বৌদ্ধ পথে চলার আগে পরামর্শ

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ গুলির মোকাবিলা করি বৌদ্ধধর্ম তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত অসুবিধা গুলিকে পরিহার করে চলতে ব্যবহারিক প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা শেখায়। এটা দেখতে পায় যে, আমাদের সমস্যার উৎসটি রয়েছে আমাদের বিভ্রান্ত চিন্তা-ভাবনা এবং অবাস্তব মনোভাবের মধ্যে। এগুলিই আমাদের আবেগ মূলক বিপর্যয় বা মানসিক বিপর্যয় এবং এগুলি আমাদের বাধ্যতা মূলক আচরণকে চালিত করে। আমরা ধ্যানের মাধ্যমে আমাদের অভ্যাসগত অকার্যকর চিন্তা-ভাবনা এবং কাজ-কর্মের মোকাবিলা করব এবং অন্যের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা, যাদের অনুপ্রেরণা বেশী মৈত্রীময় এবং ইতিবাচক হয়, যার দ্বারা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গুণ উন্নত করতে আমাদের মনকে রূপান্তর করব।

আমরা যদি জানতে চাই যে বৌদ্ধধর্ম কী এবং এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু প্রযোজ্য, তাহলে আমাদের দেখার একটা ভাল জায়গা হল- বৌদ্ধ শিক্ষা এবং অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত পারম্পারিক শব্দের সংজ্ঞাটি অর্থাৎ ধর্ম। ‘ধর্ম’ একটা সংস্কৃত শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘প্রতিরোধ ব্যবস্থা’। এটা এমন কিছু যা আমরা করি সমস্যা গুলিকে পরিহার করে চলার জন্য। যদি আমরা সেটা বুঝতে পারি তাহলে বুদ্ধ যা শিখিয়ে ছিলেন তার প্রত্যেকটির পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিল সেটা বুঝতে পারব।

প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কোন আগ্রহ জাগানোর জন্য আমাদের দেখতে হবে যে, জীবন সমস্যায় জর্জরিত; এটাকে এড়িয়ে চলার জন্য আসলে চাই অনেক সাহস। অনেক মানুষ আছে যারা নিজেকে বা নিজেদের জীবনকে গম্ভীর ভাবে নেয় না। তারা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে; তারপর সন্ধ্যাবেলা নিজেদেরকে বিনোদন ইত্যাদিতে বিক্ষিপ্ত করে তোলে; কারণ তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারা সত্যিই অভ্যন্তরীণ ভাবে তাদের জীবনের সমস্যা গুলির দিকে তাকায় না। এমনকি তারা যদি তাদের সমস্যার দিকে তাকায়ও, তারা কিন্তু সত্যিই স্বীকার করতে চাইবে না যে, তাদের জীবন সন্তোষজনক নয়, কারণ এটা তাদের মনমরা করে তুলবে। বাস্তবে আমাদের জীবনের গুণগত মূল্যকে সত্যি-সত্যিই পরীক্ষা করাও যখন এটাকে অসন্তুষ্টি জনক রূপে পাই তখন সেটাকে সৎভাবে স্বীকার করার জন্য সাহসের প্রয়োজন হয়।

অসন্তুষ্টি জনক পরিস্থিতি এবং তাদের কারণগুলি

অবশ্যই অসন্তুষ্টির স্তর রয়েছে। আমরা বলতে পারি, “কখনও-কখনও আমাদের মেজাজ খারাপ থাকে এবং কখনও-কখনও সবকিছু ঠিকঠাক চলে। ঠিকই আছে, কারণ সেটাই তো জীবন।” আমরা যদি তাতে সন্তুষ্ট হই তাহলে তো বেশ ভাল কথা। আমাদের যদি কোন আশা থাকে যে, আমরা জিনিস গুলি আরও ভাল তৈরী করতে পারি, এর জন্য এটা আমাদের একটা উপায় খুঁজতে পরিচালনা করে। আমাদের জীবনের মান উন্নত করতে প্রয়োজনীয় উপায় খোঁজার জন্য আমাদের সমস্যা গুলির উৎস খুঁজতে হবে। অধিকাংশ মানুষ তাদের সমস্যার উৎসকে বাহ্যিক ভাবে খোঁজ করেন। “আপনার কারণে আপনার সাথে আমার সম্পর্ক রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি যেভাবে চাই আপনি সেভাবে আচরণ করেন না।” আমরা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও আমরা আমাদের অসুবিধা গুলিকে দোষারোপ করতে পারি। কিছু মনোবৈজ্ঞানিক স্কুলের মতে, আমরা আমাদের শৈশব কালের ট্রমাজনিত বা আঘাত মূলক ঘটনা গুলির দিকে তাকাতে পারি এই জানার জন্য যে, আমাদের যে সমস্যা আছে সেই সমস্যাটা উদ্ভূত হওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল। অন্যের প্রতি আমাদের যে অসুখীতা আছে তার দোষারোপ করা খুবই সহজ। আসলে অন্য লোক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণ গুলির উপর দোষ চাপানো একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আমাদের যদি এই ধারণাগত কাঠামো থাকে তাহলে আমরা ক্ষমা করে দিতে পারি এবং এতে কিছু উপকার হতে পারে। তবে অধিকাংশ মানুষ দেখিয়েছে যে, শুধুমাত্র এইটুকু কর্ম তাদের মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যা এবং অসুখীতা থেকে পরিত্রাণ দেয় নি।

