মার্গক্রম (লাম-রিম)-এর পারম্পরিক উপস্থাপনা

বোধিলাভের ক্রমবদ্ধ পথ ধরে অগ্রগতি শুরু হয় এক অমূল্য মানবজন্ম লাভের পর এবং এটা জানতে হবে যে এই মানবজন্ম লাভ করার পরই এই অগ্রগতি করতে আমরা এক অবিশ্বাস্য বিরল সুযোগ প্রাপ্ত করতে পেরেছি। আমরা যদি এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে কেবল এই ধরণের পুনর্জন্ম নয়, বরং মুক্তি এবং বোধিও লাভ করতে পারব। সবকিছুই আমাদের অনুপ্রেরণা এবং লক্ষ্যের সুযোগের উপর, আর বুদ্ধ দ্বারা উপদিষ্ট ধর্মের চর্চা এবং অনুশীলনের উপর নির্ভর করে।

মূল্যবান মানব জন্ম

কেন একটা মূল্যবান মানবজন্ম একটা চিন্তামণি রত্নের সমান

আমাদের কাছে যে মূল্যবান মানব শরীরটা আছে সেটা একটা চিন্তামনি রত্নের চেয়েও বেশী মূল্যবান। এটা হ’ল ক্ষণ (অবসর)-এর আধার, তবে আমাদের শরীর আমাদেরকে যে অবসর এবং সুযোগ প্রদান করে সেটা ঔষধের উপর ভরসা করা নয়, বরং ধর্ম অনুশীলন করা। মূল্যবান মানব শরীরটা একটা চিন্তামণির চেয়েও বেশী মূল্যবান কেন? কারণ, চিন্তামণি দিয়ে আমরা এই জীবনে খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্য প্রাপ্ত করতে পারি, কিন্তু একটা চিন্তামণি অনাগত জীবনে উপকার করতে পারে না। সুতরাং, এই শরীর, আমাদের কাছে যেটা আছে, যা ধর্ম অনুশীলন করার সুযোগ প্রদান করে, সেটা এই ধরণের রত্নের চেয়েও বেশী মূল্যবান।

আমরা সকলেই সর্বদা এবং যতটা সম্ভব সময়ের জন্য সুখের কামনা করি। তবে আমরা এই জীবনকালে যা কিছু সুখ অর্জন করি না কেন, এটা খুব অল্প সময়ের জন্য হয়, কারণ এটা এই স্বল্পকালীন জীবনকালে স্থায়ী হয়। সুতরাং, আমরা যদি সুখের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা চাই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের জীবন সম্পর্কেও ভাবতে হবে। একটা চিন্তামণি রত্ন তিনটি অপায় ধাতুতে (দুর্গতিতে) পুনর্জন্ম হওয়া থেকে মুক্তি দিতে পারে না এবং আমাদের অমরত্ব প্রদান করতে পারে না, কিন্তু কার্যনির্বাহী আধাররূপী এই মূল্যবান মানব শরীরকে ব্যবহার ক’রে আমরা নিজেদেরকে নিম্ন পুনর্জন্ম (দুর্গতি) থেকে রক্ষা করতে পারি; এবং জেচুন (ভট্টারক) মিলারেপার মতো, এটাকে ধর্মের অনুশীলনের আধার হিসাবে ব্যবহার ক’রে আমরা এই জীবনকালে বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারি। সুতরাং, যেহেতু একটি চিন্তামণি রত্ন আমাদের উক্ত জিনিসগুলি প্রদান করতে পারে না, যা আমাদের মূল্যবান মানব শরীর পারে। সেই জন্য আমাদের শরীর হ’ল একটা চিন্তামণি রত্নের থেকেও বেশী মূল্যবান।

সুতরাং আমাদের এই মূল্যবান মানব শরীর ধারণ করে ধর্মের অনুশীলন করা উচিত। যদিও এটা একটা চিন্তামণি রত্নের চেয়েও মূল্যবান, তাসত্ত্বেও আমরা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী রাখি অর্থাৎ আমরা সাধারণতঃ আমাদের শরীরকে আরও বেশী পরিমাণে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করার জন্য ব্যবহার করি। এমনকি আমরা এই স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যের জন্য আমাদের জীবনটাকেও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকি। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা আমাদের চেয়ে বেশী ধনী ও বুদ্ধিমান, কিন্তু ধর্ম অনুশীলনে আমরা আমাদের মূল্যবান মানব শরীরকে ব্যবহার করে তাদের চেয়ে অনেক বেশী ইতিবাচক শক্তি (পুণ্য) সঞ্চয় করি। সুতরাং এই মূল্যবান মানব জন্মকে অপব্যয় না করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিবর্তে এটা যে তিনটি উদ্দেশ্যের জন্য কার্যকর সেগুলি পূরণ করার জন্য এটাকে ব্যবহার করা জরুরীঃ ভবিষ্যতে আরও একটি পুনর্জন্ম লাভ করা, মুক্তি এবং বোধি।

আমাদের কাছে যতই বস্তুগত জিনিস থাকুক না কেন সেগুলি কিন্তু সন্তুষ্টি নিয়ে আসে না বা সেগুলি আমাদের সন্তুষ্টি প্রদান করে না। এমনকি যদি কোন ব্যক্তি পৃথিবীর সমস্ত ভৌতিক বস্তুর মালিক হয়ে যায় তাহলেও কিন্তু সে তাতে সন্তুষ্ট হবে না। অতএব এটা স্পষ্ট যে, সমস্ত চিন্তামণি রত্নও সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারে না। কেউ যদি আরও বেশি পরিমাণে ধন-সম্পদ অর্জন করে, তাহলে এটা পছন্দের পরিবর্তে কেবল আরও বেশি দুঃখ নিয়ে আসে। আমরা এই বাস্তবতাটি নিজেরাই অনুভব করতে পারি, যেমন- আমরা যদি প্রচুর জিনিস পত্র নিয়ে বাসে বা ট্রেনে ভ্রমণ করি তাহলে ভ্রমণ করাটা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যায়। তার পরিবর্তে আমাদের কাছে যদি এই সমস্ত সম্পত্তি না থাকে তাহলে এটা খুব সহজ হয়ে যাবে।

সুতরাং আমাদের এইভাবে ধর্মের অনুশীলন করার চেষ্টা করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জেচুন (ভট্টারক) মিলারেপা, যখন তিনি গুহায় বাস করতেন, তখন তার কাছে কোন ধরণের বস্তুগত সম্পত্তি ছিল না। মিলারেপা এবং শাক্যমুনি বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন যে, বস্তুগত সম্পত্তি কতটা তুচ্ছ এবং অনাবশ্যক। সেইজন্য তারা ধর্ম অনুশীলনের জন্য সে সমস্ত সম্পত্তি পরিত্যাগ করে দিয়েছিলেন। আপনারাও, যারা বিশ্বের অনেক ধনী দেশে বাস করেছেন, উপলব্ধি করেছেন যে বস্তুগত সম্পত্তি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ধর্মের অনুশীলন করার জন্য সেগুলি পিছনে ফেলে এখানে এসেছেন।

