সাধারণ সুখঃ বিপরিণাম দুঃখতা
কিছু মানুষ বৌদ্ধধর্মকে একটি নেতিবাচক ধর্ম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যেটা চিহ্নিত করে যে, আমরা যা কিছু ভোগ করি সবই দুঃখ এবং সুখকে একেবারেই মানে না। এটা অবশ্যই একটা ভুল তথ্য। এটা সত্য যে বৌদ্ধধর্ম ব্যাখ্যা করে যে আমাদের স্বাভাবিক, সাধারণ সুখ অসন্তুষ্টিজনকঃ এই সুখটি কখনোই স্থায়ী হয় না এবং আমরা কখনোই এটাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্জন করতে পারি না। এটা বাস্তবিক সুখ নয়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আইসক্রিম খাওয়াটা বাস্তবিক সুখ হতো তাহলে আমরা এক জায়গায় বসে যত বেশি আইসক্রিম খেতাম আমাদের ততবেশি সুখী হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা শীঘ্রই যখন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাই তখন আইসক্রিম খাওয়ার সুখটা অসুখীতা ও দুঃখে পরিণত হয়ে যায়। রৌদ্রে বসে থাকা বা ছায়ায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে বিষয়টা একই দাঁড়ায়। বিপরিণাম দুঃখ বলতে এটাকেই বোঝায়।
যদিও বৌদ্ধধর্ম এই বিপরিণাম-দুঃখতা নামক আমাদের সাধারণ সুখের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে অনেক পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে যাতে আমরা বুদ্ধের চিরস্থায়ী আনন্দদায়ক অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারি, তবুও আমাদের সাধারণ সুখের অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম এই ধরণের সুখ অর্জনের উৎস সম্পর্কেও ব্যাখ্যা করে। বৌদ্ধধর্ম এই শিক্ষার ব্যবস্থা করে, কারণ এর একটি মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য হল জগতের প্রত্যেকটি প্রাণী সুখ চায় আর কেউ দুঃখী হতে চায় না। যেহেতু প্রত্যেকেই সুখের খোঁজ করে এবং তাই সাধারণ প্রাণী হিসাবে আমরা সাধারণ, স্বাভাবিক সুখ ছাড়া অন্য কোন ধরণের সুখ সম্পর্কে জানি না। এই কারণে বৌদ্ধধর্ম ব্যাখ্যা করে যে, এই সুখকে কীভাবে অর্জন করা যেতে পারে। সাধারণ সুখের সর্বাধিক মৌলিক স্তরে যখন এই ধরণের ইচ্ছা এবং সুখের প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হয়ে যায় কেবল তখনই আমরা আরও উন্নত আধ্যাত্মিক অনুশীলন গুলির সাথে গভীরতর, আরও সন্তোষজনক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হই।
তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যেমনকি মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য শান্তিদেব “বোধিচর্যাবতারে” লিখেছেনঃ
দুঃখ ত্যাগ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা স্বয়ং দুঃখের দিকে ধাবিত হতে থাকে। যদিও তারা সুখের কামনা করে, তাসত্ত্বেও মোহ-এর কারণে নিজেদের সুখ নিজেদের শত্রুর মতো নষ্ট করে দেয়।
অন্যকথায় যদিও আমরা সুখের কামনা করি, তাসত্ত্বেও যেহেতু আমরা তার উৎস সম্পর্কে অজ্ঞ, এবং তাই নিজেদের জন্য সুখ অর্জন করার পরিবর্তে আমরা কেবল আরও বেশি অসুখীতা এবং দুঃখের জন্ম দিই।
সুখ একটি অনুভূতি
যদিও সুখ অনেক রকমের হয় কিন্তু এখানে আমরা আমাদের মনোযোগ সাধারণ সুখের উপর কেন্দ্রিভূত করব। এর উৎসকে বোঝার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের স্পষ্ট হতে হবে ‘সুখ’ বলতে কী বোঝায়। সুখ জিনিসটা কী, যেটাকে আমরা সকলেই অর্জন করতে চাই? বৌদ্ধ বিশ্লেষণ অনুযায়ী সুখ হল একটা মানসিক কারণ অর্থাৎ চৈত্ত। অন্যকথায় এটা হল একধরণের মানসিক ক্রিয়াকলাপ যার সাহায্যে আমরা কোন বস্তুর বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে সচেতন থাকি। এটা হল একটি অনুভূতি বা বেদনা (ছোর-ওয়া) নামক একটা বিস্তৃত মানসিক কারণের অংশ যা সম্পূর্ণভাবে সুখ থেকে অসুখীতা পর্যন্ত একটা বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করে।
