কর্মের পরিচয়

দৈনন্দিন ভাষায় চার আর্যসত্য

আমি আরও একবার জালাপে এসে খুব খুশি এবং এই সন্ধ্যায় আমাকে যে বিষয়টি সম্পর্কে বলতে অনুরোধ করা হয়েছে সেটা হ’ল কর্ম। অবশ্যই, আমরা যখন বৌদ্ধধর্মের কোনও বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করি তখন আমাদের মধ্যে সেটার সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা কেন এটা অধ্যয়ন করতে চাই, এর গুরুত্ব কী এবং এটা বৌদ্ধধর্মের পুরো প্রসঙ্গের সাথে কীভাবে খাপ খায়। বুদ্ধ মূলতঃ প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন- আমরা জীবনে কী অনুভব করি, কী ঘটে চলেছে ইত্যাদি। সবচেয়ে মৌলিক জিনিসটা কী যা আমরা প্রত্যেকেই, সকলেই অনুভব করি, এটা হচ্ছে তাই যে, আমরা কখনও দুঃখী হই আবার কখনও সুখী। আমরা আমাদের জীবনকে এইভাবেই অনুভব করি, তাই নয় কি?

আমরা যদি কখনও অসুখী হওয়া এবং কখনও দুঃখী হওয়ার পরিস্থিতিকে পরীক্ষা করি, আমরা খুঁজে পাই যে, এর সাথে অনেক সমস্যা জড়িয়ে আছে। আমরা যখন অসুখী হই, স্পষ্টতই, এটা হল দুঃখ। কেউ অসুখী হতে পছন্দ করে না, করে কি? বন্ধুর চলে যাওয়ার মতো জিনিস দেখে অথবা কোনও ঘটনা বা অপ্রীতিকর কথা শুনে আমরা অসুখী হতে পারি এবং বিভিন্ন আবেগের সাথে বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ক’রেও আমরা অসুখী হতে পারি। আবার কখনও-কখনও আমরা অসুখী হই কিন্তু আমরা যা কিছু দেখছি বা শুনছি অথবা আমাদের চারিপাশে যা কিছু ঘটে চলেছে তার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এটি একটি সমস্যা, তাই নয় কি?

তাহলে সুখের কী হবে? আমরা কখনও-কখনও সুখ বোধ করি, তাই না? আমরা কোনও জিনিস দেখে, শুনে, প্রিয়জনের কথা শুনে সুখ বোধ করি বা আনন্দিত হই, এবং আমরা কোনও কিছুর সাথে সময় কাটিয়ে ওঠার মতো চমৎকার অবসরকে স্মরণ করার মতো কিছু মনে করে সুখ বোধ করি। কিন্তু আমরা যদি এর দিকে আরও গভীরভাবে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা যে সুখ ভোগ করি সেটার সাথেও কিছু সমস্যা জড়িয়ে আছে। প্রথমতঃ, এটা কখনই স্থায়ী হয় না এবং এটা কতদিন স্থায়ী হতে চলেছে, সেটা আমরা জানি না। আর এটা যথেষ্ট বলে মনে হয় না। আমরা এক চামচ খাবার খেয়ে সুখী হতে পারি, তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়, কারণ আমরা আরও-আরও-আরও বেশী খেতে চাই। আসলে, এটা একটা মজাদার প্রশ্ন- বাস্তবে এটাকে উপভোগ করার জন্য আপনাকে কতটা খেতে হবে? সেটার সম্পর্কে ভাবুন! আরও একটা দোষ, এই সুখের আরও একটা দোষ হ’ল আমরা জানি না যে, এর পরে কী ঘটতে চলেছে। আমরা পরের মুহুর্তে পর্যন্ত অনবরত সুখী হয়ে থাকতে পারি অথবা আমরা দুঃখী হয়েও থাকতে পারি। এটা পরিবর্তন হতে পারে। সুতরাং, এই সুখের কোনও নিরাপত্তা নেই।

আসলে, সুখ এবং দুঃখের এই ধরণের অন্তর্দৃষ্টি বা বিশ্লেষণ, বৌদ্ধ ধর্মের কাছে অসাধারণ কিছু না। বিশ্বের অনেক মহান চিন্তকগণ এর পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এটা শিখিয়েছেন। তবে বুদ্ধ যা শিখিয়েছিলেন, বুদ্ধ যা বুঝেছিলেন সেটা ছিল একটা গভীরতর ধরণের সমস্যা বা দুঃখ। তিনি প্রত্যেকের জীবনের এই উত্থান এবং পতনের পরিস্থিতিটি আরও গভীর ভাবে অবলোকন করেছিলেন যে, সুখ এবং দুঃখের উত্থান এবং পতন হতে থাকে, অনবরত হতে থাকে। পাশাপাশি তিনি যা বুঝেছিলেন সেটা হ’ল উক্ত ঘটনার কারণটি আসলে আমাদের প্রতিটি মুহুর্তের অংশ। অন্য কথায়, আমরা যেভাবে সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতনের সাথে জিনিসগুলি অনুভব করি সেটা ঐ অসন্তুষ্ট পরিস্থিতিকে স্থায়ী করে দেয়।

সুতরাং, বুদ্ধ অবলোকন করেছেন এবং দেখেছেন যে, সেই কারণটা কী যেটা প্রতি মুহুর্তে থাকে এবং যা এই অসন্তুষ্ট পরিস্থিতিকে স্থায়ী করে। আর তিনি বুঝেছেন যে, কারণটা হ’ল বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি। অন্য কথায়, আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, আমাদের চারিপাশে প্রত্যেকে কীভাবে অস্তিত্বে আছে, আর এই জগতটা কীভাবে অস্তিত্বে আছে সেই বিষয়ে বিভ্রান্তি।

আরও অনেকে এটাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে তার থেকে একেবারেই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, অন্য কেউ কেউ বলেছে যে, আমরা যে সুখ এবং দুঃখের উত্থান-পতন অনুভব করি সেটা মূলতঃ পুরস্কার ও শাস্তির কারণে করি অর্থাৎ নিয়ম অনুসরণ করা বা না করার কারণে। অনেক শিক্ষকদের মতে, সুখ বা দুঃখ ভোগ করার মূল বিষয়টা হ’ল আনুগত্য। তবে বুদ্ধ বলেছেনঃ “না, সেটা নয়। আসল কারণটি হচ্ছে বিভ্রান্তি, আনুগত্য হওয়া বা আনুগত্য না হওয়ার বিষয় নয়, বরং এটা হচ্ছে জীবন সম্পর্কে বিভ্রান্তি।” তারপর, বুদ্ধ আরও বলেছেন যে, আমরা জিনিসগুলি কীভাবে অনুভব করি সেটা সম্পর্কিত বিভ্রান্তি আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য এবং প্রয়োজনীয় অংশ নয়। এটাকে সেখানে থাকার দরকার নেই। এটা এমন কিছু যা দূরীভূত করা যায় এবং পুরোপুরি দূরীভূত করা যায় যাতে এটা আর ফিরে না আসে। তারপরে তিনি বলেছেন যে, এটা করার আসল উপায়টি হ’ল জিনিসগুলিকে অনুভব করার জন্য আমাদের পদ্ধতিটাকে পরিবর্তন করা।

এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ আমাদের মুক্ত করার জন্য অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করার বিষয় নয়, বরং মূল বিষয়টা হচ্ছে আমাদের নিজেদের মনোভাব পরিবর্তন করা, বাস্তবতা বিষয়ে নিজেদের বোধগম্যতা পরিবর্তন করা। আমরা যদি সঠিক বোধগম্যতা দ্বারা ভুল বোধগম্যতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারি এবং তারপরে এই বোধগম্যতা বজায় রাখতে পারি, তাহলে আমরা আবিষ্কার করতে পারব যে, এই সুখ-দুঃখের নিয়মিত উত্থান-পতন হয় না আর আমরা উক্ত সুখ-দুঃখের উত্থান-পতনকে স্থায়ী করি না। সুতরাং, এটাই বুদ্ধের খুব প্রাথমিক শিক্ষা যেটাকে দৈনন্দিন ভাষায় প্রয়োগ করা হয়।

আচরণগত হেতু এবং ফলের সাথে কর্ম সম্বন্ধস্থাপন করে

আমরা যখন কর্ম সম্পর্কে কথা বলি তখন কর্ম বলতে একটি মূল ব্যাখ্যাকে বোঝায় যে, কীভাবে এবং কেন আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভবগুলির উত্থান-পতন হয়। অতএব এটাই হচ্ছে কর্ম। অন্য কথায়, কীভাবে আমাদের বিভ্রান্তি এই সুখ-দুঃখ, আনন্দদায়ক এবং অপ্রীতিকর অনুভবগুলির উত্থান-পতন সৃষ্টি করে? অন্য কথায়, এটা হেতু এবং ফলের সাথে সম্বন্ধস্থাপন করে। এখানে হেতু এবং ফল হচ্ছে একটা অত্যন্ত জটিল বিষয়। যেমন- বুদ্ধ বলেছেন, “এক বালতি জল, সেই জলের প্রথম ফোঁটার কারণে পূর্ণ হয় না এবং সেটা শেষ ফোঁটার কারণেও পূর্ণ হয় না। এটা পূর্ণ হয় সমস্ত ফোঁটার সমষ্টির কারণে। একইভাবে আমরা জীবনে যা কিছু অনুভব করি, ভোগ করি সেটা কেবল একটা হেতুর (কারণ) ফল নয় অর্থাৎ হেতুটি শুধুমাত্র একটা জিনিস নয় যা আমরা একটু আগেই করেছি বা অনেক কল্প আগে করেছি। এটা প্রচুর পরিমাণ কার্যকারক এবং প্রত্যয়ের ফলাফল।

এটা আসলে একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এটা যা ব্যাখ্যা করে সেটা হল কোনও ঘটনা এককভাবে ঘটে না, আসলে সবকিছুই একে-অপরের সাথে সংযুক্ত। একটা খুব সাধারণ উদাহরণ যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে, যদি স্প্যানিশরা (স্পেনের বাসিন্দা) আমেরিকাতে না আসত তাহলে আজ আমরা এখানে এই কক্ষে এই বক্তৃতাটি শুনতাম না, শুনতাম কি? আমাদের এখানে একত্রিত হওয়ার এটা একটা কারণ। এর মতো বিভিন্ন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ আছে যার ফলে আমরা এই মুহুর্তে অথবা যেকোনও সময় যা কিছু অনুভব করি তার জন্য অবদান রাখে।

যাইহোক কর্ম হেতু সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে যা বিশেষ ভাবে আমাদের মনের সাথে সংযুক্ত। তবে আরও অনেক কারণ আছে যা আমাদের অনুভব অর্জনে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, দৈহিক কারণ, যেমন- আবহাওয়া ইত্যাদি। আমাদের প্রভাবিত করে এমন অনেক জিনিস আছে যা শুধু আমাদের মন থেকে উদ্ভূত নয় বরং অন্যের মন থেকেও উদ্ভূত। ধরুন, রাজনীতিবিদগণ যারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, ঐ সিদ্ধান্তগুলি আমাদের প্রভাবিত করে এবং সেগুলি কিছুটা বিভ্রান্তির সাথেও মিশে যেতে পারে, তাই নয় কি?

