জীবন সম্পর্কে একটি বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি

​দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- আচরণ করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করার ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি গুলি যতদূর সম্ভব ত্যাগ করা এবং তার পরিবর্তে যতবেশী সম্ভব ইতিবাচক ও গঠনমূলক পদ্ধতি গুলি উৎপন্ন করা। এসব করার জন্য বাস্তবতা সম্পর্কে এবং আচরণগত হেতু আর ফল সম্পর্কে বিভ্রান্তিকে ত্যাগ ক’রে মনকে দমন করতে হবে। আমরা যখন এইভাবে জীবন-যাপন করি তখন আমাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে একটি বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয়।​​

আমাদের বিষয়, “জীবন সম্পর্কে একটি বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি”, মূলতঃ আমরা কীভাবে বৌদ্ধ উপদেশ বা শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেগুলি আসলে বলতে কী বোঝায়? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শিক্ষাগুলির অধ্যয়ন করতে পারি এবং একটা দৈনন্দিন ধ্যান অনুশীলন করতে পারি, কিন্তু এগুলিকে আমরা কীভাবে আমাদের প্রকৃত দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্বন্ধ-স্থাপন করতে পারি সেটা স্পষ্ট নয়। সেগুলি আসলে ব্যবহারিক শব্দে কী বোঝায়? সেগুলি আমাদের জীবনকে কীভাবে পরিবর্তন করে অথবা ব্যক্তিগত ভাবে প্রভাবিত করে? বৌদ্ধ অনুশীলন কি শুধু এমন কিছু যা আমরা আমাদের একটা শখের মতো একপাশে রেখে করতে পারি অথবা জীবনের অসুবিধা গুলি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য করি? আমরা কি শুধু কোনও একটা সুন্দর মনোনিবেশ বা কল্পনায় প্রবেশ করি অথবা আমাদের অনুশীলন কি খুবই উপকারী এবং সত্যিই কি আমাদের জীবনে উপকার করে? সর্বোপরি আমাদের জীবনের দুঃখ এবং সমস্যাগুলি পরিহার করতে সহায়তা করাই ছিল বৌদ্ধধর্মের উদ্দেশ্য।


একটি উপকারী দিকনির্দেশ

আমরা বৌদ্ধ শিক্ষা গুলিকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত প্রার্থনাকে একটা খুবই উপকারী দিকনির্দেশ রূপে গ্রহণ করতে পারি। প্রার্থনাটির নাম হ’ল “ক্রমাগত করণীয় ত্রি-অনুশীলন”, যেটা সাধারণতঃ অধিকাংশ ধর্মোপদেশের পূর্বে পাঠ করা হয়। এর মধ্যে এই পঙ্‌ক্তি গুলি আছেঃ

কোনও রকমের অকুশল কর্ম না করা, যেটা গঠনমূলক সেটাকে সমৃদ্ধ ভাবে করা, নিজের মনকে পূর্ণতঃ দমন করা, এগুলিই হ’ল বুদ্ধের শিক্ষা।

এগুলিই বৌদ্ধ শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথম লাইনের, “কোনও রকম অকুশল কর্ম না করা”, অকুশল বা নেতিবাচক কর্মের তাৎপর্য এমন কিছু যা হল স্ব-ধ্বংসাত্মক, এমন কিছু যা অন্যদের সমস্যা এবং অসুখীতায় জর্জরিত করে বা দীর্ঘমেয়াদী রূপে আমাদের দুঃখী ক’রে তোলে। অতএব বৌদ্ধ অনুশীলনে আমরা প্রথম যেটা করি সেটা হল অপরের বা নিজেদের ক্ষতি করার চেষ্টা না করা। দ্বিতীয় লাইনের, “যেটা গঠনমূলক সেটাকে সমৃদ্ধভাবে করা”, গঠনমূলক শব্দের অর্থ হল এমন কিছু ঘটে যা অন্যের এবং নিজেদের জন্য ঠিকঠাক ভাবে কার্যকর হয় আর সুখ নিয়ে আসে।

এটা করার জন্য যা করতে হবে সেটা তৃতীয় লাইন ব্যাখ্যা করে, “নিজের মনকে পূর্ণতঃ দমন করা।” এটি আমাদের ধংসাত্মক এবং গঠনমূলক, উভয় কর্মের উৎসকে নির্দেশিত করে। পূর্ববর্তী থেকে বিরত থাকতে এবং পরবর্তীকে কার্যকর করার জন্য আমাদের নিজেদের উপর অর্থাৎ আমাদের মনোভাব এবং আমাদের আবেগ গুলির উপর কাজ করতে হবে আর এগুলির উদয় হয় মন থেকে। আমরা জীবনে অপরের সাথে কীভাবে সম্বন্ধ স্থাপন করি, কীভাবে আচরণ করি, কথা বলি এবং চিন্তা-ভাবনা করি তার জন্য আমাদের মনোভাব এবং আবেগ গুলি প্রভাবিত করে এবং তাই শেষ লাইন, “এইগুলি হ’ল বুদ্ধের শিক্ষা।”

বাস্তবকে বোঝা

আমরা যদি আরও একটু গভীর ভাবে দেখি, যেমনকি আমার একজন শিক্ষক বন্ধু বলেছিলেন, বৌদ্ধধর্মের মৌলিক প্রবেশপথ হল বাস্তববাদী হওয়া অর্থাৎ “জানুন বাস্তবতা কী এবং বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে তার মোকাবিলা করুন।” অন্য কথায়, আমাদেরকে আমাদের আচরণ এবং বস্তুর জ্ঞান অর্জনের জন্য বাস্তবতার উপর ভিত্তিস্থাপন করতে হবে।

বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হ’ল হেতু এবং ফল অথবা যেটা সাধারণতঃ “প্রতীত্যসমুৎপাদ”কে বোঝায়। বস্তুর উদয় বা উত্থান হয় হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে। অন্য কথায়, আমাদের ধ্বংসাত্মক এবং গঠনমূলক কর্ম গুলি হেতুর কারণে উদ্ভূত হয়। আমরা যদি আমাদের আচরণের দিকে লক্ষ্য করি আমরা দেখতে পাই যে, এটি হয় সমস্যা সৃষ্টি করছে অথবা নিজেদের এবং অপরের জন্য অধিক এবং সমৃদ্ধি বহন ক’রে আনছে। তবে আমাদেরকে আমাদের আচরণ বিচারহীন ভাবে দেখতে হবে। আমরা জীবনের সাথে যেভাবে আচরণ করি তার সম্পর্কে বিচারহীন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বৌদ্ধ নৈতিকতা কোনও ঐশ্বরিক সত্ত্বা প্রদত্ত, আইনসভা অথবা শাসক প্রদত্ত আইনকে অনুসরণ করে নির্ধারণ করা হয়নি। আমাদের যদি এই ধরণের আইন ভিত্তিক নৈতিকতা থাকে, তাহলে আমাদের রায় আছে। আমরা যদি নিয়ম এবং আইন অনুসরণ করি, তাহলে আমরা ভাল হিসাবে গণ্য হই এবং পুরস্কার পাই; আর যদি সেগুলি অনুসরণ না করি, তাহলে আমরা নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলি। ফলে আমরা খারাপ হিসাবে গণ্য হই এবং শাস্তির উপযুক্ত হই। এটি বৌদ্ধ নৈতিকতা নয় অথবা জীবনের সাথে মোকাবিলা করার বৌদ্ধ পদ্ধতিও নয়। যখন আমরা নিজেদেরকে নিজেদের বিচারক রূপে পাই তখন এই উপলব্ধি করাটা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে। এটা আমাদের মনোভাবে গভীর পরিবর্তনের মধ্যে একটা, যেটাকে আমাদের তৈরী করতে চেষ্টা করা উচিত অর্থাৎ নিজেদের সম্পর্কে বিচারক হওয়া বন্ধ করা। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা খারাপ, ভাল না, যথেষ্ট ভাল না মনে করা অথবা আমরা যা করেছিলাম সেটা ভয়াবহ ছিল।

এর পরিবর্তে আমাদেরকে হেতু এবং ফল সম্বন্ধিত আমাদের জীবনের সাথে মোকাবিলা করার পদ্ধতি লক্ষ্য করতে হবে। আমরা যদি সমস্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকি তবে সেটা ঘটে হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে। এর মানে এটা নয় যে আমরা খারাপ। আমরা যদি আরও গভীরে যাই, আমরা দেখতে পাই যে আমরা সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিলাম; আমরা বুঝতে পারিনি। এর থেকে যা বোঝা যায়, সেটা হল সত্যিই একধরণের অভিক্ষেপ। আমরা বিষয় গুলিকে অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা দেখাই এবং নিজেদের উপর সব ধরণের অর্থহীনতা, পরিস্থিতি এবং আমাদের চারিপাশের লোকজনের উপর অভিক্ষেপ করি। এই অভিক্ষেপ গুলি বাস্তবতার সঙ্গে মেল খায়, এই মনে করে তার উপর বিশ্বাস করার প্রবণতা দেখাই, কিন্তু বাস্তবে সেগুলি মেল খায়ই না। আমরা যদি নিজেদের পরীক্ষা করি এবং জানার চেষ্টা করি আমরা কেন ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করি, সাধারণতঃ আমরা বুঝতে পারব যে, আমরা কিছু অর্থহীন বিষয়ের অভিক্ষেপ করেছি যা পরিস্থিতির সাথে জড়িত এবং যা আমাদের অভিক্ষেপ গুলিকে সাড়া দিচ্ছে।

দ্বি-সত্য (দুটি সত্য)

