কীভাবে অনিত্যতার উপর ধ্যান করা যায়”-এর ভাষান্তর

গুঙ্‌থাঙ্‌ রিনপোছে (গুঙথাঙ্‌-ছাঙ্‌ কোনছোগ তেনপে ডোন্মে, ১৭৬২-১৮২৩) রচিত “অনিত্যতা-ভাবনা-কারিকা” নামক গ্রন্থটি সমস্ত গুরুদের নমস্কার ক’রে প্রারম্ভ করা হয়েছে, যে গুরুরা বহু সংখ্যকরূপে আবির্ভূত হন এবং মনকে দমন করার জন্য ধর্মোপদেশ দেনঃ

মহাসুখ এবং শূন্যতার মহাযোগকে নমস্কার, যা সমস্ত সত্ত্বদের বহু প্রয়োজন এবং প্রবণতায় উপযুক্ত হতে বিভিন্ন রুপ এবং রুপান্তরে আবির্ভূত হন।

আটটি ক্ষণ এবং দশটি সম্পদ যুক্ত এই দুর্লভ মানব শরীর একবারই লাভ এটাই হয়। এর উপর ভিত্তি ক’রে দীর্ঘস্থায়ী মূল্যবান কিছু অর্জন করতে সক্ষম না হলে এই সুযোগটি হারানোর এবং পরবর্তী পুনর্জন্ম লাভ করার আশঙ্কা থাকে। তাই  হল নিজেদেরকে মুক্তির পথে স্থাপিত করার গুরুত্বপূর্ণ সময়। বাস্তবে, এখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, কারণ এখানে উপস্থিত আমাদের সকলের বয়স কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যে। ধর্ম অনুশীলন করার জন্য আমাদের নিজেদেরকে অবশ্যই লোহার হুক সাদৃশ্য অনুস্মৃতি এবং সতর্কতা দ্বারা ধরে রাখতে হবে। এটা একটি হাতিকে প্রশিক্ষণের পর্যায়ের সাথে তুলনা করা হয়। এই মাসে বা অন্ততঃ এই বছরে লৌকিক ও সাংসারিক সব কিছু ক’রে শেষ করার চেষ্টা করা অথবা এই বছর নিজের ধর্মচর্চা স্থগিত ক’রে প্রথমে অন্য সব কিছু করার চিন্তা-ভাবনা করা হল একটা ভূতের মতো নিজেকে মোহিত করা। একবার একজন গুরু বলেছিলেন যে ধার্মিকদের জীবিত থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ নয়। কিছু লোকজন অজুহাত দেখায় যে ধর্মচর্চার জন্য তাদের অর্থ উপার্জন করতে হবে, কিন্তু এমন কোন গম্ভীর সাধক আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি যিনি অনাহারে মারা গেছেন।

আপনারা একটা উৎসর্গকৃত পূর্ণ ধর্ম অনুশীলন করার চিন্তা-ভাবনা গড়ে তুলুন। আমাদের এই জীবনের ক্রিয়াকলাপগুলি হল জলের উপরের ঢেউয়ের মতো। তরঙ্গের মতো প্রথমটি আসে, তারপর সাথে-সাথে আরও একটি চলে আসে। আপনারা যত বেশি করবেন ততবেশি নতুন ক্রিয়াকলাপ আসতে থাকবেঃ এটা হল অনন্ত। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার চেয়ে, যেখানে আমাদের উপর কোন বিধি-নিষেধ নেই, এসব ত্যাগ করার জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হওয়া কি ভাল নয়? উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোন জরুরী অবস্থার অবকাশ তৈরি হয় তখন আপনারা সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটা দৃঢ় এবং সংকল্পবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেন, আর তারপর সেটাকে যত্ন নেওয়ার জন্য লেগে পড়েন। এটা ঠিক যেন নারোপার পক্ষ থেকে তিলোপার দর্শন করতে যাওয়ার গল্পের মতো। তিনি সিদ্ধান্তমূলকভাবে তাঁর নালন্দা মঠের পদ ত্যাগ ক’রে চলে গিয়েছিলেন। অথবা চোংখাপার মতো, যিনি আদ্যসাধনা অনুশীলন করার জন্য মঞ্জুশ্রীর কাছ থেকে উপদেশ প্রাপ্ত করেছিলেন এবং সেটা সম্পন্ন করার জন্য সংকল্প নিয়ে তাঁর হাজার হাজার শিষ্যদের ত্যাগ ক’রে চলে গিয়েছিলেন।

আপনারা নিজেদেরকে বোকা বানাবেন না। আগামীদিনের ধর্ম-চর্চার আগে আপনাদের আজকের দিনের মৃত্যু শীঘ্রই আসতে পারে। সুতরাং কেউ যদি ধর্ম পালন করতে চান তাহলে সেটা আজ থেকেই শুরু করুন।

