নিষ্ক্রমণ থেকে করুণার দিকে অগ্রসর হওয়া

নিষ্ক্রমণ (ত্যাগ) এবং করুণা হল সমান মনোভাব, দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার একটা সংকল্প। তবে প্রথমটির ক্ষেত্রে মনোনিবেশ থাকে নিজের উপর আর অপরটির ক্ষেত্রে মনোনিবেশ থাকে অন্যের উপর। আমরা যখন নিষ্ক্রমণকে বিকশিত করার জন্য সমস্ত বিবরণ সম্পর্কে জেনে যাই অর্থাৎ এর কারণ, সহগত চেতসিক, বোধগম্যতা ইত্যাদি, তখন আমরা করুণাকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে সক্ষম হয়ে উঠি।

নিষ্ক্রমণ এবং করুণা হল মনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা, যে দুটিকে বৌদ্ধ পথে অগ্রসর হওয়ার সময় আমাদের অনুপ্রেরণার অঙ্গ হিসাবে বিকাশ করার প্রয়োজন হয়। আমি নির্দিষ্ট ভাবে এই দুটি মনের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইবো, কারণ এই দুটি একে অপরের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধিত। আসলে এরা অনেকটা একই মনের অবস্থা, তবে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে এদের প্রত্যেকের লক্ষ্য কী।

সমস্ত বৌদ্ধ শিক্ষার উদ্দেশ্য হল দুঃখ এবং সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সহযোগিতা করা। এটা করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতিটি হল আমাদের নিজেদের মধ্যে নিহিত আসল কারণগুলি আবিষ্কার করা এবং নিজেদেরকে ঐ কারণগুলি থেকে মুক্ত করা, যাতে তারা আর দুঃখের জন্ম দিতে না পারে। এই পদ্ধতিটি দৃঢ় বিশ্বাসের উপর আধারিত যে, ঐ কারণ গুলিকে এমনভাবে উন্মুলন করা দরকার যাতে তাদের আর কখনও উত্থান না হতে পারে। এটাকে সম্পাদন করার জন্য আমাদের একটা মনের পথ তৈরী করতে হবেঃ বোধগম্যতার একটা উপায় যা আমাদের সমস্যার মূল কারণকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত এবং নির্মূল করে। এটা হল মূলতঃ আমাদের বোধগম্যতার অভাব এবং আমাদের অজ্ঞতা।

এটাকে চার আর্যসত্যের কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য ক’রে রাখা হয়েছে। এই চার আর্যসত্য হল বুদ্ধের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা। আমরা যখন নিষ্ক্রমণ এবং করুণার দিকে তাকাই আমরা দেখতে পাই যে উভয় ক্ষেত্রেই দুঃখ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এই দুটির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রে আমাদের মন আমাদের নিজেদের দুঃখের প্রতি কেন্দ্রিভূত হয় আর করুণার ক্ষেত্রে এটা কেন্দ্রিভূত হয় অন্যের দুঃখের উপর। এইভাবে মনের অবস্থার খুব মিল আছে, তাই নয় কি? তবে এরপরে প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি আবেগ আসলে একইরকম এবং আমরা কীভাবে এক আবেগ থেকে অন্যটিতে রূপান্তর করব?

নিষ্ক্রমণ এবং করুণার অর্থ

“রিনান্সিয়েশান” শব্দটি শুধু ইংরেজী ভাষায় ব্যবহার করা হয় না বরং ব্যবহারিক ভাবে অন্যান্য সব ভাষায়ও ব্যবহার করা হয়, যে ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জগতে বৌদ্ধ ধর্ম উপস্থাপিত করা হয়। তবুও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে শুরু করে যে এটা মূল সংস্কৃত বা তিব্বতী শব্দে সঠিক অনুবাদ আছে কি। সম্ভবত এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, শব্দটি ধর্মপ্রচারক দ্বারা তৈরী করা হয়েছে, যারা পাশ্চাত্য দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রথম দিকে অনুবাদক ছিলেন এবং যারা বৌদ্ধ ধর্মকে মূল থেকে আলাদা ধারণার কাঠামোয় বুঝেছিলেন। সর্বোপরি, ‘নিষ্ক্রমণ’ শব্দটি এই অর্থ বহন করে যে, পার্থিব বিষয় বস্তুতে লিপ্ত হওয়াকে খারাপ মনে ক’রে এবং সমস্ত কিছু ত্যাগ ক’রে গুহা অথবা মঠে বসবাস করাকে বোঝায়। তবে সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ (নিঃসরণ) অথবা তিব্বতী ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ (ঙেজুং)-এর আসল অর্থ এটা নয়। আমরা যদি তিব্বতী ভাষার শব্দের দিকে তাকাই তাহলে এর অর্থ হবে নিশ্চয়তা; যার অর্থ হল নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। এটা বিশেষ ক’রে দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তাকে ধ্যানকেন্দ্রিত করে।

দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার এই নিশ্চয়তা বা দৃঢ় সংকল্পকে বিকাশ করার জন্য দুঃখ এবং দুঃখের কারণগুলিকে ত্যাগ করার প্রয়োজন। অতএব এই শব্দটির অর্থ কোন কিছুকে ত্যাগ করা অথবা কোন কিছু থেকে বিমুখ হওয়ার অর্থে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এখানে কোনকিছু বলতে দুঃখ এবং তার কারণকে বোঝায় যেটাকে আগে সনাক্ত ক’রে তার প্রতি আমরা মনোনিবেশ করি। যখনই একবার সনাক্ত হয়ে যায় যে, এটা হল দুঃখ যা আমি ভোগ করছি এবং এটা হল তার কারণ, আমি সেটাকে আর ভোগ করতে চাই না আর আমি সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, শুধু তখনই সেটাকে ত্যাগ করার ইচ্ছা বিকাশ করতে পারি। সম্ভবতঃ তখন একটা নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি জাগে “আমি চাই যে আমার দুঃখ যেন সমাপ্ত হয়ে যায়।” এক্ষেত্রে আমাদের মনের অবস্থা আমাদের নিজেদের দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত হয় আর করুণার ক্ষেত্রে কেন্দ্রিভূত হয় অন্যের দুঃখের উপর। যদিও দুঃখ ভোগ করা ব্যক্তি আমরা নিজেরা অথবা অন্যরা- আলাদা হতে পারে, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ইচ্ছা একইরকম থাকে। আমরা কামনা করি এটা যেন সমাপ্ত হয়ে যায়।

নিষ্ক্রমণ এবং করুণার বিকাশে যুক্ত আবশ্যক বিষয়

শুধু এটা জেনে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আমরা কিসের উপর মনোনিবেশ করছি, যেমন কিছু নির্দিষ্ট দুঃখ এবং তার আসল কারণ যা আমাদের এবং অন্যদের দ্বারা ভোগ করা হয়, বরং এরসাথে যুক্ত অন্য বিভিন্ন ধরণের বিষয়গুলিকেও বোঝা প্রয়োজন। “সূত্র-তন্ত্র সম্পর্কিত ব্যবহারিক পরামর্শের পত্রে” চোংখাপা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে সাধারণত কার্যকরভাবে ধ্যান করতে সক্ষম হওয়ার জন্য কোন্‌-কোন্‌ কারণগুলি প্রয়োজন। সর্বপ্রথম আমাদের বুঝতে হবে ধ্যান জিনিসটা কী। ধ্যান হল এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা বার বার কোন বিশেষ অবস্থা অথবা একটা বস্তুর উপর মনোনিবেশ ক’রে একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা বা বস্তুর সাথে আমাদের মনকে পরিচিতি এবং অভ্যস্ত করি। মনের সেই অবস্থার সাথে কীভাবে নিজেকে পরিচিত করতে হবে সেটাকে জানার জন্য আমাদেরকে এর সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত হতে হবে। আমাদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানতে হবেঃ

  • মনের ওই অবস্থাটি কীসের উপর কেন্দ্রিভূত হয়- এই ক্ষেত্রে দুঃখ এবং তার কারণগুলির উপর কেন্দ্রিভূত হয়।
  • ঐ মনটি কীভাবে বস্তুর সাথে সম্পর্কিত পরিভাষাগত শব্দটি হল “মন কীভাবে সেই বস্তুকে গ্রহণ করে।” আমাদের মন যেভাবে বস্তুকে গ্রহণ করে এখানে তার অভিপ্রায় হল এটা যেন সমাপ্ত হয়ে যায়। আমাদের মন শুধু দুঃখ এবং দুঃখের কারণের প্রতি মনোনিবেশ করে না আর তার প্রতি মনোযোগ দেয় না। পরিবর্তে আমাদের মন তারসাথে যেভাবে সম্পর্কযুক্ত হয় সেটা হল “চলে যাও!”

মনের যেকোন অবস্থা হল একাগ্রতা (সমাধি), উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিভিন্ন চৈত্ত বা চেতসিক কারণের সংমিশ্রণ। আমরা যদি এই সমস্ত কারণগুলি জানি তাহলে এটা অবশ্যই আমাদের পছন্দসই মানসিক অবস্থা বিকাশ করতে সহায়তা করবে। এরজন্য চোংখাপা আরও অনেক বিষয় নির্দিষ্ট করেছেন যা আমাদেরও জানার প্রয়োজন। এরমধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্তঃ

  • ঐ মনের অবস্থা কিসের উপর নির্ভর করে; অন্য কথায় মনের ঐ অবস্থাকে বিকশিত করার আগে আমাদের মনের যে অবস্থা বিকাশ করা প্রয়োজন যা আমাদের এই মনের অবস্থাটি তৈরী করতে এবং সমর্থন করতে সাহায্য করে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের স্বয়ং নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে বিদ্যমান দুঃখকে চিহ্নিতকরণ করতে হবে এবং সনাক্ত করতে হবে।
  •  আমরা মনের যে অবস্থাকে বিকশিত করতে চাই সেটাকে করার জন্য কোন্‌ চেতসিক বা মানসিক কারণগুলি সহায়ক হবে এবং কোনগুলি ক্ষতিকারক হবে, উদাহরণ স্বরূপ, মৈত্রী ভাবনা সহায়ক হবে আর এই মৈত্রী ভাবনা নিজের প্রতি হোক বা অপরের প্রতি; আর অন্যদিকে বিদ্বেষ, সেটা স্ব-কেন্দ্রিভূত হোক অথবা অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, এটা এরজন্য ক্ষতিকারক হবে।
  • আমরা যখন মনের ঐ অবস্থাকে বিকশিত করে ফেলব তখন সেই অবস্থা কেমন উপকারী এবং উপযোগী হবে, উদাহরণ স্বরূপ, নিষ্ক্রমণ আমাদের প্রকৃতপক্ষে দুঃখ থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করবে এবং করুণা আমাদের অন্যদেরকে তাদের দুঃখ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হতে সহায়তা করবে।

যদিও এটা বেশির ভাগ প্রযুক্তিগত বিশদের মতো প্রতীত হয়, তবে এটা আসলে বৌদ্ধ প্রশিক্ষণ অথবা মৈত্রী এবং করুণার মতো ভাবনাকে বিকশিত করার জন্য যেকোন রকমের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী। এটা কীভাবে করা যেতে পারে? প্রায়শই আমাদের সাথে এরকম ঘটতে থাকে যে আমরা সঠিকভাবে জানিই না যে মৈত্রী অথবা করুণা বলতে কী বোঝায়। এই কারণে আমাদের কী করতে হবে, সেটা না জেনে শুধু খালি মনে বসে থাকি। অথবা এরকমও হয় মৈত্রী অথবা করুণা বলতে কী বোঝায় তার বিষয়ে আমাদের নিজস্ব ধারণা থাকতে পারে কিন্তু সেটা সাধারণত স্পষ্ট হয় না। আমরা যদি অস্পষ্ট কিছু বিকশিত করার চেষ্টা করি তাহলে আমরা তারজন্য যে সর্বোত্তম আশা করতে পারি সেটা হল তার থেকে আমাদের অস্পষ্ট অনুভূতি লাভ হবে। আর সম্ভবতঃ এটা এমন এক ধরণের অস্পষ্ট অনুভূতি যেটা বৌদ্ধধর্মে আমাদের বিকশিত করার জন্য শেখায় না।