একটা মূল্যবান মানব জন্ম লাভের কারণ ও অসুবিধা

আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে, এই মূল্যবান মানব শরীরটা প্রাপ্ত করা এত কঠিন কেন। এটা প্রাপ্ত করা কঠিন কারণ এর হেতু গুলি নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর তিনটি প্রধান হেতু আছেঃ

  • কঠোর নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
  • ছয়টি সুদূর প্রসারী মনোভাব (ষট্‌ পারমিতা) অনুশীলন করা।
  • বিশুদ্ধ প্রণিধান (প্রার্থনা) সম্পাদন করা।

কঠোর নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা বজায় রাখা

কঠোর নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা বজায় রাখা খুব কঠিন আর অন্যের মধ্যে এটাকে সনাক্ত করা এবং মূল্যায়ন করাও আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। এই নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে দশটি ধ্বংসাত্মক কর্ম আছে। আমাদের ভাবতে হবে যে, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ সেগুলি কী তাও জানে না; এবং অবশ্যই যারা জানে সেগুলি কী, ত্যাগ করার জন্য অনুশীলন করে না।

কায়িক ধ্বংসাত্মক কর্ম তিনটি আছেঃ

  • প্রাণাতিপাত- উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি আমাদের হত্যা করা উচিত নয়, কিন্তু যখন একটা পোকামাকড় আমাদের কামড়ায় তখন আমরা সহজাত ভাবে সেটাকে চড় মারি এবং সেটার হত্যা করি।
  • অদত্তাদান- এমনকি আমরা যদি বাইরে না যাই এবং বড় ধরণের চুরি না করি তাহলেও আমরা অপরের কাছ থেকে জিনিস পেতে বুদ্ধিমান কৌশল ব্যবহার করি। সুতরাং এটাও প্রায় একই জিনিস।
  • কামমিথ্যাচার (অনুপযুক্ত যৌন আচরণে জড়িত হওয়া)- নিজের মধ্যে অপরের সঙ্গীর সহবাস করার ইচ্ছা জাগানো।

আমরা যখন বৃষ্টিতে বাইরে আসি তখন বৃষ্টির জল আমাদের উপর পড়ার মতো আমরা প্রতিদিন এই কায়িক ধ্বংসাত্মক কর্মগুলি সঞ্চয় করি।

চারটি বাচিক ধ্বংসাত্মক কর্ম

  • মৃষাবাদ (মিথ্যা কথা বলা)- আমরা সবসময় এটা সঞ্চয় করে থাকি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি পাহাড়ের নীচে যাওয়ার মনস্থ করি এবং তখন কেউ যদি আমাদের জিজ্ঞাসা করে আমরা কোথায় যাচ্ছি, আমরা বলে ফেলি যে পাহাড়ের উপরে যাচ্ছি।
  • পৈশূন্যতা (বিভাজনমূলক কথা বলা)- বন্ধুদের মধ্যে একে অপরের সাথে অবন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং যারা ইতিমধ্যে বন্ধু নয় তাদের মধ্যে আরও শত্রুতা তৈরী করা। আমরা সবসময় অন্যের সম্পর্কে খারাপ কথা বলে এই কর্মটা করি।
  • কঠোরভাবে কথা বলা- এটা অবশ্যই শুধু কোনও মানুষের প্রতি নয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনও একটা কুকুর যদি আমাদের কক্ষে প্রবেশ করে, আমরা বলে থাকি, “ভাগ! যা এখান থেকে!” এবং কঠোর ভাষা ব্যবহার করি। আপত্তিজনক বা রূঢ় ভাষা ব্যবহার করা একটা মস্ত বড় ভুল, যেহেতু আমরা জানি যে, কেউ যখন আমাদের প্রতি রূঢ় ভাষা ব্যবহার করে আমরা খুব আঘাত পাই এবং সেই জন্য পশু সহ অন্যরাও একইরকম অনুভব করে।
  • নিরর্থক বকবক করা- ব্যবহারিক ভাবে আমাদের মুখের প্রতিটি শব্দই গালগল্পঃ “আমি অমুক দেশে আছি”, “আমি এটা করছি এবং ওটা করছি”। আপনি যদি অনেক কথা বলেন, তাহলে আপনি বাচিক ধ্বংসাত্মক কর্ম করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেন। যেহেতু আমি ইংরেজী জানি না, ইংরেজী ভাষায় গালগল্প করার আমার কোনও সুযোগ নেই এবং তাই আমি কেবল তিব্বতী ভাষায় গালগল্প সঞ্চয় করতে পারি।

তিনটি মানসিক ধ্বংসাত্মক কর্ম

  • লোভের সাথে চিন্তা-ভাবনা করা- কারও একটা খুব সুন্দর বাড়ি ইত্যাদি আছে এবং আপনি নিজের জন্য এটার কামনা করেন, সারাক্ষণ এটার সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন এবং এটা কীভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে ষড়যন্ত্র করেন। এটা মোটেই ভাল না, তবে এটা এমনই জিনিস যা আমাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আছে।
  • বিদ্বেষের সাথে চিন্তাভাবনা করা- কেউ অসুখী হোক বা তার ঘাড় ভেঙ্গে দেওয়ার কামনা করা। এটা এমন একটা বিষয় যা শুধু আমরা আমাদের শত্রুদের জন্য কামনা করি না, বরং আমাদের বন্ধুরাও যদি আমাদের বিরক্ত করে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের সাথে চিন্তাভাবনা করতে পারি।
  • শত্রুতার সাথে বিকৃত ভাবে চিন্তাভাবনা করা- উদাহরণস্বরূপ, কোনও অনাগত পুনর্জন্ম নেই, শরণরূপী ত্রিরত্ন কাউকে সহায়তা করতে পারে না, পূজা-অর্পন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করাটা সময় নষ্ট করা, প্রদীপ প্রজ্বলন করাটা মাখনের অপচয় করা অথবা তোরমা (বলি) অর্পন করাটা শুধু ছাতু ফেলে দেওয়ার মতো, এইরকম চিন্তাভাবনা করা।

নিজেদেরকে এগুলি প্রতিহত করা থেকে বিরত রাখা খুব কঠিন। আপনি যদি নিজেকে সেগুলি করা থেকে নিজেকে বিরত না রাখেন, তাহলে আপনি একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করতে পারবেন না। বিশদে যাওয়ার এখন আর সময় নেই। তবে আপনি যদি বেশী কিছু জানতে চান তাহলে আপনাকে মার্গক্রমের শিক্ষাগুলি অধ্যয়ন করতে হবে।

ছয়টি সুদূর প্রসারী মনোভাবের (ছয় পারমিতার) অনুশীলন

একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করার দ্বিতীয় কারণ বা হেতু হ’ল সুদূর প্রসারী মনোভাব বা ছয়টি পারমিতাঃ

  • দান
  • শীল (নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা)
  • ক্ষান্তি (ধৈয্য)
  • বীর্য (প্রচেষ্টা)
  • ধ্যান (মানসিক স্থিতিশীলতা)
  • প্রজ্ঞা (প্রভেদমূলক সচেতনতা)