যদিও চোংখাপা এবং পদ্মসম্ভবের মতো মহান গুরুদের কীর্তি পৃথিবীর সমস্ত দিকে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু এই সমস্ত গুরুরা ইতিমধ্যে দেহ ত্যাগ করেছেন। শুধু তাদের নাম অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের শরীর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং আমরা তাদের বিষয়ে জানতে পারি শুধু তাদের শিক্ষার মাধ্যমে। কুশীনগরে বিদ্যমান বুদ্ধের হেলান (শয়ন-মুদ্রা) দেওয়ার মূর্তির মতোই এই সমস্ত কিছু তাদের অনিত্যতার প্রতীক, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বুদ্ধও মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। বোধিচর্যাবতারে শান্তিদেব উল্লেখ করেছেন যে যদি বুদ্ধ, প্রত্যেকবুদ্ধ এবং শ্রাবক, এঁরা সকলেই মৃত্যুকে বরণ করেন তাহলে আমরা মৃত্যুকে বরণ করব কিনা, এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে? ঐ গুরুদের মতো যিনি এবং যারা সমস্ত শিক্ষা লিখেছিলেন, এটি অষ্টম দালাই লামারও একটি শিক্ষা, কিন্তু তিনিও আজ জীবিত নেই। এখানে লক্ষ্য করা উচিৎ যে, যদি এবং যখন এই মহান সত্ত্বদের রূপ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা বুদ্ধের (স্বভাবকায়) তথতায় বিলীন হয়ে যায়, তাই এটা শুধুমাত্র বিভ্রান্ত শিষ্যদের অনিত্যতা সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করার জন্য করা হয়।

ঠিক এই মহান সত্ত্বদের মতো আগামী একশ বছরে কেউই আমাদের পাশে থাকবে না। সেই সাথে রাজা এবং রাষ্ট্রনায়ক যারা তাদের ধন-সম্পত্তি এবং শক্তির জন্য অত্যন্ত গর্বিত আর যারা তাদের কর্ম তালিকার মালা নিয়ে দম্ভ দেখায় তারাও আশেপাশে থাকবে না। শুধু থেকে যাবে তাদের নাম। আজকের অনেক বিখ্যাত বিশ্ব নেতাদের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা প্রযোজ্য, তারাও ভবিষ্যতে এখানে থাকবে না। যে সমস্ত মানুষ আপনাদের সমবয়সী এবং আপনাদের সমতুল্য শরীরিক শক্তি ধারণ ক’রে আছেন তারাও মারা যাবেন। তাদেরকে যমরাজ দ্বারা হঠাৎ ক’রে অপসারণ করা হবে। সুতরাং এমন কী আছে যা আপনাদের আস্থা জোগায় যে আপনারা চিরকাল জীবিত থাকবেন? অনিত্যতা সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা সত্ত্বেও মৃত্যুকে ভয় না করা হল অত্যন্ত বোকামী। এমনকি ভেড়ার মতো নিস্তেজ এবং বোকা প্রাণীরা যখন দেখে যে অন্য ভেড়াদের কসাই দ্বারা হত্যা করা হচ্ছে, তখন তাদের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়ে কেঁপে ওঠে।

গেশে পোতোয়া সম্পর্কিত একটা গল্প আছে। একজন ব্যক্তি তার গ্রামে বসবাস করতেন। তিনি এসে গেশে পোতোয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যখন আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে আপনি কি আমাকে একটা বার্তা পাঠাতে পারবেন?” কিছুদিন পর তাদের থেকে একটি উচ্চ গ্রামে কেউ মারা গিয়েছিল এবং এই সম্পর্কে তাকে একটা বার্তা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারেননি। অবশেষে তার নিজের মৃত্যুর লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তাই তিনি দৌড়ে গেশে পোতোয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আমাকে বার্তা পাঠালেন না কেন?” গেশে পোতোয়া উত্তর দিলেন, “আমি তো বার্তা পাঠিয়েছিলাম কিন্তু আপনি সেটা বুঝতে পারেননি।” গেশে পোতোয়া নিজে যে উপত্যকায় বাস করতেন তার নাম হল পেম্‌পো এবং সেখানে সমস্ত মৃত্যুর গণনা ক’রে অনিত্যতার উপর ধ্যান করতেন।

অনিত্যতা সম্পর্কে বোধগম্যতা অর্জনের জন্য শাস্ত্রীয় উল্লেখের উপর ভিত্তি করার প্রয়োজন হয় না; আপনারা মৃত্যুকে দেখে নগ্ন উপলব্ধির মাধ্যমে এর সম্পর্কে বোধগম্যতা অর্জন করতে পারেন যা সমস্ত প্রাণীদের কষ্ট দেয়। যারা মৃত্যুর সু-স্পষ্টতা দেখতে পায় কিন্তু সেই উপলব্ধিকে নিজের উপর প্রয়োগ করে না তারা হল চোখ খোলা অন্ধের মতো অথবা চশমা পরা চোখের মতো। ভবিষ্যতে, আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, চাকর-বাকর এবং সেবক-সেবিকা সকলেই মৃত্যুকে বরণ করবে। আপনারা তাদের সাথে থাকাকালীন, বাতাসের কারণে একত্রিত পাতার সংগ্রহের মতো, অবশ্যই পরে সবাই ছড়িয়ে যাবে। যদিও আমরা এখন একসাথে আছি কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা যখন আবার দেখাসাক্ষাৎ করব তখন আমরা বিভিন্ন রূপে থাকব এবং একে অপরকে চিনতেও পারব না। কারও পক্ষে অনিত্যতা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা বিরল কিন্তু অন্ততপক্ষে আমাদের পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকা উচিৎ, কারণ এটি স্থিতিশীলতা গড়ে তোলে।