বৌদ্ধ প্রশিক্ষণে আমরা মনের অবস্থা ইত্যাদির উপর কাজ করি যাকে বলা হয় “আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ”, আর এই পদ্ধতিটি হল একেবারে বৈজ্ঞানিক এবং সঠিক। এটা সঠিক কারণ আমরা বুঝতে পারি যে আমরা আমাদের মনের সাথে কী করার চেষ্টা করতে চাই এবং সেটাকে কীভাবে করা যায়। যদিও আমাদের মধ্যে যথাযথতা থাকে যে, আমরা আমাদের মন, হৃদয় এবং আবেগ সম্পর্কে কীভাবে কাজ করব তাহলে আমরা সেগুলিকে ইতিবাচকভাবে বিকাশ করতে পারব। তা না হলে এগুলি অস্পষ্ট হয়ে যাবে।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বেশী বৈজ্ঞানিক অথবা যৌক্তিকভাবে মনোযোগী নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে আমাদের মধ্যে কেউ হল সজ্ঞাত আর সে আবেগের সাথে বেশী কাজ করে। তবে আমরা যদি সজ্ঞাতকে কাছে থেকে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে সর্বোত্তম সজ্ঞান হল এক ধরণের সঠিকতা। অস্পষ্ট সজ্ঞান আমাদের বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং আমাদের ব্যক্তিত্ব যেমনই হোক না কেন সঠিকতা থাকাটা খুবই উপযোগী।

নিষ্ক্রমণ এবং করুণার সাথে সংযুক্ত চৈত্তঃ “অনেক হয়েছে” নামক একটা সিদ্ধান্তমূলক অনুভূতি

নিষ্ক্রমণ এবং করুণার সাথে কোন্‌ চৈত্ত বা মানসিক কারণগুলি সংযুক্ত থাকে? আমি একটা সঠিক চিত্র আঁকতে চাই যা বৌদ্ধ শিক্ষায় আলোচনা করা হয়েছে যে, কোন্‌-কোন্‌ মানসিক কারণগুলি এরসাথে সম্পর্কিত। তবে যদিও আমরা এই মনের অবস্থা এবং আবেগগুলি সঠিকভাবে বর্ণনা করি তাসত্ত্বেও স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে যে আমরা কীভাবে এগুলি অনুভব করতে পারব? আর তারপর আমরা কীভাবে বুঝতে পারব যে আমরা যেটা অনুভব করি সেটা বাস্তবিক বস্তু?

বেশ, যদি আমাদের মধ্যে এই বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকে যে বাস্তবিক হওয়ার জন্য এই চিত্ত অবস্থায় কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন, তাহলে আমরা তুলনা করে দেখতে পারি যে আমরা কী অনুভব করছি আর বাস্তবিক অনুভূতি কেমন হওয়া প্রয়োজন। আমরা যা অনুভব করছি সেটা পরীক্ষা করার জন্য আমরা ঐ অনুভূতির বিনির্মাণ করার চেষ্টা করতে পারি, আর দেখতে পারি ঐ মনের অবস্থার কোন্‌ কোন্‌ অংশ দুর্বল অথবা ক্রুটিযুক্ত তখন আমরা বুঝতে পারব ঐ চিত্ত অবস্থাকে আরও বেশি সঠিকভাবে বিকশিত করার জন্য আমাদের কী কী কাজ করার প্রয়োজন অর্থাৎ কোথায় শুধরানোর প্রয়োজন। আমাদের অনুভূতিকে বিশ্নেষণ করা এবং বোঝার প্রক্রিয়াটি এমন কোন প্রক্রিয়া নয় যা আমাদের অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয়। এটি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেটাকে মনঃসমীক্ষণ (সাইকোথেরাপি)-তেও প্রয়োগ করা হয়। যাতে আমরা সুস্থ হতে পারি আর এটা অন্যদের সাথে সাথে নিজেদের জন্যও উপযোগী হতে পারে।

নিষ্ক্রমণ এবং করুণার সাথে কোন্‌ আবেগটি বেশি প্রবল হয়? তিব্বতী ভাষায় এরজন্য “য়ি-ঝুং” শব্দটি ব্যবহার করা হয় যার অনুবাদ করা সহজ নয়। তবে এটা এমন একটা অবস্থা যার কোন কিছুর প্রতি বিরক্ত হয়ে যাওয়াকে বোঝায়ঃ “আমার জন্য এটা যথেষ্ট হয়েছে।” কখনো কখনো এটার অনুবাদ বিতৃষ্ণারূপে করা হয়। অতীতে আমি এর অনুবাদ এইভাবেই করেছি। আমরা আমাদের দুঃখ এবং অপরের দুঃখের প্রতি বিতৃষ্ণ হই। কিন্তু পরে আরও চিন্তা-ভাবনা করার পর আমি ভাবলাম এটা একটা বেশি কঠোর শব্দ কারণ বিতৃষ্ণা পরবর্তীতে অতি সহজেই ঘৃণারূপী বিরক্তকর আবেগে পরিণত হতে পারে। আমি মনে করি এই আবেগের সুরটি আরও কিছুটা নিরপেক্ষ। “দুঃখ অনেক হয়েছে, এবার এটাকে সমাপ্ত হতেই হবে”- এটা আমাদের দুঃখ হোক অথবা অন্য কারও দুঃখ। সুতরাং এতে এক ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিশ্চয়াত্মক ভাব থাকে। “ব্যস, অনেক হয়েছে।”

আমি মনে করি এটাকে আমরা আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত করতে পারি। আমরা দুঃখ ভোগ করতে পারি এবং এই দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কিন্তু আমরা আসলে এর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু করি না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দৃঢ়তার সাথে নিশ্চিত না করে ফেলি এবং সেই সীমায় না পৌঁছে যাই যেখানে আমরা বলি, “ব্যস, অনেক হয়েছে।” সুতরাং, “অনেক হয়েছে”, এই অনুভূতিটি হল নিষ্ক্রমণের একটা উপাদান এবং এটা একটা প্রধান আবেগপ্রবণ সুর।

কোন তথ্যকে সত্যরূপে বিশ্বাস করা

কোন তথ্যকে সত্যরূপে বিশ্বাস করা হল আরও একটা চৈত্ত বা মানসিক কারন যা নিষ্ক্রমণ এবং করুণার সাথে যুক্ত থাকে। কখনো-কখনো এটাকে ‘শ্রদ্ধা বা নিষ্ঠা’ রূপে অনুবাদ করা হয়, তবে আমি মনে করি এটা একটা অনুপযুক্ত অনুবাদ। এটা অনুপযুক্ত, কারণ নিষ্ঠা কখনো-কখনো মিথ্যা বা অনিশ্চিত বস্তুর প্রতিও থাকতে পারে, যেমন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির প্রতি নিষ্ঠা। এখানে কোন তথ্যের প্রতি বিশ্বাস করার উদ্দেশ্য হল এমন একটা তথ্য যেটা হল সত্য আর সেটাকে সত্যরূপে মেনে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এখানে আমরা ইস্টার বান্নি বা এরকম কিছুর প্রতি বিশ্বাস করার কথা বলছি না।

যুক্তির উপর আধারিত তথ্যকে বিশ্বাস করা

কোন তথ্যের উপর তিন প্রকারের বিশ্বাস উৎপন্ন হয়। প্রথমটি হল যুক্তির উপর আধারিত কোন তথ্যের উপর বিশ্বাস করা। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ধ্যান দুঃখের উপর মনোনিবেশ করি। আর আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এটা বাস্তবে দুঃখ এবং এটা বাস্তবে অমুক কারণ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এছাড়া আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে যে, এই দুঃখকে দূর করা যেতে পারে আর এটা দূর করা যেতে পারে চিরতরের জন্য।

শেষ পয়েন্টটি একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদি যুক্তির উপর আধারিত কোন আত্মবিশ্বাস না থাকত যে দুঃখকে দূর করা যেতে পারে আর একটা নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষ একে চিরতরের জন্য দূর করতে পারে, তাহলে পুরো আবেগপ্রবণ সুরটাই একটু আলাদা হয়ে যেত। উদাহরণ স্বরূপ, হতে পারে আমাদের জীবনে একটা নির্দিষ্ট সমস্যা আছে আর ঐ সমস্যার কারণ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কিছুটা বোধগম্যতা আছে। আমরা সত্যিই ঐ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই এবং হতে পারে আমরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাই যেখানে আমরা গভীরভাবে অনুভব করি যে আমরা অনেক সহ্য করে ফেলেছি। আমরা এটাকে মোকাবিলা করার জন্য সত্যিই কিছু করতে চাই। তবে, ধরুন আমাদের মনে হল যে আমাদের প্রচেষ্টা করা ব্যর্থ যে ঐ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার কোন রাস্তা নেই এবং আমাদের চুপচাপ এটার সাথে জীবনযাপন করা শিখতে হবে। অথবা আমাদের এরকম মনে হল যে এই সমস্যাটিকে চিরকাল ভোগ করার জন্য আমরা অভিশপ্ত। এটা বৌদ্ধধর্মে বর্ণিত তথ্যে বিশ্বাসের অবস্থা থেকে একেবারে আলাদা মনের অবস্থা। তাই নয় কি? মনের এমন অবস্থা যেখানে আমাদের মনে হয় যে আর কোন আশা নেই, ঐ পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন ব্যক্তির পক্ষে হতাশ হওয়াটা খুব সহজ। আমরা একেবারে প্রত্যাহত হয়ে যাই, কারণ যদিও আমরা সত্যিই আমাদের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে এটা তো ইচ্ছুক চিন্তা-ভাবনা এবং এখানে করার মতো কিছু নেই।

এই কারণেই আমাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস যে আমরা চিরকালের জন্য দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারি এবং তার জন্য আমাদের কারণের উপর আধারিত হতে হবে। আমরা বুঝি যে আমরা কীভাবে সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি এবং আমদের দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের প্রচেষ্টা কার্যকর হবে। এটা আমাদের মধ্যে আশা জোগায়, আশা আমাদের শক্তি দেয় এবং নিজেকে সমস্যা থেকে বাস্তবে মুক্ত করার জন্য কিছু করতে সক্ষম হয়ে ওঠার জন্য এই শক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই হল যুক্তির উপর আধারিত কোন তথ্যের উপর বিশ্বাস করার অর্থ।

স্পষ্ট মস্তিষ্কের সাথে কোন বস্তু সম্পর্কিত তথ্যের উপর বিশ্বাস করা

একটা তথ্যকে সত্যরূপে স্পষ্ট মস্তিষ্কের সাথে বিশ্বাস করাই হল কোন তথ্যকে বিশ্বাস করার দ্বিতীয় ধরণ। এটা আমাদের মস্তিষ্ককে এই অর্থে স্পষ্ট করে তোলে যে এটা আমাদের বিষয়কে দূরীভূত না ক’রে আমাদের মনকে বিরক্তিকর আবেগ থেকে মুক্ত করে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হল এই ধরণের আত্মবিশ্বাস যে দুঃখকে চিরতরে দূর করা যায়, আমাদের মনকে হতাশা থেকে মুক্ত করা যায়, পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মনের সন্দেহকে দূর করে দেয় এবং এটা আমাদের মনের অসহায়তার অনুভূতি এবং ভয়ের ভাবকে কাটিয়ে তোলে। যখন আমাদের অনেক সমস্যা এবং অসুবিধা থাকে তখন আমরা অনেক ভয়ে জীবন-যাপন করি, এই ভেবে যে, “সবসময় এই রকমই চলতে থাকবে” অথবা “আমি কোন কিছু করতে ভয় পাই কারণ আমি পরিস্থিতিকে হয়তো আরও খারাপ করে ফেলব।”

আমি নিশ্চিত যে আমরা সকলেই আমাদের মধ্যে অথবা অন্যের মধ্যে বিদ্যমান এর সাথে সম্পর্কিত উদাহরণ গুলির সাথে পরিচিত। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের সাথে কারও একটা খুব ভয়াবহ সম্পর্ক আছে, একটা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক, দুর্ব্যবহারপূর্ণ সম্পর্ক, কিন্তু আমরা এই ভয়ে ঐ সম্বন্ধটাকে বিচ্ছেদ এবং সমাপ্ত করি না যে, ঐ ব্যক্তি ছাড়া আমাদের জীবন আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। তবে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমরা সম্বন্ধটাকে সমাপ্ত করে ঐ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারি, আর এর পরিণতিতে আমাদের জীবনে সবকিছু আরও ভালো হয়ে উঠবে আর আমরা আমাদের মনকে ভয় এবং নির্বিচার থেকে মুক্ত করে তুলব।

