বৌদ্ধধর্ম ও ইসলামের মধ্যে কি কোন সাদৃশ্য আছে?

তাত্ত্বিক দিক

দুটি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজতে গেলে বহু বাধা বিপত্তি থাকে। একটি প্রধান সমস্যা হল যে শিক্ষাগত স্তরে তুলনামূলক ধর্মের বিচারে কোন তত্ত্বকে নেওয়া হল। খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্বের সেরকম তুলনামূলক আলোচনার দিকটিকে কীভাবে শ্রেনীবদ্ধ করা হয়, আমি সেটা উল্লেখ করতে চাইছি। “Buddhist Stances towards Others: Types, Examples, Consideration,” নামে একটি প্রবন্ধে ক্রিস্টিন বেইসেকিবলিংগার (Kristin Beisekiblinger) এর পরিকাঠামোটি ব্যক্ত করেছেন এবং সেটা “Buddha Attitudes to Other Religions” গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

কিবলিংগার এই প্রবন্ধে তিনটি প্রণালী উল্লেখ করেছেন- স্বতন্ত্রবাদ (Exclusivism), অন্তর্ভুক্ততত্ত্ব (Inclusivism) এবং বহুত্ববাদ বা Pluralism।

  • স্বতন্ত্রবাদ প্রণালী বা পদ্ধতিই হল মুক্তি মার্গের একমাত্র একটি ধর্মের সঠিক পথ। অপরাপর ধর্মগুলি যদিও একই বিষয়ে আমাদের মতোই বলে, যাইহোক তাদের অবস্থান অসত্য। অবৌদ্ধ অভিমত এমনকি অপর বৌদ্ধদের বিষয়েও অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ এই মনোভাব পোষণ করে।
  • অন্তর্ভুক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী মুক্তির মার্গ অনেক কিছু কিন্তু একটি হল উচ্চতর। অন্যকথায় অপরাপর ধর্মসমূহের সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য থাকলেও, এমনকি সবগুলি বৈধ হলেও, অন্যদের থেকে আমাদেরটি উত্তম। তিব্বতী পরম্পরা সকলেই একে অপরের প্রতি এমন মনোভাব পোষণ করে- “সবই নির্বাণগামী, কিন্তু আমাদের পথ শ্রেষ্ঠ।”
  • বহুত্ববাদের মতে মুক্তির মার্গ অনেক এবং কোনটিই শ্রেষ্ঠ বা উচ্চতর নয়। এটা হল অসাম্প্রদায়িক মত। বিভিন্ন ধর্মের নানাবিধ অবস্থান এবং তাদের সাধারণ বিষয়াদিকে কোনরকম স্তর ভাগ না ক’রে এই মতবাদ সেটা উপস্থাপন করে।

অন্তর্ভুক্ত বহুত্ববাদ ও তত্ত্বের সীমার মধ্যে কিছু স্তর রয়েছে। একজন ব্যক্তি প্রকৃত পার্থক্যের মধ্যে কতটা গ্রহণ করবেন এবং এই পার্থক্যগুলিকে কতটা গভীরভাবে শেখানো হবে, সেটা এরকম।

  • প্রথম ধরণটি সাদৃশের উপর জোর দেয়, সেটা যদিও পার্থক্যকে স্বীকার করে তবুও সমানতা দেখিয়ে পার্থক্যকে বদলে দেখায়। অনেকটা সাম্য বা পারিপার্শিক বিষয়ের মতো। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় আমরা যা করছি অন্য ধর্মগুলিও তাই করছে, শুধু মার্গে পার্থক্য রয়েছে। ওরা না জেনেই আমাদের ধর্ম অনুসরণ করছে। উদাহরণ স্বরূপ, ঞিঙ্‌মা জোগছেন সাধনাকে (নিষ্পন্নক্রম সাধনা) গেলুগগণ গেলুগ অনুত্তর যোগতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে।
  • দ্বিতীয় ধরণটি (বহুত্ববাদ) প্রকৃত পার্থক্যকে শ্রদ্ধা করে এবং উন্নতি বিধানের উপায় হিসাবে আলোচনার পথ অন্বেষণ করে, স্ব-ধর্ম শ্রেষ্ঠ কিনা সেটা বিচার করে না।

প্রথম ধরণটির (অন্তর্ভুক্তবাদ) পক্ষে (ওরা মনে করে আমরা একটু অন্যভাবে করছি) পক্ষে বিপদ হল যে সেটা অপ্রমাণ্য, একগুঁয়ে এবং আত্মতুষ্টি সম্পন্ন। এটা ধরে নেয় যে- আমরা তাদের ধর্মকে ওদের চেয়েও ভাল জানি। এই বিষয়ে অন্তর্ভুক্তবাদীদের দৃষ্টিতে ওরা বিশ্বাস করে যে, আমাদের ধর্ম উচ্চতর। বিষয়টি এইভাবে দেখা হয় যে অপরাপর ধর্ম আসলে আমাদের মোক্ষকেই অনুসরণ করছে, ওরা সেটা জানে না। অথবা ভাবে- ওরা আমাদের থেকে শুধু একধাপ নিচে আছে। ওরকম মনোভাব নিয়ে আমরা তাদের থেকে বেশি কিছু শিখতে পারব না, কিন্তু ওরা আমাদের কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারে। এর উপশ্রেণীগুলি হলঃ

  • সমস্ত বা অধিকাংশ ধর্মগুলি একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলছে যদিও তাদের মার্গ আমাদের মতো ভালো নয়। তবুও অবশেষে আমাদের মতোই একই লক্ষ্যে স্বাভাবিক ভাবেই পৌঁছে যাবে।
  •  অন্তিমে আমাদের মার্গে তাদের পথ দেখানোর প্রয়োজন আছে। একই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য আমরা যে পথে সেইপথে ওঁরাও চলছে, তবে যদি শুধুমাত্র নিজের পথেই চলতে থাকে সেটা ওরা পাবে না। এর উদাহরণ বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই রয়েছে। অনুত্তর তন্ত্র সম্বন্ধে বলা হয় যে সূত্র এবং অন্যান্য তন্ত্র আপনাকে দশম ভূমি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বুদ্ধত্বে পৌঁছতে হলে আপনাকে অনুত্তর যোগ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।

