সুখের পথে চলার জন্য সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার সংকল্প

তথ্যের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে গেলে, এর থেকে সৃষ্টি হওয়া চাপের কারণকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে এবং এর থেকে মুক্ত হওয়ার সংকল্পের মাধ্যমে আমাদের ডিজিটাল জীবনকে আরও ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর কৌশল অনুসরণ করতে হবে।

তথ্য যুগের এই চাপের মোকাবিলা করার জন্য ইন্টারনেটকে, আমরা কেমনভাবে সামাজিক মাধ্যম, বার্তা ইত্যাদি রূপে ব্যবহার করি তার পরীক্ষা করা দরকার। একবার যখন আমরা আমাদের নিজের ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলি সনাক্ত করে ফেলব, যা আমাদের মধ্যে আরও চাপের সৃষ্টি করে, তখন আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে যে দুঃখের উৎস আমাদের নিজেদের মনের মধ্যে রয়েছে। চাপ না নিয়ে, স্ব-শৃংখলাবদ্ধতা, একাগ্রচিত্ত, মননশীলতা এবং প্রভেদমূলক সচেতনতার সংকল্প নিয়ে, আমরা আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জগুলিকে আরো স্পষ্টভাবে এবং শান্তভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হব।

আমরা বড় শহর, ছোট নগর বা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করি না কেন আমরা সকলেই আমাদের আধুনিক বিশ্বে সমস্যার সম্মুখীন হই। বেশিরভাগ মানুষই “চাপ” শব্দটির সাথে নিজেদের জুড়ে দেয়। তথ্য, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন স্টেশন, সংগীত, সামাজিক বার্তা, খবর, তাৎক্ষণিক বার্তা, অনলাইন পণ্য ইত্যাদি আমরা আরও বেশি চাই যা তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধও হয়ে যায়। উপরে-উপরে তাদের দেখে মনে হয় তারা আমাদের জীবনযাত্রার আরও উন্নতি করছে, কিন্তু বাস্তবে এগুলি আমাদের জীবনকে আরও জটিল ও চাপযুক্ত তৈরী করে, বিশেষ করে যখন সেখানে অনেক বেশি বিকল্প থাকে। আমরা খবর, ই-মেইল বা তাৎক্ষণিক বার্তা কোনটাই বাদ দিতে চাই না। আমরা ভয় পাই যে কিছু বাদ পড়ে না যায়। এমনকি আমরা যদি টিভি অনুষ্ঠানের জন্য কোন কিছু বেছে নিয়ে থাকি, আমাদের মধ্যে সন্দেহ জাগে হয়তো দেখার মতো আরও ভালো কিছু বাদ পড়ে গেল।

আমরা সবাই সমাজের একটা অঙ্গ হতে চাই, একদল বন্ধুদের মধ্যে থাকতে চাই; আমরা সামাজিক বার্তাতে যা কিছু পোস্ট করি না কেন তার জন্য আমরা ‘পছন্দ (লাইক)’ পেতে চাই যাতে আমরা এটা অনুভব করতে পারি যে আমরা সমাজে স্বীকৃত। আমরা শান্ত হই না এবং আমরা যে পছন্দগুলি পেয়ে থাকি বা ইন্টারনেটে আমরা যে তথ্য পড়ে থাকি তার সংখ্যায় আমরা কখনই সন্তুষ্ট হই না। আমরা এই প্রত্যাশার সাথে আরও বেশি উত্তেজিত‌ হয়ে থাকি, কখন আমাদের ফোন ইঙ্গিত করবে যে আমরা একটা বার্তা প্রাপ্ত করেছি বা আমাদের ফেসবুক পেজ পরীক্ষা করে দেখি যে আমরা বেশি “পছন্দ” পেয়েছি কিনা বা একটি খবরের প্রতি আসক্ত হওয়ার মত পুনরায় খবরগুলিকে দেখি নতুন কিছু ঘটেছে কিনা। যদিও আমরা কিছুই বাদ দিতে চাই না, তাহলেও আমরা এতে কখনোই সন্তুষ্ট হই না, বরং আমরা আরও চাই।

