স্মৃতিঃ সংশ্লিষ্ট চৈত্ত

স্মৃতি (মননশীলতা)-এর অনুশীলনটি পারম্পারিক বৌদ্ধ উৎসে দেখতে পাওয়া যায়। এই উৎসগুলি থেকে আমরা বিভিন্ন ধরণের চৈত্ত (মানসিক কারণ) সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে পারি যা স্মৃতির অনুশীলন পূর্ণ হওয়ার জন্য সহগমন করতে প্রয়োজন হয়। চৈত্তগুলি হল কোন একটা বিষয়কে জানার উপায় যেটা তার জ্ঞান দ্বারা সেটাকে যোগ্য করে তোলে বা সহায়তা করে। সেগুলি আগ্রহের মতো এমন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে যা একটি জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করে; ধ্যানের মতো বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে যা এটিকে বজায় রাখতে সহায়তা করে; এবং মৈত্রী ও করুণার মতো আবেগকে অন্তর্ভুক্ত করে যেগুলি এটিকে রঙিন করতে তোলে। আমরা আমাদের স্মৃতির অনুশীলনের সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে অধ্যয়ন এবং অন্তর্ভুক্ত ক’রে এর থেকে সর্বাধিক উপকার লাভ করতে পারি।

মানসিক চাপ কমানো, ব্যথাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং কাজের সাথে বা সাধারণভাবে জীবন-যাপনে কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য স্মৃতির অনুশীলনটি আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন বৌদ্ধ ধ্যানচর্চা থেকে প্রাপ্ত স্মৃতির প্রশিক্ষণটি আমাদের মনকে শান্ত করা এবং আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আবেগ, সুখ বা দুঃখের অনুভূতি, শারীরিক সংবেদন ইত্যাদির সাথে যুক্ত। প্রায়শই এই প্রশিক্ষণটি আরও সাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয় যা সর্বক্ষণ পরিবর্তন হতে থাকা আমাদের মনের বিষয়ের পরিবর্তিত বর্তমান মুহূর্তটি পর্যবেক্ষণ করে।

ভারতীয় বৌদ্ধ উৎস

থেরবাদ পরম্পরায় স্মৃতির (পালিঃ সতি) উপস্থাপনাটি উপতিস্‌স-এর “বিমুক্তিমার্গ” (পালিঃ বিমুত্তিমগ্‌গ) এবং বুদ্ধঘোষের “বিশুদ্ধিমার্গ” (পালিঃ বিসুদ্ধিমগ্‌গ)-এর উপর আধারিত। সেখানে স্মৃতিকে বিভিন্ন ধরণের মিশ্রিত ধ্যানের একটি অভিন্ন দিক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ধ্যানের মধ্যে স্মৃতিতে অনুস্মৃতির গুণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন সর্বদা শ্বাস-প্রশ্বাস বা মৃত্যুর সত্যকে স্মরণ করা। এর কাজ হল বিষয়কে না ভুলে যাওয়া এবং এটা উদ্দীপ্ত করা হয় মনকে রক্ষা করতে যাতে এটা তার বিষয়কে হারিয়ে না ফেলে। এক অর্থে, স্মৃতি হল এক ধরণের “মানসিক আঠা” যা তার মনোনিবেশের বিষয়কে যেতে না দিয়ে ধরে রাখে। একবার এটি কোন একটি বস্তুর উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে অনিত্যতার মতো ঐ বস্তুর বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য স্মৃতির সহযোগিতায় প্রয়োজন হয় প্রভেদমূলক সচেতনতা।

“অভিধর্মকোশে” হীনযানী বৈভাষিক নিকায়কে বর্ণনা করতে গিয়ে বসুবন্ধু স্মৃতিকে দশটি চৈত্তের সাথে তালিকাভুক্ত করেছেন যা অন্যান্য জ্ঞানের সঙ্গেও থাকে। এগুলি গঠনমূলক, ধ্বংসাত্মক অথবা কেবল অব্যাকৃত চৈত্তের সাথেও যুক্ত। সুতরাং শুধু ধ্যানের প্রসঙ্গেই নয় বরং স্মৃতি সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকে।

বসুবন্ধু তাঁর কৃতি অভিধর্মকোশভাষ্যে স্মৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেনঃ “এমন একটি চৈত্ত যে তার বিষয়কে ছেড়ে দেয় না বা ভুলে যায় না এবং এইভাবে এটি তার বস্তু বা বিষয়কে লালায়িত করে তোলে আর তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে।” বিষয়ের প্রতি লালায়িত থাকা বা দৃষ্টিনিবদ্ধ রাখার কারণে স্মৃতি আমাদের সেই বস্তুকে পরে স্মরণ করতে সহায়তা করে।