অন্তর্ভুক্তিবাদের অপরাপর ধরণগুলির (যারা পার্থক্য দূরে সরিয়ে সাযুজ্যের কথা বলে) বক্তব্য হল-

  • ধ্যানের অভিজ্ঞতা বা অনুভব প্রকাশে শব্দ, ধারণা ও মতবাদ যথাযথ নয় এবং সকল ধর্ম একইরকম অভিজ্ঞতার কথা বলে।
  • সকল ধর্মের একটি সাধারণ মতবাদ ও মূল তত্ত্ব রয়েছে এবং পার্থক্যগুলির জন্য দায়ী হল ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ সমূহ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিন, জাপান, তিব্বত ইত্যাদি দেশে বৌদ্ধধর্মের নানা রূপ দেখতে পাওয়া যায় (ওঁরা বৌদ্ধ হলেও সামান্য পার্থক্যজনিত বৈশিষ্ট দেখা যায়)।

এছাড়াও বৌদ্ধধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সম্ভাব্য ভিত্তিটুকু আমরা যখন খুঁজি, তখন তা ধর্মান্তরকরণের বিষয়টি ছুঁয়ে যায়।

  • স্বতন্ত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল- যদি একমাত্র আমাদের ধর্ম সত্য হয়, তাহলে আপনাকে রক্ষা করতে হলে আপনার ধর্ম ত্যাগ ক’রে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করুন।
  • স্বতন্ত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল- আপনি আপনার ধর্ম পালন করছেন, এটা ভাল কথা, কারণ এটা আমাদের ধর্মের নিম্নস্তরীয় রূপ। অন্তিমে আপনি স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মতবাদ বুঝতে পারবেন (উদাহরণ স্বরূপ, চিত্তমাত্রবাদী অনুত্তর যোগ তন্ত্রের সাধক স্বাভাবিক ভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে যান, নিষ্পন্নক্রম সাধনায় যখন ওঁরা চিত্তহীন স্তরে পৌঁছে যান তখন তাই ঘটে) অথবা শেষে আপনাকে আমরা পরিবর্তিত করে নেব।
  • বহুত্ববাদী মতবাদ বলছে- প্রতিটি ধর্ম তাদের অন্তিম লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায় এবং সকলেই প্রশংসার যোগ্য। এখানে দুটি বিষয় বা রূপ রয়েছে- সকলের লক্ষ্য সমান; অথবা সমান নয় এবং কেউই অপর থেকে উচ্চতম নয়। সুতরাং ধর্ম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, এই বিষয়টি এমন হতে পারে আপনি যদি বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করেন আপনি বৌদ্ধ স্বর্গে যাবেন। আর যদি ইসলাম ধর্ম পালন করেন। আপনি যাবেন মুসলিম স্বর্গে, বৌদ্ধ স্বর্গে নয়।

দ্বিতীয় ধরণের অন্তর্ভুক্তবাদ বা বহুত্ববাদের পক্ষে মূল বিষয় হল অপর ধর্মকে কীভাবে বোঝা যেতে পারে আর স্ব-ধর্মের সঙ্গে তার তুলনা কী ক’রে করা যাবে। (উক্ত ধরণটি বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পার্থক্যকে সম্মান করে, কোন রকম উচু-নীচু ভেদাভেদ না ক’রে তাদের সবাইকে বৈধরূপে গ্রহণ করে)।

  • আপনি কি অন্য ধর্মকে একচেটিয়াভাবে তার নিজের শর্তে বুঝতে পারেন, বা তাদের বোধগম্য করার জন্য আপনার নিজের বিশ্বাস ব্যবস্থা থেকে তাদের দাবীগুলিকে প্রকাশ করতে হবে?
  • আপনি যদি পরেরটা মনে করেন (সেগুলিকে বোধগম্য করার জন্য আপনি আপনার নিজস্ব বিশ্বাস ব্যবস্থার দিক থেকে নিজের মতবাদ প্রকাশ করুন), তাহলে যে পদ্ধতি এক ভাবে হস্তান্তরিত হচ্ছে বা অবনতি হচ্ছে সেটা ছাড়া আপনি এটা করতে পারেন, যার সম্পর্কে আপনি দাবি করেন যে তাদের বিশ্বাস হল আপনার বিশ্বাসের বৈকল্পিক রূপ?

অন্যদিকে, আপনি যদি বৌদ্ধধর্ম ও ইসলামের মতো দুটি ধর্মে সাদৃশপূর্ণ বিষয় ও তত্ত্ব খুঁজে পান, তারপর আপনার নিজস্ব ধারণার পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে যদি অপর ধর্মের তত্ত্বসমূহকে বিবৃত করার প্রয়োজন হয়; তাহলে আপনি পার্থক্যগুলি বুঝতে ও শ্রদ্ধা করতে পারবেন। বিনা বিচারে সহনীয় মনোভাবে ওই পার্থক্যগুলিকে শ্রদ্ধা করতে পারবেন। আপনার ধর্ম শ্রেষ্ঠ এমন ধারণা থাকবে না। অপর ধর্ম থেকে আমি উচ্চাসনে আছি, এমন ধারণাও থাকবে না। এরকম শ্রদ্ধা ও অনুধাবনের মাধ্যমেই আপনি ধর্মীয় সমন্বয় স্থাপন করতে পারবেন। পরম পূজ্য দালাই লামাজীও এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- “শ্রেষ্ঠ ধর্ম কোনটি?” তিনি উত্তর দেন “সেটা হল বিশ্বাস ও অনুশীলনের মেলবন্ধন যা আপনাকে আরও বেশী দয়ালু ও করুণাময় ক’রে তুলবে।”

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

বৌদ্ধধর্মের প্রতি মুসলিমদের ঐতিহাসিক নৈকট্য

এখন, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের দিকে ভাল ক’রে দেখা যাক। ইসলামের বিষয়ে বলতে গেলে আমি আমার ব্যক্তিগত গবেষণার অতিরিক্ত রেজাশাহ কাজেমি রচিত গ্রন্থ Common ground between Islam and Buddhism যেটা পরম পূজ্য দালাই লামাজী এবং জর্ডনের রাজকুমার গাজী বিন মহম্মদ মুখবন্ধ লিখেছেন তার থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রাসঙ্গিক উদ্ধরণ আমি ডঃ কাজেমির কোরান থেকে নিয়েছি।

ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম ও বৌদ্ধগণ উভয়েই অন্তর্ভুক্তবাদী দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করেছে। এখানে বৌদ্ধধর্মকে ইন্দো-তিব্বতী শাখায় সীমিত রাখব। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিমগণ বৌদ্ধদের ‘গ্রন্থের মানুষ’ হিসাবে ইহুদি, খ্রীষ্টান ও জোরোষ্ট্রিয়ানদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটা কীভাবে হল?