পরম পূজ্য দালাই লামা সম্প্রতি একটা বড় কথা বলে চলছেন যে, মানুষকে কম সমস্যাযুক্ত জীবন গঠন করার জন্য তাদের সহায়তা করার সবথেকে সার্বজনীন উপায় কী হতে পারে। তিনি নিজেকে একজন বৌদ্ধ দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করছেন না, বরং তার উদ্বেগ হিসাবে সার্বজনীন ভাবে কথা বলছেন। তিনি বলেন, আমাদের দ্বি-সত্যকে (দুটি সত্য) বুঝে শুরু করতে হবে। এটাই হল মূল আধার। আমাদের দ্বি-সত্যকে খুবই অবিশুদ্ধ ভাবে দেখার প্রয়োজন নেই, বরং দেখতে হবে আরও বেশী প্রাথমিক ভাবে যাতে যে কেউ তার সাথে সম্বন্ধ-স্থাপন করতে পারে। অন্যদিকে অতিরঞ্জন ভিত্তিক বা আমাদের বর্বর ধারণার উপর আধারিত অভিক্ষেপও আছে; আর অপরদিকে আছে বাস্তবতা। এইগুলি হল দ্বি-সত্য।

একটা বিভ্রান্ত মনে অভিক্ষেপ গুলি সত্য মনে হয়, যেমন- আমরা একটা রেঁস্তোরায় খাবারের অর্ডার দিয়েছি। কিন্তু যখন খাবারটা পুড়ে যায় বা কোনও কারণে ফুরিয়ে যায় তখন আমরা ভাবি, “আমি অভাগা, আমি ভাল না, কেউ আমায় ভালবাসে না” অথবা যখন ট্রাফিকে আটকে যাই তখন ভাবি, “আমরা কখনও বাড়ি ফিরতে পারব না।” আমরা অতিরঞ্জিত করি এবং অভিক্ষেপ করি যে, এটা হল সবথেকে ভয়ঙ্কর জিনিস যা ঘটতে পারে এবং আমরা ট্রাফিকে আটকে থাকতে পারি। আর এটা চিরস্থায়ী হতে পারে। আমরা এই অভিক্ষেপ গুলিকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করি। এটাই হল সংবৃতি সত্য অর্থাৎ যা একটা বিভ্রান্ত মন ভুলভাবে সত্য হিসাবে বিবেচনা করে।

তারপরে আছে বাস্তবতা অর্থাৎ গভীরতম সত্যটি। বাস্তবতা হল ট্রাফিকটা আছে হেতু এবং পরিস্থিতির কারণে; এটা হ’ল ভিড়ের সময় এবং সকলেই বাড়ি ফিরতে চায়। আমরা কী আশা করি? এটি শীতকালে ঠান্ডা লাগার অভিযোগের মতো। আমরা কী আশা করতাম? এখন শীতকাল। এটা ঠিক তেমনই। আমাদের দ্বি-সত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হতে হবে। আমরা যখন উপলব্ধি করি যে, আমরা অর্থহীনতাকে অতিরঞ্জিত করছি এবং অভিক্ষেপ করছি, তখন ঐ অর্থহীনতাকে বিনির্মাণ করতে হবে। সংক্ষেপে জীবনে আমাদের সাথে যা কিছু ঘটছে সেগুলিকে জানার জন্য আমাদের দ্বি-সত্যের পার্থক্যকে বুঝতে হবে এবং এই বোধগম্যটাকে আমাদের জীবনে সংহত করতে হবে। এটা অপরিহার্য।

উক্ত প্রার্থনার পরবর্তী লাইনে এই বিষয়টি নির্দেশ করা হয়েছেঃ

তারা, অস্পষ্টতা বা একটা (ঘূর্ণী) মশাল, একটি মায়া, শিশিরের ফোঁটা, বুদ্‌বুদ্‌, একটা স্বপ্ন, বিদ্যুৎ বা মেঘের ঝলকের মতো, প্রভাবিত ধর্মকে ঐভাবে বিবেচনা করুন।

আমরা জীবনে কম-বেশী যা কিছু অতিরঞ্জিত করছি এবং অভিক্ষেপ করছি সেটাকে শনাক্ত করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, যা খুবই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে সেটা একটা মায়া, একটা স্বপ্ন, একটা বুদ্‌বুদ্‌ ইত্যাদির মতো। এটা সত্যিই সুষম নয় যেমনকি দেখে মনে হয়। অতএব, আমরা বিশ্বাস করি না যে, এটা বাস্তবের সঙ্গে খাপ খায়। এটা বিশ্বাস না করা হ’ল আমাদের কল্পনার বেলুন ফাটানোর মতো।

অভিক্ষেপ

মূলতঃ অভিক্ষেপ দুই প্রকারের হয়- কিছু হয় উপকারী এবং অন্যগুলি হয় ক্ষতিকারক। কোন অভিক্ষেপ গুলি উপকারী? আমাদের একটা ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের একটা ভ্রমণ আয়োজন করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমরা এখান থেকে সেখানে ভ্রমণ করব এবং এর সাথে আগের কথাও ভাবি। সেটাই হল একটা অভিক্ষেপ অর্থাৎ আমাদের এটা করতে হবে বা ওটা করতে হবে, সঙ্গে এটা নিতে হবে বা ওটা নিতে হবে, সংরক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি। এই ধরণের অভিক্ষেপ কাজের রুটিন বা কেনাকাটার তালিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয় যখন আমরা কোনও দোকানে যাই। এইগুলি হল সম্পর্কিত অভিক্ষেপ আমরা যেটা করার প্রবণতা দেখাই অর্থাৎ কোনও পরিকল্পনা যা আমরা অর্জন করব। আমরা প্রায়শই কাজ-কর্মের সময় এটা করি যখন কি না সারা বছর কী অর্জন করব, বা না করব তার জন্য একটা পরিকল্পনা নির্ধারণ করি।

তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, আমাদের অভিক্ষিপ্ত পরিকল্পনা একটা স্বপ্নের মতো। ব্যবহারিক স্তরে এর মানে কী বোঝায়? এর মানে নমনীয় হওয়া বোঝায়। এগুলি হল প্রভাবিত ধর্ম, যেমনকি প্রার্থনার মধ্যে বলা হয়েছে। এগুলি হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে প্রভাবিত; কখনও-কখনও তাদের “সংস্কৃত ধর্ম” বলা হয়। হেতু এবং প্রত্যয়ের ভিত্তিতে বস্তুর উৎপত্তি হয়। অতএব আমরা যখন একটি পরিকল্পনা তৈরী করি তখন পরিস্থিতিটা হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে প্রভাবিত হয় এবং তাইজন্য এগুলি পরিবর্তনও হতে পারে। পরিবর্তন হওয়ার একটা উদাহরণ এরকম হতে পারে- যেমন একটা নির্দিষ্ট বিমানে ভ্রমণ করার জন্য কোনও আসন খালি নেই। যদিও আমরা ঐ বিমানে ভ্রমণ করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু আমাদের পরিকল্পনাটি পরিবর্তন করতে হয়েছে। অভিযোগ করা এবং মন খারাপ করার পরিবর্তে আমরা শুধু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেব। এটাই হল সেই রকমই যা কিছু করার জন্য আমাদের প্রশিক্ষিত হতে হবে। আমরা যখন আমাদের আসল পরিকল্পনায় আটকে যাই এবং উপলব্ধি করার নমনীয়তা থাকে যে, আসল পরিকল্পনাটি হল একটি মায়ার মতো অথবা একটা বুদ্‌বুদের মতো এবং প্রার্থনায় উল্লিখিত সমস্ত দৃষ্টান্তের মতো, তখন আমরা এটাকে শক্ত ক’রে ধরে রাখি।

এটা কী তৈরী করে? এটা মনের একটি খুবই অসুখী অবস্থা তৈরী করে। আমরা অত্যন্ত ক্রোধিত হতে পারি বা হতাশ হতে পারি। এটা শুধু আমাদের দুঃখী করে তোলে আর পরিস্থিতিতে কোনও পরিবর্তন করে না। আমরা যখন ট্রাফিকে আটকে যাই তখন সেটাকে অভিশাপ দিলে কোনও উপকার হয় না, যেমন কি হর্নে গোঁ-গোঁ শব্দ করলে কোন উপকার হয় না। একটাই জিনিস আছে যা আমাদের উপকার করে এবং সেটা হল বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া, আর সেটা হচ্ছে আমরা যে পরিস্থিতির আশা করেছিলাম সেটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছনোর পরিকল্পনা করেছিলাম; কিন্তু আমরা ট্রেনটা ধরতে পারিনি অথবা ট্রেনটি পৌঁছতে দেরী করে। এমন পরিস্থিতিতে এর জন্য আমাদের কিছুই করার থাকে না। এইভাবে আমরা শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনের দরকারী স্তরে প্রয়োগ করতে পারি।

আমাদের বুঝতে হবে যে, বস্তুকে বিবেচনা করার একটা সঠিক এবং ভুল উপায় আছে। ভুল উপায় বলতে বোঝায় কোনও বস্তুকে স্থির এবং স্থায়ী মনে করা যেটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল প্রত্যয়ের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে। যেমন- মনে করা যে, কোনও পরিকল্পনাকে অবশ্যই স্থায়ী হতে হবে। এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা খুবই সাধারণ বিষয়। বাস্তবে আমাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে প্রস্তুত থাকতে হবে যে, কখন কোন কারণে সেটাকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে এবং আমাদের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে না। আমরা ট্রাফিকে আটকে যেতে পারি, লোক সাক্ষাৎ বাতিল করে দেয় এবং এরকম আরও কিছু। বোধিচর্যাবতারে এর সম্পর্কে সর্বোত্তম পরামর্শ প্রস্তুত করেছেনঃ

যদি প্রতিকার করা যায় তাহলে তারজন্য চিন্তিত হওয়ার কী প্রয়োজন? যদি প্রতিকার না করা যায় তাহলে চিন্তিত হয়েও কোনও লাভ নেই।