কর্ম বিশ্বাসের কথা বলে না, এটি বলে না নিয়তির কথা ও পূর্ব নির্ধারিত বিষয় এবং এরকম আরও কিছু। বরং আমরা কীভাবে জিনিস অনুভব করি এবং আমরা জীবনে যা অনুভব করি সেই বিষয়ে আমাদের মনোভাব কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করে কর্ম তার সম্পর্কে কথা বলে। কর্ম শব্দটি খুব সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয় যা আচরণগত হেতু এবং ফলের ক্ষেত্রে জড়িত তাদের সবকিছুকে বোঝায়। অন্য কথায়, আমাদের আচরণ এবং মনোভাব থেকে উত্থিত হেতু এবং ফলের সম্বন্ধকে বোঝায়। কর্ম বলতে সাধারণ ভাবে আচরণগত হেতু এবং ফলের পুরো বিষয়টি সম্পর্কিত হতে পারে অথবা এটি পুরো প্রক্রিয়াটির একটা দিককে নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করতে পারে। সুতরাং আমরা যদি কর্মের প্রক্রিয়াটি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের এটাকে আরও নিখুঁত ভাবে দেখতে হবে এবং কিছুটা বিশদের সাথে।

কর্মের ব্যাখ্যার কয়েকটি প্রক্রিয়া

আমরা যখন বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে আরও যথাযথ ব্যাখ্যার সন্ধান করতে শুরু করি তখন আমরা খুব তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করে ফেলি যে, সেখানে কেবল একটি ব্যাখ্যা নেই। এই বিষয়ে কিছু পাশ্চাত্য মানুষ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু আমাদের যদি কোনও সমস্যা বা দ্বিধা থাকে তাহলে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নির্ভর করে এটাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। পাশ্চাত্য দেশে আমরা এটা করে থাকি অর্থাৎ আমরা একটা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, একটা মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিনিসগুলির ব্যাখ্যা করি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এর কারণ হল এই বিভিন্ন ব্যাখ্যা, যা কিছু ঘটে চলেছে, সেই বিষয়টি পুরোপুরি ভাবে বুঝতে সহায়তা করে। এখানে যা কিছু ঘটে চলেছে তার প্রতিটি ব্যাখ্যার পদ্ধতি একটি নির্দিষ্ট ভাবনার প্রক্রিয়ার উপর আধারিত, যেমন- মনোবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আরও অন্যান্য প্রক্রিয়া। আমাদের এখানে বৌদ্ধ ধর্মের কিছু একরকম জিনিস আছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, কর্ম কীভাবে কাজ করে তার জন্য বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব ব্যবস্থার বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। আমাদের কাছে এও আছে যে, পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানের মতো একটি শাখার মধ্যেও ফ্রেডিয়ান মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের আধারে একটি ব্যাখ্যা, জাঙ্গিয়ান মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের আধারে একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আবার কেউ সমাজ তান্ত্রিক উপায়ে অথবা পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে বিষয়গুলির ব্যাখ্যা করতে পারে। আমরা এটা বৌদ্ধধর্মে দেখতে পাই যে, বাস্তবে বেশ কয়েকটি ব্যাবস্থার দিকে নজর দেওয়াটা সহায়ক হয়, কারণ তারা কীভাবে কর্ম সম্পাদন করে তার সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। আমাদের উদ্দেশ্য গুলির জন্য প্রক্রিয়া গুলির পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার প্রয়োজন নেই, তবে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া আছে সেই বিষয়ে সচেতন হওয়া সহায়ক।

অবশ্যই এর অর্থটা খুবই স্পষ্ট যে, আমরা পাশ্চাত্য প্রক্রিয়াগুলি অনুসরণ করতে পারি যা ব্যাখ্যা করে যে, আমাদের অভিজ্ঞতা এখন কেমন চলছে। এটি অগত্যা আমরা কর্ম সম্পর্কে যা বলি তার বিরোধী নয়।

একটা অনুরোধের চৈতসিক রূপে কর্ম

আমরা যখন একটি ব্যাখ্যা অনুসরণ ক’রে কর্মকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্গ, একটা নির্দিষ্ট বিষয় হিসাবে আলোচনা করি তখন কর্ম বললে চৈতসিককে বোঝায়। ‘চৈতসিক’ বলতে আমরা কী বুঝি? চৈতসিক হ’ল কোনও কিছু সম্পর্কে সচেতন হওয়ার একটা উপায়। আসুন একটা উদাহরণ নেওয়া যাকঃ ধরুণ, আমরা কাউকে দেখি এবং দেখে তাদের দিকে হাঁটা শুরু করি। এখানে অনেক চৈতসিক আছে যা এখানে এই অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত। এগুলি হচ্ছে বিভিন্ন দিক যেটা বোঝায় যে, আমরা এই ব্যক্তি সম্পর্কে কীভাবে সচেতন। কিছুটা খুব প্রাথমিক, যেমন- এই ব্যক্তিকে কারও কাছ থেকে আলাদা করা, অথবা প্রাচীর থেকে। আগ্রহ- এটা সেই ব্যক্তির থেকে সচেতন হওয়ার উপায় যা তাদের দেখার সাথে থাকবে। ধ্যান সেখানে থাকতে পারে; বিভিন্ন আবেগ থাকতে পারে। এ সবগুলিই হ’ল চৈতসিক এবং সেই ব্যক্তিকে দেখার মুহুর্তে আর তার কাছে যাওয়ার অন্তর্জাল তৈরী করে।

কোন্‌ চৈত্ত বা চৈতসিককে কর্ম বলা হয়? কর্ম বলতে সেই চৈতসিককে বোঝায় যা আমাদেরকে ব্যক্তির প্রতি আকৃষ্ট করে; এটা হচ্ছে সেই অনুরোধ যা সেই ব্যক্তিকে দেখতে এবং তার কাছে যেতে সহগমণ করে। এই কারণেই কিছু মতবাদ বা সিদ্ধান্ত, কর্মকে প্রায় এক ধরণের দৈহিক বল রূপে ব্যাখ্যা করা হয়। অবশ্যই, সেখানে অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য-এর মতো অন্যান্য চৈতসিক থাকতে পারে। আমরা এই ব্যক্তির সাথে কী করার সংকল্প করি? আমরা তাকে আলিঙ্গন করার সংকল্প করতে পারি অথবা আমরা তার মুখে ঘুষি মারার সংকল্প করতে পারি। এরকম অনেক চৈতসিক আছে যা এর সাথে জড়িত, কিন্তু কর্ম হচ্ছে এই মানসিক অনুরোধ যা আমাদেরকে আলিঙ্গন বা ঘুষি মারার ক্রিয়াটির দিকে আকৃষ্ট করে, যেমন- আমরা তাদের দেখছি এবং তাদের দিকে যাচ্ছি। এছাড়াও, মনে রাখবেন যে, মানসিক অনুরোধ শুধু আলিঙ্গন করা বা ঘুষি মারার মতো শারীরিক ক্রিয়াগুলির জন্য নয়। সেখানে একটা প্রেরণামূলক মানসিক অনুরোধ বা তাগিদও থাকতে পারে যার সাথে আমরা কোনও কিছুর চিন্তাভাবনা করি; এটা শুধু কিছু বলা বা শারীরিক ভাবে কিছু করার ক্ষেত্রে নয়। আমরা কোনও চিন্তাভাবনা করছি কি না, আমরা কিছু বলছি কি না অথবা আমরা শারীরিকভাবে কিছু করছি কি না, এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে কোনও এক ধরণের মানসিক তাগিদ জড়িয়ে থাকে।