উম্যাদ খলিফাদের সময় (৬৬১ খ্রীঃ- ৭৫০ খ্রীঃ) আরবরা তাদের শাসন ও ধর্ম ‘ইসলাম’কে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রসারিত করেছে। এইভাবে অষ্টম শতকের প্রথম দিকে উম্যাদ সেনাপতি মহম্মদ বিন কাশিম বৌদ্ধ অধ্যুসিত সিন্ধ অঞ্চল যা বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল জয় করেন। কোন একটি প্রধান শহরের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুগণ অনুরোধ করল যে ওঁরা যেন তাদের মন্দির পুনঃনির্মাণ ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পেতে পারেন। সেনাপতি কাশিম শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সঙ্গে বিচার বিবেচনা করলেন, তিনি আবার মৌলভিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। ধর্মীয় মৌলানাগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী বসতি সম্বন্ধে জানলেন এবং বৌদ্ধদের (হিন্দুসহ) ‘গ্রন্থের মানব’ বলে ঘোষণা করলেন।

উম্যাদ শাসক হাজ্জাজ-এর আদেশ নামা,

“বৌদ্ধ অন্যান্য মন্দির নির্মাণ এবং ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী দলপতিদের অনুরোধ ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। সাধারণ কর ব্যতীত তাহাদের উপর আমাদের আর কোন অধিকার থাকিতে পারে, সেটা দেখিতে পাইতেছি না। তাহারা আমাদের নিকট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়াছে এবং ধার্য জিজিয়া কর খলিফাকে দিতে হইয়াছে কারণ তাহারা সংরক্ষিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত (আ. ধিম্মি) হইয়াছেন। তাহাদের জীবন ও সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই। তাহাদের স্ব-ধর্ম পালনের অনুমতি দান কর। তাহাদের কেহ বাধা দেওয়া উচিত।”

এরপর, মন্দির ও বিহার তৈরীর জন্য বৌদ্ধদের অনুমতি দেওয়া হল। যতদিন পর্যন্ত জিজিয়া কর দিতে পারবে ততদিন পর্যন্ত তাদের অমুসলিম সংরক্ষিত বিষয় (জাতি) হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হল। উম্যাদ খলিফাগণ এবং পরবর্তী সময়ে বাগদাদের শাসক আব্বাসি খলিফাগণ ও ভারতের মুসলিম শাসকরাও একই নীতি নিয়েছিল। তবে অবশ্যই সকল শাসক ও সেনাপতি সেটা পালন করেনি। যাইহোক, এই আদেশের অন্তর্নিহিত অর্থ হল যে, বৌদ্ধধর্ম একটি পৌত্তলিক নিকৃষ্টধর্মের মতো নয়। তাদের অনুগামীদের সেই সুবিধা দেওয়া হয়নি।

এখন আপনি তর্ক জুড়তে পারেন যে, বৌদ্ধদের আইনগত বৈধতা দান ধর্মীয় কারণে নয় রাজনৈতিক কারণে দেওয়া হয়েছিল। সেটা দার্শনিক মূল্যায়নের বদলে বাস্তববাদী চিন্তা-প্রসূত সিদ্ধান্ত। এটা সম্ভবত তাই ছিল। মন্দির নির্মাণের অনুমতি দানের পর আরব শাসকগণ মন্দিরের দর্শনার্থী ও পূজারীদের উপর কর চাপিয়েছিল।

যাই হোক না কেন, ইসলামী বিদ্বান পন্ডিতগণ করেনি। ওই ‘বাস্তবোচিত’ নীতি ইসলামের মূল তত্ত্বের সঙ্গে আপোষ করা বা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে ওঁরা মনে করেন না। বৌদ্ধদের আইনি স্বীকৃতি দান, রাজনৈতিক রক্ষাকবচ দান এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে প্রকাশ্যে আনয়ন এটাই বোঝায় যে বৌদ্ধ বিশ্বাসে যে আধ্যাত্মিক মার্গ এবং নৈতিক নীতি রয়েছে তার উচ্চতর কর্তৃপক্ষ ভগবানের মত বিশ্বাসযোগ্য, কোন কিছু থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বৌদ্ধদের গ্রন্থের মানব বলার ভিত্তিটি কী? সেটা কি শুধু একইরকম পূজাপদ্ধতির প্রথার জন্য হয়েছে? উদাহরণ স্বরূপ, অষ্টম শতকের প্রথমদিকে ইরানি পন্ডিত ও ঐতিহাসিক আল্‌ কেরমানি আফগানিস্তানের বালক্‌ প্রদেশের নব বিহার মন্দিরের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি বেশ কিছু বৌদ্ধ রীতির সঙ্গে ইসলামের সাদৃশ্য দেখেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে মূল মন্দিরের মধ্যে একটি চৌকো পাথর বস্ত্র দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং উপাসকগণ সেটা প্রদক্ষিণ করেন এবং ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন মক্কার কাবাতে যেমনটি করা হয়। তিনি অবশ্য বৌদ্ধ বিশ্বাস নিয়ে কোন আলোচনা করেননি।

