অহিংসা এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ

আজ আমাকে আধুনিক বিশ্বে অহিংসা এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বলতে বলা হয়েছে। এগুলি এমন একটি বিষয় যা আপনাদের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। যতদূর আমি জানি, আপনারা সবাই চিকিৎসা ও শিক্ষকতা পেশায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আপনাদের কাজের অংশ হিসাবে অন্যদের সাহায্য করার জন্য অবশ্যই আপনাদের পক্ষ থেকে অহিংসক পদ্ধতিতে সাহায্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা স্পষ্ট যে, সাহায্য করা হল হিংসার বিপরীত। আর নিজের মধ্যে কিছু আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে বিকাশ করলে সেটা নিজের কাজকে আরও অর্থপূর্ণ করতে সাহায্য করে। এটি কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, বরং এরফলে আপনি ঐ সুযোগের গুরুত্বকে বুঝতে সাহায্য পান, যে সুযোগ আপনি আপনার অর্থপূর্ণ কাজের মাধ্যমে অন্যদের সাহায্য করার জন্য পেয়ে থাকেন।

বৌদ্ধধর্মে অহিংসার বিষয়ে ব্যাখ্যা করার অনেক কিছু আছে, যেমনকি সমস্ত ধর্ম ব্যাখ্যা করে। অবশ্যই ভিন্ন ব্যবস্থা অহিংসার অর্থকে আলাদা-আলাদা ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। প্রায়শই আমরা হিংসাকে একধরণের বিশেষ কর্ম, একটা হিংসাত্মক কর্ম মনে করি আর অহিংসা বলতে এই ধরণের আচরণ থেকে বিরত থাকাকে বোঝায়। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম এটাকে মনের দিক থেকে দেখে, এর সাথে যুক্ত আমাদের মনের অবস্থাকে বেশী দেখে। এর কারণ হল, আমরা বাস্তবে যেকোন প্রকারের হিংসাত্মক আচরণ করি বা না করি, এসবের মূলে তো থাকে কোন হিংসাত্মক মনের অবস্থা, তাই না? সুতরাং, কারও ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা সত্ত্বেও যদি আপনার মনে তার ক্ষতি করার জন্য তীব্র হিংসাত্মক ভাবনা থেকে যায়, তাহলে তো এটা অবশ্যই কোন কাজ করবে না। সেইজন্য মনের সেই হিংসাত্মক অবস্থাকে বোঝা এবং সেটাকে কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতিগুলি শেখা গুরুত্বপূর্ণ।

তিন প্রকারের হিংসা ও অহিংসা

বৌদ্ধ শিক্ষা অনুযায়ী, আমরা হিংসা, মনের হিংসাত্মক অবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করি। আর এখানে ‘হিংসা’ শব্দের অনুবাদ সম্ভবতঃ ‘ক্রূর হওয়া’ রূপে করা হয়। আমরা যখন হিংসাত্মক হওয়ার সম্পর্কে কথা বলি তখন এর তাৎপর্য বল প্রয়োগকারী এবং শক্তিশালী হওয়ার কথা বলি না, কারণ কখনও-কখনও কাউকে নিজের বা অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার জন্যও আমাদের বল প্রয়োগের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। যদি আপনার সন্তান রাস্তার দিকে ছুটে যায় আর গাড়ির ধাক্কায় সহজে তার মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আপনি তখন নিশ্চয়ই বলবেন না, “আমার সোনা, রাস্তায় দৌড়িও না।” হতে পারে তখন আপনাকে আপনার সন্তানকে জোর ক’রে ধরে রাখতে হবে। অতএব, আমার মতে হিংসা বলতে সেটা বোঝায় না। হিংসার অর্থ হ’ল ক্ষতি করার ইচ্ছা, আর আমরা বিভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে ক্ষতি করতে পারি। সুতরাং, বৌদ্ধধর্মে এই তিনটি ভাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও আমি বিশ্বাস করি যে, আমরা এর চেয়ে আরও বেশী চিন্তা-ভাবনা করতে পারি।

অন্যের প্রতি অহিংসা

প্রথম প্রকারের হিংসা হ’ল অন্যের সম্পর্কে হিংসাত্মক ভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। এটাকে করুণার তীব্র অভাব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যার কারণে আমরা অন্যের অনিষ্ট বা ক্ষতি করতে চাই। করুণার অর্থ হ’ল এই কামনা যে অন্যরা দুঃখ ও সমস্যা এবং সেগুলির কারণ থেকে যেন মুক্ত হয়। আর এখানে, অন্যরা যেন দুঃখ থেকে মুক্ত হয়, এই কামনা করার পরিবর্তে আমরা কামনা করি যে তারা যেন দুঃখ ভোগ করে; সমস্যায় জর্জরিত হয়, তাতে সেটা আমরা নিজেরা সৃষ্টি করি, অন্য কেউ সৃষ্টি করে অথবা সেটা প্রকৃতির নিয়মে ঘটুক না কেন। আর মনের সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য পেতে আমাদের ভাবতে হবে, এই দৃষ্টিতে যে সকলেই সমান, সকলেই সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখী হতে চায় না।

সুতরাং কেউ যখন আমাদের ক্ষতি করে, অথবা ধরুন, আপনি ক্লাসে পড়াচ্ছেন এবং একজন ছাত্র অন্য কারও ক্ষতি করছে বা তার মনোযোগ নষ্ট করছে, তখন সেই ছাত্রকে শাস্তি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে তাকে একজন অসুস্থ শিশুর মতো মনে করার চিন্তা-ভাবনা করাটা বেশি কার্যকর হয়। এর কারণ হল, ব্যক্তি ঐ ধরণের আচরণ সাধারণতঃ ক্রোধ, অধৈর্য, অস্থিরতা এবং মনের অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে করে। আসলে শিশুটি সুখী হতে চায় কিন্তু সে কীভাবে সুখী হবে সেই সম্পর্কে তার মধ্যে কোন স্পষ্ট বা সঠিক ধারণা থাকে না। সেই কারণে সে খুবই ক্ষতিকারক ভাবে, একটি বিভ্রান্তিকর মনের অবস্থার সাথে আচরণ করছে। সে ভাবছে যে এটা তাকে কোনভাবে সুখী ক’রে তুলবে। তাই ঐ শিশুটির প্রতি এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমরা শিশুটিকে খারাপ ব’লে বিবেচনা করি না, আর ভাবি না যে শিশুটিকে শাস্তি দিতে হবে। তার পরিবর্তে আমরা তার প্রতি করুণাভাব বিকাশ করি। আর কামনা করি যে, এই শিশুটি যেন তার বিভ্রান্তি এবং সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে যায়, যার কারণে সে ক্লাসে ক্ষতিকারক ভাবে আচরণ এবং দুষ্টুমি করছে।

এর অর্থ এই নয় যে আমরা কিছুই করব না, আর আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকব। অহিংসার অর্থ নিষ্ক্রিয় হয়ে কিছুই না করাকে বোঝায় না বরং এর অর্থ হল আমাদের ক্রোধিত না হওয়া, আর ঐ বিঘ্ন সৃষ্টিকারী শিশুটির ক্ষতি হওয়ার কামনা না করা। অতএব এটা স্পষ্ট যে আমাদের এমন কিছু করতে হবে যাতে শিশুটি তার ক্ষতিকর আচরণ বন্ধ করতে পারে আর এটাকে বন্ধ করার জন্য আপনার স্কুলের নিয়মে যে পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য সেটাকে গ্রহণ করতে হবে। তবে এর পিছনে যে অনুপ্রেরণা, এর পিছনে যে মনের অবস্থা থাকা প্রয়োজন, সেটা এই শিশুটিকে শাস্তি দিতে চাওয়ার চেয়ে অনেকটা আলাদা, কারণ শিশুটি দুষ্টু।