“পঞ্চস্কন্ধপ্রকরণ” নামক মহাযান চিত্তমাত্র গ্রন্থে বসুবন্ধু বিশেষভাবে একটি বস্তুকে পুনরায় স্মরণ করার প্রসঙ্গে স্মৃতিকে উপস্থাপন করেছেন। সুতরাং তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে স্মৃতি হল কোন পরিচিত বস্তুকে যেতে না দেওয়া এবং পুনরায় এটিকে লক্ষ্য করার মানসিক অবস্থা। এই গ্রন্থের টীকাতে স্থিরমতি ব্যাখ্যা করেছেন যে “পরিচিত বস্তু”- এর অর্থ হল এমন কিছু যা আমরা আগে অনুভব করেছি। অতএব কোন বস্তুকে পুনঃস্মরণ করার অর্থ সেই বস্তুর উপর ধ্যান প্রসঙ্গে অথবা শুধু কিছু স্মরণ করার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ঘটনার মধ্যে থাকতে পারে।

“অভিধর্মসমুচ্চয়” নামক চিত্তমাত্র গ্রন্থে অসঙ্গ পাঁচটি নিশ্চিত চৈত্তের মধ্যে একটিকে স্মৃতিরূপে উপস্থাপন করেছেন। উক্ত পাঁচটির মধ্যে একটি হওয়ার কারণে স্মৃতি হল একটি চৈত্ত যা শুধু গঠনমূলক জ্ঞানের মধ্যে উদ্ভূত হয়। কেবল ঐ গঠনমূলক জ্ঞানগুলি তাদের বিষয়গুলিকে ধারণ করে, অন্যকথায়, ঐ জ্ঞানগুলি তাদের বিষয়গুলিকে সঠিকভাবে এবং সৈদ্ধান্তিক ভাবে উপলব্ধি করে। এর বিষয়গুলিকে অবশ্যই এমনভাবে গঠনমূলক হতে হবে যার সাথে আমরা পরিচিত; এর দিকটি অবশ্যই এমন হতে হবে যা বস্তুর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আর সেটাকে ভুলে না যায় অথবা ছেড়ে না দেয়; এবং এর কাজ হল মানসিক বিচরণ প্রতিরোধ করা।

চোংখাপার উপস্থাপনা

“মহামার্গ-ক্রমে (লাম-রিম-ছেন-মো)” সমাধি বিকাশের বিভাগে এবং শান্ত ও স্থাপিত মনের অবস্থা (শমথ) বিভাগে অসঙ্গ দ্বারা স্থাপিত স্মৃতির সংজ্ঞাটিকে তিব্বতী আচার্য চোংখাপা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে শমথ-ধ্যান প্রসঙ্গে স্মৃতির তিনটি বৈশিষ্ট্য আছেঃ

