আধুনিক বিশ্বে দালাই লামার প্রাসঙ্গিকতা

আধুনিক বিশ্বে পরম পূজ্য দালাই লামার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে কিনা দেখা যাক। যদি তাঁর কোন ভূমিকা থাকে তবে তা হবে অসংখ্য মানুষের কাছে অর্থবহ, কল্যাণকর। তিনি একজন মহাতারকা তাই কৌতূহলোদ্দীপক এবং মনোগ্রাহী, বিষয়টি তা নয়। ‘দালাই লামা’ মানে তা নয়। তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল পরকল্যাণ।

অপরের সেবা

জগতে এমন বহু মানুষ আছেন যারা দাবী করেন যে, ওঁরা অপরের সেবায় সমর্পিত। আমি মনে করি পরম পূজ্যর বিষয়ে যা বিস্ময়কর তা হল তাঁর পরিপূর্ণ ও প্রকৃত সততা। যখন কেউ তাঁর সান্নিধ্যে যান, তাঁর বাণী শোনেন এবং বুঝতে পারেন যে, তিনি যা বলেন ঠিক তাই করেন; এই বার্তাটি অবশ্যই তাঁদের কাছে পৌঁছে যায়। সবসময় তিনি বলেন যে, তাঁর জীবনের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তিনি সেগুলি নিয়ে চলেন। প্রথমটি হল ধর্ম নিরপেক্ষ মূল্যবোধ, দ্বিতীয় হল সর্বধর্ম সমন্বয় এবং তৃতীয় উদ্দেশ্য হল তিব্বত ও তিব্বতের জনগণের মঙ্গলের জন্য প্রস্তুত থাকা, কারণ এই দায়িত্ব তাঁর উপর দেওয়া হয়েছে। 

মূল্যবোধ

পরম পূজ্য প্রায়শঃ ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেন। এর কারণ, জগতে আজ মূল্যবোধের বড়ই প্রয়োজন। জগৎ আজ ভয়ংকর ভাবে কলুষিত, অসততায় পরিপূর্ণ, মানুষের মধ্যে সংহতির অভাব খুবই প্রকট। এসব কিছুর মূল কারণ হল মূল্যবোধের অভাব। এই গ্রহের সাতশত কোটিরও বেশি মানুষের কীভাবে উপকার হবে এই বিষয়ে তিনি সবসময় ভাবনা-চিন্তা করেন। দালাই লামার বিশ্বজনীন খোলামন নিয়ে এই বিষয়ে সবসময় কথা বলেছেন। এই জনসংখ্যার মধ্যে অনেকে ধর্মে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না। প্রয়োজন হল একটি নৈতিক কাঠামো, সর্বজনগ্রাহ্য নৈতিকতার একটি ভিত্তি। এই বিষয়টিকে পরম পূজ্য দালাই লামা বলছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ’। এ কোন ধর্ম বা পদ্ধতির বিপক্ষে নয় বরং তা সকল মতবাদ এমনকি নাস্তিকদেরও সম্মান করে। তিনি একে কোন কোন সময় নৈতিক মূল্যবোধ বলেন না, তিনি বলেন এর আধার হচ্ছে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ। তিনি বলেন যে, মৌল মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সময় এসেছে এবং তার আধার হল জীববিদ্যা। সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ অনাদি এবং খুবই নিবিড় মৌলিক সম্পর্ক। অপরের যত্ন নেওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পশুদের মধ্যেও রয়েছে। পরম পূজ্য দালাই লামার জীবনেও বিষয়টি আমরা দেখতে পাই, এই কারণে তার বাণী এত মর্মস্পর্শী হয়। 

কর্ম পরিকল্পনা

২০১৩ সালে আটাত্তর বছর বয়সেও তিনি যেভাবে নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী বিশ্বভ্রমণ করে চলছেন তা অকল্পনীয়। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বিশ্বভ্রমণ করেন, কোন-কোন জায়গায় তিনি যান মাত্র একদিনের জন্য। তাঁর কর্মপরিকল্পনা ও যাত্রার নির্ঘণ্ট অত্যন্ত কষ্টকর। সহায়ক ও অনুবাদক হিসেবে আমি পরম পূজ্যর যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলাম। তাই জানি তাঁর নির্ঘণ্ট ঠিক কীরকম। প্রতিদিন তিনি একাধিক ভাষণ দেন, প্রেস কনফারেন্স থাকে আবার তার উপর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ তো আছেই, খাওয়ার সময়ও থাকে না। তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেন ৩:৩০ মিনিটে। এর পর চার ঘণ্টা ধ্যান সাধনা করেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সময় ভেদ হোক না কেন, রুটিন একই থাকে। অতুলনীয় তাঁর শক্তি এবং আনন্দের প্রবাহ। সবার জন্যে রয়েছে তাঁর ভাবনা, যার সঙ্গেই মিলিত হোন না কেন সানন্দে সে ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হন। বিষয়টি যেন অনেকটা এরকম- “ও আরেকজন মানুষ! কী অপূর্ব!”