বৌদ্ধধর্ম বলে, যদিও অন্যান্য লোকজন, সমাজ ইত্যাদি আমাদের সমস্যার সমাধানে অবদান দেয় কিন্তু সেগুলি আসলে এর গভীরতম উৎস নয়। আমাদের সমস্যা গুলির গভীরতম উৎস আবিষ্কার করার জন্য আমাদের ভিতরে অবলোকন করতে হবে। সর্বোপরি, আমরা যদি জীবনে অসুখী বোধ করি তাহলে এটি আমাদের পরিস্থিতির প্রতি প্রতিক্রিয়া করা হয়ে যাবে। বিভিন্ন মানুষ একই পরিস্থিতির বিভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া করে। এমনকি আমরা যদি শুধু আমাদের দিকেও তাকাই আমরা দেখব যে আমরা প্রথমদিন থেকে পরের দিন গুলিতে সমস্যা গুলির আলাদা ভাবে প্রতিক্রিয়া করি। যদি সমস্যার উৎস শুধু বাহ্য পরিস্থিতি হতো তাহলে আমাদের সর্বদা একই ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত ছিল, কিন্তু আমরা সেরকম করি না। এমন কিছু কারণ রয়েছে যা আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া করি সেটাকে প্রভাবিত করে, যেমন- কর্মক্ষেত্রে একটা ভাল দিন কাটানো। তবে এগুলি হল শুধুমাত্র অগভীর অবদানের কারণ; তারা গভীর ভাবে যথেষ্ট নয়।

আমরা যদি লক্ষ্য করি যে, আমরা কেমন অনুভব করি তাহলে আমরা দেখতে শুরু করি যে, জীবনের প্রতি, নিজেদের প্রতি এবং পরিস্থিতির প্রতি আমাদের মনোভাবের অনেক বেশী অবদান রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের জন্য সর্বদা দুঃখিত বোধ করি না, বিশেষ করে আমরা যখন একটা ভাল দিন কাটাই। কিন্তু যখন আমাদের একটা দিন ভালভাবে না কাটে তখন আত্ম-করুণার অনুভূতির পুনরাবৃত্তি হয়। জীবনের প্রতি আমাদের যে মৌলিক মনোভাব গুলি আছে সেগুলি আমরা যেভাবে অনুভব করি সেগুলি সেটাকে খুব ভালভাবে গঠন করে। আমরা যদি আরও গভীর ভাবে পরীক্ষা করি, আমরা বুঝতে পারব যে, আমাদের মনোভাব গুলি বিভ্রান্তির উপর আধারিত।

সমস্যার উৎস বিভ্রান্তি

আমরা যদি বিভ্রান্তির অনুসন্ধান করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, এর একটা দিক হল আচরণগত হেতু এবং ফল সম্পর্কে বিভ্রান্তি। আমরা কী করব বা বলব এবং এর পরিণাম কী ঘটবে সেই বিষয়ে বিভ্রান্ত হই। আমরা খুব বিভ্রান্ত হতে পারি, কী ধরণের চাকরী পাব, বিয়ে করব কি না, সন্তান হবে কি না ইত্যাদি। আমরা যদি একজন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাই তাহলে তার পরিণাম কী হবে? আমরা জানি না। আমাদের ধারণা যে, আমার পছন্দ গুলি থেকে কী ফলপ্রসূ হবে বাস্তবে সেগুলি হল কল্পনা। এই কল্পনা গুলি ইচ্ছুক চিন্তা-ভাবনা বা ভয় এবং মস্তিষ্ক বিকৃতি বিশেষ ভিত্তিক। আমরা মনে করতে পারি, আমরা যদি কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যাই আমরা পরবর্তী কালেও সুখে বাস করতে পারব, যেমনটা কি রূপকথায় বর্ণিত আছে। অথবা আমাদের মনে আশঙ্কা জাগতে পারে, তারা আমাদের ত্যাগ করে দেবে এবং সেই জন্য আমরা একটা আবেগময় দূরত্ব বজায় রাখি। আমরা যদি কোন পরিস্থিতিতে মর্মাহত হই তখন আমরা মনে করি চিৎকার করলে ঐ পরিস্থিতিটা ভাল হয়ে যাবে। আমাদের মধ্যে একটা প্রচন্ড বিভ্রান্ত ধারণা আছে যে, আমরা যা কিছু করি সে সম্পর্কে অন্যরা কী প্রতিক্রিয়া করতে চলেছে। আমরা মনে করি, আমরা যদি চিৎকার করি এবং আমাদের মনের কথা বলি আমরা ভাল অনুভব করব এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তবে সবকিছু সেরকম হয় না। আমরা জানতে চাই যে কী হবে। আমরা মরিয়া হয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের শরণাপন্ন হই অথবা “দ বুক অফ চেঞ্জ, দ আই চিং”-এর কয়েন নিক্ষেপ করি। আমরা কেন এমন কাজ করি? আমাদের যা ঘটে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই।

বৌদ্ধধর্ম বলে, বিভ্রান্তির একটা গভীরতর স্তর বলতে সেই বিভ্রান্তিকে বোঝায় যে, আমরা এবং অন্যরা কীভাবে বিদ্যমান আছি আর এই বিশ্ব কীভাবে বিদ্যমান আছে। আমরা নিয়ন্ত্রণের পুরো বিষয়টা নিয়ে বিভ্রান্ত। আমরা মনে করি, আমাদের সঙ্গে যা কিছু ঘটে সেটাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা মনে করি আমরা যদি অন্য কাউকে আমাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে না দিই তাহলে এটা কখনও টুকরো-টুকরো হবে না। সেই কারণে আমরা হতাশ হয়ে যাই যখন জিনিস গুলি আমাদের প্রত্যাশা মতো প্রমাণিত হয় না। সর্বদা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। বাস্তবতাটা বড়ই জটিল। যখন কিছু ঘটে তখন অনেক কিছু প্রভাবিত করে, শুধু আমরা যা করি সেটা নয়। এর মানে এটা নয় যে, আমরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা বাহ্যিক শক্তি দ্বারা নিপুণ ভাবে পরিচালিত। অতএব যা কিছু ঘটে তাতে আমরা অবদান রাখি, তবে কী ঘটবে সেটা নির্ধারণ করার একমাত্র উৎপাদক আমরা নই।