ঋতু পরিবর্তন, পাতা ঝরে পড়া এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনা অনিত্যতার শিক্ষা প্রদান করে। যেমনকি মিলারেপা বলেছিলেন, “আমি আমার চারপাশের সব কিছুকে শিক্ষা হিসাবে দেখি।”

অনিত্যতার আরও একটি উপমা হল মেলা। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এই ঘটনাগুলির জন্য একত্রিত হয় এবং পরে তারা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা জানিনা তারা কোথায় যায় এবং জানিনা তাদের এভাবে আর কখনও একত্র করা যাবে কিনা। আমাদের চারপাশে থাকা বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের এই সংগ্রহগুলি যেন মেলায় থাকা লোকজন অথবা শরতের মাছির মতো। অবশেষে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বসন্ত এবং গ্রীষ্ম ঋতুর মতো বস্তুগুলি মনোমোহকভাবে সুন্দর হতে পারে। তবে সমস্ত উপাদানগুলি অনিত্যতা এবং নিয়মিত ভাবে পরিবর্তনের শিক্ষা দেয়। গাছপালা প্রথমে সবুজ হয়, তারপর কমলা রঙ এবং তারপর অনুর্বর হয়ে যায়। জলপ্রপাতের জলের তাপমাত্রা, তার রঙ এবং শব্দ ঋতুর সাথে-সাথে পরিবর্তন হতে থাকে। যে জলপ্রপাতগুলি আকর্ষণীয়ভাবে সবুজ-নীল রঙের হয় আর সুন্দর নৃত্যের মতো ঢেউয়ের সাথে সুন্দর বুদবুদ শব্দ সৃষ্টি করে, অবশেষে পৃষ্ঠে জমাট বেঁধে যায় এবং তার কারণে সাদা বরফ ও জল থেকে বিড়বিড় শব্দের মতো একটা শব্দ নির্গত করে। মানুষের ক্ষেত্রে তাই নয়। মানুষ যখন তরুণ থাকে তারা অনেক পার্টিতে যায় এবং নাচ-গান ও মদ্যপান উপভোগ করে। কিন্তু বড় হলে তাদের অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে যায়। ঠিক আগের উদাহরণের মতো তারাও বিড়বিড় শব্দ করতে লাগে।

গ্রীষ্মকালে গায়ক মৌমাছিরা সুন্দর বাগানের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। এটা আমাদের তরুণ অবস্থার মতো। আমরা জগতের আনন্দ এবং আরামে লিপ্ত হয়ে যাই। কিন্তু শরৎকালে ঐ ফুলের বাগান একটা মরুভূমির মতো হয়ে যায় আর শীতকালে যখন ঐ বাগান দিয়ে হাওয়া বয়ে চলে তখন সেটা একটা বিষন্ন শব্দ সৃষ্টি করে। মানুষ সেখানে গিয়ে কোন কিছু নগ্ন দেখতে চায় না। কখনো-কখনো সম্পূর্ণ পাহাড় ফুলে ভরে যায় আবার পরে শীতকালে সেটা হয়ে যায় সম্পূর্ণ অনুর্বর। এটি বাড়ির ক্ষেত্রেও তাইঃ সেগুলি বিবর্ণ হয় এবং বৃদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং এগুলি সবই অনিত্যতার উদাহরণ। তবে, অনিত্যতার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক শিক্ষক হল আমাদের নিজেদের শরীর। আমাদের বয়স বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে আমরা তরুণ অবস্থায় যা কিছু করেছি সেটা আর করতে পারি নাঃ আমরা ধীর হয়ে যাই এবং আমাদের চেহারার পরিবর্তন হয়ে যায়।

অনিত্যতা শুধুমাত্র সজীব প্রাণীদের ক্ষেত্রে নয়, বরং ভবন, প্রকৃতি, বাগান, এবং সময়ের মতো নির্জীব বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নালন্দার মতো মহাবিহার যেখানে নাগার্জুন এবং অসঙ্গ অধ্যয়ন করেছিলেন আর বুদ্ধগয়া, অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। গাদেন, সেরা এবং তিব্বতের অন্যান্য মহান ভিক্ষু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এমনকি তিব্বতী গ্রন্থালয় এবং অভিলেখাগার যেখানে আমরা এখন আছি এটাও অবশেষে নষ্ট হয়ে যাবে এবং ধ্বংসাবশেষে পরিণত হবে। নাগার্জুন তাঁর রচনা “সুহৃল্লেখ”-এ বলেছেনঃ “যদি সম্পূর্ণ জগৎ সাতটা সূর্য প্রজ্জ্বলন হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেখানে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের শরীরও একইভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে”। এর কারণ হল এই ধ্বংসলীলা রূপ ধাতুর প্রথম স্তর “ব্রহ্মকায়িক” থেকে শুরু ক’রে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে।