প্রীতি

যখনই আমরা কোন ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হই, বৌদ্ধ ধর্মানুযায়ী আমাদের হৃদয়ে এই শব্দটি জাগায় উষ্ণতা। তাতে ওদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আপনি হন সুখী এবং তাদের মঙ্গলের জন্য ভাবিত। যে কোন ব্যক্তির সঙ্গে, তা তিনি জনতার সঙ্গে হন বা চলার পথে; কারও উপর দৃষ্টি গেলে তাদের প্রতি পরম পূজ্য দালাই লামা পরিপূর্ণ মনোযোগ দেন। তিনি যে সকলের প্রতি মনযোগী এবং সকলের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করেন তাঁর এই আচরণে তা ফুটে ওঠে। অতএব মানবিক মূল্যবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতার বিকাশের সামগ্রিক ভাবনা তিনি বুঝেছেন, তা সবার কল্যাণের জন্য। ‘শুধু বৌদ্ধদের জন্য’, এরকম সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা তিনি করেন না। পৃথিবীতে শিক্ষার ক্ষেত্রে কী করে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের মতো বিষয়ের প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে তিনি যথেষ্ট উদ্যোগী এবং ভাবছেনও। তাতে শিশুরা শিখবে সততা ও দয়াবান হওয়ার গুণাবলীতে কীরকম উপকার হয়। বিষয়টি বিশ্বের পক্ষে অত্যন্ত হিতকর হবে। 

ধর্মীয় সমন্বয়

ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিবাদের কারণে বিশ্বে অনেক সমস্যার উদয় হয়। সেখানে রয়েছে অনাস্থা, সেখানে রয়েছে ভয়। এ সবকিছু সমস্যা সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। পরম পূজ্য বলেন- ধর্মীয় সমন্বয়ের জন্য আমাদের যা প্রয়োজন তা হল শিক্ষা। তা শুধু ধর্ম নিরপেক্ষ নৈতিকতার শিক্ষা নয় বরং আমাদের একে অপরের থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা জানি না বলেই ভয় পাই। আমরা আসলে কী ভয় পাই তা অজানা এবং ওই অজানা গোষ্ঠী ও ধর্মের উপর আমরা নানারকম কল্পনার আশ্রয় নিই। তিনি বলেন যে, যে সব আন্তঃধর্মীয় আলোচনা চলে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, তাতে লোকজন হাসিমুখে অংশগ্রহণ করেছে, ওঁরা একে-অপরের প্রতি সদয় মৈত্রীপূর্ণ। অবশেষে তা শেষ হতো সমবেত প্রার্থনা বা মৌন ধ্যানের মাধ্যমে। এ সবই ভাল ও সুন্দর কিন্তু খুব বেশী ফলপ্রসূ নয়। ‘আমরা সকলে একই কথা বলছি এবং আমরা এক’ এরকম কথা এবং শুধু সাম্যের দিকই তুলে ধরলে তাতে একে অন্যকে জানার জন্য যে প্রকৃত শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খুব একটা লাভ হয় না। 

এই বছরের জুন মাসে, সুফি গুরুদের সঙ্গে পরম পূজ্যের একটি সভা ছিল। তিনি তাদের বলেন অনৈক্যের জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত নয় বরং আমাদের নিজেদের উন্নতির জন্য সেগুলি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তিনি বলেন যে, সকল ধর্মের একই লক্ষ্য অনুগামীরা কীভাবে সুখে থাকবে তার পথনির্দেশ হল সেই লক্ষ্য। যদিও তা লাভ করার জন্য রয়েছে নানারকম পদ্ধতি বা উপায় তবুও সেগুলির প্রয়োজন আছে। কারণ মানুষও তো বৈচিত্র্যময়। 