এই দ্বিতীয় প্রকারের আত্মবিশ্বাস দ্বারা আমরা দুঃখের অতিরঞ্জিত নেতিবাচকতা থেকেও মুক্ত হতে পারি। এমনও হতে পারে যে আমাদের বাস্তবে একটা সমস্যা আছে কিন্তু আমরা যদি ঐ সমস্যার নেতিবাচকতাকে অতিরঞ্জিত করে তুলি তাহলে এটাকে আমরা আমাদের মনের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর দৈত্যের ভাবনায় পরিণত করে ফেলব। এমনকি আমরা সমস্যাটিকে একটা মূর্ত এবং দানবের রূপ দিয়ে ফেলব, যার কারণে আমাদের ভয় আরও বেড়ে যাবে। তবে সুস্পষ্ট বিশ্বাসের উপর আধারিত নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে ঐ দুঃখ থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদি তাই হয় তাহলে আমরা আর ভয়ভীত হব না। আমরা আমাদের সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়াব না। ভয় থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করব না বরং আমরা আমাদের সমস্যার মোকাবিলা করার চেষ্টা করব এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে তার সম্মুখীন হব যা আমাদের সফলতা এনে দেবে।

অতএব, আমাদের সাবধান হতে হবে যে আমরা “সংসার-কারাগার থেকে পলায়ন করব”- এর মতো অভিব্যক্তির সাথে যুক্ত আবেগপ্রবণ অবস্থাকে আমরা কীভাবে নিই। এর অর্থ এই নয় যে অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত দুঃখের সাংসারিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভয় এবং বিদ্বেষের কারণে আমাদের মন বিপর্যস্ত এবং বিভ্রান্ত। সুস্পষ্ট বিশ্বাস অর্থাৎ এটা সত্য যে আমরা এই সমস্ত দুঃখ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি, কারণ আমাদের কাছে আছে একটা শান্ত ও সুস্পষ্ট মানসিক অবস্থা।

এর সাথে সম্পর্কিত আকাঙ্খাসহ ঐ তথ্যকে বিশ্বাস করা

তৃতীয় প্রকারের বিশ্বাস হল এর সাথে সম্পর্কিত আকাঙ্খাসহ ঐ তথ্যকে বিশ্বাস করা। এখানে আকাঙ্খা বলতে, “আমি এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসব এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি কিছু করতে চলেছি”-এটাকে বোঝায়। এই মানসিক অবস্থার দৈনন্দিন উদাহরণ এমন কোন একজন ব্যক্তি হবেন যিনি দারিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছেন এবং ঐ সীমাবদ্ধতার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে আর জীবনকে আরও সফল ক’রে তোলার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এমন নয় যে এই ধরণের মানুষজন তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঘৃণায় পরিপূর্ণ। তারা খুব স্পষ্ট ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ এবং জানে যে দরিদ্রতাকে কাটিয়ে উঠতে হলে তাদের কী করা প্রয়োজন আর তারা সেটা করার জন্য সংকল্পবদ্ধ, কারণ তারা ঐ পরিস্থিতিটাকে অনেক সহ্য করে ফেলেছে। তারা জানে যে তাদের কী করতে হবে এবং তাই তারা সেটাকে সরাসরি করেও ফেলে।

আমি আমার এক বন্ধুর উদাহরণের কথা ভাবছি সে একটা খুব দরিদ্র পরিবারে, একটা রুক্ষ পাড়ায় বড় হয়েছিল। সে এমন একটা স্কুলে গিয়েছিল এবং পড়াশুনা করেছিল, যেখানে তার ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্র একটা দলের ছিল আর একে-অপরের সাথে মারপিট করত। সে ঐ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংকল্প নিল। সে জানতো যে তাকে কী করতে হবে। সে টাকা-পয়সা আয় করার জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য খুব কঠোর পরিশ্রম করেছিল। সে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়াশুনা করে এখন একজন অত্যন্ত সফল মস্তিষ্কের সার্জন হয়ে উঠেছেন।

করুণা ও নিষ্ক্রমণের উপাদান একইরকম

যখন নিষ্ক্রমণ আমাদের নিজের দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত হয় তখন তার পরিস্থিতি এইরকম হয়। যখন এটা অপরের দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত হয় তখনও তার পরিস্থিতি এইরকম হয়। আমাদের মন অপরের দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত এবং যেভাবে আমাদের মন এরসাথে সম্পর্কিত হয় সেটা এই উদ্দেশ্যের সাথেই হয়, “এটাকে সমাপ্ত হতেই হবে।”এর সাথে যুক্ত মনের অবস্থা এবং আবেগের অনুভূতি এইরকম হয়, “অনেক হয়েছে।” আমরা বুঝতে পারি যে প্রত্যেকের জীবনে এই সমস্যাগুলি রয়েছে যা আমরা অনুভব করি, তবে এর মানে এটা নয় আমরা এর প্রতি বিতৃষ্ণ অথবা এটা নিয়ে হতাশ। আবার এগুলি হল এক ধরণের বিরক্তিকর আবেগ। আমাদের বোধগম্যতার প্রতি আমরা আত্মবিশ্বাসী এবং আস্থা আছে যে এটা তাদের সমস্যার কারণ আর এর থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাও আছে। এটা এমন নয় যে আমরা শুধু তাদের ভালো হওয়ার কামনা করি বরং আমরা অন্তর থেকে হতাশ। এখানে আমাদের বিশ্বাস হল একটা স্পষ্ট ধরণের বিশ্বাস এবং তাই এই করুণার প্রভাবে আমাদের মন বিরক্তিকর আবেগ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি একটা অন্য উদাহরণ সম্পর্কে কথা বলব। আমার মনে আছে যে আমার মা আমেরিকান টেলিভিশনে স্থানীয় খবর দেখতেন এবং তিনি প্রতিদিন ঘটিত হত্যাকান্ড, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদির ঘটনাগুলি শুনতেন। আর সেটা শুনে তিনি অত্যন্ত ক্রোধিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেনঃ “এটা কত ভয়াবহ; এরকম হওয়া উচিত হয়নি।” তার এই ভাবনা করুণার মতো বোধ হতো কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল তার মনের অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থা। এটাতো “প্রকৃত” করুণা নয় এই ক্ষেত্রে এখানে করুণা এবং উদ্বেগের সংমিশ্রণ থাকে আর তার সাথে ক্রোধ এবং বিচলিত ভাবও মিশ্রিত থাকে।

করুণা- “প্রকৃত করুণা”- বলতে একটা বিচলিত মনের অবস্থাকে বোঝায় না; এটা হল মনের একটা খুবই স্পষ্ট অবস্থা। এই অবস্থাটি আকাঙ্খাসহ একটা বিশ্বাসের সাথে সংযুক্ত, যার অর্থ হল “আমি এটাকে ঠিক করার জন্য কিছু করতে চেষ্টা করব, এই দুঃখকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করব।” সুতরাং এটা শুধু একটা কামনা মাত্র নয় যে তাদের পরিস্থিতি শুধরানোর জন্য তাদেরকে কিছু করা উচিত, বরং ঐ পরিস্থিতিকে শুধরানোর জন্য আমরা কী সহায়তা করি সেটাকে বোঝায়। যাইহোক, এই আকাঙ্খা এবং উদ্দেশ্যটি বাস্তবিক বোধগম্যতার উপর আধারিত হতে হবে যে তার জন্য আমরা কী করতে পারি। এটা এমন কোন মিশ্রিত ধারণা নয়, “আমি হলাম সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর আমি আবির্ভূত হয়ে এই জগতের রক্ষা করব” এবং “আমি যদি এই ব্যক্তিকে সাহায্য করতে সফল হই তাহলে আমি কত আশ্চর্যজনক হব; আমি যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমি দোষী হব।” এই কারণেই আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং ঐ প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা জাগাতে হবে যার মাধ্যমে আমরা দুঃখ দূর করতে পারি। এই প্রক্রিয়াটি এমনই যা দুঃখ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার জন্য কেবলমাত্র আমার ইচ্ছা শক্তি অথবা ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না, বরং এটা নির্ভর করে একাধিক হেতু এবং কারণের উপর।

দুঃখ-দুঃখতা এবং অসুখীতায় কেন্দ্রিভূত নিষ্ক্রমণ এবং করুণা

যেমনকি আমি আগে ব্যাখ্যা করেছি যে নিষ্ক্রমণ বা করুণা বিকাশ করার প্রয়োজনীয় প্রথম উপাদানটি হল দুঃখকে মনোনিবেশ করতে হবে, আর এই দুঃখটা আমাদের নিজস্ব দুঃখ হোক অথবা অপরের দুঃখ। এই পরিস্থিতিতে প্রথম প্রশ্ন ওঠে যে কেমন ধরণের দুঃখকে মনোনিবেশ করতে হবে? বুদ্ধ তিন প্রকারের দুঃখ সত্যের উল্লেখ করেছেন। এখানে তার সম্পর্কে অত্যধিক বিশদে না গিয়ে, ওই তিনটির মধ্যে প্রথম দুঃখটি যার উপর আমরা মনোনিবেশ করি সেটা হল দুঃখ-দুঃখতা এবং অসুখীতা।

পীড়া এবং অসুখীতা সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার কামনা করা খুব কঠিন নয়। আমার বিশ্বাস যে আমরা সকলেই দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসে এটা অনুভব করেছি। তবে গবেষণা করার জন্য এটা একটা খুবই আকর্ষণীয় প্রশ্ন। আমরা যখন দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসি আর দন্ত চিকিৎসক দ্বারা নোবোকেন-নামক ওষুধ ছাড়াই আমাদের দাঁতের উপর ড্রিল চালিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা ঐ পীড়া অনুভব করি। তখন কি আমাদের মনে নিষ্ক্রমণ ভাবনা জাগে? আমাদের মনের অবস্থা কি ঐরকম হয়? বাস্তবে তখন আমাদের মনের অবস্থা কেমন হয়? আমরা চেয়ারে বসে কী অনুভব করি? আমাদের মধ্যে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এটা হল একধরণের ভয় এবং উদ্বেগ। নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা যা অনুভব করি আমাদের ধ্যান তার উপর কেন্দ্রিভূত হয়। তবে নিষ্ক্রমণের বিপরীতে আমরা এটাকে সাধারণত অতিরঞ্জিত করে বসি আর এটাকে একটা দানবের রূপ দিয়ে ফেলি। ফলে আমাদের মন একেবারেই শান্ত থাকে না।

তবে ধরুণ, আমরা এই পরিস্থিতিকে নিষ্ক্রমণ ভাবের সাথে দেখি। তখনও কিন্তু আমাদের ধ্যান ড্রিলিং-এর ব্যাথার উপর কেন্দ্রিভূত হয়। আমরা তখন কামনা করি যে আমাদের ওই পীড়া যেন সমাপ্ত হয়ে যায়। আমরা এটাকে অনেক ভোগ করে ফেলেছি। আর আমাদের বিশ্বাস যে আমরা এটা থেকে মুক্ত হতে পারি। কিন্তু এখন এখানে একটা মজাদার জটিলতা চলে আসে। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা কেবল ধৈর্য ধরে এবং এরজন্য অপেক্ষা ক’রেই ঐ পীড়া থেকে মুক্ত হতে পারি। আমরা আমাদের অবশিষ্ট জীবনে ঐ দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসব না এবং দন্ত চিকিৎসক আমাদের দাঁত ড্রিলিং করবেন না। এই পরিস্থিতিতে সেখানে অনিত্যতার ভাব থাকে এবং ড্রিলিংটা সমাপ্ত হয়ে যায়; ব্যস আমাদের শুধু ধৈর্য ধরতে হবে এই চিন্তা ভাবনার সাথে আমরা শান্ত হয়ে থাকতে পারি আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি যে আমরা যদি শান্ত থাকি আর চেয়ারে বসাকালীন ঝাঁকুনি না দিই আর চাপ সৃষ্টি না করি তাহলে ঐ ড্রিলিং থেকে উদ্ভূত দুঃখ-দুঃখতা সমাপ্ত হয়ে যাবে এবং নির্মূল হয়ে যাবে।