কার্মিক আচরণের ফল

বিজ্ঞানের মতো বৌদ্ধধর্মও হেতু এবং ফলের বিষয়ে কিছু শেখায়। সুতরাং যদি কর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হই, এই অনুরোধ, যেমন- আমরা কিছু করি, কিছু বলি এবং কিছু ভাবি, তাহলে তখন সেখানে একটা ফল থাকতে পারে। কর্ম বলতে অন্যের উপর আমাদের আচরণের ফল সম্পর্কে বেশী কথা বলা নয়, যদিও এটা অবশ্যই অন্যের উপর ফলপ্রসূ হয়। এর কারণ হচ্ছে, সত্যিই আমরা অন্যের সাথে যা কিছু করি উক্ত কর্মের ফল সেই ব্যক্তির উপর তদনুরূপ অংশে ফলপ্রসূ হয়। আমরা অন্য ব্যক্তির সাথে যা করি তার কিছু প্রভাব শারীরিক কারণে ফলপ্রসূ হয়; যেমন- আপনি কাউকে আঘাত করলেন আপনার চামড়া ক্ষতস্থ হয়ে গেল। এটা কেবল শারীরিক হেতু এবং ফল। আমরা এর বিষয়ে কর্মকে নিয়ে কথা বলছি না। কিন্তু অন্য ব্যক্তির উপর এর ফল কীভাবে ফলিভূত হয়, যেমন- আমরা যা কিছু বলি অথবা যা কিছু করি, তারা কী অনুভব করে সেটা তাদের উপর নির্ভর করে, তাই না? উদাহরণস্বরূপ, আমরা কাউকে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক কিছু বললাম যার ফলে তাদের অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করতে পারে; এর কারণে তারা মর্মাহত হতে পারে। তবে তারা এও ভাবতে পারে যে, তারা একেবারে বোকা। তাই তারা আমাদের বিশ্বাস করে না এবং আমাদেরকে গুরুত্ব সহকারে নেয় না। অথবা তারা আমাদের কথা নাও শুনতে পারে বা তারা আমাদের কথা ভুলভাবে শুনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের মন অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে। সুতরাং, এমনকি সত্যিই যদি আমাদের মধ্যে এই ব্যক্তির অনুভূতিকে আহত করার উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু এর কোনও গ্যারান্টি নেই যে, এটা সত্যিই সেই ব্যক্তিকে আহত করবে, যদিও বৌদ্ধধর্ম অবশ্যই শিক্ষা দেয় যে, আমাদেরকে কাউকে আঘাত করার চেষ্টা করা উচিত না। কিন্তু এখানে কর্ম জড়িত নয়।

আমরা যখন কোনও কিছুর কার্মিক ফল সম্পর্কে কথা বলি, তখন এটার তাৎপর্য হবে যে, এটা হচ্ছে সেই কার্মিক ফল যা আবেগপ্রবণ; বাধ্যতামূলক ভাবে কর্ম করার পরিণামস্বরূপ, কার্মিক অনুরোধের সাথে আমরা নিজেরা সেটা অনুভব করি।

আমাদের নিজেদের মধ্যে ফলটা কেমন হয়? এর একটা ফল হ’ল- পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকরা যা বলে তার সাথে খুব মিল আছে- আমরা নিজেরাই একটা নির্দিষ্টভাবে চিন্তাভাবনা করা, নির্দিষ্টভাবে কথা বলা এবং নির্দিষ্টভাবে করার পরিস্থিতিটা তৈরী করি। এরফলে সেইভাবে পুনরায় আচরণ করার প্রবণতা তৈরী হয়। আর সেই কর্মটার পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতার পরিণামস্বরূপ আমরাও সম্ভাব্যতা এবং প্রবণতার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য গড়ে তুলি, আর তাদের পরিণাম স্বরূপ, আমরা সেই কর্মটির পুনরাবৃত্তি করতে চাই। যদিও এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।

এটা আসলে কী উৎপাদন করে- এটা প্রবণতা, না সম্ভাবনা? প্রবণতা একটি অনুভূতির জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ আপনার কাছে গিয়ে আপনাকে আলিঙ্গন করার মতো অনুভূতি অথবা আপনার কাছে গিয়ে খারাপ কিছু বলার মতো অনুভূতি। তারপরে, আমরা এটা করার মতো অনুভব করি। অবশ্যই, তখন আমাদের কাছে একটা বিকল্প থাকে যে, এটা করব কি না। এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এটা অনুধাবন করার জন্য আমাদের কী করা উচিত বা উচিত না সেটা সম্পাদনের বিকল্প আমাদের কাছে আছে। কিন্তু আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা এটা করতে যাচ্ছি অথবা এমনকি আমরা যদি বিবেচনা না করে থাকি যে, আমরা এটা করতে চলেছি কি না, বরং শুধু সম্পাদন করব, তাহলে পরের স্তরটি হচ্ছে কর্ম কোথায় আসে। কর্ম হচ্ছে একটা অনুরোধ, একটি প্রেরণা, একটি বাধ্যবাধকতা যার কারণে আমরা এটা করি।

তারপরে, এই প্রবণতাগুলি থেকে পরিপক্ক হওয়ার অন্যান্য বিভিন্ন জিনিস আছে। একটা জিনিস হচ্ছে, মূলতঃ, আমরা যা অনুভব করি তার বিষয়বস্তু। “বিষয়বস্তু” একটা বড় শব্দ। আমার ধারণা, আমাদের আরও একটু নির্দিষ্ট হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, এখানে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, এই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করা এবং ঐ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ না করা। মানুষ আমাদের প্রতি যেভাবে আচরণ করে এখানে সেটাও জড়িত। আমরা কীভাবে কথা বলি, এই বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট হওয়ার জন্য আমাদের আরও বেশী সতর্ক বা যত্নবান হতে হবে।

আমাদের কর্ম অন্য কোনও ব্যক্তিকে আমাদের প্রতি চিৎকার করাতে পারে না। সে আমাদের প্রতি চিৎকার করে প্রবণতার ফল হিসাবে। কিন্তু আমাদের নিজের কর্ম অন্য লোকেদেরকে আমাদের প্রতি চিৎকার করার জন্য দায়ী।

অবশ্যই, এটা বোঝার পক্ষে একটা সহজতম বিষয় নয়, তবে আমার মনে হয় এটাকে বোঝার জায়গায় পৌঁছনোর একটা উপায় হচ্ছে এটাকে একটা উদাহরণ সহ বুঝতে হবে। একটা শিশু যদি ডাইপার পরা থাকে এবং সে যদি সেই ডাইপারে মাটি ছিটায়, তাহলে সেই শিশুটিকে তার সঙ্গেই থাকতে হবে; শিশুটিকে ঐ জগাখিঁচুড়ির সাথেই থাকতে হবে যা সে বানায়। শিশুটির ডাইপার কেউ পাল্টে দেয় কিনা এর পুরো বিষয়টা একপাশে ছেড়ে দেওয়া হোক। তবে, এখানে বক্তব্যটি হ’ল- জগাখিঁচুড়িটি তৈরী করে সে এবং তাই তাকেই জগাখিঁচুড়িটা ভোগ করতে হবে। ঠিক সেইরকম আমরা জীবনে জগাখিঁচুড়ি (অশান্ত) পাকাই আমরা নিজেরাই এবং জীবন চলার সাথে-সাথে আমরা আরও জগাখিঁচুড়িতে জড়িয়ে যাই। তাই বাস্তবে এটা কাজ করে ঠিক ঐ ভাবে। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, আমরা অপরের প্রতি আরও নির্দিষ্টভাবে কর্ম করি এবং অপরের দ্বারা আমাদের প্রতি একইভাবে কর্ম করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এখানে কর্ম সম্পর্কে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হ’ল এটা তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে না। আমরা কারও প্রতি খুব বিনীত এবং নম্রভাবে বললাম কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমাদের প্রতি উন্মত্ত হতে পারে, রাগ ক’রে আমাদের প্রতি চিৎকার করতেই পারে।

এই কারণেই সত্যিকার অর্থে কর্মকে বোঝার জন্য আমাদের পুনর্জন্মের পুরো আলোচনার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, যেখানে বিষয় ফল উৎপাদন করার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে নেয়। তাই এই জীবদ্দশায় তারা ফল উৎপাদন নাও করতে পারে। আসলে, বেশীর ভাগ সময় তারা সেটা করে না। আমাদের পাশ্চাত্য মানুষদের পক্ষে এটাকে মেনে নেওয়া খুব সহজ নয়। কিছু মানুষের কাছে এটা এরকম শোনায়, যেমন- “এই জীবনকালে ভাল হন এবং পরবর্তী জীবনে আপনি স্বর্গে ফল ভোগ করবেন; খারাপ হলে পরবর্তী জীবনে আপনি নরকের ফল ভোগ করবেন।”

আমাদের এটাকে সত্যিই বেশ ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করতে হবেঃ বৌদ্ধধর্ম কি একই কথা বলে অথবা এটা তার থেকে একটু আলাদা? এটা একটা খুব সহজ বিষয় নয়, বরং একটা জটিল বিষয়, কারণ সত্যিকার অর্থে কার্মিক হেতু এবং ফলকে বোঝার জন্য আমাদের পূর্বজন্মকে জানতে হবে অর্থাৎ পূর্বজন্ম বিষয়ে বৌদ্ধ ধারণা; পুনর্জন্ম বিষয়ে অবৌদ্ধ ধারণা নয়, কে সে যে কার্মিক হেতু সম্পাদন করে এবং কে তার ফল ভোগ করে? সেখানে “আমি” বলে কেউ আছে যে পুরস্কৃত হয় অথবা শাস্তি পায়?