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই যদি আমাদের অনুগামীদের মধ্যে প্রীতি, দয়া ইত্যাদির বিকাশে তৎপর হই তাহলে কী উপায় অবলম্বন করবেন? অথবা কী উপায় ব্যবহার করব? পার্থক্যগুলি দেখে, তাদের শ্রদ্ধা করে এগুলি নতুন কিছু শেখার সুযোগ দিচ্ছে, এরকম ভাবলে আমরা আপনাদের থেকেও কিছু শিখতে পারি। প্রতিটি ধর্মের মধ্যে যারা আন্তরিক ভাবে সাধনা করছেন, ওরা একত্রিত হয়ে তাদের অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করলে খুবই ভাল হবে। বড় জনসমাগমে তা করার দরকার নেই; প্রকৃত সাধকদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকুক। তাতেও হবে মহৎ উপকার।

বৌদ্ধধর্মের তিব্বতী ঐতিহ্যের প্রতি নির্দিষ্ট দায়িত্ব কর্তব্য এবং তিব্বতী জনগণের হিত সাধনের লক্ষ্যে কর্মই পরম পূজ্যের একমাত্র কর্ম নয়। প্রাথমিক ভাবে তিনি জগতের সকলের মঙ্গল কামনা করেন। বিজ্ঞান, যন্ত্রপাতি এবং কি করে এসব কাজ করে তা জানতে পরম পূজ্যের উৎসাহ তীব্র। ১৯৮০ সাল থেকেই তিনি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন এবং তিনি তাদের কাছ থেকে শিখতে চান। তিনি বলেছেন যে, বৌদ্ধ উপদেশাবলীতে জগতের বর্ণনা, জগতের বিবর্তন ইত্যাদি আমরা যেমনটি দেখতে পাই তা যদি বৈজ্ঞানিকরা যথাযথ যুক্তির উপস্থাপনায় খণ্ডন করতে পারেন, তাহলে বৌদ্ধগ্রন্থ থেকে সেগুলি বাদ দিতে কোন অসুবিধা নেই। বিভিন্ন রাসায়নিক জিনিসের সাহায্যে মস্তিষ্কের কাজ করার পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক অনুধাবন এই বিষয়ে বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণের দুর্দান্ত পরিপূরক হতে পারে। 

তেমনই বৌদ্ধধর্মের ভাণ্ডারে রয়েছে বিজ্ঞান, জ্ঞান ও দর্শনের বিপুল সম্ভার। এসব বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে আবেগের স্বরূপ, কী করে আবেগগুলি কাজ করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই বিষয়ে বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামোর সাহায্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছে। পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকদের কাছেও এসব তথ্য ভীষণ উপযোগী হবে। বিহারগুলিতে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের শিক্ষার পাঠ্যক্রমে পরম পূজ্য বিজ্ঞানের পাঠ চালু করেছেন। বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থ ইংরেজি থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এইভাবে তিনি জগতের একটি অগ্রণী ধর্মের প্রধান হয়েও অত্যন্ত উদার ও খোলামনের ব্যক্তি হিসেবে বন্দিত হয়েছেন। 

অন্য পরম্পরার সমীপে

পরম পূজ্য ইসলামের জগতেও পৌঁছতে চান। এই কারণে মৌলিক বুদ্ধবাণী এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত সাধারণ উপদেশাবলীর যে সকল গ্রন্থ আছে তা আরবি ও অন্যান্য প্রধান ইসলামি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তিনি আমায় উৎসাহ দিচ্ছেন। এর কাজ চলছে। বিগত কয়েক বৎসর ধরে ইসলাম ধর্মকে শয়তানের রূপ দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ভয়ঙ্কর ভেবে তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া নয় বরং তাঁকে জগতের মধ্যে রাখা খুবই মহত্বপূর্ণ। বৌদ্ধধর্ম-দর্শন-মতবাদ কী এই বিষয়ে তাদের জানতে হবে আমাদের তরফে। এটা ধর্মান্তরিত করা বা ওরকম কিছু নয়। ওরাও যেন জানতে পারে এই উদ্দেশ্য হ’ল শুধু আদান-প্রদান মাত্র। তারপরেও বোঝাপড়া ও বন্ধুত্বের বিকাশে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