আমাদের বিভ্রান্তি এবং নিরাপত্তা হীনতার কারণে আমরা প্রায়শই ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করি, এমনকি এটা না জেনেও যে, এটা হল ধ্বংসাত্মক আচরণ। এর কারণ হল, আমরা বিশৃঙ্খল আবেগ ও বিশৃঙ্খল মনোভাবের প্রভাবের অধীনে আছি এবং আছি আমাদের অভ্যাসগত আচরণের বাধ্যতা মূলকতার অধীনে। আমরা শুধু অপরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক আচরণ করি না বরং আমরা প্রাথমিক ভাবে স্ব-ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করি। অন্য কথায়, আমরা নিজেদের জন্য আরও বেশী সমস্যার জন্ম দিই। আমরা যদি কম সমস্যা চাই অথবা সমস্যা থেকে মুক্তি চাই যাতে তারাও সমস্যা গুলি কাটিয়ে উঠতে পারে, তাহলে আমাদের সীমাবদ্ধতার উৎসটিকে মেনে নিতে হবে।

বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের মুক্তি

বলা যাক, আমরা শনাক্ত করতে পারি যে বিভ্রান্তিই হল আমাদের সমস্যার উৎস। এটা খুব কঠিন নয়। অনেকে বলার বিষয়ে পৌঁছে গিয়ে বলে, “আমি সত্যিই বিভ্রান্ত। আমি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। তাহলে কী হবে? আমাদের আগে গিয়ে ঐ কোর্সের জন্য অথবা রিট্রিট-এর জন্য টাকা খরচ করার পরিবর্তে খুবই গম্ভীর ভাবে ভাবতে হবে, আমরা কি সত্যিই নিশ্চিত যে, আমাদের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমরা যদি এটি মনে না করি যে, বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব তাহলে আমরা কী করার জন্য চেষ্টা করছি? আমরা যদি শুধু এই আশা করে যাই যে, আমাদের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তাহলে এটা খুব স্থিতিশীল হবে না। এটা হল ইচ্ছামত চিন্তা-ভাবনা।

আমরা ভাবতে পারি মুক্তি বা স্বাধীনতা বিভিন্ন রূপে আসতে পারে। আমরা মনে করতে পারি কেউ আমাদের রক্ষা করবে। এটা দেবতার মতো উচ্চ বা দৈব চরিত্র হতে পারে এবং সেই জন্য আমরা আবার বিশ্বাসী হয়ে উঠি। বিকল্পভাবে, আমরা একজন কল্যাণমিত্র, একজন সঙ্গী অথবা অন্য কারও দিকে অভিমূখ করতে পারি যিনি আমাদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবেন। এই রকম পরিস্থিতিতে অন্য ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে তার সঙ্গে অপরিপক্ক ভাবে আচরণ করাটা সহজ। আমরা প্রায়শই আমাদের রক্ষার জন্য কাউকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠি এবং তার জন্য আমরা নির্বিচারে ঘুরে দাঁড়াই। আমরা হয়তো এমন একজনকে বেছে নেব, যে নিজেই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয় এবং সে তার নিজের বিশৃঙ্খল আবেগ এবং মনোভাবের কারণে আমাদের নিষ্পাপ নির্ভরতার সুযোগ নেবে। এটা এগিয়ে যাওয়ার কোন স্থিতিশীল উপায় নয়। আমাদের সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আমরা কোনও আধ্যাত্মিক গুরুর দিকে তাকাতে পারি না বা সম্পর্ক গড়তে পারি না। আমাদের বিভ্রান্তি স্বয়ং আমাদেরকেই দূর করতে হবে।

একজন আধ্যাত্মিক গুরু অথবা সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক একটা সহায়ক পরিস্থিতি হতে পারে, যদি সেই সম্পর্কটা হয় স্বাস্থ্যকর বা সুমধুর। যখন এটা অস্বাস্থ্যকর হয় তখন সেটাকে আরও খারাপ করে তোলে। এটা আরও বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। শুরুতে, গুরুটি নিখুঁত, সঙ্গীটি নিখুঁত এই মনে করে আমরা অস্বীকৃতির গভীর অবস্থায় থাকতে পারি, কিন্তু অবশেষে আমাদের সরলতা লুপ্ত হয়ে যায়। আমরা যখন অন্য ব্যক্তির দুর্বলতা দেখতে শুরু করি এবং বুঝতে পারি যে, ঐ ব্যক্তি আমাদের সমস্ত বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে যাচ্ছে না, আমরা ভেঙ্গে পড়ি। আমরা বিশ্বাসঘাতকতা বোধ করি। আমাদের আস্থা এবং আমাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। এটি একটি ভয়ানক অনুভূতি। এই জন্য শুরুতে সেটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে কোনটা সম্ভব এবং কোনটা নয়। আমাদের জানতে হবে একজন আধ্যাত্মিক গুরু কী করতে পারেন এবং কী করতে পারেন না। ভেঙ্গে পড়া থেকে এড়িয়ে চলার জন্য আমাদের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের মনের অবস্থাকে বিকাশ করতে হবে যা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত। বিভ্রান্তির বিপরীত বোধশক্তি আমাদের বিভ্রান্তিকে উত্থান হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পারবে। বৌদ্ধধর্মের দৃষ্টিতে, আমাদের কাজ হল আমাদের মনোভাব, আমাদের বিশৃঙ্খল আবেগ এবং আমাদের আবেগ প্রবণ, বাধ্যতা মূলক অথবা বায়ুগ্রস্ত আচরণের প্রতি অন্তর্মুখী এবং মনোযোগী হতে হবে। এর মানে হল, আমরা নিজেদের মধ্যে সেই জিনিস গুলি দেখতে ইচ্ছুক হই যেগুলি ততটা সুন্দর নয়। অতএব আমাদের সেগুলি অস্বীকার করা উচিত। আমরা যখন এমন কোনও বস্তুকে দেখতে পাই যে, সেগুলি আমাদের সমস্যার সৃষ্টি করছে অথবা সমস্যার লক্ষণ তৈরী করছে তখন আমাদের সেগুলিকে পরিহার করার জন্য তাদের প্রতিপক্ষকে প্রয়োগ করতে হবে। এসব কিছু অধ্যয়ন এবং ধ্যানের উপর আধারিত। আমাদের বিশৃঙ্খল আবেগ এবং মনোভাব আর সেগুলি কোথা থেকে উদ্ভূত হচ্ছে সেটাকে শনাক্ত করা শিখতে হবে।