‘অনুভূতি’-এর সংজ্ঞাটি কী? অনুভূতি হল একটা মানসিক কারণ, যার মধ্যে অনুভব করার স্বভাব থাকে। এর অর্থ হল কোন বস্তুকে অনুভব করার মানসিক ক্রিয়াকলাপ অথবা কোন বস্তু বা পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তবে অনুভব করার ক্রিয়াকলাপকে বোঝায়। সুখ এবং দুঃখের বিস্তৃত অনুভূতি না থাকলে আমরা বাস্তবে কোন বস্তু বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুভব লাভ করতে পারি না। যেমন একটা কম্পিউটার ডেটা (তথ্য) গ্রহণ করে এবং তারপর সেই ডেটার প্রক্রিয়া শুরু করে, তবে যেহেতু কম্পিউটারের মধ্যে সেই প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করার সময় কোন সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকে না, তাই কোন কম্পিউটার ডেটার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে না। এটাই হল একটা কম্পিউটার এবং মনের মধ্যে পার্থক্য।
সুখ-দুঃখের একটি স্তরের অনুভূতি ঐন্দ্রিয় বিষয়ের জ্ঞান- রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ অথবা সুখ বা দুঃখের দৈহিক সংবেদন- কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা করার মতো মানসিক বস্তুর জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। এক্ষেত্রে এটাকে নাটকীয় বা চরম পন্থা হওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না। এটা খুব নিম্নস্তরের হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে সুখ অথবা দুঃখের অনুভূতির কিছু স্তর আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে অন্তর্ভুক্ত করে- এমনকি আমরা যখন কোন স্বপ্ন না দেখে গভীর নিদ্রায় লীন থাকি তখনও আমরা এটাকে নিরপেক্ষ অনুভূতির মাধ্যমে অনুভব করি।
সুখের সংজ্ঞা
বৌদ্ধধর্ম সুখের দুটি সংজ্ঞা প্রস্তুত করে। একটি বস্তুর সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়িত হয় আর অন্যটি সংজ্ঞায়িত হয় নিজের মনের অবস্থার সাথে আমাদের অনুভূতির ক্ষেত্রে।
- প্রথমটি সন্তুষ্টিজনকভাবে কোন কিছুর অনুভূতি হিসাবে সুখকে সংজ্ঞায়িত করে। আর এটা এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে, এটি আমাদের জন্য লাভদায়ক, তবে বাস্তবে সেটা লাভদায়ক হতেও পারে নাও পারে।
- দ্বিতীয়টি সেই অনুভূতি হিসাবে সুখকে সংজ্ঞায়িত করে যখন যেটা শেষ হয়ে যায় সেটাকে আমরা পুনরায় অর্জন করতে চাই। অসুখীতা হল এক ধরণের অনুভূতি যেটা যখন জাগে আমরা তখন তার থেকে মুক্ত হওয়ার কামনা করি। অন্যদিকে নিরপেক্ষ অনুভূতি হল এক ধরণের অনুভূতি সেটা যখন জাগে অথবা সমাপ্ত হয়ে যায় তখন আমাদের মধ্যে ঐ দুটি কামনার মধ্যে কোনটাই থাকে না।
এই সংজ্ঞা দুটি পরস্পর সম্পর্কিত। আমরা যখন কোন কিছু সন্তোষজনক ভাবে অনুভব করি, তখন আমরা যেভাবে সেই বস্তুটাকে অনুভব করি সেটা হল বস্তুটি আক্ষরিক অর্থে মনোজ্ঞরূপে আমাদের মনে আবির্ভূত হয়। আমরা বস্তুটি গ্রহণ করি এবং তদনুসারে বস্তুটি আমাদের মনোযোগের বিষয় হিসাবে স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করে। এর থেকে বোঝা যায় যে আমরা আমাদের মনোযোগের বিষয়টিকে লাভজনক মনে করি, কারণ এটা আমাদের সুখী ক’রে তোলে; এটা আমাদের ভালো অনুভব করায়। যথারীতি ঐ অনুভব থেকে প্রাপ্ত লাভকে আমরা অবিরতভাবে ধরে রাখতে চাই। আর যদি কোন কারণে সেটা সমাপ্ত হয়ে যায় তাহলে আমরা সেটাকে আবার ফিরে পেতে চাই। কথোপকথনে, আমরা বলি আমরা বস্তুটি উপোভোগ করি এবং তার থেকে অনুভূতি লাভ করি।
তবে আমরা যখন কোন বস্তুকে যন্ত্রণাদায়করূপে অনুভব করি, তখন বস্তুর সাথে সম্পর্কিত এই অসুখী অনুভবকে আক্ষরিক অর্থে বলা হয় অমনোজ্ঞ অথবা অমনপ। এর অর্থ হল আমরা বস্তুটি গ্রহণ করি না আর সেই কারণে বস্তুটি আমাদের মনোযোগের বিষয় হিসাবে স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করে না। আমরা মনে করি যে বস্তুর প্রতি আমাদের অনুভবটি হল অনুপযোগী এবং প্রকৃতপক্ষে এটা আমাদের ক্ষতি করে। এইজন্য আমরা চাই এটার অবসান হোক। কথোপকথনে, আমরা বলি যে আমরা বস্তুটি উপভোগ করি না অথবা তার থেকে আমরা অনুভূতি লাভ করি না।
কোন বস্তুর গুণাবলীর অতিরঞ্জিতকরণ