বৌদ্ধধর্মের মধ্যেও রয়েছে মহাযান পরম্পরা, যা তিব্বত, চিন, জাপান ইত্যাদি দেশে অনুসরণ ও সাধনা করা হয়। অন্যদিকে রয়েছে স্থবিরবাদ ও থেরবাদী পরম্পরা, তা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অনুশীলন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ, সম্ভবতঃ তা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর যে এই দুটি পরম্পরার অনুগামীগণ একে-অপরের বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না। এই বিষয়ে বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনার জন্য তিনি একজন আমেরিকান ভিক্ষুণীকে আর্থিক সহায়তা দান করে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রতিটি সাধনার বিষয়ে মহাযান ও থেরবাদ কী বলছে তা বিবৃত হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানভাণ্ডার পরে দক্ষিণপূর্ব এশীয় ভাষায় অনুবাদ করে তা সকলের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হবে। 

স্ত্রীদের দীক্ষা

তিব্বতে পূর্ণ উপসম্পদা প্রাপ্ত ভিক্ষুসংঘ অবশ্যই আছে। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভিক্ষুণী পরম্পরা ভারত থেকে হিমালয় অতিক্রম করে সে দেশে পৌঁছোয়নি। নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি হল ভৌগলিক। প্রাচীন কালে দুর্গম হিমালয় পায়ে হেটে একদল ভিক্ষুণীর তিব্বত যাওয়া সহজ ছিল না। ভিক্ষুণী উপসম্পদা দানের জন্য দশজন ভিক্ষুণীর উপস্থিতি অনিবার্য। এই কারণে তা ব্যহত হয়েছে। এই বিষয়েও পরম পূজ্য দালাই লামা দেখছেন কীভাবে লুপ্ত পরম্পরাটি পুনরুদ্ধার করা যায়। তার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রকল্প এবং অধ্যয়নে সাহায্য করছেন, যাতে ইচ্ছুক স্ত্রীগণ তিব্বতী পরম্পরায় (মহাযান) পূর্ণ উপসম্পদা প্রাপ্ত ভিক্ষুণী হতে পারেন।

‘আমি একজন সাধারণ ভিক্ষু মাত্র’

সম্পূর্ণভাবে অহংকার বা ঔদ্ধত্য বর্জিত পরম পূজ্য দালাই লামার ‘তৃণ থেকে দীন, তরু থেকে সহিষ্ণু’ চরিত্রটিই এক পরমাদরণীয় গুণ। তিনি সবসময় বলেন যে, অন্য সকল মানুষের মত আমিও একজন সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ ভিক্ষু মাত্র। তিনি বলেন, “যখনই আমি কোন ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হই, আমি তাকে অন্য একজন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করি। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের সঙ্গে যেমন বার্তালাপ করে আমাদের তেমন মতবিনিময় হয়। দালাই লামা কোন একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, তেমন নয়। না কোন তিব্বতী, না কোন বিদেশী। গৌণ এই পার্থক্য নয়, বরং আমরা সবাই মানুষ এই ভাবনা হল এর প্রাথমিক ভিত্তি।”

তিনি দেবতা তুল্য, রাজা এবং তাঁর বিশেষ অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা রয়েছে, মানুষের এরকম কল্পিত ধারণা এমুহূর্তে দূর করেছেন। তিনি যখন বিশাল জনসমাগমের সামনে আসেন, প্রশান্তির প্রতিমূর্তি, মনে হয় যেন তিনি রয়েছেন আপনালয়ে। তিনি হয়তো চুলকালেন, আঁচর কাটলেন, সবই সাধারণ মানুষের মতো। তিনি একেবারেই আত্মসচেতন নন, এমনকী নেই কোন দেখানপনা ভাব। যদি কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সেই সময় পায়ে হয়তো রবারের চপ্পল পরাছিল; তা পরেই তিনি চলে যান। তিনি কাউকে প্রভাবিত করার জন্য চেষ্টাও করেন না। 

রসবোধ

পরম পূজ্য রসবোধ নিয়ে যেভাবে কথা বলেন তা বিস্ময়কর। তা থেকে কেউ মুক্ত হতে পারেন না। সবাইকে সেটা স্পর্শ করে। একবার তিনি একটি ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন; বসার চেয়ারটি একেবারেই আরামদায়ক ছিল না। সেটি ছিল আর্ম চেয়ার (আরামকেদারা)। অবশেষে তিনি আয়োজক এবং দর্শকদের বলেন সমস্ত আয়োজন তো খুবই ভাল হয়েছে। শুধু পরের বার অনুগ্রহ করে ভাল চেয়ারের ব্যবস্থা করবেন। এই চেয়ারটি একেবারেই আরামদায়ক ছিল না। তিনি কথাগুলি এমন প্রীতিভরে নরম স্বরে বলেছিলেন যে, কেউ ক্ষুণ্ণ হননি বরং সবাই হেসে উঠেন। ভর্ৎসনাও যদি করতে হয়, তিনি লোকেদের এই ভাবেই করেন। 