এই “অনুপ্রেরণা” শব্দটিকে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর দুটি দিক আছে। একটি হ’ল আমাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এবং অন্যটি হ’ল আবেগ যা আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রেরণা জোগায়। আমাদের উদ্দেশ্য হ’ল শিশুটিকে সাহায্য করা। এই জন্যই আমরা শিক্ষক হতে চলেছি। আপনি যদি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হতে যান, তাহলে সেখানেও একই জিনিস প্রযোজ্য অর্থাৎ আপনার লক্ষ্য হবে রোগীর সহায়তা করা। এখন মনের সেই অবস্থাটি কী, যা আমাদের সেই লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য প্রেরিত করে বা পরিচালনা করে? যদি মনের সেই অবস্থাটি কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য হয় অথবা আমরা যদি আশা করি যে অন্য ব্যক্তিরা আমাকে ধন্যবাদ জানাক বা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করুক, তাহলে সত্যিই এটা একটা খুবই স্বার্থপর উদ্দেশ্য, তাই না? আত্মকেন্দ্রিক! আর যেহেতু আমাদের চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুর বেশিরভাগ আমাদের নিজেদের উপর কেন্দ্রীভূত, সেইজন্য আমরা আমাদের পূর্ণ মনোযোগ এই বিষয়ের উপর দিই না যে, অন্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোনটা ভাল হবে। যেমন- একজন ডাক্তার কোন রোগীকে অস্ত্রোপ্রচারের জন্য পরামর্শ দেন, যেখানে প্রকৃতপক্ষে তার অস্ত্রোপ্রচারের কোন প্রয়োজনই হয় না, কিন্তু তিনি অস্ত্রোপ্রচারের জন্য পরামর্শ দেন যাতে সে অস্ত্রোপ্রচার ক’রে অর্থ উপার্জন করার সুযোগ পায়। এর পরিবর্তে, অন্য ব্যক্তিদের সহায়তা করার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের যা অনুপ্রাণিত করতে পারে সেটা হ’ল করুণা- অন্য ব্যক্তির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা, তার কল্যাণের কথা চিন্তা-ভাবনা করা যে, তার জন্য কোন্‌টি সবচেয়ে ভাল হবে।

একইভাবে কখনো-কখনো চিকিৎসা পেশায় কাউকে সহায়তা করার জন্য আমাদের এমন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয় যেটা বেশ বেদনাদায়ক হতে পারেঃ যেমন- ইনজেকশন্‌, অস্ত্রোপ্রচার, ইত্যাদি। (অস্ত্রোপ্রচার থেকে পুনরায় স্বাস্থ্য লাভ করা বেদনাদায়ক হয়) তবে এটা কোন হিংসাত্মক পদ্ধতি নয় কারণ এখানে উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে ব্যথা দেওয়া থাকে না, বরং উদ্দেশ্যটি হল তাকে কষ্ট থেকে, তার সমস্যা থেকে এবং তার রোগ থেকে মুক্ত করা।

সেইজন্য আপনি যখন একটি দুষ্টু স্কুল ছাত্রকে শাসন করার প্রয়োজন মনে করেন সেখানেও এই একই জিনিস প্রযোজ্য অর্থাৎ এখানেও অনুপ্রেরণাটি হল ছাত্রটিকে আঘাত করা নয়। আমরা শুধু ছাত্রটির সহায়তা করতে চাই, কারণ আমরা বুঝি, সেও আমার মতো একজন মানুষ- সে সুখী হতে চায়, দুঃখী হতে চায় না- সম্ভবতঃ আমি তাকে শেখাতে পারি এবং জীবনে সুখী হওয়ার উপায় বলতে পারি। আর ভবিষ্যতে এই শিশুটি যেকোন পেশায় থাকুক না কেন, তার ক্ষেত্রে যেটা উপকারী হবে সেটা হল তার মধ্যে যেন নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে, তার মধ্যে যেন ঐ বোধগম্যতা থাকে যে, অন্যদের কীভাবে সহযোগিতা করতে হয়। এগুলি এমনই গুণ যা ভবিষ্যতে যে কেউ হোক না কেন প্রত্যেককে সাহায্য করবে।

শৃঙ্খলার অর্থ হল আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। যখন একটি শিশু দুষ্টুমি করতে চায় তখন সেই শিশুটিকে বোঝাতে হবে সে যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এইভাবে শিশুটিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এই থাকে যে, আমরা যেন তার সহযোগিতা করতে পারি যাতে সে নিজে শৃঙ্খলা বিকাশ করতে পারে। শিশুটিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার সময় যদি আমাদের মনের অবস্থা সেই রকম থাকে তাহলে এক অর্থে বিষয়টি শিশুটির মনে গেঁথে যায়। এটা এমনই যেমন- কোন মাতা-পিতা তার শিশুকে শাসন করে তখন তারা তাদের মনে শিশুটির প্রতি কোন বিদ্বেষ ভাবনা জাগায় না, জাগায় কি?

অতএব, আমি যেটা মনে করি সেটা হল আমরা যদি চিকিৎসা বা শিক্ষার মতো অন্যদের সহায়তা করার পেশায় যাই তাহলে আমাদের এই বিষয়টি শিখতে হবে এবং এতে প্রশিক্ষিত হতে হবে যে আমাদের মধ্যে যেন মৈত্রীর মনোভাব, করুণার মনোভাব থাকে। এটা এমনই একটি ভাবনা যার কারণে আপনি রোগীদের সহযোগিতা করতে চান, ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা করতে চান যাতে তারা আরও একটি সুখী ও উন্নত জীবন-যাপন করতে এবং সমস্যা মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে। অবশ্যই বাহ্যিক স্তরে আপনাকে তো পেশাদার হতেই হবে, যার অর্থ হল গম্ভীর হওয়া এবং কখনো-কখনো বেশ কঠোর হওয়া। এইভাবে আমরা অহিংসার এই প্রথম অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পেশাকে অহিংসাত্মক পদ্ধতিতে চালাতে পারি।

এইভাবে অন্যের প্রতি করুণা শূন্য হয়ে তাদের ক্ষতি করার পরিবর্তে আমরা তাদের প্রতি করুণাভাব জাগাবো অর্থাৎ আমরা কামনা করব যে তারা যেন ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকে, দুঃখ থেকে মুক্ত হয়। অবশ্যই কাউকে সাহায্য করার সর্বোত্তম উপায়গুলি জানা সত্যিই খুব কঠিন। প্রত্যেকটি শিশু, প্রত্যেকটি রোগী অন্যদের থেকে আলাদা হয়। তাই এর অর্থ হ’ল এটা আবশ্যক নয় যে একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেটা কার্যকর হয়, সেটা অন্যের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে। অতএব একজন ডাক্তারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক রোগী আর একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ছাত্রের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন আমাদের প্রতিদিন অনেক রোগীদের দেখতে হয় অথবা ক্লাসে অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড় থাকে তখন এরকম করা ততটা সহজ নাও হতে পারে। তাহলেও যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা-আলাদাভাবে চেনা সম্ভব না হয়, তখন সেখানে আবার যেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটা হ’ল মনের অবস্থা, তাদের জানার আগ্রহ। তাদের জানার আগ্রহটা তাদের সম্মান করার উপর নির্ভর করে। আর তাদের একই ধরণের আগ্রহ এবং সম্মানের সাথে দেখা উচিত, যেমন- আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন- আপনার সন্তান, আপনার মা-বাবা, আপনার ভাই-বোন অথবা অন্য কোন ব্যক্তিকে তার বয়স এবং নিজের বয়সের খেয়াল রেখে করেন।