সুতরাং বৌদ্ধদের “গ্রন্থের মানব” বলার পিছনে কী কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি বৌদ্ধদের “গ্রন্থের মানব” বলে চিহ্নিত করা হয় এবং প্রকাশ্যে তাদের ‘সংরক্ষিত’ গোষ্ঠী হিসাবে কোরানের ২.৬২ আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২.৬২ আয়াত বলছেঃ

যাহারা প্রকৃত বিশ্বাসী এবং যাহারা ইহুদি এবং খ্রীষ্টান এবং সেবিয়ান যাহারা ভগবানে এবং অন্তিম দিনে বিশ্বাসী এবং পুণ্য কর্ম করে- তাহার জন্য তাহাদের প্রভুর সঙ্গে তাহাদের পুরষ্কার থাকিবে। তাহাদের উপর কোন ভয় ও দুঃখকষ্ট নামিয়া আসিবে না।

এই আয়াতটি বৌদ্ধধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সাধারণ সাদৃশ্যের ইঙ্গিতবাহী। কোরান অনুসারে ভগবান ও অন্তিম বিচারের দিন এবং পুণ্য ও সৃষ্টিশীল কর্ম করার উপদেশ, এর মধ্যে রয়েছে সেই ভিত্তিটুকু। এমনকি মতবাদ এক না হলেও তাদের অন্তত সমকক্ষ হবার যোগ্য বলে ইসলাম মনে করে। কোরানে যেমনটি বলা হয়েছে (২.১৩৭)-

এবং তোমরা যেমন বিশ্বাস কর তেমনটি তাহারা যদি বিশ্বাস করে, তাহলে তাহারা সঠিক দিশাপ্রাপ্ত।

এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে অন্তর্ভুক্তবাদে অন্তর্ভুক্ত। বৌদ্ধরাও ইসলাম এ কথিত মুক্তি লাভ করবে কারণ ওঁরাও একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।

তাহলে প্রশ্ন হল ঈশ্বর, ঈশ্বর কর্তৃক প্রদর্শিত ধর্ম, অন্তিম বিচারের দিন, একমাত্র সত্য ইত্যাদি ধারণার সীমারেখা কী হবে? বৌদ্ধ ও ইসলামের কিছু ধর্মাচার্য এই বিষয়ের সংগায়নে অত্যন্ত গোঁড়া। কতিপয় আবার এগুলিকে উদারতার সঙ্গে দেখেছেন।

ইসলামের প্রতি ঐতিহাসিক বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ

এই ধারণাগুলির সীমা অন্বেষণের পূর্বে ইসলামের প্রতি বৌদ্ধদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের দিকে দেখা যাক। বৌদ্ধ পরম্পরার সংস্কৃত ভাষায় রচিত কালচক্র তন্ত্রের গ্রন্থে ইসলামী রীতি ও বিশ্বাসের একমাত্র উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ সেটা দক্ষিণ আফগানিস্তান ও উত্তর পাকিস্তানে দশম শতকের শেষে বা একাদশ শতকের প্রথমদিকে লেখা হয়েছে। তৎকালে বৌদ্ধগণ মুলতানের শাসকদের দিকে থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ছিলেন। মুলতানি শাসকরা ছিলেন ইসমাইল ঘরানার শিয়া পন্থী। মুলতান ও মিশরের ফাতিমি খলিফারা সংযুক্তভাবে আরব আব্বাসি খলিফাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং ইসলামী দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বৌদ্ধ ও হিন্দুগণ এই প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাঝখানে পতিত হয়েছিল।

সম্ভাব্য আগ্রাসনকারীদের বিশ্বাস ও প্রথা সম্বন্ধে কালচক্র গ্রন্থ কিছু উল্লেখ করেছে। কিছু বিশ্বাস ইসমাইলদের ভাবনা ব্যক্ত করেছে, যেমন- নবীদের তালিকা; সেটা আবার অন্যরা মানে না। আবার ঐ তালিকায় যুক্ত হয়েছে মানিকাবাদের প্রবক্তা। এই সমস্ত আচরণের সঙ্গে যুক্ত বৌদ্ধ নৈতিক মূল্যবোধের নীতির সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। যদিও গ্রন্থে তাদের একই রকম বলে লেখা হয়নি। যাই হোক এই বিষয়গুলি দুটি ধর্মের মধ্যে একটি সাধারণ ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, শ্রী কালচক্র তন্ত্রোত্তরতন্ত্রহৃদয় বলছে-

তাদের একটি জাতি, চুরি করে না এবং সত্যবাদী। তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, অপরের স্ত্রী থেকে দূরে থাকে, নির্দিষ্ট সাধনা পালন করে এবং স্বপত্নীতে বিশ্বস্ত থাকে।

অন্যত্রও, অন্তর্ভুক্তবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা খুঁজে পাই। বৌদ্ধ পরিভাষায় আক্রমণকারীদের বিশ্বাস নিয়ে কালচক্রতন্ত্রের লঘু কালচক্রতন্ত্র রাজা গ্রন্থের ২.১৬৪ সুক্ত বলছে-

গতিশীল বা স্থাবর সমস্ত বিষয় সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক সৃষ্টিজাত। তাহাকে সন্তুষ্ট করা থেকেই মিলে মুক্তির কারণ টাইস, যেখানে স্বর্গ রয়েছে।

এটা অবশ্যই মানুষের জন্য রহমানের উপদেশ। আক্রমণকারীদের কালচক্র গ্রন্থ ‘তাই’ দ্বারা ব্যক্ত করেছে। এই আরবী শব্দটি ইসানের আরবী আক্রমণকারীদের বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে (পারসী শব্দ- তাজি)। ‘রহমান’ পরম করুণাময় আল্লাহ্‌-এর উপাধি।

পুন্ডরিক এই পদের অত্যুজ্জ্বল ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ‘বিমলপ্রভনাম-লঘু-কালচক্রতন্ত্ররাজাটিকা’ গ্রন্থে বলছেন-