ভাক্লাভ হাভেল এর সঙ্গে সাক্ষাৎ

এটা ঐ সময়ের কথা যখন চেকোস্লোভাকিয়া ছিল চেক প্রজাতন্ত্রের অধীনে। সেখানকার প্রথম রাষ্ট্রপতি ভাক্লাভ হাভেল যখন পরম পূজ্যকে আমন্ত্রণ জানান তখন আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। রক স্টার ফ্রাঙ্ক জাপ্পাকে প্রথম আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল এবং পরম পূজ্য ছিলেন দ্বিতীয় আমন্ত্রিত ব্যক্তি। হাভেল চাইলেন পরম পূজ্য তাকে এবং তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের ধ্যান সাধনা শেখান। কারণ তিনি বলেন, “আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই এবং কী করে সরকার চালাতে হয় তার কোন ধারণা নেই আমাদের। আমরা শান্ত, আমরা ঘুমোতে পারি না। কীভাবে শান্ত হতে হয়, অনুগ্রহ করে আপনি কী তা শেখাবেন? নইলে একটি নতুন দেশের সরকার আমরা চালাতে পারব না।” ভাক্লাভ হাভেল ছিলেন অত্যন্ত মাটির মানুষ।

প্রাগের বাইরে একটি গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে তিনি পরম পূজ্য সহ তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলের সকল সদস্যদের আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি নিজে কখনও সেটাতে থাকতে পছন্দ করতেন না। প্রাসাদটি সত্যিই বিশাল, এর লম্বা সভাগারে হেঁটে হারিয়ে যেত সবাই। তিনি অতি সাধারণভাবে পরম পূজ্যকে বলেন, “এটি কমিউনিস্ট নেতাদের বেশ্যালয় ছিল।” দালাই লামার সঙ্গে এই ধরণের ভাষায় বার্তালাপ অনভিপ্রেত, কিন্তু হাভেল ছিলেন মাটির মানুষ। তিনি এতকিছু ভেবে বলেননি। পরপর পরম পূজ্য সহ সকলে একটি বিশাল কক্ষের মেঝেয় বসলেন। হাভেল ও তাঁর মন্ত্রীরা পরম পোশাক পরেছিলেন। দালাই লামা তাদের শেখালেন কীভাবে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ও আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলিকে কাজে লাগিয়ে শান্ত থাকা যায়।

সাধারণতঃ পরম পূজ্য রাত্রিবেলা আহার গ্রহণ করেন না এবং তিনি ভিক্ষুর শীল কঠোর ভাবে পালন করেন। তবে তিনি আবার যথেষ্ট নমনীয়। সেই রাতে রাষ্ট্রপতি হাভেল প্রাসাদে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। কথা-বার্তা হল ইংরেজিতে। হাভেল চেইন স্মোকার ছিলেন। দালাই লামা যেভাবে হাভেলকে বোঝালেন তাও উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রপতির ডান দিকে বসেছিলেন দালাই লামা। হাভেল ধূমপান করেই যাচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি হলেও তা ছিল অশোভন। দালাই লামার কোন ভাবান্তর নেই, তিনি সহজেই বললেন, “আপনি অত্যধিক ধূমপান করেন। এতে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবং আপনার ক্যানসার হতে পারে। তাই আপনাকে ধূমপান অবশ্যই কমাতে হবে।” এও ছিল পরম পূজ্যের করুণার বহিঃপ্রকাশ। পরে সত্যিই হাভেল এর ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছিল। কী করলে অপরের মঙ্গল হবে এ হল পরম পূজ্যের আসল ভাবনা। অন্যরা তাঁকে নিয়ে কী ভাবল তা কোন বিষয় নয়। এই ঘটনাটি ছিল তার একটি উদাহরণ।