যেমনকি আমি প্রথম দিকে উল্লেখ করেছি, পুনর্জন্মের বিষয় এবং যে এটা অনুভব করে, এটাকে বাদ দিয়ে বৌদ্ধধর্ম নিয়মের আনুগত্যের ভিত্তিতে পুরস্কার এবং শাস্তির কথা বলে না। বৌদ্ধধর্ম বলে না যে, এই জীবনটা এক ধরণের পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষার ফলটা আমরা পাব পরের জন্মে। এটা সহজ ভাবে বলে যে, জিনিসগুলি ফল উৎপাদন করতে দীর্ঘ সময় নেয়। আমরা পরিবেশের দিক থেকে সেটা দেখতে পারি। আমরা একটা নির্দিষ্ট ভাবে কর্ম করি এবং এটা আমাদের জীবদ্দশায় কিছু ফল উৎপাদন করে, তবে এটা অনাগত প্রজন্মের জীবনকালে একটা অনেক বেশী ভয়াবহ ফল উৎপাদন করতে চলেছে। এটা ওটার মতো কিছু।

সুখ এবং অসুখীতা (দুঃখ)

একটা সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রা যার সাথে কর্ম পরিপক্ক হয়- অন্য কথায়, আরও একটা মাত্রা যার সাথে এই কর্মগুলির ফল পরিপক্ক হয়- সেটাকে সেইভাবে হতে হয় যার বিষয়ে আমরা বক্তৃতাটির প্রথমদিকে আলোচনা করছিলাম। এটাকে সুখী এবং দুঃখী মাত্রা বলা হয়। কোনও নির্দিষ্ট কর্ম পুনরাবৃত্ত করলে আমরা আমাদের সাথে নির্দিষ্ট ভাবে আচরণ করে অথবা এটা একটা খাড়া উঁচু পাহাড় থেকে এক টুকরো পাথর আমাদের মাথার উপর পড়ার মতো হতে পারে। আমরা এই জিনিসগুলি সুখ বা দুঃখ সহকারে অনুভব করতে পারি। সেইটার বিষয়ে ভাবুন। কিছু মানুষ আছে, যখন তারা আরশোলায় পা রাখে তখন তারা খুব খুশী হয়। আমি এই ধরণের ভয়ঙ্কর জিনিসের সাক্ষাৎ করেছি। অন্যরা, যখন তারা একটা আরশোলায় পা দেয়, বিরক্ত হয়ে যায় এবং খুব দুঃখ বোধ করে। কিন্তু মানুষ, যখন তাদের কেউ আঘাত করে অথবা তাদের দিকে চিৎকার করে, তখন তারা খুব অসন্তুষ্ট এবং খুব দুঃখ বোধ করে, এবং অন্যান্য লোকেরা আনন্দিত হয়, “হ্যাঁ, আমি একজন পাপী; আমি ভাল নয়; আমি খারাপ; আমার প্রতি চিৎকার করা এবং আমি আঘাত পাওয়ার যোগ্য।”

আপনারা এই উক্তিটি জানেন। আমার মনে হয় এটা এখানে এসেছে মেক্সিকো থেকে অথবা সম্ভবতঃ কেউ গল্পের আকারে এটা তৈরী করেছে এবং আমি এটা বিশ্বাস করি। তবে এটা এরকম বলেঃ “যদি আমার স্বামী আমাকে আঘাত করেন, তাহলে তার অর্থ হবে, তিনি সত্যিই ভালোবাসেন; যদি তিনি না করেন, তার মানে হবে, তিনি আমাকে পাত্তা দেন না।”

এই সুখ বা দুঃখ প্রায়ঃ ভিন্ন ধরণের বলে মনে হয়, তাই নয় কি? একটা দিকের নিরিখে আমাদের সাথে যা ঘটে অভ্যাসবশতঃ বাধ্য হয়ে যা করি এবং তাতে যে অভিজ্ঞতা হয়; এটা হ’ল একটা দিক। আর আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলি আমরা যা অনুভব করি এটা হ’ল একটা দিক। আর অন্য দিকটা হ’ল- আমরা বাস্তবে সেটা সুখ অথবা দুঃখ সহকারে কেমন ভাবে অনুভব করি। আমাদের দ্বারা অনুভূত উভয় দিকটি অতীতের ভিন্ন কার্মিক ক্রিয়া থেকে পরিপক্ক হয়। আমরা যদি শুধু সুখী এবং অসুখীতার দিকটা দেখি, তাহলে এটা একটা খুব সাধারণ দিক হবে। এটা আমরা ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে বা গঠনমূলক পদ্ধতিতে কর্ম করি, সেটা থেকে আসে। আমরা যদি ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি তাহলে অসুখী ফল অনুভব করি; আমরা যদি গঠনমূলক ভাবে কর্ম করি তাহলে তার ফলস্বরূপ সুখ অনুভব করা হয়।

গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণ

বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক বলতে কী বোঝায় সেটা তদন্ত করার সময় একটা খুব আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই এর যথেষ্ট কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। তবে যেমনটি আমরা দেখেছি, আমরা আসলে অন্যের উপর পরিপক্ক হওয়া ফলের নিরীখে একটা কর্মের স্বভাবকে নির্দিষ্ট করতে পারি না, কারণ কে জানে এর ফল কী হবে। এর কারণ হল এরসাথে আরও অনেক বিষয় যুক্ত হয়ে থাকে। সুতরাং গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক বিষয়টা আমাদের মনের অবস্থার সাথে যুক্ত যার মাধ্যমে আমরা কর্ম করি। যদি আমাদের কর্ম, লোভ, আসক্তি, ক্রোধ অথবা শুধু পুরোপুরি নির্বোধতার উপর ভিত্তি করে তাহলে এটা হবে ধ্বংসাত্মক। অন্যদিকে যদি আমাদের কর্ম, অলোভ, অক্রোধ, অনাসক্তি বা নির্বোধতার উপর ভিত্তি করে তাহলে এটা হবে গঠনমূলক। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যদি এটা এর থেকে বেশী হয়, অর্থাৎ এটা যদি মৈত্রী এবং করুণা, দান ইত্যাদির উপর আধারিত হয় তাহলে এটাও হবে গঠনমূলক।

এখানে অন্যান্য কারণও আছে। একটা কর্মকে গঠনমূলক বা ধ্বংসাত্মক করে তোলে এমন অন্যান্য কারণগুলি পরীক্ষা করাটা খুব আকর্ষণীয়। একটি কারণ হল- নৈতিক আত্মমর্যাদা। এটা আমাদের আত্ম ভাবমূর্তি এবং আমাদের আত্ম সম্মানের সাথে সম্পর্কিত। যদি আমাদের মধ্যে নিজের প্রতি সম্মান না থাকে তাহলে আমাদের আচরণের ফল নিজের উপর কেমন ফলিভূত হবে সে বিষয়ে গ্রাহ্য করব না। এটা হল “যা হবে দেখা যাবে”- এই মনোভাব যদি এই ধরণের নিম্ন আত্ম-সম্মানের সাথে থাকে তাহলে আমি একজন মুর্খের মতো আচরণ করব না। আমি একজন বোকার মতো নিষ্ঠুর ভাবে কর্ম করব না কারণ আমি ঐ ভাবে কর্ম করে নিজেকে ছোট করতে চাই না। আমি কী করতে পারি সে সম্পর্কে আমার মধ্যে আরও উচ্চতর মতামত আছে। আমরা এখানে ঐ বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলছিঃ হয় নৈতিক আত্ম-মর্যাদা বোধ আছে অথবা নৈতিক আত্ম-মর্যাদার কোনও ধারণা নেই। এটা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করব কী না সেটা নির্ধারণ করার জন্য এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরও একটা বিষয় হচ্ছে কীভাবে আমাদের আচরণ অন্যের উপর প্রতিফলিত হয়। আমরা কী বিষয়ে কথা বলছি? আমি যদি ভয়ঙ্কর ভাবে আচরণ করি, তাহলে সেটা কীভাবে আমার পরিবারের উপর প্রতিফলিত হয়? সেটা কীভাবে আমার দেশের উপর প্রতিফলিত হয়? আমি যদি ভয়ঙ্কর ভাবে কর্ম করি, তাহলে মানুষ মেক্সিকানদের বিষয়ে কী ভাববে? আমরা যদি বৌদ্ধ হই, আমি যদি বাইরে গিয়ে মাতাল হয়ে যাই এবং লড়াই-ঝগড়া শুরু করি, তাহলে সেটা কীভাবে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধদের উপর প্রতিফলিত হবে? কারণ আমাদের মধ্যে আমাদের পরিবার, গোষ্ঠী অথবা ধর্ম, দেশ, শহর, যাই হোক না কেন, তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে। তাই আমাদের আচরণের ফল সম্পর্কে উদ্বেগ এবং আমাদের আচরণ অন্যের উপর কীভাবে প্রতিফলিত হয় সেই বিষয়ে উদ্বেগ থাকে। যদি আমাদের মধ্যে সেটা থাকে, তাহলে আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করা থেকে বিরত থাকি। আর যদি সেটা না থাকে তবেই আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি। এটি বৌদ্ধধর্মের একটি অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কী? আত্ম-সম্মান, আত্ম-মর্যাদাবোধ এবং আমাদের সম্প্রদায় প্রতি সম্মানবোধ।

এটা আমাদেরকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন যেগুলির জন্য এটা একটা বৃহৎ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। আপনি যদি কোনও ব্যক্তি এবং তার সম্প্রদায়কে আত্ম-মর্যাদার সমস্ত বোধ থেকে বঞ্চিত করেন, তাদের জীবনকে সত্যিই ভয়ঙ্কর করে তোলেন এবং তাদের সম্পর্কে ভয়ঙ্কর বিষয়গুলি ভাবেন, তাহলে তারা ভাববে যে, তারা যা করার চেষ্টা করছেন সেটা বিবেচ্য নয়। যদি তাদের কাছে আত্মমূল্য বা নিজের সম্প্রদায়ের মূল্য সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকে, তাহলে তারা কেন বাইরে যাবেন না এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবেন না? তারা মনে করবে যে, তাদের কাছে হারানোর কিছু নেই। আমি মনে করি, আমরা অন্যের সাথে কীভাবে আচরণ করি, বিশেষ করে বিশ্বের সমস্যায় জর্জরিত পরিস্থিতিতে, সেটা মনে রাখা একটা সহায়ক বিষয়। কাউকে আত্ম-মর্যাদার অনুভূতি বা তাদের সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ থেকে কখনও বঞ্চিত না করা গুরুত্বপূর্ণ।

এমন কিছু চৈতসিক আছে যেগুলি একটা কর্মকে ধ্বংসাত্মক বা গঠনমূলক করে তোলার সাথে যুক্ত আছে। এগুলি সেই জিনিস, যেমন- বিষয়টাকে গম্ভীর ভাবে নেওয়া যে, আমরা যে ধরণের কর্ম করি এবং অন্যের সাথে আচরণ করি সেটা তাদের প্রভাবিত করে। এর অর্থ বিবেক বা যত্নশীলতার বোধকে বোঝায়। আমি এটাকে “যত্নশীল মনোভাব” বলি। কিন্তু কখনও-কখনও আমরা খুব নির্বোধ হয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, “আমি আপনাকে যা খুশি বলতে পারি।” এটা কোনও ব্যাপার না। আমি আপনার অনুভূতিটা গম্ভীর ভাবে নিই না। এতে আমার যত্নশীল মনোভাবের অভাব থাকে।