কিন্তু দান অনুশীলন করার পরিবর্তে আমরা কৃপণতা অনুশীলন করি এবং অপরকে আমাদের কৃপণ মনোভাব প্রসারিত করি। ধৈর্য্য ধারণ করার পরিবর্তে আমরা ক্রোধিত হই। প্রচেষ্টা, যার দ্বারা আমরা বীরত্বপূর্ণ সাহস নিয়ে কাজ করি এবং ধর্ম অনুশীলনে আনন্দিত হই, সেটা করার পরিবর্তে আমরা অলসতা দেখাই এবং সারাক্ষণ ঘুমোতে চাই। মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিবর্তে আমরা মানসিক বিক্ষেপতা বা বিচরণ গড়ে তুলি, যেমন- কোনও মন্ত্র পাঠ করার সময় আমাদের মন চারিদিকে বিচরণ করতে থাকে এবং এটা হওয়ার জন্য আমরা আরও সুযোগ তৈরী করি।

এক সময় একজন শিক্ষক ছিলেন। ধর্ম অনুশীলনের মাঝামাঝি তার মনে পড়েছিল যে, তার একটা কাজ ছিল যেটা তিনি তার শিষ্যকে দিয়ে করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি তার শিষ্যকে সেটা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি যে মুহুর্তে সেটা স্মরণ করলেন তখন তার ধ্যানসাধনা বন্ধ হয়ে গেল, তিনি উঠে পড়লেন এবং তাকে সেটা করতে বললেন। এই ছিল তার মনের বিক্ষেপতা। আমরা যখনই পাঠ অনুশীলন করি আমাদের মন বিচরণ করার প্রবণতা দেখায়।

সুদূর প্রসারী প্রভেদমূলক সচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতার (প্রজ্ঞা) বিকাশ করতে হবে যা শূন্যতাকে অবগমন করে। কিন্তু আমরা এর পরিবর্তে লৌকিক জিনিস, যেমন- চিত্রকলা ইত্যাদি, অধ্যয়ন করি। সুতরাং আমরা সঠিক প্রকারের জ্ঞান অর্জন করি না।

সংক্ষেপে, একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করার কারণগুলি নির্মাণ করা খুব কঠিন। এইরকম একটা শরীর লাভ করা যে কত বিরল সেটা দেখে আমাদের মনে করা উচিত যে, এটা আমরা একবারই লাভ করেছি এবং এটা খুব শীঘ্রই হারিয়ে যেতে পারে। যে মূল্যবান মানব শরীরটা আমরা প্রাপ্ত করেছি সেটা যদি সদ্ব্যবহার না করি তাহলে ভবিষ্যতে অন্য আরও একটা প্রাপ্ত করা খুব কঠিন হয়ে যাবে।

বিশুদ্ধ প্রণিধান (প্রার্থনা) অর্পন করা

একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করার জন্য আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা করার সাথে বিশুদ্ধ নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা পালনকে সম্পূরণ করা এবং ছয়টি সুদূর প্রসারী মনোভাব (ছয় পারমিতা) অনুশীলন করতে হবে। এর অর্থ এইরকম প্রার্থনা নয়, “ওহে বুদ্ধ, আমাকে এই জিনিসটা প্রদান করুন যাতে আমি যেন একটি সুন্দর মেয়ে বা একটা সুন্দর ছেলে হই, আমি সবসময় আপনার স্তুতি করব!” পরিবর্তে, একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভের জন্য এটা হ’ল একটা নির্দিষ্ট পরিণামনা (উৎসর্গ) সহ আমাদের উদ্দেশ্য এবং ইতিবাচক শক্তির একটা অত্যন্ত দৃঢ় নির্দেশনা।

পরিণামনাটি (উৎসর্গ) নির্দিষ্ট হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। গদেন মঠে একটা সিংহাসন ছিল, যেটা গেলুগ পরম্পরার প্রধানের একটা খুব উঁচু আসন নামে পরিচিত। তিব্বতে, মঠটিতে সবসময় পশু থাকত। একদিন একটা গরু মন্দিরে ঢুকে সিংহাসনের উপর শুয়েছিল। এই দেখে ভিক্ষুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা সেখানে উপস্থিত একজন মহান শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেন, “এর কারণ কী?” উত্তরে শিক্ষক মহাশয় বললেন, “পূর্বে এক জীবনকালে এই প্রাণীটা গদেন সিংহাসনে বসতে সক্ষম হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নির্দিষ্ট ছিল না।”

অবসরের আটটি পরিস্থিতি থেকে অবকাশ

একটা মূল্যবান মানবজন্মের স্বভাবটা হ’ল এটা আটটি অবকাশকে উপভোগ করে। তার অর্থ হ’ল, এই মুহুর্তের জন্য, এটা অনবসরের আটটি অস্থায়ী পরিস্থিতি থেকে মুক্ত। একটি অনবসরের অবস্থা বলতে যেখানে ধর্ম পালন করার কোনও সুযোগ নেই, তাকে বোঝায়।

অনবসরের চারটি অমানুষিক অবস্থা আছেঃ

  • আনন্দহীন প্রদেশে একটা আটকে থাকা প্রাণী (নারকীয় সত্তা)- আমরা যদি একটা আনন্দহীন নরকের পুনর্জন্ম লাভ করি তাহলে সেখানে অনুশীলন করার কোনও সুযোগ থাকবে না, কারণ আমাদের শরীর সারাক্ষণ আগুনে আসীন থাকবে।
  • দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে থাকা ভূত (প্রেত)- আমরা যদি ভূত রূপে পুনর্জন্ম লাভ করি তাহলে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষুধার্ত থাকব এবং আহারের চিন্তায় মগ্ন থাকব।

আমরা যদি সকালে উঠে সকালের খাবার না পাই তাহলে আমরা ধর্ম পালন করতে রাজি হই না। আমরা যদি মাথা ব্যথার সাথে উঠি তাহলেও আমরা ধর্ম অনুশীলন করতে আগ্রহ দেখাই না। সুতরাং আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি যে, আমরা যদি প্রেত রূপে জন্ম নিই এবং ষাট বছর ধরে অনাহারে জীবনযাপন করি, তাহলে আমরা কোনভাবেই ধর্ম পালনে আগ্রহী হব না। সুতরাং আমরা যে কত ভাগ্যবান তার প্রশংসা করতে হবে যে, আমাদের একটা আনন্দবিহীন নারকীয় লোকে আটকে থাকা নির্যাতিত প্রাণী অথবা সর্বদা আহারের জন্য আঁকড়ে থাকা প্রেতরূপে পুনর্জন্ম লাভ করতে হয়নি।

  • বুকে হেঁটে চলা প্রাণী (পশু)- এমনকি আমরা যদি পরম পূজ্য দালাই লামার কুকুর রূপেও জন্মগ্রহণ করি, তাহলেও কিন্তু শরণগমনের প্রার্থনাটা পাঠ করতে পারব না। আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, আমরা সে রকম হইনি।
  • একটা দিব্য সত্তা (দীর্ঘজীবী দেবতা)- স্বর্গে বসবাসকারী দেবতাদের এত পার্থিব সুখ আছে, যার কারণে তারা ধর্ম পালনে আগ্রহ দেখায় না।