কোন বস্তুর সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার অর্থ কী? আমরা যখন কোন বস্তুর সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তখন আমরা নির্বোধ বা অজ্ঞ না হয়ে এবং ভালো গুণাবলী অথবা তার ত্রুটিগুলি অতিরঞ্জিত বা অস্বীকার না করে সেটাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করি। এই বিষয়টি আমাদের অশান্তকারী আবেগ অর্থাৎ ক্লেশ এবং আমরা সুখী বা অসুখীতার সাথে কোন বস্তুকে অনুভব করি কিনা তার সম্পর্কে আলোচনা করাতে বাধ্য করে।
অশান্তকারী আবেগের একটি শ্রেণী হল লালসা, আসক্তি এবং লোভ। এই তিনটি অশান্তকারী আবেগের কারণে আমরা কোন বস্তুর ভালো গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করে তুলি। লালসার কারণে আমরা বস্তুটি প্রাপ্ত করতে চাই যদি সেটা আমাদের কাছে না থাকে; আসক্তির কারণে আমরা সেটাকে হারাতে চাই না যখন সেটা আমাদের কাছে থাকে; আর লোভের কারণে সেটা আমাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও আমরা আরও বেশি পেতে চাই। এই অশান্তকারী আবেগের কারণে আমরা বস্তুর স্বল্পতা উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখাই। এগুলি আমাদের মনের সুখী অবস্থা নয়। এর কারণ হল আমরা মনে করি বস্তু আমাদের সন্তুষ্টি প্রদান করে না। এর অর্থ হল আমরা বস্তুতে সন্তুষ্ট নই। আমরা যথাযথভাবে সেটাকে গ্রহণ করি না।
উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন আমাদের প্রেমী অথবা প্রেমিকাকে দেখি, যার প্রতি আমরা খুবই আসক্ত, আমরা তখন সেই দৃশ্যটি সুখ বা আনন্দের সাথে উপভোগ করতে পারি। আমরা ব্যক্তিটাকে দেখে সন্তুষ্ট হই; আমরা সেটাকে সন্তোষজনক মনে করি। কিন্তু যখনই আমরা ঐ ব্যক্তির ভাল গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি এবং তার সাথে থাকি আমাদের মধ্যে তার প্রতি আসক্তি জেগে ওঠে আর যখনই আমরা তার সঙ্গ পাই না আমরা তার নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি, ফলে আমরা অসন্তুষ্ট এবং অসুখীতা বোধ করতে থাকি। আমরা এখনই ঐ ব্যক্তিটিকে দেখার মুহূর্ত হিসাবে গ্রহণ করি না বরং আমরা তাকে আরও চাই এবং তার চলে যাওয়াকে আমরা ভয় পাই। ফলস্বরূপ, আমরা হঠাৎ করেই আমাদের প্রিয়জনকে অসন্তোষজনক, অস্তিরতা এবং অসুখীতার সাথে দেখার অনুভব করি।
অশান্তকারী আবেগের আরও একটি শ্রেণী হল বিকর্ষণ, ক্রোধ এবং বিদ্বেষ। এগুলির ভিত্তিতে আমরা কোন বিষয়ের দোষ বা নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করে তুলি এবং সেইজন্য আমরা সেটাকে আর পেতে চাই না যদি আমাদের কাছে সেটা না থাকে; সেটা থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই যখন সেটা আমাদের কাছে থাকে; আর যখন তার অবসান হয় আমরা সেটাকে পুনরায় পেতে চাই না। এই তিনটি অশান্তকারী আবেগ সাধারণত ভয়ের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকে। সেগুলিও মনের সুখী অবস্থা নয় কারণ আমরা সেই বিষয়ের প্রতি সন্তুষ্ট নই। আমরা যথাযথ ভাবে সেটাকে গ্রহণ করি না।
উদাহরণ স্বরূপ, ধরুণ আমাদের দাঁতের রুট ক্যানেল করাতে হবে। ব্যথার শারীরিক সংবেদন হল আমাদের অনুভবের বিষয়বস্তু। আমরা যদি বস্তুর নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত না করে সেটা যেমন আছে তেমনভাবেই গ্রহণ করি তাহলে প্রক্রিয়াটি চলাকালীন আমরা অসুখী হব না। ব্যথার অনুভূতি জাগাকালে আমরা একটি নিরপেক্ষ অনুভূতি বজায় রাখতে পারব; আমরা মেনে নেব যে যত সময় পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে এটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করব না; আর যখন দন্ত চিকিৎসক ড্রিলিং করা বন্ধ করে দেবেন আমরা কামনা করব না তিনি যেন আরও বেশী ড্রিলিং করুক। ফলে আমাদের মধ্যে ড্রিলিং-এর ব্যথার সমতা বজায় থাকে অর্থাৎ না বিকর্ষণ, না আকর্ষণ, না নির্বোধতা। প্রকৃতপক্ষে, ড্রিলিং-এর প্রক্রিয়াটি চলাকালীন আমরা এই চিন্তা-ভাবনার উপর মনোনিবেশ ক’রে আনন্দ অনুভব করতে পারি যে আমরা ভবিষ্যতে বেশি দাঁতের ব্যথাকে প্রতিরোধ করতে চলেছি।
