শান্তিদেব অষ্টম শতাব্দীতে পূর্ব ভারতের বঙ্গ প্রদেশের একটা অঞ্চলের রাজপুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করতে চলেছিলেন তখন তিনি মঞ্জুশ্রীর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঐ সময় মঞ্জুশ্রী বলেছিলেন, “সিংহাসন তোমার জন্য নয়।” মঞ্জুশ্রীর পরামর্শ শুনে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে বনের দিকে প্রস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন অ-বৌদ্ধ গুরুদের সাথে সাক্ষাৎ ও অধ্যয়ন করেছিলেন। পাশাপাশি নিবিড় ভাবে ধ্যান করেছিলেন এবং সমাহিত সমাধির অবস্থা প্রাপ্ত করেছিলেন। শাক্যমুনি বুদ্ধের সাথে যা ঘটেছিল সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, গভীর সমাধিতে লীন হয়ে দুঃখের মূলকে উন্মূলন করা যায় না। মঞ্জুশ্রীর উপর নির্ভর করে অবশেষে তিনি সমস্ত বুদ্ধের জ্ঞানের প্রতিমূর্তির প্রকৃত দর্শন লাভ করেছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত করেছিলেন।
তারপরে শান্তিদেব বন ত্যাগ করে নালন্দা মহাবিহারে চলে গেলেন। সেখানে তাঁকে উপাধ্যায় দ্বারা ভিক্ষুর দীক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। সেখানে তিনি মহান সূত্র এবং তন্ত্রগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন এবং নিবিড় ভাবে অনুশীলন করেছিলেন। তবে তিনি তাঁর সমস্ত অনুশীলন এবং সাধনা গোপন রেখেছিলেন। সকলেই ভেবেছিল যে, তিনি খাওয়া, ঘুমোনো এবং মল ত্যাগ করা (ভু-সু-কু) ছাড়া কিছুই করেন না। তবে বাস্তবে তিনি প্রভাস্বরী ধ্যান অবস্থায় থাকতেন।
অবশেষে মঠের ভিক্ষুরা তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন কারণ তারা মনে করলেন যে, তিনি অপ্রয়োজনীয়। অজুহাত হিসাবে তারা তাঁকে বলেছিল যে, তাঁকে একটা মূল পাঠ্যের উপর বক্তৃতা দিতে বলতে হবে, যখন তিনি না পারবেন নিজেকে বোকা ভাববেন। তারা তাঁর জন্য কোন সিঁড়ি ছাড়াই একটা উঁচু সিংহাসন স্থাপন করেছিল এবং ভেবেছিল যে, তিনি সেখানে উঠতে পারবেন না। কিন্তু শান্তিদেব কাছে যেতেই সিংহাসনটি তাঁর স্তরে নেমে গিয়েছিল, যাতে তিনি সহজেই আরোহন করতে পারেন।
তারপরে তিনি বোধিসত্ত্বের আচরণ সম্পর্কিত বোধিচর্যাবতার নামক গ্রন্থের পাঠদান শুরু করেন। যখন তিনি শূন্যতা সম্পর্কিত নবম অধ্যায়ের একটি নির্দিষ্ট কারিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি আস্তে-আস্তে আকাশে উঠে গিয়েছিলেন। কারিকাটি ছিল-
যখন (শূন্যতার জ্ঞানের কারণে) ভাব অথবা অভাব বুদ্ধির সামনে বিদ্যমান থাকে না, তখন (বিষয়-বিষয়ী দ্বৈত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে) কোন সত্য প্রকট হয় না। এই অবস্থায় সবকিছু পরম শান্ত হয়ে যায়।। ৩৫।।
এরপর শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল আর অবশিষ্ট পাঠটি আবৃত্তি হয়ে চলেছিল। এইভাবে তিনি নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে ভিক্ষুরা তাদের স্মৃতি থেকে গ্রন্থটি লিখে রাখেন।
শান্তিদেব তাঁর উপদেশে আরও যে দুটি গ্রন্থ উল্লেখ করেছিলেন যা তিনি নালন্দায় লিখেছিলেন। সেই দুটি হল- ১) শিক্ষাসমুচ্চয় এবং ২) সূত্রসমুচ্চয়। অবশেষে কেউ স্বপ্নে শান্তিদেবের দর্শন প্রাপ্ত করেছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, সেগুলি কোন নির্দিষ্ট ভিক্ষুর ঘরের ছাদের ভিতরের বিমে লুকিয়ে রাখা আছে। উক্ত স্বপ্নে শান্তিদেব এও বলেছিলেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না।
“সূত্রসমুচ্চয়” নামক গ্রন্থটিতে সূত্রের মূল বিষয়গুলির সারাংশ প্রস্তুত করা আছে, অন্যদিকে শিক্ষাসমুচ্চয়ে আছে সূত্রে বিদ্যমান অনুশীলনের সারাংশ। দ্বিতীয় প্রন্থটির “শিক্ষাসমুচ্চয়” তিব্বতী অনুবাদ এবং “বোধিচর্যাবতার” তেংগ্যুর সংগ্রহে সংরক্ষিত আছে। তেংগ্যুরের অর্থ হল- বুদ্ধবচনের উপর প্রণীত ভারতীয় টীকার তিব্বতী অনুবাদ সংগ্রহ। খুনু লামা রিনপোছের মতে, “সূত্রসমুচ্চয়” নামক গ্রন্থটি তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল, কিন্তু তেংগ্যুরে পাওয়া যায় না।
বোধিচর্যাবতার-এর উপর, বিশেষ করে এর নবম অধ্যায়ের উপর বেশ কয়েকটি ভাষ্য বা টীকা রচনা করা হয়েছে। তিব্বতী ভাষ্যগুলি সব পরম্পরা থেকে এসেছে, কারণ এই গ্রন্থটি তিব্বতের সমস্ত বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। গেলুগ পরম্পরায় চোংখাপা দ্বারা রচিত “মহামার্গক্রম” নামক গ্রন্থটি অনেকটা “শিক্ষাসমুচ্চয়” এবং “বোধিচর্যাবতারের” উপর আধারিত, বিশেষ করে পর-আত্মপরিবর্তন উপদেশের সাথে যুক্ত। যদিও চোংখাপা “বোধিচর্যাবতার”-এর উপর আলাদা কোন ভাষ্য রচনা করেননি, তবুও তাঁর “মহামার্গক্রম” গ্রন্থটি উপরোক্ত গ্রন্থে আলোচিত আনেকগুলি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর “নেয়ার্থনীতার্থবিভঙ্গশাস্ত্র-সুভাষিতসার” নামক গ্রন্থটি উপরোক্ত গ্রন্থের নবম অধ্যায়ের অনেকগুলি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর “মধ্যমক-মত-প্রকাশ” (মূলমধ্যমককারিকার টীকা মধ্যমকাবতার)-এর টীকাটিও প্রবলভাবে এর উপর নির্ভর করে।