আমি মনে করি, এরজন্য একটা খুবই উপকারী দিকনির্দেশনা হ’ল, আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে এই ব্যক্তিটা হ’ল একজন মানুষ আর আমার মতো তারও একটি অনুভূতি আছে। সে সুখী হতে চায়, ঠিক তেমনি যেমন আমি সুখী হতে চাই আর যেমন আমি প্রিয় হতে চাই, ঠিক তেমনি সেও প্রিয় হতে চায়। আমি যদি তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করি, নিষ্ঠুর ভাবে আচরণ করি এবং তার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করি, তাহলে সে আঘাত পাবে, ঠিক তেমনি যখন অন্য কেউ আমাদের সাথে ঐভাবে আচরণ করে তখন আমরা আঘাত পাই। অতএব, একজন ব্যক্তি হিসাবে অন্যের প্রতি সম্মান ভাব রাখার ভাবনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নিজেদের প্রতি হিংসা

দ্বিতীয় প্রকারের হিংসা অনেকটা ঐ হিংসার সাথে যুক্ত যার সম্পর্কে আমরা এখন আলোচনা করছিলাম। কারণ এখানে আমরা ঐ অহিংসা সম্পর্কে আলোচনা করছি যা নিজেদের সাথে যুক্ত (প্রথম প্রকারের অহিংসা অন্যদের সাথে সম্পর্কিত)। এখানে আমরা আত্ম-ধ্বংসাত্মক না হওয়ার কথা বলছি। আমরা যখন আত্ম-ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠি তখন সেখানে আত্ম-প্রেমের অভাব থাকে, যার কারণে আমরা নিজেদের ক্ষতি অথবা নিজেদের অনিষ্ট করার কামনা করি। এটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে নিজেদের ক্ষতি করাও হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, এই ধরণের বিচার, “আমি খারাপ”, “আমি ভালো নই”, “আমি একেবারে ভালো নই”।

বিশেষ ক’রে আমরা যদি একজন ডাক্তার হই এবং আমাদের একজন রুগী যদি মারা যায়, যেটা অনিবার্যভাবে ঘটে যাকে, তখন এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা, “ওহ্‌, আমি একজন ভয়ানক ডাক্তার। আমি খুবই খারাপ।” আর তারপর নিজেকে অপরাধী মনে ক’রে কোন না কোনভাবে শাস্তি দেওয়াটা সাধারণতঃ মনোবৈজ্ঞানিক বা আবেগগতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এর কারণ হল আমরা কারও সহযোগিতা করতে পারিনি তাই তার মৃত্যু হয়েছে। এই বিষয়গুলিই হল এমন কিছু যে, আমরা যদি একজন ডাক্তার বা শিক্ষক হতে চাই তাহলে আমাদের সত্যিই এই বিষয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার। আমরা তো বুদ্ধ নই; আমরা সকলকে সাহায্য করতে পারি না- এমনকি বুদ্ধও সকলকে সাহায্য করতে পারেননি। তাই স্বাভাবিকভাবে মাঝে-মাঝে আমরা ব্যর্থ হব। এমনও হতে পারে যে কখনো-কখনো আমরা কোন রোগীর চিকিৎসা ক’রে তাকে রোগমুক্ত করতে পারব না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বাস্তবে কাউকে সাহায্য করার জন্য তার পক্ষ থেকে তাকে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এমন কিছু রোগ যার তো আমরা নিরাময়ই করতে পারি না এবং এমনকি সেটা যদি সম্ভবও হয় তাহলেও আমরা কখনো-কখনো ভুল করে ফেলি; সর্বোপরি আমরা তো মানুষ। আবার কিছু ছাত্রদের মধ্যে গম্ভীর মানসিক এবং সামাজিক সমস্যা অথবা অন্য প্রকারের সমস্যা থাকে- পারিবারিক সমস্যা- আর তাদের সহায়তা করাটা সত্যিই আমাদের সাধ্যের বাইরে থাকে।

সুতরাং আমাদের ঐ উপায়গুলির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ সেগুলি আমাদের পক্ষে আত্ম-ধ্বংসাত্মক হতে পারে। অন্যকথায়, এর অর্থ হল নিজেদের প্রতি হিংসাত্মক হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, আত্ম-ধ্বংসাত্মক হওয়ার অর্থ হল নিজেদের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করা অর্থাৎ এই চিন্তা-ভাবনা করা, “আমাকে একেবারে নিখুঁত হতে হবে” যেটা বাস্তবে করা একেবারেই অসম্ভব। অবশ্যই আমরা যে কাজটা করি সেটাকে যতটা সম্ভব ভালোভাবে করার চেষ্টা করি কিন্তু কেউ কখনো নিখুঁত হয় না। আর তাই তাতে আমরা নিশ্চিতভাবে দুঃখিত হই। আমরা ভবিষ্যতে আরও ভালো ক’রে করতে সক্ষম হতে চাই। তবে এরজন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যাতে ব্যর্থতার কারণে আমরা তীব্রভাবে হতাশাগ্রস্থ না হয়ে পড়ি কারণ হতাশা শুধু আমাদের কাজের ক্ষতিই করবে, আমরা আমাদের কাজকে কার্যকরীভাবে করতে পারব না।

এখন আপনি হয়তো বলতে পারেন, “আমি কীভাবে নিজেকে হতাশ হওয়া থেকে বা ভীষণভাবে আঘাত পাওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পারি”- ধরুন, আপনার কোন ছাত্র আছে এবং সে স্কুল ছেড়ে চলে যায়। স্বাভাবিক, এটা দুঃখজনক, তবে মূল কথা হল হতাশ হলে হবে না। তাই প্রশ্নটি হলঃ আমরা কীভাবে নিজেকে হতাশ না হতে সহায়তা করতে পারি? বিষয়টা সেখানে পৌঁছে যায় যেখানে আমরা অন্যদের সাথে আচরণ করার সম্পর্কে কথা বলছিলাম। প্রকৃতপক্ষে, অন্যদের সহায়তা করা এবং তাদের ক্ষতি না করতে চাওয়ার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল তাদের সম্মান করা উচিত। এটা সবসময় নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যেঃ “আমার ক্ষমতা আছে; তা না হলে আমি একজন শিক্ষক বা ডাক্তার হতে পারতাম না।” আমরা আমাদের অনুপ্রেরণা দৃঢ়তার সাথে নিশ্চিত করিঃ “আমি যে কাজটি করছি তার পিছনে আমার একটা ভাল উদ্দেশ্য আছে।” আর “একজন মানুষ হিসাবে আমি নিখুঁত নই; তবুও আমি নিজেকে সম্মান করার দৃষ্টিতে দেখি যে আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।” এটাই আমাদের সকলকে হতাশ না হতে সাহায্য করে।