মনে রাখবেন, কোন কিছুর প্রতি সুখী হওয়া বা সন্তুষ্ট হওয়াটা প্রয়োজনের ভিত্তিতে বেশি কামনা করা অথবা কামনা করাকে বাদ দেওয়া নয়। এটা আমাদের নিষ্ক্রিয় ক’রে তোলে না যাতে আমরা কখনো জীবনে নিজেদের বিষয়, স্বয়ং নিজেদের অথবা নিজেদের পরিস্থিতির উন্নতি করার চেষ্টা না করি। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের কর্মক্ষেত্রে কোন একটা পরিকল্পনা গ্রহণ ক’রে তাতে যা অগ্রগতি করেছি অথবা অস্ত্রপ্রচার ক’রে যতটুকু সুস্থ হয়েছি আমরা সেটা গ্রহণ করতে পারি, সন্তুষ্ট হতে পারি এবং পরিণাম স্বরূপ তাতে আমরা সুখী হতে পারি। তবে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এখনো অবধি যেটা অর্জন করেছি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আরও অগ্রগতি করার কামনা করতে পারি। আমাদের প্লেটে রাখা আহারের পরিমাণ বা ব্যাঙ্কে সঞ্চয় করে রাখা টাকা-পয়সার পরিমাণের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া প্রযোজ্য, যদি প্রকৃতপক্ষে বাস্তবিকতা এই হয় যে আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে নেই এবং আমাদের আরও বেশি প্রয়োজন নয়। খাওয়া-দাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আহার না থাকা, ব্যাঙ্কে টাকা-পয়সা না থাকা অথবা বেশি পরিমাণে থাকার সুবিধাকে অস্বীকার করার নেতিবাচক দিকগুলিকে অতিরঞ্জিত না ক’রে আমাদের কাছে যতটুকু পরিমাণে আছে তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আমরা বেশি পরিমাণ আহার অথবা টাকা-পয়সা অর্জন করার জন্য চেষ্টা করতে পারি। আমরা যদি এতে সফল হই তাহলে মনে করতে হবে ঠিক আছে; আর যদি অসফল হই তাহলেও বলব ঠিক আছে। আমরা কোন না কোন ভাবে চালিয়ে যাব। তাহলেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল বেশি অর্জন করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি কিন্তু সেটা করতে পারি সাফল্যের জন্য প্রত্যাশার মানসিক বিচরণ অথবা ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বেগ ত্যাগ ক’রে।
শান্তিদেব ধৈর্য সম্পর্কে বোধিচর্যাবতারে “ধৈর্য”- নামক অধ্যায়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-
যদি প্রতিকার করা সম্ভব হয় তাহলে মন খারাপ করা উচিত নয়। যদি প্রতিকার করা সম্ভব না হয় তাহলেও মন খারাপ করেই বা লাভ কী?
সুখের মূল উৎস হিসাবে গঠনমূলক আচরণ
দীর্ঘমেয়াদে, গঠনমূলক আচরণ হল সুখের মূল কারণ। এর অর্থ হল, লালসা, আসক্তি, লোভ, বিকর্ষণ, ক্রোধ, নির্বোধতা ইত্যাদির মতো অশান্তকারী আবেগের প্রভাবের অধীনে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত থাকা, নিজের এবং অন্যের উপর আমাদের আচরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের উদ্বেগ ব্যতীত আচরণ। দুঃখী হওয়ার মূল কারণ হিসাবে ধ্বংসাত্মক আচরণ বলতে এই ধরণের আচরণে যুক্ত থাকাকে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, লালসার কারণে আমরা কোন স্টোরের জিনিসপত্রের ভালো গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি। আর আইনী পরিণতিকে উপেক্ষা ক’রে আমরা সেটা চুরি করি। ক্রোধের কারণে আমরা আমাদের অংশীদার যদি কিছু বলে থাকে আমরা তার নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি এবং এরফলে আমাদের সম্পর্কের উপর যে প্রভাব পড়বে সেটাকে উপেক্ষা ক’রে আমরা তার প্রতি চিৎকার করি অথবা কঠোর ভাবে কথা বলি।
অশান্তকারী আবেগ বা ক্লেশের প্রভাব থেকে বিরত হয়ে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে। পরিণাম স্বরূপ, ভবিষ্যতে যদি কোন অশান্তকারী আবেগ জাগে তাহলেও আমরা এর ভিত্তিতে কোন কর্ম করব না এবং অবশেষে অশান্তকারী আবেগের শক্তি দুর্বল হতে থাকবে। আর শেষ পর্যন্ত অশান্তকারী আবেগ খুব কম জাগবে। অন্যদিকে আমরা যত অশান্তকারী আবেগের ভিত্তিতে কর্ম করব ভবিষ্যতে সেটা তত বেশি জাগতে থাকবে এবং ক্রমশ সেটা আরও প্রবল হতে থাকবে।