আরেকটি সম্ভাবনা হ’ল আমরা বিশ্বাসী হতে পারি যে, আমরা এই দুঃখের প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন ক’রে এই দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারি। এটা প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে অনুকূল পরিস্থিতিতে পরিবর্তন করার বুদ্ধি-শোধন বা মনোভাব প্রশিক্ষণের উপায়কে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি তিব্বতে বা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অত্যাচারিত সমস্ত লোকজনদের দুঃখ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি আর তার তুলনা দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসে অনুভূত পীড়ার সাথে করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে আমাদের ব্যথা তুলনামূলক ভাবে একেবারে তুচ্ছ। আমাদের দুঃখের আপেক্ষিকতার বোধগম্যতা আমাদেরকে তুলনামূলক ভাবে অল্প পীড়াকালে শান্ত থাকতে সহায়তা করে। আর আমরা এর থেকে বেশী দুঃখ-কষ্ট পাই না। তাহলেও কিন্তু পীড়া সেখানে থাকবে তবে এটা একটা বড় বিষয় হয়ে থাকবে না।

এই দুটি উদাহরণেই আমাদের নিষ্ক্রমণ বা ত্যাগ ভাবনা রয়েছে। আমরা কী ত্যাগ করছি? উপরে-উপরে আমরা দুঃখ ত্যাগ করছি। তবে দুঃখের প্রতি আমাদের মনোভাব যেমনই হোক না কেন আমরা তাৎক্ষনিকভাবে এর থেকে মুক্ত হতে পারি না; ড্রিলিং বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা পীড়াদায়ক শারীরিক বেদনা অনুভব করতে থাকি। প্রকৃতপক্ষে, দন্ত চিকিৎসকের পক্ষ থেকে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পীড়া বা যন্ত্রণা অব্যাহত থাকে, তাতে আমরা এটা ত্যাগ করি অথবা না করি। তবুও ড্রিলিং থেকে উদ্ভূত পীড়া হল অনিত্য বা অস্থায়ী এবং এই অনিত্যতার কারণে আমরা এর থেকে শীঘ্রই রেহাই পেয়ে যাব, এই আত্মবিশ্বাসটি আমাদের পীড়াকে সহ্য করতে সহায়তা করে। অতএব, আমরা যদি আরও গভীর ভাবে পরীক্ষা করে দেখি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, আমরা আসলে ঐ দুঃখকে ত্যাগ করছি যার অনুভূতি আমাদের শারীরিক ভাবে হয়। মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা তাৎক্ষনিকভাবে ঐ অসুখীতা থেকে মুক্ত হতে পারি।

দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসে থাকাকালীন যখন আমাদের অনুভূতির সাথে ভয় এবং উদ্বেগ যুক্ত হয়ে যায় এই মানসিক অবস্থাগুলি আমাদের আরও বেশি অসুখী করে তোলে আর আমাদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে। তবে আমরা যদি পীড়ার প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করি, যেমন- এর অনিত্যতা অথবা আপেক্ষিকতা উপলব্ধি করি, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হয়ে উঠি যে ড্রিলিং-এর কারণে আমরা মানসিক ভাবে এবং আবেগগত ভাবে বেশি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করব না।

এটাই হল নিষ্ক্রমণের অনুশীলন। এটা এই বোধগম্যতার উপর ভিত্তি করে যে আমরা এখানে কী ত্যাগ করতে চলেছি অর্থাৎ মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে বাস্তবে আমরা কী থেকে মুক্ত হতে পারি। আমরা নিম্নলিখিত অনুভূতিগুলি ত্যাগ করিঃ

  • একটি কষ্টকর শারীরিক সংবেদনার প্রসঙ্গে অনুভূত অসুখীতা
  • কষ্টকর মানসিক এবং আবেগপ্রবণ অবস্থাগুলি।
  • এই কষ্টকর মানসিক এবং আবেগপ্রবণ অবস্থা প্রসঙ্গে অনুভূত অসুখীতা।

মনোভাবের পরিবর্তন কষ্টের অনুভূতির সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে পুরোপুরি বদলে দেয়। আমরা এটার উদাহরণ ঐ মহান লামাদের রূপে দেখেছি যাদের মৃত্যু পাশ্চাত্য হাসপাতালে হয়েছে, তাতে ঐ মৃত্যুটা ক্যানসারের কারণে হোক অথবা অন্য কোন মারাত্মক রোগের কারণে। তারা অবশ্যই শারীরিক পীড়া অনুভব করেছিলেন কিন্তু তারা নিশ্চয়ই ঐ রোগের কারণে অসুখী এবং ভয়ভীত হওয়া ত্যাগ করেছিলেন। পরিবর্তে, তাঁরা অপরের দুঃখ এবং তাদের শোক, বিশেষ করে, নিজেদেরকে অসহায় বোধ করা ডাক্তারের অস্বস্তির কথা ভেবে তাঁরা পুরো পরিস্থিতিটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। এই লামাগুলি খেয়াল রাখেন যে ডাক্তারটি কেমন অনুভব করেন আর অন্য লোকজন যারা তাকে পরিদর্শন করতে আসে এবং সম্মান জানাতে আসে তারা কেমন অনুভব করে।

তাদের দ্বারা এই রোগের সাথে মোকাবিলা করার জন্য গৃহীত দৃষ্টিকোণের আধার কী? এটা হল নিষ্ক্রমণ এবং করুণা। তারা নিজেরা এবং অন্য সকলের সাথে যুক্ত সমস্ত পরিস্থিতির সাথে জড়িত চাপ এবং মানসিক পীড়া ত্যাগ করেছেন। আর এখানে তারা কেবল ত্যাগ করার ভান করেন না। এই লামাগুলি কেবল বাইরে প্রকাশ করেন না, “ঠিক আছে; আমি ঠিক আছি, চিন্তা করবেন না।” বরং ভিতরে ভিতরে তারা ঠিক আছে বলে মনে করেন না। যদি তাঁরা ঠিক হতেন তাহলে তাঁরা এই স্পষ্ট বিশ্বাসটি হারিয়ে ফেলতেন। দৃঢ় বিশ্বাস ভয় এবং অস্বস্তিকে দূর করে দেয় কারণ এটা জানলে যে অমুক ধরণের প্রতিষেধক উপাদান প্রয়োগ করার ফলে এই পরিস্থিতির পুরো চাপ দূর হয়ে যাবে। অবশ্যই এই লামাদের মতো নিষ্ক্রমণ এবং করুণার অনুশীলনের সাথে আমরা যত বেশি পরিচিত হব আমাদের মধ্যে নিষ্ক্রমণের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত কারণগুলি স্বয়ংক্রিয় ভাবে উত্থাপিত হবে। এটা কৃত্রিম এমন কিছু নয় যাদেরকে আমাদের উৎপন্ন করতে হবে।

কঠিন পরিস্থিতির আরও একটি উদাহরণ হল আমাদের চাকরী হারিয়ে যাওয়া অথবা আমাদের সঞ্চিত ধন হারিয়ে ফেলা। যদিও ঐ পরিস্থিতির কারণে আমরা একটা বড় ধাক্কা খেতে পারি, তবে প্রত্যেকেই যারা তাদের কাজ হারায় অথবা সঞ্চিত ধন হারায় তারাও এটাকে ভয়ঙ্কর অনুভব করে। আমরা চাই যে, এই অসুখীতা এবং হতাশা যেন সমাপ্ত হয়ে যায় তাতে এটা আমাদের হোক বা অপরের। নিষ্ক্রমণ থেকে করুণার দিকে অগ্রসর হওয়ার অর্থ এই নয় যে আমরা আমাদের দুঃখ ত্যাগ করা বন্ধ করে দিই। বরং আমরা আমাদের মনের অবস্থা এত প্রসারিত করি যাতে এর মধ্যে প্রত্যেকে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়ঃ এর অর্থ আমরা এবং অন্য সকলেই।

সাধারণ সুখ সম্পর্কিত দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত নিষ্ক্রমণ এবং করুণা

এই পর্যন্ত ছিল দুঃখ-দুঃখতা এবং অসুখীতার দুঃখতাকে পরিলক্ষিত নিষ্ক্রমণ এবং করুণা। তবে আমাদের সুখও অবশ্যই সমস্যা যুক্ত। এক অর্থে এটাও দুঃখের একটা রূপ। এই দুঃখ বলতে ঐ সত্যকে বোঝায় যেটা আমাদের সাধারণ সুখ সেটা কখনও স্থায়ী হয় না; এটা কখনও সন্তুষ্টি প্রদান করে না; আর আমরা কখনোই মনে করি না, আমরা যে সুখ উপভোগ করেছি বা করি সেটা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত। আর এই সুখ অবিলম্বে অস্বস্তি এবং অসুখীতায় পরিবর্তন হয়ে যায়। এইজন্য এই দুঃখকে বলা হয় “বিপরিণাম দুঃখতা।” উদাহরণ স্বরূপ, যদি আইসক্রিম খাওয়াটা সুখের আসল কারণ হতো তাহলে আমরা যত বেশি আইসক্রিম খাব আমাদের ততবেশি সুখী হতে হবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে আমরা এমন একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাই যখন মনে হয় যে আইসক্রিম বেশি খাওয়ার কারণে আমরা অসুস্থ বোধ করছি। আইসক্রিম খাওয়া থেকে উত্থিত আমাদের সাধারণ সুখ পরিবর্তন হয়ে থাকে আর আমরা সুখী হই না। সংক্ষেপে, সাধারণ সুখ হতাশাজনক হয়। আমরা যতই সুখকে বজায় রাখতে চাই না কেন আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে আমাদের মেজাজ কখন পরিবর্তন হয়ে যায়। তদুপরি, এখন আমাদের যে সুখ আছে অথবা আগে যে সুখ ছিল তাতে আমরা কখনো সন্তুষ্ট নই। আমরা সর্বদা আরও চাই। মুক্ত হওয়ার সংকল্প নিয়ে আমরা এই বিপরিণাম দুঃখকেও ত্যাগ করতে পারি।

তবে সাধারণ সুখকে ত্যাগ করার অর্থ কী? এর অর্থ কি এটা যে আমরা কখনো সুখী হতে চাই না? এটা কি তাই যে আমরা সুখকে এইজন্য ত্যাগ করতে চাই, কারণ এটা অসন্তুষ্টির জন্ম দেয়? এরকম চিন্তা-ভাবনা করাটা বৌদ্ধ অবস্থান সম্পর্কে একটা স্থূল ভুল ধারণা তৈরী করা। সাধারণ সুখ হল অনিত্য এবং এটা সমাপ্ত হয়ে যাওয়া নিশ্চিত। যেমনকি পীড়া এবং অসুখীতার ক্ষেত্রে হয়। তবে নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা বাস্তবিকতাটা মেনে নিই আর সাধারণ সুখ যত সময় বজায় থাকে তার ভাল গুণাবলীকে আমরা অতিরঞ্জিত করে দেখি না।

এইভাবেই আমরা আমাদের সাধারণ সুখ সম্পর্কিত দুঃখকে কাটিয়ে উঠি। আমরা এটাকে অস্থায়ী ভাল অনুভূতিরূপে উপভোগ করি, তবে এর বিষয়ে পুরোপুরি অবগত থাকি যে এটা সবসময়ের জন্য স্থায়ী থাকবে না। যেহেতু আমরা জানি যে এটা সমাপ্ত হয়ে যাবে, তাই আমরা হতাশ হই না। আমরা আশাও করি না যে এটা চিরকালের জন্য স্থায়ী হবে। তবে যত সময় টিকে থাকে আমরা এটাকে উপভোগ করি। আমরা এই ভেবে অনুভব করি না যে এটা সমাপ্ত হয়ে যাবে বরং ঐ মুহুর্তের জন্য আমরা উদ্বেগের সাথে ভয়ভীত হই যে এটা সমাপ্ত হয়ে যাবে। মনে রাখবেন, আমরা যখন এই বাস্তবিকতার প্রতি স্পষ্ট বিশ্বাস করি যে এটা সমাপ্ত হয়ে যাবে, তখন ঐ চিন্তা-ভাবনার কারণে উত্থিত অস্বস্তি থেকে আমরা আমাদের মনকে মুক্ত করে ফেলব।

আমি এমন একজন বন্ধুর সাথে সময় কাটানোর উদাহরণ দেব যে সবসময় আমাদের সাথে থাকে অথবা যাকে আমরা সবসময় দেখতে পাই না। বন্ধুটা অল্প সময়ের জন্য আমাদের সাথে দেখা করে চলে যায় আর আমরা তাতে সন্তুষ্ট হই না। আমরা চাই যে ঐ ব্যক্তিটি আরও বেশি সময়ের জন্য আমাদের সাথে থাকুক। যাইহোক, ঐ দেখা-সাক্ষাৎ থেকে আমাদের মধ্যে এমন কী অর্জন করার প্রত্যাশা থাকে যা না পাওয়ার কারণে আমরা নিজেদেরকে অসন্তুষ্ট বোধ করে বসি? আমরা কি সত্যিই কোন প্রত্যাশা করেছিলাম যে ঐ ব্যক্তিটির সাথে থাকলে আমরা চূড়ান্তভাবে সুখী বোধ করব আর আমাদের একাকীত্ব এবং নিরাপত্তাহীনতা চিরকালের জন্য দূর হয়ে যাবে? সে যদি আরও পাঁচ মিনিট বেশি আমাদের সাথে থাকত তাহলে কি আমরা সন্তুষ্ট হতাম?