  • এটি এমন একটি বিষয়ের উপর মনোনিবেশ করে যার সাথে আমরা আগে থেকে পরিচিত, অপরিচিত এমন কিছু নয়। অতএব এর বিষয়টি হল এমন কিছু যার সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়ে থাকি এবং এটি গঠনমূলকও হতে পারে, যেমন- দৃষ্টিনিবদ্ধকৃত বুদ্ধের প্রতিমা অথবা অব্যাকৃত বা অনির্দিষ্ট কিছু, যেমন দেহ।
  • বস্তুর উপর এর মানসিক ধরণ এমন হয় যে আমরা বস্তুর কথা ভুলে যাই না। “ভুলে না যাওয়া” এর অর্থ এই নয় যে কেউ যখন আমাদের জিজ্ঞাসা করে আমরা তখনই অনুশীলনের নির্দেশাবলী কী সেটা মনে করতে পারি অথবা আমাদের মনোনিবেশের বিষয়টি এই রকম অথবা ঐ রকম সেটা মনে করতে পারি। এর অর্থ হল আমরা যখনই আমাদের মনকে কেন্দ্রীভূত বস্তুকে বস্তুর সাথে করে ফেলি অবিলম্বে বিচরণের সামান্যতম বিভ্রান্তি ছাড়াই আমরা মানসিকভাবে এটাকে ধরে রাখি। যদি আমাদের মনোযোগ উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করতে থাকে তাহলে এর অর্থ এই হবে যে আমরা আমাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি। সুতরাং আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত বস্তুর উপর নিবদ্ধ রাখার পরে সেটাকে আমি এই বিষয়ের সাথে আমার মনকে আবদ্ধ করে রাখি। তারপরে এমন মনের অবস্থা যা বিচ্ছিন্ন ভাবে (মৌখিকভাবে) নতুন কিছু ভাবে না বরং এর অটুট শক্তির ধারাবাহিকতা গড়ে তোলে, সেটাই হল নিজেকে স্মৃতির হাতে সুপুর্দ করার উপায়। নিজেদের স্মৃতি শক্তির কাছে সুপুর্দ করার অর্থ হল নিজেদেরকে আমাদের চিকিৎসকের হাতে সুপুর্দ করা অথবা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের কাছে সুপুর্দ করার মতো। আমরা নিজেকে তখনই একজন চিকিৎসক অথবা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের কাছে নিজেকে সুপুর্দ করি যখন আমরা নিশ্চিত হই যে ঐ ব্যক্তিটি পুরোপুরি তারজন্য যোগ্য। ঠিক তেমনই, আমরা শুধু তখনই নিজেকে স্মৃতির কাছে সুপুর্দ করি যখন আমাদের মনের অবস্থা বাস্তবে স্মৃতির অবস্থা পরিপূর্ণ হতে যোগ্যতা পূরণ করে।
  • এর কাজটি হল আমাদের মনকে অন্য কোন কেন্দ্রীভূত বস্তুর প্রতি বিভ্রান্ত না হতে দেওয়া। আরও সম্পূর্ণরূপে যদি বলা হয়, স্মৃতি আমাদের মনোযোগকে মনোনিবেশের বিষয়টিকে ভুলে যাওয়া অথবা হারিয়ে ফেলতে বাধা দেয়; এটি ধৈর্য সহকারে বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ ধরে রাখে; এবং এটি উক্ত বস্তুর সাথে পরিচিতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

স্মৃতি ধ্যান

যখন সমতারূপী একটি শান্ত এবং স্থাপিত মনের অবস্থা অর্থাৎ স্মৃতি অর্জনের জন্য অনুশীলন করা হয় তখন ধ্যান সম্পর্কিত বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু (আলম্বন) স্থির থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোন চাক্ষুষ বুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করা হয় তখন মনের অবস্থা স্থির থাকে। স্মৃতি অনুশীলনে, যদিও আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে এটা শেখানো হয়েছে যে এটা হল আমাদের মানসিক বা শারীরিক জ্ঞানের সদা-পরিবর্তিত বিষয়গুলির ক্রমবর্ধমান বর্তমান মুহূর্ত। এটা হল থেরবাদ অনুযায়ী স্মৃতির উপস্থাপনা। বস্তুর নিরিখে এবং বসুবন্ধু দ্বারা প্রবর্তিত বৈভাষিক উপস্থাপনার সাথে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ যে স্মৃতি জ্ঞানের সমস্ত মুহূর্তের সাথে বিদ্যমান থাকে। তবে যেমন বসুবন্ধু এবং অসঙ্গ তাদের চিত্তমাত্র গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সেই অনুযায়ী বস্তুটি অবশ্য এমন কিছু নয় যা আমরা আগে পরিচিত হয়েছি, যেমন বুদ্ধের শারীরিক উপস্থিতি, পরিবর্তে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে যা কিছু অনুভব করি, যেমন শারীরিক সংবেদন, চিন্তা-ভাবনা আবেগ বা অনুভূতি, আমরা তার উপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু যেমন অসঙ্গ প্রমাণ করেছেন যে আমরা যথতা এবং সিদ্ধান্তের সাথে তাদের প্রতি মনোনিবেশ করি।

বর্তমান মুহূর্তের স্মৃতির যে অবস্থাটি আমরা বিকাশ করার চেষ্টা করি আসলে সেটা হল মনের নির্দিষ্ট কয়েকটি চৈত্তের মিশ্রণ, যার সম্পর্কে বৌদ্ধ বিশ্লেষণে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যেগুলি প্রধান এবং যাদের নিযুক্ত করা হয় সেগুলি হল স্বয়ং স্মৃতি, সতর্কতা এবং যত্নশীল মনোভাব। স্মৃতিকে আরও কার্যকরভাবে অনুশীলন করার জন্য এই চৈত্তগুলির মধ্যে প্রত্যেকটিকে সনাক্ত করা সহায়ক হয়ে ওঠে যাতে এদের মধ্যে যদি কোন শক্তির ঘাটতি থাকে তাহলে আমরা সেগুলির সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারি।

