চিত্তের স্বভাব

চিত্তের স্তর

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সত্ত্ব (সংবেদনশীল প্রাণ) এবং অসত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধতা আছে আর সত্ত্ব এবং মানসিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন স্তর আছে। আমরা যখন জেগে থাকি, স্বপ্ন দেখি এবং গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকি, আবার আমরা যখন অজ্ঞান হয়ে থাকি, প্রতিটি পর্যায়েই মনের একটি গভীর স্তর থাকে। এমনকি মৃত্যুর সময়ও যখন শ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায় তারপরেও চিত্তের বিলুপ্তি প্রক্রিয়া চলতে থাকে, সেই সময় চিত্তের আরও গভীর স্তর থাকে। মৃত্যুর সময় যে কী ঘটে তার কোন অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, তবে আমরা জানি জেগে থাকা, স্বপ্ন দেখা এবং গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকার অভিজ্ঞতা কেমন হয়।

প্রাথমিক চিত্ত (বিজ্ঞান) এবং চেতসিকদের মধ্যে পার্থক্য

প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে প্রধান আধ্যাত্মিক সাধনাগুলি সর্বদা চিত্তের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণ স্বরূপ, সমাধি, সমাপত্তি এবং বিপশ্যনা অর্থাৎ চিত্তের একটি ব্যতিক্রমী অনুভূতিশীল অবস্থার উৎপত্তি। এই উভয় বিষয়টি চিত্তের সাথে, চিন্তা-ভাবনা এবং চিত্তকে ব্যবহার করার সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং চিত্ত কী সেটা সনাক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চিত্ত এবং চিত্তের বিভিন্ন শ্রেণী, এর উপর অনেক ব্যাখ্যা আছে, যেমন- বৌদ্ধধর্মে প্রাথমিক চিত্ত এবং চেতসিকগুলির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায় এর ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়।

বৌদ্ধ পরম্পরায় প্রাথমিক চিত্ত এবং চেতসিক সমূহের পার্থক্য বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তারমধ্যে আছে দুটি প্রধান ব্যাখ্যাঃ একটি চিত্তের বিষয়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে পার্থক্য তৈরী করে এবং অন্যটি পার্থক্য তৈরী করে চিত্তের অপরিহার্য স্বভাব অনুসারে। উদাহরণ স্বরূপ, মৈত্রেয়নাথ ‘মধ্যান্তবিভাগে’ প্রথম পার্থক্যের উপর ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন। এই ব্যাখ্যাটি চিত্তের বিষয়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে নির্ধারিত। প্রাথমিক চিত্তটি সামগ্রিকভাবে একটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যেখানে গৌণ চিত্ত বা চেতসিক সমূহ বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী কারণগুলি দৃষ্টিনিবদ্ধ করে। দ্বিতীয় উপায়টি চিত্তের দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে পার্থক্য তৈরী করে। প্রাথমিক চিত্তের মাধ্যমে বিষয়গুলি সম্পূর্ণভাবে অনুভব করা হয়। চেতসিক বা গৌণ চিত্ত সম্পর্কে বলতে গেলে এখানে বিষয়গুলি চিত্তের নির্দিষ্ট দিক অথবা চিত্তের কার্যাবলী দ্বারা অনুভব করা হয়।

এখন এই দুটির মধ্যে অর্থাৎ প্রাথমিক চিত্ত এবং চেতসিকগুলির মধ্যে আমরা দুটি বিস্তৃত বিভাগের ব্যাখ্যা করতে পারিঃ সেখানে এমন কিছু রয়েছে যার প্রয়োজন থাকে শারীরিক সেন্সর (সুবেদী গ্রাহক) আবার এমন কিছু আছে যার শারীরিক সেন্সরের প্রয়োজন থাকে না। যেগুলির শারীরিক সেন্সরের প্রয়োজন থাকে সেগুলি হল ইন্দ্রিয়গত বিজ্ঞান আর যেগুলির প্রয়োজন থাকে না সেগুলি হল মনোবিজ্ঞান (মানস বিজ্ঞান)। এখন আমাদের সেই বিষয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আলোচনা করেন। সুতরাং আমাদের কাছে রয়েছে ইন্দ্রিয়গত বিজ্ঞান বনাম মনোবিজ্ঞান বা মানসিক চেতনা, যদিও কখনো-কখনো চিত্ত শুধুমাত্র মনোবিজ্ঞানকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।