এই পরামর্শটি সত্যিই মৌলিক, আমাদের কিছু হজম করতে হয় এবং জীবনের সাথে মোকাবিলা করার উপায়ের অঙ্গ তৈরী করে নিতে হয়। আমরা যদি জীবনে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ি এবং আমরা যদি সেটাকে পরিবর্তন করতে পারি তাহলে সেটা সহজভাবে পরিবর্তন করতে হবে। আর আমরা যদি সেটা পরিবর্তন না করতে পারি, তাহলে তার জন্য করার কিছু থাকে না, তার জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনও কারণ থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ, ভ্রমণকালে আমাদের জিনিসপত্র হারিয়ে গেল এবং কিছুতেই সেটা ফেরত পাওয়া সম্ভব হল না। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের বাস্তবকে স্বীকার করতে হবে।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমার একটা খুব মজাদার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি পরম পূজ্য দালাই লামার প্রবচন শুনতে হল্যান্ড ভ্রমণ করছিলাম। আমি অ্যামস্টারডামে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। আমি চেক-ইন করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। ঐসময় সেখানকার কম্পিউটার সিস্টেমটি খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং এর কারণে দীর্ঘ লাইন হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে, তারা হয়তো সময় মতো চেক-ইন করতে পারবে না এবং বিমানটি ধরতে পারবে না। এক পর্যায়ে, আমার সামনে লাইনে থাকা লোকেরা টিকিট এবং পাসপোর্ট বের করছিল। তাদের মতো আমিও যখন ঐ কাজটা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম যে, আমি সঙ্গে পাসপোর্ট নিতে ভুলে গিয়েছি। পাসপোর্ট ছাড়া চেই-ইন করতে পারিনি এবং আমার কাছে জার্মান পরিচয়পত্র ছিল না।

আমার সারা জীবনে এটাই প্রথম বার ঘটেছিল। আমি তখন কী করতে পারতাম? আমি তখন ছিলাম বিমান বন্দরে এবং সেখান থেকে কোনভাবে আমার কামরায় গিয়ে এবং বিমান-বন্দরে ফিরে এসে বিমানটি ধরার কোনও উপায় ছিল না। আমি কি এরকম কিছুর জন্য মন খারাপ ক’রে বসে থাকলে হতো? এতে কোনও লাভ হতো না। আমি কি রাগ ক’রে বসে থাকলে হতো? এতেও কোন লাভ হতো না। বরং আমি তখন তথ্য-ডেস্কে গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম যে, এর পরে কোনও বিমান আছে কি না। জানতে পারলাম, ঐ সময় ঐ বিমান বন্দর থেকে কোনও বিমান ছিল না। কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তের বিমান বন্দর থেকে রাত্রে একটা বিমান ছিল। এর অর্থ হল, আমি সন্ধ্যাবেলা যে অনুষ্ঠানে যোগদান করার পরিকল্পনা করেছিলাম সেটা মিস করব। কী করব? আমি বাড়ি চলে গেলাম, অন্য বিমানে টিকিট সংরক্ষণ করলাম এবং সেই সন্ধ্যাবেলা উড়লাম। এটা ঠিক ঐ রকম।

এই ধরণের অভিজ্ঞতা হ’ল একটা পরীক্ষা যে, আমরা কীভাবে শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনে সংহত করেছি। আমরা কি পুরো বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করব এবং উত্তেজিত হয়ে যাব? আমরা যদি রেগে যাই, তাহলে এটি আমাদের নিজেরই ক্ষতি করবে এবং আমাদের দুঃখিত করে তুলবে। আমাদের তাৎক্ষণিক ভাবে পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে এবং যা যা প্রয়োজন তাতে যোগদান করতে হবে। এটাই হল সেই পদ্ধতি যেভাবে আমাদের ব্যবহারিক স্তরে অভিক্ষেপের উপর স্থির করার পরিবর্তে অনিত্য সম্পর্কে বুদ্ধের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যেভাবে আমি একটা নির্দিষ্ট বিমানে চড়ার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং তার জন্য অ্যামস্টারডাম থেকে রটারডাম ট্রেনে করে ভ্রমণ করেছিলাম এবং সেখান থেকে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এটা একটা স্বপ্নের মতো এবং ওরকম আর ঘটতে যাচ্ছে না। বেশ, এবার আমার একটা অন্য পরিকল্পনা আছে।

এটা ধ্যানের জন্য প্রদত্ত খুবই মৌলিক নির্দেশের সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ আমাদের কোনও প্রত্যাশা ছাড়া ধ্যান করতে হবে। আমাদের যদি কোনও প্রত্যাশা না থাকে, তাহলে আমাদের কোনও হতাশাও থাকবে না। বৌদ্ধধর্মের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এটা খুবই মৌলিক।

আমার বোনের দুটি ছেলে এবং চারটি নাতি আছে। আমি সবসময় তাকে উৎসাহিত করি, সে যেন আশা না করে যে, তার ছেলেরা বা নাতিরা তাকে ডাকবে। আমরা যদি আশা করি, তাহলে আমরা হতাশ হব। কারণ তারা আমাদের জন্য সেটা করতে যাচ্ছে না। আমরা যদি কারও সাথে কথা বলতে চাই, আমরা তাদের ফোন করতে পারি। এটা ঐটার মতোই সহজ; আমরা বাস্তবতাকে স্বীকার করতে পারি। আমরা যদি এটাকে পরিবর্তন করতে পারি তাহলে পরিবর্তন করব। আর যদি পরিবর্তন না করতে পারি তাহলে পরিবর্তন করব না। আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র আসার আগে পর্যন্ত পাব না। সেটা আমাদের স্বীকার করতে হবে।

আবার বলছি, অভিক্ষেপ দুই প্রকারের হয়। একটা যেটা উপকারী- আমাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে। আমরা যদি কোথাও যেতে চাই তাহলে আমাদের বিমানে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু অন্যগুলি না শুধু অসহায়ক বরং ক্ষতিকারকও।

অনুধাবন এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ

আমাদের ক্ষতিকারক অভিক্ষেপ গুলি লক্ষ্য করার আগে, এক মুহুর্তের জন্য আমাদের নিজস্ব পরিস্থিতির উপর অনুধাবন করা একটি ভাল ধারণা। আমরা কতটা নমনীয়? আমরা কতটা দুঃখিত হই যখন সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে না? আমরা কিছু করতে কতটা আটকে যাই যেটা আমাদের একটা নিশ্চিত সময়সূচীতে করতে হতো। উদাহরণ স্বরূপ, এই কাজটি এই সঠিক সময়ের মধ্যে করতেই হবে; অথবা আমরা যদি একটা রেঁস্তোরায় যাই, তারা আমাদের পছন্দের মতো সঠিক খাবারটা রাখবে এবং সেটা দ্রুত পরিবেশন করে দেবে। আমরা কোন পরিকল্পনা এবং প্রত্যাশার সাথে কতটুকু আঁকড়ে থাকি? লক্ষ্য করার চেষ্টা করুন, আমরা যখন হতাশ হয়ে যাই তখন কতটা অপ্রীতিকর মনে হয়। আমরা আমাদের প্রত্যাশার কারণে হতাশ হই। আমরা মনে করি আমাদের পরিকল্পনা অবশ্যই জিনিস গুলি কীভাবে কাজ করে তার বাস্তবতার সঙ্গে মিল খাবে।

কিন্তু সবকিছু হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভরশীল। রেঁস্তোরায় আমরা যে খাবারটা চেয়েছিলাম সেটার ঘাটতি পড়তে পারে। এসব হল হেতু এবং প্রত্যয়। ট্রেনটা বিলম্ব ছিল; আমরা ট্রাফিকে আটকে গিয়েছিলাম এবং তারজন্য বিমানটি মিস করেছি। এসব হেতু এবং প্রত্যয়। আপনি কতটা নমনীয় তা কয়েক মিনিটের জন্য পরীক্ষা করে দেখুন। এটা কি এমন কিছু যার জন্য আপনার কাজ করা দরকার? এটা যথেষ্ট নয় যে, অনিত্যতা সম্পর্কে শিখলাম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করলাম এবং উপলব্ধি করলাম যে, শ্বাস-প্রশ্বাস অনিত্য। ওটা অবশ্যই খুবই ভাল, তবে আমরা কীভাবে সেটাকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করব? সেটাই হল অনিত্যতাকে জানার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক।

একটা থালা পড়ে যাওয়া এবং ভেঙ্গে যাওয়ার মতো ব্যবহারিক উদাহরণের কথা ভাবুন। এর প্রতি আপনার আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া কী হবে? আপনি নৈশ আহার তৈরী করছেন এবং সেটা পুড়ে গেল। আপনি আবেগপ্রবণ ভাবে সেটার সাথে মোকাবিলা করবেন? আমাদের উন্নতি সেখানে প্রকাশিত হয়। আমরা কম্পিউটার বা ফোনে কিছু করার চেষ্টা করি কিন্তু সেটা কাজ করে না। আপনি কি তক্ষুনি অন্য কিছু করার চেষ্টা করবেন? না আপনি মন খারাপ করে বসবেন? আর এর জন্য কি আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন?

এগুলি হল শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ। আমরা যদি ঐ পরিস্থিতিতে মন খারাপ করি এবং দ্বিতীয় পরিকল্পনাতে পরিবর্তন করতে সক্ষম না হই তাহলে আমাদের অন্য ক্ষেত্রে কাজ করা উচিত যাতে আমাদের মন খারাপ না হয়। কারণ ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদিতে কিছু করার অন্য উপায় আছে। আমরা যদি মর্মাহত হই, এটা নির্দেশনা না করে এসব ক্ষেত্রে আমাদের কাজ করতে হবে।

ক্ষতিকারক অভিক্ষেপ

উপর বর্ণিত দুই প্রকারের অভিক্ষেপের মধ্যে একটি অভিক্ষেপ পরিকল্পনা এবং সময়-সূচী তৈরী করার জন্য উপকারী এবং অন্যটি ক্ষতিকারক। “আমি একজন পরাজয়ী; কেউ আমাকে ভালবাসে না; এই লোকটি ভয়ঙ্কর এবং আরও কিছু,” এই ধরণের কল্পনা হল ক্ষতিকারক। অথবা “যদি খাবার জ্বলে যায় বা আমরা যদি ট্রেনটি মিস করি”, তাহলে পুরোপুরি বিপর্যন্ত হয়ে যাবে। এই ধরণের ক্ষতিকারক অভিক্ষেপগুলি অতিরঞ্জিতার উপর আধারিত।

রাগের সাথে আমরা কোনকিছুর নেতিবাচক গুণগুলি অতিরঞ্জিত করি এবং সেটাকে ফুটিয়ে তুলি। অনেকে ভুগর্ভস্থ পথ বা মেট্রোর সাথে এটা অনুভব করে; যেমন আমরা যখনই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামি ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। আমরা এর সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হই? আমরা কি প্রতিজ্ঞা করি? এটি বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ জিনিস নয় যার জন্য পাঁচ বা দশ মিনিট অপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু এটিকে আমরা ফুটিয়ে তুলি এবং রাগের প্রতিক্রিয়া করি আর মন খারাপ করে ফেলি। এটি আমাদের দুঃখী করে তোলে। এতে কোনও কাজ হয় না। হয় কি?