যেমনকি আমরা দেখেছি, আমরা যখন কোন বস্তুকে সুখ বা আনন্দের সাথে অনুভব করি তখন আমরা সেটাকে নির্বোধতা, লালসা, লোভ, বিদ্বেষ অথবা ক্রোধের মতো অশান্তকারী আবেগ ব্যতীত অনুভব করি। ঐ সময় বিষয়টিকে অনুভব করা তার প্রকৃত স্বভাবটি কী সেই হিসাবে গ্রহণ করার ভিত্তির উপর নির্ভর করে। ঐ সময় আমরা বিষয়টির ভালো বা খারাপ দিকটা না অতিরঞ্জিত করি, না অগ্রাহ্য করি। এইভাবে অনুভব করার প্রক্রিয়াটি গঠনমূলক আচরণের অভ্যাস থেকে জাগে যার অধীনে আমরা আচরণ করি, কথা বলি এবং চিন্তা-ভাবনা করি। একইভাবে মানুষ, বস্তু অথবা পরিস্থিতির ভালো দিকগুলিকে অতিরঞ্জিত না করে অথবা খারাপ দিকগুলিকে অগ্রাহ্য না করে তাদের প্রকৃত স্বভাব যেমন তার ভিত্তিতে তাদের গ্রহণ করি।
সুখের পরিপক্কতার জন্য আবশ্যক সম্ভাব্যতার পরিস্থিতিগুলি
সুখ বা দুঃখের সাথে আমরা যেভাবে সমস্ত বস্তু বা চিন্তা-ভাবনা অনুভব করি সেটা স্বয়ং বস্তু বা চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নির্ধারণ হয় না। যেমনকি আমরা দেখেছি, আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পূর্ববর্তী আচরণের মাধ্যমে আমরা যদি ঐ বস্তুগুলির ইতিবাচক দিকগুলিকে অতিরঞ্জিত করা অথবা নেতিবাচক দিকগুলিকে অগ্রাহ্য করা থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলে থাকি তাহলে দাঁতের রুট ক্যানালের কাজ করার সময় উত্থিত যন্ত্রণাকেও আমরা মনের সুখী অবস্থার সাথে অনুভব করতে পারব। সুখের সংজ্ঞার দিকে ফিরে গিয়ে আমরা পুরো প্রক্রিয়াটিকে সন্তোষজনক ভাবে অনুভব করতে পারি। এর কারণ হল ঐ প্রক্রিয়াটি আমাদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যে ঐ কাজটি আমাদের নিজেদের উপকারের জন্যই হচ্ছে।
যদিও আমরা অশান্তকারী আবেগের অধীনে কর্ম করা, কথা বলা অথবা চিন্তা-ভাবনা থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পেরেছি এবং তার ভিত্তিতে সুখের সাথে বিষয় এবং চিন্তা-ভাবনাকে অনুভব করার সম্ভাবনা গড়ে তুলতে পেরেছি, তবুও সেই সম্ভাবনাটিকে সুখের অনুভবে পরিণত করার জন্য নির্দিষ্ট পরিস্থিতি আবশ্যক। কোন বস্তুকে সুখের সাথে অনুভব করতে হলে সেটা দৃঢ়ভাবে নির্ভর করে আমাদের মনোভাবের উপর যে আমরা বস্তুটির আসল বাস্তবিকতা কীভাবে গ্রহণ করি, তাতে বস্তুটি যা কিছুই হোক না কেন অর্থাৎ এটা রুট ক্যানেল কাজের যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক সংবেদন হোক অথবা প্রিয়জনের দৃশ্য। সুতরাং এই মুহূর্তে আমরা সুখী বা অসুখী যাই অনুভব করি না কেন আর আমরা যে কোন বস্তু দেখি, শুনি, শুঁকি, স্বাদ গ্রহণ করি, শারীরিকভাবে স্পর্শ গ্রহণ করি অথবা চিন্তা-ভাবনা করি না কেন, সব ক্ষেত্রেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনের অবস্থা খুবই সমালোচনামূলক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এটাও দেখেছি যে আমরা যখন কোন কিছুর বাস্তবতা গ্রহণ করি এবং সেটার সম্পর্কে নির্বোধ হয়ে না থাকি, তখন আমরা তার ভাল গুণাবলীগুলিকে অতিরঞ্জিত করি না অথবা খারাপ গুণাবলীগুলিকে অগ্রাহ্য করি না। এরফলে আমরা সেই বস্তুকে লালসা, লোভ বা আসক্তি অথবা বিকর্ষণ বা ক্রোধের সাথে উপভোগ করি না। সুতরাং, সুখকে যেকোন নির্দিষ্ট মুহূর্তে পরিপক্ক করার জন্য যা পরিচালনা করতে যা সহায়তা করে সেটা হল নির্বোধতা থেকে মুক্ত হওয়া।
নির্বোধতা বা মোহ
দুঃখের যেকোন মুহূর্তে আমরা যে বিষয়টি উপভোগ করি সেটার সম্পর্কে আমাদের নির্বোধতা বা মোহ অগত্যা সীমাবদ্ধ থাকে না। মোহ-এর আরও বেশী বিস্তৃত পরিসর আছে। এটা নিজেদের উপরও মনোনিবেশ করা যেতে পারে। আমরা যখন বড় দুঃখ সহ কোন সমস্যার সম্মুখীন হই, তখন মোহ-এর কারণে আমরা বিষয়টাকে শুধু নিজের উপরই স্থির করে ফেলি আর আমরা এমনকি ভাবতে লাগি যে আমরাই কেবল এই সমস্যাটি ভোগ করছি।
