কর্মের পরিচয়

দৈনন্দিন ভাষায় চার আর্যসত্য

আমি আরও একবার জালাপে এসে খুব খুশি এবং এই সন্ধ্যায় আমাকে যে বিষয়টি সম্পর্কে বলতে অনুরোধ করা হয়েছে সেটা হ’ল কর্ম। অবশ্যই, আমরা যখন বৌদ্ধধর্মের কোনও বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করি তখন আমাদের মধ্যে সেটার সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা কেন এটা অধ্যয়ন করতে চাই, এর গুরুত্ব কী এবং এটা বৌদ্ধধর্মের পুরো প্রসঙ্গের সাথে কীভাবে খাপ খায়। বুদ্ধ মূলতঃ প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন- আমরা জীবনে কী অনুভব করি, কী ঘটে চলেছে ইত্যাদি। সবচেয়ে মৌলিক জিনিসটা কী যা আমরা প্রত্যেকেই, সকলেই অনুভব করি, এটা হচ্ছে তাই যে, আমরা কখনও দুঃখী হই আবার কখনও সুখী। আমরা আমাদের জীবনকে এইভাবেই অনুভব করি, তাই নয় কি?

আমরা যদি কখনও অসুখী হওয়া এবং কখনও দুঃখী হওয়ার পরিস্থিতিকে পরীক্ষা করি, আমরা খুঁজে পাই যে, এর সাথে অনেক সমস্যা জড়িয়ে আছে। আমরা যখন অসুখী হই, স্পষ্টতই, এটা হল দুঃখ। কেউ অসুখী হতে পছন্দ করে না, করে কি? বন্ধুর চলে যাওয়ার মতো জিনিস দেখে অথবা কোনও ঘটনা বা অপ্রীতিকর কথা শুনে আমরা অসুখী হতে পারি এবং বিভিন্ন আবেগের সাথে বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ক’রেও আমরা অসুখী হতে পারি। আবার কখনও-কখনও আমরা অসুখী হই কিন্তু আমরা যা কিছু দেখছি বা শুনছি অথবা আমাদের চারিপাশে যা কিছু ঘটে চলেছে তার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এটি একটি সমস্যা, তাই নয় কি?

তাহলে সুখের কী হবে? আমরা কখনও-কখনও সুখ বোধ করি, তাই না? আমরা কোনও জিনিস দেখে, শুনে, প্রিয়জনের কথা শুনে সুখ বোধ করি বা আনন্দিত হই, এবং আমরা কোনও কিছুর সাথে সময় কাটিয়ে ওঠার মতো চমৎকার অবসরকে স্মরণ করার মতো কিছু মনে করে সুখ বোধ করি। কিন্তু আমরা যদি এর দিকে আরও গভীরভাবে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা যে সুখ ভোগ করি সেটার সাথেও কিছু সমস্যা জড়িয়ে আছে। প্রথমতঃ, এটা কখনই স্থায়ী হয় না এবং এটা কতদিন স্থায়ী হতে চলেছে, সেটা আমরা জানি না। আর এটা যথেষ্ট বলে মনে হয় না। আমরা এক চামচ খাবার খেয়ে সুখী হতে পারি, তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়, কারণ আমরা আরও-আরও-আরও বেশী খেতে চাই। আসলে, এটা একটা মজাদার প্রশ্ন- বাস্তবে এটাকে উপভোগ করার জন্য আপনাকে কতটা খেতে হবে? সেটার সম্পর্কে ভাবুন! আরও একটা দোষ, এই সুখের আরও একটা দোষ হ’ল আমরা জানি না যে, এর পরে কী ঘটতে চলেছে। আমরা পরের মুহুর্তে পর্যন্ত অনবরত সুখী হয়ে থাকতে পারি অথবা আমরা দুঃখী হয়েও থাকতে পারি। এটা পরিবর্তন হতে পারে। সুতরাং, এই সুখের কোনও নিরাপত্তা নেই।