বুদ্ধিমত্তা এবং স্মৃতি

আমি যতজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তার মধ্যে নিঃসন্ধেহে পরম পূজ্য সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান মানুষ। তাঁর স্মৃতি একেবারে যাকে বলা হয় ফটোগ্রাফিক স্মৃতি। উপদেশ দেওয়ার সময় সমস্ত পরম্পরা ও আচার্যদের বাণী সম্বলিত বৌদ্ধ উপদেশাবলীর সম্ভার তাঁর মনে থাকে। তিনি যে কোন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত দিতে পারেন। তিব্বতীরা তাদের পড়াশোনার সময় নানা ধরণের গ্রন্থ কণ্ঠস্থ করার প্রশিক্ষণ নেন। কোন গ্রন্থ হয়তো হাজার পৃষ্ঠার সম্বলিত তা হলেও তিনি এমন অসংখ্য ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ মনে রেখেছেন, বিষয়টি অভাবনীয়। উপদেশ দানের সময় তিনি এই গ্রন্থ থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে আনেন তো অপর একটি গ্রন্থ থেকে বলেন আর একটি উদ্ধৃতি; বিষয়টি সহজ নয়, বেশ কঠিন। এইভাবে তাঁর স্মৃতি কাজ করে, বিষয়টি অত্যন্ত উন্নত বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। আপনি কিছু জিনিস নিয়ে দেখলেন তা সব কীভাবে মেলানো যায়, বিষয়টি এরকম। আইনস্টাইনের মত মানুষ e=mc2 বার করল? সব কিছু জড়ো করে কীভাবে নকশাটি মেলানো যায় তার ভিত্তিতে এসব হয়েছে। তিব্বতী গ্রন্থাদির উপর বিপুল আধিপত্য থাকায় পরম পূজ্য সেটা করতে পারেন। 

তাঁর ‘ফটোগ্রাফিক স্মৃতি’ শুধু বইয়ের ব্যাপারে নয় মানুষের ক্ষেত্রেও একই রকম, তার নমুনা আমি অনেকবার দেখেছি। তিব্বতে একজন অতিবৃদ্ধ ভিক্ষু ধর্মশালায় পরম পূজ্যের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সে সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাকে দেখামাত্র বললেন- “ও আপনাকে আমার মনে আছে। তিরিশ বছর আগে ভারতে আসার সময় আমরা আপনার বিহারে যাত্রা বিরতি করি, তখন কোন একটা অনুষ্ঠান চলছিল। নৈবেদ্যর একটি বড় থালা আপনাকে ধরে থাকতে হয়েছিল, থালাটি সারাক্ষণ ধরে রাখা আপনার পক্ষে ছিল খুবই কঠিন, বেশ ভারী ছিল থালাটি। আপনার মনে আছে?” তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন সেরকোঙ্‌ রিনপোছে। তিনি একসময় পরম পূজ্য দালাই লামার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমায় বলেছেন যে, শৈশবে দালাই লামাকে কোন একটি বিষয় একবার দেখালেই তিনি সেটা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলতেন এবং সেটা স্মরণে রাখতেন। 

সম্পন্নতা

আমাদের সমকালে এই মানবদেহী একজন বিরল ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব। তাহলে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? দেখুন মানুষ হিসেবে একজন কী করতে পারে, সেখানেই রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর। অবশ্যই তিনি বলেন যে, নিজেকে উন্নত করার জন্য তাঁকে ভীষণ খাটতে হয়েছে আর তার সঙ্গে এই কাজটুকু আমরা সবাই করতে পারি। সমস্যা তিনি কী করে সমাধান করেন তা একবার দেখা যাক। কল্পনা করুন, এই পৃথিবীর একশ কোটিরও বেশী মানুষ তাঁকে পয়লা নম্বর গণশত্রু হিসেবে দেখে। এ কথায় পরম পূজ্য শুধু হাসেন। কারণ তিনি জানেন যে এটা সত্য নয় আর তাঁর মাথায় তো শিং নেই! কেউ আপনাকে চীবরের আড়ালে শয়তান তকমা দিল, আপনি কীভাবে সামলাবেন? 