ধ্যান

ধ্যানের অর্থ হল- আমরা বিভিন্ন প্রতিপক্ষকে একটা নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগ ক’রে অনুশীলন করি, যাতে আমরা কীভাবে তাদের প্রয়োগ করব সে বিষয়ে পরিচিত হতে পারি এবং বাস্তব জীবনে সেরকম করতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি কারও উপর রেগে যাই যখন তারা আমাদের পছন্দ মতো আচরণ না করে, ধ্যান অবস্থায় আমরা এগুলি মনে করি এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলিকে দেখার চেষ্টা করি। যেমন- অন্য একজন ব্যক্তি অনেক বিভিন্ন কারণে ভিন্নমতে আচরণ করছে। তিনি (পু.) বা তিনি (স্ত্রী.) বিদ্বেষবশতঃ বাধ্য হয়ে আচরণ করছেন না। তিনি ঐরকম করছেন কারণ তিনি আমাদের ভালবাসেন না। ধ্যান অবস্থায়, আমরা এই ধরণের মনোভাব গুলির অবসান করার চেষ্টা করি “আমার বন্ধু আমাকে আর ভালোবাসে না কারণ সে (পু.) বা সে (স্ত্রী.) আমাকে ফোন করেনি।”

আমরা যদি স্বাচ্ছন্দ্য, বোধশক্তিপূর্ণ এবং ধৈর্য্যশীল মনের অবস্থার সাথে এই ধরণের পরিস্থিতির মোকাবিলা করে অনুশীলন করি তাহলে সেই ব্যক্তি আমাকে এক সপ্তাহ ধরেও যদি ফোন না করে আমি দুঃখী হব না। আমরা যখন দুঃখী হতে শুরু করি আমরা মনে করি ঐ ব্যক্তিটি সম্ভবতঃ খুবই ব্যস্ত আছেন এবং এটা মনে করা আত্মকেন্দ্রী হবে যে, তার জীবনে আমরাই হলাম সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই ধরণের বিচার আমাদের আবেগপ্রবণ বিপর্যয়কে শান্ত করে দেয়।

বৌদ্ধ অনুশীলন (সাধনা) একটি পূর্ণকালীন পেশা

বৌদ্ধ অনুশীলন একটা শখ নয়। এটা এমন কিছু নয় যা আমরা একটা খেলা হিসাবে বা বিনোদন হিসাবে করি। বৌদ্ধ অনুশীলন একটা পূর্ণকালীন কাজ। আমাদের কাজ হল জীবনের প্রত্যেকটা জিনিসের প্রতি আমাদের যে মনোভাব তার উপর কাজ করা। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি সকল জীবের প্রতি মৈত্রী বিকাশ করি, তাহলে আমাদের পরিবারের উপর সেটা প্রয়োগ করতে হবে। অনেকে তাদের ঘরে বসে মৈত্রীর উপর ধ্যান-ভাবনা করে, কিন্তু তাদের মা-বাবা অথবা সঙ্গীদের সাথে মিলে মিশে চলতে পারে না। এটা দুঃখের বিষয়।

চরমতা ত্যাগ করা

বৌদ্ধ শিক্ষা গুলি বাড়িতে এবং কর্মক্ষেত্রে বাস্তবিক জীবনের পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করার জন্য চেষ্টা করতে আমাদের চরমতা ত্যাগ করতে হবে। চরমতার একটা মেরু হল, সব দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আর অন্য চরমতা হল সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া আমাদের উপর। জীবনে যা কিছু ঘটে সেটা খুব জটিল। উভয় পক্ষ অবদান দেয়, অন্যরা অবদান দেয়, আর আমরাও অবদান দিই। তাদের আচরণ এবং মনোভাব কীভাবে পরিবর্তন করা যায় তার জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, এটা খুব সহজ নয়- বিশেষ করে আমরা যদি স্ব-ধর্মনিষ্ঠ হই, পবিত্র ভাবে চলি এবং অপরকে পাপী ব’লে দোষারোপ করি। অতএব নিজেকে পরিবর্তন করা বেশী সহজ। যদিও আমরা অন্যদের পরামর্শ দিতে পারি যদি তারা গ্রহণযোগ্য মনে হয় এবং আমাদের পরামর্শের কারণে বেশী আক্রমণাত্মক না হয়, কিন্তু মুখ্য ভাবে নিজেদের উপর প্রয়োগ করে তবেই করতে হবে।

নিজের উপর কাজ করতে গিয়ে আমাদের চরমতার আরও একটি জুটির দিকে নজর রাখতে হবে, আমরা আমাদের অনুভূতিতে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন কি না অথবা সেগুলি সম্পর্কে মোটেও সচেতন কি না। প্রথমটা হল আত্মরতি মূলক তন্ময়তা বা ব্যস্ততা। আমরা যা অনুভব করি শুধু সেটা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হই। অন্যরা কী অনুভব করছে সেটাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখাই। আমরা মনে করি, আমরা যা অনুভব করি সেটা অন্যরা যা অনুভব করে তার থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, আমরা আমাদের অনুভূতির থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলি অথবা কিছুই অনুভব করি না। এটা এমন যেন আমাদের আবেগ গুলিকে নোবোকেনের সাথে গুলি করা হয়েছিল। এই চরমতা গুলিকে ত্যাগ করার জন্য আমাদের একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্য দরকার। এটা খুব সহজ নয়।