অন্যদিকে আমরা আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি দেখে অভিভূত হই আর তাই জন্য আমরা আমাদের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে এবং পাতালরেলে থাকাকালীন বা ঘুরে বেড়ানোর সময় গান শুনে সেগুলি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকে রোধ ক’রে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভার্চুয়াল জগতে পালিয়ে যাই। আমরা সর্বদা বিনোদনকে বাধ্যতামূলক প্রয়োজন বোধ করি। একদিকে আমরা শান্তি এবং প্রশান্তির আকাঙ্ক্ষা করি আবার অন্যদিকে আমরা তথ্য, সংগীত ইত্যাদির অভাবে শূন্যতার আশঙ্কা করি। আমরা বাহ্যিক দুনিয়ার চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ, তাই আমরা সেটিকে ছেড়ে দিয়ে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ফিরে যেতে চাই। তাসত্ত্বেও সামাজিক মাধ্যমে আমরা সেখানে আমাদের তথাকথিত "বন্ধু"-দের সঙ্গ এবং অনুমোদনের সন্ধান করি এবং কখনই সুরক্ষিত বোধ করি না। তবে আমাদের এই মোবাইল যন্ত্রে ফিরে যাওয়াটাই কি কোনো সমাধান?

যখন আমরা এই অভ্যাসগত নিয়মানুবর্তিতাতে আটকে থাকি এবং এর উৎসগুলি নির্ধারণ করি, তখন আমরা যে অসুখীতা ভোগ করি তার সনাক্তকরণ প্রয়োজন। তারপর আমাদের এই অসুখীতা এবং তার উৎস মুক্ত হওয়ার উপায় সম্পর্কে অবগত হয়ে তার মুক্ত হওয়ার সংকল্প বিকাশ করতে হবে এবং এই কাজটি ঘটানোর ক্ষেত্রে আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কিন্তু আমরা একটি জীবন্ত লাশের মতো অনুভূতিহীন হতে চাই না, আমরা সুখী হতে চাই। আর সুখ বলতে শুধুমাত্র দুঃখের অনুপস্থিতিকে বোঝায় না; এটি দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একটি নিরপেক্ষ, অনুভূতিহীন অবস্থা।

আমাদের নিজেদের মন হল দুঃখের উৎস

আমরা যে দুঃখ, পীড়ন এবং চাপ অনুভব করি তার উৎস বাহ্যিক বস্তু বা পরিস্থিতি নয়; নতুবা যারা এর মুখোমুখি হয়ে থাকে তারা সকলেই এটি একইরূপে অনুভব করত।

আমাদের এই দুঃখের উস হল আমাদের নিজেদের মন, তার সাথে এর মনোভাব ও আবেগ এবং আধুনিক জীবনের বাস্তবতাকে পরিচালনা করার আমাদের বিভ্রান্তিকর উপায়।

আমাদের মধ্যে আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণের একটি দৃঢ় অভ্যাস রয়েছে যেগুলি বিরক্তিকর আবেগ এবং মনোভাব, যেমন- নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্বেষ এবং আরও অনেক কিছু থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে। তারা আমাদের এমনভাবে কাজ করতে নেতৃত্ব দেয় যা আরও চাপ এবং সমস্যা নিয়ে আসে। এটা প্রতিক্রিয়া-লুপের (চক্র) মতো আমাদের বিরক্তিকর আবেগ এবং মনোভাবকে আরও জোরদার করে।

এই অস্বস্তিকর আবেগ ও মনোভাব অসচেতনতার উপর অধারিত অর্থাৎ উদ্ভূত হয়ে থাকে। হয় আমরা আমাদের আচরণের ফলাফল জানি না এবং আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি তার সম্পর্কে আমরা অবাস্তবিক, নয়তো সেগুলি সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা এটা জানি না যে আরও বেশি “পছন্দ” পাওয়া আমাদের বেশি সুরক্ষিত বোধ করাবে না; বরং আমরা ঠিক এর বিপরীত ভাবি। এটি আমাদের মধ্যে “পছন্দ” অর্জন করার আকাঙ্খা বৃদ্ধি করে, আমাদের কাছে সেটি কত সংখ্যক আছে তা বারংবার খতিয়ে দেখার নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায় ও কখনো সন্তুষ্ট না হওয়ার প্রবণতা এবং মানসিক অশান্তির বৃদ্ধি করে। কিংবা আমরা নির্লজ্জভাবে এটা ভাবি যে অপার্থিব দুনিয়ার কম্পিউটারে খেলা আমাদের জীবনে সম্মুখিন হতে পারা যেকোনো সমস্যাকে দূরে নিয়ে যায়। তারা এইসব অসচেতনতা ও নির্লজ্জতা এবং বিরক্তিকর আবেগগুলি, যেমন- আসক্তি, আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণের নেতিবাচক অভ্যাসগুলির শক্তিবৃদ্ধি এবং বিরক্তিকর মানসিক অবস্থার জন্ম দেয়।

আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, ঐ লক্ষণগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য তদনুরূপ আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতার প্রয়োজন, যেমন- একটি চাহিদাপূর্ণ কাজ। আমাদের এটির মোকাবেলা করতেই হবে, এটিই বাস্তব; আর তার জন্য আমরা শুধু নিজেদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারি। আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি ও সীমাবদ্ধতাগুলির বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে হবে এবং পরিস্থিতিকে একটি ভয়ঙ্কর দৈত্য মনে করে অভিক্ষেপ করা বন্ধ করতে হবে আর এই অভিক্ষেপ করা বন্ধ করতে হবে যে আমরা যথেষ্ট ভাল নই, কারণ আমরা মনে করি আমাদের নিখুঁত হতে হবে। তারপর আমরা যে বাস্তবের সম্মুখীন হই তার সর্তকতা অবলম্বনের জন্য আমাদের একাগ্রচিত্ত হতে হবে, আর এটা করতে হবে এটাকে অতিরিক্ত অনুমান না করে বা অবমূল্যায়ন না করে এবং বাস্তবতা থেকে আমাদের দৃষ্টি কখন হারিয়ে সেটাকে সনাক্ত করার জন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এর সাথে আত্ম-ধ্বংসাত্মক অভ্যাসের ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকতে আমাদের স্ব-শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আমরা শুরু করি স্ব-শৃঙ্খলা দিয়ে এবং ছোট-ছোট জিনিসের প্রতি মনোনিবেশ ক’রে। যখন আমরা খুবই চাপ অনুভব করি, আমাদের কর্টিসোল স্তরের (একটি চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন) বৃদ্ধি হয়, তখন আমরা একটু স্বস্তির খোঁজ করি, উদাহরণ স্বরূপ- একটি সিগারেট অথবা সামাজিক বার্তা দেখা বা কিছু আকর্ষণীয় জিনিসের জন্য ইন্টারনেটে ডুবে যাওয়া। আমরা সেই উত্তেজনা এবং আনন্দের প্রত্যাশাটিকে অনুভব করি যে এটি আমাদের ভালো বোধ করাবে। তাই আমাদের ডোপামাইন স্তর (একটি পুরস্কারের প্রত্যাশার হরমোন) বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সিগারেট খাওয়া বা ইন্টারনেট দেখার পর আমরা সন্তুষ্ট হই না। ফলে আমাদের চাপ পুনরায় ফিরে আসে। 

আমাদের এই ভুল ধারণার প্রতি বিশ্বাস করার বিভিন্ন লোকসানগুলিকে প্রভেদ করা উচিত যে, সিগারেট সমস্যার সমাধান করবে, বা “পছন্দগুলি” সমস্যার সমাধান করবে, বা সাম্প্রতিক সংবাদ পড়লে সমস্যার সমাধান হবে। তারপর আমরা মুক্ত হওয়ার সংকল্প গড়ে তুলতে পারব। আর আমরা তখন সিগারেট ত্যাগ করতে পারব, কখন আমাদের ই-মেইল বা বার্তা দেখব অথবা আমরা কতবার সামাজিক বার্তা ও সংবাদ দেখব, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। যখন আমাদের মধ্যে সিগারেট খাওয়ার বা ইন্টারনেট ঘাঁটার জন্য বাধ্যতামূলক প্ররোচনা কাজ করবে না, তখন আমরা সেগুলি থেকে বিরত থাকব।

শারীরিক স্থুলত্ব থেকে মুক্তি পেতে যেমন আমাদের খাদ্য সংযম করা দরকার হয়, ঠিক তেমনি মানসিক স্থূলত্ব থেকে মুক্তি পেতে আমাদের একটি তথ্য সংযম করাও দরকার।

