
ভূমিকা
আপনি একজন কর্মী! অভিনন্দন। এক অর্থে, বুদ্ধও একজন কর্মী ছিলেন। তাঁর জীবনকাহিনী থেকে বোঝা যায় যে তিনিও সেই সময়ের পৃথিবীর অবস্থা দেখে বিরক্ত ছিলেন। যৌবনের বেশিরভাগ সময় তিনি তার বাবার প্রাসাদে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং যখন তিনি প্রথমবারের মতো বাইরে বেরিয়েছিলেন তখনই তিনি প্রাসাদের দেয়ালের বাইরের বিশাল দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন হন, ঠিক যেমনটি আজ আপনি যখন খবর দেখেন।
যদিও দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধের আরামদায়ক বিশ্ব দৃষ্টিকে ভেঙে পরে, তবুও এটি তাকে ভয় বা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেনি। প্রকৃতপক্ষে, বুদ্ধের প্রতিক্রিয়া একজন কর্মীর মতো হয়ে ওঠে, সমস্ত জীবের দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে যাত্রা শুরু করেন। সুতরাং, বুদ্ধ এবং তাঁর শিক্ষা সরাসরি সেই জরুরি তার অনুভূতির কথা বলে যা অনেক তরুণ আজ অনুভব করে, যারা রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে বসবাস করি এবং যা আমরা এত লালন করি সেই মানবিক মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান ক্ষয় বলে মনে হয়।
পৃথিবীকে কীভাবে পরিবর্তন করা যায়
তাহলে, বৌদ্ধধর্ম অনুসারে আমরা পৃথিবীকে কীভাবে পরিবর্তন করব?
বৌদ্ধদর্শন অন্বেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, উত্তরের বিভিন্ন দিক উঠে আসতে শুরু করে। প্রথমত, পৃথিবীর অবস্থা দেখে বিরক্ত হওয়াটা খারাপ কিছু নয়। বরং বিপরীত। বৌদ্ধধর্মে, আমরা ক্লান্তবোধের এই মোড়ককে "ত্যাগ" বলি- যখন আমরা সবকিছু দেখে ফেলি এবং বুঝতে পারি যে আমাদের অস্বস্তি কমানোর জন্য আমরা যে সমস্ত স্বাভাবিক উপায় ব্যবহার করি সেগুলি আর কাজ করে না। তাই, আমরা সক্রিয়ভাবে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান শুরু করি।
বুদ্ধ যে সমাধানটি খুঁজে পেয়েছিলেন তা ছিল বেশ মৌলিক। তিনি প্রশ্নটি গ্রহণ করেছিলেন এবং একটি বিপ্লবী বক্তব্য দিয়েছিলেন: যদি আপনি পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে চান, তাহলে নিজেকে পরিবর্তন করা দিয়ে শুরু করুন। প্রথম পদক্ষেপ হল "আমি" সম্পর্কে আমাদের যে সংকীর্ণ ধারণা রয়েছে তা আরও মহান কিছুতে পরিবর্তন করা।
নিজেদের এই মহান সংস্করণ হিসেবে, আমরা এই ছোট্ট "আমি"-এর জন্য নয় বরং সকলের জন্য পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে চাই। এটি একটি বিশাল বিস্তার, তাই না? কিন্তু এর সাথে সাথে, চূড়ান্ত লক্ষ্য হল সকলের দুঃখ কষ্টের নিবৃতি, সেটা এর চেয়ে কম কিছু নয়: ক্ষুধা, যুদ্ধ, অসুস্থতা, সমস্ত মানসিক অস্বস্তি এবং দুঃখ। সমস্ত কিছু। এই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি কেবল আমাদের নিজেদের ভালোর জন্য, আত্মকেন্দ্রিকভাবে বিশ্বকে পরিবর্তন করার বিষয়টি পরিহার করে। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি এমন একজনকে বোধিসত্ত্ব হিসাবে বর্ণনা করে যিনি বিশ্বকে দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত করতে এবং সকল প্রাণীকে বোধি লাভের দিকে পরিচালিত করতে যাত্রা করেন, যার চিত্ত অপরিসীম করুণায় পূর্ণ। যেহেতু আমরা সকলেই সুখী হতে চাই এবং কেউই অসুখী হতে চাই না, তাই এটি অপরিহার্য হয়ে ওঠে যে আমরা কেবল নিজের সুবিধার জন্য নয় বরং সকলের সুবিধার জন্য বিশ্বকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করি।
শূন্যতা এবং আন্তঃনির্ভরশীলতা
তাহলে, একজন বোধিসত্ত্ব ঠিক কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারেন?
বোধি প্রাপ্তির পথে বৌদ্ধশিক্ষায় স্নাতক একজন বোধিসত্ত্ব কীভাবে পৃথিবীকে উন্নত করতে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু, আপনাকে এর স্বাদ দেওয়ার জন্য, আমরা "আমি কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারি" এই প্রশ্নটিকে এই "আমি" কে বা কী? এবং "জগৎ" আসলে কী, এই প্রশ্নে স্থানান্তরিত করি। বৌদ্ধধর্ম এই দৃষ্টিকোণটি প্রদান করে যে "জগৎ" এবং "আমি" আমরা যতটা ভাবি ততটা অপরিবর্তনীয় নয়। বুদ্ধ আমাদের অনুমানগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে আমরা যখন "আমি" বলি এবং সেটা বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা আমাদের দেহ বা মনের মধ্যে এমন কোনও একক, দৃঢ় অংশ খুঁজে পাই না যা আসলে আমি। এবং ঠিক যেমন "আমি" স্থির এবং স্বাধীন নয়, তেমনি কীভাবে একটি অপরিবর্তনীয়, একঘেয়ে "জগৎ" থাকতে পারে যা "আমরা" ঠিক করার চেষ্টা করছি? আমরা যতবেশি এই বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করি, ততই আমরা মূল বৌদ্ধশিক্ষা শূন্যতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, যে জিনিসগুলির স্ব-প্রতিষ্ঠিত অস্তিত্ব নেই এবং প্রতিত্যসমুৎপাদ, যা সবকিছুই বিপুল সংখ্যক কারণ এবং অবস্থার উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয়, কেবল কয়েকটি জিনিসের উপর নয় যা আমরা করতে পারি। এটি বুঝতে পেরে, আমরা কেবল যা করতে পারি তা করি যা তাতে কিছু অবদান রাখবে, তবে নিজেদের, বিশ্ব এবং আমরা যা করছি তা থেকে বড় কিছু তৈরি করবে না।
বুদ্ধ কি ব্যর্থ হয়েছিলেন?