এখানে মনোবিজ্ঞান দুই প্রকারের হয়ঃ ১) একটা হল যা ইন্দ্রিয় দ্বারা তার সমানন্তর প্রত্যয়ের মাধ্যমে উদ্ভূত হয় এবং ২) দ্বিতীয়টি সমানন্তর প্রত্যয়রূপে তার ইন্দ্রিয়ের অভাব থাকে। আমাদের গ্রন্থে আমরা পাঁচটি সর্বত্রগ চেতসিক বিষয়ে কথা বলি যেগুলি ইন্দ্রিয়সহ সমস্ত বিজ্ঞানের সাথে বিদ্যমান থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মধ্যে সুপ্রবিচয় প্রজ্ঞা, সুখ ভোগের একটি স্তর ইত্যাদি আছে। প্রজ্ঞা বলতে বোঝায় “এটা কি অথবা ওটা কি” এবং বিজ্ঞানীরা বলেন যে এটি চক্ষু ইন্দ্রিয়ের ভিত্তিতে ঘটে না বরং শুধুমাত্র ঘটে মস্তিষ্কে। আমরা ব্যাখ্যা করি যে ইন্দ্রিয় নিজে চিন্তা করে না “এই রকম কিছু অথবা ওই রকম কিছু”, তবে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে পার্থক্য করার চেতসিক থাকে, যেমন- অন্ধকার এবং আলোর মধ্যে পার্থক্য করা।

আরও পার্থক্য

এখন বৌদ্ধ চিন্তাধারা এবং পরম্পরায় এই বিষয়ে অবশ্যই বিভিন্ন মতামত আছে আর আছে বুদ্ধি কীভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত। উদাহরণ স্বরূপ, বৈভাষিক অবস্থান অনুসারে এমন কোন মানসিক স্বরূপ নেই যা কোন বিষয়কে উপলব্ধি করার মাধ্যম হিসাবে গণ্য। অন্যদিকে সৌত্রান্তিকরা বলেন যে সেখানে একটি স্বরূপ থাকে অর্থাৎ মানসিক স্বরূপ এবং সেটাই হল তাই যাকে বাস্তবে অনুভব করা হয়। ঐ দ্বিতীয় মতামতটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি আছে।

সুতরাং বৌদ্ধ পরম্পরাগুলিতে দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বুদ্ধির কার্যকলাপ বিষয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে, যেমন- চাক্ষুষ-বোধ। সৌত্রান্তিক এবং চিত্তমাত্র পরম্পরাগুলির মধ্যে এই বিষয়ে শাস্ত্রার্থ হয় যে আমরা যখন একটি বস্তুর দিকে তাকাই যার অনেক রঙ থাকে তখন কি ঐ বস্তুর একাধিক স্বরূপ এবং একাধিক চাক্ষুষ-বোধ সমান থাকে? অথবা বিষয়ের বিবিধ স্বরূপকে একমাত্র চাক্ষুষ জ্ঞান দ্বারা গ্রহণ করা হয়? অথবা সম্পূর্ণ বহু রঙ্গীন বিষয়ের একাকী স্বরূপকে একমাত্র চাক্ষুষ জ্ঞান দ্বারা গ্রহণ করা হয়। ব্যাখ্যা অনুযায়ী রঙের বহুগুণ থাকা সত্ত্বেও চিত্ত তাদের সকলকে সামগ্রিকভাবে যেভাবে গ্রহণ করে এবং সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের কাছাকাছি বলে মনে হয়। আবেগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাথে কোন সমরূপতা নেই। উদাহরণ স্বরূপ, পল একম্যান বলেছেন যে আবেগ, মেজাজ এবং লক্ষণের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। বিজ্ঞানীরা প্রাচীন গ্রন্থের আগমের উদ্ধরণগুলির উপর ভিত্তি করে না, বরং তারা ভিত্তি করে গবেষণার উপর। সুতরাং, এই বিষয়ে আরও যৌথ গবেষণা ফলপ্রসু হতে পারেঃ বিজ্ঞানী এবং বৌদ্ধ উভয়ের ক্ষেত্রে সেটা অনেক উপকার হবে।

বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় সেখানে এমন-এমন বিষয় আছে যার অনেক ভৌতিক গুণাবলী থাকে এবং তারপর এমন কিছু আছে যেগুলি হল বিষয়কে জানার মাধ্যম আবার এমন কিছু আছে যেগুলি এই দুটির মধ্যে গণ্য হয় না। তাসত্ত্বেও সেগুলি সর্বদা পরিবর্তন হতে থাকে, যেমন- সময়।

চিত্তের মূল স্বভাব

এখন জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (সচেতনতা), এটি এমন একটি ধর্ম (বিষয়বস্তু) যা মানসিক ক্রিয়া-কলাপের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়ঃ কিছু জানার বা সচেতন হওয়ার মানসিক ক্রিয়াকলাপ। এর সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলি হলঃ ১) স্পষ্টতা বা প্রভাস্বর, যার অর্থ হল স্বরূপ নির্মাণ, ২) প্রজ্ঞা (সচেতনতা) কোন কিছুর বিষয়ে সচেতনতা বা কোন কিছুর জ্ঞান, এবং ৩) কিছু অনুভব করার সময় বিভিন্ন ধরণের সকারাত্মক বা নকারাত্মক আবেগ থাকে কিন্তু তবুও মানসিক ক্রিয়াকলাপের স্বভাব নিজের দিক থেকে নিরপেক্ষ থাকে। একটি মানসিক ক্রিয়াকলাপ সহায়ক বা ক্ষতিকারক কিনা সেটা নির্ভর করে চেতসিকের উপর, মানসিক ক্রিয়াকলাপরূপী চেতসিকের মূল স্বভাবের উপর নয়।

উদাহরণ স্বরূপ, ক্রোধ চিত্তের মূল স্বভাবের অংশ নয়। পরিবর্তে ক্রোধ উদ্ভূত হওয়ার জন্য হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে। (অন্যদিকে কোন কিছুর মূল স্বভাব বিরতিহীন নয় এবং উদ্ভূত ও উপস্থিত হওয়ার জন্য হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে না। এটি উদ্ভূত হয় এবং নিরন্তর উপস্থিত থাকে।) এরপর কিছু নির্দিষ্ট চেতসিক যেমন- ক্রোধ, হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর ভিত্তি ক’রে উৎপন্ন হয় আর সেটা শুধুমাত্র তখনই প্রভাবশালী হয়।

ক্রোধ যখন সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয় তখন চিত্ত অথবা মানসিক ক্রিয়া-কলাপ থেকে ক্রোধকে আলাদা করা কঠিন হয়ে ওঠে। যাইহোক, অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা চিত্তের একটি বিন্দু পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে ক্রোধ কখন বিকশিত হয়, সেটা উদ্ভূত হয় আবার সমাপ্ত হয়ে যায়। পর্যবেক্ষণের এই প্রক্রিয়ায় ক্রোধকে কম করার সামর্থ্য থাকে। অতএব, যখন কোন একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা অথবা চেতসিক উদ্ভূত হয় তখন সেটাকে প্রভাবিত করা যেতে পারে।

এটি চিত্তের স্বভাব সম্পর্কে সামান্য ব্যাখ্যা।

আবেগ এবং ভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক

আর একটি আকর্ষণীয় বিষয় যার উপর আমি আরও বেশি গবেষণা চালিয়ে যেতে চাই সেটা নিম্নলিখিত বিষয়ঃ