আমরা যদি অন্যদের সাথে থাকাকালীন সর্বদা নিজেদের দিকে লক্ষ্য করি, এটা একটা কল্পনা দ্বৈত সৃষ্টি করবে অর্থাৎ আমরা স্বয়ং এবং আমরা কী অনুভব করছি বা কর্ম করছি। এইভাবে আমরা বুঝতে পারব যে, আমরা কারও সাথে সম্পর্কিত নই বা কারও সাথে নেই। আসল দক্ষতা হল সম্পর্ক গড়ে তোলা; স্বাভাবিক আর আন্তরিক উপায়ের সাথে আচরণ করা; এবং পাশাপাশি আমাদের মনোযোগের একটা অংশ থাকবে আমাদের অনুপ্রেরণা এবং মনোভাবের উপর। এটা করার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এটা ছাড়া, ভাঙ্গাচোরা উপায়ের সাথে আচরণ করলে আমরা অপরের সাথে উপস্থিত হতে পারব না। আমরা যদি অন্যের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন কালীন আমাদের অনুপ্রেরণা এবং অনুভূতি গুলিকে পরীক্ষা করি, তাহলে কখন-কখনও এটা ব্যক্তিকে বলতে সহায়তা করে। তবে, সেই অনুভূতি করাটা খুব আত্মরতি মূলক হয়ে ওঠে যে, আমায় ঐ ব্যক্তিকে বলতে হবে। প্রায়শই অন্য লোকেরা আমরা কী অনুভব করি তার প্রতি আগ্রহী হয় না। এটা অনুভব করা খুব স্ব-গুরুত্বপূর্ণ যে তারা জানতে চায়। আমরা যখন লক্ষ্য করি আমরা স্বার্থপরতার সাথে আচরণ করতে চলেছি তখন আমরা এটা বন্ধ করতে পারি। আমাদের ঘোষণা করার দরকার পড়ে না।

দুটি চরমতার আরও একটা সেট হ’ল আমরা সবাই খারাপ অথবা আমরা সবাই ভাল। আমরা যদি আমাদের অসুবিধা, আমাদের সমস্যা এবং আমাদের বিশৃঙ্খল আবেগের উপর বেশী জোর দিই তাহলে আমরা অনুভব করতে শুরু করব যে, আমরা খারাপ মানুষ। সেটা খুব সহজে দোষে অবনতি হতে থাকে। “আমার অনুশীলন করা উচিত। আমি যদি না করি, আমি একজন খারাপ মানুষ হয়ে যাব।” এটা অনুশীলনের জন্য একটা অত্যন্ত বায়ুগ্রস্থ আধার।

আমাদের অন্য চরমতাকেও ত্যাগ করতে হবে যা আমাদের ইতিবাচক দিকগুলির উপর বেশী জোর দেয়। “আমরা নিখুঁত। আমরা সবাই বুদ্ধ। সবকিছুই দুর্দান্ত।” এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এটা পরোক্ষভাবে বোঝাতে পারে যে, আমাদের কিছুই পরিহার করার প্রয়োজন নেই; আমাদের কোন নেতিবাচকতা বন্ধ করার প্রয়োজন নেই কারণ আমাদের সকলকে যা করার প্রয়োজন সেটা হল আমাদের মৌলিক ভাল গুণাবলীকে দেখতে হবে। “আমি দুর্দান্ত, আমি নিখুঁত। আমাকে আমার নেতিবাচক আচরণ বন্ধ করতে হবে না। আমি ইতিপূর্বে একজন বুদ্ধ।” আমাদের একটা ভারসাম্য দরকার। আমরা যদি নিজেরাই হতাশ বোধ করি তাহলে আমাদেরকে নিজেদের ক্ষমতা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যাতে আমরা সমস্ত ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারি এবং বুদ্ধ হয়ে যেতে পারি। পাশাপাশি আমরা যদি একটু অনীহা বোধ করি তাহলে আমাদের নেতিবাচক দিক গুলির উপর জোর দিতে হবে।

দায়িত্ব নেওয়া

মূলতঃ দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরকে নিতে হবে আমাদের বিকাশের জন্য এবং সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। অবশ্যই আমাদের সহযোগীতা দরকার। কারণ নিজেদের পক্ষে এটা করা সহজ নয়। আমরা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের কাছ থেকে সহযোগীতা পেতে পারি, আর পেতে পারি আধ্যাত্মিক সমুদায় বা সংঘ থেকে, সমমনা ব্যক্তির কাছ থেকে এবং সেই ধরণের মানুষের কাছ থেকে যারা নিজেদের উপর কাজ করেন আর সমস্যার জন্য একে-অপরকে দোষারোপ করেন না। এই কারণে, অংশীদারিতে একই ধরণের মনোভাব শেয়ার করে নেওয়াটা গুরুত্বপুর্ণ যে কোনও দোষের উৎপত্তির জন্য অন্যের দোষারোপ না করে। যদি উভয় অংশীদার পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে তাহলে তাতে কোনও কাজ হয় না। যদি শুধু একজন অংশীদার নিজের উপর কাজ করে এবং অন্যজন শুধু দোষারোপ করে, তাহলেও সেখানে কোন কাজ হয় না। আমরা যদি ইতিপূর্বে একটা সম্পর্কে থাকি যা অন্য ব্যক্তি দোষারোপ করে তখন আমাদের খতিয়ে দেখতে হয় আমরা কী অবদান রাখছি। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। এটি আরও কঠিন হয়ে যায়। আমাদের এই সম্পর্কে শহীদ হওয়া থেকে এড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, “আমি এই সব সহ্য করছি। এটা খুবই কঠিন।” সম্পূর্ণ জিনিসটা স্নায়বিক হতে পারে।