স্মৃতি

তথাকথিত “মানসিক আঠা”-রূপী স্মৃতি নিজেই আরও দুটি চৈত্ত্য বা মানসিক কারণের সাথে সহগমণ করেঃ প্রভেদতা (সংজ্ঞা) এবং মনসিকার (মনস্কার)।

প্রভেদতা আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্তকে বিভিন্ন উপাদানগুলির গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে। এটা এগুলিকে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে। উদাহরণ স্বরূপ, প্রভেদতা অন্যান্য শারীরিক সংবেদনগুলি থেকে শারীরিক ব্যথার সংবেদনকে আলাদা করে যা আমরা সমসাময়িকভাবে অনুভব করি, যেমন আমরা যে ঘরে আছি তার তাপমাত্রা। সঠিক মনসিকার বা বিবেচনা বস্তুকে সঠিকভাবে গ্রহণ করে- ব্যথা বলতে শুধু শারীরিক সংবেদনকে বোঝায়, এর থেকে বেশি কিছু নয় এবং কমও নয়।

প্রভেদতা এবং সঠিক মনসিকারের সাথে যুক্ত স্মৃতির মাধ্যমে আমরা সর্বদা পরিবর্তিত বর্তমান মুহূর্তের বিষয়বস্তুর উপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। আমরা বিক্ষিপ্ত না হয়ে আমাদের মনোনিবেশের বিষয় হিসাবে বর্তমান মুহূর্তের বিষয়বস্তুগুলি না হারিয়ে এটি অনুশীলন করার চেষ্টা করি। বিক্ষিপ্ততা প্রায়শই ঘটে থাকে কারণ আমরা পূর্বের মুহূর্তগুলিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকি অথবা ভবিষ্যতের মুহূর্তগুলিতে আমরা কী অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চলেছি তার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। অতঃপর আমরা দৃশ্যের বিষয়টা ভুলে যাই যে অতীত বা ভবিষ্যতের এই চিন্তা-ভাবনা যেগুলি এখন ঘটছে, আমরা তাদেরকে আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতার মুহূর্তের বিষয়বস্তু হিসাবে আলাদা করা বন্ধ করি এবং পরিবর্তে তাদের গল্পের পংক্তিতে সমাহিত হয়ে যাই। পরিণামস্বরূপ, এই ভাবনাগুলির কারণে বিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে আমরা আমাদের মনোনিবেশের বিষয়টি হারিয়ে ফেলি। তবে যদি আমরা মনের একটি অবিক্ষিপ্ত অবস্থা বজায় রাখতে সফল হই তাহলে আমরা স্থিতিশীল মননশীলতা অর্জন করে ফেলি যা এর মনোনিবেশের বিষয়টি ভুলে যাই না। এইভাবে স্মৃতি আমাদের অভিজ্ঞতার পরিবর্তিত বর্তমান মুহূর্তের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখার জন্য “মানসিক আঠা” হিসাবে কাজ করে।

অসঙ্গের “মধ্যান্তবিভাগের” টীকাতে স্থিরমতি ব্যাখ্যা করেছেন যে স্মৃতি-সাধনা বজায় রাখার জন্য একটি সহায়ক হিসাবে আমাদের মনোনিবেশের বিষয় সম্পর্কে মাঝে মাঝে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এর অর্থ হল মানসিকভাবে এটাকে একটা মূল শব্দরূপে অভিহিত করা যাতে আমরা আমাদের স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারি। এটি বসুবন্ধুর কথনের সাথে একদম মিলে যায় যে স্মৃতি তার বিষয়টির উপর নজর রাখার জন্য যুক্ত থাকে। চোংখাপা এই বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আপনি যদি এই ব’লে এই কথাটি খন্ডন করেন যে এটি একটি অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা-ভাবনা এবং সেইজন্য মৌখিকভাবে নিজেকে স্মরণ করানোর কোন প্রয়োজন হয় না, তাহলে স্মৃতি এবং সতর্কতা শক্তিশালীরূপে বিকাশ করা খুব কঠিন হয়ে যাবে।”

সতর্কতা (সম্প্রজন্য)