এখন, তায়ি আক্রমণকারীদের মতবাদ বলা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা রহমান সকল ক্রিয়াশীল বস্তুর সৃষ্টি করছেন, স্থাবর ও গমনশীল উভয়ই। তাই-দের বিশেষ ক’রে শ্বেতবস্ত্রধারী আক্রমণকারীদের কাছে মুক্তির উপায় হল রহমানকে তুষ্ট করা এবং এই মানুষের উচ্চস্থানে (স্বর্গে) পুনর্জন্মের অবশ্যই সহায়ক হবে। তিনি সন্তুষ্ট না হলে নরকে জন্ম হবে। এইগুলি হল রহমানের উপদেশ যা তাইদের মতবাদ।

পুন্ডরিক আরও বলছেন-

আক্রমণকারী তাইদের মতে মৃত মানুষ স্বর্গ বা নরক যেখানেই জন্ম নিক না কেন তাদের মানবদেহ নিয়েই দুঃখ বা কষ্ট অনুভব করবে এবং সেটা রহমানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হবে।

এখানে ইসলামের প্রতি বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধবাদী দৃষ্টিকোণে সমতা মানুষের নৈতিক আচরণের ভিত্তিতে স্বর্গ অথবা নরকে পুনর্জন্মের দৃষ্টির উপর নির্ভর করে। এখানে এই অংশ সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় বিষয় হল যে কালচক্র গ্রন্থ সৃষ্টিকর্তার মতবাদের উপর কোন ব্যাখ্যা মন্তব্য করে না, এটা এও মন্তব্য করে না যে ব্যক্তির পুনর্জন্ম নির্ধারণে সৃষ্টিকর্তার কী ভূমিকা আছে এবং তারজন্য সেই ব্যক্তি তাকে সন্তুষ্ট করেছে কিনা। তবে শেষ বিন্দুতে, ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করেছে কিনা তার ভিত্তিতে আল্লাহর রায় নির্ধারিত। এই বিষয়ে বৌদ্ধ উপস্থাপনা উচিত বলে মনে হয় না। হাদিত অনুযায়ী (মহম্মদের জীবন বৃত্তান্ত), আল্লাহ বলেছেনঃ

হে আমার সেবকগণ, আমি তোমাদের কর্ম পরীক্ষা করি এবং তার ভিত্তিতে ফল প্রদান করি।

যাইহোক, কালচক্র গ্রন্থগুলি কেবল পরবর্তী জীবনের স্বরূপ এবং পরবর্তী জীবনে মনুষ্য দ্বারা এই জীবনে কৃত সামান্য কর্মের ফল সম্পর্কে আলোচনা করে। এই বিষয়ে, এইভাবে আলোচনা করার সময় কালচক্র গ্রন্থগুলি অন্তর্ভুক্তবাদীদের দৃষ্টিকোণ প্রস্তুত করে। আর সেখানে আক্রান্তদের অনন্ত পুনর্জন্মের মতবাদ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা উপস্থাপিত করে যার বিষয়ে বৌদ্ধধর্ম আরও বেশি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে। লঘু কালচক্র তন্ত্র দ্বিতীয়, ১৭৪ ব্যাখ্যা করেঃ

(অনন্ত) পরবর্তী জীবনের মাধ্যমে মানুষ সংসারে নিজের দ্বারা পূর্বে কৃত কর্মের (ফল) ভোগ করে। যদি তাই হতো তাহলে এক জন্ম থেকে অন্য জন্ম পর্যন্ত মানুষের কর্মের হিসাব কখনোই সমাপ্ত হতো না। যদি তাই হতো তাহলে সংসার থেকে মুক্তি কখনোই সম্ভব হতো না। আর অনন্ত অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতেও মুক্তি কখনো সম্ভব হতো না। অবশ্যই এই ধারণা তায়ী লোকজনদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় যদিও অন্যান্য সমুদায় এর খন্ডন করে।

আমরা যদি অনন্ত নরকদন্ডকে ব্যাপক বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে বৌদ্ধ এবং মুসলিম দৃষ্টিকোণের মধ্যে সাদৃশ্য একটু বেড়ে যাবে। এর কারণ হল, আপনি দেখতে পাবেন যে পুনর্জন্ম এবং মুক্তি সম্পর্কে মুসলিম দৃষ্টিকোণ বৌদ্ধদৃষ্টিকোণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা ধাপ। তারপর আবার, বৌদ্ধ শব্দাবলীতে আপনি বলতে পারেন যে মুসলিমরা কেবল দুঃখ-দুঃখতা অথবা সবচেয়ে নিম্নতর পুনর্জন্মের অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলে। এই মুক্তির অর্থ হল স্বর্গে পুনর্জন্মের অবস্থা। কিন্তু মার্গক্রম (লাম-রিম) অনুসারে, এটা কেবল প্রারম্ভিক লক্ষ্যের অনুপ্রেরণা মাত্র। এরপর বৌদ্ধধর্ম মধ্যম লক্ষ্যের অনুপ্রেরণার অন্তর্গত সংস্কার দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলে। চর্চার এই আলোকে, ইসলামের অনুসরণ করার অর্থ হল বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করার প্রারম্ভিক ধাপ অনুসরণ করা।

কিন্তু আপনি অনন্ত দুঃখ সম্পর্কিত মুসলিম মতবাদকে আলাদাভাবে দেখতে পারেন যাতে সেটাকে বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা মনে না হয়। কালচক্র গ্রন্থে, মুসলিমদের নরকের ধারণা সম্পর্কে আপত্তি হল যে একবার নরকের অগ্নিতে পতন হয়ে গেলে, সেই যাতনা অনন্ত হয়ে যায় এবং সেখান থেকে কারও মুক্তি সম্ভব হয় না। কিন্তু যদি কেউ বৌদ্ধ মতানুযায়ী সংসারের বিবরণ দেখে, তাহলে সেই সত্ত্ব সেখানে সেইভাবে পরিত্রাণ পেতে চায়, যেমনকি জ্বলন্ত ভবন থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চায়। এছাড়াও সাংসারিক পুনর্জন্মের চক্র ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকবে যতক্ষণ না সেই সত্ত্ব তার থেকে মুক্তির কোন উপায়ের খোঁজ করে, অর্থাৎ ধর্মের প্রতি অভিমুখ করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ঞিঙ্‌মা গুরু মিফাম (মি-ফাম জাম-ইয়াঙ্‌ নাম-গ্যাল গ্যাছো) তার “The Glorious Kalacakra Tantra” শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেনঃ অধ্যায়ের ভাষ্য (পঞ্চম), গভীর সচেতনতা (পালদুস-কি খোর-লোই গ্যুদ্‌-ক্যি ছিগ-দোনরাব-তু সেল-ছে-দোর্জে নি-মাই নাঙ্‌-বা, ইয়ে-শে লেলুই ডেল-ছেন), মূল কালচক্র সাহিত্যের চেয়ে আরও শক্তিশালী অন্তর্ভুক্তিবাদী পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। এটা ইঙ্গিত করে যে, বুদ্ধ কুশলতার সাথে মুসলিমদের বোধি প্রাপ্ত করার দিকে পরিচালিত করার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। মিফাম লিখেছেনঃ