একটা কালো এবং সাদা ইঁদুর পালা ক’রে একটা দড়ি খাচ্ছিল, যে দড়ি দিয়ে একটা খড়ের বোঝা বাধা ছিল। এই কালো এবং সাদা ইঁদুর দুটি রাত এবং দিনকে প্রতিনিধিত্ব করে, খড়ের বোঝা প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের জীবনকালকে আর বোঝার চারপাশের দড়িটি প্রতিনিধিত্ব করে এর সময়কালকে। এই দড়িটি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট না হওয়ার আগে এবং খড়ের বোঝা যা আমাদের জীবনকালকে প্রতিনিধিত্ব করে, সেটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের যতটা সম্ভব গঠনমূলক কাজ করার সুযোগ ব্যবহার ক’রে নেওয়া উচিৎ।

সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত যমরাজের সন্নিকটে যাওয়ার জন্য আমাদের তাড়া করছে। যেমন একটা পশুকে কষাইখানার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক তেমনই প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। প্রতিটি নিশ্বাস, যা আমরা নিয়ে থাকি, আমাদের মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা কতটা এর কাছাকাছি চলে এসেছি? আমরা অল্প বয়সী বলে মরব না মনে করাটা হল বোকামী। যমরাজের কাছে বয়সের কোন পার্থক্য থাকে না। ধনুকের মতো বাঁকা, সাদা চুল এবং কাঁপতে থাকা শরীর যুক্ত অত্যন্ত বৃদ্ধ মা-বাবা যদি তাদের সন্তানদের মৃতদেহ কবরস্থানে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে আমরা কীভাবে বলব যে যমরাজ বয়সের ক্ষেত্রে বৈষম্য করেন? এইভাবে নির্বিশেষে ধর্ম পালন করা প্রয়োজন, শুধুমাত্র আমরা যখন বৃদ্ধ হব তখন নয়।

আমাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য বন্ধু হল আপনার নিজের অনুশীলন। মানুষ নির্ভরযোগ্য নয়। খারাপ পরিস্থিতির শিলাবৃষ্টিতে যখন কারও ফসল নষ্ট হয়ে যায় তখন সে আগে যাদের দেখাশোনা করেছিল সেই নির্ভরশীল মন্ডলী থেকেও কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আমরা যখন গরীব হয়ে যাব তখন মানুষ আমাদের দিকে কোন মনোযোগ দেবে না। পরিবর্তে, আমরা যখন ধনী এবং বিখ্যাত হয়ে যাই তখন মানুষ সবসময় আমাদের মনোযোগ রাখবে। যখন কোন ব্যক্তি ধনী হয়ে ওঠে তখন মানুষ তার কাছে এসে ভান করে আর দাবী করে যে তার খ্যাতিতে তাদের অবদান অবশ্যই আছে। মানুষ আপনার সুখ ভাগ করার চেষ্টা করে কিন্তু তারা আপনার দুঃখ ভাগ করে না। যখন তারা আপনার কাছ থেকে কিছু পায় না তখন তারা আপনাকে উপেক্ষা করে। বুদ্ধ এর বিপরীতভাবে আচরণ করেছেন এবং গরীব ও অভাবগ্রস্থদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছেন।

যদি কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুকে বলে যে তিনি ভাল নন, তাহলে সে তার মন পরিবর্তন ক’রে ফেলবে এবং চঞ্চল হয়ে উঠবে। শুধুমাত্র কয়েকটি কথা পরের দিন আপনাকে অপছন্দ করতে তাকে প্রেরিত করবে। এটি এই উক্তিটিকে প্রমাণ করেঃ “এমন কিছু এক গজ দ্বারা পৌঁছন যায় না, যেটা আগে কয়েক ইঞ্চি দ্বারা পৌঁছন যেত।” এর অর্থ হল মাত্র কয়েকটি শব্দ মানুষকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে যারা আগে কাছে ছিল। আমাদের খোঁজ করতে হবে একজন স্থির ধর্ম বন্ধুর! বন্ধুরা একে অপরের প্রতি যত্নশীল হয় এবং আপনার ভুল ও দুর্বলতা খুঁজে বার করতে দ্বিধা বোধ করে। তবে একজন শত্রু এইক্ষেত্রে বেশি উপকারী হয়, কারণ সে আপনার ভুল-ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দেয়।

কিছু মানুষ ধন-সম্পত্তি সঞ্চয় করার জন্য সারাজীবন ব্যয় ক’রে দেয়; ফলস্বরূপ, তারা জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটায় আর অনেক দুঃখও ভোগ করে। যেহেতু এটা এত দুঃখের কারণ অতএব, ধন-সম্পত্তির প্রতি আমাদের আসক্ত হওয়া উচিৎ নয়। ধন-সম্পত্তিতে সুখের আভাস থাকে কিন্তু সেটা বাস্তবে থাকে না। ধন-সম্পত্তির প্রতি আমাদের আকর্ষণ হল অগ্নিশিখার প্রতি আকর্ষিত একটি মথ বা প্রজাপতির মতোঃ যদি এটা তার খুব কাছে যায় তাহলে সে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। দেখলে মনে হয় ধনবান ব্যক্তিরা সুখী, দেখতে সুন্দর, একটা সুন্দর বাড়ি আছে এবং টাকা পয়সা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই। এটা আকর্ষণীয় মনে হয় কিন্তু আমরা যখন ঐ পরিস্থিতিতে পুরোপুরি নিমজ্জিত হই তখন আমরা বুঝতে পারি যে একবার তারা ধনী হয়ে গেলে ধর্মের প্রতি তাদের আগ্রহ হারিয়ে যায় এবং আরও বেশী ধন সঞ্চয় করার প্রতি তাদের মনোযোগ বেড়েই যায়। পুন্য সঞ্চয় করতে গিয়ে আমরা সবসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি কিন্তু বেশি ধন সঞ্চয় করতে আমরা কখনোই ক্লান্ত হই না।