আমরা অসন্তুষ্ট হয়েছি কারণ আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, তবে এটা ছিল একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব প্রত্যাশা। আমরা যে প্রত্যাশা করেছিলাম সেরকম হওয়া অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে, আমরা যদি অলৌকিক কিছু ঘটে যাওয়ার আশা না করি তাহলে যা কিছু ঘটে থাকে তাতে আমরা সন্তুষ্ট হই। এটাকে বলা হয় বাস্তবিকতাকে মেনে যেওয়া। আমরা ঐ ব্যক্তির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, তার সাথে খাওয়া-দাওয়া, ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি যা কিছুই হোক না কেন আমরা সেটাকে উপভোগ করি। আমাদের মধ্যে এই বোধগম্যতাটুকু থাকে যে এই ঘটনাগুলির কারণে আমাদের অসুখীতা, একাকীত্ব অথবা ক্ষুধা, সবসময়ের জন্য সমাপ্ত হবে না; আর তাই আমরা এই আশা করি না। আমরা আমাদের বন্ধুর দেখা সাক্ষাৎকে অতিরঞ্জিত করি না; এই বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট অনুভূতি থাকে এবং তাই সে যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় আমরা উদাস বা হতাশ হই না। আমরা শুধু উপভোগ করি, ঘটনাটা যেমন ঘটতে থাকে তেমন সমাপ্তও হয়ে যায় এবং সেইজন্য যখন এটা সমাপ্ত হয়ে যায় আমরা মেনে নিই যে এটা সমাপ্ত।

এক বার যখন আমরা সাধারণ সুখের কারণে উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা করা ত্যাগ করে দিই তখন আমরা কীভাবে এটাকে অন্যের সাধারণ সুখের মধ্যে প্রসারিত করতে পারি? এটা স্পষ্ট যে আমরা যখন অন্য ব্যক্তির সাধারণ সুখ থেকে উদ্ভূত সমস্যাতে মনোনিবেশ করি ঐ পরিস্থিতিতে আবার স্পষ্ট মনের হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই এটা এমন নয় যে আমরা ঈর্ষা করি, কারণ অন্য ব্যক্তিটি সুখী এবং আমরা সুখী নই। যদিও আমরা উপলব্ধি করতে পারি তার সুখ তাকে সন্তুষ্ট করবে না। পরিবর্তে আমরা বুঝতে পারি যে এই ব্যক্তিটির বন্ধুর সঙ্গে তার যে সম্পর্ক আছে, সে তার থেকে বেশি প্রত্যাশা করে অথবা তার সাথে যত ভাল কিছু ঘটুক না কেন সে সর্বদা হতাশ এবং অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে। আমরা এই পরিস্থিতিকে একটা সমস্যারূপে গণনা করি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা চাই না সে যেন সুখী হয়। আমরা যার উপর মনোনিবেশ করি সেটা হল অসুখীতা অথবা সমস্যা যেটা উদ্ভূত হয় তার দ্বারা অনুভূত সাধারণ সুখের মাধ্যমে।

এখানে সুখ এবং সুখজনিত সমস্যার মধ্যে পার্থক্য করার ফলে এটা আমাদের অন্য ব্যক্তিরা যে সুখ ভোগ করে তার প্রতি আনন্দিত হতে সক্ষম করে তোলে। বৌদ্ধ শিক্ষায় আনন্দের উপর (অনুমোদন) খুব জোর দেওয়া হয়। আমরা তাদের সুখের প্রতি আনন্দিত হই, তবে আমরা বাস্তবিক ভাবে সাধারণ সুখের দোষগুলি বুঝতে পারি আর সাধারণ সুখের কারণে উত্থিত সম্ভাবিত সমস্যার প্রতি আমাদের মধ্যে করুণা ভাব জাগে। যাইহোক, এটা সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও, পার্থিব সুখ হওয়া সত্ত্বেও আমরা এর প্রতি আনন্দিত হতে সক্ষম হই।

সংস্কার দুঃখতার (সর্বব্যাপী দুঃখ) উপর কেন্দ্রিভূত নিষ্ক্রমণ এবং করুণা

বুদ্ধ দ্বারা নির্দেশিত দুঃখের গভীরতম রূপটি হল “সংস্কার দুঃখতা (সর্বব্যাপী দুঃখ)।” এটা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত পুনর্জন্ম অর্থাৎ তথাকথিত “সংসার”-কে বোঝায়। এটা হল প্রথম দুই প্রকারের সমস্যাকে অনুভব করার আধার। এটা হল ঐ দুঃখের স্বরূপ যা বুদ্ধ তাঁর চার আর্যসত্যের উপস্থাপনকালে অনন্যভাবে দুঃখরূপে চিহ্নিত করেছিলেন। আমরা নিয়মিতভাবে কোন না কোন রূপে এক প্রকারের “দূষিত” শরীর ধারণ করতে থাকব যা জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলতে থাকবে। হাঁটা শিখতে থাকা, কাজ করতে শিখতে থাকা আর যেটা বার বার সহজ ভাবে আঘাত পাবে এবং অনিবার্যভাবে অসুস্থ হবে, বৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছবে, ক্ষমতা হারাবে এবং তারপর মারা যাবে। আর আমাদের মনও নিয়মিতভাবে দূষিত হতে থাকবে যা কোন না কোন রূপে বিভ্রান্ত হবে, নানাপ্রকার কল্পনায় জর্জরিত হবে, অদ্ভূত চিন্তা-ভাবনায় ঘিরে থাকবে এবং ক্রমবর্ধমান মেজাজের কারণে নিয়মিতভাবে এর উত্থান-পতন হতে থাকবে।

আমরা সবসময় একটা জটিল সম্পর্কের মধ্যে থাকি যা কখনোই সন্তোষজনক হয় না। আমাদের সাথে এরকম ঘটনা ঘটতে থাকে যা আমরা চাই না যে সেগুলি ঘটুক। আমরা সবসময় যেটা পছন্দ করে থাকি সেটা পাই না; প্রকৃতপক্ষে, প্রায়শই আমরা ঐ জিনিসগুলি থেকে আলাদা হয়ে যাই যেগুলি আমরা পছন্দ করি, আর এমন জিনিসের সাথে মিলিত হই যা পছন্দ করি না। অন্যরা যখন এইভাবে অথবা ঐভাবে আচরণ করে আমরা সেটা পছন্দ করি না; তারা আমাদের ইচ্ছা মতো কিছুই করে না আমরা হতাশ হয়ে পড়ি; কঠোর পরিশ্রম করা সত্ত্বেও আমরা যেটা পছন্দ করি সেটা পাই না, যেমন- একটা ভালো কাজ, একজন ভালো সঙ্গী এবং এরকম আরও কিছু। কেবল আমাদের অনাগত জীবন সম্পর্কে নিশ্চয়তা নেই তা নয় বরং পরের মুহুর্তে আমরা কী অনুভব করব তার সম্পর্কেও কোন নিশ্চয়তা নেই।

আমাদেরকে সবসময় এই ধরণের শরীর এবং বর্তমান জীবন ত্যাগ করতে হবে, যেটা আমরা বর্তমানে কাটিয়ে চলেছি আর পুনরায় একবার নতুন জন্ম গ্রহণ ক’রে আবার সবকিছু নতুন ক’রে শিখতে হবে, আবার নতুন বন্ধু বানাতে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। আবার অবশ্যই এই সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন গ্যারান্টি থাকে না যে আমরা আবার মানবরূপে জন্মগ্রহণ করব; সম্ভাবনা এটা থাকে যে আমরা আর মানবরূপে জন্মাব না। হতে পারে আমাদের পুনর্জন্ম হবে একটা আরশোলা রূপে অথবা তার থেকেও নিম্নস্তরের প্রাণীরূপে। নিষ্ক্রমণ অবস্থায় আমরা সংকল্প করি যে আমাদের সাথে এরকম অনেক কিছু ঘটেছে।

নিষ্ক্রমণের এই স্তরটির সাথে যুক্ত মনের অবস্থাকে পরীক্ষা করাটা বড়ই আকর্ষণীয়। আমার মনে হয় এখানে একটা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত সাংসারিক পুনর্জন্মের প্রতি বিরক্ত হওয়ার একটা উপাদানও রয়েছে। যেহেতু আমরা সাংসারিক জীবনকে অতিরঞ্জিত করে দেখি না, তাই আমরা এক অর্থে এর প্রতি মোহিত হই না। আমরা শুধু এর প্রতি আগ্রহী হই নাঃ এটা সবসময় একই প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্ত হতে থাকে।

আমরা যদি জীবনে কখনো নিয়মিতভাবে বার বার ঘটিত সমস্যার প্রতি মোহিত না হয়ে তার প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠি তখনও কিন্তু এরফলে ঘটিত পরিস্থিতি নিয়ে আমরা চিন্তিত হই না। এটা সেরকম কিছু না। এর অর্থ এই নয় যে আমরা “যাই হোক না কেন”- এর বিচ্ছিন্ন মনোভাবকে গ্রহণ করে নিই। পরিবর্তে, আমরা বুঝতে পারি যে অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম সম্পর্কিত সর্বব্যাপী সমস্যার কারণ হল আমাদের বিরক্তিকর আবেগ, আমাদের বিরক্তিকর মনোভাব এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণ। এছাড়াও আমরা বুঝতে পারি যে এই দুঃখের আসল কারণ হল আমাদের মনের অশান্ত অবস্থা ও বাধ্যতামূলক আচরণের পিছনে লুকিয়ে থাকা অজ্ঞতা এবং বিভ্রান্তি। আমরা এগুলি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে সংকল্পবদ্ধ।

সংসার থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্পই হল “আসল জিনিস”, নিষ্ক্রমণের গভীরতম স্তর। তদুপরি, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমরা সাংসারিক পুনর্জন্মের এই ভয়ঙ্কর চক্রের অবসান ঘটাতে পারি। পরিণাম স্বরূপ, আমাদের মন এর কারণে অশান্ত হয় না যে আমরা এই অবস্থায় আছি, বরং আমাদের মন স্পষ্ট থাকে। আমরা নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য কিছু করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হই। এছাড়াও আমরা জানি যে এটার অবসান ঘটাতে আমাদের কী করতে হবে। আর আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমরা এটাকে করতে পারি। আমরা যখন সংসার থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্পকে শুধু নিজের উপর কেন্দ্রিভূত না ক’রে অন্য সকলের প্রতি সমানভাবে কেন্দ্রিভূত করি, তখন সেটা “মহা করুণার” রূপ ধারণ করে নেয়।