তবে এখানে একটি খুব চ্যালেঞ্জিং বিষয় রয়েছে। বুদ্ধ, তাঁর মহাকরুণা এবং প্রজ্ঞার ভিত্তিতে, সমস্ত প্রাণীর উপকারের জন্য অতুলনীয় জ্ঞান (বোধি) অর্জন করেছিলেন। এবং তবুও, চারপাশে দেখুন। যুদ্ধ চলছে, অন্যায় হওয়া চলছে এবং আমরা সর্বত্র দুঃখ দেখতে পাচ্ছি। তাহলে, মহান বুদ্ধ-কর্মীর কী হয়েছিল? যদি বুদ্ধের লক্ষ্য ছিল সকলকে দুঃখ থেকে মুক্ত করা, তাহলে আমরা কীভাবে বলতে পারি যে তিনি সফল হয়েছেন?
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এবং উত্তরের গভীরতা নির্ভর করবে বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে সেই ব্যক্তির বোঝার গভীরতার উপর। বুদ্ধ রাতারাতি পৃথিবীকে রূপান্তরিত করেননি- এবং আসলে করতে পারেননি- জাদুর কাঠি নাড়ানোর মতো। কিন্তু, অন্যান্য মহান কর্মীদের মতো- গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং- এর কথা ভাবুন – তার প্রভাব তাৎক্ষণিক ফলাফল থেকে আসেনি, বরং বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সম্পূর্ণ নতুন উপায় প্রদান করেছে। পারস্পরিক নির্ভরতার বিশাল পৃথিবীতে, আমরা বলতে পারি যে, বুদ্ধের অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা পৃথিবী ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত হয়েছে। অবশ্যই, আমাদের প্রত্যেকের বৌদ্ধশিক্ষা গ্রহণ এবং অনুশীলন করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের জন্য সবকিছুই আছে– বুদ্ধ আমাদের দুঃখ কষ্টের জগতে পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী টুলবক্স যোগ করেছেন, যে কেউ যে কোনও সময় সেটা ব্যবহার করতে পারে।
আমরা যদি একটু গভীর ভাবে তাকাই, তাহলে বুদ্ধ আরও বলবেন যে আমরা যাকে "জগৎ" বলি সেটা একক নয়। এর আগে অনেক জগৎ ছিল এবং ভবিষ্যতেও অনেক জগৎ আসবে। কিছু শিক্ষা বলে যে, এমনকি বহু বিশ্ব, সমান্তরাল জগৎ, বর্তমানে বিদ্যমান আছে। আমাদের জগতের অবস্থা- অথবা বাস্তবে সম্ভাব্য যে কোনো জগৎ- স্থির নয়, এবং এর ভবিষ্যৎ ও নয় স্থির নয়। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত; যেহেতু এটি একটি পরিবর্তনশীল পৃথিবী, তাই এতে আমরা যে কোনও ইতিবাচক প্রভাব ফেলি সেটা মূল্যবান হবে। আর কেবল আমাদের শারীরিক কর্মকাণ্ডই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ পরিবর্তন কেবল বাহ্যিক ঘটনার মাধ্যমে আসে না। বৌদ্ধশিক্ষার ক্ষেত্রে মানসিক কার্যকলাপ- আমাদের চিন্তা ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দেশ্য- আমাদের কর্মের মতোই শক্তিশালী।
বোধি প্রাপ্তি সবকিছু বদলে দেয়
সবশেষে, যখন কেউ পূর্ণবোধি প্রাপ্ত করে, তখন সমীকরণ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। একজন সম্পূর্ণ বোধিপ্রাপ্ত বুদ্ধের কার্যকলাপ স্থান, কাল বা এমনকি দৃশ্যমানতার রীতিনীতি দ্বারা আবদ্ধ নয়। তারা যে সাহায্য প্রদান করে সেটা সবসময় মানুষের চোখে স্পষ্ট নাও হতে পারে, তবে তা নির্বিশেষে চলতে থাকে।
তাই, সম্ভবত আমাদের মূল প্রশ্নের উত্তর এত জটিল নয়। প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয় যখন আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করি সকল বিষয়গুলি সম্পর্কে, এবং যখন আমরা দেখি যে "আমি" এবং "জগৎ" অসংখ্য সম্ভাবনার সাথে পরস্পর সম্পর্কিত এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। বুদ্ধ দেখিয়েছিলেন যে, পরিবর্তন আসলে ভেতর থেকে শুরু হয়, কিন্তু সেখানেই শেষ হয় না। যদি আমরাও করুণা এবং প্রজ্ঞার মতো আশ্চর্যজনক গুণাবলী বিকাশ করি, তাহলে আমরা সত্যিই স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারব। আর যদি পথটি কঠিন মনে হয়? তাহলে আপনি ঠিক সেই স্থানে আছেন যেখানে বুদ্ধ এক সময় ছিলেন, যা শুরু করার জন্য উপযুক্ত জায়গা।