আমাদের ভৌতিক শরীরের কিছু উপাদানের পরিবর্তনের কারণে কিছু আবেগ উৎপন্ন হতে পারে। এছাড়াও একটি বিশেষ মানসিক মনোভাবের বিকাশ ও শরীরের কিছু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে, উদাহরণ স্বরূপ, ক্রোধ অথবা বিদ্বেষ। যখন ক্রোধ জাগে তখন মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশে রক্ত চলাচল বেশি হয়; অন্যদিকে মস্তিষ্কের একটি ভিন্ন অংশ করুণার সাথে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং, সুক্ষ্মস্তরে আমাদের গবেষণা করতে হবে যে কোনটি প্রথমে উদ্ভূত হয়ঃ এটি মস্তিষ্কের একটি পরিবর্তন যা একটি আবেগের জন্ম দেয়, না একটি আবেগ যা মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটায়। এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

উদাহরণ স্বরূপ, স্নায়ুকোষে (নিউরোন) পরিবর্তন হয়। এখন এটি একটি সূক্ষ্ম বিষয় কিন্তু যখন সূক্ষ্মস্তরে পরিবর্তনগুলি সঞ্চয় হয় তখন আমরা ঐ পরিবর্তনের স্থূল মাত্রা দেখতে পাই, যেমন- আমরা যখন ভয় পাই তখন পায়ে রক্তের চলাচল বেড়ে যায় এবং সেইজন্য আমরা দৌড়াই; যখন ক্রোধ জাগে তখন বাহুতে রক্ত চলাচলের মাত্রা বেড়ে যায় আর সেইজন্য আমরা মারামারি করতে থাকি। সুতরাং, এই উদাহরণগুলি থেকে আবেগ এবং স্থূল শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ, রক্ত প্রবাহ হল একটি স্থূল রূপ যার মধ্যে পরিবর্তন প্রকাশ পায় কিন্তু মানসিক অবস্থা এবং শরীরের পরিবর্তনের মধ্যে এই সম্বন্ধটি কোন্‌ স্তরে স্থাপিত হয়?

বৌদ্ধ এবং হিন্দু তন্ত্র উভয়ই একটি সূক্ষ্ম স্তরীয় শক্তির কথা বলেঃ চিত্ত বা মানসিক ক্রিয়াকলাপ এই শক্তির কারণে পরিচালিত হয়। এটাকে ‘আভ্যন্তরীণ বায়ু’ বলা হয়, আর এর অর্থ অবশ্যই শক্তির মতো কিছু একটা হওয়া উচিত যা স্থূল ভৌতিক স্তর এবং মানসিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে। এটি এমন কিছু যা হিন্দু এবং বৌদ্ধ বিশ্লেষণের মধ্যে মিল আছে। সুতরাং বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার ক্ষেত্রে এটা একটি আসল প্রশ্নঃ ঐ মাধ্যম বা প্রক্রিয়া কী যা মানসিক এবং ভৌতিক ক্ষেত্রকে সংযুক্ত করে?