নিষ্ক্রমণের বিকাশের সময় বিপদগুলি এড়িয়ে যাওয়া উচিত

মার্গক্রম অর্থাৎ বোধিলাভের জন্য নির্ধারিত মার্গক্রমের প্রেরণার তিনটি স্তর সম্পর্কে নিষ্ক্রমণ এবং করুণাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এইজন্য আমরা এখানে এই প্রসঙ্গে চর্চা করব যে এই দুটিকে বিকশিত করার সময় আমাদের কোন্‌ কোন্‌ বিপদ থেকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। প্রাথমিক স্তরের অনুপ্রেরণা হল অনাগত জীবনকে শুধরানোর জন্য কাজ করা যাতে আমরা নিয়মিতভাবে সর্ব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন একটা বহুমূল্য মানব জন্ম লাভ করতে পারি যা আমাদের বোধিলাভের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সক্ষম করে তোলে। অনুপ্রেরণার এই প্রাথমিক স্তরের বিকাশ কালে যে বিপদ বা আশঙ্কা তৈরী হয় সেটা হল আমাদের মধ্যে খুব সহজেই এই বহুমূল্য মানব জন্মের প্রতি আসক্তি জন্মায়। আমরা মনে করি, “আমি পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে চাই আর নিজের বন্ধু-বান্ধব এবং প্রিয়জনদের সাথে নিয়মিত থাকতে চাই আর আমি যেন সর্ব সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারি ইত্যাদি, ইত্যাদি।” এইভাবে পুনর্জন্ম লাভ করার আমাদের প্রচেষ্টা সহজেই গভীর আসক্তির সাথে মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। যখন এইরকম ঘটে আমরা তখন বহুমূল্য মানবজন্মের গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করে তুলি। সর্বোপরি, আকাঙ্খা এবং আসক্তি কোন বস্তুর গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করে তোলার উপর ভিত্তি করে। আকাঙ্খার কারণে আমরা ভাবি, “আমাকে এই জিনিসটা পেতেই হবে,” আর যখন আমাদের কাছে কিছু থাকে না তখন আসক্তির কারণে আমরা ভাবি যেহেতু ইতিমধ্যে এটা আমার কাছে আছে, “আমি এটাকে হারাতে চাই না।”

নিষ্ক্রমণকে বিকশিত করার বিপদটি আসক্তির বিপদের সমান তবে সেটা বিকর্ষণ বা ঘৃণারূপে থাকে। বহুমূল্য মানবজন্মের গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করে দেখার কারণে উৎপন্ন আকর্ষণের পরিবর্তে নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রে আমাদের যে বিপদটা থাকে সেটা হল সাংসারিক অস্তিত্বের নেতিবাচক গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত করা। এই অতিরঞ্জিতের কারণে আমাদের মধ্যে তার প্রতি বিকর্ষণ জাগে যা আমাদের ঘৃণার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যার বিষয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। বিদ্বেষ এবং বিকর্ষণ একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত।

আমরা যখন নিষ্ক্রমণ বিকশিত করতে অভ্যাস করি তখন আমরা অনুপ্রেরণার মধ্যবর্তী স্তরের সাধক হওয়ার জন্য কাজ করি যে সংসার অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য প্রচেষ্টারত থাকে। এটা অতটা সহজ নয়। এই পরিস্থিতিতে আমরা সংসারের দোষ বা ত্রুটির প্রতি মনোনিবেশ করি, যেটা হল তথাকথিত “মনকে ধর্মের প্রতি প্রবৃত্ত করার চারটি বিচার”- এর মধ্যে একটি। আমরা সর্বক্ষণ সংসারের অসুবিধাগুলির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার চেষ্টা করি।

আমরা যখন বাস্তবে এই অভ্যাসটা করা শুরু করে দিই তখন আমরা জীবনে যা কিছু অনুভব করি তারমধ্যে সংসারের দোষকে সন্ধান করি। এটা আমাদের আবেগ এবং জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণের উপর প্রবল প্রভাব পড়তে পারে। আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন আমাদের মনে সর্বপ্রথম যে ভাবনাটি জাগে সেটা হল দুঃখ। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন কোন ব্যক্তিকে দেখি এবং তার প্রতি কিছুটা আকর্ষণ জাগে তখন তার সাথে আমাদের মনে দুঃখের কথাও জাগে। আমরা একটা নতুন কাজে যোগদান করি এবং ভাবি, “দুঃখ; এটা তো ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।” যা কিছুই ঘটুক না কেন, “সব কিছুতেই দুঃখ।” টেলিফোনের ঘন্টা বাজে, “দুঃখ।” যা কিছুই হোক। আমরা শাওয়ারে প্রবেশ করি, “দুঃখ; এটা সমাপ্ত হয়ে যাবে এবং পরে আবার অন্য দুঃখের সম্মুখীন হব। বিরক্তিকর!” এইভাবে সাধারণ জীবনের প্রতি একটি খুব নেতিবাচক মনোভাব বিকশিত করা খুব সহজঃ আমরা যা কিছু অনুভব করি তার প্রতি, বিশেষ করে লোকজনের প্রতি। আমরা একটা নতুন কম্পিউটার ক্রয় করি, “দুঃখ; এটা খারাপ হয়ে যাবে; কোন একটা ভাইরাস এটাকে নষ্ট করে দেবে।” আমরা একটা বন্ধুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করি এবং তখন আমাদের মনে প্রথম এই চিন্তা-ভাবনা জাগে যে, আমাদের দেখা সাক্ষাৎ-এর সময়টা কতটা অসন্তোষজনক হবে। আমরা কিছুই উপভোগ করতে পারি না। সবকিছুকে ভয়ঙ্কর এবং মুর্খতাপূর্ণ মনে করার এই নেতিবাচক মনোভাব হতাশার কারণ হয়ে ওঠে।

আনন্দকে নিষ্ক্রমণ এবং করুণার সাথে মিশ্রিত করা

নেতিবাচকতা এবং হতাশার এই আশঙ্কার সাথে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি? কেবল এই ব’লে ছেড়ে দেওয়াটাই কি এর সমাধান, “জীবনের সৌন্দর্যকে উপভোগ করুন।” আমাদের এখানে খুবই সাবধান হতে হবে। জীবনের আনন্দ উপভোগ করা কি জীবনের দুঃখের স্বভাব সম্পর্কে নির্বোধ থাকা হয়? এটা কি নিষ্ক্রমণের বিরোধী? এটাকে করুণায় পরিবর্তন করুনঃ আমরা ভাবি, “এটা কতটা দুঃখজনক যে প্রত্যেকে দুঃখ ভোগ করছে; এটা কতটা ভয়ঙ্কর।” কাউকে দেখে আনন্দিত হওয়ার আনন্দের সাথে এই দুঃখের সংমিশ্রণ কি, “আমি আপনার দুঃখ নিয়ে আনন্দিত? না, এটা একেবারেই হতে পারে না।” তাহলে আমরা কীভাবে আনন্দ এবং সুখের অনুভূতিকে নিষ্ক্রমণ অথবা করুণার সাথে মিশ্রিত করব?

আমরা যখন জীবনে আনন্দের সন্ধান ও অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করার আনন্দ এবং তাদের জীবনে আনন্দ খোঁজ করার চেষ্টা করি তখন আমরা এমন একটা বস্তুর প্রতি ধ্যান কেন্দ্রিত হই যেটা নিষ্ক্রমণ এবং করুণার অনুভূতি থেকে আলাদা হয়। আমরা আনন্দের সাথে নিজের এবং অপরের তথাগতগর্ভের সম্ভাবনার উপর এবং আধ্যাত্মিক প্রগতির ঐ সুযোগের উপর ধ্যান কেন্দ্রিত করি যা আমাদের জীবন আমাদের প্রদান করে। আমাদের সকলের মধ্যে এমন সম্ভাবনা রয়েছে যা আমাদের বুদ্ধত্ব লাভ করতে সক্ষম করে তোলে আর এটাই একটা আনন্দের বিষয়। এটাই হল আনন্দের উৎস। আমরা নিজের এবং অন্যের জীবনের দুঃখের স্বভাবের উপর আনন্দের সাথে মনোনিবেশ করি না।

উদাহরণ স্বরূপ, নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের দিকে এবং নিজেদের জীবনের দিকে তাকাই আর উপলব্ধি করি এবং স্বীকারও করি যে দুঃখ আছে। যদিও এটা দুঃখময় তাহলেও আমরা এতে হতাশ হই না। অথবা “যাইহোক না কেন”- আমরা এর দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করি। এটা আসলে এক ধরণের অসহায়ত্ব এবং হতাশার অনুভূতি। পরিবর্তে নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি যে আমরা নিজেদেরকে দুঃখ থেকে মুক্ত করতে পারি। আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং নিশ্চিত হই যে আমরা এই অসহনীয় পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য কিছু করব; আমরা জানি আমাদের কী করতে হবে এবং আত্মবিশ্বাসী যে আমরা এটা করতে পারি আর এটা থেকে মুক্ত হতে পারি। এরকম চিন্তা-ভাবনা করলে এটা আমাদের আনন্দিত ক’রে তোলে, তাই নয় কি?

তবুও আনন্দ এবং নিষ্ক্রমণ অথবা করুণা, মনের এই দুটি অবস্থাকে পরস্পর মিলিয়ে দেওয়া একটা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। তারা কি একই সাথে ঘটে; এদের একটা কি অন্যের মধ্যে নিহিত? তোং-লেন (আদান-প্রদান) অনুশীলনের মতো একটার পর একটা উৎপন্ন হয় অর্থাৎ দুঃখকে গ্রহণ করে সুখ প্রদান করা? বাস্তবে আমরা কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মেলাতে পারি- আন্তরিক নিষ্ক্রমণ ভাবনাপন্ন হয়, কিন্তু নেতিবাচক চিত্তের অবস্থা ব্যতীত কি সবকিছুই ব্যর্থ আর হতাশাপূর্ণ? আমার কাছে মনে হয় নিষ্ক্রমণ অথবা করুণা এবং আনন্দের মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং অন্যের জীবনকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। তবে আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের জন্য এটার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

নিষ্ক্রমণ সম্পন্ন হওয়ার অর্থ অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়া ত্যাগ করা নয়

ধরুন, আমরা প্রকৃতপক্ষে নিষ্ক্রমণকে বিকশিত করতে সফল হয়ে যাই যাতে আমরা আমাদের সাধারণ জাগতিক অস্তিত্ব সম্পর্কিত বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট না হই। ধরুন, এরপর আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই যে যদি আমরা কোন রকমের সাংসারিক সম্পর্কের সাথে যুক্ত হই সেটা কেবল আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে উঠবে। আর সেইজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুণী হয়ে মঠে জীবন-যাপন করব। এমনকি আমরা যদি এই সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলি তাহলেও আমাদের সতর্ক হতে হবে যে আমরা যেন সাধারণ ভাবে লোকজনদের প্রতি বিরক্ত না হই, কারণ এটা তাদের প্রতি করুণাভাব জাগানোর ক্ষেত্রে একটা প্রধান বাধা তৈরী হবে। আমরা এইভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি, “আপনি হলেন শুধু একটা সমস্যা!” এই চিন্তা-ভাবনা কারও সাথে জড়িত না হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলে। আমরা যদি একজন করুণাময় ব্যক্তি হতে চাই তাহলে আমাদের অন্যের সাথে জড়িত হওয়া প্রয়োজন আর সময়ে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করা উচিত।

অতএব, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ বা উদাসীনতার ভাব হল নিষ্ক্রমণ বিকশিত হওয়ার পথের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমরা যখন কোন ব্যক্তির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করি তখন আমাদের মনে হতে পারে, “এই ব্যক্তিটি কেবল সমস্যায় পড়েছেন। এর সাথে মেলামেশা করলে সেটা আমার জন্য শুধু দুঃখ এবং সমস্যাই বয়ে আনবে। এ আমার কোন পরামর্শই নেবে না; এ আমার জন্য একটা কঠিন সময় তৈরী করবে।” ইত্যাদি এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা থেকে এড়ানোর জন্য আমাদের শুধরানো প্রয়োজন।

আমরা যখন নিষ্ক্রমণ বিকাশ করি তখন দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দুঃখকে দেখা উচিত। সর্বপ্রথম, আমরা আমাদের দুঃখকে অসহনীয় মনে করি আর এর থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিই। তদুপরি, আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের মধ্যে তথাগতগর্ভ অর্থাৎ মৌলিক সম্ভাবনা আছে যা আমাদের সব ধরণের দুঃখ থেকে মুক্ত হতে এবং মোক্ষ লাভ করতে, এমনকি বুদ্ধত্ব লাভ করতে সক্ষম করে তোলে। সব ধরণের দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করলে আমাদের জীবনের আনন্দের অনুভূতিকে অস্বীকার করা যায় না, বরং সেটা আমাদের আনন্দ দিয়ে ভরে দেয়। তখন এই আনন্দ আমাদের নিষ্ক্রমণের, আমাদের মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্পের বিরোধী হয় না। বাস্তবে এই আনন্দ আমাদের নিষ্ক্রমণকে প্রবল করে তোলে। সুতরাং নিজেকে অবহেলা করা এবং “যাইহোক না কেন,” এই উদাসীন মনোভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করতে অবহেলা করার পরিবর্তে আমরা নিজেদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিই আর এক অর্থে নিজেদের প্রতি করুণা ভাব রাখি।