এখন ঐ পরিস্থিতিতে কী হয়, যখন আমরা সততার সাথে পরীক্ষা করি এবং বুঝতে পারি যে আমি সত্যিই আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম না? আমি আরও ভাল করতে পারতাম। দেখুন, ঐ পরিস্থিতিতে, নিঃসন্দেহে আমরা অনুশোচনা করি। আর তাই সেই পরিস্থিতিতে আমাদের পুনর্নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যেঃ “ভবিষ্যতে, আমি আরও কঠোর পরিশ্রম করার চেষ্টা করব।” তবে প্রতিরোধের জন্য, অথবা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করার জন্য, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা না করার এই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তির জন্য আমাদের পরীক্ষা করতে হবে যে ঐ ব্যর্থতার কারণ কী ছিল। এটা হতে পারে কারণ আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। আর এর জন্য, আমাদের নিজেদের প্রতি সদয় হতে হবে, আত্ম-ধ্বংসাত্মক নয়। আমাদের জানতে হবে যে বিশ্রামের ক্ষেত্রে আমাদের কী কী প্রয়োজন; আমার সীমা কী? আর পুনরায়, আমাদের ঐ সীমাগুলির সম্মান করতে হবে। তার জন্য লজ্জাবোধ করার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেরই নিজস্ব সীমা থাকে। অবশ্যই, জরুরী অবস্থায় আমরা বেশী পরিশ্রম করতে পারি, কিন্তু সব পরিস্থিতি জরুরী হয় না। আর কখনো-কখনো আমাদের এরকমও বলতে হয়, “আমার বিশ্রাম প্রয়োজন,” এবং তারপর যদি সম্ভব হয় তাহলে বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া উচিত। তবে কখনো-কখনো এটা সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু যদি সম্ভব হয়, তাহলে অপরাধ বোধ না ক’রে বিশ্রাম নেওয়া উচিত।

অবশ্যই, এখন আমরা যদি আমাদের পেশা এবং পরিবারকে পালন-পোষণ করার দায়িত্ব পালন করার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করি, তাহলে তখন সবসময় সেটা করা সহজ হয় না। সন্তানদের, আমাদের নিজেদের অনেক চাহিদা থাকে। তবে আমাদের এই বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যে, আমরা আমাদের সময়সূচীকে কীভাবে সাজাবো, যাতে আমরা অতিরিক্ত পরিশ্রম না করি, আমরা আমাদের কাজের কারণে ক্লান্ত না হয়ে যাই এবং কোনও কাজ ভাল ক’রে না করতে পারি। আর এই পরিস্থিতিকে ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে দেব না যতক্ষণ না আমরা বিকল হয়ে পড়ব। এর কারণ হ’ল, আমাদের চাহিদার উপেক্ষা করাটা নিজেদের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে যাওয়া হয়। অতএব নিজেদের প্রতি অহিংসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যের দুর্ভাগ্যের প্রতি আনন্দিত না হওয়া

তৃতীয় প্রকারের অহিংসা হ’ল অন্যের দুর্ভাগ্যের প্রতি আনন্দিত না হওয়া। অন্য কথায়- এটা নিষ্ঠুর ব’লে বিবেচিত হয়- আমরা মনের নিষ্ঠুর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হিংসার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি- অন্যের অসুবিধাকে দেখে আনন্দিত হওয়া হল একটা নিষ্ঠুর মনের অবস্থা; অন্য কথায়, যখন কেউ ব্যর্থ হয়। এখন আমরা ভাবতে পারি, “কিন্তু এটা তো এমন কিছু নয় যেটা আমি সত্যিই করি।” তবে আপনি যদি রাজনীতির উদাহরণের কথা মনে করেন, যেখানে দুইজন প্রার্থী আছেন এবং তাদের মধ্যে একজনকে চান না যে সে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলুক- নির্বাচনে হেরে যাক এবং তাকে বের করে দেওয়া হোক- তাহলে আমরা এতে খুব খুশি। আমরা তাঁর দুর্ভাগ্যের প্রতি আনন্দিত হই, তাই না? আর এই ধরণের পরিস্থিতিতে যদিও আমরা আনন্দিত হতে পারি যে, আমরা যাকে সবচেয়ে ভাল মনে করি তিনি তাঁর ক্ষমতা লাভ করেছেন, কিন্তু অন্য ব্যক্তির পরাজয়ে বা ক্ষতিতে আনন্দিত হওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ নিঃসন্দেহে তাঁর একটা পরিবার আছে, অন্যান্য আরও লোকজন আছে যারা তাঁর উপর আশ্রিত আর তারা দুঃখ ভোগ করছে- তারাও তো মানুষ। তাই আমি আনন্দিত যে তিনি ক্ষমতায় নেই, কিন্তু আমি তাঁর জন্য কামনা করি যে, তিনি যেন জীবনে সুখী হন। আমি তাঁর জন্য খারাপ কিন্তু কামনা করি না (আমি তার অনিষ্ট হওয়ার কামনা করি না)।

সুতরাং আমরা দেখছি যে এই তিন প্রকারের অহিংসা তিন প্রকারের ক্রূর চিন্তা-ভাবনাকে প্রতিহত করেঃ

  • করুণার অভাব- অন্যরা যেন দুঃখ এবং কষ্ট ভোগ করে, তার কামনা করা।
  • কোন আত্ম-মৈত্রী না থাকা- সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে নিজেদের ক্ষতি করার কামনা করা।
  • অন্যের দুর্ভাগ্যের প্রতি আনন্দিত হওয়া- অন্য কেউ ব্যর্থ হলে বা তাদের সাথে ভয়াবহ কিছু ঘটলে আনন্দিত হওয়া।

আর যেমনকি আমি আগে বলেছি, যে ধরণের কর্ম আমরা হিংসাত্মক না হয়ে করি সেটা আমাদের শক্তিশালী ক’রে তোলে। বৌদ্ধ সূত্রে এর একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়। একটি নদীর কূলে দুইজন সাধক বসেছিল। ঐসময় একজন ব্যক্তি নদীর কাছে এসেছিল- আর ঐ নদীর স্রোত ছিল খুব শক্তিশালী- এবং ঐ ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে নদী পার হতে চেয়েছিল। এটি এমনই একটি নদী ছিল যা আসলে কেউ সাঁতার কেটে পার হতে পারত না; যদি কেউ সেরকম করার চেষ্টা করত সে অবশ্যই ডুবে যেত। তাদের মধ্যে একজন সাধক অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের সাথে সেখানে বসেছিল এবং যখন ঐ ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অবশ্যই ডুবে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ছিল সে কিছুই করতে রাজি ছিল না। অন্য সাধকটি সেখান থেকে উঠে ঐ ব্যক্তিকে নদীতে ঝাঁপ না দেওয়ার জন্য রাজী করাতে পারছিল না। আর সেইজন্য সে ঐ ব্যক্তিকে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া থেকে বাধা দেওয়ার জন্য ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। বুদ্ধ ঐ সম্পূর্ণ ঘটনাকে দেখেছিলেন (বুদ্ধ সেই স্থান দিয়ে গমন করছিলেন এবং তিনি সম্পূর্ণ ঘটনাকে দেখেছিলেন) এবং তিনি বলেছিলেন, যে সাধক তার মুখে হাসি নিয়ে শান্ত হয়ে সেখানে বসেছিল সে হিংসাত্মক কাজটি করেছিল। ঐ ব্যক্তিকে ক্ষতি হওয়া থেকে বাধা দেওয়ার জন্য ঘুষি মারাটা ছিল অহিংসাত্মক। কেন? ঐ ব্যক্তিকে দুঃখ থেকে মুক্ত হতে সহযোগিতা করা এবং অনিবার্যভাবে জলে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করার কারণে।

আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ

এখন এই সম্পূর্ণ আলোচনার সম্পর্ক আজ সকালের আমাদের আলোচনার বিষয়ের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে যুক্ত। এই “আধ্যাত্মিক” শব্দটি প্রকৃতপক্ষে সংজ্ঞায়িত করা একটা কঠিন কাজ। আর নিঃসন্দেহে এর একটা আলাদা অর্থ আছে অথবা নিঃসন্দেহে ইংরেজী এবং রাশিয়ান ভাষায় এর ভিন্ন অর্থ আছে। কিন্তু এখানে আমরা দেখব যে, বৌদ্ধ প্রসঙ্গে এই শব্দটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় অথবা এর সমতুল্য শব্দ কী হবে। বৌদ্ধধর্মে আমরা ধর্মের কথা বলি। এখানে ধর্মের অর্থ হ’ল একটি প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থা; এটা এমন কিছু যা আমরা দুঃখ এবং সমস্যাকে এড়ানোর জন্য পালন করি। এর অর্থ কেবল তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে করি না, যেমন- আপনি একটি গাড়ী বা সাইকেল চালাচ্ছেন আর কোনকিছুর সাথে ধাক্কা খাওয়া থেকে এড়ানোর জন্য আপনি সেটাকে একপাশে ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। এটা তো ধর্ম হল না।

সুতরাং, আমি শুধু দৈনন্দিন জীবনের তাৎক্ষনিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করছি না। আমি এটাকে আধ্যাত্মিক বলব না, বরং এর অর্থ ভবিষ্যতে কোন পরিস্থিতিকে প্রতিরোধ করতে চাওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কথা বলা হচ্ছে। বৌদ্ধধর্ম সহ বেশীরভাগ ধর্ম অনুযায়ী, এর অর্থ হ’ল ভবিষ্যতের জন্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা আর কিছু ধর্মে মরনোত্তর জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাকে বোঝায়। এর অর্থ, কেবল এই জন্মে বস্তুগত সাফল্যের জন্য আমাদের প্রধান উদ্বেগ না থাকা, কারণ মৃত্যুর সময় সমস্ত সাফল্যতা পিছনে পড়ে থাকে আর ভবিষ্যতের জীবনকালের তুলনায় এই জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত।

এখন আমরা যদি ভবিষ্যতের পুনর্জন্ম বা পরজীবনে বিশ্বাস করি তাহলে সেটা খুব ভাল, তবে এমনও হতে পারে যে আমাদের মধ্যে অনেকে তাতে বিশ্বাস করে না। তা সত্ত্বেও কি আমরা আধ্যাত্মিক মানুষ হতে পারি? আমার মনে হয়, আমরা অবশ্যই আধ্যাত্মিক হতে পারি যদি আমরা শুধু এই জন্মের আমাদের বস্তুগত কল্যাণ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করি, কেবল নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য না ভাবি, পরিবর্তে আমরা যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাবি, উদাহরণ স্বরূপ, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে। অন্য কথায় বলতে গেলে, যেকোন ধরণের অবদান দিয়ে আমরা বিশ্বকে একটা আরও ভাল স্থান হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি তাতে আমাদের অবদান খুবই ছোট হোক না কেন। আবার বুদ্ধ দ্বারা ব্যবহৃত একটা উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করতে পারি- চালের একটা বড় বস্তা চালের এক-একটা দানার কারণে পূর্ণ হয়। অতএব এমনও হতে পারে, আমাদের মধ্যে কিছু লোকজন সেই বস্তাটি ভরার জন্য একমুঠ চালের অবদান দিতে সক্ষম, আর কিছু লোকজন কেবল চালের একটা দানা মাত্র দিতে সক্ষম, তাহলেও অবদান তো দুই ধরণের লোকজনই রাখে। এটাই আসল কথা। আর তাই, আমরা যদি সত্যিই খুব বেশী অবদান না রাখতে পারি, তাহলে অন্ততঃ পক্ষে আমরা চেষ্টা তো করতে পারি।

সুতরাং, যেহেতু আপনারা শিক্ষক অথবা চিকিৎসক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ লাভ করছেন, তাই এটা স্পষ্ট যে এই বিশ্বকে ভাল বানানোর জন্য অবদান রাখার ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা করার এটা একটা বড় সুযোগ। শিক্ষক হিসাবে আপনি এমন লোকজনদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন যাদের কাছ থেকে আপনি আশা করতে পারেন যে তারা ভবিষ্যতে নিজেদের অবদান রাখবে। ডাক্তার হিসাবে আপনি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ হতে সাহায্য করছেন যাতে তারা ভবিষ্যতে তাদের অবদান রাখতে পারবে। অতএব এর সম্পর্ক সুখী হওয়া এবং দুঃখী না হওয়ার কামনার সাথে খুব ভালভাবে যুক্ত হয়ে যায়। সেইজন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কোনও হিংসাত্মক ভাবনা রাখা উচিত নয় বরং তাদের সম্মান করা উচিত। “আমি ভবিষ্যতে অবদান রাখতে পারি”, এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের সম্মান করি আর আমরা আমাদের রোগীদের এবং আমাদের ছাত্রদের সম্মান করি এই ভেবে যে, “তারাও অবদান রাখতে পারে।” আর অবদান বলতে কী বোঝায়? বিশ্বকে একটা ভাল স্থান বানানোর অর্থ কী? এর অর্থ হ’ল, মূলতঃ মানুষকে সুখী হওয়ার জন্য কোন্‌ ধরণের উপায় উন্নত করা। আর মানুষকে সুখী হওয়া অর্থ কেবল বস্তুগত স্তরে নয়, যদিও সেটা গুরুত্বপূর্ণ, জীবনে যেকোন পরিস্থিতি সামনে আসে তার মোকাবিলা করতে কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয় বরং মানসিক দক্ষতাও ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়ার জন্য মানসিক শান্তিও দরকার।

অতএব এগুলি হ’ল সেই বিষয় যাকে আমি আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ হিসাবে বিবেচনা করি; অন্য কথায়, আমরা আমাদের জীবনে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং আমরা আমাদের জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু করি। সংক্ষেপে, আমি মনে করি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ ক’রে, আপনাদের মতো তরুণদের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা সম্পর্কে গম্ভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা পড়াশুনা করছি সেটা কেন করছি? আমি জীবনে কী অর্জন করতে চাই? আমি ভবিষ্যতে আমার পরিবারের জন্য কী অর্জন করতে চাই? আমি অবশেষে ভবিষ্যতের জন্য- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যেতে চাই? আর আমি এটা কেন চাই? এর জন্য আপনাকে অনেক আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান বা আত্ম-নিরীক্ষণ করার প্রয়োজন হতে পারে, তবে এটা করা একটা অত্যন্ত সার্থক কাজ। আমরা হয়তো ভাববো যে আমাদের এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্তোষজনক নয়। তবে আমি মনে করি, এই বিষয়টা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের মানদন্ড ব্যবহার করতে হবে, “আমি কি আমার অনুপ্রেরণার সংশোধন করার চেষ্টা করতে চাই?” যে আমি যা করছি সেটা আমার ও অন্যদের জন্য সুখ নিয়ে আসবে কিনা, নাকি এটা কেবল সমস্যার সৃষ্টি করবে? এটার মূল্যায়ন করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে স্বল্পমেয়াদী তাৎক্ষণিক পরিণামের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা জীবনে যা কিছু করি তার সম্পর্কে যদি স্পষ্ট হই আর আমরা দেখি যে আমরা আমাদের জীবনের ভাল দিকে এগিয়ে যেতে পারছি, তাহলে সেটা আমাদের মঙ্গল ও সন্তুষ্টির একটি খুবই চমৎকার অনুভূতি প্রদান করে।