আসলে, সুখ এবং দুঃখের এই ধরণের অন্তর্দৃষ্টি বা বিশ্লেষণ, বৌদ্ধ ধর্মের কাছে অসাধারণ কিছু না। বিশ্বের অনেক মহান চিন্তকগণ এর পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এটা শিখিয়েছেন। তবে বুদ্ধ যা শিখিয়েছিলেন, বুদ্ধ যা বুঝেছিলেন সেটা ছিল একটা গভীরতর ধরণের সমস্যা বা দুঃখ। তিনি প্রত্যেকের জীবনের এই উত্থান এবং পতনের পরিস্থিতিটি আরও গভীর ভাবে অবলোকন করেছিলেন যে, সুখ এবং দুঃখের উত্থান এবং পতন হতে থাকে, অনবরত হতে থাকে। পাশাপাশি তিনি যা বুঝেছিলেন সেটা হ’ল উক্ত ঘটনার কারণটি আসলে আমাদের প্রতিটি মুহুর্তের অংশ। অন্য কথায়, আমরা যেভাবে সুখ-দুঃখের উত্থান এবং পতনের সাথে জিনিসগুলি অনুভব করি সেটা ঐ অসন্তুষ্ট পরিস্থিতিকে স্থায়ী করে দেয়।

সুতরাং, বুদ্ধ অবলোকন করেছেন এবং দেখেছেন যে, সেই কারণটা কী যেটা প্রতি মুহুর্তে থাকে এবং যা এই অসন্তুষ্ট পরিস্থিতিকে স্থায়ী করে। আর তিনি বুঝেছেন যে, কারণটা হ’ল বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি। অন্য কথায়, আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, আমাদের চারিপাশে প্রত্যেকে কীভাবে অস্তিত্বে আছে, আর এই জগতটা কীভাবে অস্তিত্বে আছে সেই বিষয়ে বিভ্রান্তি।

আরও অনেকে এটাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে তার থেকে একেবারেই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, অন্য কেউ কেউ বলেছে যে, আমরা যে সুখ এবং দুঃখের উত্থান-পতন অনুভব করি সেটা মূলতঃ পুরস্কার ও শাস্তির কারণে করি অর্থাৎ নিয়ম অনুসরণ করা বা না করার কারণে। অনেক শিক্ষকদের মতে, সুখ বা দুঃখ ভোগ করার মূল বিষয়টা হ’ল আনুগত্য। তবে বুদ্ধ বলেছেনঃ “না, সেটা নয়। আসল কারণটি হচ্ছে বিভ্রান্তি, আনুগত্য হওয়া বা আনুগত্য না হওয়ার বিষয় নয়, বরং এটা হচ্ছে জীবন সম্পর্কে বিভ্রান্তি।” তারপর, বুদ্ধ আরও বলেছেন যে, আমরা জিনিসগুলি কীভাবে অনুভব করি সেটা সম্পর্কিত বিভ্রান্তি আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য এবং প্রয়োজনীয় অংশ নয়। এটাকে সেখানে থাকার দরকার নেই। এটা এমন কিছু যা দূরীভূত করা যায় এবং পুরোপুরি দূরীভূত করা যায় যাতে এটা আর ফিরে না আসে। তারপরে তিনি বলেছেন যে, এটা করার আসল উপায়টি হ’ল জিনিসগুলিকে অনুভব করার জন্য আমাদের পদ্ধতিটাকে পরিবর্তন করা।

এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ আমাদের মুক্ত করার জন্য অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করার বিষয় নয়, বরং মূল বিষয়টা হচ্ছে আমাদের নিজেদের মনোভাব পরিবর্তন করা, বাস্তবতা বিষয়ে নিজেদের বোধগম্যতা পরিবর্তন করা। আমরা যদি সঠিক বোধগম্যতা দ্বারা ভুল বোধগম্যতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারি এবং তারপরে এই বোধগম্যতা বজায় রাখতে পারি, তাহলে আমরা আবিষ্কার করতে পারব যে, এই সুখ-দুঃখের নিয়মিত উত্থান-পতন হয় না আর আমরা উক্ত সুখ-দুঃখের উত্থান-পতনকে স্থায়ী করি না। সুতরাং, এটাই বুদ্ধের খুব প্রাথমিক শিক্ষা যেটাকে দৈনন্দিন ভাষায় প্রয়োগ করা হয়।

Top