শারিপুত্রের একজন শিষ্য ছিল। সে “গুরু-ভক্তি” দ্বারা নিজেকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছিল। মৃত্যুর পর ঐ শিষ্যটি স্বর্গে জন্মগ্রহণ করেছিল। শারিপুত্র তাঁর দিব্য দৃষ্টি প্রয়োগ ক’রে দেখতে পেলেন যে, তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্য সেই লোকে জন্ম নিয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি স্বর্গে গিয়ে তাকে দেখতে যাবেন। তদনুসারে শারিপুত্র যখন স্বর্গে গেলেন তখন তাঁর ঐ শিষ্য তাঁকে “হাই!” বলে সম্বোধন করেছিল। যেহেতু ঐ সময় তার সময়টা এত ভাল কাটছিল যে, সে তার গুরুর প্রতি বা ধর্ম পালনে আগ্রহী ছিল না।

এটা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করতে পারি। যদি কেউ খুব গরিব হয় তাহলে সে ধর্ম পালন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু সে যদি ধনী হয়ে ওঠে এবং খুব স্বাচ্ছন্দবোধ করে তাহলে সে তাতে আর আগ্রহ দেখায় না। সুতরাং আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, আমরা দীর্ঘজীবী দেবতা রূপে জন্ম নিইনি।

মনুষ্য অবস্থায় চারটি অনবসর আছে। পুনর্জন্ম হওয়াঃ

  • যেখানে বুদ্ধের বাণী অনুপস্থিত- উদাহরণস্বরূপ, এমন দেশে বা এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করা মানুষ আছে যেখানে বা যখন তারা ধর্মের একটা শব্দও শুনতে পায় না। আমরা সেই পরিস্থিতিতে নেই।
  • বর্বর সমাজে- এমন স্থান যেখানকার মানুষ যার প্রতি আগ্রহী সেটা হল খাদ্য এবং বস্ত্র প্রবন্ধ করা।

তিব্বতে চরি নামক একটা পর্বত আছে। তিব্বতীরা প্রতি বারো বছর অন্তর সেখানে যায়। সেখানে বসবাসকারী লোবা উপজাতিটি অত্যন্ত বর্বর। তাদের দেশে যেতে হলে প্রত্যেককে কর দিতে হতো। যে কর নির্ধারণ করা ছিল সেটা হল একটি ইয়াক (চমরী গাই)। লোবারা যখন ইয়াকটি পেয়ে যেত তারা সঙ্গে-সঙ্গে সেটাকে হত্যা ক’রে খেয়ে নিত এবং তার রক্ত পান করে নিত। সুতরাং আমরা ভাগ্যবান যে, আমাদের ঐরকম স্থানে জন্ম হয়নি, কমপক্ষে মনুষ্য রূপে।

  • অধিকতর বিকলাঙ্গ রূপে- আমরা যদি অন্ধ, বধির বা বোবা হয়ে জন্মগ্রহণ করি বা শারীরিক, মানসিক অথবা সামাজিক ভাবে প্রতিবন্ধী হই, তাহলে অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে গম্ভীর ভাবে বাধা-বিঘ্ন ঘটতে পারে।
  • আধ্যাত্মিক বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন ক্ষেত্রে পুনর্জন্ম হওয়া- এমন স্থান যেখানকার মানুষ মনে করে যে, আধ্যাত্মিক অনুশীলন, বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মটা হ’ল সময় নষ্ট করা একটা নীরস জিনিস এবং যার জন্য সময় ব্যয় করা যোগ্য, সেটা হল অর্থ উপার্জনের জন্য।

আমাদের যদি এই অনাবসরের অবস্থাগুলি থেকে একটা মানবজন্ম থাকে এবং তদতিরিক্ত আমরা এটাকে প্রাপ্ত করার কারণগুলি জানি, তাহলে আমরা দ্বিগুণ ভাগ্যবান হয়ে যাই। অনেকেই এই ধরণের মূল্যবান মানব জীবন ধারণ করা সত্ত্বেও বোঝে না যে, এই ধরণের পুনর্জন্ম অব্যাহত ভাবে প্রাপ্ত করার কারণ কী।

উপমা

মূল্যবান মানব শরীর প্রাপ্ত করতে যে সমস্ত অসুবিধাগুলি আছে সেগুলি উপলব্ধি করতে আমরা সহায়তার জন্য উপমা ব্যবহার করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, এটা বালির দানার মতো দুর্লভ বা বিরল যা আয়নায় নিক্ষেপ করার সময় তাতে লেগে থাকে।

আমরা যদি এই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, আমরা উপলব্ধি করব যে, আমাদের বর্তমান মানবজন্মটা কত মূল্যবান কৃতিত্ব এবং আমাদের ভাবা উচিত যে, আমরা কেবল একবারই এটা প্রাপ্ত করতে পেরেছি। ভারতবর্ষের কয়েক মিলিয়ন লোকের কথা ভাবুন যাদের মধ্যে কত কম লোক ধর্ম পালন করছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এটা কত বিরল!

একবার একজন লামা একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করা যে কি কঠিন সেই বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছিলেন। শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত একজন মঙ্গোলীয় বলেছিলেন, “আপনি যদি মনে করেন যে, মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করা খুবই কঠিন, তাহলে আপনাকে চীনে গিয়ে দেখে আসা উচিত যে, সেখানে কত মানুষ রয়েছে!” এটা আমাকে বলার মতো হবে, আমাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাওয়া উচিত। ধ্যান সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য এগুলি ভাল বিষয়।

আমাদের মূল্যবান মানব দেহের সদ্ব্যবহার করা এবং সার্থক জীবনযাপন করা

আমরা যদি ভাবি, এই মূল্যবান মানব দেহটা প্রাপ্ত করার জন্য আমরা পূর্ব জন্মে কতটা পরিশ্রম করেছি, তাহলে এই জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য আমরা আমাদের আকাঙ্খার প্রতি অত্যন্ত উৎসাহী হব। একটা উদাহরণ হ’ল- আপনি একটি বোঝা একটা পর্বতের অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন এবং তারপর সেটাকে ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে দেওয়ার পর কিন্তু এটা নিজের মতো নীচেই নামতে থাকবে, উপরে আর যাবে না। ঠিক তেমনই, আমরা এই জীবনে একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করার জন্য যে কর্ম করেছি সেটা হ’ল পর্বতের অর্ধেক পথ পর্যন্ত বোঝা বহন করার মতো। এরপর আমরা যদি এটা ছেড়ে দিই, তাহলে সমস্ত কর্ম ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সুতরাং, যেহেতু এখন আমাদের একটা মূল্যবান মানব দেহ আছে, ভবিষ্যতে আরও একটার জন্য শুধু কামনা করলে হবে না। আমাদের এখন যেমন আছে, আমাদেরকে বুদ্ধের সম্বুদ্ধত্বের অবস্থা প্রাপ্ত করার জন্য এটাকে এখনই ব্যবহার করা উচিত। আমরা যদি সেটা না করি, তাহলে এটা ঐরকম হবে যে, এক বস্তা চাল থাকা সত্ত্বেও সেটাকে উপভোগ না ক’রে তার উপর শুধু বসে থাকা। আর পরবর্তী জন্মে আরও একটা বস্তা প্রাপ্ত করার জন্য কামনা করা। সুতরাং আমাদের এখনই মানবজন্মের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা উচিত।

মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক হওয়া

মৃত্যু নিশ্চিত

আমরা যদি বিবেচনা করি যে, আমাদের কাছে কী ধরণের মূল্যবান মানব দেহ আছে, তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এটা কোনও শীলা বা ধাতু দিয়ে তৈরী নয়। যদি এরকম হতো তাহলে এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত। আসলে, আমরা যদি আমাদের ভিতরে কী আছে সেটা দেখার জন্য যদি আমাদের দেহ কেটে ফেলি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, এতে অনেক রক্ত এবং নাড়িভুঁড়ি আছে, যেমন- কোনও বাজারে মাংস কেনার পর প্রাণীদের নাড়িভুঁড়ি তাদের ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয় সেইরকম নাড়িভুঁড়ি। আমাদের শরীরের ভেতরের অংশ একটা ঘড়ির ভেতরের অংশের মতো কোমল।

আমরা যদি মৃত্যু সম্পর্কে এবং কত মানুষ মারা গেছে সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে জপমালার প্রত্যেকটি গুটিকা গণনা করতে-করতে অনেক মালার মধ্য দিয়ে যেতে পারব। আমি যদি ভাবি, আমি ধর্মশালায় আসার পর কত লোক মারা গেছে, তাহলে আমি খুব দ্রুত আমার পুরো জপমালাটি শেষ করে ফেলব।

মানব দেহ প্রাপ্ত ক’রে মারা যায়নি এমন কেউ নেই এবং আপনি যদি মনে করেন উদ্ভিদ এবং গাছ কীভাবে মারা যায়, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, মৃত্যুর আগে সেটা শুধু সময়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জন্ম নেওয়ার প্রাকৃতিক নিষ্কর্ষটি হ’ল মৃত্যু হওয়া। এই বিষয়ে কেউ কিছু করতে পারে না। আমাদের এখানে যোগ হওয়ার শেষটা হ’ল বিয়োগ হওয়া, আর উপরে যাওয়ার চূড়ান্ত উপসংহারটি হ’ল নীচে নেমে আসা। আমাদের মৃত্যুকে বরণ করা ছাড়া কোনও গতি নেই, এই সত্যটা বুঝতে পেরে মৃত্যু আগে যতটা সম্ভব ধর্ম পালন করার চেষ্টা করা উচিত।

তাই আমরা কীভাবে মরে যাব সে সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করা উচিত। ভাবুন, আপনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং আপনার মাংস একটা ভয়াবহ রঙে পরিণত হয়ে গেছে, আর আপনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আপনার সকল আত্মীয়-স্বজন কাঁদছে এবং বলছে যে, এটা কত ভয়াবহ! ডাক্তার এসে আপনাকে ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু তিনি তাঁর জিভ টিক-টিক ক’রে বলছেন যে, পরিস্থিতি খুব খারাপ।

আমরা যে কোনও সময় মরে যেতে পারি

এছাড়াও, আপনি কখন মারা যাবেন সে বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। পাকা চুল যুক্ত বৃদ্ধ মাতা-পিতাদের তাদের আগে তাদের সন্তানদেরকে সমাহিত করতে দেখা যায়। অনেকে সাধারণ খাবার খেয়েও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি তিব্বতের দিক থেকে এই উদাহরণটি বিবেচনা করতে পারেন। এক ব্যক্তি কয়েকটি বড় মাংসের টুকরো একপাশে রেখে বললেন যে, সে সকালে সেগুলি খাবে, কিন্তু মাংসের টুকরোগুলি তার চেয়ে বেশী দিন স্থায়ী ছিল। আরও একটা উদাহরণঃ আমি শিমলার একজন আলুচাষীকে জানতাম যে তার মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য লুচি ভাজছিল কিন্তু লুচিটা ভাজার সময় সে মারা গিয়েছিল।

অনিত্যতা এবং মৃত্যুর প্রশংসা লাভ করার সর্বোত্তম উপায় হ’ল সেগুলির সম্পর্কে শুধু গ্রন্থ পড়লে হবে না, বরং যারা মারা গেছে তাদের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে।

মৃত্যুর সময় শুধু ধর্মই আমাদের সহায়তা করতে পারে

মৃত্যুর উপর ধ্যান করার গুরুত্বটা কী? এটা দেখায় যে, শুধু ধর্ম পালন করাটাই হ’ল একমাত্র সার্থক কাজ।

আমরা যদি বস্তুগত জিনিসগুলির সম্পর্কে বিবেচনা করি তাহলে আপনি দেখবেন যে, আমরা আমাদের সাথে কিছুই নিয়ে যেতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একজন ধনী ব্যবসায়ী হন এবং আপনি অনেক টাকা-পয়সা উপার্জন করেন, সে ক্ষেত্রে খুব বেশী হলে আপনি একটা মূল্যবান বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারবেন যা দিয়ে শব দাহ করার সময় আপনার দেহটাকে জড়িয়ে নেওয়া যাবে। ঐ ব্যবসায়ীটা উক্ত ধন-সম্পত্তি উপার্জন করার জন্য যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক কর্ম সঞ্চয় করেছে, যেমন- সে দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করেছে, তার পরিমাণ প্রচুর হতে পারে।

আপনার যদি অনেক সেবক বা কর্মী থাকে অথবা আপনি যদি ১,০০,০০০ সৈনিকদের আদেশ করা একজন সেনা প্রধান হন, তাহলেও আপনি যখন মারা যাবেন কেউ আপনার সাথে যেতে পারবে না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনে ভরা একটা দেশও আপনার সহায়তা করতে পারে না। তারা যা করতে পারে সেটা হ’ল আপনি মরে গেলে শুধু আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে, আপনাকে বিরক্ত করবে এবং আপনার শান্তিপূর্ণ মৃত্যু ও পুনর্জন্মে বাধা সৃষ্টি করবে।

মৃত্যুর সময় যে একমাত্র জিনিস সহায়তা করতে পারে সেটা হ’ল ধর্ম পালন। আপনি যদি গঠনমূলক কর্ম করে যথেষ্ট পরিমাণে ইতিবাচক (কুশল) কর্মশক্তি সঞ্চয় করে থাকেন তাহলে এটা আপনার ভবিষ্যতের পুনর্জন্মকে অনেক উপকার করতে পারে, তবে নেতিবাচক কর্মশক্তি তাদের আরও খারাপ করে দেবে। এটা এমন কিছু যা আপনি মৃত্যুর বিষয়ে চিন্তাভাবনা না করে বুঝতে পারেন। তিব্বতে অনেক ধনী তিব্বতী ছিল কিন্তু তাদেরকে শুধু তাদের জ্ঞান এবং আভ্যন্তরীণ গুণ যা কিছু তাদের কাছে সেই সময় ছিল সে সবের সাথে চলে আসতে হয়েছিল। সুতরাং আমাদেরকে আমাদের নিজের জীবনকালে বিশুদ্ধ ভাবে ধর্ম পালন করা উচিত আর পার্থিব কর্মকান্ডে সময় নষ্ট করা উচিত নয়।