আমার মনে হয় এমন একটা বিষয় যা মাঝে-মাঝে মানুষকে হতাশ ক’রে তোলে সেটা হ’ল, তারা দেখতে পায়, তাদের জীবনের কোন অর্থ নেই, কোনও দিক নেই। আমরা কোন পেশায় যুক্ত হয়ে আছি কিন্তু তাতে আমাদের মন নেই। আর আমাদের মনে হয় যে, সারা বিশ্বের সমস্যা, আমাদের দেশের সমস্যা, আমাদের জেলার সমস্যা, আমার পরিবারের সমস্যা, আমার নিজের সমস্যা- এই সব সমস্যা খুবই ভয়াবহ, আমাদের সহ্যের ক্ষমতার বাইরে। তাই মনের এই অবস্থার সাথে জীবনযাপন করার অর্থ কী আছে? এটা সত্যিই দুঃখজনক; এটা একটা সুখী জীবন নয়। আর সেইজন্য পুনরায় হতাশার এই অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করার জন্য আমাদের নিজেদের প্রতি সম্মান ভাব থাকা প্রয়োজন। আমাদের পুনর্নিশ্চিত করতে হবে যে, “বাহ্যিক পরিস্থিতি যাইহোক না কেন, আমার মধ্যে এই ক্ষমতা আছে যে আমি নিজেকে উন্নত ক’রে একজন আরও ভাল মানুষ তৈরী করতে পারি।” এটা শুধুমাত্র নিজেকে একজন সুখী মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়- এই বিষয়টাকে মেনে নেওয়া- বরং আমার মনের এই অবস্থা আমার চারপাশের সকলকে প্রভাবিত করবে। অতএব চিকিৎসা বা শিক্ষাগতভাবে অপরের সহযোগিতা করা, এটা একটা অর্থপূর্ণ কাজ। আমরা জানিনা যে ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তবে আমরা জানি, যদি মানুষের স্বাস্থ্য ভাল থাকে, মানুষ যদি শিক্ষিত হয়, তাহলে এই আশা করা যেতে পারে যে পরে পরিস্থিতি ভাল হবে। হয়তো এই কল্পনা করা কঠিন। তাসত্ত্বেও ভবিষ্যতে অসুবিধা আরও বেশি থাকলে আমরা তার মোকাবিলা করার জন্য মানুষকে আরও ভালভাবে প্রস্তুত হতে সহযোগিতা করতে পারি। 

আধুনিক বিশ্বে অহিংসা এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পর্কে এটাই আমার চিন্তা-ভাবনা

প্রশ্ন

এই আধুনিক বিশ্বে, অবশ্যই আমরা বুঝতে পারি যে বৌদ্ধ মূল্যবোধে করুণা ভাব আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে পরিস্থিতিটা সত্যিই কঠিন হয়ে ওঠে। কখনো-কখনো শিশুরা মা-বাবা ছাড়া বড় হয় এবং বড় হয়ে তারা নিষ্ঠুর হয়ে যায়। আর শিক্ষক হিসাবে আমাদের পক্ষে তাদের সামনে এটা প্রমাণ করা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে যে, করুণার প্রয়োজন কী- তাদের জানা উচিত যে কীভাবে দুর্বল মানুষদের রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষতি না করা আর দুর্বল মানুষদের প্রতি ক্রুর হওয়া উচিত নয়। আর তাই, শিক্ষক হিসাবে- এই বার্তাটি কীভাবে ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দেব, বিশেষ ক’রে এমন ছাত্রদের কাছে যারা হিংসাত্মক হয়; যাদের লালন-পালন খুব কঠিন অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে হয়।

আমি মনে করি এমন একটি পদ্ধতি যা এই ধরণের উন্মত্ত শিশুদের সাহায্য করতে পারে সেটা হ’ল তাদেরকে অন্যদের দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, তারা অন্যদের দিয়ে উদার হোক। যদি কাউকে (যেমন- একটা শিশু) অন্য শিশুদেরকে কিছু দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়- অন্য কথায়, তারা যদি কোন কাগজ বা বরাত (অ্যাসাইমেন্ট) অন্যের কাছে পৌঁছায়, অথবা তারা এমনকিছু করে যেটা হল উদার কাজ, তাহলে তারা এমনকিছু করে যা অন্যের উপকার হয়। এটা শিশুটিকে আত্ম-সম্মানের অনুভূতি জাগায়। অন্য কথায়, যখন একটা শিশু খুব কঠিন পটভূমি থেকে আসে এবং সে অনুভব করে যে তাকে কেউ ভালবাসে না, তখন তারা সাধারণতঃ প্রত্যাখ্যানের ঐ ভাবটাকে উন্মত্ত আচরণের মাধ্যমে ব্যক্ত করে। “আমাকে যদি সাধারণভাবে জীবনে ভাল মনে না করা হয় কারণ আমার একটা ভাল পটভূমি নেই, তাহলে আমিও দেখিয়ে দেব যে আমি কতটা খারাপ”, এক অর্থে, তার অর্থ এইরকম হয়। অতএব, অন্য কথায়, তারা আচরণ করে যে তারা হল সমাজবিরোধী, সমাজের অঙ্গ নয়, অপরাধ ইত্যাদিতে যুক্ত হয়ে যায়। এটা একটা সাধারণ বিষয়। কিন্তু তাদেরকে যদি দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয় যে, তারা হ’ল একজন ভাল মানুষ, তাদের কাছে এমন কিছু আছে যা তারা অন্যদের দিতে সক্ষম, যদিও তারা সেটা ভালভাবে দেয় না- আমার বলার অর্থ হল যে, তারা সেটাকে দক্ষতার সাথে দেয় না- তবুও এর কারণে তারা এই অনুভূতি অনুভব করে যে, তাদের কাছে ইতিবাচক কিছু আছে যা তারা অবদান রাখতে পারে, শুধু নেতিবাচক কিছু নয়।

বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, এটাকে দান ক’রে একধরণের ইতিবাচক শক্তি বা পুণ্য সঞ্চয় করা বলা হয়। কিন্তু আমাদের এটার বৌদ্ধ ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমি মনে করি, মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টির ভিত্তিতে আমি যেটা ব্যাখ্যা করেছি সেটা কখনো-কখনো সহায়ক হতে পারে। তবে তাদের ইতিবাচক এবং গঠনমূলক কিছু করতে দেওয়ার সময় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে তাদের মনে যেন এই ধারণা না জাগে যে এটা একটা শাস্তি।

আমাদের জীবনে, আমরা প্রায়শই কাউকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করি। কিন্তু আবার, আমরা যখন কাউকে পুনরায় শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করি সেখানে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার একটা প্রক্রিয়াও থাকে। এই প্রক্রিয়ায়, সবচেয়ে উপকারী শাস্তি, অথবা সামাজিক কাজের মতো কোন ধরণের কাজের মধ্যে কোন্‌টা হতে পারে? ঐ ব্যক্তিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যেতে পারে? অথবা ঐ ধরণের ব্যক্তিকে কোন্‌ ধরণের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে? ধরুন, যারা কারাগারে আছে, অপরাধী- যাদেরকে আমরা শিশু অবস্থায় না থাকাকালীন বা বড় হয়ে যাওয়ার পর শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চাই।

