মার্গক্রম (লাম-রিম) অনুশীলনের জন্য ধ্যানের পরামর্শ

যদি বুদ্ধের শিক্ষাগুলি জীবনে অনুশীলন করতে চাই, তাহলে ধ্যান-সাধনা তারজন্য অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ধ্যান এমন কিছু নয় যেটা বিশেষ ক’রেই বৌদ্ধধর্মী। আমরা সমস্ত ভারতীয় পরম্পরার পাশাপাশি ভারতের বাইরেও অবৌদ্ধ ব্যবস্থায় ধ্যান দেখতে পাই।

সংস্কৃত ভাষায় ধ্যানের জন্য ‘ভাবনা’ শব্দ নির্ধারণ করা আছে। ভাবনা শব্দটি তৈরী হয়েছে ‘ভূ’ ধাতু থেকে যার অর্থ হল ‘হওয়া, (ভবতি)’ অথবা ‘কিছুকে অন্য কিছুতে পরিবর্তন করা’। অতএব, ভাবনা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করি যে সেইভাবে মনের একটি গঠনমূলক অবস্থা গড়ে তুলতে পারি এবং লাক্ষণিকভাবে আমরা সেই অবস্থায় পরিণত হয়ে যাই। অন্য কথায়, ধ্যান সাধনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে একটি বিশেষ লাভদায়ক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি।

যেহেতু ‘ভাবনা’ শব্দটি সংস্কৃত মূল ‘ভূ’ ধাতু থেকে তৈরী হয়েছে, ‘ভবতি’ রূপ থেকে, তাই ভাবনা শব্দ রূপান্তরকে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি মৈত্রীর উপর ধ্যান ভাবনা করি তাহলে তখন আমরা আসলে আমাদের হৃদয়ে মৈত্রীর সাথে নিজেকে রূপান্তরিত করি। যখন এই শব্দাবলীটি সংস্কৃত ভাষা থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, তখন এটাকে যে শব্দ দিয়ে অনুবাদ করা হয়েছিল তার অর্থ হল ‘অভ্যাস গড়ে তোলা’। এর তিব্বতী শব্দ হল ‘গোম’। ‘গোমের’ অর্থ হল কিছু ইতিবাচকে নিজেকে অভ্যস্থ করা, নেতিবাচক বা নিরপেক্ষ বস্তুতে নয়। এইভাবে এর অর্থ বোঝায় ইতিবাচক, গঠনমূলক অভ্যাস গড়ে তোলা।

তাই এর তিব্বতী শব্দটি সংস্কৃত শব্দের অর্থ অথবা নিহিতার্থে বেশ মিল আছে। উভয় পদের অন্তর্নিহিত অর্থ হল আমাদের লক্ষ্যের মতো হয়ে উঠতে নিজেকে রূপান্তরিত করার জন্য- একটা মৈত্রীময় হৃদয় বানানোর জন্য- আমাদের একটা লাভদায়ক অভ্যাস হিসাবে মৈত্রী উৎপন্ন করতে হবে। এই লাভদায়ক অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করি সেটা হল ধ্যান।

শিক্ষা শ্রবণ করা

বুদ্ধের সময়ের পূর্ববর্তী কালে যেগুলি প্রধান ভারতীয় দার্শনিক গ্রন্থ ছিল, সেগুলি হল উপনিষদ। ঐ গ্রন্থগুলির মধ্যে ইতিমধ্যে ধ্যান সাধনার বিষয়ে উল্লেখ করা আছে। উপনিষদগুলিতে ধ্যান সাধনাকে তিন-পদক্ষেপ প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা হয়েছেঃ শ্রবণ, চিন্তন এবং ধ্যান। বুদ্ধ কিন্তু এই তিন পদক্ষেপের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেননি; ইতিমধ্যে এগুলি তাঁর সময়ে প্রচলিত ছিল। অতএব, আমরা যদি কোন কিছুর প্রতি একটা ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলতে চাই অবশ্যই সর্বপ্রথমে আমাদের সেই বিষয় সম্পর্কে শ্রবণ করতে হবে; তারপর তার উপর চিন্তন-মনন ক’রে সেটাকে বুঝতে হবে; এবং অবশেষে সেটাকে নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করতে হবে।

আমরা যদি ধর্ম সম্পর্কে কিছু না জানি তাহলে সর্বপ্রথম আমাদের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য অর্জন করতে হবে আর আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে, ঐ তথ্যগুলি সঠিক। কেবল সঠিক মৌলিক তথ্যই একটা নির্ভরশীল ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে পারে, যাতে প্রকৃত ধর্মশিক্ষার প্রতি আগ্রহ জাগে। তবে বুদ্ধের সময়ে দার্শনিক শিক্ষাগুলি কখনোই লেখা হত না। সেগুলিকে লিখিত গ্রন্থরূপে সংকলন করা শুরু হয়েছিল শতাব্দী পরে। এই কারণেই এই তিন-পদক্ষেপের প্রক্রিয়া শুরু হয় “শ্রবণ” থেকে; অন্যকথায় উচ্চস্বরে প্রদত্ত শিক্ষাকে শ্রবণ করা।

আজ, আপনারা গ্রন্থ বা ইন্টারনেটে উপলব্ধ তথ্যকে পড়ার প্রথম পদক্ষেপে কিছু নির্দিষ্ট ধরণের অনুশীলন বা মানসিক অবস্থা, যা আপনারা বিকাশ করতে চান, অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এটা একটা বিবাদের বিষয় কারণ আমরা যখন একজন গুরুর কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষা শ্রবণ করি, তখন গুরু দ্বারা একটা বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যেখানে গুরু আমাদের সামনে উপস্থিত থাকেন। আমরা যখন একটি জীবন্ত বা সাক্ষাৎ শিক্ষা-বক্তৃতা শ্রবণ করি তখন আমরা গুরু দ্বারা এমনভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারি যেটা সম্ভবতঃ গ্রন্থ পড়েও হতে পারি না। যদিও এটাও বাস্তব তাসত্ত্বেও কাউকে গ্রন্থ রচনা করতেই হয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও সত্য প্রতীত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আপনারা যখন একটা লাইফ কনসার্ট-এ যান তখন বাড়িতে যে সিডি (CD)-টা শোনেন তার চেয়ে এই অভিজ্ঞতাটি বেশ প্রভাবশালী এবং অনুপ্রেরণাদায়ক হয়। এটা একটা বেশ আলাদা ধরণের অভিজ্ঞতা।

আমরা যখন শিক্ষা বা প্রবচন শ্রবণ করি তখন সবচেয়ে উপকারী নির্দেশাবলীর মধ্যে একটি হল “মাটির ফুলদানীর মতো তিনটি দোষ” দূর করাঃ

  • প্রথমতঃ, একটা উলটে রাখা ফুলদানীর মতো হওয়া থেকে নিজেকে এড়িয়ে যেতে হবে, যেখানে কোনকিছু প্রবেশ করতে পারে না। অন্যকথায়, আমাদের মন যদি বন্ধ থাকে তাহলে এটা স্পষ্ট যে, আমরা যা কিছু শ্রবণ করব সেটা থেকে কিছুই শিখতে পারব না।
  • এরপর, আমাদের এমন একটি ফুলদানীর মতো হওয়ার দোষ থেকে এড়িয়ে চলতে হবে যার নীচে একটা ছিদ্র থাকে। এই ক্ষেত্রে তার মধ্যে যা কিছুই ঢালা হোক না কেন সেটা ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ইংরেজীতে একটি অভিব্যক্তি আছে, “এক কান দিয়ে শোনে আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়।” আমাদের এটাও এড়িয়ে চলতে হবে।
  • সর্বশেষে, আমাদের একটি নোংরা ফুলদানীর মতো হওয়ার দোষ থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। আপনারা যখন নোংরা ফুলদানীতে পরিষ্কার জল ঢালেন সেই জলও নোংরা হয়ে যায়। অন্যকথায়, যখন আমাদের মধ্যে অনেক পূর্ব ধারণা থাকে তখন ঐ পূর্ব ধারণাগুলি নতুন উপাদান সম্পর্কে আমাদের নতুন বোধগম্যতাকে দূষিত ক’রে দেয়। অন্য ব্যক্তি যা বলে সেটাকে শ্রবণ করার পরিবর্তে আমরা সবসময় আমাদের নিজস্ব ধারণার সাথে নতুন উপাদান মিশিয়ে ফেলি।

এই ভুলগুলি এড়ানোর জন্য একবার যখন আমরা নির্দিষ্ট শিক্ষা শ্রবণ ক’রে ফেলি, সেগুলিকে কোনভাবে লিখে রাখা অথবা সেগুলিকে রেকর্ড ক’রে রাখলে খুবই উপকার হতে পারে, যাতে আমরা উল্লেখিত পয়েন্টগুলি সঠিকভাবে মনে রাখতে পারি। যদি আমাদের মধ্যে নিখুঁত স্মৃতিশক্তি না থাকে সেক্ষেত্রে এটা খুবই লাভদায়ক হয়। আমাদের মধ্যে অধিকাংশের মধ্যে সেটা নেই। আমরা যা কিছু শ্রবণ ক’রে থাকি সেগুলিকে লেখার জন্য যত দেরি করব তত বেশি আমাদের পূর্ব ধারণাগুলি আমাদের স্মৃতিশক্তিকে দূষিত ক’রে ফেলবে। আর আমরা যদি সেগুলিকে লিখে ফেলি বা রেকর্ডিং করেও ফেলি আমাদেরকে কিন্তু সেগুলিকে বার বার শুনতে হবে, কেবল আলমারীতে রাখা কোন ডাইরিতে, আমাদের কম্পিউটারের কোন ফাইলে অথবা আইপডে একটা নির্দিষ্ট ফাইলে রাখা মাত্রতে কোন কাজ হবে না।

সাক্য আচার্য সোনম চেমো বলেছেন যে, ধর্মের অনুশীলনে প্রবেশ করার জন্যঃ

  • প্রথমে আমাদের মেনে নিতে হবে আমাদের মধ্যে সমস্যা আছে এবং আমরা ভুগছি।
  • এরপর আমাদের মধ্যে ঐ দুঃখময় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা থাকতে হবে।
  • সর্বশেষে, ঐ দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ধর্মের প্রতি আগ্রহ জাগাতে হবে।

নব সাধকের অবস্থায় আমাদের অবশ্যই উন্মুক্ত মনের হতে হবে এবং আমরা যা কিছু শিখি সেটাকে ধারণ ক’রে রাখতে হবেঃ তবে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, আমাদেরকে শিক্ষার শ্রবণ করতে হবে আগ্রহ এবং উদ্দেশ্যের সাথে যাতে আমরা যা কিছু শ্রবণ করি সেটাকে মূল্যায়ন করতে পারি। আমরা এটাকে মূল্যায়ন করতে চাই যাতে আমরা যে শিক্ষাগুলি শ্রবণ করি, সেগুলি এমন কিছু কিনা, এবং যদি আমরা সেটাকে বাস্তবে অনুশীলন করি সেটা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে কিনা। আমরা স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বা আমাদের পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানদ্বারা অন্যদের প্রভাবিত করার জন্য বৌদ্ধশিক্ষাগুলি শ্রবণ করি না। আমরা শিক্ষাগুলি এই কারণে শ্রবণ করি যাতে আমরা তাদের মধ্যে কিছু খুঁজে পেতে পারি, যেটা ব্যক্তিগতভাবে প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের জীবনে সহায়ক হয়।

শিক্ষাগুলি শ্রবণ করার সময় নিজেদেরকে এবং পরিস্থিতিকে বিবেচনা করার বিভিন্ন উপায় আছে। “ত্রি-অভিজ্ঞান” নামে পরিচিত পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে একজন অসুস্থ ব্যক্তি অথবা রুগী হিসাবে, গুরু বা শিক্ষককে একজন চিকিৎসক হিসাবে এবং শিক্ষা বা উপদেশকে আমাদের বিভিন্ন রোগ বা সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার ঔষধ হিসাবে বিবেচনা করি। এখানে রোগ বলতে অশান্তকারী আবেগ বা ক্লেশকে বোঝায়।

আমাদের অনুশীলনে আমরা যেমন যেমন অগ্রগতি করি সেখানে গুরু বা শিক্ষকের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত আরও নির্দেশ থাকে, যেমন- গুরুকে বুদ্ধ হিসাবে দেখা ইত্যাদি, কিন্তু ঐ নির্দেশাবলীগুলি নব সাধকদের জন্য নয়।

আমরা যা শ্রবণ করে থাকি তার বিষয়ে চিন্তন

দ্বিতীয় পদক্ষেপটি হল আমরা যা কিছু শুনে থাকি তার বিষয়ে চিন্তন-মনন করা। আমরা কোন একটি শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তন-মনন করি যাতে আমরা সেটা বুঝতে পারি। আমরা যখন সঠিকভাবে বুঝতে পারি যে শিক্ষার অর্থটা কী তখন আমরা ঐ চিন্তন প্রক্রিয়ার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে যাই। একটি শিক্ষাকে সঠিকভাবে এবং বাস্তবে অনুশীলন করার জন্য আমাদের সেটাকে কেবল সঠিকভাবে বুঝলেই হবে না, তার সাথে-সাথে আমাদের নিশ্চিতও হতে হবে যে শিক্ষাটি বৈধ এবং এটি এমন একটি বিষয় যা আমাদের নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে, কারণ এটা আমাদের নির্দিষ্ট সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। আমাদের এই বিষয়ে নিশ্চিতও হতে হবে শিক্ষাটি যে বিষয় সংক্রান্তে আলোচনা করছে সেটা আমাদের পক্ষে বাস্তবে লাভ করা সম্ভব। আমরা যদি মনে করি সেটা অসম্ভব- উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি কখনোই আমাদের ক্রোধকে কাটিয়ে উঠতে না পারি, তাহলে ক্রোধকে দমন করার উদ্দেশ্যে কোন অনুশীলনকে অনুসরণ করার অর্থ কী হবে? তাই আমাদের নিশ্চিত হতে হবে নির্ধারিত অনুশীলনটি বর্ণিত লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

আমরা যখন কোন শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তন-মনন করি তখন আমরা সেটা অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে করি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি সকলের প্রতি সমানভাবে মৈত্রী বিকাশের উদ্দেশ্যে ধ্যান-সাধনার চর্চা করি, তাহলে সেই ধরণের মৈত্রী বিকাশের জন্য আমাদের যে সমস্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান থাকা দরকার। উদাহরণ স্বরূপ, সকলের জন্য সমান মৈত্রী ভাবনা কিসের উপর নির্ভর করে? এটা নির্ভর করে সকলকে সমানভাবে দেখা বা সমদর্শী ভাবনার উপর অর্থাৎ আমাদের ভাবতে হবে সকলেই আমার প্রতি সদয় হয়েছেন ইত্যাদি। অতএব, আমাদের মনে সার্বজনীন মৈত্রী বিকাশের জন্য আমাদের জানতে হবে মৈত্রী কিসের উপর নির্ভর করে এবং আমাদের মধ্যে মৈত্রী বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য আমাদের আগে থেকে কেমন অন্তর্দৃষ্টি এবং মানসিক অবস্থা বিকাশ করা প্রয়োজন।

তদতিরিক্ত, আমাদের এটাও জানতে হবে মৈত্রীর বিরোধী কারণগুলি কী যা মৈত্রী প্রতিকার করে। বিশেষভাবে, আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে ঐ বিরোধী কারণগুলি হল ক্রোধ এবং ঘৃণা; আর আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে মৈত্রী ঐ কারণগুলির উপর বিজয় লাভ করতে পারে এবং আমাদের সেগুলি থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমাদের এটাও জানতে হবে কীভাবে মৈত্রী আমাদেরকে তাদের থেকে মুক্তি প্রদান করে।

এছাড়াও আমাদের বুঝতে হবে, মৈত্রী বিকাশের উদ্দেশ্য কী এবং একবার এর বিকাশ করতে পারলে আমরা সেটা দিয়ে কী করব। এটা মৈত্রী বিকাশের লাভগুলিকে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন অনেক গ্রন্থ দেখি যা বোধিচিত্ত বিকাশের লক্ষ্য সম্পর্কে নির্দেশনা প্রস্তুত করে, সেগুলি সাধারণতঃ বোধিচিত্তের লক্ষ্য থাকার লাভগুলি বর্ণনার সাথে শুরু করে। বোধিচিত্ত বলতে সমস্ত প্রাণীদের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে আমাদের নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত অনাগত বোধিলাভের লক্ষ্যকে বোঝায়। গ্রন্থ রচনা করার সময় এইভাবে শুরু করার উদ্দেশ্য হল জীবনে এমন একটা লক্ষ্য থাকা যা আমরা বিকাশ করতে চাই এবং সেটার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।

অবশেষে, আমাদের শিক্ষার যুক্তির প্রতি বিশ্বাসী হতে হবে। সেগুলিকে যুক্তিসঙ্গত হতে হবে, সেগুলিকে কারণগত হতে হবে এবং পর্যায় ও শিক্ষার প্রকৃত বিবরণের পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলিকে অর্থবোধক হতে হবে।

এইরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলিকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের প্রথমে কী বিকাশ করতে হবে, কীভাবে আমাদের এই বা ঐ সমস্যাযুক্ত মনের অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে, বিপরীত কারণগুলি কী কী, যাদের থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে ইত্যাদি সেগুলি না বুঝেই একটা ধ্যান অনুশীলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে সেটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এর একটা উদাহরণ হলঃ “শ্রবণ করা হল নিজেদের মুখে খাবার দেওয়ার মতো; চিন্তন করা হল সেটাকে চিবানোর মতো।” আমরা যদি খাবারটাকে না চিবিয়েই গিলে ফেলার চেষ্টা করি তাহলে সেটা আমাদের গলায় বেঁধে যাবে। ঠিক তেমনই আমরা যদি শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তন-মনন না ক’রে ধ্যান-ভাবনা করার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের অসুবিধা হবে।

আমরা ঠিক কীভাবে আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি? চিন্তন প্রক্রিয়াটি হল আমি যেমন উল্লেখ করেছি যে বিভিন্ন বিন্দু সম্পর্কে চিন্তন করার কয়েকটি মুক্ত পদ্ধতি হতে পারে অথবা একবার যদি আমরা সেটা সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে সেটা হবে আরও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

আনুষ্ঠানিক চিন্তন প্রক্রিয়া

আনুষ্ঠানিক চিন্তন প্রক্রিয়ার অর্থ হল একটা যুক্তির লাইন অনুসরণ করা। আমরা যখন একটি নির্দিষ্ট মনের অবস্থা বিকাশ করতে চাই তখন আমাদের সেটাকে গড়ে তুলতে হয়। আমাদের মনের সেই অবস্থা গড়ে তুলতে হয় পর্যায়ক্রমে বা ধাপে-ধাপে। প্রায়শই, এই ধাপগুলি যুক্তির লাইনের ভিত্তিতে কাজ করাকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণ স্বরূপ, শিক্ষা একটা যুক্তির লাইনকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে যে, শিক্ষা অনিত্যতা সম্পর্কে একটি বোধগম্যতা গড়ে তোলে (হেতু এবং প্রত্যয়ের কারণে প্রভাবিত বস্তু মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হতে থাকে এবং একসময় তার অবসানও ঘটে); অথবা এটা এমন একটা যুক্তির লাইন অন্তর্ভুক্ত করে যা শূন্যতা সম্পর্কে একটি বোধগম্যতা জাগায় (সবকিছু অসম্ভব উপায়ে অস্তিমান)। তদনুরূপ, চিন্তন ক’রে এবং যুক্তির লাইনকে অনুসরণ ক’রে কাজ করার মাধ্যমে আমরা শুধু অনিত্যতা এবং শূন্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই না যে সেটা বৈধ, বরং ঐ যুক্তির লাইনগুলি অনিত্যতা এবং শূন্যতাকে সত্যরূপে বৈধভাবে প্রমাণও করে। শুধু তাই নয়, আমরা এই যুক্তির লাইনকে অনুসরণ ক’রে নিশ্চিতও হয়ে যাই যে আমরা অনিত্যতা এবং শূন্যতা সম্পর্কে একটা সঠিক এবং সিদ্ধান্তমূলক বোধগম্যতা বিকাশ করতে পারি। মনে রাখবেন, বিশ্বাসী হওয়াই হল চিন্তন প্রক্রিয়ার একটা অংশ।

বিকল্পভাবে আমরা মনের একটি নির্দিষ্ট অবস্থা গড়ে তুলতে পারি এবং সেটা অগত্যা যুক্তির লাইনের মাধ্যমে নয়, বরং পর্যায়ক্রমে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি একটা বোধিচিত্তের লক্ষ্য বিকাশ করতে চাই তাহলে আমরা সেটা সমতা বিকাশের মতো পর্যায়গুলিকে অনুসরণ ক’রে করতে পারি। আর তারপর প্রত্যেককে আমাদের পূর্ববর্তী জীবনের মা-রূপে মনে করা, মাতৃস্নেহের মমতাকে স্মরণ করা, তারজন্য কৃতজ্ঞতা বিকাশ করা ইত্যাদির মাধ্যমে করি। আমরা এই পর্যায়গুলি অনুসরণ ক’রে অনুশীলন করি যাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, এই ধাপগুলি অনুসরণ ক’রে আমরা একটা বোধিচিত্তের লক্ষ্যকে বিকাশ করার উদ্দেশ্যে পৌঁছতে পারি। এটা কিন্তু এখনও একটি চিন্তন প্রক্রিয়ার অংশ।

এছাড়াও আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে, এই চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে মনের প্রকৃত অবস্থাটি কেমন যেটাকে বিকাশ করার জন্য আমরা চেষ্টা করি। কয়েকটি ধ্যান আমাদের একটা নির্দিষ্ট বস্তুর উপর মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে, যেমন- একজন বুদ্ধ দৃষ্টিগোচরকৃত। একজন দৃষ্টিগোচরকৃত বুদ্ধের উপর ধ্যান করার জন্য আমাদের বুঝতে হবে যে এটা হল একটা মনোনিবেশী ধরণের ধ্যান আর এর লক্ষ্য হল একটি নির্দিষ্ট বস্তুর উপর মনোনিবেশ করা। যেমন- একটা ছোট, ত্রি-কোণীয়, আলো দিয়ে তৈরী জীবন্ত বুদ্ধ যা আমরা আমাদের সামনে আমাদের চোখের স্তরে কল্পনা করি।

অন্যদিকে, ধ্যান বিভিন্ন প্রকারের আছে যা একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা বিকাশের জন্য অনুশীলন করা হয়, যেমন- মৈত্রী। মৈত্রী এমন একটা বস্তু নয় যা আমরা মনোনিবেশ করি, বরং এটি মনের একটি অবস্থা, এক ধরণের মানসিক মনোভাব যা আমরা বিকাশ করি। অতএব, আমাদের জানতে হবে আমরা কেমন ধরণের ধ্যানের অভ্যাস করছিঃ আমরা কি একটা নির্দিষ্ট বস্তুর উপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি অথবা একটি মনের নির্দিষ্ট অবস্থা বিকাশের জন্য চেষ্টা করছি? আমরা কী সাধন করার চেষ্টা করছি?

উভয় ক্ষেত্রেই চোংখাপা প্রবলভাবে জোর দিয়েছেন যে আমাদের দুটো বিষয়ের সম্পর্কে জানতে হবেঃ

  • প্রথমত, আমাদের স্পষ্ট হতে হবে যে সেই বস্তুটি কী যেটাকে আমাদের মনে জাগাতে হবে। আমরা দৃষ্টিগোচরকৃত বুদ্ধের উপর ধ্যান সম্পর্কে অথবা মৈত্রীর উপর ধ্যান সম্পর্কে কথা বলি না কেন, সেই বস্তুটি কী যা আমাদের ধ্যানে আবির্ভাব হয়?
  • দ্বিতীয়ত, আমাদের জানতে হবে যে মন কীভাবে সেই বস্তুটিকে ধরে রাখে, কীভাবে সেটাকে উপলব্ধি করে।

আমরা যদি এই দুটি বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট না হই তাহলে আমরা কীভাবে মনের অবস্থা উৎপন্ন করতে পারব যা আমরা বিকাশ করতে চাই?

উদাহরণ স্বরূপ, করুণাঃ করুণা কিসের উপর লক্ষ্য স্থাপন করে? আবির্ভুত বস্তুটি কী? করুণার উপর ধ্যান করার সময় আমাদের মনে যে বস্তুটি আবির্ভাব হয় সেটা হল প্রাণী, দুঃখময় বিভিন্ন প্রাণী। আমাদের মন তাদের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে এবং তাদের সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট দিক আলাদা করে, যথা- তাদের দুঃখ এবং দুঃখের কারণ। মন কীভাবে ঐ বস্তুগুলিকে ধরে রাখে? এই প্রাণীরা তাদের দুঃখ এবং সেগুলির কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় কামনা এবং সেগুলিকে নিজের উপর ফলিভুত করতে চেষ্টা করার অভিপ্রায়ে মন এই বস্তুগুলিকে ধরে রাখে। এইভাবে আমরা যে নির্দেশাবলী শ্রবণ করেছি অথবা অধ্যয়ন করেছি সেগুলি সম্পর্কে চিন্তন করার মাধ্যমে আমাদের মনের যে অবস্থা বিকাশ করতে চাই সেটা খুব স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করতে এবং বুঝতে সক্ষম হই।

আমরা যদি বোধিচিত্তের উপর ধ্যান করার পরিকল্পনা করি তাহলে আমাদের ভাবতে হবে এবং খুবই স্পষ্ট হতে হবে যে এই ধরণের ধ্যানের সময় আমাদের মন কী করে। অধিকাংশ সাধক বোধিচিত্তকে করুণার সাথে গুলিয়ে ফেলে; তবে বোধিচিত্ত এবং করুণা এক নয়। বোধিচিত্ত হল মনের একটি অবস্থা যার আধার হল করুণা; কিন্তু শুধু অন্যরা দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার কামনার চেয়ে আরও বেশি বিকশিত হয়। সর্বপ্রথম আমাদের মৈত্রী এবং করুণার সেই ভিত্তি থাকা দরকার।

আমরা যখন আমাদের আসনে বসে বোধিচিত্তের উপর ধ্যান করি তখন আমরা কীসের উপর মনোনিবেশ করি? আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বোধির উপর মনোনিবেশ করি যা এখনও লাভ হয়নি কিন্তু তথাগতগর্ভের বিষয়গুলির উপর ভিত্তি ক’রে এবং ঐ বোধিলাভ করার জন্য প্রয়োজনীয় কঠোর পরিশ্রমের উপর নির্ভর ক’রে লাভ করা যেতে পারে। আমাদের তথাগতগর্ভের বিষয়গুলি হল মৌলিক গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্য যা আমাদের সকলের মধ্যে নিহিত আছে এবং যা আমাদের বুদ্ধ হতে সক্ষম ক’রে তোলে, যেমন- আমাদের মনের বিশুদ্ধ স্বভাব। আমরা শাক্যমুনি বুদ্ধের বোধির উপর মনোনিবেশ করি না। আমরা সাধারণতঃ কোন মূর্ত বোধির উপর মনোনিবেশ করি না, বরং আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত, হবু বোধির উপর মনোনিবেশ করি।

আমরা আমাদের হবু বোধির উপর কীভাবে মনোনিবেশ করি? এটা খুবই সহজ নয়। প্রথমতঃ আমাদের বুঝতে হবে যে এর অর্থ কী, এটা কেমন ধরণের ধর্ম বা বস্তু- এটা একটা হবু ধর্ম বা বস্তু। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের বিবেচনা করতে হবেঃ হবু অঙ্কুরটা কি ইতিমধ্যেই বীজের মধ্যে অস্তিমান থাকে যেটা শুধু বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে? না কি বীজ অবস্থায় অঙ্কুরটা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন থাকে?

স্পষ্টতই, আমরা যখন হবু বোধির উপর মনোনিবেশ করি তখন আমরা যার উপর মনোনিবেশ ক’রে থাকি সেটার সম্পর্কে সত্যিই একটা স্পষ্ট বোধগম্যতা লাভ করার জন্য এখানে শূন্যতার বোধগম্যতার প্রয়োজন হয়। আমাদের হবু বোধি কোথাও বসে নেই, যেমন- একটা দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ সীমানা যার দিকে আমরা দৌড়ে এগিয়ে যাই। কিংবা এটা আমাদের মনে বা আমাদের তথাগতগর্ভে কোথাও বসে নেই যা উদ্ভূত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা সেটার মতো সেরকম কোন সন্ধানযোগ্য বস্তু নয়। অন্যদিকে, আমরা এমন কিছুর উপর মনোনিবেশ করি না যার কোন অস্তিত্বই নেই, আমরা অনস্তিমান কিছুর উপরে মনোনিবেশ করি না। এর পরিবর্তে, আমাদের বুঝতে হবে যে আমাদের হবু বোধি হল এমন কিছু যা আমাদের তথাগতগর্ভের বিষয়গুলির উপর ভিত্তিতে আমাদের চিত্ত-সন্ততিকে বৈধভাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আমাদের এটাও জানতে হবে কোনকিছুর জন্য উপযুক্ত ভিত্তিতে বৈধভাবে আখ্যায়িত হওয়ার অর্থ কী?

তবে, ঐ হবু বোধির উপর মনোনিবেশ করার জন্য আমাদেরকে আমাদের মনে আবির্ভূত বোধির একধরণের মানসিক উপস্থাপনার মাধ্যমে মনোনিবেশ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা “বোধি” শব্দের আওয়াজকে কল্পনা করতে পারি অথবা আমাদের সামনে একজন বুদ্ধকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে পারি। তন্ত্র অনুযায়ী, আমরা নিজেদেরকে বুদ্ধ-মূর্তিরূপে দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে পারি। এই দুটি উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের মনে হবু বোধির উপস্থাপনারূপে আবির্ভূত মানসিক শব্দ অথবা মানসিক চিত্রকে মনে করতে পারি।

এরপরে আমাদের মন কীভাবে এই মানসিক বস্তুর উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে যা আবির্ভূত হয়? দুটি উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি ক’রে আমাদের মনে আবির্ভূত মানসিক বস্তু দ্বারা প্রদর্শিত বোধির উপর মনোনিবেশ করি। প্রথম উদ্দেশ্যটি হলঃ “আমি বোধি লাভ করব।” এখন, বোধিলাভের এই উদ্দেশ্যটি বজায় থাকাটা আরও অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে যা আমাদের চিন্তা করা এবং বোঝা দরকার। বোধিলাভের জন্য যা করতে হবে সেটা আমাদের আগে বাস্তবসম্মত ভাবে জানতে হবে। আমাদের মনোভাব কখনও কেবল আকস্মিকভাবে জাগতে পারে নাঃ “ওহ্‌, আমি এটা লাভ করতে চলেছি এবং নিশ্চিত হতে হবে আমরা সেটা লাভ করতে পারি।” বোধি-অবস্থা লাভের জন্য আমাদের একটা বৈধ উদ্দেশ্য থাকা দরকার; অন্যথায় এটা লাভ করা কেবল একটা সুন্দর স্বপ্ন হয়ে থাকে। আর অবশ্যই, আমাদের সঠিকভাবে বুঝতে হবে বোধি বলতে আসলে কী বোঝায়, যেটাকে আসলে বোঝা খুব সহজ নয়। এই প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ চিন্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা এই সমস্ত উপলব্ধি অর্জন করি।

এই মানসিক উপস্থাপনার উপর মনোনিবেশ করার সময় আমাদের কাছে যে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি থাকে সেটা হল, বোধিলাভের মাধ্যমে আমরা যতদূর সম্ভব পরকল্যাণ করব। সর্বোপরি, বোধিলাভের অর্থ একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হওয়া নয়। আর অবশ্যই, প্রত্যেকের কল্যাণ করতে সক্ষম হওয়াটা নির্ভর করে বোধিচিত্তের ভিত্তি স্থাপনের পূর্ব পদক্ষেপের উপর, যেমন- মৈত্রী এবং করুণা। এর অর্থ হল আমরা অন্যদেরকে বোধি লাভ করার দায়িত্ব গ্রহণ করি, কারণ আমরা কামনা করি তারা যেন সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে সুখে সমৃদ্ধ হয়ে যায়।

আসলে এই চিন্তন ধাপটি হল একটা বেশ দীর্ঘ পদক্ষেপ আর এরজন্য অনেক পরিশ্রমের প্রয়োজন। তবে, এই ধাপের শেষে আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে এবং সম্পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বুঝতে পারি আর জানতেও পারি যে মনের অবস্থাটি কেমন যা আমরা অর্জন করার চেষ্টা করি আর সেই মানসিক অবস্থা গড়ে তুলব কীভাবে। আমরা সম্পূর্ণভাবে এবং বৈধভাবে নিশ্চিত হয়ে উঠি যে আমরা সেই মনের অবস্থা বিকাশ করতে সক্ষম এবং সেটা বিকশিত হলে অত্যন্ত লাভদায়ক হবে।

যদিও এই চিন্তন প্রক্রিয়াটি ধ্যানের মতো মনে হয় তবে, পরম্পরাগত সংজ্ঞা অনুযায়ী এটা ধ্যান নয়। যে সমস্ত পাশ্চাত্য লোকজন একেবারে সঠিকভাবে শব্দাবলীটি ব্যবহার করেন না তারা হয়তো এই চিন্তন প্রক্রিয়াটিকে ধ্যান বলতে পারেন, কিন্তু এটা সঠিক নয়। চিন্তন এবং ধ্যানের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট হতে হবে।

এই চিন্তন প্রক্রিয়াটি একটি অত্যন্ত সার্থক কার্যকলাপ এবং শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তন করা বিষয়টা এমন কিছু যা আমরা যেকোন সময়ে করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকি তখন এটা করা অত্যন্ত উপকারী জিনিস। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন ট্রাফিকে আটকে পড়ি তখন আমরা একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তন করতে পারি, যেমন- এইরকম পরিস্থিতিতে মৈত্রী ভাবনা প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এটা কীভাবে প্রাসঙ্গিক হবে? এর লাভ কী হবে ইত্যাদি? এইগুলি হল সেই পয়েন্ট যেগুলি সম্পর্কে আমরা আমাদের দিনের বেলায় চিন্তন করতে পারি।

ধ্যান

এবার আমরা আমাদের তিনটি পদক্ষেপ প্রক্রিয়ার তৃতীয় পর্যায়ে এসেছি অর্থাৎ ধ্যানের বিষয়ে। ধ্যান হল খাবারকে হজম করার মতো যেটাকে আমরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। ধ্যানের উদ্দেশ্য হল মনের একটি নির্দিষ্ট ইতিবাচক অবস্থাকে অভ্যাস হিসাবে গড়ে তোলা। বাস্তবে সেই মানসিক অবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে ওঠার জন্য আমরা সে অবস্থা সম্পর্কে চিন্তন করি এবং বুঝতে পারি আর নিশ্চিত হই যে, আমরা সেটা বিকাশ করতে পারি।