আমাদের জীবনের সমস্ত পার্থিব ক্রিয়াকলাপকে গমের তুষের মতো তুচ্ছ বিবেচনা করা উচিত। বাস্তবে পার্থিব ক্রিয়াকলাপে কোন সার নেই; পার্থিব ক্রিয়াকলাপকে আমাদের শিশুদের দ্বারা তৈরী বালির দুর্গের মতো ভাবা উচিত। যেমন- শিশুরা বালির দুর্গের সাথে খেলা শেষ হয়ে গেলে সেটাকে সেখানে ফেলে চলে যায়, ঠিক তেমনই আমাদের পার্থিব ক্রিয়াকলাপকে বিবেচনা করা উচিত। আপনারা যদি এই সমস্ত বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে এটা আপনাদের ধর্ম পালনে ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে।

প্রেরণার দুটি উদ্দেশ্য

প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য

আমরা যদি সমস্ত পার্থিব ক্রিয়াকলাপগুলিকে অপ্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বহীন মনে করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, ধর্ম পালন হল একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, এই ধরণের মনোভাব বিকাশ করার জন্যঃ “এখন আমি একটা মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করেছি; আমি এটা অনাগত জীবনে আরও খারাপ লোকে (দুর্গতিতে) পতিত না হওয়ার জন্য এটা ব্যবহার করতে যাচ্ছি”, এটা হল আমাদের মূল্যবান জীবনের সুযোগ গ্রহণের সর্বনিম্ন স্তর।

তিনটি খারাপ লোকে পতিত হওয়া থেকে যা আমাদের প্রতিরোধ করবে সেটা হল কঠোর নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলার পালন। কিন্তু আমরা যদি নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা পালন করার জন্য খুব দৃঢ় ইচ্ছার বিকাশ করি তাহলেও সেটা ধীরে-ধীরে হ্রাস হতে থাকে। সুতরাং নিজেদেরকে আরও খারাপ লোকে পতিত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের অশান্ত আবেগ থেকে মুক্ত হতে হবে। এটা হল একটা অত্যন্ত মলিন বস্ত্রের টুকরো ধুয়ে ফেলার মতো অর্থাৎ আপনি প্রথমে সামান্য শক্তি ব্যবহার করুন এবং তারপর আপনি ধীরে ধীরে আপনার শক্তি বৃদ্ধি করুন। নিজেকে অশান্ত আবেগ থেকে মুক্ত করার জন্য আপনাকে ধীরে এবং মৃদু ভাবে শুরু করতে হবে এবং তারপর ধীরে-ধীরে নিজেকে পুরো শক্তির প্রচেষ্টা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আপনাকে এটাকে ধীরে-ধীরে প্রয়োগ করতে হবে এবং তারপরে ধীরে-ধীরে সেটাকে প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি নিজেকে অশান্ত আবেগ থেকে মুক্ত করতে পারবেন, অন্যথা আপনার প্রচেষ্টা অতি সহজেই হ্রাস হয়ে যেতে পারে।

আপনি যদি তিনটি খারাপ লোকে পুনর্জন্ম হওয়াকে ত্যাগ করতে চান তাহলে আপনি নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা অনুসরণ করুন। এটি হল ধর্মের অনুশীলনের সর্বনিম্ন স্তর।

মধ্যবর্তী লক্ষ্য

এমনকি আমরা যদি তিনটি দুর্গতিতে বা অপায় যোনিতে জন্ম নেওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পরবর্তী জীবনে সুখ এবং আনন্দে পরিপূর্ণ দেব যোনিতে (স্বর্গ) জন্ম নিই অথবা এমনকি মানুষ রূপেও যদি জন্ম নিই, তাহলেও আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে সমস্ত সাংসারিক পুনর্জন্ম দুঃখময়। মার্গক্রমের শিক্ষাগুলিতে এই বিষয়টি ব্যাপক ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে এটাকে এই উদাহরণ দিয়ে বর্ণনা করা যেতে পারেঃ ধরুণ আপনি রোদে দাঁড়িয়ে আছেন এবং রোদের তাপটা অত্যন্ত গরম। এর থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আপনি ভিতরে যেতে পারেন। ভিতরে গেলে আপনি গরমের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন। তাসত্ত্বেও তখন কিন্তু আবার শীতের দুঃখ-কষ্ট থেকে যায়। এমন কোনও সাংসারিক পরিস্থিতি নেই যেখানে আমরা দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে থাকতে পারি।

অশান্ত আবেগগুলি আমাদের সংসারে চক্কর কাটতে, অনিয়ন্ত্রিত পুনর্জন্ম নিতে বাধ্য করে। একটা গাছের গোড়ার মতো এর মূলটা হ’ল স্বতন্ত্র সত্যগ্রহ। আমাদের সংসারের চারিদিকে চক্কর কাটাটা হ’ল একটা দোলনার মতো যার কোথাও শেষ নেই। এর থেকে নেমে আসার একমাত্র উপায় হ’ল নিজেকে উন্নীত করা বা নিজেকে এর থেকে উঁচুতে তোলা। এটা করার জন্য আমাদের আর্য পুরুষ, একজন উচ্চ উপলব্ধিযোগ্য সত্তা হতে হবে। আর্য বলতে এমন একজন কেউ যার কাছে নিঃস্বভাবতার অর্থ হচ্ছে একটা অসম্ভব “আত্মার” অভাব। এটাকেই শূন্যতার প্রভেদমূলক সচেতনতা বা শূন্যতার জ্ঞান বলা হয়।

আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে শূন্যতার এই উপলব্ধিটা বিকাশ করার জন্য শমথ প্রাপ্ত করা প্রয়োজন। শমথ হচ্ছে মনের একটা শান্ত এবং স্থির অবস্থা। এটাকে প্রাপ্ত করার জন্য আমাদের দরকার নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলার (শীল) পালন। সুতরাং তিনটি অধিশিক্ষা- অধিশীল, অধিসমাধি এবং অধিপ্রজ্ঞা- আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত সাংসারিক পুনর্জন্ম থেকে উন্নীত হতে অনুমতি প্রদান করে। আমরা যদি এগুলি অনুশীলন করি তাহলে আমরা সংসারে চক্কর কাটা বন্ধ করতে পারি।

সত্ত্বের তিনটি শ্রেণীবিন্যাস আছে যারা নিজেদের আর্য অবস্থায় উন্নীত করেছেঃ

  • যাঁরা দর্শন মার্গের মন (দর্শনমার্গ) প্রাপ্ত করেছেন।
  • যাঁরা ভাবনা মার্গের মন (ভাবনামার্গ) প্রাপ্ত করেছেন।
  • যাঁরা অশৈক্ষ্যমার্গ প্রাপ্ত করেছেন।