অন্য সকলের প্রতি করুণাভাব বিকশিত করার ক্ষেত্রে একই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য। আমরা তাদের জন্য কামনা করি যে তারা যেন তাদের দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যায় আর তারজন্য আমরা আনন্দিত হই যে তারাও তথাগতগর্ভের ভিত্তিতে মুক্ত হয়ে যায়। এরপর আমরা তাদের সহায়তা করার জন্য বাস্তববাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করি। অন্যকথায় আমরা চাই যে তাদের দুঃখ যেন নির্মূল হয়ে যায়, তবে আমরা ঐ লোকজনদের বিষয়ে চিন্তিত থাকি যারা দুঃখ ভোগ করে এবং কামনা করি তারা যেন শেষ হয়ে না যায়।

আমরা সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিটি নিজের উপর প্রয়োগ করি। “আমি চাই আমার দুঃখ-কষ্ট যেন দূর হয়ে যায়, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতে চাই। আমার প্রত্যাখ্যানের নেতিবাচক মনোভাব দুঃখের উপর কেন্দ্রিভূত হয়ে থাকে, একজন ব্যক্তি হিসাবে আমার উপর নয়।” এই দুটিকে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া এবং চিন্তা-ভাবনা করা খুবই সহজ, “আমি আমার দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেকে হত্যা করে ফেলব।” যখন নিজের সম্পর্কে এই পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে যায় তখন আমরা একইভাবে করুণায় প্রেরিত হয়ে ভাবতে পারি, “আমি চাই যে আপনার দুঃখ যেন দূর হয়ে যায়, কিন্তু আমি চাই না যে আপনি যেন শেষ হয়ে যান।”

এই পার্থক্যটি করা অতটা সহজ নয়। ঠিক তেমনই নিষ্ক্রমণের এই ত্রুটিপূর্ণ উৎপত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করাও অতটা সহজ নয়। এই ভাবনা আমাদের লোকজনদের দ্বারা বিতাড়িত বোধ করায় আর এর কারণে আমরা কারও সাথে যুক্ত হওয়া থেকে এড়িয়ে যাই। আমরা এই ভেবে এটা করি, “ব্যস, আমাকে একা থাকতে দিন। আমি শুধু আমার গুহা অথবা মঠে গিয়ে সাধনা করতে চাই।” এমনকি আমাদের বিরক্তিকর আবেগ যদি অত্যন্ত প্রবল হয় যা অন্যদের সহায়তা করতে আমাদের ক্ষমতায় মারাত্মক ভাবে বাধা সৃষ্টি করে আর ঐ মনোভাবকে শুধরানোর জন্য আমাদের একান্তে ধ্যান করার প্রয়োজন হয়, তাহলেও আমাদের অন্যের প্রতি অথবা নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং করুণার অভাব ত্যাগ করতে হবে।

ব্যক্তি এবং তাদের দ্বারা অনুভূত দুঃখের মধ্যে সম্পর্ক

নেতিবাচক মনোভাব বিকাশের এই সমস্যাটিকে আমরা কীভাবে ত্যাগ করতে পারি? এরজন্য আমাদের ঐ সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে যাকে আমি বলি “ধর্ম-লাইট” আর বিশ্লেষণ করতে হবে যথার্থ ধর্মের দৃষ্টিতে “রিয়েল থিং ধর্ম।” ধর্ম-লাইট সম্পূর্ণভাবে এই জন্মের উপর আধারিত পদ্ধতিগুলি উপস্থাপন করে; অন্যদিকে “রিয়েল থিং ধর্ম” অতীত এবং অনাগত জীবনকে স্বীকার করার উপর আধারিত।

আমাদের জীবনের সমস্ত মুহুর্তগুলির সন্ততির উপর আরোপিত অবস্থাকে একটা জীবনকাল বলা হয়। আমাদের জীবনকাল কোন এক মুহুর্তের সমরূপ নয়, নাই বা এটা এদের কোন মুহুর্তের সাথে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বে থাকে। এছাড়াও এমনকি আমরা বলতে পারি না আমাদের জীবনকাল তার সমস্ত মুহুর্তের সমষ্টির সমরূপ, কারণ আমাদের জীবনকালের সমস্ত মুহুর্তগুলি একই সাথে ঘটে না। আমরা যখন বয়স্ক হয়ে যাই তখন আমাদের শৈশবকাল আর থাকে না। আমাদের জীবনকাল শুধুমাত্র নিছক সন্ততির উপর আরোপিত।

রিয়েল থিং ধর্ম (যথার্থ ধর্ম) অনুযায়ী ব্যক্তিও একইভাবে ব্যক্তিগত মানসিক সন্ততির উপর আরোপিত হয়ে আছে। তবে যে মানসিক সন্ততির উপর আরোপিত থাকে সেটা কেবল এই জীবনকাল পর্যন্ত সীমিত থাকে না। সেগুলি আদি এবং অন্ত ব্যতীত চিরকাল স্থায়ী থাকে। এইভাবে ব্যক্তিও মানসিক সন্ততির কোন মুহুর্তের সমরূপ হয় না, যার উপর সে আরোপিত হয়; নাই বা সে সন্ততি থেকে আলাদা স্বাধীনভাবে অস্তিমান হয় অথবা সম্পূর্ণ সন্ততির সাথে সমরূপ হয় না, যেমন সমস্ত সন্ততি একই সময়ে একই সাথে ঘটে।

মানসিক সন্ততির যেকোন বৈশিষ্ট্যের উপর আরোপিত কোন ব্যক্তির সম্পর্কেও এই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য। নিষ্ক্রমণ এবং করুণার ক্ষেত্রে মানসিক সন্ততির বৈশিষ্ট্য হল সর্বব্যাপী দুঃখ। ব্যক্তি জীবন-যাপন করে এবং দুঃখ ভোগ করে কিন্তু তারা যে সন্ততির উপর আরোপিত তার উপর জনিত দুঃখ কোন বিশেষ স্থিতির সমরূপ হয় না। নাই বা সেটা সর্বব্যাপী দুঃখের সমরূপ হয় যা অনাদীরূপে তার মানসিক সন্ততিতে ঘটে চলেছে।

আমরা যখন এই তথ্যগুলি উপলব্ধি করি তখন আমরা “আমি” অথবা অন্য কাউকে অনুভূত দুঃখরূপে সনাক্ত করি না। এর কারণ হল আমরা দুঃখকে বিভ্রান্তির বশে “আমি’ অথবা “তুমি” রূপে দেখি না আর সেটাকে সমরূপে মনে করি না। এই কারণে আমরা যখন কামনা করি যে দুঃখ সমাপ্ত হয়ে যাক তখন আমরা কামনা করি না “আমি” অথবা “তুমি” যেন সমাপ্ত হয়ে যায়।

এইভাবে আমরা অন্যের এবং নিজের “আমি” সম্পর্কে আরও স্পষ্ট বোধগম্যতা লাভ করি। আমাদের মানসিক সন্ততি থেকে দুঃখ এবং দুঃখের কারণগুলি এমনভাবে উন্মুলন করা যেতে পারে যার আর কখনো পুনরাবৃত্তি না হয়। কিন্তু ঐ দুঃখকে যারা ভোগ করে সেই মানুষগুলিকে কখনো নির্মূল করা যেতে পারে না। যেমন মানসিক সন্ততির কোন অন্ত নেই, ঠিক তেমনই ঐ মানসিক সন্ততির উপর আরোপিত ব্যক্তি যাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা “আমি” আছে তারও কোন অন্ত নেই।

আমরা যদি মানসিক সন্ততির সহজাত শুদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হই আর দুঃখ এবং দুঃখের কারণকে চিরতরে নির্মূল করতে পারি তাহলে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যে, আমরা যেন এই “আমি”-কে শুদ্ধ মানসিক সন্ততি না ভেবে বসি। আর ঐ দুঃখকে নির্মূল করার বিষয়টিকে গুরুতর ভাবে বিচার না করি, কারণ আমাদের মনে হবে বাস্তবে দুঃখের অস্তিত্বই নেই।

আদান-প্রদান (তোং-লেন) অনুশীলনে দুঃখকে গ্রহণ করে সুখ প্রদানের পরিবর্তন

আমরা যখন অন্যের অথবা নিজের দুঃখের কথা ভাবি তখন এটা যন্ত্রণাদায়ক হয়। আমরা সত্যিই খুশি হই না যে আমরা অথবা অন্যরা দুঃখ ভোগ করছে; এরজন্য আমরা দুঃখিত হই। আদান-প্রদান (তোং-লেন) অনুশীলনে আমরা অন্যের দুঃখের উপর মনোনিবেশ করি অথবা এমনকি আমাদের নিজের দুঃখের উপরও। আর স্বাভাবিক ভাবেই এর বিষয়ে দুঃখ বোধ করি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা কিছুই অনুভব করি না যেমন- দুঃখটি অবাস্তব ছিল এবং কষ্ট দেয়নি। এরপর আমরা দুঃখকে গ্রহণ করার কল্পনা করি; আমরা স্বেচ্ছায় এটাকে স্বয়ং ভোগ করার জন্য মেনে নিই। তারপর আমরা তাদেরকে অথবা নিজেদেরকে মৈত্রী প্রদান করি যার অর্থ হল সুখী হওয়ার কামনা। এইভাবে আমরা নিজেদের উপর গৃহীত দুঃখের ভাবনা দ্বারা অন্যদের প্রদত্ত সুখ ভাবনায় পরিবর্তন করি।

আদান-প্রদান অনুশীলন করার সময় দুঃখ ভোগ করার বদলে সুখের অনুভূতির এই পরিবর্তন অনেক লোকজনদের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করে। আমরা দুঃখের অনুভূতিকে হঠাৎ সুখের অনুভূতিতে কীভাবে পরিবর্তন করতে পারি? সর্বোপরি এই দুটি অনুভূতি হল পরস্পর বিরোধী। আমাদের সামনে এই ধরণের সমস্যা ঐ সময় উৎপন্ন হয়েছিল যখন আমরা আলোচনা করেছিলাম যে নিষ্ক্রমণের সাথে দুঃখকে কীভাবে মনোনিবেশ করা যেতে পারে আর সেটাও হতাশ না হয়ে, জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম হয়ে আর মুক্তি লাভের সম্ভাবনাকে অনুভব করতে সক্ষম হয়ে। এখানে উপস্থাপিত বিষয়টি ঠিক একই রকম।

একজন অসুস্থ আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুর সাথে দেখা করার উদাহরণটি চিন্তা-ভাবনা ক’রে আমরা সুখের সাথে দুঃখের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হওয়ার গুরুত্বকে বুঝতে পারি। আমরা দুঃখ বোধ করি যে তারা অসুস্থ এবং পীড়িত। তবে যদি প্রিয়জনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করাকালীন আমরা যদি উদাস এবং দুঃখী হয়ে থাকি তাহলে তাতে ঐ ব্যক্তির কোন লাভ হয় না। আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হল ঐ সময় আমাদের অসুস্থ আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুকে উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু ঐ পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে একটি সুখের অনুভূতি বিকাশ করতে পারি? এটা কি কেবল একটি কৃত্রিম অনুভূতি? ভিতরে ভিতরে ভয়াবহ দুঃখের অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও আমরা কি শুধু মুখে একটা বড় হাসি ভাব রাখি?