আমাদের চাকুরী হারানোর উদাহরণটি নেওয়া যাক। বাস্তবটা হল বিশ্বজুড়ে এমন মিলিয়ন সংখ্যায় লোকজন আছে যারা তাদের চাকুরী হারিয়ে এখন বেকার হয়ে পড়ে আছে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ, আমরা অনিত্যতা সম্পর্কে নির্বোধ না হয়ে আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে হেতু এবং প্রত্যয় থেকে উদ্ভূত সমস্ত ধর্ম (বস্তু) অন্যান্য হেতু এবং পরিস্থিতির কারণে প্রভাবিত হয় এবং অবশেষে সেগুলি সমাপ্ত হয়ে যায়। এই চিন্তা-ভাবনাটি খুবই সহায়ক হতে পারে। তবে বিষয়টি আরও কার্যকর হবে যখন আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করব যেখানে কেবলমাত্র আমাদের সমস্যা নয় বরং চাকুরীর মতো প্রত্যেকের সমস্যা অন্তর্ভুক্ত হবে, যদি কিনা সেটা ঘটে থাকে। আমাদের ভাবতে হবে, “এটি শুধু আমার একার সমস্যা নয় বরং সমস্যাটি হল বিশাল সংখ্যক মানুষের। আমি কেবল একা নই যার একটা সমাধানের প্রয়োজন আছে; অন্য সকলেরই সমাধান প্রয়োজন। প্রত্যেককেই এই ধরণের সমস্যা এবং দুঃখকে কাটিয়ে উঠতে হবে।” এটিই হল বাস্তবতা।
নির্বোধতা ব্যতীত এই চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা নিজের প্রতি মমত্ববোধের পরিবর্তে অপরের জন্য করুণা বিকাশ করতে পারি। এরফলে আমাদের মন আর কখনো সংকীর্ণভাবে শুধু নিজের দিকে মনোনিবেশ করবে না, পরিবর্তে এই পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে অন্য সকলের জন্য চিন্তা-ভাবনা করার প্রবৃত্তি আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে উঠবে। অন্যের সমস্যা কাটিয়ে ওঠানোর সহায়তা করার কামনার কারণে আমাদের নিজস্ব সমস্যাগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে হ্রাস পেতে থাকে এবং সেগুলিকে একটা উদ্দেশ্যমূলক পদ্ধতিতে মোকাবিলা করার জন্য আমরা সাহস এবং শক্তি বিকাশ করি। আমরা অবশ্যই চাকুরী হারাতে চাই না, কিন্তু সমতা ভাবনার মাধ্যমে আমরা পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার করি। আর অন্যের কথা ভেবে আমরা আনন্দিতও হতে পারি যে, এখন আমাদের কাছে তাদের সহযোগিতা করতে চেষ্টা করার সুযোগ আছে।
করুণা এবং সুখের মধ্যে সম্পর্ক
এরপর কোন বিষয় বা কোন সুখের পরিস্থিতিকে অনুভব করতে আমাদের সম্ভাবনাকে পরিচালনা করার অন্যতম মূল কারণ হল করুণা। কিন্তু সেটা কাজ করে কীভাবে? অন্যরা দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হোক এই কামনা করা হল করুণা, যেমনটা আমরা নিজেদের জন্য কামনা করি। তবে আমরা যখন অন্যের দুঃখ এবং অসুখীতার উপর মনোনিবেশ করি তখন আমরা স্বাভাবিক ভাবে সেই বিষয়ে সুখী হই না, দুঃখিত হই। অথবা আমরা আমাদের অনুভূতিগুলি অবরুদ্ধ করে ফেলি আর কিছুই অনুভব করি না। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা তাদের দুঃখ সম্পর্কে সুখী বোধ করি না। সুতরাং করুণা কীভাবে মনের সুখী অবস্থা উৎপন্ন করতে পারে?
এটাকে বুঝতে হলে আমাদের বিপর্যস্ত অনুভূতি এবং অবিপর্যস্ত অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। এখানে আমি এই শব্দাবলীগুলি তাদের যথাযথ সংজ্ঞার মাধ্যমে নয় বরং আরও বেশি চলিত অপরিভাষাগত পদ্ধতিতে ব্যবহার করছি। পার্থক্যটি হল সেটা সুখী, অসুখী অথবা নিরপেক্ষ যাই হোক না কেন, অনুভূতিটি নির্বোধতা বা মোহ এবং বিভ্রান্তির সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। মনে রাখবেন, আমরা যখন সাধারণ ভাবে সুখকে দুঃখ থেকে আলাদা করি তখন সেখানে পার্থক্যটি হয় আমরা যে বস্তুকে অনুভব করি সেটার সম্পর্কে আমরা নির্বোধ থাকি কিনা।
এখানে আমরা যদি অসুখীতার সাথে উপভোগ করি এমন বস্তুর গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত বা অগ্রাহ্য নাও করি তাহলেও আমরা আমাদের মাথার উপর অন্ধকারে ঝুলে থাকা ভারী মেঘের মতো, সেই অসুখী অনুভূতিটিকে একধরণের দৃঢ় সত্যতঃ সিদ্ধ বা সত্যতঃ অস্তিত্বযুক্ত বস্তু রূপে পরিণত করি। তারপর আমরা সেই অনুভূতির নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি এবং কল্পনা করি। উদাহরণ স্বরূপ, “একটি ভয়ঙ্কর হতাশা” হিসাবে আমরা তখন তার ভিতরে আটকে থাকার মতো অনুভব করি। এক্ষেত্রে নির্বোধতা এটাকে যথাযথ ভাবে অসুখী অনুভূতিরূপে গ্রহণ করে না। সর্বোপরি, অসুখী অনুভূতি হল এমন কিছু যা মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হয়। কারণ এর তীব্রতায় অনেক পার্থক্য আছেঃ এটা কোন প্রকারের দৃঢ় একঘেয়ে বস্তু নয় যা নিজস্বভাবে অস্তিমান এবং অন্য কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