সতর্কতা হল একটি চৈত্ত বা মানসিক কারণ যা স্মৃতির অবস্থার নিরিক্ষণ করে এবং পরীক্ষা করে যে মনোনিবেশের বিষয়ের উপর মানসিক ধরণ কেমন কী আছে। এটি আমাদের মনোনিবেশের বিষয়ের উপর স্মৃতি বজায় রাখার প্রসঙ্গে অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতার বর্তমান মুহূর্তের বিষয়বস্তুর উপর কাজ করে, এক অর্থে তাই সতর্কতা হল দৃঢ় স্মৃতির একটা অঙ্গ। চোংখাপা উল্লেখ করেছেন, আমাদের স্মৃতি যত দৃঢ় হবে আমরা ততই বিক্ষিপ্ত না হয়ে মনোযোগী হতে অভ্যস্ত হয়ে যাব। ফলস্বরূপ, আমরা যখন বাস্তবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাব তখন আমরা লক্ষ্য করার জন্য আরও বেশি সংবেদনশীল হয়ে যাব। এইভাবে আমাদের স্মৃতি যতই দৃঢ় হবে আমাদের সতর্কতাও তত দৃঢ় হবে।

সতর্কতাকে আমাদের দ্বৈতবাদী শব্দ হিসাবে ভাবা উচিত নয়। কারণ একটি স্বতন্ত্রভাবে প্রহরী মনের থেকে একটি প্রশিক্ষণার্থীদের মনের দিকে লক্ষ্য করা সম্পূর্ণভাবে আলাদা। অন্যদিকে চোংখাপা উল্লেখ করেছেন যে আমাদের এই দুটি অর্থাৎ স্মৃতি এবং সতর্কতাকে সাবধানের সাথে আলাদা করতে হবে। তিনি সাবধান করেছেন, “আপনি যদি বিভ্রান্ত হয়ে যান এবং মনের এই অবস্থাগুলিকে একসাথে মিশিয়ে ফেলেন আর এই পার্থক্যগুলি না করেন তাহলে সবকিছুই গুলিয়ে যাবে, যেমন আজকাল তিব্বতের অনেক ধ্যান সাধকরা করেছেন আর আমার সন্দেহ হয় যে তারা আদেও প্রকৃত ধ্যান অবস্থা প্রাপ্ত করেছেন।”

সতর্কতা শুধু আমাদের স্মৃতিগুলির মধ্যে পথভ্রষ্টতাকে লক্ষ্য করে না বরং এক অর্থে একটি আভ্যন্তরীণ “বিপদ আশঙ্কার পদ্ধতি” উদ্দীপিত করে যাতে পুনরুদ্ধার মনোযোগের আমরা আমাদের মনোনিবেশকে সংশোধন করতে পারি এবং স্মৃতিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। সতর্কতা এবং পুনরুদ্ধার মনোযোগের কার্য সম্পাদন করতে আমাদের যত্নশীল মনোভাবরূপী স্মৃতির তৃতীয় প্রধান উপাদানকে ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।

একটা যত্নশীল মনোভাব (অপ্রমাদ)

যত্নশীল মনোভাব (অপ্রমাদ) হল এমন একটা চৈত্ত বা মানসিক কারণ যা যত্ন নেয় এবং আমাদের মনের অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক থাকে। এটা আমাদের মনকে ধ্বংসাত্মক দিকে ঝুঁকে পড়া থেকে রক্ষা করে আর গঠনমূলক এবং ইতিবাচক দিকটি ধরে রাখে। সুতরাং, যত্নশীল মনোভাব দ্বারা আমরা আমাদের মনের অবস্থাটিকে গুরুত্ব সহকারে নিই; আমরা এটার “যত্ন নিই।” এই বিষয়ে, যত্নশীল মনোভাব কিছুটা মনোনিবেশের বিষয়ের প্রতি লালিত চৈত্তের সমান হয় যা বসুবন্ধু স্মৃতির অংশ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