তিনি কখনও হতাশাগ্রস্ত হন না। তিনি বলেছেন এই অনুভূতির কখনোই অভিজ্ঞতা হয়নি এবং তাঁর পক্ষে বোঝা কঠিন। আমার মনে আছে তিনি একবার স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি কখনোই শোনেননি বা ভাবতেও পারেন না যে কারও নিজের প্রতি ঘৃণা আছে বা তার হীনমন্যতা আছে। তিনি তা কখনও মুখোমুখি হন নি এবং এই অভিজ্ঞতাও হয়নি তাঁর।

তিনি সর্বক্ষণের আশাবাদী আবার একই সঙ্গে পরিস্থিতির বাস্তবতাকেও সেইভাবেই সামলান। বর্তমানের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “মানুষই এই পৃথিবীর সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং মানুষই তা দূর করতে পারে।” একেবারে সাধারণ স্তরে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের প্রসার, শিশুদের শিক্ষায় নৈতিকতার অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর সমস্যাগুলি দূর করার জন্য অবদান রাখছেন। পরিপূর্ণ নম্রতা ও মাটির মানুষ হয়ে তিনি সমগ্র বিশ্বের কল্যাণে সক্রিয় হয়ে কাজ করে চলেছেন। এই বিষয়টি এত মরমিয়া যে, বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোপরি রয়েছে তাঁর অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি এবং রসবোধ। 

তাঁর সচিব এবং মন্ত্রণাদাতারা সবসময় বলেন যে, আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন, ভ্রমণ কম করুন আপনি। প্রতিদিন ভ্রমণের সময় প্রতিটি মিনিট ব্যয় হয় সভা বা উপদেশ দানে, প্রায়শঃ বিমান ধরতে হয়। কিন্তু তিনি সবসময় বলেন, “না, আমার যখন এরকম করার মতো শক্তি আছে। আমি এভাবেই ভ্রমণ করব, কারণ এতে অন্যদের উপকার হয়।”

তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হল যে, তিনি আমাদের দিচ্ছেন আশা-ভরসার আলো। তিনি অত্যন্ত সৎ এবং ভয়ানক কঠিন কাজ করছেন। যখন তিনি মানবজাতির উন্নয়নের কথা বলেন তাঁর বক্তব্য হয় সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী এবং তা করাও যেতে পারে; যেমন- শিক্ষা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও নৈতিকতার মতো বিষয়। এগুলি কোন অলৌকিক উপায় নয়, প্রকৃতপক্ষে আমরা তা করতে সক্ষম। আমাদের দেশ বা শহরে যখন তাঁর পদার্পণ ঘটে তখন ব্যক্তিগত ভাবে পরম পূজ্য দালাই লামার দর্শন ও অনুভব লাভ একটি পরম অনুভূতি ও বিস্ময়কর। 

প্রশ্নোত্তর

পরম পূজ্য, সকল আধ্যাত্মিক কর্তব্য এবং ব্যবহারিক বিষয় যেমন শরণার্থীদের জীবনযাত্রাকে রক্ষা করার কাজটি আপনি কীভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করেন?

তিনি শুধু বিপুল অধ্যয়ন এবং অনেক ধ্যান সাধনায় ব্যাপ্ত থাকেন না, বরং তিনি নির্বাসিত তিব্বতী জনগণের কেন্দ্রীয় তিব্বতী সরকারেরও প্রধান। সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা এবং গভীর দূরদর্শীতার সাথে তিনি এই পথটি ত্যাগ করেছেন আর প্রবর্তন করেছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্ধারিত প্রধান। তাঁকে বলা হয় সিক্যোঙ্‌ (রাষ্ট্রপাল)। তার আগে নির্বাসিত শরণার্থীদের বসবাসের ব্যবস্থা থেকে বহু প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এই বিপুল কর্ম যোগ্য সম্পাদনে তাঁর কৌশল একেবারেই বাস্তবচিত। ভাবতেন না “ওহ! এটা খুব বেশী, এ অসম্ভব, আমি পারব না।” তিনি খুব পরিকল্পিত ভাবে এগোতেন। তাঁর অধীনস্ত বিভিন্ন প্রকল্প সম্পাদনের ও প্রতিনিধিত্ব করার কাজ সামলেছেন অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও স্মরণ শক্তির মাধ্যমে। যা অত্যাবশ্যক তিনি সেটা করেন। তাঁর কাছে এ কোন বড় বিষয় নয়।

আমি অনেক সময় কিছুটা মজা করে বলি যে, কী করে বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ করতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে কালচক্র যানের পদ্ধতি খুবই সহায়তা করে। কালচক্র মণ্ডলে আপনাকে ৭২২টি ব্যক্তিত্ব দৃষ্টিগোচর করতে হবে। আমার মনে হয় খুব কম লোকই তা করতে পারেন। বিপুল ও জটিল এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজের উপর সাধনা করার পর যত বড় ও জটিল কাজই আসুক না কেন তা ছোটই মনে হয়। আপনি কোনকিছুকে ভয় পান না, কারণ আপনি খুব বড় কিছু একটা করছেন না। 