লোভ এবং আসক্তির প্রভাবে, আমরা কোনও জিনিসকে বিশ্বের সবথেকে সুন্দর জিনিস বলে মনে করি অথবা মনে করি যে, আমরা সবথেকে অসাধারণ ব্যক্তির সাথে আছি। আমরা অতিরঞ্জিত করি, প্রেমে পড়ি এবং শুধু ব্যক্তির ভাল অতিরঞ্জিত দিকগুলি দেখি। আমরা আশা করি ব্যক্তিটি আমাদের অতিরঞ্জিত অনুসারে জীবিত থাকুক, কিন্তু সেটা কেউ পারে না। আর যখন সেটা না হয় তখন আমরা হতাশ হয়ে যাই।

এই ধরণের মনোভাব গুলি সমস্যাযুক্ত। প্রায়শই যেটা ঘটে সেটা হল আমরা জিনিস গুলিকে একটা খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, এগুলি ঘটতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন আমাদের জীবনে কোনও ধাক্কা খাই, কেউ আমাদের প্রত্যাখ্যান করে বা কেউ এমন কিছু করে যা আমাদের জন্য অপ্রীতিকর; আমরা যে ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রেখেছি সে এমন কিছু করে যা আমরা পছন্দ করি না, জন্মদিনে ডাকে না অথবা রেগে যায় এবং আমাদের প্রতি চিৎকার করে বা যাই হোক না কেন তখন আমরা শুধু একটা ঘটনার দিকে মনোনিবেশ করি। আমরা পুরো সম্পর্কের বৃহত্তর চিত্রটা দেখি না। আমরা তাদের শনাক্ত করি এই সংকীর্ণ জিনিস দিয়ে, আর তাইজন্য আমরা খুব রেগে যাই।

আমাদের যদি অসুবিধা হয় বা কোনও অসুস্থতা থাকে, তাহলে আমরা ভাবতে লাগি, “আমি বেচারা; আমিই একমাত্র যে এইরকম দুঃখ ভোগ করছি”। আবার, এটা একটা অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ। এটা একটা অভিক্ষেপ যা বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখার উপর আধারিত। উদাহরণ স্বরূপ, “আমায় কেউ ভালবাসে না।” আমরা যদি আমাদের সম্পূর্ণ জীবনটাকে খুঁটিয়ে দেখি, তাহলে সম্পূর্ণ জীবনে কেউ আমাদের ভালবাসেনি, এটা কি হতে পারে? আমাদের কুকুর কি আমাদের ভালবাসে না? কেউ কি কখনও আমাদের প্রতি সুন্দর ছিল না বা কেউ কি আমাদের যত্ন নেয়নি? আরও একটা উদাহরণ, “আমি একজন পরাজয়ী।” সেটা কি সত্যি? এটা কি সত্যি যে, আমরা কখনও কোন কিছুতে সাফল্য পাইনি? আমরা সফল হয়েছি হাঁটা শিখতে অথবা টয়লেট করায় প্রশিক্ষিত হতে। অতএব আমরা কোন কিছুতে অবশ্যই সফল হয়েছি।

আবার আমাদের অভিক্ষেপ গুলি বাস্তবতার সাথে মিল খায় না; কিন্তু আমরা চাই সেগুলি মিল খাক এবং সেই জন্য আমরা বিশ্বাস করি সেগুলি সে রকম হবে। আমরা এটা চাই যে, আমাদের সঙ্গী সবথেকে অসাধারণ হোক, হোক বিশ্বের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এর জন্য একটা ভাল উদাহরণ হল- অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইন গুলি, কীভাবে তাদের জীবনে একটা সঙ্গী থাকে। আমাদের জন্য তারা সবাই একই রকম, কিন্তু পেঙ্গুইনের জন্য এটি তাদের সকলের মধ্যে বিশেষ একজন। অবশ্যই পেঙ্গুইনদের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ সমান বলে মনে হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে অন্য কেউ যদি আমাদের ভালবাসে সেটা বিবেচ্য হয় না। না, এটা আপনাকেই করতে হবে। এটা শুধু আপনাকেই ভালবাসতে হবে- যিনি হলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট একজন- সেটা হলেন আপনি যিনি আমায় ভালবাসেন। এই ধরণের অতিরঞ্জন খুব একটা উপকারী হয় না।

বাস্তবতা অস্বীকার করা

ক্ষতিকারক অভিক্ষেপের আরও একটা ভিন্নতা হল বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অর্থাৎ অপরের বাস্তবতা না দেখে অস্বীকার করা। এটা তখন ঘটে যখন আমরা মানুষকে বস্তুর রূপ দিই এবং তাদের অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে বিবেচনা না ক’রে বস্তু রূপে পরিণত করি। বৌদ্ধধর্মে একটা খুব বিখ্যাত লাইন আছে, “প্রত্যেকে সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখী হতে চায় না।” আমরা অন্য লোকের ক্ষেত্রে এটাকে কত গম্ভীর ভাবে নিই? আমরা প্রায় এটাকে উপেক্ষা করি এবং এমন ভাবে কাজ করি যেন আমরা অপরের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করি বা অপরের সাথে কথা বলি, তাতে কিছু আসে যায় না। এটা এমন মনে হয় যেন কর্মফল ওখানে প্রয়োগ হয় না, এবং অন্য কারও মধ্যে অনুভূতি নেই।

উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের কার্যালয়ে কেউ খুবই আপত্তিজনক এবং অপ্রীতিকর। তাসত্ত্বেও সেই ব্যক্তি সুখী হতে চায়, দুঃখী হতে চায় না। সে চায় মানুষ তাকে পছন্দ করুক, সে চায় না মানুষ তাকে অপছন্দ করুক। সে অপ্রীতিকর ভাবে আচরণ করে। এর কারণ হল- সে খুব বিভ্রান্ত যে, তাকে সুখ কে এনে দেবে। আবার এটা ফিরে যায় অ-বিচারী হওয়ার দিকে। শান্তিদেব বলেছেন, “শত্রুর মতো ভেবে আমরা আমাদের সুখকে নষ্ট করে দিই।” অন্য কথায়, আমরা অসুখীতার কারণের দিকে দৌড়াই। যদি কেউ মারাত্মক ভাবে স্বার্থপর আচরণ করে, সেটা সবাইকে প্রেরিত করে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে। সে যেভাবে আচরণ করে সেটা কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু সেই ব্যক্তিটা মনে করে যে, তার ঐ আচরণ তাকে সুখী করতে চলেছে।

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- অপরের মুখোমুখি হওয়ার সময় বোঝার চেষ্টা করতে হবে, “আপনি সুখী হতে চান, যেমনটা আমি চাই। আপনার মধ্যে অনুভুতি আছে, যেমনটা আমার মধ্যে আছে। আপনি দুঃখী হতে চান না এবং চান সবাই আপনাকে পছন্দ করুক, যেমনটা আমি চাই। আপনি চান না আপনাকে কেউ অপছন্দ করুক অথবা প্রত্যাখ্যান করুক, যেমনটা আমি চাই না।” যখন আমরা বাসে থাকি বা ট্রাফিকে আটকে যাই তখন অনুশীলন করার জন্য এটা সহায়ক। প্রত্যেকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে চায়, কেউ ট্রাফিকে বসে থাকতে চায় না, যেমনটা আমরা চাই না। অপরের প্রতি ক্রোধিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সকলের মধ্যে অনুভূতি আছে, যেমনটা আমাদের মধ্যে আছে।

একটা অত্যন্ত সহায়ক লাইন হল- “যদি প্রত্যেকে বুদ্ধকে পছন্দ না করে থাকে; তাহলে আমাদের কেন আশা করা উচিত যে প্রত্যেকে আমাদের পছন্দ করবে?” অথবা “তারা যদি যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ ক’রে হত্যা করে থাকে, তাহলে আমাদের জন্য আমরা কী আশা করতে পারি? তাই কি যে, সবাই আমাদের ভালবাসতে চলেছে?” এটা খুব উপকারী হয় যখন কেউ আমাদের পছন্দ করে না অথবা ইতিবাচক ভাবে আমাদের সাড়া দেয় না যেমনটা আমরা চাই। এগুলি এমন কয়েকটি লাইন যা জীবনে অবাস্তব প্রত্যাশা এবং অভিমুখের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ব্যবহারিক স্তরে খুব সহায়ক হতে পারে। আমরা ভাবি, “আমাকে সবসময় সঠিক হওয়া উচিত এবং প্রত্যেককে আমার কথা শোনা উচিত।” কিন্তু তারা এরকম করবে কেন?

মনে রাখবেন, আমরা এখানে বাস্তব এবং অবাস্তবের মধ্যে একটা পার্থক্য তৈরী করছি। আমাদের এটাকে আরও ভাল করা, আরও উন্নতি করা, আরও একাগ্র হওয়া বা যাই হোক না কেন, করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বাস্তবে, আমরা আরও ভাল করতে সক্ষম যা হল একটি বাস্তব প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা যখন ভাবি, “আমাকে সবসময় আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া উচিত। আপনার সবসময় আমার জন্য উপলব্ধ হওয়া উচিত।” এতে কি হয়, যখন আমাদের সঙ্গী কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসে, মনে হয় যেন সারাদিন তার জীবনে কিছুই ঘটেনি আর কোন কিছু না ক’রে এসেছে আর সে এখন আমাদের জন্য সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধ থাকবে। এটা একটা অবাস্তব প্রত্যাশা। তাই নয় কি?