সাধারণভাবে এর উত্তর দেওয়া কঠিন, কারণ এখানেও আবার প্রত্যেকেই একজন ব্যক্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারাগারে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলাম না, কিন্তু আমার সহকর্মী, আমার বৌদ্ধ সহকর্মী, অনেকেই এই কাজে যুক্ত রয়েছে। একটা বিষয় যা তারা বুঝতে পেরেছে সেটা হ’ল, কারাগারে বন্দী থাকা অনেক মানুষ, অবশ্যই সবাই নয়, ............... এতে অনেক সময় লেগে যায়, কারণ তাদের জীবনকে পরীক্ষা করতে অনেক সময় লেগে যায়, অনেক সময় যাতে তারা দেখতে পারে যে, তারা জীবনে কী-কী কাজ ক’রে এসেছে আর তারা জীবনে কী-কী করতে চাইছে। অতএব সেখানে অনেক বন্দী থাকে যারা নিজেদের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে, হিংসাত্মক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখার প্রতি বেশ আগ্রহী। আর সেইজন্য তারা মনকে শান্ত করার অত্যন্ত মৌলিক ধরণের বৌদ্ধ ধ্যান, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দেওয়ার অনুশীলন শেখার প্রতি গ্রহণশীল হয়। এইভাবে এই শ্রেণীর মানুষ অবশ্যই এই ধরণের সহযোগিতার জন্য গ্রহণশীল হয়ে থাকে। তবে সবাই কিন্তু সহায়তা লাভ করার যোগ্য হয় না, আর তারা যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে তাদের জন্য আমাদের বিশেষ কিছু করার থাকে না। যদি তাদের মধ্যে নিজেদের জীবন পরিবর্তন করা অথবা উন্নতি করার ইচ্ছা না থাকে, তাহলে তাদের কেবল শারীরিক ভাবে শাস্তি দেওয়ার অর্থ হ’ল তাদের মনের মধ্যে আরও বেশী শত্রুতা এবং ক্রোধ জন্ম দেওয়া।

কিছু ধরণের নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ আছে যা মনোবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয় এবং সেটা হয়তো এখানে খুব বেশী প্রযোজ্য নয়, কিন্তু সাধারণভাবে এটাকে এইভাবে জানা যেতে পারেঃ ধরুন একটা শিশু আছে, সাধারণতঃ মেনে নেওয়া যেতে পারে যে  একটা কিশোর, যে একেবারে সহযোগিতা করে না এবং সে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। সে একজন মানুষ, একজন নেতার সাথে ভ্রমণে যায়। তার সাথে আছে একটা খচ্চর। খচ্চর অবশ্যই একটা জেদী প্রাণী এবং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের দ্বারা কাজ করানো খুবই কঠিন। ঐ খচ্চরকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব ঐ বালকটিকে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে তাকে এই কাজটি করার জন্য নিজের ক্রোধ এবং অধৈর্য ইত্যাদিকে কাটিয়ে উঠতে শেখার প্রয়োজন হয়। আর তারপর কোনভাবে খচ্চরের সাথে কাজ করতে হয়। এর অর্থ হল তাকে এমন কোন দায়িত্ব দেওয়া হল যেটা গঠনমূলক, এক অর্থে ঐ খচ্চর দ্বারা কাজ করানোর দায়িত্ব।

এইভাবে কখনো-কখনো একটা বালককে পশুর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব দিলে............  পশুটি তার সমালোচনা করে না; মানুষ তার সমালোচনা করে। ধরুন, একটা কুকুর............ আপনি তাকে যতই শাসন করুন না কেন কুকুরটি আপনাকে পছন্দ করতেই থাকবে। ঠিক একইরকম বালকদের কোন অন্য পশু, যেমন কুকুরকে যত্ন নেওয়ার সুযোগ দিলে সে তখন কাউকে শান্ত করার জন্য তার সহযোগিতা করা, কোন রকমের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রভাবিত করতে পারে। তবে হ্যাঁ, কিছু লোকজন অবশ্যই নিষ্ঠুর হয় এবং আপনি যদি তাদের একটা কুকুর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দেন তাহলে তারা কুকুরটিকে নির্যাতন করা শুরু করে দেবে। সুতরাং আপনাকে বেশ সতর্ক থাকতে হবে। আমার একজন বন্ধু আছে যিনি হলেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি প্রাথমিকভাবে হিংসুক কিশোর-কিশোরীদের দেখাশোনা করেন। তিনি এই ধরণের জীবনে ঘটিত অসুবিধার মধ্যে কাজকর্ম করেন। তিনি যে নির্দেশিকাগুলি ব্যবহার করেছিলেন আর যার সম্পর্কে তিনি আমাকে বলেছিলেন তাদের মধ্যে একটা হল, যে সমস্ত শিশুরা খুব হিংসুক হয় তাদের সাথে এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত যা দেখে মনে হবে যে আপনি তাদের প্রতি আগ্রহী এবং তাদের মানবীয় সম্মান দিচ্ছেন। এই বিষয়টা আমরা আগে আলোচনা করেছি। অতএব তাদের বিষয়টাকে গম্ভীরভাবে নিন। তাদের কথা শোনার জন্য সময় বের করুন এবং জানার চেষ্টা করুন যে তাদের সমস্যাটা কী। তবে যে জিনিসটা আপনাকে সত্যিই এড়িয়ে চলতে হবে সেটা হল আপনি যদি তাদের কথা শোনেন তখন আপনি বলবেন না। “ওহ্‌, আপনার সময় শেষ। এবার আপনি আসুন।” সাধারনতঃ তারা এই বিষয়ে খুবই নিষ্ঠুরভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় কারণ তারা এটাকে প্রত্যাখ্যাত হিসাবে দেখে।

সুতরাং এখান থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই সেটা হলঃ আমরা যদি একটা অবাধ্য ছাত্রের সাথে মোকাবিলা করতে যায় তাহলে সেই ছাত্রকে আমাদের সময় দিতে হবে। আপনাকে তার কথা শুনতে হবে। আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে তার সমস্যাটা কী (এমনকি আপনি যদি ঐ সমস্যার সমাধান নাও বের করতে পারেন তবুও কেবল এই বিষয়টা সহায়ক হতে পারে যে, আপনি তার কথা সহানুভূতির সাথে শুনছেন)। তবে এরজন্য কোন সময়সীমা রাখবেন না এবং মানুষ হিসাবে ঐ বালককে সম্মান দিন।

কিন্তু তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য বাস্তবে কী করা উচিত এটা বলা বড় কঠিন। আমি জানি না আপনাদের সমাজে আসলে কী গ্রহণযোগ্য, কী গ্রহণযোগ্য নয়। তবে শুধু শাস্তি, বিশেষ ক’রে রাগের কারণে দিলে তাতে কোনও লাভ হয় না।

আমরা কীভাবে মানুষের সাথে আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কে বিরক্ত হওয়া থেকে কাটিয়ে উঠতে পারি?