আমরা যদি এই ধরণের চৈতসিক, যেমন- লোভ, ক্রোধ, আত্ম-মূল্যহীন, আমরা যা কিছু যেভাবে করি সেটা অন্যের উপর প্রতিফলিত হয় এই বিবেচনার অভাব, অযত্নশীল এবং বিষয়টা গম্ভীর ভাবে না নেওয়া যে, আমরা যা করি সেটা অন্যের উপর প্রভাব ফেলবে এবং তার সাথে আমাদের উপর প্রভাব ফেলবে, তাহলে এর ফল কী হবে? অসুখীতা বা দুঃখ। দুঃখ, যদিও এটা একটা শাস্তি নয়।

এই বিষয়ে আমাদের বেশ গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই সমস্ত নেতিবাচক কারণসহ সেই মনের অবস্থা কি একটা সুখী মনের অবস্থা হতে পারে? এটা কি সত্যিকারের সুখের অনুভূতি তৈরী করতে পারে? অথবা এটা কি শুধু অসুখীতা (দুঃখ) সৃষ্টি করে? আমরা যদি এর বিষয়ে আরও বেশী চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে এটা সত্যিকার অর্থে একটা বোধগম্যতা তৈরী করে যে, মনের সেই অবস্থা, মনের সেই নেতিবাচক অবস্থা, অসুখীতা অনুভব করার ফল উৎপাদন করতে পারে। আর আমাদের মধ্যে লোভ, ক্রোধ এবং এই ধরণের অন্যান্য ভাবনারোহিত মনের অবস্থা তৈরী হয়, তাহলে সেটা সুখ উৎপাদন করে। অতএব, আমাদের এই ধরণের আচরণের সাধারণ ভাগ আছে- গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক। আর সেগুলি তদনুরূপে আমাদের দুঃখ অথবা দুঃখ ভোগ করার ফল উৎপাদন করে।

তারপরে, এছাড়াও, নির্দিষ্ট ধরণের কর্ম আছে যা আমরা করিঃ কারও প্রতি চিৎকার করা, কারও প্রতি সদয় হওয়া ইত্যাদি। এই ধরণের আচরণ এবং পরিস্থিতি গুলিকে জড়িত হওয়ার প্রবণতার পুনরাবৃত্তি করার ক্ষেত্রেও এগুলির ফল আছে, যেগুলি অন্যরা আমাদের প্রতি তদনুরূপ আচরণ করে।

আমাদের কার্মিক আচরণের আরও একটি ফল হল আমরা কেমন ধরণের পুনর্জন্ম লাভ করবঃ আমরা কি এই মৌলিক দেহ এবং একটা কুকুর, একটা আরশোলা অথবা মানুষের মন নিয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করব? এখানে এই বিষয়ে খুব বেশী বিশদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের সাথে নির্দিষ্ট কিছু ঘটতে এবং আমাদের কর্মকে একটা নির্দিষ্ট উপায়ে অনুভব করার প্রসঙ্গ হিসাবে আমরা কেমন ধরণের শরীর এবং মন ধারণ করব? এখানে আরও অনেক বিবরণ আছে কিন্তু আমি এই প্রারম্ভিক বক্তৃতায় সবচেয়ে সাধারণ নীতিগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।

নির্ধারণ অথবা স্বাধীন ইচ্ছা

সুতরাং একদিকে, আমরা কিছু ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি এবং আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলি অনুভব করি; এবং অন্যদিকে, আমরা সুখ-দুঃখের উত্থান-পতনের সাথে অনুভব করি যা কখনও-কখনও আমাদের আচরণের সাথে মিল খায় এবং আবার কখনও-কখনও এগুলি মিল খায় বলে মনে হয় না। এই সমস্ত কিছুর সর্বক্ষণ উত্থান-পতন হয়েই চলেছে, হয়েই চলেছে। আমরা জানি না যে, পরবর্তীতে কী ঘটতে চলেছে এবং অবশ্যই, আমাদের সাথে যা ঘটে সেটা কেবল আমার কারণে এবং আমার কর্মের কারণে ঘটে না। এটা জগতের প্রত্যেকের সাথে এবং তাদের কর্মের সাথে যা ঘটছে আর তারা যা কিছু করছে তার কারণেও প্রভাবিত হয়। এছাড়াও, দৈহিক জগৎ অর্থাৎ জগতের উপাদানগুলি- আবহাওয়া, ভূমিকম্প ও সেই ধরণের বস্তুর কারণেও প্রভাবিত হয়। এই কারণেই, আমরা পরবর্তীতে কী অনুভব করতে চলেছি সেটার ভবিষ্যবাণী করা খুব কঠিন। এর কারণ হ’ল- যে বিষয়গুলি প্রভাবিত করে সেগুলি খুব, খুবই জটিল। বাস্তবে বুদ্ধ বলেছেন, এটা হল কোনও একটা বিষয়কে বোঝার মধ্যে সবচেয়ে জটিল বিষয়।

এখানে আমাদের স্পষ্ট হতে হবে, কারণ অনেক লোক এই কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে অর্থাৎ এটা কি নির্ধারণ, নাকি এতে আমাদের একটা স্বাধীন ইচ্ছা আছে? এর কোনটাও সঠিক নয়, বরং উভয়ই চুড়ান্ত। সাধারণতঃ নির্ধারণ বলতে বোঝায়, অন্য কেউ আমাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছে যে, আমরা কী করতে চলেছি বা আমরা কী অনুভব করতে চলেছি। অন্য কেউ বলতে কি একজন বাহ্যিক সত্তা, একজন উচ্চতর সত্তা বা যাই হোক না কেন, তাকে বোঝায়। বৌদ্ধধর্ম বলে যে, ব্যাপারটা তা নয়, এটা এমন নয় যে, আমরা যা করতে চলেছি সেটার সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিয়ে ফেলেছে অর্থাৎ আমরা হলাম পুতুল মাত্র, অন্য কারও দ্বারা লিখিত নাটকে অভিনয় করছি।

অন্যদিকে, স্বাধীন ইচ্ছাটি হল খানিকটা এইরকম- কেউ রেঁস্তোরায় বসে খাদ্য তালিকা ধরে কী অর্ডার দেবে তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জীবন এরকম নয়। জীবনকে সেরকম রূপে কল্পনা করার বিষয়ে বৌদ্ধধর্ম বলে যে, সেটা সঠিক নয়, বরং এটা বিভ্রান্ত। মনে হতে পারে এবং অনুভবও করা হয় যে, “আমি” বলে এমন কিছু আছে যা আমাদের জীবন থেকে আলাদা এবং অনুভব থেকে আলাদা। বর্তমানে যা কিছু ঘটছে সেটা তার বাইরে অবস্থিত এবং সে খাদ্য তালিকার মতো জীবনকে দেখতে পারে আর তার থেকে পদ (আইটেম) বেছে নিতে পারে। বাস্তবে জীবন থেকে আলাদা বা অনুভব থেকে আলাদা কোনও “আমি” নেই। আর খাদ্য তালিকায় থাকা ছোট-ছোট জিনিসগুলির মতো যেগুলি আমরা পছন্দ করতে পারি সেগুলির মতো আমাদের সাথে কিছুই ঘটে না। সেগুলি আগে থেকেই এমন ভাবে সেখানে উপস্থিত নেই যেগুলির জন্য বোতাম টিপে দিলাম আর ভেন্ডিং মেশিন থেকে সেগুলি বেরিয়ে আসল অথবা সেরকম অন্যকিছু। আমি মনে করি এটা একটা উপযোগী চিত্র যা দেখলে অত্যন্ত অর্থহীন মনে হবে। এটা এমন কিছু নয় যে অনুভব গুলি ভেন্ডিং মেশিনের মধ্যে থাকা ক্যান্ডিবার গুলির সমান এবং আপনি যা পছন্দ করেন সেটা নিজের ইচ্ছা মতো নিতে পারেন অর্থাৎ বোতামটি টিপুন, টাকা ভরুন, জিনিসটা আপনার কাছে চলে আসল। জীবনটা ঠিক ঐ রকম নয়, তাই কি? এটা এমন নয় যে, এটা আমরা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই, “আজ আমি সুখ উপভোগ করব এবং আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করব যে, প্রত্যেকে যেন আমার কাছে ভালো হয়”। তারপরে আমরা জীবনের মেশিনে টাকা ভরে দিলাম আর যা পছন্দ করেছিলাম ব্যাস সেটা হয়ে গেল। এটা হল স্বাধীন ইচ্ছা তাই নয় কি? আমাদের সাথে কী ঘটতে চলেছে এবং আমরা কী করতে চলেছি সেটা নির্ধারণ করার স্বাধীন ইচ্ছা। তবে আমাদের সাথে যেটা ঘটে সেটা এই দুটি নির্ধারণবাদ অথবা সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছার থেকে বেশী সূক্ষ্ম এবং পরিশীলিত।