আসুন, আমরা এক মুহুর্তের জন্য বিবেচনা করে দেখি যে, আমাদের মধ্যে অবাস্তব প্রত্যাশা কখন জাগে। উক্ত অবাস্তব প্রত্যাশার মধ্যে আমাদের মধ্যে কত গুলি প্রত্যাশা আছে এবং আমরা কত ভালভাবে তাদের চিনতে পারি? আমরা কি উপলব্ধি করি সেগুলি ক্ষতিকারক এবং যখন আমরা বিশ্বাস করি তখন আমাদের ক্ষতি করে? আমরা কি দেখতে পাই, তারা সংবেদনশীল ব্যথার জন্ম দেয়? পরম পূজ্য দালাই লামা এগুলিকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা-নির্মাতা বলতে পছন্দ করেন।

পাশ্চাত্য দেশে অনেক লোক রায়-ভিত্তিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের মধ্যে অনেকের জন্য, সবচেয়ে কষ্টদায়ক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে একটি হ’ল যে, আমরা যথেষ্ট ভাল নই। এটা অত্যন্ত বিচারণীয়। আমাদের চিনতে হবে যে, কেউ আমাদের বিচার করছে না এবং আমাদের অবশ্যই নিজেদের বিচার করার প্রয়োজন নেই। আমরা বিভ্রান্ত হতে পারি, কিন্তু এর মানে এই নয় আমরা অসম্পূর্ণ বা খারাপ। এটা একটা অত্যন্ত স্ব-ধ্বংসাত্মক অভিক্ষেপ।

দুটি সত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। আমাদের কাছে যেটা সত্য প্রতীত হয়, উদাহরণ স্বরূপ- আমরা যথেষ্ট ভাল না, সেটা আসলে মিথ্যা। এটাকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। অতএব আমাদের এটা বিশ্বাস করা বন্ধ করার চেষ্টা করা উচিত এবং হেতু আর ফলের সাথে জীবন-যাপন করা উচিত। আমরা যদি কিছু অর্জন করতে চাই, তাহলে আমাদের হেতু সম্পাদন করতে হবে। সেটা যদি সম্ভব হয়, তাহলে সেটা করতে হবে; আর যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি আরও একটা ভাল কাজ পেতে চাই, তাহলে আমাদের সেটা সন্ধান করতে হবে। এর জন্য আকাশ থেকে পড়বে বা আমাদের কেউ দেবে ব’লে অপেক্ষা করলে হবে না। এর কারণ এবং ফল আছে। আমাদের সম্ভাব্যতার প্রতি গ্রহণযোগ্য হতে হবে এবং তার সুবিধা গ্রহণ করতে হবে। শুধু ভয়ানক ভেবে পরিস্থিতির মধ্যে তালাবদ্ধ থাকলে হবে না। এরকম করলে আমরা কখনও এগিয়ে যেতে পারব না এবং এই বিষয়ে কিছুই হবে না। এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা অত্যন্ত নেতিবাচক। যেমনকি প্রার্থনায় উল্লেখ করা আছে- “কোনও রকমের নেতিবাচক কর্ম না করা।” এটা শুধু কার্য করা বা কথা বলার ক্ষেত্রে নয়, বরং চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর মধ্যে রয়েছে, আমরা কীভাবে নিজেদের এবং অপরের সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করি।

চার আর্যসত্য

বাস্তবতা থেকে অভিক্ষেপের পার্থক্য করার পদ্ধতিটি হ’ল- চার আর্যসত্যকে আমাদের জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়। পরম পূজ্যজী জোর দেন, “আমাদের দ্বি-সত্য (দুই সত্য) থেকে চার সত্যের দিকে যেতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে প্রথম আর্যসত্য রূপী আমাদের সমস্যা গুলি দ্বিতীয় আর্যসত্য রূপী কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। আমাদের এই অভিক্ষেপ গুলি আছে। এছাড়া, তথ্য সম্পর্কে অবিদ্যা বা অসচেতনতা হ’ল, এই অভিক্ষেপ গুলি বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। আমরা যদি তৃতীয় আর্যসত্য রূপী সেটার নিরোধ অর্জন করতে চাই, মুক্ত হতে চাই, তাহলে চতুর্থ আর্যসত্য রূপী বাস্তবতাকে জানতে হবে অর্থাৎ আমাদের কল্পনার বেলুনকে পটাস্‌ করে ফাটিয়ে ফেলতে হবে।”

এটাকে প্রয়োগ করার জন্য আমাদের বৌদ্ধ হতে হবে না। যেমনকি পরম পূজ্য দালাই লামা বলেন, “এটা একটি সার্বজনীন পদ্ধতি এবং এটাকে আমাদের চার আর্যসত্য হিসাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের এটাকে আর কিছু বলতে হবে না। এইভাবে, এটা বাস্তবে ত্রি-রত্নের দিকে নিয়ে যায়। ঐ তিনটি কী কী সেটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি বুঝতে পারি যে, আমরা যদি সমস্যার কারণটিকে দূর করে ফেলি, সমস্যাটি চলে যাবে। যে অবস্থায় সমস্ত কারণ এবং সমস্যা গুলি চলে যায় আর যে জ্ঞান এটার সম্পর্কে বোধগম্য করায় সেটা হল ধর্মরত্ন। এগুলি হল-তৃতীয় এবং চতুর্থ আর্যসত্য। বুদ্ধ হলেন তারা যারা সম্পূর্ণরূপে সেটা করেছেন আর সংঘ হলেন তারা যারা এটা আংশিকভাবে করেছেন।”

এইভাবে, আমাদের আছে দ্বি-সত্য, চার আর্যসত্য এবং ত্রি-রত্ন আর তার জন্য আমাদের বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বৌদ্ধ হওয়ার বিভাজন লাইন বলতে ভবিষ্যতের জীবন উন্নতি করার জন্য কাজ করার লক্ষ্যকে বোঝায়। তবে, এই পদ্ধতির জন্য পূর্ব এবং অপর জন্মের প্রতি বিশ্বাসের প্রয়োজন আছে। যেমনকি পরম পূজ্যজী নির্দেশ করেছিলেন, “অতীশের সময় তিব্বতে আমাদের যে পারম্পারিক সুত্র প্রবর্তিত হয়েছিল সেটা হল লাম-রিম (মার্গক্রম) অর্থাৎ অনুপ্রেরণার তিনটি স্তর। এগুলির প্রয়োজন হল অপর জন্ম বা ভবিষ্যতের জন্মকে উন্নতি করা, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্ত অপর জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করা এবং তারপর বোধি লাভ করা যাতে সকলকে ভবিষ্যতের জীবন থেকে মুক্তি পেতে সর্বোত্তম সহায়তা করতে সক্ষম হওয়া যায়। এই পুরো কাঠামোটি ভবিষ্যতের জন্ম এবং পুনর্জন্মের উপর নির্ভর করে। যে চারটি ধারণা যা মনকে ধর্মের দিকে অভিমুখ করে এটাও সেই একই জিনিস – পুনর্জন্ম। সম্পূর্ণ মার্গ শ্রদ্ধার উপর আধারিত আর সেখানেও এই ধরণের একটা জিনিস রয়েছে- পুনর্জন্ম।

পাশ্চাত্যদের জন্য অথবা এবং সাধারণ পদ্ধতির জন্য, দ্বি-সত্য, চার আর্যসত্য এবং ত্রি-রত্ন দিয়ে শুরু করা বেশী ভাল। এর পরে, আমরা “হেতু এবং ফল”-এর উপর আলোচনার পরিচয়টা করে দিতে পারি। আমরা যদি সেটা একবারে শুরু থেকে করি তাহলে হেতু এবং ফলের আলোচনার কোন অর্থই থাকবে না। এটা অনাদি কালের মনের দিকে পরিচালিত করে; এবং আমরা যদি অনাদি মনকে বুঝতে পারি, তাহলে আমরা পুনর্জন্মকে বুঝতে পারব। এই মুহুর্তে, আমরা ভবিষ্যতের জীবনকে উপকৃত করতে এবং সংসার অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্তির কামনা করব। যখন আমাদের প্রবৃত্তি পুনর্জন্মে বিশ্বাসের উপর আধারিত ‘লম-রিম’ বা ‘মার্গক্রমে’ হয় তখন সেটা স্থিতিশীল হয় না। এর মানে এটা নয় যে, সেটার উপর আধারিত মার্গক্রমের অনুশীলন অর্থহীন। কিন্তু এটা ঠিক যে, এটা আরও স্থিতিশীল হবে যদি আমরা সেই জায়গায় পৌঁছতে পারি যেখানে তিব্বতীরা পারম্পরিক ভাবে পুনর্জন্মে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে শুরু করেন।

দ্বি-সত্যের এই পরিকল্পনা এটাও নির্দেশ করে যে, আমরা কীভাবে শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনে একীভূত করতে পারি। এটা শুরু হয় আমাদের অভিক্ষেপ এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য দিয়ে অর্থাৎ আমরা অভিক্ষেপ করি এবং সেই অভিক্ষেপ গুলিকে ভুল বিশ্বাস রূপে স্বীকার করি। এই সমস্ত সম্পাদন করতে হবে বিনা বিচারে। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ওটা দিয়ে সাহায্য করবেন কিন্তু আপনি করেননি।” অথবা “আমি ভেবেছিলাম আপনি এটা সঠিক ভাবে করবেন কিন্তু আপনি করেননি।” আমাদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে, আমরা কাউকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম এই আশা ক’রে যে, সে সেটা ভালভাবে করবে কিন্তু তারা করেনি। তখন আমরা কী করি? আমরা নিজেরাই সেটা করি। আমাদের কি সেই ব্যক্তির উপর রাগ করলে হবে? এতে কোনও লাভ হয় না। এর পরিবর্তে, ভবিষ্যতে তাকে এই ধরণের কাজের দায়িত্ব দেবেন না অথবা শিখিয়ে দিন কীভাবে সেটাকে সঠিক ভাবে করতে হয়। বাস্তবতার সাথে মোকাবিলা করুন। আমরা দুঃখিত হই আমাদের প্রত্যাশার কারণে যে, ঐ ব্যক্তিটি কোনও নির্দেশনা ছাড়াই এটা সঠিক ভাবে করে দেবে। আমরা আশা করতে পারি যে তারা করবে; সেটা আলাদা। প্রত্যাশা না থাকলে কোন হতাশা থাকবে না।