অনুপ্রেরণার প্রাপ্তি

বৌদ্ধ পথ সহজ নয়। এটি জীবনের কদর্যতা বা অশুচিতার সঙ্গে কাজ করে। এই বিষয়ে এগিয়ে যেতে আমাদের এক ধরণের শক্তির প্রয়োজন হয়। আমাদের প্রয়োজন স্থিতিশীল অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস যদি শিক্ষকরা হন যারা দুর্দান্ত অলৌকিক গল্প বলেন এবং নিজেদের সম্পর্কে বা বৌদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে অন্যান্য এই ধরণের সমস্ত জিনিস বলেন, এটা তাহলে অনুপ্রেরণার খুবই স্থিতিশীল উৎস হবে না। এটা নিশ্চয়ই উত্তেজনা পূর্ণ হবে না তবে আমাদের পরীক্ষা করতে হবে এটা আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করছে। অনেকে এটি একটা কাল্পনিক জগতকে শক্তিশালী করে যেখানে আমরা অলৌকিক শক্তি দ্বারা মুক্তি লাভের প্রার্থনা করি। আমরা কল্পনা করি যে, কোন মহান জাদুগর তার অলৌকিক শক্তি দিয়ে আমাদের রক্ষা করতে চলেছে অথবা আমরা স্বয়ং হঠাৎ এই অলৌকিক জিনিস গুলি বিকাশ করতে সক্ষম হয়ে যাব। আমাদের এই কাল্পনিক গল্প সম্পর্কে খুব সাবধান হতে হবে। তারা আমাদের আস্থাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে ইত্যাদি। এটা সহায়ক হতে পারে কিন্তু এটা অনুপ্রেরণার স্থিতিশীল আধার নয়। আমাদের প্রয়োজন একটা স্থিতিশীল আধারের।

একটা নিখুঁত উদাহরণ হল বুদ্ধ নিজেই। বুদ্ধ মানুষকে কাল্পনিক ব’লে তাদের অনুপ্রাণিত করা বা মুগ্ধ করার চেষ্টা করেননি। তিনি মানুষের কাছে গিয়ে, তাদের আশীর্বাদ দেওয়ার চাল সাজি করেননি এবং সেইভাবে গাদাননি। বুদ্ধ যে দৃষ্টান্তটা ব্যবহার করেছেন যেটাকে সারা বৌদ্ধ শিক্ষা জুড়ে পুনরাবৃত্তি করা হয় সেটা হল বুদ্ধ হলেন একটা সূর্যের মতো। সূর্য মানুষকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে না। প্রাকৃতিক ভাবে সূর্য যেভাবে আছে, এটা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রত্যেকের জন্য উষ্ণতা নিয়ে আসে। যদিও একটা কাল্পনিক গল্প শুনে, একটি মূর্তি দিয়ে মাথায় স্পর্শ করলে বা গলায় বাঁধার একটা লাল সুতো পেয়ে আমরা তুঙ্গে উঠি তবে সেটা স্থিতিশীল নয়। অনুপ্রেরণার স্থিতিশীল উৎস হল- একজন ব্যক্তি হিসাবে তার চরিত্রের মতো শিক্ষক স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এবং স্বাভাবিক ভাবে উপস্থিত থাকেন। তিনি সেভাবে থাকেন তার বৌদ্ধ শিক্ষার অনুশীলনের পরিণাম স্বরূপে। এটাই অনুপ্রেরণাকারী, যা এমন কোন কাজ নয় যা আমাদের মনোরঞ্জন করার জন্য তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যদিও এটা চমৎকার গল্পের মতো উত্তেজক নাও হতে পারে, কিন্তু এটা আমাদের অনুপ্রেরণার একটা স্থিতিশীল বোধশক্তি প্রদান করে।

আমরা যখন উন্নতি করি, আমরা স্বয়ং আমাদের উন্নতি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি- অলৌকিক শক্তি অর্জন ক’রে নয় বরং আমাদের চরিত্র সেখান থেকে কীভাবে আস্তে-আস্তে পরিবর্তন হয়। শিক্ষাগুলি সব সময় আমাদের নিজস্ব ইতিবাচক কর্মের প্রতি আনন্দিত হতে জোর দেয়। এটা মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, উন্নতি কখনও রৈখিক হয় না। এটা কিন্তু প্রতিদিন ভাল হয় না। জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য হল যে, আমাদের মেজাজে জোয়ার-ভাটা ঘটতে থাকবে যতক্ষণ আমরা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তি জনিত সমস্যা গুলি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে না যাই। এটা একটা অবিশ্বাস্য ভাবে উন্নত অবস্থা। আমাদের অবশ্যই আশা করা উচিত যে, আমরা কখন-কখন সুখী অনুভব করব আবার কখন-কখন দুঃখী। আমরা মাঝে-মাঝে ইতিবাচক ভাবে আচরণ করতে সক্ষম হব এবং অন্য সময় আমাদের স্নায়বিক স্বভাব অদম্য হয়ে যাবে। এর উত্থান-পতন হবেই হবে। অলৌকিক ঘটনা সাধারণতঃ ঘটে না।

জীবনে অষ্ট লৌকিক ধর্মের প্রতি অস্বস্তি এড়ানোর শিক্ষা গুলি জোর দেয় যে, যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে আমরা তার কারণে আমাদের মাথা ফোলাবো না, আর যদি ভাল না হয় তাহলে হতাশ হব না, সেটাই জীবন। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে দীর্ঘকালীন পরিণামের দিকে, অল্পকালীন পরিণামের দিকে নয়। উদাহরণ স্বরূপ আমরা আমরা যদি পাঁচ বছর ধরে অনুশীলন করে আসি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। এমনকি আমরা যদি কখনও ভেঙ্গে পড়ি, তখনও যদি আমরা উপলব্ধি করি যে, আমরা ঐ পরিস্থিতি গুলি শান্ত এবং স্বচ্ছ মন আর অন্তর দিয়ে পরিচালনা করতে সক্ষম, তাহলে এটা বোঝাবে যে, আমরা কিছুটা উন্নতি করেছি। এটি অনুপ্রেরণা জনক। এটি নাটকীয় নয়, যদিও আমরা চাই এটা নাটকীয় হোক এবং নাটকীয় প্রদর্শনীতে আমরা তুঙ্গে উঠি। এটা স্থিতিশীল অনুপ্রেরণা।