কর্মের উৎস হিসাবে বিভ্রান্ত

আমি এই বক্তৃতার আগে বলেছিলাম, বৌদ্ধধর্ম সত্যিই অসাধারণ। যার বিষয়ে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, সমস্ত বিষয়ের নিয়মিত উত্থান-পতনের নির্দিষ্ট কারণ আছে, যেমন- আমরা যে সুখ, দুঃখ এবং অন্য সবকিছু যেটা আমাদের সাথে ঘটে সেটা আমরা সত্যিই ঘটতে দেখতে চাই না এবং যার উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, সে সবকিছুর কারণ আছে। কারণটি আমাদের অনুভবের প্রত্যেক মুহুর্তের অংশ এবং পুরো লক্ষণটিকে স্থায়ী করে দেয়, আর সেই কারণটিই হল বিভ্রান্তি। শুধু তাই নয়, আমরা যখন বিভ্রান্তির সাথে কর্ম করি সেটা ধ্বংসাত্মক হোক বা গঠনমূলক, এটা আরও শক্তিশালী করে দেয় যাকে আমরা বলি “ধ্রুব অভ্যাস” অর্থাৎ নিয়মিতভাবে বিভ্রান্তির সাথে আচরণ করার অভ্যাস। আর তার কারণে আমরা প্রতি মুহুর্তেই বিভ্রান্তির সাথে কর্ম করতে থাকি।

এই বিভ্রান্তি কী? এটা বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে একটা খুব গম্ভীর বিষয়।তবে আমরা যদি এটাকে সহজ ভাষায় বলি তাহলে আমরা বিভ্রান্তি নিয়ে যা বলব সেটা হ’ল আমি কীভাবে অস্তিত্বে আছি, আপনারা কীভাবে অস্তিত্বে আছেন এবং প্রত্যেকের অস্তিত্ব কীভাবে আছে সেই বিষয়ে বিভ্রান্ত হওয়াকে বিভ্রান্তি বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা মনে করি, আমি হলাম জগতের কেন্দ্রবিন্দু; আমিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন; আমার সবসময় কাজটা হয়ে যাওয়া উচিত; সকলের সবসময় আমার জন্য সময় থাকা উচিত। আমাদের সেল ফোনের আধারে আমরা এই মনোভাবটা সনাক্ত করতে পারিঃ যেমন- আমরা মনে করি, তারা যা কিছু করুক না কেন, আমার যে কোনও সময় তাদের ফোন করতে এবং তাদের বিঘ্ন ঘটাতে সক্ষম হওয়া উচিত, আর তারাও যেন আমার জন্য উপলব্ধ থাকে। এর কারণ হল, আমি যা বলব তারা সম্ভবতঃ এখন যে কাজটি করতে চলেছে আমার কাজটি অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সেটার তুলনায়। এই বিভ্রান্তির ভিত্তিতে, আমরা অপরের সাথে ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করতে পারি- তাদের প্রতি চিৎকার করা, তাদের প্রতি নিষ্ঠুর হওয়া ইত্যাদি। আর আমি করতে পারি, কারণ আমি যা চাই তারা সেটা করে না অথবা আমি যা পছন্দ করি না তারা সেটা করে। বাস্তবে আমি যা পছন্দ করি তাদের সেটা করা উচিত, কারণ আমি যেটা চাই সেটা স্পষ্টতই তারা যা চায় তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অথবা এই বিভ্রান্তির উপর ভিত্তি করে আমরা কারও জন্য ভালো কিছু করতে পারি তাদের প্রতি সদয় হয়ে থাকি, কারণ আমি চাই যে, তারা আমাকে পছন্দ করুক; আমি চাই যে তারা আমার সাথে সুখী হোক। আমি প্রয়োজন বোধ করতে চাই যে আমি অন্য কারও জন্য যা করি সেটা তাদের প্রয়োজন বলে মনে করি। সুতরাং আমি আমার কন্যাকে বলব কীভাবে তার সন্তানদের লালন-পালন করতে হয় এবং কীভাবে তার বাড়ি সামলাতে হয়। এটা কি সহায়ক হবে না? আমার কন্যা আমার পরামর্শ এবং আমার সহায়তা চায় কিনা সেটা বিবেচনার বিষয় নয়, তবে আমি মনে করি যে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন এবং তাই আমি তার জন্য প্রয়োজনীয় হতে চাই। আর এটা স্পষ্ট যে, আমি আমার কন্যার চেয়ে ভাল জানি কীভাবে তার সন্তানদের লালন-পালন করতে হবে এবং তাকে অবশ্যই আমার কাছ থেকে এটা শোনা দরকার।

সুতরাং সেখানে এই বিভ্রান্তি আছে আর এর পিছনে রয়েছে উভয় ধ্বংসাত্মক এবং গঠনমূলক আচরণ। এই বিভ্রান্তির কারণেই আমরা এই উত্থান এবং পতনের চক্রটিকে স্থায়ী করি। অতএব এর থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেটা আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

নিজেদেরকে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেওয়া

আমরা যখন এই কার্মিক প্রবণতা এবং অভ্যাসগুলি বিশেষ করে, প্রবণতাগুলি কীভাবে পরিপক্ক হয় তার পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা করি তখন আমরা বুঝতে পারি যে, ঐ সমস্ত কিছুই আমাদের সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতনের মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের দুটি চৈতসিক আছে যা আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভবের সাথে থাকে। এগুলি এখানে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটিকে ‘তৃষ্ণা” বলা হয়। আমরা যখন সুখ অনুভব করি তখন আমরা তীব্র আকাঙ্খা করি। এর অর্থ হল আমাদের মধ্যে একটি তীব্র ইচ্ছা থাকে যার অর্থ এটার থেকে বিয়োগ না হওয়া। “চলে যেও না, সারাক্ষণ আমার সাথে এখানে থাক। তুমি কি আরও বেশি সময় থাকতে পারবে?”, এই ধরণের ভাবনা আমাদের মধ্যে জাগে যখন আমরা কারও সাথে থাকা উপভোগ করি। অথবা আমরা চকোলেট কেক খাওয়া উপভোগ করি এবং আনন্দ বোধ করি, তাই আমরা সেই সুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। এর কারণে, আমরা আরও বেশি, আরও বেশি খেয়ে চলি, তাই নয় কি? সেটাই তৃষ্ণা। তারপর, আমরা যখন দুঃখ অনুভব করি, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর থেকে বিয়োগ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি। এগুলির উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় চৈতসিক অন্তর্নিহিত আছে আর সেটা হ’ল একটা ‘আমি’, একটা ‘দৃঢ় আমি’-কে সনাক্ত করার দৃঢ় মনোভাব যার মাধ্যমে আমরা সব কিছু অনুভব করি। আমি এই সুখ প্রাপ্ত করেছি এবং এটা যা কিছুই হোক না কেন, আমাকে সুখ প্রদান করে; তাও আরও বেশি করে আর এর থেকে বিয়োগ হতে চাই না। ‘আমি’ যা পছন্দ করে না ‘আমিকে’ তার থেকে বিচ্ছেদ হতে হবে। আপনি যা বলছেন ‘আমি’ সেটা পছন্দ করে না। অতএব, আপনি চুপ করলে ভাল হবে, অন্যথা ‘আমি’ আপনার প্রতি চিৎকার করবে।

আমরা যখন এই তৃষ্ণার সাথে আমাদের জীবনে সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতন অনুভব করি এবং যা কিছু ঘটে চলেছে তার সাথে একটা দৃঢ় ‘আমি’-এর অস্তিত্ব অনুভব করি, বিভ্রান্তির উপর আধারিত এই সমস্ত কিছুই সমস্ত কার্মিক প্রবণতাকে পরিপক্ক করার কারণ হয়ে ওঠে। এইভাবে, আমরা আমাদের সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতনকে স্থায়ীত্ব প্রদান করি আর আমাদের পূর্বের আচরণের পুনরাবৃত্তি করি। এর কারণ হচ্ছে, এটাই তাই যা ঐ প্রবণতাগুলির কারণে পরিপক্ক হয়। আর যেটা সত্যিই ভায়াবহ সেটা হ’ল, সুখ-দুঃখের প্রতিটি মুহুর্তে এই বিভ্রান্তিটি সাথে থাকে।

উক্ত ধারণাটি সুখ–দুঃখের মুহুর্তগুলিকে স্থায়ী করে দেয় যা বিভ্রান্তির সঙ্গেও থাকে। আমরা এখন যে বিভ্রান্তি অনুভব করছি সেটা হ’ল আমাদের আগের বিভ্রান্তির পরিণাম অর্থাৎ আমরা আগে যে সুখ-দুঃখ অনুভব করতাম।

এই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত চক্র, এই স্বস্থায়ী চক্রকে বৌদ্ধধর্মে ‘সংসার’ বলা হয়। আমরা যদি এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারি তাহলে কর্মের পুরো ব্যবস্থাটি বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং আমরা সংসার থেকে মুক্ত হয়ে যাই। আমরা যদি সঠিক বোধগম্যতা দ্বারা বিভ্রান্তিকে প্রতিস্থাপন করি, তাহলে সেখানে “দৃঢ় আমি” বলে কোন আধার থাকবে না। এর অর্থ যে কী এই বিষয়ে আমি সবিস্তারে আলোচনা করব না। আপনারা শুধু এর সাধারণ ধারণাটির সাথে অবগত হন। যদি সঠিক বোধগম্যতা জাগে তাহলে এই আধারটির অস্তিত্ব থাকবে না, “আমার কাছে এটা আছে এবং ওটা নেই”। যেহেতু সেখানে কোনও তৃষ্ণা থাকে না, তাই এই প্রবণতা এবং অভ্যাসগুলিকে সক্রিয় করার মতোও কিছু থাকে না। আর যদি এই প্রবণতা এবং অভ্যাসগুলিকে সক্রিয় করার মতো কিছু না থাকে তাহলে আপনি বলতে পারবেন না যে আপনার মধ্যে এখনও প্রবণতা এবং অভ্যাস আছে।