বসুবন্ধু এই বক্তব্যটি তুলে ধরেছেন যে আমরা যদি কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্তে আমাদের মনোনিবেশের বিষয়ের প্রতি লালায়িত না হই, অন্যকথায়, আমরা যদি এটাকে কাছে ধরে না রাখি, এক অর্থে, এটাকে মনে রাখার মতো উপযুক্ত হিসাবে স্মরণ করতে পারব না। যত্নশীল মনোভাব অবশ্যই লালায়িত হওয়ার চেয়ে আরও বেশি কিছু অন্তর্ভুক্ত করে। এটা কেবল মনোনিবেশের কোন বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট যত্নশীল হয় না যাতে আমরা এটা মনে রাখতে পারি। পরিবর্তে, আমাদের যত্নশীল মনোভাবের কারণে সতর্কতা যখন সনাক্ত করে যে এটা ত্রুটিমুক্ত হয়ে উঠেছে তখন আমরা আমাদের স্মৃতির মানসিক ধরণ সংশোধন করার জন্য পুনরুদ্ধার-মনোযোগ ব্যবহার করতে উৎসাহিত হই। যত্নশীল মনোভাব না থাকলে আমরা যত্ন নিতে পারব না যে আমরা আমাদের মনোনিবেশের বিষয়টি ভুলে গিয়েছি অর্থাৎ আমাদের বর্তমান মুহূর্তকে, এমনকি আমরা যদি লক্ষ্য করে থাকি যে আমরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছি তখনও আমরা যত্ন নিতে পারব না। অতএব যত্নশীল মনোভাব হল নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলার ভিত্তি, যার সহায়তায় আমরা ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকি।

যত্নশীল মনোভাবের তিব্বতী শব্দ “বাগ-ইয়ো”-এর আক্ষরিক অর্থ হল “সাবধানতা অবলম্বন করা”। এর বিপরীত “বাগ-মে” শব্দটির অর্থ হল “সতর্কতার অভাব, অসতর্ক হওয়া”। তবে এর যে মূল সংস্কৃত শব্দটি তিব্বতী ভাষায় “বাগ-মে” রূপে অনুবাদ করা হয়েছিল সেটা হল “অপ্রমাদ” যার অর্থ “প্রমাদ নয়”। প্রমাদ শব্দের অর্থ হল ‘মাতাল বা মানসিক ভাবে অস্থির’, যেমন আমরা যা কিছু বলি বা করি না কেন কোনটির বিষয়ে যত্নশীল হই না। যত্নশীল মনোভাব থাকলে আমরা মাতালের মতো পতীত হই না। পরিবর্তে আমরা হয়ে উঠি সংযত, সংরক্ষিত এবং দায়িত্বশীল আর এইভাবে আমরা আমাদের মনের অবস্থা সম্পর্কে যত্নশীল হয়ে উঠি।

সারাংশ

এইভাবে স্মৃতির অনুশীলন চৈত্তগুলিকে একটি জটিল নেটওয়ার্কে নিযুক্ত করে যা আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতার বর্তমান মুহূর্তের পরিবর্তিত বিষয়ে মনোনিবেশ করে। স্মৃতি, সতর্কতা এবং যত্নশীল মনোভাবের মতো তিনটি মূল বিষয় ছাড়াও এটি প্রভেদতা, সঠিক বিবেচনা, নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা এবং প্রয়োজন হলে পুনরুদ্ধার-মনোযোগকেও অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং এই কারণগুলির মধ্যে প্রত্যেকটির সাথে নিশ্চয়তা সহ আলাদা করতে আমাদের প্রয়োজন হয় প্রভেদমূলক সচেতনতা। স্মৃতি ধ্যান প্রসঙ্গে প্রভেদমূলক সচেতনতা কেবল তখনই তার মনোনিবেশের বিষয়টির কিছু অংশের প্রতি মনোনিবেশ করতে সীমাবদ্ধ থাকে না, যেমন আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্তের অনিত্যতা। এটি ধ্যান করার সময় আমাদের মনের অবস্থার বিভিন্ন দিকগুলির উপর মনোনিবেশ করে।

চোংখাপা শমথ-এর শান্ত এবং স্থাপিত অবস্থার বিকাশের বিষয়ে তার আলোচনায় জোর দিয়ে বলেছেন যে এর অনুশীলনের জন্য মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য দ্বারা রচিত প্রামাণিক গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর হওয়া প্রয়োজন। তিনি পরামর্শ দিয়েছেনঃ

কেবল অন্ধ উৎসাহের সাথে জোর করে নিজেকে চাপানোর জন্য নিজের আশা জাগিয়ে রাখবেন না। যেমনটি আর্যশূর “পারমিতাসমাস” নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “শুধুমাত্র উৎসাহ ব্যবহার করলে আপনি কেবল ক্লান্তই হয়ে পড়বেন। পরিবর্তে আপনি যদি প্রভেদমূলক সচেতনতার সহায়তায় নিজেকে বিকশিত করেন তাহলে আপনি মহান উদ্দেশ্যগুলি সম্পন্ন করতে পারবেন।
Top