প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরাগুলি অর্থাৎ অবৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ উভয় পরম্পরাগুলিতে ‘আভ্যন্তরীণ স্পর্শ জ্ঞান’ নামক কিছু অবধারণা আছে। [বৌদ্ধধর্ম এটিকে চেতসিক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে যা জ্ঞানের (বিজ্ঞানের) বস্তুর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার সময় উক্ত বস্তুটি প্রীতিকর, অপ্রীতিকর অথবা নিরপেক্ষ কিনা তার বিভেদ স্থাপন করে আর তার ভিত্তিতে ক্রমাগতভাবে সুখ, দুঃখ অথবা নিরপেক্ষ অনুভূতি অনুভব করে।] এই আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ জ্ঞানের উপর ভিত্তি ক’রে সেটাকে একটি প্রাপ্তির হেতু হিসাবে গ্রহণ করা হয় আর তার ভিত্তিতে শারীরিক জ্ঞান উদ্ভূত হয়। আর সেটাই হল সুখ অথবা দুঃখরূপী মানসিক বোধের সমানন্তর প্রত্যয়। এছাড়া যদিও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলির নির্দিষ্ট অঙ্গে একটি জ্ঞানাত্মক অবস্থান থাকে, যেমন- দৃষ্টিশক্তি থাকে চোখে, তবুও স্পর্শের জ্ঞান শারীরিক সংবেদনার ভিত্তিতে উৎপন্ন হয়। আর এটি সমগ্র শরীর এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলিতে পরিব্যাপ্ত থাকে। বিজ্ঞানের মতে দেখা এবং শ্রবণ করা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গত প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা জ্ঞানাত্মক অবস্থান থাকে কিন্তু সেই সবগুলির সম্পর্ক মস্তিষ্কের সাথে থাকে। সেগুলি মস্তিষ্কে পরিব্যপ্ত হয়ে থাকে। তাই এখানে আমাদের এমন কিছু জ্ঞানাত্মক স্তরের ধারণা পরীক্ষা করতে হবে যা অন্য সমস্ত জ্ঞানাত্মক স্তরে পরিব্যপ্ত হয়ে থাকে। কারণ বৌদ্ধধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয়ই এই ধরণের একটি স্তরে অস্তিত্বে রয়েছে বলে মনে করে।

আমরা যখন মস্তিষ্ক, স্নায়ুকোষের পরীক্ষা করব তখন আমাদের অবশ্যই স্থূল স্তরের চিত্ত এবং সূক্ষ্ম চিত্তের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। আমরা চিত্তের স্থূল স্তরকে মানুষ এবং কুকুর উভয়ের ইন্দ্রিয় জ্ঞানের স্তরের ভিত্তিতে সনাক্ত করতে পারি। কিন্তু উভয়ের মস্তিষ্কের মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণে তাদের চিত্ত এবং ঐ চিত্তের স্থূলতর স্তরের উপর কাজ করার প্রক্রিয়ায় পার্থক্য হয়ে যায়। (উদাহরণ স্বরূপ, মানুষের চেয়ে কুকুরের মধ্যে ঘ্রাণশক্তি বেশি উন্নত থাকে) তবে বিষয়টা হল স্থূল ইন্দ্রিয়গত ক্রিয়া-কলাপের চেয়ে চিত্ত অথবা মানসিক ক্রিয়াকলাপের সূক্ষ্মতর স্তর থাকতে হবে।

চিত্ত যে মাত্রায় ভৌতিক শরীরের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে সেই অনুযায়ী চিত্তের সূক্ষ্মতারও বিভিন্ন স্তর থাকে। ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের স্থূল স্তর শরীরের উপর বেশি নির্ভরশীল। অন্যদিকে বিরক্তিকর আবেগ (ক্লেশ) থাকে চিত্তের সূক্ষ্মতর স্তরে। এদের নির্ভরশীলতা ভৌতিক শরীরের উপর কম থাকে। স্বপ্নের স্তরের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইঃ এটি শরীরের উপর কম নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অতএব, আবেগ এবং স্বপ্ন দেখার এই সূক্ষ্মতর বিষয়ের ক্ষেত্রে মানুষ এবং পশুদের মধ্যে পার্থক্য কী?

বর্তমানে মৃত্যুর প্রক্রিয়ার উপর গবেষণা করার জন্য বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম উপলব্ধ আছে। বিগত পনেরো বছর ধরে এই ধরণের গবেষণা চলছে। তবে একজন মৃত ব্যক্তির মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য যখন ব্যক্তির মাথায় বিদ্যুতের তার (ইলেকট্রড) লাগানো হয়, ঐ ধরণের পরীক্ষা করার সময় আজ পর্যন্ত কারও মৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু এখন এই ধরণের পরীক্ষা নিয়ে আমাদের আরও বেশী গম্ভীর হওয়া দরকার। আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা প্রয়োজন যে কেউ মারা যাওয়ার আগে তার মাথায় যেন বিদ্যুতের তার লাগিয়ে রাখা হয়। তবে এটা একটা জটিল বিষয়। এই বিষয়ে আমাদের উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে।