সংক্ষেপে, জীবন অনিত্য এবং মৃত্যু আসতে বাধ্য। অতএব, আমাদেরকে এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মৃত্যু যে কখন আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে একবার এটা এসে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ধনবান ব্যক্তিরা এটাকে ঘুষ দিতে পারে না, সুন্দরীরা এটাকে আকৃষ্ট করতে পারে না এবং পেশীবহুলরা একে কুস্তি করাতে পারে না। মনে হয় কিছু জায়গায় টাকা দিয়ে ভিসা বৃদ্ধি করা যায় অথবা বাড়ির অনুমতি বৃদ্ধি করা যায় কিন্তু এটা আমাদের আয়ু-কালের বৃদ্ধি করাতে পারে না।

আমরা যখন যমরাজ দ্বারা ধৃত হই তখন আমাদের এই শরীরটা ছেড়ে চলে যায় যেটা জন্ম থেকে আমাদের সঙ্গে থাকে। মৃত্যুর সময় যদিও আমরা উষ্ণ শয়নে মারা যাই এবং আমাদের চেতনা যখন চলে যায় তখন আমাদের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব এবং ধন-সম্পত্তির দিকে ফিরে তাকানোর একটা মুহুর্তও সুযোগ থাকে না। এটাই জীবনের বাস্তবিকতা এবং এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। অক্লান্তভাবে কষ্ট সহ্য ক’রে আমাদের দ্বারা সঞ্চিত সব কিছুই ত্যাগ ক’রে চলে যেতে হবে। আমাদের গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক কর্ম, বোঝা এবং দায়িত্ব নিজের পিঠে নিয়েও এই জীবনের বাইরে যেতে হবে। কিছু বৃদ্ধ মা-বাবা তাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরী করে, কিন্তু তারা যখন মারা যায় তখন সেটা তৈরী করার সময় তারা যেসমস্ত কীট-পতঙ্গ এবং পোকামাকড় ইত্যাদির হত্যা করেছিল, তার ধ্বংসাত্মক কর্মের বোঝা তাদের পীঠে ক’রে নিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে, তার সন্তান এবং নাতি-নাতনীরা সেই বাড়িতে থেকে তাদের জীবন উপভোগ করে। এইভাবে এই ধরণের কাজ কর্মের মাধ্যমে আমরা শুধু নেতিবাচক কর্মের ওজন সঞ্চয় ক’রে চলি।

আমরা যখন অন্তরাভব-এর বিপদজনক পথে যাত্রা করি এবং যমরাজের সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হই বা তাদের দ্বারা আটকে দেওয়া হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি, যে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম সেটা মূল্যহীন ছিল। ঐ সময় তীব্র অনুশোচনা করলেও তাতে কোন লাভ হবে না। একটা প্রবাদ আছেঃ “কেউ যদি আগে থেকে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে সে হয় জ্ঞানী আর কেউ যদি পরে অনুশোচনা করে সে হয় মূর্খ।” অজানা জায়গায় একজন অপরিচিত ব্যক্তির জন্য প্রকৃত পথপ্রদর্শক হল ধর্ম; দীর্ঘ ভ্রমণের বিধান হল ধর্ম; যে মাঝি আমাদের নিরাপদে সমুদ্রের অপর পারে নিয়ে যায় সে হল ধর্ম। তাই আজ থেকেই আপনারা আপনাদের শরীর, বাক্‌ এবং মনকে ধর্মের জন্য প্রয়োগ করুন।

যেহেতু, আমাদের নিজেদের সুখ অসুরক্ষিত করাটা নিজেদের সাধ্যের মধ্যে থাকে, তাই আমাদের অবশ্যই সেটা করতে হবে। আমরা যদি না করি তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ব এবং আমরা কী করব সেটা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারব না। একজন ধার্মিক ব্যক্তি এবং একজন অধার্মিক ব্যক্তি যখন মারা যান তখন তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। পরের জন যখন মারা যান তখন তার মধ্যে কোন সচেতনতা থাকে না এবং দুঃখ-কষ্টের সাথে মারা যান। অন্যদিকে, পূর্ববর্তী ব্যক্তিটি মারা যান শান্তিতে। তিনি আগাম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকেন; তার ধন-সম্পত্তি গরীব, আত্মীয়-স্বজন, শরণগমণের আধার ইত্যাদিদের মধ্যে বন্টন ক’রে দেন। ধার্মিক ব্যক্তির মতো হতে হলে আমাদের উচিৎ যতটা সম্ভব এই উপদেশগুলি থেকে শেখার চেষ্টা করা। তবে আমাদের মধ্যে ভুল পরিত্যাগ (নির্যাণ) থাকা উচিৎ নয় এবং সমস্ত আহার, নিদ্রা এবং ধন-সম্পত্তি ত্যাগ করা উচিৎ নয়। এর পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতা এবং বস্তুগত বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা উচিৎ এবং যতটা সম্ভব অনুশীলন করার চেষ্টা করা উচিৎ।