বিশৃঙ্খল আবেগ

আমরা যখন এই লাইনটা অনুসরণ করতে চাই, “কোনও নেতিবাচক কর্ম না করা”, তখন আমাদের সনাক্ত করতে হবে যে, আমরা যখন যেভাবে আচরণ করি, কথা বলি বা চিন্তা-ভাবনা করি তখন কিন্তু বিশৃঙ্খল আবেগের প্রভাবে থেকেই করি। একটা বিশৃঙ্খল আবেগের সংজ্ঞা হল- মনের একটা অবস্থা যা বিকাশকালে আমাদের মনের শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করে। আমরা যখন রেগে যাই, তখন আমাদের মনে শান্তি থাকে না। এর ফলে আমরা যা বলি এবং করি পরে তার জন্য অনুতাপ করতে হয়। আমরা লোভী হই বা কারও প্রতি অনুরক্ত হই, এটা তখন মনের শান্ত অবস্থা হয় না। আমরা কিছু বলি এবং পরে হাস্যকর বলে বিবেচনা করি। প্রায়শই অধিক চাহিদা এবং অনুরক্ততার কারণে এটি অন্য ব্যক্তিকে তাড়া করে।

আমরা কখন বিশৃঙ্খল আবেগের প্রভাবে কাজ করি সেটা আমাদের সনাক্ত করতে হবে। আমরা যখন আমাদের নিজস্ব শক্তির প্রতি কিছুটা সংবেদনশীল হয়ে উঠি, তখন আমরা অনুভব করি যে, কোনও অন্তর্নিহিত শত্রুতা বা সুদৃঢ় থাকলে আমরা কিছুটা ঘাবড়ে যাই। এই ধ্বংসাত্মক এবং বিশৃঙ্খল আবেগ গুলি জন্ম নেয় অবিদ্যা থেকে, আমাদের অসচেতনতা থেকে। আমরা হেতু এবং ফল সম্পর্কে অসচেতন। এর মানে এটা নয় যে, আমরা বোকা। আমরা অসচেতন যে, জিনিসগুলি আসে হেতু এবং ফল থেকে; আর আমরা অসচেতন যে, আমাদের অভিক্ষেপ গুলি বাস্তবতার সঙ্গে মিল খায় না। ‘সপ্ত বুদ্ধি-শোধন’ নামক গ্রন্থে সংক্ষেপে বলা হয়েছে- 

সমস্ত দোষ একটি বস্তুর উপর রাখুন, স্ব-লালিত করুন। 

এর অর্থ হল, আমরা সব সময় সুদৃঢ় হই যে, সব কিছু আমাদের মতো চলুক, যেভাবে আমরা সেগুলি হওয়াতে চাই। এটি “আমারটা প্রথম” মনোভাব অর্থাৎ “আমি যেভাবে অভিক্ষেপ করি এবং আশা করি জিনিস গুলি সেরকম হওয়া উচিত।” আমাদের সমস্যা দোষারোপ করা মনোভাব খুবই সহায়ক পরামর্শ। উদাহরণ স্বরূপ, আমি চেয়েছিলাম এই রেস্তোঁরাটি নিখুঁত হোক” অথবা “আমি চেয়েছিলাম এই সন্ধ্যাটি নিখুঁত হোক” অথবা “আমি চেয়েছিলাম আপনি আমার প্রতি এইভাবে আচরণ করবেন”। এসব কিছুই “আমি, আমি, আমি” ধারণা থেকে জন্ম নেয়। আমরা শুধু “আমার” কথা ভাবি, আপনার কথা নয়। আমরা ভাবি না যে, কাউকে হয়তো একটা কঠিন দিন কাটাতে হয়েছে অথবা অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এটি শুধু ‘আমি’ এবং ‘আমরা কী চাই’ সম্পর্কিত।

এগুলি হল- কয়েক ধরণের সমস্যা যা আমরা মনোনিবেশ করতে চাই এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন করতে চাই। জীবনের প্রতি বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি হল, আমাদের সমস্ত সমস্যার দোষারোপ স্ব-লালিত। এর অর্থ হল- স্বার্থপর এবং স্বার্থকেন্দ্রিক হওয়া। এটা এই পরামর্শ দেয় না যে, আমরা পুরোপুরি ভাবে আমাদের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করব, বরং অপরের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা ক’রে আমরা আমাদের প্রয়োজনকে একমাত্র জিনিস হিসাবে গ্রহণ করব না। এটা একটা মৌলিক পদ্ধতি।

“যেটা গঠনমূলক সেটাকে সমৃদ্ধ ভাবে করা”, এর অর্থ হল- রাগ না ক’রে, লোভী না হয়ে বা অভাবী না হয়ে বোঝাপড়ার সাথে আচরণ করা। আমরা এমন এক ধরণের ব্যক্তি হওয়া থেকে বাঁচতে চাই যার অনুমোদন এবং সব সময় মনোযোগ প্রয়োজন হয়। আমরা যখন উক্ত মনোভাবের প্রভাবে কাজ বা আচরণ করি, তখন আমরা সমস্যা তৈরী করি। তাই নয় কি? আমরা অপরের জন্য অবাস্তব দাবি করি এবং হতাশ হয়ে যাই। গঠনমূলক ভাবে কাজ করার অর্থ হল- উক্ত মনোভাব ছাড়া কাজ করা। এর অর্থ এই নয় যে, গভীরতম স্তরে আমরা এই বিশৃঙ্খল আবেগ এবং মনোভাব থেকে নিরোধ সত্য লাভ করেছি, বরং আমরা সক্ষম হই তাদের শক্তিশালী প্রভাবের অধীনে কাজ না করতে।

জীবন হল আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

আমরা শিশুসুলভ হতে চাই না এবং অন্যের গুণাবলীকে স্বীকৃতি জানাতে চাই না। আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের যেমন অনুভূতি রয়েছে তেমন অন্যদেরও অনুভূতি রয়েছে। আমরা যেমন প্রত্যাখ্যাত বা অগ্রাহ্য হতে চাই না তেমনই অন্যরাও অগ্রাহ্য বা প্রত্যাখ্যাত হতে পছন্দ করেন না। এই বোধশক্তিকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। এটা করার জন্য, আমাদের নিজের মনকে পূর্ণতঃ দমন করতে হবে। যেমনটি আমাদের প্রার্থনার তৃতীয় লাইনে বলা আছে।

আমাদের জীবনকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রূপে দেখা খুবই উপকারী। অনুশীলনেরও অভিপ্রায় এটাই। নিশ্চিত ভাবে এটা কেবল মনোরম পরিবেশে একটা আসনে বসা, যেখানে মোমবাতি আর ধূপ থাকে, নীরবতা থাকে এবং কান্না করা শিশুরা না থাকে, এর মধ্যে সীমিত নয়।

একবার আমি একটি বৌদ্ধ কেন্দ্রে গিয়েছিলাম যেখানে আমার একজন ছাত্র উপদেশ দিচ্ছিলেন এবং সেখানে কেউ তাদের সাথে দুই বছরের শিশুকে নিয়ে এসেছিল। অধিবেশন চলাকালীন শিশুটি শিক্ষণ কক্ষে ছুটে বেড়াচ্ছিল। আমরা দুই বছরের শিশুর থেকে আর কীই বা আশা করতে পারি- তারা কি দেড় ঘন্টা ধরে এক জায়গায় নিশ্চলভাবে বসে থাকতে পারে? শিক্ষক মহাশয় বলেছিলেন যে, বাচ্চাটিকে ক্লাসে নিয়ে আসাটা নিখুঁত ছিল; আমরা যখন ধ্যান করার চেষ্টা করছিলাম তখন এই ছোট্ট শিশুটি চারিপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল এবং প্রচন্ড কোলাহল করছিল। এটা ধ্যান করার সময় একটা বিস্ময়কর চ্যালেঞ্জ ছিল। এটাই আসল ধ্যান অনুশীলন। আমরা কি এই পরিস্থিতিতে অশান্ত বা বিক্ষিপ্ত না হয়ে ধ্যান সাধনা করতে পারি? এর অর্থ এই নয় যে, সন্তানের আঘাত এড়াতে অভিভাবকরা মনোযোগ দেন না। কিন্তু আমরা কি বাইরের ট্রাফিকের জোর শব্দের সাথে ধ্যান অনুশীলন করতে পারি অথবা যখন আমরা ট্রাফিকের মধ্যে যাই তখন?