ব্যবহারিক হওয়া

আমাদের একটু ব্যবহারিক হতে হবে এবং পা মাটিতে রাখতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান গুলি করি, এটাকে কোন সাধু-সন্তের বাহ্যিক চিত্র হিসাবে মনে না করাটা গুরুত্বপূর্ণ যিনি আমাদেরকে পাপের ক্ষমা করছেন।

বৌদ্ধধর্মে এমন কোন সাধু-সন্ত নেই যিনি শুদ্ধিকরণ দ্বারা আমাদের রক্ষা করবেন এবং আশীর্বাদ দেবেন। এটা কোনভাবেই একটা প্রক্রিয়া হতে পারে না। আমাদের যা শুদ্ধ করে তোলে সেটা হল ঐ তথ্যটি, যে আমাদের মন স্বাভাবিক ভাবে শুদ্ধ। এটা বিভ্রান্ত দ্বারা সহজাত রঞ্জিত নয়; বিভ্রান্তিকে পরিহার করা যেতে পারে। আমরা আমাদের প্রচেষ্টায় মনের স্বাভাবিক শুদ্ধতাকে উপলব্ধি ক’রে আমরা আমাদের অপরাধ, নেতিবাচক সম্ভাবনা ইত্যাদি ত্যাগ করতে পারি। এটি কাজ করার জন্য শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া সক্ষম করে তোলে।

আরও, এই সমস্ত অনুশীলন গুলি করা এবং বৌদ্ধ শিক্ষা গুলিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করার জন্য আমরা যে স্তরে আছি সেই স্তরটা চিনতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এর জন্য দাম্ভিক না হই অথবা এই অনুভব না করি, আমাদের এখনকার চেয়ে আরও বেশী উচ্চ স্তরে থাকতে হবে।

একটি ক্যাথলিক পটভূমি থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী

উদাহরণ স্বরূপ, কিছু লোক যারা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আগ্রহী তারা ক্যাথলিক পটভূমি থেকে এসেছেন। সেটা যদি আমাদের হয়, তাহলে আমরা বৌদ্ধধর্মের দিকে অভিমুখ করতে পারি এবং অধ্যয়ন শুরু করতে পারি। আমাদের ভাবতে হবে না যে, আমাদের ক্যাথলিকতা ত্যাগ করতে হবে এবং বৌদ্ধধর্মে রূপান্তর হতে হবে। তবে, দুটি অনুশীলনকে মিশ্রিত না করে ফেলাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা গির্জায় বসার আগে বেদীটার সামনে তিনবার প্রণাম করব না। তেমনি আমরা যখন একটা বৌদ্ধ অনুশীলন পালন করব আমরা তখন ভার্জিন মেরীকে মনোনিবেশ করব না, বরং বুদ্ধকে দৃষ্টিগোচর করব। আমরা প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ভাবে পালন করব। আমরা যখন গির্জায় যাব, তখন শুধু গির্জাতেই যাব; যখন বৌদ্ধ ধ্যান করব তখন শুধু একটা বৌদ্ধ ধ্যানই করব।

বৌদ্ধধর্মে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন- মৈত্রীর উপর জোর দেওয়া, অপরের সহায়তা করা ইত্যাদি। মৌলিক স্তরে সেখানে কোনও বিরোধ নেই। আমরা যদি মৈত্রী, দান এবং পরহিতের অনুশীলন করি তাহলে আমরা উভয় দিক থেকে একজন ভাল ক্যাথলিক এবং একজন ভাল বৌদ্ধ হয়ে যাই। যাইহোক, সর্বশেষে আমাদের একটা পছন্দ করতে হবে। তবে সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য আমাদের পূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত হব। আমরা যদি একটা বিল্ডিং-এর সবচেয়ে উঁচু তলায় যেতে চাই, আমরা কিন্তু একই সময়ে দুটি সিঁড়ি দিয়ে যেতে পারি না। এটা একটা সহায়ক চিত্র। আমরা যদি শুধু একটা লবিতে মৌলিক আধার-স্তরে কাজ করি, তাহলে সেটা ঠিক আছে। এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমরা উভয় থেকে উপকৃত হতে পারি।

অনুপযুক্ত আনুগত্য ত্যাগ করা

জীবনে বৌদ্ধধর্মকে প্রয়োগ করার সময় আমাদের স্থানীয় ধর্ম গুলিকে খারাপ বা নিম্নতর মনে করে সেগুলিকে প্রত্যাখ্যান না করার জন্য যত্নশীল হতে হবে। এটা একটা বড় ভুল। সেটা হলে কিন্তু আমরা একজন ধর্মান্ধ বৌদ্ধ বা একজন ধর্মান্ধ ক্যাথলিক হয়ে যাব। মানুষ সাম্যবাদ এবং গণতন্ত্র দ্বারাও এটা করে। একটা মনোবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা যাকে বলা হয় অনুপযুক্ত আনুগত্য এটাকে গ্রহণ করে যেমন আমাদের মধ্যে আমাদের পরিবার, পটভূমি ইত্যাদির প্রতি অনুগত হওয়ার প্রবণতা আছে, তেমনি আমরা ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি অনুগত হতে চাই, যদিও আমরা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছি। আমরা যদি আমাদের পটভূমির প্রতি অনুগত না হই এবং খারাপ ভেবে সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দিই, তাহলে আমরা অনুভব করব যে আমরা খুব খারাপ। এর কারণ হল এটা চরম অস্বস্তিকর এবং আমরা অসচেতন ভাবে আমাদের পটভূমিতে কিছু খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি যার প্রতি আমরা অনুগত হতে পারব।