আমরা যদি এমন কোন পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করি যা আমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হয়, যেটা আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়, তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে সেটা অনেক আলাদা-আলাদা হেতু, পরিস্থিতি এবং অবস্থার কারণে উৎপন্ন হয়- যেমন সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ঐ অবস্থা সম্পর্কিত মানুষের পারিবারিক পরিস্থিতি, তাদের পটভূমি ইত্যাদি। আমরা যখন এর প্রতি বিরক্ত এবং ক্রোধিত হই, তখন আমরা আমাদের মনে ঐ ঘটনা অথবা ঐ বিষয়কে তাতে যাই হোক না কেন, তাকে নিয়ে বিরক্ত হই। আমরা সেটাকে একটা মূর্ত ভয়ঙ্কর দানব, ভয়ঙ্কর জিনিসে পরিণত করি। আমরা ঐ হেতু এবং প্রত্যয়ের সমস্ত দৃষ্টিকে হারিয়ে ফেলি যার উপর ঐ পরিস্থিতি নির্ভর করে। আর আমরা তার সম্পর্কে এত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য অভিক্ষেপ বা কল্পনা করি যা বাস্তবে তার মধ্যে থাকে না। যেহেতু আমরা ঐ পরিস্থিতিকে ঐরকম ভাব চাই না যেমনকি সেটা প্রতীয়মান হয়, অতএব আমরা তার প্রতি আমাদের আবেগগত প্রত্যাখ্যানকে নিজের ক্রোধ-রূপে প্রকট করি।

এখন আমরা যদি এটা নিয়ে ভাবি তাহলে প্রত্যাখ্যান ......... এর পিছনে প্রক্রিয়াটি এই হবে, “আমি কামনা করি যে এই দুঃখ, এই অসুবিধা যেন দূর হয়ে যায়, তার অস্তিত্ব যেন না থাকে।” এটাই হল করুণা। এইভাবে ক্রোধ এবং বিরক্তির প্রতিপক্ষ সবসময় মৈত্রী বা প্রেম হয়। তাই মৈত্রী হল এক প্রকারের কামনা যেখানে আমরা চাই যে অন্য ব্যক্তি সুখী থাকুক এবং সে সুখের সব রকমের সাধন অর্জন করুক। ঐ ব্যক্তি এই সমস্ত কারণের বশে খারাপ আচরণ করে আর সেইজন্য সে বলে যে সে দুঃখী। আমি কামনা করি যে সে যেন সুখী হয়, যাতে সে বিরক্তিকরভাবে, ভয়াবহভাবে আচরণ করা বন্ধ করে দেয়। ঐ ব্যক্তি যাতে সুখী হয় তারজন্য আমাকে শিখতে হবে যে এমন কোন পরিস্থিতি আছে যা তাকে দুঃখী ক’রে তোলে আর উচ্ছৃঙ্খলভাবে আচরণ করে। আর তারপর দেখুন, আপনি এই পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য কী করতে পারেন।

আর এইগুলি হল কয়েকটি পদ্ধতি যা আমরা ব্যবহার করি। এটি মূলতঃ বিশ্লেষণ করেঃ এটা এই কারণে এবং ঐ কারণে উৎপন্ন হয়। আমি চাই তারা এইভাবে কাজ করা বন্ধ করুক, যা এই হেতুর কারণে করা হয় আর এই পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য কী করতে পারি, যার কারণে ঐ ব্যক্তির আচরণ প্রভাবিত হয়?

শিক্ষক হিসাবে আমরা বিভিন্ন পটভূমি থেকে আগত শিশুদের সাথে কাজ করি- বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় পটভূমি- তাহলে এই ধরণের আলাদা-আলাদা শিশুদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এবং শিক্ষিত করতে শুধু ধৈর্য থাকাটা পর্যাপ্ত হবে কি?

আমার মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল শিশুদের প্রতি আগ্রহ জাগানো। এর অর্থ হল আমাদের জানতে হবে যে ঐ শিশুদের ধর্মীয় পটভূমি কী, তাদের সামাজিক পটভূমি কী। আপনি যে সমস্ত লোকজনদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করেন তাদের সম্পর্কে আপনি যত জানবেন আপনি ততই বুঝতে পারবেন যে বাস্তবে তাদের কী প্রয়োজন। আর শিক্ষা প্রদান করার অর্থ কেবল তাদের কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সক্ষম ক’রে তোলা নয়, বরং তাদের আরও ভালো ব্যক্তি হতে সহযোগিতা করা। অতএব আপনারা তাদের সম্পর্কে জানুন। আপনারা তাদেরকে তাদের দ্বারা নিজের সম্পর্কে, তাদের পরিবার সম্পর্কে, তাদের পটভূমি সম্পর্কে অথবা এই ধরণের বিষয় সম্পর্কে ছোট-ছোট নিবন্ধ লেখান। তাদের নিজেদের সম্পর্কে কিছু বলতে বলুন। তারপরেই আপনারা তাদের সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন।

আমার প্রায়শই এমন লোকজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় যারা তাদের মতামত জানাতে অথবা নিজেদের সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন হলে দ্বিধায় পড়ে, কারণ তারা প্রত্যাখ্যাত হতে ভয় পায়। এখানে আমার প্রশ্ন হল এই ধরণের লোকজনদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় যাতে তারা তাদের মোহ এবং ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে।

আমি মনে করি কিশোর-কিশোরীদের জন্য এটি একটি বিশেষ ভাবে বড় সমস্যা। যারা তাদের সহকর্মীদের স্বীকৃতি নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত থাকে। তাদের লজ্জা কাটিয়ে ওঠানোর জন্য কীভাবে সহযোগিতা করা যায়? হ্যাঁ, বৌদ্ধ মঠে ব্যবহৃত শিক্ষা পদ্ধতির একটি পদ্ধতি হ’ল যে একটি উপদেশ সমাপ্ত হওয়ার পর সমস্ত শিক্ষার্থীদের জোড়ায়-জোড়ায় বিভাজিত হতে হয় এবং তারপর একে-অপরের সাথে আলোচনা করতে হয় অর্থাৎ তারা শাস্ত্রার্থ করে, আসলে তারা করে যৌক্তিক শাস্ত্রার্থ। তবে যে বিষয়টির উপর আলোচনা বা শাস্ত্রার্থ করা হয় সেটা হ’ল কিছুক্ষণ আগে যে বিষয়টার উপর শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল তার উপর শাস্ত্রার্থ ক’রে বিষয়টা সঠিকভাবে বোঝা গেছে কিনা। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে তারা পুরো ক্লাসের সামনে আলোচনা করে না, যেখানে কিছু শিক্ষার্থী দয়ালু নাও হতে পারে এবং তারা তাদের উপর হাসি-ঠাট্টা করতে পারে। যখন সেখানে দুইজন থাকবে তখন সেখানে আপনাকে কিছু না কিছু বলতেই হবে। আর শিক্ষকটি ঘোরাফেরা ক’রে প্রত্যেকটি দলের কাছে এক-দুই মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনেন যাতে তিনি জানতে পারেন যে শিক্ষার্থী সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, না অন্য কিছু সম্পর্কে। এটি একটি খুব ভাল শিক্ষাবিজ্ঞান পদ্ধতি, কারণ এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীকে সেখানে একেবারে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকার অনুমতি দেয় না, তারা কিছু না শোনে অথবা তারা মনোযোগ না দেয়। পরিণামস্বরূপ, তারা কিছুই না শেখে। পরিবর্তে, তাদের কিছু না কিছু বলতেই হয়; তাদের অন্য ব্যক্তিদের দেখাতে হয় যে তারা যা আলোচনা করছে সেটা তারা প্রকৃতপক্ষে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এইক্ষেত্রে তাদের লাজুক হলে হয় না। তবে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে শিক্ষার্থী যেন প্রত্যেকবার আলোচনার জন্য একই সঙ্গীকে নির্বাচন না করে; তাদের অংশীদারকে পরিবর্তন করতে হবে। মঠের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত এটি একটি পদ্ধতি। হয়তো এটা লাভদায়ক হতে পারে।

Top