যে সকল সত্ত্ব নতুনভাবে দর্শনমার্গের মন প্রাপ্ত করেছেন তাঁরা হলেন শূন্যতার নির্বিকল্পিত প্রত্যক্ষ জ্ঞানধারক। যাঁরা ভাবনামার্গের মন বিকাশ করেছেন তাঁরা আরও ধ্যান সাধনা করেন এবং শূন্যতার নির্বিকল্পিত জ্ঞানের অভ্যাস গড়ে তোলেন অথবা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যান। আপনি যদি ধ্যান সাধনা করে থাকেন এবং আপনার মনকে এই শূন্যতার জ্ঞানে সম্পূর্ণরূপে অভ্যস্ত করে ফেলেন আর মুক্তিকে প্রতিরোধ করা অবেগপ্রবণ আবরণ থেকে আপনার মনকে চিরতরে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে তোলেন তাহলে আপনি হলেন একজন অর্হত্‌, একজন মুক্ত সত্ত্ব।

অনুপ্রেরণার উন্নীত লক্ষ্য

মৈত্রী এবং করুণা

তবে একাকী নিজেকে মুক্ত করাটা যথেষ্ট নয়, কারণ সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্ব একই দুঃখে আবদ্ধ আছে। সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্ব একই রকম যে, তারা সকলেই দুঃখ ভোগ করছে এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা পোষণ করে। আমরা এমন মনের বা ভাবনার বিকাশ করি যা কামনা করে যে, সমস্ত সত্ত্ব যেন দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হয়ে যায়, একে বলা হয় ‘করুণা।’ তবে সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্বকে দুঃখ থেকে মুক্ত করার জন্য এই কামনাটি বিকাশ করতে আপনাকে দীর্ঘকাল ধরে দুঃখের উপর ভাবনা করতে হবে। তারপরে, এটা যে কত ভয়াবহ তা বুঝতে পেরে আপনি ‘পরিত্যাগ’ অর্থাৎ মুক্ত হওয়ার সংকল্পটি বিকাশ করতে পারবেন। দুঃখ যে কতটা ভয়াবহ, একবার যদি আপনি এই ধারণাটি বিকাশ করে ফেলেন এবং স্বয়ং এখান থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছাটি জাগিয়ে ফেলেন, তখন আপনি এই ধারণাটিই সমস্ত সত্ত্বদের মধ্যে প্রয়োগ করতে পারবেন। এটাই করুণা।

সুতরাং, পরিত্যাগ (অভিনিষ্ক্রমণ) হচ্ছে নিজে দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা। অন্যদিকে, করুণা হচ্ছে সমস্ত সত্ত্ব দুঃখ থেকে মুক্ত থাকার ইচ্ছা। করুণা এবং মৈত্রীর মধ্যে পার্থক্য হ’ল- করুণার ক্ষেত্রে আমরা ভাবি, “কী চমৎকার না হবে যদি সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্ব সুখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হয়ে যায়”, অন্যদিকে মৈত্রী হ’ল- সমস্ত সত্ত্ব সুখ এবং সুখের কারণে সমৃদ্ধ হওয়ার কামনা।

কীভাবে সমতা এবং বোধিচিত্ত বিকাশ করা যায়

আমাদের মধ্যে মৈত্রী এবং করুণা না থাকার কারণ কী? আমরা কেন কামনা করি না যে, সকলে যেন দুঃখ থেকে মুক্ত হোক এবং সুখে সমৃদ্ধ হোক? এর কারণ হচ্ছে আমাদের মন বা চিত্ত স্নিগ্ধ বা স্বাচ্ছন্দ নয়, বরং রুক্ষ; এটার উঁচু এবং নীচু পয়েন্ট আছে। আমাদের চিত্তের অসমতাটা কী? এটা হ’ল, আমাদের চিত্তে আমাদের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের প্রতি অত্যাধিক আসক্তি আছে। তাই, আমরা যখন আমাদের শত্রু বা অপছন্দের লোকজনদের দেখি আমাদের মধ্যে অত্যধিক বিদ্বেষের জন্ম হয়।

সুতরাং, আমরা কীভাবে একটা খাত রাস্তা সমান বানাব? আমরা এই উদাহরণটিকে অবলোকন ক’রে বুঝতে পারিঃ একটা লোক গতকাল আপনাকে একশত টাকা দিয়েছিল এবং অন্য একটা লোক আজ আপনাকে একশত টাকা দিয়েছে। যে লোকটি আপনাকে গতকাল একশত টাকা দিয়েছিল সে আজ আপনার মুখে এক ঘুষি মারল আর যে লোকটি আজ আপনাকে একশত টাকা দিয়েছে সে গতকাল আপনার মুখে এক ঘুষি মেরেছিল। আপনার কাকে পছন্দ করা উচিত এবং কাকে অপছন্দ করা উচিত?

সুতরাং, এরই মতো আমাদের ভাবতে হবে যে, কীভাবে আমাদের শত্রুরা অতীতে আমাদের অনেক উপকার করেছিল এবং ভবিষ্যতেও উপকার করতে পারে। তেমনই আমাদের বন্ধুরা অতীতে আমাদের প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি করেছিল এবং ভবিষ্যতে আবার সেটা করবে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।

আরও একটা উদাহরণঃ বিভিন্ন মানুষ আছে যারা হ’ল নরখাদক অথবা এমনকি নেকড়ে বাঘে পরিণত মানুষ বা পিশাচ। আমরা তাদের আকর্ষণীয় মনে ক’রে কোনও একজনের সাথে বিবাহ করতে পারি। কিন্তু একদিন রাতে তার লম্বা তীক্ষ্ণ দাঁত বেরিয়ে আসলো এবং সে আমাকে খেয়ে ফেলল।

আপনি যখন একটা কুকুরকে আঘাত করেন, সেটা তখন ঘেউ-ঘেউ করে আর আপনাকে কামড়ে দেয়। সুতরাং, আমরা যদি কোনও শত্রুর উপর ক্রোধিত হই, আমরা কুকুরের মতোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। আমাদেরকে মনের এই অসমতা, এই আসক্তি এবং বিকর্ষণ দূর করতে হবে, পরিবর্তে মনের সমতা লাভ করতে হবে। এই সমতা অবস্থার শীর্ষে, আমরা মৈত্রী এবং করুণা বিকাশ করতে পারি, যেমন আপনাকে আপনার গাড়ির যাতায়াতের জন্য একটা খাত রাস্তা নির্মাণ করতে হবে।

আমাদের মধ্যে ডাইনামাইটের মতো শক্তিশালী চিন্তাভাবনা জাগাতে হবে যা একটা রাস্তাকে বিস্ফোরণ করে সমান করে দেয়। কী ধরণের চিন্তাভাবনা? অন্যান্য সীমাবদ্ধ সত্ত্বদের জন্য দয়া করার চিন্তাভাবনা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দুধ পান করি। দুধটা আসে গরু এবং জল মহিষ থেকে। এরা বাইরে গিয়ে ঘাস খায় এবং জল পান করে আর আমরা যা করি সেটা হল তাদের কাছ থেকে দুধটা প্রাপ্ত করি। খরগোশ এবং ইঁদুর চিকিৎসাগত পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাই আমরা যে ওষুধ সেবন করি সেটা ইঁদুর এবং খরগোশের জীবনের মূল্যে সম্ভব হয় যার জন্যে তারা তাদের প্রাণ দেয়।