প্রবণতাটা হ’ল অসচেতন ভাবে আমাদের পটভূমির কিছু কম উপকারী দিকগুলির প্রতি অনুগত হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা ক্যাথলিক ধর্ম প্রত্যাখ্যান করতে পারি কিন্তু আমরা বৌদ্ধধর্মে উল্লিখিত নরকের প্রতি প্রবল ভয়ের জন্ম দিই। আমার এক বন্ধু একজন কট্টর ক্যাথলিক ছিলেন। তিনি পরে দৃড়ভাবে বৌদ্ধধর্মের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ফলে তার অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গিয়েছিল, “আমি ক্যাথলিক ধর্ম ত্যাগ করে দিয়েছি, এবার আমাকে ক্যাথলিক নরকে যেতে হবে; আর আমি যদি বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করি এবং ক্যাথলিক ধর্মে ফিরে যাই আমাকে তাহলে বৌদ্ধ নরকে যেতে হবে।” যদিও এটা শুনতে বিচিত্র লাগে, কিন্তু এটি সত্যিই তার কাছে একটি মারাত্মক সমস্যা তৈরী হয়েছিল।

আমরা প্রায় অজ্ঞান ভাবে ক্যাথলিক ধর্ম থেকে নির্দিষ্ট মনোভাব আমাদের বৌদ্ধ অনুশীলনে নিয়ে আসি। তাদের মধ্যে সবথেকে সাধারণ গুলি হ’ল দোষী-ভাবনা এবং আমাদের রক্ষার জন্য অলৌকিক ঘটনা এবং সন্ধান করা। আমরা যদি অনুশীলন না করি, আমরা যদি ভাবি যে আমাদের অনুশীলন করা উচিত, আর যদি সেটা না করি তাহলে আমরা দোষী। এই ধারণা গুলি মোটেই সহায়ক নয়। আমাদের শনাক্ত করতে হবে যে, আমরা এসব কখন করি। আমাদেরকে আমাদের পটভূমির দিকে তাকাতে হবে এবং ইতিবাচক দিক গুলি স্বীকার করতে হবে যাতে আমরা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য গুলির পরিবর্তে ইতিবাচক গুলির প্রতি অনুগত হতে পারি। “আমি উত্তরাধিকার সূত্রে দোষ এবং অলৌকিক-অন্বেষণ পেয়েছি।”, এরকম চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে আমরা মনে করতে পারি, “উত্তরাধিকার সূত্রে আমি ক্যাথলিক পরম্পরার প্রেম, দান এবং অভাগাদের সহায়তা করার ভাবনা পেয়েছি।”

আমরা আমাদের পরিবারের বিষয়ে একই জিনিস করতে পারি। আমরা তাদের প্রত্যাখ্যান করতে পারি এবং তারপর সজ্ঞানে তাদের ইতিবাচক পরম্পরা গুলির প্রতি অনুগত হওয়ার পরিবর্তে অজ্ঞান ভাবে তাদের নেতিবাচক পরম্পরা গুলির প্রতি অনুগত হতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি স্বীকার করি, তারা আমাদের যে ক্যাথলিক পটভূমিটা দিয়েছে তারজন্য আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। এরকম করলে আমরা অতীত সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ছাড়া এবং নেতিবাচক অনুভূতি ছাড়া আমরা আমাদের নিজস্ব পথে যেতে পারি। উক্ত দ্বন্দ্ব এবং অনুভূতি ক্রমাগত আমাদের উন্নতিকে বিপন্ন করে।

মনোবৈজ্ঞানিক বৈধতা জানার চেষ্টা করার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি আমাদের অতীত সম্পর্কে অর্থাৎ আমাদের পরিবার, আমাদের জন্ম-ধর্মগুলি অথবা যা কিছুই হোক না কেন, নেতিবাচক মনে করি তাহলে আমরা নিজেদের প্রতিও নেতিবাচক মনোভাব জাগানোর প্রবণতা দেখাব। এর বিপরীতে, আমরা যদি আমাদের পটভূমি এবং অতীতের ইতিবাচক জিনিস গুলি স্বীকার করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের প্রতি বেশী ইতিবাচক মনোভাব জাগানোর প্রবণতা দেখাব। এটা আমাদের আধ্যাত্মিক পথে আরও স্থিতিশীল হতে সহায়তা করবে।

সারাংশ

আমাদের আস্তে-আস্তে, ধাপে-ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যখন অত্যুন্নত শিক্ষা সম্পর্কে শ্রবণ করব বা পড়ব, যদিও সেটা অতীতের মহান আচার্যরা বলেছেন, “যখনই আপনি একটা উপদেশ শোনেন, অবিলম্বে সেটা প্রয়োগ করুন।”, আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, যে কোনটা আমাদের জন্য খুবই উন্নত অথবা এটা এমনই যেটা আমরা এখনই প্রয়োগ করতে পারি। যদি এটা অত্যুন্নত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে এটিকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে আমাদের পদক্ষেপটি নির্ণয় করতে হবে। এরপর, ঐ পদক্ষেপ গুলি অনুসরণ করতে হবে। সংক্ষেপে, যেমন আমার একজন শিক্ষক গেশে নাওয়াঙ্‌ দরগে বলেছিলেন, “আমরা যদি কাল্পনিক পদ্ধতি অনুশীলন করি, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা কাল্পনিক ফল প্রাপ্ত করব; আমরা যদি ব্যবহারিক পদ্ধতি অনুশীলন করি, তাহলে আমরা প্রাপ্ত করব ব্যবহারিক ফল।”

Top