যদিও মৃত্যুর প্রকৃত পরীক্ষার সময় কী ঘটে তার পরিমাপ করার জন্য কোন গম্ভীর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তবে ভারতীয় গ্রন্থ মানসিক ক্রিয়া-কলাপের সম্পর্কে তিনটি স্তরের ব্যাখ্যা করে। এরমধ্যে তৃতীয় স্তরটি শুধুমাত্র মৃত্যুর সময় ঘটে। আরও নির্দিষ্টভাবে যদি বলা হয় এটা তখনই ঘটে যখন শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদপিন্ডের ক্রিয়া-কলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং তা সত্ত্বেও মানসিক ক্রিয়াকলাপের প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে। এই স্তরটি চিত্তের অন্যান্য স্তরের তুলনায় ভৌতিক শরীরের উপর কম নির্ভরশীল বলে মনে হয়। সুতরাং স্থূল স্তর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুকোষের অধীনে থাকে কিন্তু যেটা বেশি সূক্ষ্মতর সে বিষয়ে আরও প্রশ্ন আছে।

এছাড়াও আমি বিস্মিত যে বৌদ্ধ শ্রেণীকরণ অনুযায়ী আমাদের বিরক্তিকর আবেগগুলিকে (ক্লেশ) কেন স্থূল স্তরের বদলে সূক্ষ্মস্তরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলি স্থূল ভৌতিক শরীরের উপর কম নির্ভরশীল কেন? একবার আমি বৈজ্ঞানিকদের একটি সভায় জিজ্ঞাসা করছিলাম, “কোন শারীরিক প্রক্রিয়া ছাড়াই শুধুমাত্র মানসিক কার্যকলাপ শারীরিক প্রভাব উৎপন্ন করতে পারে কি?” উত্তরে একজন বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন, ‘তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে হ্যাঁ, কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়।”

এই দৃষ্টিকোণটি খুব বেশি বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয় না। একটা সহজ প্রক্রিয়া আছে যা নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে। কান্না করা বা অশ্রু ঝরানো একটি মানসিক অবস্থার ভৌতিক প্রতিক্রিয়া। তবে এটি আনন্দ বা দুঃখের সাথে ঘটতে পারে। মানসিক স্তরে এই দুটির মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে। তবে শারীরিক প্রতিক্রিয়া একই রকম। যদি ডান চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু নির্গত হয় এবং বাম চোখ থেকে নির্গত হয় দুঃখের অশ্রু, তাহলে আমরা শারীরিক স্তরে তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। কিন্তু এটা এমন নয় অর্থাৎ পার্থক্যটি স্থূল স্তরে হয় না। তাই মানসিক স্তরের গবেষণা করতে গেলে আমাদের এই স্থূলতম শারীরিক স্তরের চেয়ে আরও গভীরে গিয়ে দেখতে হবে। তবে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের ভৌতিক স্তরের গবেষণার মাধ্যমে চিত্তের গবেষণা করার জন্য আমাদের প্রশ্ন করতে হবে যে কিছু বাদ পড়ে যায়নি তো, এটা কি এখনও একেবারে সামান্য রয়ে গেছে!

বৌদ্ধ তর্ক শাস্ত্রে আমরা বিভিন্ন ধরণের অনুমানের কথা বলি, উদাহরণ স্বরূপ, কোন বিশেষ বস্তুর বিশেষ গুণাবলী পর্যবেক্ষণ ক’রে আমরা একটি শ্রেণীকে সাধারণীকরণ এবং অনুমান করতে পারি। অথবা যদি সেই উপলব্ধ বস্তু সেই বিশেষ গুণাবলীতে যুক্ত না হয় তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি সেটি একটি আলাদা শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত। তবে আবেগ এবং শরীরের সাথে সম্পর্কিত এই ধরণের বিষয়ের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে আসার জন্য এমন একটি পদ্ধতির প্রয়োজন যেটা খুবই বিস্তৃত এবং অনিয়মিত।

Top