ধর্মের অনুশীলন বলতে পোষাক পরিধান এবং রীতি-নীতি অনুসরণ করাকে বোঝায় না, বরং একটা উষ্ণ এবং করুণাময় হৃদয় থাকাকে বোঝায়। একটি তিব্বতী মহিলার গল্প আছে, যে মৃত্যুর পর নরকে যায় এবং যমরাজের সাথে সাক্ষাৎ করে। সে তাকে বলে যে, যদিও সে শারীরিকভাবে ক্ষতি করেছিল, তবে সে সেটা করেছিল মানসিকভাবে ভাল অনুপ্রেরণার সাথে। সেই কারণেই তার জীবনকে তার পুরনোরূপে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গল্পটা এই বোঝায় যে বাহ্যিকভাবে আমাদের কর্ম যেমনই দেখাক না কেন সেখানে একটা সদয় হৃদয় থাকার প্রয়োজন।

একটা প্রবাদ আছেঃ “যারা ধর্ম নিয়ে বেশী কথা বলে তারা অনুশীলন করে কম (অতি সাধুতা চোরের লক্ষণ)।” অতীশ সবসময় এর উপর জোর দিতেন এবং যখনই তিনি কারও সাথে দেখা করতেন তিনি সবসময় জিজ্ঞাসা করতেন, “আপনার কাছে কি একটা ভালো হৃদয় আছে?” ড্রোম-তোন্‌পা যখন অতীশের মৃত্যুর খবর শুনতে পেয়েছিলেন তখন তিনি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন, কারণ তিনি অতীশের মৃত্যুর সময় তার সঙ্গে ছিলেন না। তবে মৃত্যুর আগে অতীশ অবশ্যই তাঁর শিষ্যদের জন্য একটা বার্তা রেখে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে, তিনি যদি আর না থাকেন ঐ পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে যদি একটা ভাল হৃদয় থাকে তাহলে সেটা তার দর্শন করার সমান হবে। কদম্পা পরম্পরার শিক্ষাটি মনে রাখাও ভাল যে যদিও আমরা এখন অপরের কল্যাণ করতে না পারার জন্য অভিযোগ ক’রে থাকি, তাহলেও আমরা কমপক্ষে যদি অন্যের ক্ষতি করা থেকে নিজেদের সংযত করি তাহলে সেটা আমাদের স্তরে অনেক লাভদায়ক হয়। তাই আপনারা কাউকে অসুখী না করার চেষ্টা করবেন।

কোন ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারা অবরোধ না হওয়া অবস্থায়ও কিন্তু তার কাছে ইতিবাচক সম্ভাবনা সঞ্চয় করা এবং নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সুযোগ ও শক্তি থাকে। অবশেষে, আপনি নিজেই আপনার নিজের শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং নিজের সবচেয়ে খারাপ শত্রুও। ভবিষ্যতে আপনি যে সুখ অর্জন করবেন সেটা আপনার উপরেই নির্ভর করে। যে ব্যক্তি ধর্ম পালন না ক’রে মারা যায় সে হল একটা মৃত কুকুরের সমান, বিশেষ ক’রে অন্তরাভব অবস্থায়। আপনি একজন মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে কোন পার্থক্য হবে না। একজন চক্রবর্তী সম্রাট, যিনি ধর্মপালন করেন না এবং একটা কুকুর যে রাস্তায় মারা যায়, এদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। বাস্তবে, যখন তারা মারা যায় তখন এটা ভালোও হতে পারে যে কুকুরটি কম নেতিবাচক কর্ম করেছিল। সুতরাং অনুশীলনের শুরুতে, মধ্যে এবং শেষে অনিত্যতা সম্পর্কে ভাবনা করা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সবচেয়ে উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞ আচার্যরা অনিত্যতার উপর ধ্যান করেন।

সমস্ত পায়ের ছাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছাপটি হল হাতির পায়ের ছাপ। সমস্ত চিন্তা ভাবনার মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভাল ছাপ সেটা হল অনিত্যতার ছাপ।