আমরা যখন অন্যের কথা ভাবি এবং কোন প্রকারের অনুভূতি আমাদের মধ্যে জাগে না, আমরা তখন একই রকম বিশ্লেষণ প্রয়োগ করতে পারি। এক্ষেত্রে আমরা যখন দুঃখ বা অসুখী বোধের নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করি তখন আমরা সেটাকে উপভোগ করতে ভয় পাই এবং তাই আমরা সেটাকে অবরুদ্ধ করি। ফলে আমরা তখন একটি নিরপেক্ষ অনুভূতি উপভোগ করি, সুখের অনুভূতিও না দুঃখের অনুভূতিও না। তবে তখন আমরা নিরপেক্ষ অনুভূতিটিও অতিরঞ্জিত করি আর সেটাকে শক্ত কিছু হিসাবে কল্পনা করি, যেমন একটা বড় শক্ত “কিছুই না” যা আমাদের মধ্যে বসে আছে আর আমাদের আন্তরিক ভাবে কিছু অনুভব করা থেকে বিরত রাখছে। করুণাকে বিকাশ করার জন্য এটা অস্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে অন্যের কঠিন পরিস্থিতি দুঃখজনক যেমনটি আমাদের হতে পারে, যেমন আমরা চাকুরী হারানোর সময় যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। ঐ রকম পরিস্থিতিতে ঐ দুঃখ অনুভব করতে বা সেটাকে অবরুদ্ধ করা অথবা দমন করতে ভয় পাওয়া অস্বাস্থ্যকরও হবে। আমাদের এই দুঃখটা অনুভব করতে হবে, তবে সেটাকে করতে হবে অবিরক্তিকর ভাবে যাতে আমরা অন্যের দুঃখের প্রতি সহানুভূতি জানাতে সক্ষম হতে পারি। এরফলে আমরা অন্যদের দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য গভীর আন্তরিক ইচ্ছা বিকাশ করতে এবং সেই দুঃখকে কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করার জন্য কিছুটা দায়বদ্ধ হতে পারি। সংক্ষেপে বৌদ্ধ পরামর্শ হল, “দুঃখ ভোগ করার কারণে, কোন কিছুকে একটা শক্ত ‘বস্তু’ হিসাবে পরিণত করবেন না; এটাকে কোন বড় বিষয় বানিয়ে ফেলবেন না।”
মনকে শান্ত করা
অবিরক্তিকর ভাবে দুঃখের অনুভূতি অনুভব করার জন্য আমাদের সমস্ত মানসিক বিচরণ এবং নিস্তেজতা যুক্ত মনকে শান্ত করতে হবে। মানসিক বিচরণের কারণে আমাদের মনোযোগ অশান্তকারী বহিরাগত চিন্তা-ভাবনা যেমন- উদ্বেগ, সন্দেহ, ভয় অথবা আমরা যা আশা করি সেই প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। মানসিক নিস্তেজতার কারণে আমরা একটি মানসিক কুয়াশায় পতিত হই যারফলে আমরা সব কিছুর প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠি।
আমাদের মানসিক বিচরণ এবং নিস্তেজতার মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বৌদ্ধধর্ম অনেক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। সবচেয়ে মৌলিক পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি পদ্ধতি হল আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে শান্ত হয়ে যাওয়া। এই পদ্ধতির মাধ্যমে মানসিক বিচরণ ও নিস্তেজতা সহ আমাদের মন প্রশান্ত এবং নির্মল হয়ে যায়। এই রকম অবস্থায় আমরা আরও সহজেই যে কোন অতিরঞ্জিততা, ঘৃণা অথবা অন্যের সমস্যা এবং দুঃখ সম্পর্কে আমাদের অনুভূতির প্রতি উদাসীনতাকে শান্ত করতে পারি। তারপরেও যদি আমরা শুরুতে দুঃখ বোধ করি, এর কারণে আমরা ভেঙে পড়ি না।
যদিও অবশেষে আমাদের মন আরও শীথিল এবং শান্ত হয়ে ওঠে, তবে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই একটা নিম্নস্তরের সুখ ভোগ করি। একটা প্রশান্ত মানসিক এবং আবেগপ্রবণ অবস্থায় মনের উষ্ণতা এবং সুখ প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যদি গঠনমূলক আচরণে যুক্ত হয়ে সুখ ভোগ করার জন্য প্রবল সম্ভাবনা তৈরী করে থাকি তাহলে আমাদের মনের প্রশান্তিময় পরিস্থিতি তাদের পরিপক্ক হতেও উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করে।
মৈত্রীর বিকাশ