অ-ভারতীয় আক্রমণকারীদের দুটি (দার্শনিক বিন্দু) আছে যা তারা ধরে রাখে। তারা পরমাণু সংগ্রহের প্রকৃতির জন্য বাহ্যিক ঘটনাকে ধরে রাখে এবং তারা এমন একজন ব্যক্তির আত্মার অস্তিত্বকে ধরে রাখে যে অস্থায়ীভাবে জন্ম নেয় বা যার একটি স্বরূপ আছে যেটা সংসারে জন্ম নেয়। এর লক্ষ্য হল, এর ফলস্বরূপ দেবতাদের সুখ লাভ করা। এগুলি ছাড়া, তারা অন্য কোনও ধরণের নির্বাণ সম্পর্কে মত প্রকাশ করে না।

মিফাম আক্রমণকারীদের মতবাদকে ইঙ্গিত ক’রে বলেছেন যে, বস্তুর পারমাণবিক স্বভাব বৌদ্ধ মতের সাথে খাপ খায়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, হীনযান বৌদ্ধধর্মের বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক নিকায় অবিভাজ্য, অনবয়ব পরমাণুর কথা বলে; অন্যদিকে মহাযান বৌদ্ধধর্মের চিত্তমাত্র (বিজ্ঞানবাদ) এবং মধ্যমক নিকায়গুলি অনবরতভাবে বিভাজ্য পরমাণুগুলির মতবাদ প্রকাশ করে।

মিফাম অহং বা আত্মা সম্পর্কে বলতে থাকেন,

তারা (আক্রমণকারীরা) কী গ্রহণ করতে পারবে, বুদ্ধ তাদের প্রবৃত্তি এবং চিন্তা-ভাবনা বুঝে সেই সূত্রের উপর উপদেশ দিয়েছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, “ভারোদ্বহনসূত্রে” বুদ্ধ বলেছেন যে (নিজের কর্মের) দায়িত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে কিন্তু ব্যক্তির আত্মা নিত্য না অনিত্য সেই বিষয়ে কিছু বলে না। এই বিষয়গুলি তাদের (আক্রমণকারী) মতবাদের দৃষ্টিতে সত্য। বুদ্ধের অভিষ্ট অর্থ হল যে ব্যক্তি এমন একটি আত্মার সন্ততি হিসাবে অস্তিত্বে আছে যা কর্মের দায়িত্ব বহন করে, কিন্তু যা শুধুমাত্র একটি সন্ততির উপর অভিহিত করা হয় এবং স্বভাবতঃ এটা স্থায়ী বা অস্থায়ী নয়।
মনের অভ্যাস থেকে উদ্ভূত স্বপ্ন অবস্থায় মূর্ত ব্যক্তি, যে আনন্দ এবং দুঃখ অনুভব করে, তার কোন অস্তিত্ব থাকে না। যেহেতু এটা নিছক আভাস, সেক্ষেত্রে (ব্যক্তির) অনিত্যতা একটা অনিত্য বস্তুর প্রকৃতির মতো হয় না। এর কারণ হল, এটা একটা ব্যক্তির স্বভাব বিরুদ্ধ। শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হলে, এটা (স্পষ্টতই) এমন একটি বস্তু যার নিত্য বা অনিত্য কোন প্রক্ষেপণ থাকে না, এইরকম শেখান হয়। তথাগতের এই শিক্ষার কারণে, (আক্রমণকারীরা) আক্রমণকারীদের ধর্ম পরিত্যাগ করে এবং পরবর্তীকালে একটি বৌদ্ধ ব্যবস্থার অধিকারী বৈভাষিক হয়ে ওঠে।

এখানে অন্তর্ভুক্তিবাদী মনোভাব হল বুদ্ধ এমন শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আক্রমণকারীর মতবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই দক্ষতার মাধ্যমে তিনি আক্রমণকারীদের মুক্তির দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুসলিমরা স্পষ্টতই এটাকে আপত্তিকর বলে মনে করে এবং এই মনোভাবে স্পষ্টতই ধর্মীয় সম্প্রীতির স্থাপনা সম্ভব হয় না।

সাধারণ ভিত্তিতে বৌদ্ধদের গ্রন্থের মানুষ হিসাবে বিবেচিত করা হয়

সাধারণ ভিত্তিগুলি পরীক্ষা করার জন্য বৌদ্ধদের গ্রন্থের মানুষ হিসাবে বিবেচনা ক’রে আমাদের ইসলামের নিহিতার্থে ফিরে আসা যাক। যেমনটা আমরা দেখেছি, এই মতবাদের সাধারণ ভিত্তি হল যে বৌদ্ধধর্ম হল উচ্চতর কর্তৃত্ব অর্থাৎ ঈশ্বর দ্বারা প্রকাশিত একটা ধর্ম। এটা অবশ্যই, উন্মোচনের উৎস হিসাবে ঈশ্বর এবং সেই ব্যক্তি যিনি সেই উন্মোচনটা করতে পেরেছেন এবং সেটা তিনি বিশ্বের সাথে আদান-প্রদান করেছেন, সেই ব্যক্তির উপর প্রশ্ন ওঠে।

বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয়ই উন্মোচন সম্পর্কে এই প্রশ্নটির বিষয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিবাদী পদ্ধতি অনুসরণ করে। উদাহরণ স্বরূপ, কালচক্র ভাষ্য “স্টেইনলেস লাইট” ব্যাখ্যা করে,

আক্রমণকারীদের বিষয়ে, পয়গম্বর/ পেগাম্বর মহম্মদ ছিলেন রহমানের অবতার। আক্রমণকারীদের শিক্ষার নির্দেশক ছিলেন আক্রমণকারী তায়িসের গুরু এবং শিক্ষক।

হিন্দুধর্মে, অবতার হল একটি দেবতার আত্মার অন্য রূপের আবির্ভাব। এইভাবে, মহম্মদ রহমানের অবতার হওয়া এবং কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার বলে হিন্দুদের মতবাদ সমান্তরাল। বৌদ্ধ পরিভাষায়, এই সাদৃশ্যটি মতবাদ প্রকাশ করার সমতুল্য হবে যে মহম্মদ আল্লাহর একজন নির্মাণকায় রূপে উদ্ভূত রূপ।

অন্যদিকে, বুদ্ধকে কি আল্লাহর নবী বা দূত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে? পারস্যের ইতিহাসবিদ আল-বেরুনি ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রীষ্টিয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আক্রমণের সময় গজনীর মাহমুদের সাথে ছিলেন। সেখানে তিনি যা শিখেছিলেন, তার উপর ভিত্তি করে আল-বেরুনি ভারত সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন (আরবী. কিতাব-আল-হিন্দ)। এতে, তিনি মৌলিক বৌদ্ধ রীতিনীতি এবং আস্থার বর্ণনা করেছিলেন এবং উল্লেখ করেছিলেন যে, ভারতীয়রা বুদ্ধকে একজন ধর্মপ্রবক্তা বা প্রবর্তক হিসাবে গণ্য করে। এর মানে এই নয় যে, তিনি বুদ্ধকে মুসলিমদের আল্লাহর নবী অথবা দূত হিসাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবুও কোরাণ (৪: ১৬৩-১৬৪) বলেঃ

সত্যিই আমরা আপনাকে অনুপ্রাণিত করি, যেমন আমরা নোয়াহ্‌ এবং তার পরবর্তী ধর্ম প্রবর্তকদের অনুপ্রাণিত করেছি, যেমন আমরা আব্রাহাম, ইসমাইল এবং ইসাক ও জেকব, আর পিতৃপুরুষদের এবং যিশু, কোব এবং জোনাহ্‌, অ্যারণ এবং সলোমনকে অনুপ্রাণিত করেছি এবং আমরা যেমন ডেভিডকে ধর্ম সংগীত প্রদান করেছি। আমরা আপনাকে উল্লেখ করেছি যে আগে যত বার্তাদূত পাঠানো হয়েছিল ও অন্য বার্তাদূতদের বিষয়ে উল্লেখ করিনি।

বুদ্ধকে এমন বার্তাবাহকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যার বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

উদাহরণ স্বরূপ, কোন বুদ্ধের বারোটি জ্ঞানদায়ক লীলার উপস্থাপনা অনুসারে, বুদ্ধ বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়, যখন সত্ত্বাগণ পরিপক্ক হয় এবং প্রতিটি যুগে ধর্মকে আলাদাভাবে শিক্ষা দেন, যাতে সেখানে সত্ত্বদের অনুরূপ হয়। যদিও এই কল্পের এক হাজার উত্তম নির্মাণকায় বুদ্ধ আছে, পরবর্তী মহাকল্প পূর্বে অনেক সংখ্যক মহাকল্পে এমন ধরণের বুদ্ধ আবির্ভূত হবেন, সেখানে এমন অনেক নির্মাণকায় ব্যক্তিত্ব থাকবেন যেখানে প্রতিটি উত্তম নির্মাণকায়ের শিক্ষার অস্তিত্ব থাকবে। নির্মাণকায়দের এই উভয় দলকে “ধর্মের বার্তাবাহক” হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রতিটি বুদ্ধ বিভিন্ন লোকের জন্য ভিন্নভাবে ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্য কুশল উপায় ব্যবহার করেন। কারও-কারও জন্য, বুদ্ধ এমনও শিক্ষা দিয়েছেন যে আত্মার অস্তিত্ব আছে। ইসলামেরও দক্ষ উপায়ে শিক্ষা দেওয়ার নিজস্ব সংস্করণ আছে। কোরাণ (১৪:৪) বলে, 

আমি আর কোনও দূতকে তার মানুষদের ভাষা ব্যতীত প্রেরণ করিনি, যাতে সে তাদের কাছে সেটা স্পষ্ট ক’রে না দেয়।

আমাদের এখানে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও ইসলাম বুদ্ধকে ঈশ্বরের দূত হিসাবে মেনে নিতে পারে; মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রীষ্টান এবং ইহুদীরা বেশ ক্ষুব্ধ হবে যদি বলা হয় যে, মহম্মদ, যীশু, আব্রাহাম এবং ডেভিড, এঁরা নির্মাণকায় বুদ্ধ বা আল্লাহর অবতার। এটা তুলনামূলক ধর্মের অন্তর্ভুক্তিবাদী পদ্ধতির একটি প্রধান ত্রুটি। যাইহোক, আমরা কীভাবে বৌদ্ধ মতবাদটি বুঝতে পারব যে নাগার্জুন যে প্রজ্ঞাপারমিতার শিক্ষা উদ্ঘাটন করেছিলেন যেটা মঞ্জুশ্রী নাগদের কাছে সুপুর্দ করেছিলেন এবং যারা সেটা সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে রেখেছিল? নাকি অসঙ্গ মৈত্রেয়র কাছ থেকে মৈত্রী, করুণা এবং বোধিচিত্তের বিপুল কর্মের শিক্ষা প্রাপ্ত, যখন তাকে তুষিত স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? আমরা কীভাবে ঞিঙ্‌মা পরম্পরার বিশুদ্ধ দৃষ্টি এবং উদ্ঘাটিত নিধি (তেরমা) গ্রন্থের শিক্ষা বুঝতে পারব? এই বৌদ্ধ মতবাদ কি আল্লাহর বাণী জ্ঞানকে উদ্ঘাটিত করার জন্য ধর্মপ্রবক্তাদের মুসলিম মতবাদ থেকে এতই আলাদা?