আমরা যেমন আমাদের খাদ্য গ্রহণকে সীমাবদ্ধ করে রাখি, ঠিক তেমনি আমাদের তথ্য, বার্তা, সঙ্গীত ইত্যাদিকে সীমাবদ্ধ করতে হবে।

যেহেতু নেতিবাচক অভ্যাস অনেক শক্তিশালী হয়, তাই পুরনো আত্ম-ধ্বংসাত্মক অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে গেলে প্রথমে আমাদের শরীরে কর্টিসোল স্তরের বৃদ্ধি পায় এবং চাপ তৈরী হয়। এটি সিগারেট, ইন্টারনেট এবং মোবাইল বা সঙ্গীত থেকে নিজেকে বিরত রাখার মতো। কিন্তু এগুলি থেকে বিরত থাকার চাপ ধীরে-ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমরা মনের শান্তি ও স্থিরতা উপভোগ করব। যদি আমরা আমাদের নেতিবাচক অভ্যাসগুলি ইতিবাচক অভ্যাসগুলির স্থানে প্রতিস্থাপন করি, যেমন- আমরা যদি এটা বুঝতে পারি যে আমরা সকলেই মানবতার অংশ এবং সকলেই একে অপরের সাথে যুক্ত আর তাই আমাদের কল্যাণ অন্যদের উপর নির্ভরশীল, তাহলে এটি অন্যের সাথে যুক্ত থাকা এবং বন্ধনের অনুভূতির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে, যেটি বাস্তবে ইন্টারনেট ও সামাজিক নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে সম্ভব হয় না। সুতরাং আমাদের অক্সিটোসিন স্তর যা আমাদের (বন্ধন হরমোন) বৃদ্ধি করবে এবং আমরা আরো আনন্দ ও সুরক্ষিত বোধ করব।

নিজেকে ধ্বংসাত্মক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা

সংক্ষেপে, একবার যদি আমরা মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গড়ে তুলি, তাহলে তার জন্য নিজেকে মুক্ত করার জন্য পুরনো নেতিবাচক অভ্যাসগুলি থেকে আমাদের স্ব-শৃঙ্খলা, একাগ্রতা এবং প্রভেদমূলক সচেতনতা (শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা) অর্থাৎ তথাকথিত “তিন-প্রশিক্ষণে (ত্রি-শিক্ষা)” প্রশিক্ষিত হতে হবে। এই তিনটি একত্রে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এগুলিকে সঠিকভাবে বিকাশের ক্ষেত্রে যে কারণগুলি এতে বাধা সৃষ্টি করে সেগুলি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবেঃ

  • অনুশোচনা স্ব-শৃঙ্খলার বাধা সৃষ্টি করে উদাহরণ স্বরূপ, আমরা ইন্টারনেট না দেখা বা ই-মেইল অথবা বার্তার তৎক্ষণাৎ উত্তর না দেওয়ার কারণে অনুশোচনা করি। এর একটি সহায়ক পদ্ধতি হলো আমরা কম্পিউটার বা মোবাইল যন্ত্রের সূচক বা সাংকেতিক বিজ্ঞপ্তি বন্ধ করে রাখতে পারি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেটা দেখতে পারি আর শুধু জরুরি খবর গুলি দেখামাত্রই উওর দিতে পারি। স্ব-শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিদিন আমাদের কম ব্যস্ত সময়গুলি ও নির্দিষ্ট একটি সময় অন্যদের ই-মেইলের জবাব দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া উচিত।
  • নিদ্রাহীনতা, মানসিক অশান্তি এবং চঞ্চলতা আমাদের একাগ্রতায় বাধা সৃষ্টি করে এগুলির যে কোন একটির কারণে,  আমরা মননশীলতাকে হারিয়ে ফেলি যে নিয়মিতভাবে এই বার্তাগুলি দেখা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখলে আমাদের জীবনের জটিলতা আরো হ্রাস পাবে।
  • সিদ্ধান্তহীন দোলাচল আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতায় বাধা সৃষ্টি করে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বার্তাগুলি দেখা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কিনা ভেবে সর্বদা আমরা চঞ্চল হয়ে উঠি। এই ধরণের সন্দেহ জাগে কারণ ইন্টারনেট দেখা থেকে বিরত থাকা কঠিন এবং চাপযুক্ত। এই সন্দেহগুলির সাথে মোকাবেলা করতে গেলে অভ্যাস পরিবর্তনের সুবিধাগুলিকে নিজেদের মনে করিয়ে দিতে হবে।

