা যে, আমরা কতটা ভয়াবহ এবং তাই আমরা সুখী হওয়ার যোগ্য নই।
১০। বিকৃতি এবং বিরোধিতার সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- নিজের উন্নতি করা অথবা অপরকে সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করাকে নিজেকে বোকা মনে করা।
আমাদের ধ্বংসাত্মক নমুনাগুলিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়
আমরা অতীতে যে সমস্ত ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে আচরণ করেছি যখন সেদিকে নজর দেওয়া শুরু করি তখন নিজের বিষয়ে নেতিবাচক অনুভূতি ত্যাগ করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপরাধবোধে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরিবর্তে আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমরা অজ্ঞানবশতঃ সেগুলি করেছিলাম এবং আমাদের আচরণের পরিণতি সম্পর্কে নির্বোধ ছিলাম; আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে আমাদের বিরক্তিকর আবেগের কারণে পরিচালিত হয়েছি, না কি আমরা সহজাত খারাপ। আমরা যা করেছি তার জন্য অনুশোচনা বোধ করি; প্রার্থনা করি যে এরকম হওয়া উচিত ছিল না; কিন্তু আমরা উপলব্ধি করি যে, আমরা অতীতকে পরিবর্তন করতে পারি না। যেটা হয়ে গেছে সেটা অতীত, তবে এখন আমরা এই ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করার সংকল্প করতে পারি। তারপরে আমরা আমাদের জীবনকে ইতিবাচক দিকে নিশ্চিত করি এবং যতদূর সম্ভব মৈত্রী এবং করুণার উপর আধারিত গঠনমূলক কাজে যুক্ত হতে চেষ্টা করি। এটা আরও বেশী ইতিবাচক অভ্যাস তৈরী করে সমভার করে এবং অবশেষে নেতিবাচক দিকগুলির বাধ্যতামূলক শক্তিকে অতিক্রম করে।
তারপরে আমরা যে সমস্ত মানুষ এবং ঘটনাগুলির মুখোমুখি হই তাদের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার গতি কমিয়ে দিই যাতে আমরা মুক্ত স্থানটি ধরতে পারি যে, আমরা কখন অভ্যাসের বশে ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করার মতো অনুভব করি এবং বাস্তবে কর্ম করি। আমরা এই স্থির করার জন্য সেই মুহুর্তটা ব্যবহার করি যে, কোনটি সহায়ক হবে এবং কোনটি হবে ক্ষতিকারক। এটা আমাদের কিছু ধ্বংসাত্মক করা, বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করে। যেমনকি মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য শান্তিদেব সুপারিশ করেছেন, “কাষ্ঠ-খন্ডের মতো থাকুন।” আমরা যেটা করতে পারি, তবে বোধগম্যতা, মৈত্রী, করুণা এবং নিজেদের ও অপরের প্রতি সম্মানের মাধ্যমে। এর মানে এই নয় যে, আমরা কোনকিছু চাপিয়ে দিই যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলবে। একটা বুদ্ধিমান এবং করুণাময় চিত্ত দ্বারা আমরা নেতিবাচক শক্তির অপসারণ করি যা আমাদের এমন কিছু করতে বা বলতে পরিচালিত করত যার জন্য আমাদের অনুশোচনা করতে হতো। তারপরে আমরা ইতিবাচক আবেগ ও বোধগম্যতার ভিত্তিতে গঠনমূলকভাবে আচরণ করতে মুক্ত হয়ে উঠি।
সারাংশ
আমরা যখন ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকি তখন এটা শুধু অন্যের উপকার করে না, বরং সর্বশেষে এতে আমাদের নিজেদের স্বার্থ থাকে। আমরা যখন দেখি যে, এটা আমাদের নিজস্ব আচরণ যা হচ্ছে আমাদের নিজের অসুখীতার কারণ, আমরা স্বাভাবিকভাবেই, বাস্তবে আমরা ধ্বংসাত্মক এবং নেতিবাচক অভ্যাস এবং কর্ম এড়াতে আনন্দ বোধ করব। আমরা যখন এই অভ্যাসগুলিকে শক্তিশালী হতে বন্ধ করি, তখন অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নতি হয় এবং হয়ে ওঠে আরও খাঁটি আর আমরা নিজের সাথে আরও শান্তি বোধ করি। অতএব আমরা যদি সত্যিই মানসিক শান্তির কামনা করি তাহলে আমাদের ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এই ধরণের কর্ম আমাদের জীবনের মানকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে।