ভূমিকা
আজকের সন্ধ্যার বিষয় হল বিশ্লেষণাত্মক বা বিচার ধ্যান-সাধনা। এখন, আত্ম-শুদ্ধির দৃষ্টিতে জীবন এবং বোধিচিত্তে নিরাপদ ও ইতিবাচক দিকে যাওয়ার জন্য তিনটি পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছেঃ
- আমাদেরকে প্রবচন শ্রবণ করতে হবে।
- তারপর আমাদেরকে তার উপর চিন্তন বা ভাবনা করতে হবে।
- এবং তারপর আমাদের করতে হবে তার উপর ধ্যান-সাধনা।
এতে সকলেই একমত। এটি একটি অত্যন্ত আদর্শ বৌদ্ধ শিক্ষা।
শান্ত হওয়া
শান্ত হওয়ার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করা হল এই তিনটির মধ্যে প্রাথমিক ধাপ। কিছু লোকজন এটাকে শমথ-এর পূর্ণরূপ মেনে নেন। প্রবচন শ্রবণ করার আগে আমাদের শান্ত হওয়া প্রয়োজন; সেগুলির সম্পর্কে চিন্তন করার আগে আমাদের শান্ত হওয়া প্রয়োজন; ধ্যান-সাধনা করার আগে আমাদের শান্ত হওয়া প্রয়োজন। তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ ক’রে সেটা করা যেতে পারে। কেবল শান্ত হয়ে আমরা একাগ্রতার অবস্থা লাভ করতে পারি না আর এটা অবশ্যই আমাদের সমস্যার কারণগুলি উন্মূলনও করে না (যদিও এটা এই বাধা-বিঘ্নগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের মন আরও নির্মল হয়ে যায়)।
নিঃসন্দেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর ধ্যান-সাধনা করার পদ্ধতিকে পূর্ণ একাগ্রতার বিকাশের একটা উদ্দেশ্য মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মনকে শান্ত করার জন্য ব্যবহৃত মনোনিবেশ আমাদের পূর্ণ একাগ্র অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে না। আর প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি সেটার দিকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে তাকাই তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, কেবল থেরবাদ শিক্ষায় বলা হয়েছে যে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ ক’রে আমরা পূর্ণ একাগ্রতা লাভ করতে পারি। শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করা হল একটি ইন্দ্রিয়গত অনুভূতি- আর মহাযান শিক্ষা অনুযায়ী, যা তিব্বতী পরম্পরা অনুসরণ করে, পূর্ণ একাগ্রতা লাভের জন্য আপনাকে ইন্দ্রিয়গত নয়, বরং মানসিক জ্ঞান প্রয়োগ করতে হবে।
অতএব, আমরা যখন তিব্বতী পরম্পরায় ধ্যানের দিকে লক্ষ্য করি তখন আমাদেরকে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ ক’রে কেবলমাত্র শান্ত হওয়ার চেয়েও আরও আগে যেতে হবে। এটাই হল প্রাথমিক।
শ্রবণ করা
ঠিক আছে, এবার আমাদের প্রবচন শুনতে হবে, সেগুলি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং ধ্যান করতে হবে। এই তিনটি ধাপের প্রত্যেকটি থেকে আমরা এক ধরণের প্রভেদমূলক সচেতনতা লাভ করি (যা সাধারণতঃ প্রজ্ঞারূপে অনুবাদ করা হয়, তবে প্রজ্ঞা একটি খুবই অস্পষ্ট শব্দ)। প্রথমে আমাদের কোন বস্তুকে প্রভেদ করতে হবে। এটাকে সাধারণতঃ ‘স্বীকৃতি’ বলা হয়। চাক্ষুষেন্দ্রিয়ের মতো, দেওয়ালের উপর টাঙানো কারও চিত্রের বিভেদ তার মুখের আকৃতি এবং রঙের ভিত্তিতে করা হয় যাতে আমরা তার সমস্ত ত্বকের মোকাবিলা করতে পারি এবং যে কোনও ধরণের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি। সুতরাং, এটাই প্রথম ধাপ, প্রথম প্রভেদতা। আর প্রভেদমূলক সচেতনতা যা করে সেটা হল এর সাথে একটা সিদ্ধান্তমূলকতা যোগ করেঃ “এটা অবশ্যই এটা এবং ওটা নয়।” প্রভেদমূলক সচেতনতা বলতে এটাকেই বোঝায় (যেমন আমি বলি, এটাকে সাধারণতঃ ‘প্রজ্ঞা’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়, তবে আমরা এখানে যে বিষয়টাকে উল্লেখ করছি ‘প্রজ্ঞা’ তার অর্থের সঠিক স্বাদটা ব্যক্ত করে না)।
এই শিক্ষাগুলি শ্রবণ ক’রে আমরা যা লাভ করি সেটা হল প্রভেদমূলক সচেতনতা, যেটা উৎপন্ন হয় শ্রবণ থেকে। এর অর্থ হল বৌদ্ধ শিক্ষাগুলিকে প্রভেদ করা। এর অর্থ হল বৌদ্ধ বিবৃতি থেকে অন্যান্য বিবৃতিকে প্রভেদ করা (আমরা সেটাকে অ-বৌদ্ধ বিবৃতি বলতে পারি) এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে বলতে পারিঃ “এটি বুদ্ধের শিক্ষা।” এই শিক্ষা দ্বারা যদি আমাদের কোন লক্ষ্য প্রাপ্ত করতে হয়, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এটি বৌদ্ধ শিক্ষা, তাই না?
সুতরাং, এখানে এই পর্যায়ে আমরা যেটা পাই সেটা হল ধর্ম সম্পর্কিত শব্দগুলির একটি ধারণা, কিন্তু সেগুলির অর্থ কী তার সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। উদাহরণ স্বরূপ, আমার কাছে একটা মূল্যবান মানব জীবন আছে। বেশ, আমরা এটাকে অ-বৌদ্ধ বিবৃতি থেকে প্রভেদ করতে সক্ষম। তাই, আমাদের কাছে একটা মানব জীবন আছে এবং আমরা স্বীকার করি যে এটা সত্য, কারণ আমাদের মধ্যে বুদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, তবে এই পর্যায়ে আমরা সত্যিই এর অর্থ কী সেটা বুঝি না। বৌদ্ধ শিক্ষা বলে না যে এই মানব জীবন অর্থহীন, এর কোন উদ্দেশ্য নেই এবং জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই। আমরা প্রভেদ করেছিঃ “ঠিক আছে, বৌদ্ধ বিবৃতিটি হল যে আমাদের কাছে একটা মূল্যবান মানব জীবন আছে।”
চিন্তন করা
এবার আমাদের পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে এবং সেটা হল এর অর্থ বোঝার জন্য এটা সম্পর্কে চিন্তন করা। এর অর্থ হল, মূল্যবান মানব জীবনের সংজ্ঞা সম্পর্কে চিন্তন করা- এর অর্থ কী- এবং এটা মূল্যবান কেন তার যুক্তি প্রণালী। আমরা যদি সেটা বুঝি তাহলে আমরা শিক্ষাকে বুঝি, তাই নয় কি? অতএব, আমাদের এই বিষয়ে কাজ করতে হবে। এটা নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে একটা মূল্যবান মানব জীবনের আঠারোটি বৈশিষ্ট কী। উদাহরণ স্বরূপ, আমি একটা পশু নই। আমরা জৈবিক অর্থে বলছি না যে, আমরা একটা উদ্ভিদ নই; আমরা একটা পশু। আমরা সেই অর্থে বলছি না। একজন মানুষ বলতে তাকে বোঝায় যে হল একজন সত্ত্ব এবং যে দীর্ঘমেয়াদে কোনটা লাভদায়ক ও কোনটা ক্ষতিকারক তার মধ্যে প্রভেদ করতে সক্ষম, বুঝতে আর সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম ইত্যাদি।
সুতরাং, আমাদের বুঝতে হবে এর অর্থ কী- আমি একটা পশু নই- এবং আমাদের যুক্তির প্রণালীটি বুঝতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে যে এটা কোন প্রমেয়কে প্রমাণ করে। এখানে প্রমেয়টি হল পশু হিসাবে নয়, বরং মানুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করাটাই হল ধর্ম অনুশীলন করা এবং উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে মূল্যবান। প্রমেয় বলতে যেটাকে আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। একজন মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করা, পশুরূপে নয়, এটাই হল ধর্ম অনুশীলন করা এবং উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে মূল্যবান। আর যুক্তির প্রণালীটি হল, পশুরূপে আমি পাশবিক প্রবৃত্তির শক্তিশালী এবং অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের অধীনে থাকব। পাশবিক প্রবৃত্তি কী? শিকার করা এবং হত্যা করা। আমার এলাকা রক্ষা করার জন্য, কুকুরের মতো কেউ উঠোনে আসলে ঘেউ-ঘেউ ক’রে ওঠে। আর যখন মন চায় অন্য পশুর সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে। একটা পশু হিসাবে, দীর্ঘমেয়াদে কোনটা লাভদায়ক এবং কোনটা ক্ষতিকারক সেটাকে পার্থক্য করার ক্ষমতা ভীষণ ভাবে দুর্বল থাকে। স্পষ্টতই, স্বল্পমেয়াদে তারা সেটা পার্থক্য করতে পারে- আপনি সিংহের কাছ থেকে পালিয়ে যান কারণ সেটা লাভদায়ক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কোনটা লাভদায়ক এবং ক্ষতিকারক সেটা তারা পার্থক্য করতে সক্ষম হয় না। অতএব, আমি যদি এরকম হই তাহলে আমার পক্ষে ধর্ম অনুশীলন করা খুবই কঠিন হয়ে উঠবে।
আপনাদের সেটার সম্পর্কে ভাবতে হবে এবং কল্পনা করার চেষ্টা করতে হবে যে, এটা কীসের সম্পর্কে বলছে। আমরা সেই পরিদৃশ্য সম্পর্কে কল্পনা করার চেষ্টা করি যে আমরা যদি পশু হতাম এবং নিজেদেরকে পাশবিক যোনির অসুবিধাগুলি বোঝানোর চেষ্টা করতাম তাহলে সেটা কেমন হতো। যদি আমার মধ্যে নিয়মিতভাবে এই প্রবৃত্তিটি থাকত, শিকার করার এই প্রবল প্রবৃত্তি ...... মানে, যেভাবে একটা বিড়াল পোকামাকড় বা ইঁদুরের পিছনে ছুটতে থাকে সেটাকে দেখুন অর্থাৎ সেটাকে খাওয়ার জন্য নয়, বরং কেবল সেটার উপর অত্যাচার করা এবং ধরার চেষ্টা করা, এটা যদি আমার প্রথম প্রবৃত্তি হতো, প্রবল আবেগ হতো, যে আমি যখন মেঝেতে ছোট্ট জীবকে নড়াচড়া করতে দেখি ...... যদি এটা আমার স্বয়ংক্রীয় প্রবৃত্তি অপ্রতিরোধ্য হতো, তাহলে আমি কীভাবে নিজেকে সংশোধন করতে পারতাম?
বাস্তবে আমাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা খুবই আকর্ষণীয়। আমরা যখন একটা মাছি, একটা আরশোলা বা একটা মশাকে ঘরে দেখি, আমরা তার শিকার করার জন্য তৎপর হয়ে উঠি; আমরা মনোযোগ রাখতে পারি না- আমরা কিছুই করতে পারি না- যতক্ষণ না আমরা আমাদের শিকারকে ধরে হত্যা না করে ফেলি। আমরা ধ্যান-সাধনা করতে পারি না, আমরা পড়াশোনা করতে পারি না- আমরা কিছুই করতে পারি না- যতক্ষণ না আমরা তার হত্যা করে ফেলি। যেমনকি আমি বলি, যে কোন বিষয়কে তার অযৌক্তিক পরিণাম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটা লাভদায়ক হয়। আমরা নিজেদেরকে আমাদের হাস্যকর আচরণের চরম মূর্খতার পরিচয় সম্পর্কে তখনই অবগত হই যখন আমরা কল্পনা করি যে আমরা হেলমেট পরে আফ্রিকার শিকার যাত্রায় যাচ্ছি। এমনকি আমরা যদি মশাটিকে ঘর থেকে তাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাই, অন্ততঃ আমাদের কাজকর্ম করার প্রবৃত্তিতে কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই হবে। আমরা শুধু শিকার করতে যাওয়া কোন পশু নই।
এছাড়াও আমরা যদি পশু হতাম আর নিয়মিতভাবে অন্যান্য প্রাণীরা যদি আমাদের শিকার করত আর সেটা যেকোন সময় করত, আমাদের উপর আক্রমণ করত, তাহলে তো আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হতো। এই পাশবিক পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য একটা অনুকূল পরিস্থিতি তৈরী করবে না যাতে আমরা অধ্যয়ন করার জন্য শান্ত থাকা, একাগ্রতা লাভ করতে পারি ইত্যাদি।
সুতরাং, এইভাবে আমরা পশুদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি বিচার করি- পশুর যৌন আচরণের পদ্ধতি, তার আঞ্চলিকতা ইত্যাদি- এবং দেখি যে যদি এই ধরণের প্রবৃত্তি, প্রবল প্রবৃত্তি আমাদের মধ্যে তীব্র থাকত তাহলে সেটা আবার আমাদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াত।
অথবা আমাদের যদি নিয়মিতভাবে একটি ভারী বোঝা বহন করতে হতো, যেমন- ভারতে বলদ গরুদের ভারী বোঝা বহন করতে হয় (আর সর্বক্ষণ বেতের আঘাত খেতে হয় ইত্যাদি), তাহলে সেটাও আমাদের সাধনা করার ক্ষেত্রে খুবই কঠিন হয়ে উঠত। অতএব, এইভাবে আমরা যখন এই উদাহরণগুলি বিচার করি, পশু হিসাবে জন্ম নেওয়ার এই বিষয়টাকে, তখন আমাদের সেটাকে প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। আমরা কোন বেম্বী অথবা ধনী পরিবারের কুকুরের সম্পর্কে কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি একটা আরশোলার সম্পর্কে। আমরা ভাবছি রাস্তার একটা কুকুরের সম্পর্কে, আমরা ভাবছি একটা কাজের পশু নিয়ে।
সুতরাং, আমরা এখানে সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যটিকে সঠিক পেয়েছি, আর আমরা বুঝেছি যে আমরা সেরকম নই। আর তাই আমি এগুলি থেকে মুক্ত কারণ আমি সেগুলি থেকে স্বাধীন। ধর্ম অনুশীলন করার জন্য আমার কাছে আছে সুযোগ এবং স্বাধীনতা। তাই আমার কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন।
এবার আমরা এই পর্যায়ের জন্য কিছু মুহূর্ত কাটাব। পশুদের সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমরা বুঝেছি যে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করেছি এবং আমরা এটাও বুঝেছি যে আমরা তার থেকে মুক্ত। যেহেতু আমরা সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত, তাই আমাদের কাছে অনুশীলন করার সময় আছে।
বেশ, আমরা দেখতে পাই যে আমরা সম্পূর্ণভাবে পাশবিক প্রবৃত্তির অধীনে নেই।
- আমাকে মেঝেতে চলাফেরা করা যেকোন ছোট প্রাণীর উপর দিয়ে যেতে এবং ছোঁ মেরে ধরতে হবে না।
- যখন অন্য সব পশুরা ঘেউ-ঘেউ করে তখন আমাকেও ঘেউ-ঘেউ করা অথবা তাদের মতো অনুকরণ করার প্রয়োজন হবে না।
- আমাকে অন্য প্রাণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়োজন হবে না, যেমন- যখনই আমি দেখতে পাই যে কোন পশু আমাকে আকৃষ্ট করছে তখন আমাকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
আমার মধ্যে সামান্য কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও আমাকে সেটা কার্যকর করার দরকার নেই। আমি একজন মানুষ। আমার মধ্যে কোনটি থাকা উচিত এবং কোনটি অনুচিত তার পার্থক্য করার ক্ষমতা আছে। সুতরাং, এই কারণে আমার কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন আর আছে মূল্যবান মানব জীবনের উদ্দেশ্য। ঐ উদ্দেশ্যটি হল ধর্মের অধ্যয়ন এবং অনুশীলন করার ক্ষমতা, কেবল প্রচুর অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে মূল্যবান নয়।
অতএব, এই পর্যায়ে আমরা কি করছি? আমরা করছি ধর্মের চিন্তন এবং মনন। আমরা শুধু শব্দের উপর নির্ভরশীল নই। এটাই হল প্রথম পর্যায় বা ধাপ। তবে, একটা মূল্যবান মানব জীবনের চারিত্রিক চিহ্ন বা সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের নিজস্ব পরিস্থিতি, আমাদের নিজস্ব অবস্থা আর যুক্তির প্রণালীর উপর নির্ভর ক’রে আমরা একটি আনুমানিক উপলব্ধি অর্জন করি। অনুমানের অর্থ হল একটি যুক্তির প্রণালীর উপর নির্ভরশীল হওয়া- এই কারণের উপর নির্ভর ক’রে আমি সেটা বুঝি। আমরা প্রভেদমূলক সচেতনতা লাভ করি সেটা উদ্ভূত হয় চিন্তন থেকে। আর এটা এমন একটি ধারণার উপর কেন্দ্রিভূত হয় যার সঠিক অর্থ থাকে, যেটা শুধুমাত্র নিরর্থক শব্দের উপর ভিত্তি করে না। সুতরাং, এখানে অর্থবহ ধারণাটি হল, “আমার কাছে একটা মূল্যবান মানব জীবন আছে কারণ আমি পশু হওয়া থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছি”, এবং এটা নিশ্চিত। এটাই সেই পার্থক্য গড়ে তোলে। এটাই অন্যান্য কারণ এবং অশুদ্ধ সংজ্ঞা থেকে এটার পার্থক্য। সুতরাং, এটা নিশ্চিত।
আসুন, এবার আমরা প্রভেদমূলক সচেতনতার উপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করিঃ “আমার কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন কারণ আমি পশু হওয়া থেকে মুক্ত।” আমরা এই বোধগম্যতার উপর মনোনিবেশ করি। প্রকৃতপক্ষে, এর ক্রমটা অন্যভাবে হওয়া উচিতঃ “আমি পশু হওয়া থেকে মুক্ত। সুতরাং, আমার কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন।” অন্য কথায়, আমরা একটি যুক্তি ধারার উপর নির্ভরশীল হই এবং তারপর আমরা তার নিষ্কর্ষে পৌঁছে যাই। আর পরে আবার আমাদের সেই যুক্তি ধারার উপর নির্ভর হতে হয়।
বেশ, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এই প্রথম দুটি পর্যায়, শ্রবণ এবং চিন্তনের, মধ্যে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। এই দুটি থেকে আমরা যে প্রভেদমূলক সচেতনতা লাভ করি সেটাও সম্পূর্ণ আলাদা।
- প্রথমটিঃ “আমাদের কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন।” আপনারা জানেন এটি বৌদ্ধশিক্ষা- এতে কোন সন্দেহ নেই- তবে আমরা কেবল অনুমান করি যে এটা সত্য। আমরা সত্যিই অবগত নই। আমরা আসলে এর প্রকৃত অর্থ বুঝি না।
- কিন্তু দ্বিতীয়টির মাধ্যমে আমরা বুঝি যে মূল্যবান মানব জীবন বলতে কী বোঝায়, আমরা জানি কেন আমাদের কাছে এটা রয়েছে (এর কারণ), আর আমরা জানি যে কী এটাকে মূল্যবান ক’রে তোলে (ধর্ম পালন করতে সক্ষম হওয়ার কারণে মূল্যবান)। সুতরাং, এটাকে না বুঝে সত্য ব’লে ধরে নেওয়ার পরিবর্তে আমরা এই নিষ্কর্ষে পৌঁছতে পারি এবং অনুমানের ভিত্তিতে বৈধভাবে জানতে পারি। তার মানে হল এটা যুক্তির একটা প্রণালীর উপর নির্ভর করে। আর আমাদের কাছে আছে একটি প্রভেদমূলক সচেতনতা। এর অর্থ হল আমরা এটার বিষয়ে নিশ্চিত। আমাদের একটা দৃঢ় মত আছে যে, “আমার কাছে সত্যিই একটা মূল্যবান মানব জীবন আছে। আর সেটা কোন নিশ্চিত কারণ এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য।”
শাস্ত্রার্থ
এখন এখানে এই দৃঢ় মতকে লাভ করার জন্য শাস্ত্রার্থ একটা খুবই উপকারী উপায় হতে পারে। কারণ শাস্ত্রার্থ যা করে সেটা হল এটা আমাদেরকে কোন অনির্ণায়ক অস্থিরতা অথবা অর্থ বা ধারণাকে দূর করতে সাহায্য করে। আমরা অনির্ণায়ক হব না, আমরা বিচলিত হব না, আমাদের মধ্যে সেটা আছে কি? আমাদের মধ্যে কি সেটা নেই? এর মানে কি এই? এর মানে কি ঐ? কারণ অন্যরা আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আরও বেশি ভুল-ত্রুটি খুঁজে পাবে যেটা আমরা নিজেরা সেটা করতে পারি না। আপনারা যদি একা বসে নিজের বোধগম্যতার পরীক্ষা করেন তাহলে খুবই সহজে তার উত্তর পেয়ে যাবেন, “ওহ্, অনেক হয়েছে!” অন্যরা আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আরও বেশি কার্যকরভাবে আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলি খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। তারা আরও বেশি উৎসাহের সাথে সেগুলিকে অনেক সময় ধরে বজায় রাখে। কখনো-কখনো শাস্ত্রার্থে আপনারা একটি আবেগগত বিষয়ে পৌঁছে যান যেখানে আপনারা বলে ওঠেন, “অনেক হয়েছে। আমাকে একা থাকতে দিন।” আপনারা যদি এই জিনিসটা ধ্যান-সাধনায় করতেন তাহলে আপনারা অনেক আগেই সেটাকে বন্ধ করে দিতেন। তাই এই কারণে বৌদ্ধ পরম্পরা শাস্ত্রার্থের পদ্ধতির উপর ভীষণ ভাবে জোর দেয়। এটি আমাদের বোধগম্যতা বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত হয়ে দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করতে সাহায্য করে।
বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান
অতএব, এখানে শিক্ষার বিষয়ে চিন্তন বা মনন করতে হয়। এরপর আমাদের তার উপর ধ্যান-সাধনা করতে হয়। আমি যেটা বলতে চেয়েছি সেটা হল প্রায়শই মানুষ মনে করে যে দ্বিতীয় পর্যায়টি হল ধ্যান। কিন্তু আসলে এটা হল চিন্তন করা, শিক্ষাগুলি সম্পর্কে মনন করা। ধ্যান সাধনা হল তার বাইরে কিছু। তবে অবশ্যই আমরা ধ্যান-সাধনা ততক্ষণ করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই দ্বিতীয় পর্যায়কে পূর্ণ না করি। যতক্ষণ আপনারা এই শিক্ষাটি না বুঝবেন এবং নিশ্চিত না হবেন যে এটা সঠিক ততক্ষণ আপনারা সত্যিই এর উপর ধ্যান করতে পারবেন না। আপনারা কোন একটা কিছুকে বুঝতে পারেন এবং নিশ্চিত হতে পারেন যে সেটা ভুল কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা হল বিষয়টাকে বোঝা এবং তার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যে, সেটা সত্য। কারণ ধ্যান-সাধনা হল এই বোধগম্যতা এবং বিশ্বাসকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে একীভূত করার পদক্ষেপ।
তাই প্রথমে আমরা বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান-সাধনা করি যেটাকে আমি “বিচার ধ্যান” বলতে পছন্দ করি এবং তারপর করি স্থির বা স্থাপিত ধ্যান। এই দুই প্রকারের ধ্যান শিক্ষাকে একীভূত এবং আত্মসাৎ করার জন্য নির্ধারিত। এখন, বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান-সাধনার জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে দুটি চৈত্ত (চেতসিক) ব্যবহার করি (এর উপর জোর দেওয়া হয়; অবশ্যই আরও চৈত্ত আছে যেগুলি আমাদের ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, যেমন- একাগ্রতা ইত্যাদি)। আমি যেভাবে এগুলির অনুবাদ করতে চাই সেটা হল স্থূল বিশ্লেষণ এবং সূক্ষ্ম মীমাংসা। কিছু প্রসঙ্গে এই দুটি শব্দের অর্থ তদন্ত করা এবং পরীক্ষা করাকে বোঝায়।
আমরা কীভাবে এই দুটি চৈত্তকে বুঝব? আসুন, আমরা একটা গ্রন্থ সম্পাদন করার উদাহরণ ব্যবহার করি। এখানে আমরা নিজেরা বা অন্য কেউ যে গ্রন্থটা রচনা করেছেন তার মধ্যে কোন ভুল-ত্রুটি আছে কিনা সেটা জানার জন্য গ্রন্থটা পড়ি। প্রথমে আমরা মোটামুটিভাবে তদন্ত করব এবং সনাক্ত করব যে অমুক মুদ্রিত পৃষ্ঠায় ভুল-ত্রুটি রয়েছে। আপনারা মোটামুটিভাবে ভুল-ত্রুটিগুলিকে দেখেন এবং তদন্ত করেন। তারপর আপনারা সেটার সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করেন এবং নির্দিষ্ট বিবরণগুলি যাচাই করেন। আপনারা কি এই দুটির মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পান? অতএব, এটা হল তদন্ত করা যার অর্থ হল স্থূলভাবে বিষয়টার সনাক্তীকরণ করা এবং তারপর সাবধানে সেটাকে পরীক্ষা করতে হয়, যার অর্থ হল গম্ভীরভাবে বিষয়টিকে পরীক্ষা করা।
সুতরাং, আমাদের মূল্যবান মানব জীবনের উপর বিশ্লেষণাত্মক অথবা বিচার ধ্যানের ক্ষেত্রে আমাদের কী করতে হবে? আমরা আমাদের উপর মনোনিবেশ করি এবং তদন্ত ও যাচাই করি যে আমাদের মধ্যে পশু না হওয়ার কোন বৈশিষ্ট্য আছে কি না। তাই আমরা সেটাকে মোটামুটিভাবে তদন্ত করি। আর আমরা সনাক্ত করি যে আমাদের মধ্যে সেই স্বাধীনতা আছে কি না। আচ্ছা, এইভাবে তদন্ত ক’রে আমরা কী সনাক্ত করি? আমরা সনাক্ত করি যে আমরা শিখতে পারি এবং আমরা যোগাযোগ স্থাপনা করতে পারি, আমরা একটা পশুর চেয়ে আরও বেশি পরিশীলিত স্তরে কাজ করতে পারি। ঠিক? অতএব, সেরকম করুন। আর সেটা করুন ব্যক্তিগত ভাবে, শুধু কথায় নয়। আমরা দ্বিতীয় পর্যায় সম্পন্ন করলাম। মনে রাখবেন, এই শব্দগুলির অর্থ আছে। আমরা ঐভাবে বস্তু সনাক্ত করতে পারিঃ
- আমি শিখতে পারি
- আমি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি
- আমি একটা পশুর চেয়ে আরও বেশি পরিশীলিত স্তরে কাজ করতে পারি।
ঠিক আছে, অতএব আমরা একটা পশু না হওয়ার স্বাধীনতাকে সনাক্ত করেছি। এরপর আমরা খুবই সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করি এবং বুঝতে পারি যে যদি আমরা কখনো-কখনো পশুর মতো আচরণ করি, যেমন- আমাদের যৌন সম্পর্কের জন্য ডিস্কোতে যাওয়া, সম্ভাব্য সঙ্গীদের পিছনের অংশ শুঁকে নেওয়া, আর একরাতের জন্য সম্পর্ক স্থাপন করা, কিন্তু এসব করার জন্য আমরা বাধ্য হয়ে থাকি না। আমরা প্রভেদ করতে পারি এবং আমাদের আচরণকে পরিবর্তন ক’রে ফেলতে পারি। অতএব, আমরা ঐ মীমাংসাত্মক ধ্যানের উপর মনোনিবেশ করি যে আমরা একটা পশু নই। এগুলি আমাদের আচরণ প্রসঙ্গে একটা সূক্ষ্ম বিবরণ।
আমরা একজন সঙ্গীর সন্ধানে ঘোরাফেরা করি, আমাদের ঘরে মশা এবং আরশোলার শিকার করি অথবা অন্য যা কিছু করি না কেন আমরা বোঝার চেষ্টা করি যে, “আচ্ছা, আমি এইরকম আচরণ করতে পারি কিন্তু আমি প্রকৃতপক্ষে সেরকম করতে বাধ্য নই। আমি চাইলে পছন্দ করতে পারি। এটা আবশ্যক নয় যে আমাকে তেমন হতে হবে। আমি একজন মানুষ। অন্ততঃ আমি একজন পশু নই। অন্য কুকুরদের মতো আমাকে ঘেউ ঘেউ করার প্রয়োজন হয় না। যদি কেউ বলে যে আমাকে এই দৈর্ঘ্যের বস্ত্র ধারণ করতে হবে, ঐ দৈর্ঘ্যের নয়; আমাকে এই রকম চুল রাখতে হবে ঐ রকম নয়; আমাকে এই গানটি গাইতে হবে ঐ গানটি নয়, সেক্ষেত্রে আমাকে সেই অনুরূপ করার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা তো কোন পশু নই যে অন্যরা ঘেউ-ঘেউ করলে আমরাও ঘেউ-ঘেউ করতে লাগব।” আমরা এখানে একটি প্রাসঙ্গিক, সাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। যখন সবাই, “যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ” ব’লে চিৎকার করে তখন আমাদেরকেও “যুদ্ধ, যুদ্ধ” ব’লে চিৎকার করার কোন প্রয়োজন হয় না, তাই না? আমরা তো পশু নই যে অন্যরা ঘেউ-ঘেউ করলে আমরাও তার সাথে ঘেউ-ঘেউ করতে লাগব।
অতএব, আমরা এই সূক্ষ্ম বিশদের ভিত্তিতে বুঝতে পারি যে “আমরা সত্যিই একটা পশু নই।” আমরা ঐ ধরণের পশু নই যে কুকুরের মতো এক জায়গায় বসে থাকি এবং নিজের স্বামী যতক্ষণ পর্যন্ত না বলবে, “যাও এবং হাড়টা নিয়ে এসো,” আমরা অপেক্ষা করতে থাকব। আমাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা আছে।
ঐ সনাক্তীকরণ এবং বিচারকে বজায় রেখে বিশেষ ক’রে ঐ সনাক্তীকরণকে যে আমরা একটা পশু নই, আমরা পুনরায় যুক্তি-প্রণালী দ্বারা পরীক্ষা করিঃ
- আমরা যদি পশু হতাম তাহলে আমরা পুরোপুরিভাবে ধর্ম পালন করতে পারতাম না।
- আমাদের কাছে পশু না হওয়ার স্বাধীনতা আছে।
- অতএব, ধর্ম পালন করার জন্য আমাদের কাছে আছে মূল্যবান মানব জীবন।
তারপর আমরা অনুমান-জ্ঞানের উপর মনোনিবেশ করি এবং একটা মূল্যবান মানব জীবনের অধিকারী হিসাবে নিজেদেরকে উপলব্ধি করার উপর মনোনিবেশ করি।
অতএব, আপনারা এরকম করুনঃ
- আমরা যদি পশু হতাম তাহলে আমরা পুরোপুরিভাবে ধর্ম পালন করতে পারতাম না।
- আমাদের কাছে পশু না হওয়ার স্বাধীনতা আছে। আমরা সেটাকে উপলব্ধি করতে পারি।
- অতএব, ধর্ম পালনের জন্য আমাদের কাছে আছে মূল্যবান মানব জীবন।
- আর ঐ অনুমান-জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের কাছে একটা মূল্যবান মানব জীবন কেন আছে।
আচ্ছা, যেহেতু সেখানে আছে বিচার বা বিশ্লেষণ তাই এটাকে বলা হয় বিচার-ধ্যান। যেমনকি আমি বলেছি এটাকে সাধারণতঃ এটাকে বিশ্লেষণাত্মক ধ্যানরূপে অনুবাদ করা হয়। কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক শব্দটি তার পূর্ণ অর্থবোধ করায় না, করে কি? আর এখানে আমাদের কাছে রয়েছে প্রভেদমূলক সচেতনতা যা ধ্যান ভাবনা থেকে উদ্ভূত হয়। এটা খুবই সিদ্ধান্তমূলক কারণ আমরা এই বিষয়টাকে বুঝতে পারি যে আমাদের কাছে আছে এই মূল্যবান মানব জীবনটি এই উদ্দেশ্য বা ঐ উদ্দেশ্যের জন্য। আর আমরা সাবধানে সেটাকে যাচাই করি। আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের কাছে অবশ্যই এই কারণে বা ঐ কারণে সেটা আছে।
স্থির ধ্যান-সাধনা
ধ্যানের দুটি ধাপ আছে, বিশ্লেষণাত্মক এবং স্থির ধ্যান। স্থির ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র একটা মূল্যবান মানব জীবন লাভ করার বিশদ বিবরণকে সক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ না করেই তার উপর মনোনিবেশ করি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হল ‘সক্রিয়ভাবে’- বিশ্লেষণ না ক’রে যে, “এর কারণ হল আমি একটা পশু নই” এবং “আমি যদি একটা পশু হতাম তাহলে আমি ধ্যান-সাধনা করতে পারতাম না” ইত্যাদি। এইভাবে আমরা যা করি সেটা হল আমরা এই অনুভূতির উপর মনোনিবেশ করি যে আমাদের কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন। এখানে অনুভূতির অর্থ হল দৃঢ় বিশ্বাস- আমরা সত্যিই এটার উপর বিশ্বাস করি। আপনারা এটার উপরেই মনোনিবেশ করেন। এটা এর বিশদ বিবরণের বিশ্লেষণ করে না। এটাই দৃঢ় বিশ্বাস এবং অনুভূতি যে আমরা মূল্যবান মানব জীবন সম্পন্ন। অবশ্যই এটা ভিত্তি করে এটাকে বোঝা এবং উপলব্ধি করার উপর।
আসুন এক মুহূর্তের জন্য এটা করা যাক
এই ধরণের ধ্যান সাধনার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভুল-ত্রুটি এবং অসুবিধাগুলি থেকে মুক্তি পাই, যেমন- সময়ের অপব্যয়, আর এই ধরণের ধ্যান সাধনার মাধ্যমেই আমরা আমাদের মূল্যবান মানব জীবনকে উপলব্ধি ক’রে আমরা আমাদের ভাল গুণাবলী বিকাশ করি এবং এটাকে ধর্মের জন্য গঠনমূলক ভাবে ব্যবহার করি। যেহেতু, আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে কিছু বুঝি, তাই আমরা সেটাকে একীভূত করার চেষ্টা করি; আমরা সেটা অনুভব করি। এরফলে পরিবর্তন ঘটে কারণ এটা সমস্যার কারণগুলি নিবারণ করে আর ভাল গুণাবলী বিকাশ করে।
আমরা এটাকে না বুঝে কেবল শ্বাসের উপর মনোনিবেশ ক’রে এর তুলনা করতে পারি। যদিও এটা আমাদের শান্ত করতে পারে, তবে ঘুমিয়ে এবং ঘুমের ওষুধ সেবন করেও আমরা শান্তি লাভ করতে পারি কিন্তু এটা আমাদের সমস্যাগুলির অবসান ঘটায় না। অন্যদিকে, আমরা যদি বোধগম্যতা এবং বিশ্লেষণের সাথে শ্বাসের উপর মনোনিবেশ করি, যেমন- অনিত্যতা, ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মূর্ত নিয়ন্ত্রক অথবা প্রক্রিয়াটির অপসারণকারী পর্যবেক্ষক ইত্যাদি, তাহলে এটা আমাদের সমস্যাগুলির কারণ থেকে মুক্তি দেওয়ার কারণ হিসাবে কাজ করা শুরু করতে পারে।
ধর্মের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য এই বিশ্লেষণটি খুব, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের সমস্যার কারণগুলি থেকে মুক্তি প্রদান করে এবং আমাদের সম্ভাবনা, ইতিবাচক সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করায়।
বুদ্ধিগত, সজ্ঞাত, আভ্যন্তরীণ এবং আবেগগত ভাবে অনুভূত বোধগম্যতা
এবার আপনারা লক্ষ্য করবেন যে বিশ্লেষণাত্মক এবং স্থির ধ্যান-সাধনা উভয়ই হল ধারণাগত। আমরা এখানে যেটা বর্ণনা করেছি উভয়ই ধারণাগত জ্ঞান; তারা উভয়ই ধারণাগত। এই দুটিই একটা মূল্যবান মানব জীবনের অর্থ কী তার ব্যাখ্যা ধারণার উপর আধারিত। সেটাই ধারণাগত অর্থ- এটি একটি ধারণার ভিত্তিতে অস্তিমান। বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান একটি যুক্তি প্রণালীর উপর নির্ভর করে, কিন্তু স্থির ধ্যান কোন যুক্তি প্রণালীর উপর নির্ভর করে না। তবে উভয় ধ্যানই মূল্যবান মানব জীবনের অর্থ যে কী সেই মূল্যবান মানব জীবনের উপর মনোনিবেশ করে। অতএব, ধারণাটি হল একটি প্রতিনিধিত্ব। আমি যেটা বলতে চেয়েছি, সেটা হল ধারণার অর্থ কী? প্রশ্ন হল একটা মূল্যবান মানব জীবনের প্রতিনিধিত্ব। আমরা এটাকে শব্দ দিয়ে, একটা চিত্র অথবা একটি অনুভূতির মাধ্যমে উপস্থাপন করি। তবে ঐ প্রতিনিধিত্বের সাথে একটা অর্থ যুক্ত থাকে। শব্দ, চিত্র বা অনুভূতির সাথে যুক্ত থাকে একটা অর্থ।
আমি এই বিষয়টাকে উল্লেখ করছি কারণ প্রায়শই আমাদের মধ্যে ধ্যান-সাধনা সম্পর্কিত বৌদ্ধ-প্রণালী বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি দেখতে পাওয়া যায়। আর আমরা এটাকে বোঝার জন্য পাশ্চাত্য শব্দাবলী ব্যবহার করি, যেটা হল একটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া। প্রায়শই পাশ্চাত্য শব্দাবলীতে আমরা বুদ্ধিগত এবং স্বজ্ঞাত প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করি। তাই এখানে আমাদের বৌদ্ধ বিশ্লেষণে এটা কিসের অনুরূপ হবে?
- আমরা যদি কোন বস্তুকে শব্দ দিয়ে উপস্থাপন করি- শব্দের সমন্বয়ে একটা ধারণা- এবং শব্দের উপর ভিত্তি ক’রে কোন কিছুর উপর মনোনিবেশ করি, তাহলে আমরা সেটাকে বুদ্ধিগত প্রক্রিয়া বলব।
- কোন বস্তুকে একটি অনুভূতি বা একটা চিত্র দ্বারা উপস্থাপন করার সময়- একটি অনুভূতি বা একটা চিত্রের উপর ভিত্তি ক’রে- যদি তার উপর মনোনিবেশ করি তাহলে আমরা সেটাকে স্বজ্ঞাত প্রক্রিয়া বলব। তবে দয়া ক’রে লক্ষ্য রাখবেন যে আমরা শব্দ, চিত্র এবং অনুভূতি দ্বারা কিছু উপস্থাপন করি বা না করি উভয় ক্ষেত্রেই এই উপস্থাপনটি একটা সঠিক প্রতিনিধিত্ব বা ভুল প্রতিনিধিত্ব হতে পারে। এর কারণ হল, উভয়ই ধারণাগত, বুদ্ধিগত এবং স্বজ্ঞাত প্রক্রিয়া। উভয়ই হল ধারণাগত। আর উভয় ক্ষেত্রেই শব্দের অর্থ অনুভূতি বা চিত্র যা বোঝায় তার সঠিক বোধগম্যতা থাকা দরকার। আপনারা বুঝতে পারছেন তো?
তদুপরি, এই বোধগম্যতাকে আত্মসাৎ করার জন্য আমাদের এটাকে বিশ্বাস করতে হবে আর দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এর উপর মনোনিবেশ করতে হবে। একটা দৃঢ় বিশ্বাস। আমি মনে করি পাশ্চাত্য জগতে এটাকেই আভ্যন্তরীণ বা অন্তরঙ্গ বোধগম্যতা বলে। এই আভ্যন্তরীণ বোধগম্যতা যখন মূল্যাঙ্কনের মতো গঠনমূলক আবেগের সাথে যুক্ত হয়ে যায়- আমরা একটা মূল্যবান মানব জীবনের মূল্য এবং দুর্লভতাকে উপলব্ধি করি- তখন পাশ্চাত্য জগতে আমরা বলি যে আমরা আমাদের এই বোধগম্যতার কারণে আবেগগতভাবে প্রভাবিত হয়েছি।
এই কারণে একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে একটা সুষ্ঠু সম্পর্ক থাকার দুটো দিক রয়েছে, যার উপর ধ্যান সাধনা করা প্রয়োজন। একটা দিক হল গুরুর মধ্যে বিদ্যমান সদ্ গুণের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং অন্যটি হল তার দয়া ভাবনার উপলব্ধি। এখানে আমাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস আছে আর আমরা আবেগগত ভাবেও অনুপ্রাণিত। যখন আমাদের মধ্যে এই দুটিই রয়েছে তখন ঐ বোধগম্যতাটি শব্দের মাধ্যমে অথবা অনুভূতির মাধ্যমে লাভ হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না; সেখানে কোন পার্থক্য গড়ে তোলে না। সুতরাং আমরা পাশ্চাত্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে অথবা বুদ্ধিগত বা স্বজ্ঞাত দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করি না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং বোধগম্যতা আর উপলব্ধি আছে আমরা সত্যিই সেখানে পরিবর্তন ঘটাতে পারি। তবে সবসময় মনে রাখবেনঃ যতক্ষণ আমরা এই সংসারে আছি; পরিবর্তন অরৈখিক হয়ে থাকে; এবং সেখানে উত্থান এবং পতন ঘটতেই থাকে। এমন নয় যে প্রতিদিন সেটা ভাল থাকবে। দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতায় উন্নতি হতে পারে কিন্তু দিনে-দিনে, ঘন্টায়-ঘন্টায় এর উত্থান এবং পতন হতেই থাকে।
মনে রাখবেন, আমরা যখন একটি স্বজ্ঞাত পন্থা ইত্যাদি সনাক্ত করার চেষ্টা করি তখনও আমাদের বোধগম্যতা এবং বিশ্বাস লাভ করার জন্য একটি যুক্তি প্রণালীর উপর নির্ভর করার প্রয়োজন হয়। অন্যথায়, যদি আমাদের মধ্যে কেবল কোন কিছুর অনুভূতি থাকে তাহলে সেটা খুবই অসম্পূর্ণ এবং অস্পষ্ট হতে পারে। আর আমাদের সেটার সম্পর্কে বোধগম্যতা লাভ হবে না। তবে আমরা যদি কোন যুক্তি-পদ্ধতি ব্যবহার করি, আমরা যদি নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু উপলব্ধি করি, আমরা যদি সেগুলি বুঝি, আমাদের মধ্যে সেগুলির সংজ্ঞার জ্ঞান থাকে তাহলে আমরা সেগুলিকে নিজেদের মধ্যে সনাক্ত করতে সক্ষম হই ইত্যাদি। যদি আমরা বুদ্ধিগত প্রবৃত্তি সম্পন্ন সাধক হই তাহলে আমরা সেটাকে শব্দের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব ক’রে মনোনিবেশ করতে পারি। তাতে কিছু আসে যায় না, উভয়ই বৈধ হতে পারে, কারণ উভয়ই ধারণাগত। কিন্তু আমাদের চেতনাকে অধারণাগত হওয়ার ক্ষেত্রে- সেটা খুব, খুবই জটিল। সেটা হল কোন কিছুকে উপলব্ধি করা- উপলব্ধি করা যে আমাদের কাছে আছে একটা মূল্যবান মানব জীবন- এর সম্পর্কে কোন ধারণার মাধ্যমে, একটি অনুভূতির মাধ্যমেও নয় ইত্যাদি, বরং সোজাসাপ্টাভাবে। এটা খুবই কঠিন।
যদি আমাদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার থাকে তাহলে আমরা বুঝতে পারব আমরা হলাম বুদ্ধিগত অথবা স্বজ্ঞাত প্রাণী। তা সত্ত্বেও আমাদের অগ্রগতির জন্য ঐ গুলির বিষয়ে অবগত হওয়ার বৈধ প্রণালীর মধ্য দিয়ে যেতে হবেঃ আপনাদের কিছু শুনতে হবে আর অনুমান করতে হবে যে সেটা সত্য। তারপর আপনাদের সেটাকে বুঝতে হবে, সনাক্ত করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে; আপনাকে একটা অনুমানগত জ্ঞান লাভ করতে হবে। তারপরেই ঐ বিষয়ের উপর আপনার মনোনিবেশ করতে হবে। ঠিক আছে, এইভাবে আমরা ঐ পথ অনুসরণ ক’রে অগ্রগতি করতে পারি। এটা করা হয় শ্রবণ, চিন্তন এবং ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে। এটাই হল বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান-সাধনা।
এরজন্য সময় লাগে। সম্ভবতঃ এই বিষয়টা আপনারা এখন শুনেছেন। তারপর আপনাদের এর সম্পর্কে চিন্তন এবং মনন করতে হবে। এমনও হতে পারে বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান-সাধনার বিষয়ে আপনাদের মধ্যে অপূর্ণ জ্ঞান ছিল, তাই এখন আপনারা একটু বেশি পরিস্কৃত আলোচনা শুনেছেন। সুতরাং আপনাদেরকে এর বিষয়ে চিন্তন করতে হবে। সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে এরপর চিন্তন করতে লাগুন।
প্রশ্ন
আমি এই বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান সাধনার গুরুত্বকে বুঝেছি এবং এটাও বুঝেছি যে এটা গুরুর সাথে কীভাবে সম্পর্কিত, কিন্তু আমি যেটা বুঝিনি সেটা হল আমাদের কেন বলা হচ্ছে যে আমাদের পক্ষ থেকে গুরুকে কেন প্রশ্ন করা উচিত নয়। আর তারা যা বলেন এবং তারা যেভাবে আচরণ করেন আমাদেরকে সেগুলির কোন সন্দেহ অথবা প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিতে হবে?
বেশ, এটি বৌদ্ধধর্মের প্রকৃত শিক্ষা নয়। যদি গুরুর আচরণ বিনয় অর্থাৎ নৈতিক শিক্ষার বিপরীত হয় তাহলে আমাদেরকে সেটা দেখিয়ে দিতে হবে। আমাদেরকে তার সমর্থনে গেলে হবে না। গুরু যদি আমাদের নৈতিক শিক্ষার বিপরীত, সম্বরের বিপরীত কিছু বলেন তাহলে এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে যে আপনারা সেটা নিষেধ করতে পারেন।
আমরা যদি সূত্র এবং তন্ত্র শিক্ষার আরও গভীরে যাইঃ যদি গুরুর কথন তাঁর বচনের সাথে মিল না খায় তাহলে আমরা প্রশ্ন করতে পারি, “আমরা এটা বুঝতে পারিনি। এটা আপনার পূর্বের কথনের বিপরীত। আপনি কি এটা আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করবেন?” “এটা ঐ পাঠের বিরোধিতা করে। আপনি কি আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করবেন?” ইত্যাদি। এর কারণ হল অন্যান্য লোকজনদের মতো গুরুর মুখ থেকেও ভুল ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসে।
বুদ্ধের পূর্ববর্তী জীবনের বিশুদ্ধ উদাহরণের মতোঃ যখন একজন গুরু বুদ্ধ এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের বাইরে গিয়ে চুরি করতে বলেছিলেন তখন বুদ্ধ সেটা করেননি। তখন গুরু বুদ্ধকে প্রশ্ন করেছিলেন এবং উত্তরে বুদ্ধ বলেছিলেন, “চুরি করলে কার লাভ হতে পারে?” গুরু বলেছিলেন, “কেবল তুমিই এই পাঠের বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছ।” অনুত্তর তন্ত্রের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ীঃ আমরা যদি গুরুর মধ্যে মতবিরোধ দেখতে পাই এবং দেখি যে তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করছেন আর যখন আমরা গুরুকে প্রশ্ন করি এবং গুরু সেটা স্বীকার করেন না, গুরু সেটা পরিবর্তন করেন না ইত্যাদি- আমরা যদি এই সমস্ত দোষ দেখি, এমনকি আমরা যদি গুরুর কাছ থেকে তান্ত্রিক দীক্ষা প্রাপ্ত করে থাকি তাহলে আমাদের যেটা বলা হয় সেটা হল ঐ ধরণের গুরুর সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকতে হবে। ঐ ধরণের গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করা অথবা তার সাথে বসবাস করার কোন প্রয়োজন নেই। তবে আপনাদের মুখ বন্ধ রাখবেন। একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখবেন। গুজব ছড়াবেন না। আর ভাববেন না, “ওহ্, এই গুরুটি কী ভয়াবহ!” আমরা যা কিছু শিখেছি তার মূল্য বুঝতে হবে, নিজের গুরুর গুণকে আমাদের মানতে হবে এবং বাকী বিষয়গুলির প্রতি আমাদের সমতা বজায় রাখতে হবে।
আমরা যখন বলি তখন আমরা প্রশ্ন করি না এর অর্থ কী হয়। আপনারা এই বিষয়টাকে নিয়ে প্রশ্ন করেন না যে গুরুর মধ্যে তথাগতগর্ভ আছে- তাই আপনারা সন্দেহ করেন না- তবে এর অর্থ এই নয় যখন গুরুর উপদেশ অনুচিত বলে মনে হয়, তখন আপনারা তার উপর সন্দেহ করবেন না। আমরা যখন ঐ উদাহরণগুলি দেখি, যেমন- তিলোপা, নারোপাকে একটা উঁচু পাহাড় থেকে লাফ দিতে বলেছিলেন আর সেই মতো তিনি সেটা করেও ছিলেনঃ যেমনকি পরম পূজ্য দালাই লামা সবসময় বলেন, “ভাল ক’রে পরীক্ষা করুন।” তিলোপা এমন একজন গুরু ছিলেন এবং এমন একটি অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি জীবন্ত মাছ খেয়ে ফেলতেন, তাদের হাড়গোড় মাটিতে ছড়িয়ে রাখতেন, তুড়ি বাজাতেন আর সেই মাছগুলি আবার জীবিত হয়ে যেত। নারোপা ছিলেন তৎকালীন সবচেয়ে প্রকান্ড মঠাধ্যক্ষ। তাই আমাদের গুরু যদি তিলোপার স্তরে থাকেন এবং আমরা যদি নারোপার স্তরে থাকি তাহলে নারোপার জীবন কথার উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমরা সেই স্তরের না হই আর আমাদের গুরুও যদি সেই স্তরের না হন- যে স্তরের প্রায় সবাই আছে- তাহলে এটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, আমাদের সবসময় পরীক্ষা ক’রে দেখতে হবে। গুরু কী করছেন এবং সেটা কি ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? আর গুরু যে প্রবচন দিচ্ছেন সেটা কি ধর্মের অনুকূল? আমাদের সবসময় পরীক্ষা করতে হবে। যদি আমরা সেটা না জানি তাহলে পরীক্ষাই করতে হবে।
আমি একটা প্রথম স্তরের ছাত্র। আমি এই কেন্দ্রে শিক্ষার উদ্দেশ্যে একজন নবাগত এবং অবশ্যই আমি জানি যে আমার ভুল-ত্রুটি এবং জ্ঞানের অভাবে আমার এই অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু আমার পক্ষে পুনর্জন্ম এবং ধারাবাহিক জীবন কালের ধারণাটি মেনে নিতে খুব খুব কঠিন বলে মনে হচ্ছে। তবে আমি এটা বুঝতে পারছি যে বৌদ্ধশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, উদাহরণ স্বরূপ, আমি যখন আমার মূল্যবান মানব জীবনের উপর ধ্যান-সাধনা করি- যেটা আমি করেছি যতদূর গভীরে আমি যেতে চাই- সেটাকে আমি একটা উপহার হিসাবে, একটা সম্ভাবনা হিসাবে এবং একটা পরিবর্তনের সুযোগ হিসাবে দেখি। আমি জানি যে আমাকে ভবিষ্যতের জীবনগুলির উপর বিবেচনা করতে হবে যা আমার পক্ষে খুব খুবই কঠিন। তাই আমি অনুভব করি আমি যতই গভীরভাবে এবং বার-বার আমার মূল্যবান মানব জীবনের উপর ধ্যান-সাধনা করি না কেন তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ ভবিষ্যতের জীবনকে না বুঝে আমার মূল্যবান মানব জীবনের পূর্ণ উপলব্ধি সবসময় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অতএব, এটা আমার পক্ষে একটা উভয় সংকট। আমি কীভাবে এটার মোকাবিলা করতে পারি?
আপনার পর্যবেক্ষণটি একটা খুব ভাল পর্যবেক্ষণ। তন্ত্র-সম্বরের মধ্যে একটা সম্বর হল আমরা বোধিলাভ না করা পর্যন্ত আমাদের কোন জ্ঞানে তৃপ্ত হতে নেই। আর এর অর্থ হল ঐ পথ অনুসরণ ক’রে আমরা যত অগ্রগতি করব মূল্যবান মানব জীবন সহ প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে। তাই এখন যদি আমরা পুনর্জন্মকে বুঝেও যাই তাহলেও আমরা মূল্যবান মানব জীবনকে বোঝার ক্ষেত্রে আরও গভীরে যেতে পারি। প্রত্যেকটা পর্যায়ই লাভদায়ক, বিশেষ ক’রে আমরা যদি সবসময় মনে রাখি যে আমাদের মধ্যে এখন যে জ্ঞানের স্তর রয়েছে সেটা গভীর থেকে গভীরতর জ্ঞান লাভ করার প্রথম ধাপ। তাই এই নম্রতার সাথে এটাই উত্তম।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা খুবই স্পষ্টঃ কখনো মনে করবেন না যে আপনারা সেটাকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন। “ওহ্, এবার আমি বুঝে গিয়েছি। আমাকে মূল্যবান মানব জীবন সম্পর্কে আর ভাবতে হবে না।” এটা একটা বড় ভুল। আপনারা সবসময় গভীর থেকে গভীরতর স্তরে যেতে পারেন।
যেমন আপনি ব্যাখ্যা করেছেন মানুষ হিসাবে আমাদের মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা আছে। আপনি যেমন বলেছেন আমাদের মধ্যে ঘেউ-ঘেউ না করা এবং ঐ সমস্ত কাজকর্ম না করার বিকল্প আছে। কিন্তু যদি আমাদের মধ্যে এই বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা থাকে, এর মানে হল আমাদের মধ্যে কিছু সম্ভাবনা আছে, তাহলে ধরুন, আমরা যদি পশু হিসাবে পুনর্জন্ম গ্রহণ করি তখন আমরা সেই সম্ভাবনা গুলি কেন হারিয়ে ফেলি? এখানে আমি বলতে চেয়েছি যে এটা আমার কাছে অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত ব’লে মনে হচ্ছে যে আমাদের কাছে এখন যে বিশ্লেষণাত্মক সম্ভাবনা রয়েছে সেটা আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি, আমরা যদি পশুরূপে পুনর্জন্ম লাভ করি। সেখানে এমন কী ঘটে?
আপনাদেরকে একটা সম্ভাবনা এবং একটা প্রত্যক্ষ প্রকাশ ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। একটা শিশুর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা থাকে তারমধ্যে থাকে গাড়ি চালাতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু তার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা বাস্তবিক ক্ষমতা নেই। আমরা যখন অসুস্থ হই তখনও আমাদের মধ্যে পরিস্কারভাবে চিন্তা-ভাবনা করা, কাজ করা এবং আরও অনেক কিছুর সম্ভাবনা থাকে কিন্তু ঐ মুহূর্তে সেখানে একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যায়। ফলে ঐ সময় আমাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ক্ষমতা থাকে না। একইভাবে পশু হিসাবেও তাদের মধ্যে ক্ষমতা থাকে- তথাগত গর্ভের ক্ষমতা তখনও তাদের মধ্যে থাকে- কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রকাশ ক্ষমতা থাকে না (আর যদি থাকেও তবে সেটা মানুষের তুলনায় খুব নিম্নমানের হয়)।
উৎসর্গ
এটাকে একটা উৎসর্গের সাথে সমাপ্ত করা যাক। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আমরা এখানে শ্রবণ, ধ্যান সাধনা ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে যে ইতিবাচক শক্তি উৎপন্ন করেছি, আমরা যদি সেগুলিকে বোধিলাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ না করি, সেটা না করার ফলে যা ঘটবে সেটাকে এক ধরণের ভুল পরিস্থিতির মতো সাংসারিক পরিস্থিতি বৃদ্ধি করার কারণ হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের মূল্যবান মানব জীবনকে প্রচুর অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব। অতএব, বোধিলাভের কারণ হিসাবে কাজ করার জন্য আমরা প্রকৃতপক্ষে সেটাকে উৎসর্গ করি। আমরা বলি, “সকলের কল্যাণ করার জন্য সক্ষম হতে আমার এই কর্মটি বুদ্ধের মন, শরীর, বাক্ ইত্যাদি প্রাপ্ত করতে সক্ষম হওয়ার কারণ হয়ে ওঠে!” তারপরেই এটা বাস্তবে একটা কারণ হিসাবে কাজ করবে। আর “এই জ্ঞান এবং উপলব্ধি যেন আরও গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে যাতে বোধিলাভ পর্যন্ত সকলের কল্যাণ করার জন্য সক্ষম হতে আমার আচরণ ফলপ্রসু হয়!”