আরও অনেক কৌশল আছে যার দ্বারা আমরা নিজেদের সুখী রাখতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ যখন আমরা একটি জনবহুল পাতাল রেলে থাকি, তখন নিজের দিকেই বেশি মনোনিবেশ ক’রে আমরা যত বেশি নিজেকে রক্ষা করার জন্য মোবাইল ফোনে মগ্ন হয়ে যেতে চাই, আমরা তত বেশি আবদ্ধ বোধ করি। আমাদের কর্মশক্তি আরও পিষে যায় এবং আমরা আরো চাপ অনুভব করি। আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, কারণ আমরা বিপদের আশঙ্কায় থাকি। এমনকি মোবাইলে খেলতে-খেলতে বা আইপডে গান শুনতে-শুনতে আমরা যতই মশগুল হই না কেন, আমরা নিজেদের চারপাশে একটি দেয়াল তুলে দিই, কারণ নিজের শান্তি ভঙ্গ হতে দিতে চাই না। এর ফলে আমরা আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠি। অন্যদিকে আমরা যদি জনাকীর্ণ অঞ্চলের মানুষের ভিড়ের অংশ হিসেবে নিজেকে দেখি এবং নিজেদের মতো করে সকলের জন্য উদ্বেগ ও করুণার বিকাশ করি তাহলে আমাদের হৃদয় ও মন উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। আমরা বিপদ থেকে সতর্ক হতে পারি, কেবল নিজের প্রতি মনোনিবেশ করার ভন্ডামি ছাড়া, আমরা কামনা করবো সবাই যেন নিরাপদ থাকুক। সঙ্গীত বা খেলার মধ্যে আমরা অন্য সবাইকে মগ্ন করতে চেষ্টা ক'রে এবং আমরা নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করি না। এই ধরণের কৌশলগুলি কেবল আমাদের একাকিত্বকে বাড়িয়ে তোলে। এর পরিবর্তে আমরা যদি নিজেদেরকে আমাদের চারপাশের প্রত্যেকে একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ মনে করি তাহলে আমরা একটি ঝাঁকের কোন একটি পশুর মত সুরক্ষিত বোধ করব। এই কৌশলটি কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করতে স্ব-শৃঙ্খলা, একাগ্রচিত্ত এবং প্রভেদমূলক সচেতনতা, এই তিনটি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

আরো একটি কৌশল যা আমরা গ্রহণ করতে পারি সেটা হল, আমরা যখন আমাদের কাজের থেকে বিরতি প্রয়োজন হয় তখন মোবাইল না দেখে বা না ঘেঁটে, যদি সম্ভব হয়, আমাদের উঠে দাঁড়ানো উচিত এবং ঘরের চারপাশে হাঁটা উচিত। ইন্টারনেট বা ফোনের চেয়ে বেশি উৎসাহ নিয়ে নিজের কাজ করুন।

সারাংশ

মুক্ত হওয়ার সংকল্পের মাধ্যমে আমরা যদি স্ব-ধ্বংসাত্মক অভ্যাস থেকে উত্থিত চাপকে হ্রাস করতে তিনটি প্রশিক্ষণের বা ত্রি-শিক্ষার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করি, তাহলে আমরা কাজ-কর্ম, পরিবার, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদির চাপ মোকাবেলার করার ক্ষেত্রে একটি শান্ত মনের অবস্থায় অবস্থান করবো। এগুলি বিশেষ করে তথ্য-আসক্তি ও ইন্টারনেট, সামাজিক বার্তা এবং সঙ্গীত ইত্যাদিতে মগ্ন হওয়ার মতো আধুনিক জীবনের জটিলতাগুলি মোকাবেলায় কার্যকর হবে। এর অর্থ এই নয় যে আমাদের ইন্টারনেট ত্যাগ করতে হবে বা আমাদের মোবাইল যন্ত্র ফেলে দিতে হবে, বরং তাদের কীভাবে উপকারী এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে তার সম্পর্কে আমাদের আরও ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

Top