এরপর আমরা এই সুখকে মৈত্রীর চিন্তা-ভাবনার সাথে বৃদ্ধি করি। মৈত্রী হল অন্য সত্ত্বরা সুখ এবং সুখের কারণে যুক্ত হোক, এই কামনা। এই ধরণের কামনা স্বাভাবিক ভাবে করুণামূলক সহানুভূতি থেকে উদ্ভুত হয়। যদিও আমরা কারও বেদনা এবং দুঃখের প্রতি দুঃখী হয়ে উঠি কিন্তু সক্রিয়ভাবে ব্যক্তির সুখী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার সময় সেরকম ভাবে অনুভব করাটা কঠিন হয়ে ওঠে। আমরা যখন নিজের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা বন্ধ করে দিই এবং তার পরিবর্তে অন্য কারও সুখের উপর মনোনিবেশ করি, তখন আমাদের হৃদয় স্বাভাবিক ভাবেই উষ্ণ হয়ে ওঠে। এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের মনে আরও বেশি আনন্দের মৃদু অনুভূতি জাগায় এবং এটা আমাদের গঠনমূলক আচরণের মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে নির্মিত সুখী অনুভব করার জন্য আরও বেশি সম্ভাবনা তৈরী করতে পারে। সুতরাং যখন মৈত্রী নিঃস্বার্থ এবং আন্তরিক হয় তখন একটা মৃদু সুখ তার সাথে প্রবাহিত হয়। আর এই সুখটা বিরক্তিকর হয় না, বরং এর কারণে আমাদের দুঃখ অদৃশ্য হয়ে যায়। যেমন মাথা ব্যথায় পীড়িত একজন মা-বাবা তার অসুস্থ সন্তানকে শান্তনা দেওয়ার সময় তার নিজের ব্যথা ভুলে যান, ঠিক তেমনই আমরা যখন মৈত্রী ভাবনা প্রসার করি তখন কারও দুর্গতির কারণে আমাদের মনে যে দুঃখ জাগে সেটাও অদৃশ্য হয়ে যায়।
সারাংশ
সংক্ষেপে, দীর্ঘমেয়াদে, বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী সুখের সবচেয়ে মৌলিক উৎস হল লালসা, লোভ, আসক্তি, বিদ্বেষ এবং ক্রোধের মতো অশান্তকারী আবেগ বা ক্লেশ এবং মনোভাবের প্রভাবের অধীনে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা। ভবিষ্যতে সুখ ভোগ করার জন্য এই ধরণের গঠনমূলক আচরণ আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে সম্ভাবনা তৈরী করে। আমরা যে বস্তু বা পরিস্থিতি অনুভব করি অথবা যে স্তরের সুখ বা দুঃখের অভিজ্ঞতা অর্জন করি তাদের ভালো গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত না ক’রে এবং খারাপ গুণাবলীকে অগ্রাহ্য না ক’রে আমরা সেই সম্ভাবনাগুলিকে পরিপক্ক করতে প্রেরণা দিতে পারি। এক্ষেত্রে নির্বোধতা এবং তার পাশাপাশি আসক্তি, বিদ্বেষ অথবা উদাসীনতা ছাড়াই তখন আমাদের মানসিক বিচরণ এবং নিস্তেজতা বিজড়িত আমাদের মনকে শান্ত করা দরকার।
বিশেষ ক’রে আমাদের উদ্বেগ অথবা প্রত্যাশা বিজড়িত মনকে শান্ত করা দরকার। এই নির্মল এবং প্রশান্ত মনের মধ্যে আমরা ইতিমধ্যে একটা নিম্নস্তরের সুখ অনুভব করি এবং বৃহত্তর সুখ অনুভব করার জন্য আমাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটাকে পরিচালনা করা দরকার।
এরপর আমরা অন্যের সমস্যার দিকে মনোনিবেশ করি এবং তারা কীভাবে আমাদের থেকে আরও খারাপ পরিস্থিতিতে বিজড়িত হতে পারে সে সম্পর্কে আমরা আমাদের মনকে প্রসারিত করি। আমরা শুধু আমাদের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা বন্ধ করে দিই। আমরা ভাবি যে অন্য সকলেই যদি তাদের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে যায় তাহলে কী চমৎকারই না হবে এবং আমরা যদি তাদের এই উদ্দেশ্যটা সম্পাদন করতে সহায়তা করতে পারি তাহলে কী দুর্দান্তই না হবে। এই প্রবল করুণা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মনোভাবকে মৈত্রীর অনুভূতির দিকে পরিচালনা করে অর্থাৎ তাদের সুখী হওয়ার কামনা জাগায়। তাদের সুখ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার মনোভাবটি আমাদের সুখের সম্ভাবনাকে পরিপক্ক করতে আরও বেশি উৎসাহিত করে।
করুণা এবং মৈত্রীর এই ভাবনাগুলির মাধ্যমে আমরা বুদ্ধত্ব লাভ অথবা কোন মহান মানবীয় ব্যক্তিত্বের দিকে অভিমুখ করতে পারি। তাদের দৃষ্টান্তগুলির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ক’রে বাস্তবে অপরকে সহায়তা করতে প্রচেষ্টা করার জন্য কিছু দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য আমরা অনুপ্রেরণা অর্জন করি। এই অনুপ্রেরণাটি কেবল আমাদের অন্যের সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার শক্তি এবং সাহস অর্জন করতে সহায়তা করে তা নয়, বরং এর পাশাপাশি এটা আমাদের নিজেদের সমস্যা মোকাবিলা করতেও সহায়তা করে, তবে আমরা এটা করতে সফল হই সেগুলিকে অতিরঞ্জিত না ক’রে আর ব্যর্থতা বা সাফল্যের প্রত্যাশা সম্পর্কে উদ্বেগ না হয়ে।