মিলারেপা তাঁর কালো যাদু অর্থাৎ গুরুর গুরুর মৃত্যু দেখে ধর্মে প্রবেশ করেছিলেন। গাম্পোপা ধর্মে প্রবেশ করেছিলেন যখন তাঁর স্ত্রী মারা যান। একইভাবে বুদ্ধ যখন প্রথমবার মৃত্যুকে দেখেছিলেন তখন তিনি ধর্মে প্রবেশ করতে এবং দুঃখ-কষ্টের সমাধান খুঁজতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অনিত্যতাকে মধ্যম (প্রধান) পথ হিসাবে উল্লেখ করা হয় (এখন মধ্যমক বা মধ্যপথের সাথে বিভ্রান্ত হবেন না)। এটা হল একটা প্রধান পথ যা এই জীবনের প্রতি আসক্তির প্রতি বাধা সৃষ্টি করে এবং একজন সাধকের অনুশীলনে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা স্থাপন করে। প্রধান পথ হিসাবে অনিত্যতার উপর এই লাইনটির আরও গভীর ব্যাখ্যা আছে। এটাকে মধ্যম পন্থার পরিপ্রেক্ষিতেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, অনিত্যতা হল মাধ্যমিক দর্শনের অন্তর্দৃষ্টি বিকাশের ভিত্তি যা আত্মার অস্তিত্বের প্রতি মিথ্যা কল্পনাগুলিকে দূর করে এবং সাম্বৃতিক বা ব্যবহারিক আত্মার বাস্তবতায় আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে।

মনকে বিক্ষিপ্ততা থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে ধর্মে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হওয়ার পর আমাদেরকে অবশ্যই নিম্নলিখিত অনুশীলনগুলি পালন করতে হবে। যদিও এই জগতে অনুশীলনের অনেক পরম্পরা আছে যা গভীর হওয়ার ক্ষেত্রে বিখ্যাত, তবে ধর্মের অনুশীলনে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পর চোংখাপা দ্বারা সু-প্রতিষ্ঠিত পরম্পরার মাধ্যমে ত্রিকালগত বুদ্ধদের শিক্ষার সম্পূর্ণ সারমর্মকে অনুসরণ করার চেষ্টা করাটা সর্বোত্তম হবে। এরজন্য আমাদের সূত্র এবং তন্ত্রের সমন্বয় এবং একীভূত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, যার মধ্যে ব্যাখ্যা এবং অনুশীলন উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটাকে অনুশীলন করতে হলে আমাদের পথের স্বভাব বা স্বরূপ, ক্রম এবং বিভাজনগুলি জানতে হবে এবং তারপর সেগুলিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদেরকে সূত্রের আগে তন্ত্রের অনুশীলন করা উচিৎ নয় অথবা দুর্লভ মানব জীবন, শরণ-গমণ, প্রতীত্যসমুৎপাদ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না ক’রে বোধিচিত্ত সম্পর্কে অধ্যয়ন করা উচিৎ নয়।

আমাদেরকে সম্পূর্ণ নির্ভুল পথের প্রবৃত্তি এবং তার প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি দিনে দিনে আমাদের মনে রোপন করার চেষ্টা করা উচিৎ। ঠিক যেমন ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন যতটা সম্ভব জিনিসপত্র বিক্রি করার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনই আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরী করার জন্য প্রতিদিন যতটা সম্ভব কুশল বীজ রোপন করতে চেষ্টা করা উচিৎ। প্রকৃত অনুশীলনে আমরা সূত্র এবং তন্ত্র সম্পর্কিত সাধারণ পদগুলির একটা সংক্ষিপ্ত গ্রন্থকে ভিত্তি ক’রে ‘অবলোকন ধ্যান’ অনুশীলন করতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, “গুণ-আধার (য়োন-তন শি-গ্যুরমা)” যা সাধারণতঃ কষ্ঠস্থ করা হয়, ধীরে-ধীরে পাঠ করা হয় এবং তার উপর ধ্যান করা হয়। এই অনুশীলনটি ‘জোর-ছোদ্‌’-তে (প্রাথমিক সাধনা) দেখতে পাওয়া যায়। এরকম আরও একটি গ্রন্থ হল ‘সংক্ষিপ্ত মার্গক্রম’ যে গ্রন্থটি ষট্‌-পারমিতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রস্তুত করে। তবে এই গ্রন্থটি ‘য়োন-তন শি-গ্যুরমা’-এর মতো স্পষ্ট নয়, তাহলেও এটা তিন প্রকারের নৈতিক শৃঙ্খলা (ত্রি-অধিশীল) অন্তর্ভুক্ত করে যা ষট্‌ পারমিতার উপস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরণের “অবলোকন ধ্যানের” জন্য আমরা আরও একটি গ্রন্থ অনুসরণ করতে পারি সেটা হল ‘গুরু-পূজা’ (লামা-ছোদ্‌পা) এবং এটা হল মার্গক্রমের একটা অংশ। “অবলোকন ধ্যান” হল আমরা যা কিছু শিখে থাকি সেটাকে পর্যালোচনা করার একটি কার্যকরী পদ্ধতি। এটি ঐ শ্রুতিকে আমাদের মনে সামুহিকভাবে সংগঠিত করতে সাহায্য করে। এটি হল একটি মানচিত্রকে পর্যালোচনা করার মতো যা আমাদের সব কিছু দেখতে বা পুরো সমভূমির একটা পর্বত থেকে গগনচারী দৃশ্য দেখতে সহায়তা করে।