এখানে দুঃখ ভাব থেকে সুখে আন্তরিক রূপান্তরিত করতে আমরা মহামুদ্রা অর্থাৎ ‘মনের মহামুদ্রা স্বভাব’ সম্পর্কিত উন্নত শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করতে পারি। সর্বপ্রথম আমরা যখন অন্যের বা নিজের দুঃখগুলি গ্রহণ করি তখন আমরা স্বেচ্ছায় দুঃখকে গ্রহণ করি। আমরা যখন আন্তরিকভাবে এটা করি তখন এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং বলের অনুভূতি জোগায়। আমাদের মনে আমরা পীড়িত নামক তথাকথিত “পীড়িত হওয়ার মানসিকতা থাকে না।”

মহামুদ্রার পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা যে দুঃখ ভোগ করি তার কারণে উত্থিত উদাসী ভাবকে আমরা মহামুদ্রা পদ্ধতির মাধ্যমে সেটাকে সাগরের উপর উদ্ভূত তরঙ্গরূপে বিচার করতে পারি। দুঃখকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার কারণ অর্জিত আভ্যন্তরীণ বলের কারণে ঐ তরঙ্গ আমাদের আবেগপ্রবণ ভাবে নাড়াতে পারে না। আমাদের দ্বারা অনুভূত দুঃখের তরঙ্গকে আমরা শান্তভাবে শান্ত হতে দিই। একবার যখন এটা স্বাভাবিকভাবে শান্ত হয়ে যায় তখন আমরা মনের সহজাত আনন্দ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এটা স্বাভাবিকভাবে আমাদের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত হয়। আর এটাই হল তাই যা আমরা আদান-প্রদান (তোং-লেন) অনুশীলন কালে অন্যদের দিই অথবা আমরা নিজেরা অনুভব করি।

মনের এই প্রাকৃতিক আনন্দের প্রতি বিরক্ত হওয়া বা বিরক্তিভাব প্রকাশ করার কিছু নেই। আমরা নিজের সুখের ঘোষণা বা প্রচার করি না, যেমন- “এটা কী বাজে যে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আপনার জন্য আমার খারাপ লাগছে তবে আমি আমার জীবন নিয়ে সুখে আছি। আমার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।” আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যময়, সহজাত আনন্দ শান্তিপূর্ণভাবে অন্যদের এবং নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে আর সুখের অনুভূতি জোগায়।

নিষ্ক্রমণ এবং করুণাকে বিকশিত করার আধার

আমরা যখন আমাদের বক্তৃতা শুরু করেছিলাম তখন আমি উল্লেখ করেছিলাম, চোংখাপা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, করুণার মতো মনের অবস্থাকে বিকশিত করার জন্য সর্বপ্রথম এটা জানা দরকার ঐ চিত্ত অবস্থার আধারটা কী। করুণাকে বিকশিত করার জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হল প্রথমে তার আধাররূপী সঠিক নিষ্ক্রমণকে বিকশিত করতে হবে। নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিরক্তিকর আবেগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হই যেটা আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত পুনর্জন্মকে পরিচালিত করে এবং আমরা সেগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টারত হই।

করুণার আধার গঠনের পরবর্তী পদক্ষেপটি হল নিষ্ক্রমণের আধারের ভিত্তিতে সমতাকে বিকাশ করা। অন্যকথায়, আমাদের বিরক্তিকর আবেগগুলিকে সমাপ্ত করার জন্য প্রচেষ্টারত হওয়া। সমতার মাধ্যমে আমরা আকর্ষণ বিকর্ষণ অথবা তাদের কারও প্রতি উদাসীনতার বিরক্তিকর ভাব ব্যতীত সকল প্রাণীর প্রতি উন্মুক্ত হয়ে মনোনিবেশ করি। আমরা সকলের প্রতি সমানভাবে উন্মুক্ত হই। যেহেতু আমরা সবাই এই দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে এক যে আমরা প্রত্যেকেই একটি অনাদি এবং অনন্ত মানসিক সন্ততির উপর আরোপিত। এর কারণ হল অনাদিকাল থেকে প্রত্যেক প্রাণীর সাথে সব ধরণের সম্বন্ধ রয়েছে আমরা তাদের মধ্যে কাউকে একটা সম্পর্কের মাধ্যমে সনাক্ত করি না, যদিও তারা কোন না কোন সময় আমাদের বন্ধু, শত্রু অথবা অপরিচিত ছিল সুতরাং এখানে আকর্ষণ, বিকর্ষণ বা উদাসীনতার কোন ভিত্তি থাকে না।

এরকম কোন সময় সম্পর্কে মনোনিবেশ করলে লাভ হয় না যে একসময় প্রত্যেকটি প্রাণী আমাদের শত্রু বা হত্যাকারী ছিল। যে সম্পর্কে মনোনিবেশ করলে বেশি লাভ হয় সেটা হ’ল প্রত্যেকে কোন না কোন সময় আমাদের মা হয়েছিলেন, আর মা হিসাবে অথবা প্রধান পালনকর্তা হিসাবে তারা প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি যে কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন তার উপর চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। এমনকি এই জন্মে আমাদের মা আমাদের নির্যাতন দিয়ে থাকেন এবং দুর্ব্যবহার করে থাকেন তাহলেও যে নুন্যতম কৃতজ্ঞতা তিনি বজায় রেখেছেন, সেটা হল তিনি আমাদের গর্ভপাত করেননি। তিনি অথবা বর্তমানে আমাদের স্থানাপন্ন মা, আমাদের উপর বিশেষভাবে সদয় হয়েছেন কারণ তারা আমাদেরকে তাদের গর্ভে ধারণ করে রেখেছিলেন।

পরবর্তী পদক্ষেপটি সাধারণত “কৃতজ্ঞতা পরিশোধ করা” হিসাবে অনুবাদ করা হয়, তবে আমার মতে “শোধ করা” শব্দটি একটি ব্যবসায়িক চুক্তিতে ঋণ শোধ করাকে বোঝায় অর্থাৎ আমরা যদি ঋণ শোধ না করি তাহলেও আমরা দোষী হয়ে যাই। এখানে এই পদক্ষেপে যে মনোভাবটি অভিপ্রেত সেটা হল বাধ্যতা বা অপরাধবোধের পরিবর্তে আমাদের কৃত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা। এরপর সেই আবেগের ভিত্তিতে আমরা যখন কল্পনা করি যে আমাদের মায়ের অন্ধ বিভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তিকর ক্ষতিকারক আচরণের খাদে পড়ে যাওয়ার অবস্থায় আছি আর আমরা তাদের সাথে আছি এবং জানি কিভাবে তার সহযোগিতা করতে হবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমরা প্রচেষ্টা করার দায়িত্ব নিজেদের উপর নিই যাতে তার পতন রোধ করার জন্য কিছু করতে পারি। যদি তার নিজের পুত্র বা কন্যা তার সহায়তা না করে তাহলে কে করবে?

প্রত্যেকে একসময় অথবা অন্যসময় আমাদের জন্য কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন তারজন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা বোধের ভিত্তিতে এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের সহায়তা করে নিজেদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মাধ্যমে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হৃদয়গ্রাহী মৈত্রী বিকাশ করি। আমরা সকলের সাথে এই ধরণের উষ্ণ সংযোগ অনুভব করি যে আমরা যখনই কারও মুখোমুখি হই তখনই আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘনিষ্ঠতা অনুভব করি, যেমন- একজন মা তার একমাত্র সন্তানের জন্য অনুভব করে। আমরা তাদের কল্যাণ সম্পর্কে আন্তরিকভাবে উদ্বিগ্ন হই আর তাদের সাথে খারাপ কিছু ঘটলে আমরা দুঃখিত হই।

এই হৃদয়গ্রাহী মৈত্রীর ভিত্তিতে ঐ ধরণের মৈত্রী বিকাশ করা যায় যা বৌদ্ধধর্মে ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ সমস্ত সত্ত্বরা সমান ভাবে সুখী হোক এবং সুখের কারণে যুক্ত হোক, এই কামনা। সকলের প্রতি এই মৈত্রীর ভিত্তিতে আমরা করুণা বিকাশ করিঃ তারা সকলেই যেন দুঃখ থেকে এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হয়, এই কামনা। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে অন্তর্নিহিত এবং সমর্থনকারী করুণা হল অনেকগুলি ইতিবাচক আবেগের মিশ্রণ, যেমন প্রত্যেকের সাথে উন্মুক্ত ভাব এবং ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি, তাদের উদারতার জন্য কৃতজ্ঞতা, হৃদয়গ্রাহী মৈত্রী, স্নেহ ইত্যাদি। এগুলি সবই করুণার মধ্যে সমাহিত।

তারপর এর অর্থকে আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, যদি করুণা নিষ্ক্রমণের ঐ মনের অবস্থাকে বোঝায় যা অন্যের দুঃখকে অভিপ্রেত করে তাহলে করুণার আধারও নিষ্ক্রমণের কোনরূপে নিহিত হওয়া উচিত। এর অর্থ হল আমাদের সর্বপ্রথম নিজের প্রতি সমতা ভাব রাখা দরকার অর্থাৎ আকর্ষণ নয়, বিকর্ষণ নয় অথবা উদাসীনতা নয়। এরপর আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা এই জীবনে এবং অতীত জীবনে যে সমস্ত নেতিবাচক কর্ম করেছি তার উপর মনোনিবেশ করলে কোন লাভ হয় না। অন্য জন্মে তারা আমাদের মা হয়েছেন এবং আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন এই বিষয়টির উপর মনোনিবেশ করার সাথে সাথে তাদের দ্বারা কৃত ইতিবাচক কর্মের উপর মনোনিবেশ করা উচিত। যেগুলি আমরা স্বয়ং নিজেদের জন্য করেছি। বর্তমানে আমরা বহুমূল্য মানব জীবনের সমস্ত উপকারী পরিস্থিতিকে উপভোগ করছি। এটা হল আমাদের দ্বারা অতীতে কৃত গঠনমূলক কর্মের ফল। এরকম ক’রে আমরা নিজেদের প্রতি যে সদয়তার পরিচয় দিয়েছি আমরা তার প্রশংসা করি আর কৃতজ্ঞতা বোধ করি। এই ভাবনাটি আমাদের নিজের প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে হৃদয়গ্রাহী মৈত্রীর দিকে পরিচালিত করে। আমরা আন্তরিক ভাবে আমাদের কল্যাণের বিষয়ে যত্নশীল হই এবং আমাদের সাথে যদি খারাপ কিছু ঘটে তাহলে আমাদের খুব খারাপ লাগে।

করুণার অনুশীলন করার সময় প্রধান সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে যেটা সকলকে সমান করে দেয় সেটা হল প্রত্যেকেই সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখী হতে চায় না আর সকলের সুখী হওয়ার সমান অধিকার আছে, দুঃখী হওয়া নয়। “প্রত্যেকে” এই শব্দটি এখানে আমাদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং আমাদের সুখী হওয়ারও অধিকার আছে; আমাদেরও দুঃখী না হওয়ার অধিকার আছে। অতএব নিষ্ক্রমণের বিকাশ- মুক্ত হওয়ার এই দৃঢ় সংকল্প- মূলত আমাদের নিজেদের প্রতি করুণা ভাব বিকাশ করা প্রয়োজন।

দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি নিজের প্রতি দ্বৈতবাদী মনোভাবকে গ্রহণ করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি না যে “আমার” প্রতি করুণাভাব বিকাশকারী “আমি” ঐ “আমি” থেকে আলাদা যার প্রতি আমি করুণা ভাব বোধ করছি। “নিজের প্রতি সদয় ভাব জাগানো” হল কেবল একটা কথার ভাব। তবে আমরা যদি নিজেদের প্রতি সদয় হতে চাই আর নিজেদেরকে দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত করতে চাই তাহলে আমাদের ও নিজেদের মনোভাব বিকাশ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি এই ব্যক্তির সাথে অসুস্থ সম্পর্কে রাখতে চাই না; আমি ক্রোধিত হতে চাই না; আমি মন খারাপ করতে চাই না; আমি আসক্ত হতে চাই না।” এইভাবে আমরা দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পকে বিকাশ করি। আর এটা আমাদের একটা আধার জোগায় যে আমরা কীভাবে “সবকিছু দুঃখময়” এই ভাবনার সাথে হৃদয়গ্রাহী সুখ এবং প্রশান্তির মৌলিক অনুভূতি বজায় রাখতে পারি।

সারাংশ

আমরা অনেক উপাদান সম্পর্কে চর্চা করেছি, তবে আমি বৌদ্ধধর্মের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আরও একটি পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। এটা শুধু অধ্যয়ন করার একটা বিষয় নয় কিন্তু আমাদের নিজস্ব বিকাশের দিক থেকে আমরা কীভাবে নিষ্ক্রমণ এবং করুণাভাব বিকাশ করতে পারি সেটা বোঝানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে কীভাবে স্বাস্থ্যকর ও স্থিতিশীল উপায়ে নিষ্ক্রমণকে করুণারূপে পরিবর্তন করা যায় আর মনের এই দুটি অবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী।

Top