আমি একটি উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করব। ধরুণ, আপনার মধ্যে যদি ডাইনোসর দেখার প্রবণতা থাকে, তাহলে যখন ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন আপনি যদি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যান তখন আপনার মধ্যে ডাইনোসর দেখার আর কোন প্রবণতা থাকবে না, থাকবে কি? সেখানে একটা প্রবণতা ছিল তাই আমি যখন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতাম আমি সবসময় ডাইনোসর দেখতে পেতাম। যেহেতু এখন সেখানে ডাইনোসর নেই, তাই ডাইনোসর দেখার প্রবণতাও নেই। এই উদাহরণটি ব্যবহার ক’রে, যখন একটি প্রবণতাকে পরিপক্ক করার কোনও কারণ না থাকে, যেমন- একটা ডাইনোসর আপনার সামনে চলা-ফেরা করা, যা একটা ডাইনোসরকে দেখার প্রবণতা পরিপক্ক করে, অর্থাৎ প্রবণতাটিকে সক্রিয় করার মতো যদি কিছুই না থাকে, তাহলে আপনার মধ্যেও আর প্রবণতা থাকবে না। আর কোনও প্রবণতা না থাকায়, আমাদের কার্মিক প্রবণতাগুলি যদি পরিপক্ক না হয়, তাহলে আমরা আর সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতন অনুভব করব না। আর অবশ্যই আমরা এই সাথে কোনও বিভ্রান্তিরও সম্মুখীন হই না; সেটাও চলে যায়।

এই ভাবেই আমরা সম্পূর্ণ সাংসারিক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়ে যাই। আমরা আর এই অসন্তোষ এবং সুখ-দুঃখের অনিরাপদ উত্থান এবং পতন অনুভব করি না। এর পরিবর্তে, আমরা একটা খুবই আলাদা ধরণের, খুব স্থির সুখ উপভোগ করি। এটা একটা খুব আলাদা গুণ সম্পন্ন সুখ, যা বিভ্রান্তির সাথে মিশ্রিত কোনও এক ধরণের সুখ নয়, অথবা ঐ ধরণের সুখ নয়, “আমি খেলাটায় জয়লাভ করেছি এবং সেই জন্য এই পুরস্কারটি প্রাপ্ত হল।” এটা এক ধরণের পুরস্কার, যা আমরা একটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করি।

আমি একটা সহজ উদাহরণ মনে করি যদিও এটা একটা সঠিক উদাহরণ নয়। এর সম্পর্কে কথা বলার জন্য আমি যা বলি সেটা হল দিনের শেষে আমরা যখন এক জোড়া টাইট জুতো খুলে ফেলি তখন আমাদের যে আনন্দ হয় এখানে সেটা হতে পারে অর্থাৎ এটা একটা আনন্দদায়ক স্বস্তি যে, আমি এর থেকে মুক্তি পেলাম।

এছাড়াও মুক্তি লাভের পর আমরা যা অনুভব করি সেটা হল আমাদের ক্রিয়াকলাপগুলি আর এগুলি এই বাধ্যবাধকতামূলক কর্ম দ্বারা পরিচালিত হয় না, যার কারণে আমরা একটা নির্দিষ্ট উপায়ে কর্ম করি এবং নির্দিষ্ট কিছু অনুভব করি। পরিবর্তে আমরা যদি মুক্তির উপরে একজন বুদ্ধ হওয়ার জন্য কর্ম করি তখন আমাদের কর্মকে যে পরিচালিত করবে সেটা হল করুণা, যার অর্থ হল অন্যরা দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়ার কামনা।

সমাপ্তি-সূচক শব্দ

এটা কর্মের সাথে যুক্ত কিছু নীতির একটা প্রাথমিক পরিচয়। এর সম্পর্কে যা কিছু বলা যায় এবং ব্যাখ্যা করা যায় তার চেয়ে আরও অনেক অনেক কিছু রয়েছে। তার মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় যেমন এই ধরণের কর্মের কারণে এই ধরণের ফল পরিপক্ক হয়। যদি এই উপাদানটি থাকে তাহলে তার ফল আরও বেশী শক্তিশালী হবে। আর যদি সেটা সেখানে না থাকে তাহলে তার ফল আলাদা হবে ইত্যাদি। যেমন আপনি যদি কোন কিছু দুর্ঘটনাবশতঃ করেন যেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করার বিপরীত হয় সেই ক্ষেত্রে তার ফল হয় আলাদা। এর সম্পর্কে অনেক বিস্তৃত বিবরণ আছে।

এছাড়াও এই মুহুর্তে যেটা আসলে পরিপক্ক হতে চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলা হয় তাহলে সেটাকে নীতির সাথে সাধারণীকরণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হল এটা আমাদের চারিপাশে ঘটিত সমস্ত কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের সাথে এখন যা ঘটছে সেটাকে আমরা সাধারণ নীতির সাথে সাধারণীকরণ করতে পারি না, কারণ আমাদের সাথে এখন যা ঘটছে সেটা এখন ঘটিত সমস্ত কিছুর কারণে প্রভাবিত। একবার ভাবুন, রাস্তায় আপনার কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেটা কেন ঘটেছিল? এটা এমন এক ধরণের কর্ম যা অন্য সকলকে তাদের দিক থেকে সেই রাস্তার দিকে নিয়ে এসেছিল যেদিকে আমি ছিলাম; এছাড়া ঐসময় ট্রাফিকের পরিস্থিতি, আবহাওয়া এবং রাস্তার অবস্থা; উক্ত ঘটনাটিকে পরিপক্ক করার জন্য অনেকগুলি জিনিস একত্রিত হয়েছিল।

আমরা যদি এই বিষয়ে আগ্রহী হই, তাহলে এর বিভিন্ন দিকগুলি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য অনেক বড় সুযোগ আছে। আমি মনে করি, আমরা কর্ম সম্পর্কে যত বেশী অধ্যয়ন করি, কর্মের নিয়ন্ত্রণে থাকাটা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটি আরও সহায়ক হয়ে ওঠে। এর ফলে আমরা শুধু নিজেদেরকে সাংসারিক দুঃখ থেকে মুক্ত করি না, বরং অন্য সকলকে সহায়তা করতে সক্ষম হয়ে উঠতে আরও উন্নত অবস্থায় অবস্থান করি।

তোমার কী প্রশ্ন আছে?

প্রশ্ন

এই প্রসঙ্গে, অপরাধ কি চিত্রের বাইরে? এখানে অপরাধের সাথে কোনও লেনদেন নেই, তাই না?

সঠিক। বৌদ্ধ ব্যাখ্যা অনুযায়ী কর্মের সাথে অপরাধের কোনও সম্পর্ক নেই। একটা শক্তিশালী দৃঢ় “আমি”-রূপী একটা আলাদা সত্তা এবং আমি যা করেছি সেটা অন্য একটা আলাদা সত্তা। এটা হচ্ছে দুটি পিং-পং বল অথবা সেরকম কোনও কিছুর মতো। অপরাধটা এই ধরণের ভাবনার উপর আধারিত। আর তারপরে, আমরা বিশ্বাস করি যে, ঐ “আমি” নামক সত্তা ভীষণ খারাপ এবং ঐ অন্য সত্তা “আমি যা করেছিলাম” সেটাও ভীষণ খারাপ। সুতরাং এই দুটি আপাত দৃঢ় সত্তার এবং সেটাকে ছাড়তে না দেওয়ার একটা বিচার আছে, এটাই হল অপরাধ। এটা আপনার ঘর থেকে কখনও আবর্জনা ফেলে দেওয়ার মতো নয় বরং “এটা কী ভয়ানক, এটা কী দুর্গন্ধ এবং কী নোংরা”, এই বলে ভেতরে রেখে দেওয়া, আর বাইরে যেতে না দেওয়ার মতো।

এটা খুবই স্পষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আমি পুরো ব্যবস্থাটা বুঝি এবং এটাও বুঝি কীভাবে বিভ্রান্তি, তাড়না, প্রবণতা এবং সমস্ত কিছু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে আমি মনে করি, এই বিষয়ে শুধু বোধগম্যতা থাকা মানেই অনুভব করা অথবা বাধ্যতামূলক ভাবে কর্ম করার প্ররোচনা থেকে এখনই মুক্তি পাওয়া যথেষ্ট নয়।

সঠিক। হ্যাঁ, এইজন্য আমাদের সর্বপ্রথমে নৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে হবে। মনে রাখবেন, আমি উল্লেখ করেছি যে, যখন আমি বলার মতো অনুভব করি ‘আপনি আজ একটা কী কুৎসিত পোশাক পরেছেন;” এবং যখন আমি প্রকৃতপক্ষে এটা বলি এই দুটির মধ্যে কিছুটা ব্যবধান থাকে। আমরা যদি সেই জায়গাটা ধরতে পারি তাহলে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে থাকে যে, আমি যদি ঐ ব্যক্তিটিকে বলি, তিনি কী কুৎসিত পোশাক পরেছেন, এর কারণে কী পরিণাম ফলিভূত হতে চলেছে। আর যদি আমরা দেখতে পাই যে এটা বললে কোন ফলদায়ক হবে না তাহলে আমরা বলব না। নৈতিক শৃঙ্খলা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ দিয়ে আমরা এটাই শুরু করি।

এছাড়াও আমি যখন কিছু করতে চাই তখন আমি কী অনুভূতি বোধ করি সেটা পরীক্ষা করতে পারি, যেমন- আমার কিছু করার ইচ্ছা কি লোভের মতো কোন বিরক্তিকর আবেগের উপর আধারিত? এটা কি ক্রোধের উপর আধারিত? এটা কি নির্বোধতার উপর আধারিত? আমি কি মনে করি যে, আপনার পোশাকটি কুৎসিত বললে আপনার উপর কোন প্রভাব পড়বে না? অথবা আমার কিছু করার ইচ্ছা কি দয়ার উপর আধারিত? এবং আরও অন্য ইতিবাচক বিষয়ের উপর আধারিত? এই কারণেই বিরক্তিকর আবেগ ও মনোভাবের সংজ্ঞাটি খুবই সহায়ক। এটি একটি মনের অবস্থা যা যখন উত্থাপিত হয় তখন আমাদের মনের শান্তি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করে।