এই মুহূর্তে মার্গক্রমের অভিজ্ঞতা অর্জন করা কঠিন হতে পারে কিন্তু প্রতিদিন “অবলোকন ধ্যান” করলে সেটা আমাদের মনে শিক্ষার সম্পূর্ণ সংগ্রহের নির্দেশনা রোপন করে। আমরা যখন মার্গক্রমের উপর ধ্যান ভাবনা করি তখন আমাদের নির্দেশাবলীতে উল্লিখিত সঠিক পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হবে। সর্বপ্রথম, আমাদের বোধিচিত্তের প্রেরণা নির্ধারণ করতে হবে এবং শেষে সম্পন্ন করতে হবে উৎসর্গ। আমরা যখন অধিবেশনের শুরুতে আমাদের প্রেরণা নির্ধারণ করব তখন আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা সমস্ত সত্ত্বের কল্যাণের জন্য ধ্যান ভাবনায় যুক্ত হতে চলেছি। যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে অন্ততঃ আমাদের মনে ত্যাগ ভাবনা জাগাতে হবে। আমাদের ধ্যান সাধনা সমাপ্ত হওয়ার পর সমস্ত সত্ত্বের সুখ এবং বুদ্ধত্ব লাভের উদ্দেশ্যে আমরা যে ইতিবাচক সম্ভাবনা বিকশিত করেছিলাম সেটাকে উৎসর্গ করতে হবে। আমি আপনাদের সকলকে এই ধরণের অনুশীলনে যুক্ত হয়ে আপনাদের দুর্লভ মানব জীবনের সারমর্মকে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। “সারমর্মকে গ্রহণ করা”- এর ব্যাখ্যার তিনটি স্তর আছেঃ মহৎ, মধ্য এবং ছোট। মহৎ বলতে এই জন্মে বুদ্ধ হওয়া, মধ্য বলতে সমস্ত স্থূল আকারের ক্লেশ থেকে মুক্ত হওয়া এবং ছোট বলতে দুর্গতিতে পুনর্জন্ম হওয়া থেকে মুক্তি লাভ করাকে বোঝায়।

উৎসর্গ

এর দ্বারা নির্মিত ইতিবাচক শক্তিপুঞ্জের সামর্থ্য এবং বলের মাধ্যমে আমরা দুঃখের কারণগুলি অর্থাৎ নিত্যতার প্রতি লোলুপ ভাবনা আসক্তি এবং বিদ্বেষকে ধ্বংস করতে সক্ষম হতে পারি। আমরা যেন বিশেষ ক’রে সত্য-গ্রাহকে আঁকড়ে ধরার শক্তিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হতে পারি যা হল এই দুঃখময় সংসারের মূল! প্রত্যেকে যেন বুদ্ধত্বরূপী মহান এবং শুভ অমরত্বের অবস্থা লাভ করতে পারে।

ধর্মের উন্নতির সময় শত-শত নৈতিক কর্ম করার চেয়ে ধর্মের অবনতির সময় একদিনের জন্য এর অনুশীলন করা ভাল। ধর্মের অনুশীলনের অর্থ হল একটা ভাল হৃদয় থাকা, সদয় হওয়া, বিবেকবান হওয়া, করুণাময় হওয়া এবং অপরের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা। গুরুর অনুগ্রহ শোধ করার এটাই হল সর্বোত্তম উপায়। কারও অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করার সময় করুণাময় হওয়ার ভান না ক’রে নজিরবিহীনভাবে ধর্মপালন করাটাই হল উত্তম। মিলারেপা বলেছেন, “শুধু নিজের সুখের জন্য কর্ম করবেন না, অন্যের জন্যেও করবেন। পিতারূপী গুরুর ঋণ শোধ করার এটাই হল শ্রেষ্ঠ উপায়।

নবাগতদের জন্য ধর্মে প্রবেশ করার সর্বোত্তম উপায় হল সর্বপ্রথম দশটি ধ্বংসাত্মক কর্ম সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা এবং সেগুলি থেকে নিজেকে সংযত রাখা। তারপর সে ধীরে ধীরে তার অনুশীলন গড়ে তুলতে এবং ধ্যান-সাধনায় প্রবেশ করতে পারে। শুরু থেকেই অবিলম্বে ধ্যান-সাধনা করলে মনে হতাশা জন্ম নিতে পারে এবং তাকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এরফলে তার মধ্যে ধ্যানের প্রতি ঘৃণা তৈরী হতে পারে। এটা সবচেয়ে নিরীহ, সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং ধর্মচর্চার জন্য অপ্রকৃত ভিত্তি নয়। দশটি গঠনমূলক কর্মের নৈতিকতা অনুশীলন করার জন্য আমাদের বিকাশ করতে হবে নৈতিক আত্ম-মর্যাদা; আমাদের কর্মগুলি অন্যের উপর কীভাবে প্রতিফলিত হয় সেই বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। আর বিকাশ করতে হবে মননশীলতা এবং সতর্কতা। আমাদের কেবল এমন কিছু করা উচিৎ নয় যা আমাদের কেবল সন্তুষ্ট করে বরং আমরা যা পরিধান করি, যে কর্ম করি, যা চিন্তা-ভাবনা করি এবং যা কিছু বলি সেটা অন্যের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল আমরা যেন কারও ক্ষতি না করি।

Top