কিছু সীমাবদ্ধ সত্ত্ব আছে যাদেরকে আমরা আমাদের শত্রুরূপে বিবেচনা করি এবং যারা আমাদের ক্ষতি করে। কিন্তু আমরা যদি ঐ ক্ষতিটা, যা তারা করেছে, তার সাথে তাদের দয়ার তুলনা করি তাহলে পরেরটি পূর্ববর্তীটির চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়। বাস্তবে তারা আমাদের যে ক্ষতি করে সেটা আসলে আমাদের জন্য খুব সহায়ক হতে পারে। বুদ্ধ হওয়ার জন্য আমাদের ধৈর্যের বিকাশ করা প্রয়োজন এবং এর জন্য আমাদের জঘন্য বা অত্যাচারী লোকের প্রয়োজন হয়। যদি সবাই সুন্দর হতো, ভালো হতো তাহলে আমরা ধৈর্যের বিকাশ করতে পারতাম না। যারা আমাদের উপর ক্রোধিত হয় তারা হল সীমাবদ্ধ প্রাণী, বুদ্ধ নয়। সুতরাং তারাই আমাদের ধৈর্য ধরা শেখায়। উদাহরণস্বরূপ, অতীশ যখন তিব্বতে গিয়েছিলেন তিনি তাঁর সাথে একজন দুর্দান্ত ভারতীয়কে নিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি তার ধৈর্যের পরীক্ষা করেছিলেন। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল তিনি তাকে কেন সঙ্গে নিয়ে গেছেন, উত্তরে তিনি বলেছিলেন তার ধৈর্যের অনুশীলন করার জন্য। সুতরাং সীমাবদ্ধ সত্ত্ব এবং বুদ্ধগণ আমাদের প্রতি তাদের দয়ার ক্ষেত্রে সবাই সমান। এটা শান্তিদেব রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ নামক গ্রন্থে প্রমাণ করা হয়েছে।

বুদ্ধ ক্রোধিত না হওয়ার একটা কারণ আছে এবং সেটা হ’ল তার মধ্যে একাগ্র চিত্ত আছে এবং অশান্ত আবেগ মুক্ত সমাহিত ধ্যান আছে। যেহেতু বুদ্ধের মধ্যে এই একাগ্র চিত্তযুক্ত ধ্যান আছে তিনি ক্রোধিত হন না। সুতরাং এটা আমাদের বিকাশ করা উচিত। সকালে আমাদের দুটি ভাবনার সাথে জেগে উঠতে হবেঃ 

  • আজ আমি অন্যকে ক্রোধিত করার কারণ হব না।
  • আমি অন্যকে সুযোগ দেব না যাতে আমি ক্রোধিত হই।

আমরা যদি এর সাথে অভ্যস্থ হয়ে উঠি তাহলে আমরা আমাদের অশান্ত আবেগ কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়ে উঠব এবং অবশেষে চিরকালের জন্য অশান্ত আবেগমুক্ত অবস্থা বিকাশ করতে সক্ষম হয়ে উঠব। এইভাবে আমরা বুদ্ধ হয়ে যাব। আমরা যদি জিজ্ঞাসা করি যে, বুদ্ধদের সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা কী করতে পারি, এটা হবে সীমাবদ্ধ সত্ত্বাদের সহায়তা করা এবং সদয় হওয়া। এটাই সত্যিই বুদ্ধদের সন্তুষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারও পিতা-মাতা থাকে এবং তাদের সন্তান থাকে তাহলে আমরা পিতা-মাতার প্রতি সদয় হওয়ার চেয়ে সন্তানদের প্রতি দয়াবান হওয়ার মাধ্যমে ঐ পিতা-মাতাকে আরও সুখী করে তুলতে পারি। একইভাবে বুদ্ধ সুখী হন, যদি আমরা সীমাবদ্ধ প্রাণীদের পাশাপাশি বুদ্ধের প্রতিও সদয় হই। অতএব এই সমস্ত কিছুর ভিত্তিতে আমাদের বোধিচিত্ত বিকাশের চেষ্টা করা দরকার অর্থাৎ সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্বের কল্যাণের জন্য আমি বুদ্ধ অবস্থা লাভ করতে চলেছি।

এই জন্মে বোধিলাভ করা

এর চেয়েও বড় কথা এই জীবদ্দশায়, এই মুহুর্তে সমস্ত সীমাবদ্ধ সত্ত্বের কল্যাণের জন্য আমাদের বুদ্ধ অবস্থা লাভ করার জন্য খুব দৃঢ় সংকল্প থাকা দরকার। বুদ্ধ বলেছেন যে, এই জীবদ্দশায় বোধিলাভ করার একটা উপায় আছে। সেই উপায়টা কী? এটা হল তান্ত্রিক পথের মাধ্যমে। আপনি যদি এটা অনুসরণ করেন তাহলে এই জীবদ্দশায় আপনার পক্ষে বুদ্ধত্ব লাভ করা সম্ভব।

যদিও আমাদের মধ্যে এই জীবদ্দশায় বুদ্ধত্ব লাভ করার খুব দৃঢ় সংকল্প আছে, তাহলেও এটাকে সহজ বলে মনে করা উচিত নয়। এর কারণ হল আমরা অনাদিকাল থেকে প্রচুর পরিমাণে ধ্বংসাত্মক কর্ম সঞ্চয় করে রেখেছি। তন্ত্রটা দ্রুত হতে পারে তবে এটা অত্যন্ত কঠিন পথ। আমাদের ভাবা উচিত নয় যে, তান্ত্রিক পথের সাধনা করা বিমানে ভ্রমণের মতো দ্রুত। এটা ততটা সহজ নয়। উদাহরণস্বরূপ, জেচুন মিলারেপাকে তার গুরু মারপার নির্দেশে অনেক ভোগান্তির মধ্য দিয়ে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল, যেমন- গৃহ নির্মাণ করা, মারধোর খাওয়া ইত্যাদি। এই কারণেই তিনি সেই জীবদ্দশায় জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলেন। মিলারেপা যে কষ্ট ভোগ করেছিলেন আমরা তার একটা অংশও ভোগ করতে আগ্রহী নই।

যদি আমাদের এই জীবদ্দশায় বুদ্ধত্ব লাভ করার দৃঢ় সংকল্প থাকে এবং আমরা অত্যন্ত কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকি তাহলে এমন সুযোগের সম্ভাবনা রয়েছে যে, আমরা যদি অটলভাবে অনুশীলন করতে পারি আমরা সত্যিই বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারি।

সারাংশ

একটা মূল্যবান মানব দেহের সাথে জন্মগ্রহণ করার পর আমাদের এটাকে ধর্মপালন, আরও ভাল পুনর্জন্ম গ্রহণ, মুক্তি লাভ এবং বুদ্ধত্ব লাভ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে। এর জন্য আমাদের একটা ক্রমবদ্ধ পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত দশটি ধ্বংসাত্মক কর্ম ত্যাগ করা, অশান্ত আবেগ থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং সংসার থেকে মুক্ত হওয়ার সংকল্প ও বোধিচিত্তের বিকাশের জন্য একাগ্র সমাধি আর শূন্যতার নির্বিকল্পিত উপলব্ধি লাভ করা।

Top