এটাই হল জীবন এবং জীবনই অনুশীলনের ক্ষেত্র হওয়া উচিত, আমাদের অজ্ঞান, অসচেতনতা এবং বিশৃঙ্খল আবেগ গুলির বিরুদ্ধের একটি সত্যকারের যুদ্ধক্ষেত্র হওয়া উচিত। বোধিসত্ত্ব রত্নমালায়, অতীশ স্পষ্টভাবে বলেছেনঃ

অনেকের মধ্যে থাকাকালীন, আমাদের বাণীর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। একা থাকাকালীন, আমাকে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

এটি খুব উপকারী বাণী। আমরা যখন অন্যের সাথে থাকি, তখন কীভাবে তাদের সাথে কথা বলি তা লক্ষ্য করতে হবে। কেবল শব্দ নয়, বরং কন্ঠের সুর, আবেগ এবং তাদের পিছনের মনোভাবের প্রতিও। যদি আমরা দেখি যে, আমরা বিদ্বেষ এবং অহংকারের সাথে কথা বলছি, তবে লক্ষ্য করতে হবে এবং স্বর নামাতে হবে। যখন আমরা একলা থাকি, এটা আমাদের মনের উপরও প্রযোজ্য হয়। সব লক্ষণ “আমি অভাগা, কেউ আমার প্রশংসা করে না।” দেখতে হবে, আমরা কী ভাবছি।

এটা আমাদের নিয়ে যায় “সপ্ত বিন্দু বুদ্ধি-শোধন”-এর দিকে, যেখানে বলা হয়েছে যে, আমাদের তিনটি কঠিন জিনিসের প্রতি সচেতন থাকতে হবে- প্রতিপক্ষের প্রতি মনোযোগী হওয়া- মনোযোগী থাকার অর্থ হল তাদের স্মরণে রাখা; প্রয়োগ করার জন্য মনোযোগী হওয়া; এবং বজায় রাখার জন্য মনোযোগী হওয়া। মনোযোগী হওয়ার জন্য এগুলি সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা অনুস্মৃতির (মননশীলতা) অনুশীলন সম্বন্ধে শুনি, তবে এর অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমে এটাকে যেমন ভাবে বোঝা হয় যে, আমরা কেবল বর্তমান ক্ষণে রয়েছি। “অনুস্মৃতি” শব্দের অর্থ হল মনে রাখা বা স্মরণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা যা করছি তা হ’ল আবর্জনা এবং তারপরে এই উপলব্ধিটি প্রয়োগ করতে হবে এবং এটি চালিয়ে যেতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে এটিই আসল অনুশীলন।

অপরিকল্পিত এবং কল্পিত অবস্থা

আমরা সমস্ত বৌদ্ধ পরামর্শে শ্রবণ করি যে, আমাদের কল্পনাবিহীন হতে হবে, কল্পনাযুক্ত নয়। এটার মানে কী? অবশ্যই আমরা একটি খুব প্রযুক্তিগত সংজ্ঞা এবং বিশ্লেষণ পাঠ করতে পারি, কিন্তু আমরা যদি এটির ব্যবহারিক স্তরে তাকাই, তাহলে আমরা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করি সেটা হচ্ছে যে, এটি প্রয়োগ করার জন্য এই বিষয়গুলি সম্পর্কে ভাবতে হবে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে আমরা কোন বিমান বা ট্রেন ধরতে পারিনি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য হল যে, অনিত্যতার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা না করা এবং কীভাবে হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে সমস্ত কিছু প্রভাবিত হয় এবং যদি আমরা রাগ করি তাহলে এতে আমাদের কোনও লাভ হয় না। আমাদের প্রাথমিক স্তরেই এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে হবে, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হল যে, পরবর্তীতে এগুলি যে স্বতঃস্ফুর্ত হয়। আমাদের এই বিষয়গুলি সম্পর্কে আর ভাবতে না হয়, এটা যেন স্বতঃস্ফুর্ত থাকে। স্বাভাবিক ভাবে, আমরা এই অনাবশ্যক প্রতিক্রিয়া না ক’রে যেন নমনীয় থাকি।

এটিই আমাদের লক্ষ্য। এটা কোন রহস্যময় অবস্থা নয়। হতে পারে এটি সম্পূর্ণ গভীর অপরিকল্পিত অবস্থা নয়, তবে একটি অপ্রযুক্তিগত উপায়ে আমরা এটি অর্জনের জন্য অনুশীলন করি। আমরা নিজের এবং অন্যের জন্য আরও বেশি দুঃখের জন্ম না দেওয়ার জন্য এই সমস্ত শিক্ষাকে আমাদের জীবনে সংহত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য অনুশীলন করি। এটাই হল সবকিছু।

প্রশ্নাবলীঃ

একটি পরিকল্পনা অনুসরণ করতে কখন নমনীয় হতে হবে

আমি মনে করি যে, আমি নমনীয় এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাই, কিন্তু এটা সর্বদা সত্য হয় না। বাস্তবতা জানার ক্ষেত্রে আমি যে সমস্যার মুখোমুখি হই সেটা হ’ল কখন কোন পরিকল্পনাকে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ আর কখন ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়, কী পরিবর্তন করা যেতে পারে, কী পরিবর্তন না করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ,আমি ট্রেনটি ধরতে পারি নি, আমি ছুটে গিয়ে একটি ট্যাক্সি ধরলাম এবং পরের স্টেশনে ট্রেনটি ধরলাম। আমরা কী ভাবে বিচার করব যে, কখন আমাদের পরিকল্পনার জন্য লড়াই করাটা কার্যকর হবে?

একটি পরিকল্পনা অনুসরণ করা অথবা ত্যাগ ক’রে দেওয়ার সাথে বেশ কয়টি কারণ জড়িত থাকে। আমাদের দেখতে হবে এর কোনও বিকল্প আছে কিনা এবং এটা পরিবর্তন করা যায় কিনা, যেমন আপনার ট্যাক্সি ধরা এবং পরের স্টেশনে ট্রেন ধরার উদাহরণ। যদি কোন ট্যাক্সি উপলব্ধ না থাকে, তাহলে আমাদের হাল ছেড়ে দিতে হবে। এটি ব্যবহারিক স্তরের একটি উদাহরণ। কিন্তু অন্য একটি স্তরের ক্ষেত্রে, ধরুন আমরা একটি স্কুলে ভর্তির আবেদন করেছি, কিন্তু আমরা এই বছর প্রত্যাখ্যাত হলাম। এই পরিস্থিতিতে আমরা কি হাল ছেড়ে দিই, না পরের বছর আমরা আবার আবেদন করব? আমাদের মুল্যায়ণ করতে হবে। আমরা যদি অন্য কোথাও ভর্তি না হতে পারি তাহলে পরের বছর আবেদন করাতে নেতিবাচক কিছু নেই। এই সময় পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করতে হবে যে যথার্থটা কী। আমরা আমাদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা অতিরঞ্জিত করে দেখছি না তো? আমাদের অন্যান্যদের মতামতও জিজ্ঞাসা করতে হবে।

প্রত্যেক ব্যক্তির পছন্দ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন; এটার কোন বিশেষ উত্তর নেই যা সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। আমাদের লক্ষ্য অর্জনের কারণ গুলি কী, সেটা পরীক্ষা করা দরকার। কারণ, বস্তুর উদ্ভব হয় হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে। এই কারণ গুলি এবং পরিস্থিতি গুলি কি পূরণ হচ্ছে? ঐ হেতু এবং প্রত্যয় গুলির কি সংযোগ হয়? এখন যদি তাদের সংযোগ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কি সংযোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? বিকল্প আছে কি? আমাদের এই সিদ্ধান্ত গুলি এবং পরিবর্তন গুলির দিকে খুব যুক্তিযুক্ত পদ্ধতিতে এগোতে হবে।

অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ব্যক্তি হওয়া

আমি কীভাবে নিজেকে একটি দুঃখের ফাঁসে আটকে রেখেছি তা আমার জন্য নতুন। আমি মনে রাখার চেষ্টা করি যে, আমার অভিক্ষেপ গুলি যৌক্তিক নয়, তবে আমার অনুভূতি গুলি আলাদা এবং আমি পিছিয়ে যাই। নিজেকে অবমুল্যায়ন না করার অনুশীলন করার জন্য আমি কী করতে পারি, কারণ স্মরণ করা এখন কঠিন?

প্রায়শই আমরা জানি যে, কী করলে উপকার হতে পারে আর সর্বোত্তম কী হতে পারে, কিন্তু আমাদের আবেগ গুলি এতটাই শক্তিশালী হয় যে, এটির সম্পর্কে কিছু করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটি আসলে একটা খুব সাধারণ ঘটনা। আমাদের আরও ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করা দরকার, অর্থাৎ নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে, যদিও আমি খুব আবেগপ্রবণ এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারি ইত্যাদি। এটা এমন কিছু নয় যা আমি এতো গুরুত্ব সহকারে নেব।

এর অর্থটাকে ভুল না বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা খুব মন খারাপ করতে পারি এবং কোন কিছু দ্বারা উৎসাহিত হতে পারি; কিন্তু এই জিনিস গুলি পেরিয়ে যায়। মেজাজ এবং আবেগ স্থির থাকে না, বদলে যায়। সেগুলি ধরে রেখে তার সাথে অভিন্ন হওয়া উচিৎ নয়। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি খুব মর্মাহত, কারণ আমি সব গণ্ডগোল করেছি এবং আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারি নি, আমি ভাল নই।” ঐরকম চিন্তা-ভাবনা ক’রে আমরা আমাদের মেজাজকে সনাক্ত করি এবং তাই এটিকে আমরা ধরে রেখে দিই। আমরা মনে করি, আমরা যা অনুভব করছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বা বিশেষ, তবে তা নয়। এটি শুধু একটি ক্ষণস্থায়ী মেজাজ। আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, আমরা বাস্তবে এটার আকাঙ্ক্ষী নই। আমাদের নিশ্চিত হওয়া উচিত যে, যেহেতু এই মেজাজটা অতিক্রম করবে, এতএব এটাকে অতিক্রম করতে দিই। গভীর ভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, এটি ছিল আমাদের কাছে অবাস্তব প্রত্যাশা। আমরা আঘাত অনুভব করি, কিন্তু সেই আঘাতটি অতিক্রম করে। আমরা সেই আঘাতটিকে এতো গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করব না যে, এটাই যেন পৃথিবীর শেষ।

পারম্পরিক ভাবে, একটি মেজাজকে আকাশের মেঘ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে এবং এটা অতিক্রম করে। আসলে শুরু করার জন্য এটার মোকাবিলা করাটাই একমাত্র উপায়। এছাড়াও, আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আবেগ গুলি উত্থান-পতন করতে থাকে। আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ অন্যের তুলনায় অনেক বেশী সংবেদনশীল। ঠিক আছে, আমাদের এটির সম্পর্কে বিচার করা আবশ্যক নয়। এটি বাস্তবতাকে গ্রহণ করারই একটা অঙ্গ। বাস্তব হ’ল আমরা এখন এখানে আছি, আমরা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারি এবং তাড়াতাড়ি দুঃখিত হয়ে উঠতে পারি, তবে আমাদের এটাকে ধরে রাখলেই হবে না। বাস্তবতা কী তা জানতে দৃঢ় ভাবে আরও বেশী কাজ করতে হবে। 