আমরা বলতে পারি যে, আমরা কখন মনের শান্তি হারাইঃ আমাদের হৃদয় একটু বেশী দ্রুত স্পন্দন করে এবং আমরা একটু অস্বস্তি বোধ করি। সুতরাং আমরা সূক্ষ্ম জিনিসগুলি লক্ষ্য করার চেষ্টা করি, যেমন- আমি কি অহংকারবশতঃ কিছু বলছি? উদাহরণ স্বরূপ, কেউ বলে, “আমি সেটা বুঝতে পারিনি,” এবং আপনি বলেন, “ওহ, কিন্তু আমি বুঝেছি।” আপনি একটু অস্বস্তি লক্ষ্য করবেন। এর পেছনে কিছু অহংকার থাকে।; কিছু অভিমান; এবং এটাই তাই যা আপনি খোঁজ করেন।

কিন্তু বাস্তবতাকে বোঝার জন্য, যার অর্থ হল শূন্যতা সম্পর্কে বোধগম্যতা লাভ করা ইত্যাদি খুব খুব কঠিন। আর আমরা যখন এটা লাভ করি তখন আমাদের এর সাথে অভ্যস্ত হতে হবে যাতে এটা সর্বক্ষণ আমাদের সাথে থাকে। এই কারণেই আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে নৈতিক আত্মশৃঙ্খলা দিয়ে শুরু করি।

আমি একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় আপনি উল্লেখ করেছেন যে আবেগ দু-রকমের হয় যা এই সুখ-দুঃখ, অস্থিরতা বা ওঠা-নামাকে স্থায়ী করে দেয়। আপনি কী বলছিলেন যে এর মধ্যে একটা হল তৃষ্ণা, তাহলে অন্যটা কী?

আমি যা ব্যাখ্যা করছিলাম সেটা হল দুটো কারণ যা কার্মিক প্রবণতাগুলিকে সক্রিয় করে। এটা আসে প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ অঙ্গের শিক্ষা থেকে। একটা হল তৃষ্ণা আর অন্যটিকে আসলে প্রাপকের মনোভাব বা আবেগ বলা হয় যার বিষয়ে আমি সহজবোধ্য করছিলাম। এটা পাঁচটা আলাদা সম্ভাবনার একটি তালিকা। এটাই ফলটা লাভ করে। অতএব সবথেকে বিশিষ্টটা হল একটা দৃঢ় “আমি”-কে সনাক্ত করা। যার মাধ্যমে আমরা অনুভব করি কী চলছে বা না চলছে।

এটা কি কোন কিছুর সাথে সম্পর্কিত একটা দৃঢ় “আমি”-কে সনাক্ত করে? এটা স্পষ্ট যে এখানে বিভ্রান্তি আছে এবং আমাদের এর খেয়াল রাখতে হবে আর এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমরা আসলে কিসে বিভ্রান্ত হচ্ছি এবং কার মাধ্যমে বিভ্রান্ত হচ্ছি?

এটা একটা সহজভাবে উত্তর দেওয়া প্রশ্ন নয়। আমরা বিভ্রান্ত হই “আমি”-তে যা অস্তিমান, প্রচলিত বা সাংবৃতিক ‘আমি’, মিথ্যা ‘আমি’-এর মাধ্যমে যা অস্তিমান নয়। আমরা যেটা করি সেটা হল যে, প্রকৃত “আমি”-কে অস্তিমান রূপে কল্পনা করি এবং সেটা করি অসম্ভব উপায়ে। এটা হল অতিরঞ্জন। এটা এমন কিছু যোগ করে যেটা আসলে সেখানে নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমি সুখী বা আমি দুঃখী। এটা এমন নয় যে আপনি দুঃখী আর আমিও দুঃখী। যখন সুখ অথবা দুঃখের একটা অনুভব থাকে, আমরা উল্লেখ করি যে আমি সুখী। এর মানে এটা নয় যে আপনি সুখী বা অন্য কেউ সুখী, বরং আমি সুখী। সেই ‘আমি’ অথবা ‘আমাকে’ হল প্রচলিত ‘আমি’ যা অস্তিমান।

এই প্রচলিত ‘আমি’-এর জন্য একটা উদাহরণ ব্যবহার করা যাক। ধরুণ, আমরা কোন চলচিত্র দেখি, চলচিত্রটির নাম “গোন উইথ দ্য উইন্ড”। চলচিত্রটিতে একটা আনন্দের দৃশ্য আছে, তারপর একটা দুঃখের দৃশ্য এবং তারপর আরও একটা সুখকর দৃশ্য। বেশ, এবার কী হবে। এই আনন্দদায়ক দৃশ্যটা “গোন উইথ দ্য উইন্ড”-এর দৃশ্য এবং দুঃখের দৃশ্যটা হল আরও একটা দৃশ্য এবং সেটাও “গোন উইথ দ্য উইন্ড”-এর দৃশ্য। আমরা কীভাবে “গোন উইথ দ্য উইন্ড”-নামক সিনেমার পুরো বিষয়টা, সমস্ত দৃশ্যগুলি অর্থাৎ আনন্দদায়ক এবং দুঃখ উভয়কে প্রচলিত ভাবে আখ্যা দিই? “গোন উইথ দ্য উইন্ড”, এটা হল শুধু একটা শিরোনাম, কেবল একটা নাম। কিন্তু আমরা যখন “গোন উইথ দ্য উইন্ড”-সিনেমার সম্পর্কে কথা বলি তখন আমরা শুধু শিরোনাম সম্পর্কে কথা বলি না। পরিবর্তে, আমরা আসল সিনেমা সম্পর্কে কথা বলি অর্থাৎ শিরোনামটি কী বোঝায়। এটাই হল প্রচলিত ভাবে অস্তিমান সিনেমা, এটা অস্তিত্বে থাকে। সিনেমাটি তারমধ্যে থাকা প্রত্যেকটি দৃশ্য থেকে আলাদা কিছু নয় অর্থাৎ সিনেমাটি ঐ দৃশ্যগুলি থেকে আলাদা এবং স্বাধীন একটা মিথ্যা সিনেমা। এর কোন অস্তিত্ব নেই। আমরা ব্যাখ্যা করি যে, প্রচলিতভাবে অস্তিমান সিনেমাটি শুধুমাত্র তারমধ্যে থাকা দৃশ্যের আধারে আখ্যা যুক্ত বা পরিকল্পিত।

একইভাবে, আমাদের জীবনে আনন্দের মুহুর্ত আছে, আছে দুঃখের মুহুর্ত এবং আরও কিছু তাই আমরা কিভাবে এই সমস্তগুলিকে উল্লেখ করি? আমরা এটাকে ‘আমি’ বলে উল্লেখ করি, সেই প্রচলিত ‘আমি’ যা অস্তিমান; এটা আপনি নন বরং ‘আমি’। একইভাবে, “গোন উইথ দ্য উইন্ড”-নামক সিনেমাটি “স্টার ওয়ারস”- নামক সিনেমাটি নয়। কিন্তু সেখানে কোন আমি নেই যা সুখ-দুঃখকে অনুভব করার মুহুর্ত থেকে আলাদা এবং যে এই মুহুর্তগুলিকে অনুভব করে। সেটা হবে একটা মিথ্যা “আমি”, একটা মিথ্যা “আমি” যা অস্তিমান নয়। আর ‘আমি’ হল শুধু একটা শব্দ; সুতরাং ‘আমি’ বলতে শুধু সেই শব্দটাকে বোঝায় যা জীবনের অনুভবের সমস্ত মুহুর্তের আধারে উল্লেখ করা হয়।

এবার বিভ্রান্তির কথা ভাবতে হবে যে এমন একটা ‘আমি’ আছে যেটা আছে শরীরের মধ্যে, এর ভিতরে বাস করছে, এর সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত আছে, বোতামগুলি টিপছে; ব্যাস ‘আমি’ আমার পায়ে ব্যাথা অনুভব করছি, আমি খুব দুঃখিত আর ‘আমি’ এটা পছন্দ করি না। মনে হয় যেন সেই এলিয়েন জিনিসটার ভিতরে থাকা সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা একটা আমি ছিল যার নাম শরীর। তারপরে প্রচলিত ‘আমি’-এর পরিবর্তে ঐ ‘আমি’ ঐ মিথ্যা ‘আমি’-তে বিভ্রান্ত হই, আমরা এই ভ্রান্ত আমিকে সনাক্ত করি। তারপর তৃষ্ণা বশতঃ আমরা ভাবি ‘আমি’ এই দুঃখ থেকে, ব্যাথা থেকে এবং যে পীড়া বা যন্ত্রণা আমি শারীরিক ভাবে অনুভব করি তার থেকে মুক্ত হতে পারব। যখন আমাদের মধ্যে দৃঢ় ‘আমি’ সম্পর্কে এই ভুল ধারণা আমরা এসব অনুভব করি না। এর অর্থ এই নয় যে আমরা সেখানে বসলাম আর ব্যাথাটা শুরু হয়ে গেল। আমাদের পা যদি আগুনে থাকে অবশ্যই আমরা সেই আগুন থেকে পা সরিয়ে নিই। কিন্তু এর পিছনে থাকা ‘আমি’-এর ধারণা একটু আলাদা। সেখানে কোন আতঙ্ক নেই।

তবে এই মিথ্যা ‘আমি’ বনাম প্রচলিত বা সাংবৃতিক ‘আমি’-এর ধারণাটি অত্যন্ত জটিল এবং উন্নত। অতএব এটাকে এইখানে বাদ দেওয়া যাক। এর পরিবর্তে এই সন্ধ্যায় একটি উৎসর্গ (পরিণামণা) দিয়ে এখানে শেষ করা যাক। আমরা মনে করি; এর থেকে যা কিছু বোধগম্যতা, যা কিছু ইতিবাচক শক্তির উদয় হয়েছে সেটা যেন আরও গভীর থেকে গভীরতর স্তরে যায়, শক্তিশালী থেকে আরও শক্তিশালী হয় এবং সকলের কল্যাণের জন্য বুদ্ধত্ব লাভের কারণ হিসাবে কাজ করে!

Top