আল্লাহর ক্ষেত্রে, বৌদ্ধধর্ম যে একমাত্র দিকটিকে খন্ডন করে সেটা হল একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা যেকোন কিছুর কারণে প্রভাবিত হয়ে বা বশিভূত না হয়ে সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি সৃষ্টি করার ইচ্ছার মাধ্যমেও সৃষ্টি করতে পারেন।

এটা ঈশ্বরের অন্যান্য গুণাবলী, এমনকি সৃষ্টিকেও খন্ডন করে না। উদাহরণ স্বরূপ, অনুত্তরযোগতন্ত্র ব্যাখ্যা করে যে, প্রতিটি ব্যক্তির প্রভাস্বর চিত্তই সেই ব্যক্তি যে সমস্ত আভাস অনুভব করে তার সৃষ্টিকর্তা এবং সেটা সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত কর্ম এবং সামুহিক কর্ম উভয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। তদুপরি, গভীরতম সত্য অর্থাৎ পারমার্থিক সত্য হিসাবে, প্রভাস্বর চিত্ত আল্লাহর মতো, কথা ও ধারণা অতীত। কোরাণ ঘোষণা করেঃ

মহান এবং উচ্চ হল আল্লাহ, তারা যেভাবে ব্যাখ্যা করে।

তবুও, আল্লাহর নিরানব্বইটা নাম আছে এবং এগুলি আল্লাহর অত্যাবশ্যক গুণাবলীকে নির্দেশ করে। একইভাবে, মঞ্জুশ্রী-নাম-সংগীতি (জাম-পাল ছেন জো)-এ মঞ্জুশ্রী তার আদি অবস্থায় প্রভাস্বর চিত্তকে বোঝায় এবং এই কালচক্র গ্রন্থের শ্লোকগুলি তার গুণাবলীকে ব্যাখ্যা করে।

আল্লাহর মতো, প্রভাস্বর চিত্তধারী মঞ্জুশ্রী হলেনঃ

(৫৮) আদিম, যিনি হলেন সর্বোচ্চ
(১০০) যিনি হলেন অনাদি এবং অনন্ত
(৯৭) অপ্রকাশিত, যাকে দেখা যায় না, যার কোন চিহ্ন নেই যেটা তাকে দেখাবে।

এছাড়াও আল্লাহ এক, একইভাবে প্রভাস্বর চিত্তধারী মঞ্জুশ্রীও হলেন তাইঃ

(৪৭) অদ্বয়, অদ্বয়ের বক্তা।

আল্লাহর অত্যাবশ্যক গুণাবলীর মধ্যে একটি হল আল-হক্ক-বাস্তব, সত্য, যেটা সঠিক, সেটাও একটা নৈতিক অর্থে। ধর্মের অর্থে ধর্মতার সাথে এর একটা ধারণাগত সম্পর্ক আছে- পারমার্থিক সত্য, গভীর সচেতনতা ধর্মকায়।

প্রভাস্বর চিত্তধারী মঞ্জুশ্রী হলঃ

(৫৫-৫৬) পবিত্র ধর্ম, ধর্মের শাসক ......... দুর্দান্ত, অবিনশ্বর ধর্মতা
(৪৭) যেটা পূর্ণরূপে সঠিক তার শেষবিন্দুতে স্থির সিংহের গর্জনের সাথে নিঃস্বভাব।
(১৫৭) তিনি হলেন পরমার্থ সত্যের বিশুদ্ধতা এবং গরিমা।

আল্লাহকে সর্বদা অল-রহমান, করুণাময়, এবং অল-রহিম, দয়ালু হিসাবে উল্লেখ করা হয়- করুণাবশতঃ সৃষ্টি করার অর্থে করুণাময় এবং অন্যদের দুঃখ থেকে উদ্ধার করার জন্য দয়ালু। জোগছেন (নিষ্পন্নক্রম)-এ, বিদ্যার গুণ হল, বিশুদ্ধ সচেতনতা, যা আভাসকে প্রকট করে সেটাকে “করুণা” বলা হয়। তদুপরি, মঞ্জুশ্রী অর্থাৎ প্রভাস্বর চিত্তঃ

(৩৮) মহামৈত্রী, মহাকরুণার সর্বোত্তম চিত্ত দ্বারা গঠিত
(৮৮) সব প্রাণীর লক্ষ্য পূরণকারী সাধন, উপকারের কামনাকারী, অগণিত প্রাণীর প্রতি পিতামাতার স্নেহের অধিকারী।

এছাড়াও, আল্লাহর মতো, প্রভাস্বর চিত্তধারী মঞ্জুশ্রীঃ

(১৫২) নৈবেদ্য প্রাপ্ত করার যোগ্য, প্রশংসার যোগ্য, প্রণাম করার যোগ্য ........ বন্দনীয়, শ্রদ্ধার যোগ্য, আনুগত্য-স্বীকারের যোগ্য।

আল্লাহ সম্পর্কে এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য, প্রভাস্বর চিত্ত, সত্যের স্ফূর্তি, করুণা ইত্যাদি, মৌলিক ভাগ করা নৈতিক নীতিগুলি ছাড়াও বৌদ্ধ ও ইসলামের মধ্যে একটি সাধারণ ভিত্তি নির্দেশ করে। অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্যও উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন ইসলামে জিকির (জিক্র) এবং বৌদ্ধধর্মের মন্ত্র পাঠ, দান-ধর্মের প্রতি ঝোঁক, অধ্যয়ন, সৎ জীবিকা ইত্যাদি। আমরা যদি এই সমস্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্মানজনক বহুত্ববাদী পদ্ধতিতে বিবেচনা করি, আলোচনাত্মক ভাবনা না জাগাই এবং একে অপরের শিক্ষাগুলিকে আমাদের নিজস্ব রূপের পরিবর্তিত রূপ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা না করি, তাহলে আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরী করতে পারি।

Top