উদাহরণ স্বরূপ, “আমি একান্তবাসের জন্য গিয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম যে আমার দুর্দান্ত সমাধি হবে, কিন্তু পুরো সময় আমার মন সব জিনিসের উপর ঘুরে বেড়ালো”। ঠিক আছে, আমাদের একটি অবাস্তব প্রতাশা ছিল। তবে মন ঘুরে বেড়াবে অবশ্যই এটা খুব ভাল নয়। প্রত্যাশা কম ক’রে এবং এটি সম্পর্কে আন্তরিক ভাবে অনুভব করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি সর্বোচ্চ স্তর লাভ করতে পারি, তবে এটি কারণ এবং ফলের উপর নির্ভর না করে আসবে না। আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে”।

এছাড়াও, আমরা যদি খুব আবেগী হই, তবে সেই প্রবণতাটিকে রুপান্তরিত ইতিবাচক আবেগ উৎপন্ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে আমরা আরও বেশী মৈত্রী এবং করুণার অনুভব করতে সক্ষম হব। এই অর্থে, আবেগী হওয়া একটি ইতিবাচক বিষয়। সবশেষে, কিছু মানুষ রয়েছে যারা খুব বুদ্ধিমান হন, তাদের জন্য কোন আবেগ অনুভব করা খুব কঠিন হয়ে যায়। তাদের জন্য বাস্তবে মৈত্রী এবং করুণাকে অনুভব করা খুব কঠিন হয়। যদি আপনি একজন খুব আবেগপ্রবণ ব্যক্তি হন, তাহলে ইতিবাচক কিছু ইতিমধ্যেই রয়েছে, এটিকে শুধু রূপান্তরিত করতে হবে। যদি আপনি কারণ এবং ফল প্রয়োগ করেন তবে এটি ক্রমশঃ হতে থাকবে। 

আমাদের সুখ-সুবিধার জায়গার বাইরে কাজ করা

আমরা এই সমস্ত অনুশীলন করি এবং আমরা দেখি যে, সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষদের দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা কখনও বুঝতে পারব যে, আমরা আমাদের সুবিধাজনক স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে এবং এমন কিছু বিষয় গুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হই যা আমাদের আবেগগত ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাবে?

এটি যা গঠনমূলক বা ধ্বংসাত্মক, তার সাথে সম্পর্কিত।  উদাহরণ স্বরূপ, নিজের সুবিধাজনক স্থানের বাইরে বেরিয়ে কোনও মদের দোকানে গিয়ে মাতাল লোকেদের সঙ্গে সময় কাটানো গঠনমূলক নাও হতে পারে। আমরা বলতে পারি যে, একজন বোধিসত্ত্ব নরকে যেতে পারেন সেখানকার প্রাণীদের সাহায্য করার জন্য, কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের জন্য সেটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের সুবিধাজনক স্থান থেকে বেরিয়ে গঠনমূলক কিছু করতে পারা যেমন রাস্তার গৃহহীন ব্যক্তির সাথে কিছু কথা বলার মতো, কিছুটা আলাদা।

সর্বপ্রথমে যেটা আলাদা করতে হবে সেটা হ’ল আমরা যা করতে চাই তাতে সুবিধাজনক স্থানের বাইরে এই পরিস্থিতি কতটা উপকারী হতে পারে। কিছু যুবক হয়তো কোন ক্লাবে গিয়ে টেকনো সংগীতের তালে সারা রাত নাচতে পারে। আমাদের সুবিধাজনক স্থানের বাইরে গিয়ে তা করা কি আমাদের কোনো উপকারে লাগবে? এটা সুবিধাজনক স্থানের বাইরে যাওয়া তো বটে, যতক্ষণ না আমরা আমাদের নেতিবাচক বিচারগত আবেগ গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, এতে ইতিবাচকও কিছুই থাকে না। কিন্তু এই আবেগকে কাটিয়ে ওঠার জন্য সারারাত নাচ করা এবং খুব জোর সংগীতের কারণে বধির হওয়া আব্যশক নয়। যদিও নিজের সুবিধাজনক স্থানের বাইরে  যাওয়ার জন্য অন্য পথও আছে, যেমন শরণার্থীদের জন্য কাজ করা। আমাদের সুবিধাজনক স্থানের বাইরে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করা গঠনমূলক এবং ইতিবাচক হবে এবং আমাদের উদারতা বিকাশে সহায়তা করবে। বার্লিনে আমার একটি ছোট্ট সাপ্তাহিক আলোচনার ক্লাস আছে। আমরা সকলেই বন্ধু। ক্লাস শেষে খাবার খাওয়ার জন্য বাইরে যাই। একবার আমি প্রশ্ন করেছিলাম যে, দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম তাদের কীভাবে সহায়তা করে। আমার ক্লাসের একজন শিক্ষার্থী বলেছিলেন যে, তিনি তার সুবিধাজনক স্থান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তিনি আরও মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন এবং যারা দেখতে ভালো সেই মানুষদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছেন। এক অর্থে তিনি নিজেকে অন্য মানুষদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন, তিনি কাজের জায়গায় এমন কারও সাথে বন্ধুত্ব করবেন, যিনি অত্যন্ত স্থূল, যিনি দেখতে খুব ভালো নন এবং যিনি আকর্ষনীয়ও নন। তিনি সত্যিই দেখতে চেয়েছিলেন যে, এমন একজন মানুষ যিনি সুখী হতে চান, পছন্দের হতে চান, এবং অপছন্দের বা উপেক্ষিত হতে চান না। এই ব্যক্তিটি একটি নতুন ভালো বন্ধু, একজন রত্ন হতে পারেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই ব্যক্তিকে উপেক্ষা করবেন না। এটি আমাদের সুবিধাজনক স্থানের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনও কিছুর একটি খুব ভালো উদাহরণ। এরকম জিনিসগুলি খুব সহজে করা যায়। যদি আমরা আমাদের সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে যাই, তবে সেটি ধাপে-ধাপে বরণ করা সম্ভব হবে, অগম্য নয়।

অন্য এক বন্ধু এক অন্য চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি তার সুবিধাজনক স্থান থেকে সবসময় বাইরে যেতে পছন্দ করেন। তাই তিনি পার্কে চলে যেতেন যেখানে মাদক বিক্রেতারা মাদক বিক্রি করতেন এবং তিনি তাদের সাথে সময় কাটাতেন। তিনি এটা করেছিলেন কারণ তিনি ঐ মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাতে অস্বস্তি বোধ করতেন। আমি এতে কিন্তু কোনও লাভ দেখছি না। এটা করা একপ্রকারের খুব সাহসী প্রদর্শন।

এটা একটা আকর্ষনীয় প্রশ্ন যে, আমাদের সুবিধাজনক স্থান থেকে কীভাবে বাইরে যেতে এবং আমাদের সুবিধাজনক স্থান বলতে আসলে কী বোঝায়। এটা ভাবা যে কোন সীমা পর্যন্ত আমদের সুবিধাজনক স্থানের পরিধি যেখানে আমরা সুরক্ষিত অনুভব করি? সুবিধাজনক স্থান কী? এটা নিজের মধ্যে বিশ্লেষণ করার মত বিষয়। আমরা কি যে কোনো পরিস্থিতিতে যেকোন ব্যক্তির সাথে স্বচ্ছন্দ অনুভব করতে পারি?

এর মূল চাবিকাঠিটি হ’ল একটি জিনিসের উপর দোষ চাপানোঃ আত্ম-পোষণ। আমরা যখন কোন পরিস্থিতি বা ব্যক্তির সাথে অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি, এর কারণ হল, তখন আমরা “আমি, আমি, আমি’’ সম্পর্কেই ভাবি। উদাহরণ স্বরূপ আমরা মনে করি, “আমি এটা পছন্দ করি না এবং আমি এটা পরিচালনা করতে পারব না,’’ আমরা অন্যদের সম্পর্কে ভাবি না। এটা অন্যের প্রতি আগ্রহী হওয়া এবং দেখার বিষয় যে, আমরা সকলেই মানুষ।

সারাংশ

এগুলি হ’ল কিছু খুব মৌলিক নীতি। যদি আমরা এত স্বার্থপর এবং আত্ম-কেন্দ্রিক হওয়া বন্ধ করতে পারি তাহলে আমরা আরও সুখী হতে পারব। যখন আমরা অন্য কোন ব্যক্তির সাথে থাকি, তখন কেবল নিজের বিষয়ে কথা বলার পরিবর্তে, আমরা যদি সেই ব্যক্তির প্রতি আন্তরিক আগ্রহ দেখাই এবং তার জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, তাহলে আমরা আরও সুখী হব এবং অবশ্যই অন্য ব্যক্তিটিও আরও সুখী হবে। জীবনের সাথে এবং অন্যের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে এগুলি হল মৌলিক এবং ব্যবহারিক পরিবর্তন। এটি মনে রাখার জন্য আমরা লাভ করতে চাই সেই অনুস্মৃতি। আমরা যখন স্বার্থপর হয়ে যাই বা কেবল নিজের সম্পর্কেই চিন্তা করতে থাকি, তখন এই পরামর্শটি প্রয়োগ করার কথা মনে রাখতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি অন্য ব্যক্তিটি ব্যস্ত থাকে এবং চলে যেতে চান, আমরা কিন্তু কথা বলতেই থাকি। আমরা ভাবি যে, আমাদের যেটা বলতে হবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্য ব্যক্তিটি কি সত্যিই এটা শুনতে ইচ্ছুক? না, কিন্তু আমরা ভাবি যে, তিনি শুনতে ইছুক। জীবনই হ’ল সেখানে যেখানে আমাদের ধর্ম প্রয়োগ করা আবশ্যক।

Top