জীবন সমস্যা সঙ্কুল। কোন-কোন ব্যক্তির জীবন তো অন্যদের থেকে আরও বেশী জটিল। ভয় না করে তাকেই কেন আপন করে নিই না? বেশী হলে আরও ভাল। আমার ওয়েবসাইটের মতো ২১টি ভাষা নিয়ে কাজ করছি, বেশী কিছু নয়, আমরা সেটা করতে পারি। প্রয়োজন হলে আরও বাড়ানো হবে, কেন নয়? দালাই লামা যে বিপুল কর্মযজ্ঞে যুক্ত তার তুলনায় এই কাজ কিছুই নয়। তবে তা সম্ভাবনার কথাও বলে। কোন অভিযোগ নয়, ‘আমি বেচারা’ তাও নয়। আমার মা যেমন বলতেন- ‘সোজা ওঠো এবং নামো’। শুধু করে যাও।

আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন দালাই লামাকে কেন পরম পূজ্য বলা হয় যদিও তিনি তো জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষ?

আচ্ছা, দালাই লামা নিজেকে পরম পূজ্য বলেন না। আমি জানি না কীভাবে সেটা শুরু হয়েছে। মনে হয় তা খ্রিস্টান উপাধি থেকে নেওয়া হয়ে থাকবে এবং ইংরেজির সঙ্গে জুড়ে গেছে। রাজাদের যেমন “মহামহিম” আখ্যা দ্বারা সম্বোধন করা হয়, তেমনই মানুষ সেটা শ্রদ্ধা সহ সম্বোধন হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আপনাদের আধ্যাত্মিক গুরুকে বোঝানোর জন্য তিব্বতী ভাষায় অনেক সম্মানসূচক শব্দ রয়েছে। দালাই লামার জন্য বিশেষ শব্দও আছে কিন্তু ‘His Holiness’ এর অনুবাদের মতো কিছুই নেই। মানুষ এই শব্দটিকে সাধারণ সম্বোধনের জন্য গ্রহণ করেছেন এবং তিনি তাদের এর জন্য নিষেধ করতে পারেন না। মানুষ তাঁকে ভগবানের মতো পূজা করুক, তিনি সেটা অবশ্যই চান না। 

যেহেতু আপনি তিব্বতী, অতএব জানেন আপনি হয়তো কোন ইংরেজি শব্দের সন্ধান দিতে পারেন যা হবে এর সমার্থক। 

তাঁর জন্য প্রধান যে উপাধিটি ব্যবহৃত হয় সেটা হল ‘কুনদুন’। এর অর্থ হল- সর্বোচ্চ উপস্থিতি বা শ্রীচরণেষু। শব্দটি অন্য ভাষায় অনুবাদ করা শক্ত। এর মানে হল তিনি অবতার হয়ে আসছেন এবং সর্বোচ্চ শ্রেণীর সত্ত্বার গুণাবলী প্রকাশ করছেন। আপনি এমন একজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি সত্যিই আলোক প্রাপ্ত। আমি এটি চালু করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কেউ আগ্রহী হন নি! 

সারাংশ

কিছু মানুষ তাঁকে তাদের আধ্যাত্মিক গুরু মেনে শ্রদ্ধা করেন। অন্যরা তাঁকে একজন সুপার স্টার হিসেবে দেখেন। এমন কিছু মানুষও আছেন যারা তাঁকে ভাবেন “ভেড়ার চামড়ায় আচ্ছাদিত নেকড়ে।” প্রকৃত সত্য হল দালাই লামা তাঁর ধর্ম নিরপেক্ষ নৈতিকতার আদর্শ এবং ধর্মীয় ঐক্যের ভাবনার বিকাশের মাধ্যমে বিশ্ব-শান্তি এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে চলেছেন। তিনি হলেন মৈত্রী, করুণা ও প্রজ্ঞার প্রতিমূর্তি। আমরা মানুষ হয়ে কী অর্জন করতে পারি, তাঁর সম্ভাবনা কতটুকু তা তিনি আমাদের দেখিয়ে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।

Top