প্রাথমিকভাবে, ধ্যান হল একটি দ্বিগুণ প্রক্রিয়া। এর একটা ধাপ হল প্রভেদমূলক ধ্যান যেটাকে আমি এইভাবে অনুবাদ করি। এটা সাধারণতঃ “অ্যানালিটিক্যাল বা পরীক্ষামূলক বা বিচার ধ্যান” রূপে অনুবাদ করা হয়। কিন্তু অ্যানালিটিক্যাল বললে সেখানে চিন্তন ধাপের সাথে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই আমি মনে করি “ডিসার্নিং” শব্দটি এই শব্দাবলীটির জন্য সঠিক অনুবাদ। এই প্রেক্ষাপটে “বিচার” করার অর্থ হল খুব সাবধানে কোন বস্তুকে পরীক্ষা করা এবং একটা নির্দিষ্ট উপায়ে সেটাকে বোঝা। ধ্যানের দ্বিতীয় দিকটি হল “স্থাপিত ধ্যান” যেখানে আমরা প্রকৃতপক্ষে মনের সেই অবস্থায় স্থাপিত হই এবং তার উপর মনোনিবেশ করি। আমরা এই দ্বিতীয় পর্যায়টিকে “স্থির ধ্যান” বলতে পারি।

আমরা কীভাবে প্রথম ধাপে “বিচার ধ্যান”, সম্পন্ন করব? চিন্তন প্রক্রিয়া চলাকালীন আমরা একটি যুক্তির লাইনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকি অথবা মনের একটি নির্দিষ্ট অবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমরা পর্যায় এবং ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হই। আমরা একটি বোধগম্যতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সেটা ক’রে থাকি আর ঐ বোধগম্যতাটি হল আমাদের মানসিক অবস্থা কেমন যা আমরা বিকাশ করতে চাই। এছাড়া আরও একটি বোধগম্যতা আছে যেটা আমরা বিকাশ করতে চাই সেটা হল, আমরা কীভাবে বিকাশ করতে পারব। কিন্তু এখন আমরা বাস্তবে মনের সেই অবস্থাটি উৎপন্ন করার জন্য এবং আমাদের মধ্যে সেটাকে নতুন ক’রে জাগানোর জন্য সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। উদাহরণ স্বরূপ, সকলের করুণা উৎপন্ন করার জন্য আমরা এই যুক্তির লাইন অনুসরণ করিঃ “প্রত্যেকেই আমার মা হয়েছেন, প্রত্যেকেই আমার প্রতি সদয় হয়েছেন ......” ইত্যাদি। যাতে আমরা প্রকৃতপক্ষে মনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারি এবং বাস্তবে সেটা অনুভব করতে পারি।

একবার যদি আমরা এই প্রক্রিয়ায় ধাপে-ধাপে মনের যে অবস্থায় নিজেদের অভ্যস্ত করতে চাই তারজন্য কাজ ক’রে ফেলি, তাহলে আমরা সক্রিয়ভাবে মনোনিবেশ্য বস্তুটি প্রভেদ করতে পারি অথবা বুঝতেও পারি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি করুণার উপর ধ্যান করি তাহলে সমস্ত প্রাণীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি এবং বিশেষ ক’রে এই বিশদটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি যেখানে আমরা তাদের বিভিন্ন বিষয় আলাদা করি, যেমন- তাদের সমস্যা এবং দুঃখ। আমরা প্রভেদ করি তারা দুঃখে পীড়িত এবং আমরা কামনা করি যে তারা যেন দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। আর সেই দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ওতপ্রোত হই। বাস্তবে আমরা আমাদের মনের মধ্যে তাদের এইভাবে দেখি অথবা এটা বাস্তব জীবনেও হতে পারে, যখন আমরা বাস্তবে লোকজনদের দেখি। করুণা অন্যদের এবং তাদের দুঃখের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করে। আর এর অর্থ হল তারা দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়ার কামনা।

আমরা কিছু সময়ের জন্য একটি সক্রিয় প্রক্রিয়ার মধ্যে সেই বিচার শক্তির সাথে থাকি। পরবর্তীকালে, মূলতঃ স্থাপিত ধ্যান হল আমরা যেটা বিচার করি সেই বিষয় বা মানসিক অবস্থার প্রতি পূর্ণ একাগ্রতা সহ ডুবে যাওয়া। স্পষ্টতই আমরা যখন বিচার ধ্যান পর্বটি অনুশীলন করি তখন আমাদের মধ্যে একাগ্রতা থাকা প্রয়োজন হয়, কিন্তু স্থাপিত ধ্যান পর্বে আমরা আমাদের অনুভূতিকে আমাদের হৃদয়ে গভীর ভাবে ডুবে যেতে দিইঃ আমরা প্রবলভাবে করুণা অনুভূতি করি। আমরা বিচার এবং স্থাপিত ধ্যান, সামনে এবং পিছনে, ধ্যানের এই দুটি পর্যায়কে পরিবর্তন করি। আর অবশেষে আমরা সেগুলিকে একীভূত করতে সক্ষম হই। বিচার ধ্যান এবং স্থাপিত ধ্যানের পর্যায়কে একীভূত করা খুবই কঠিন। যে ধাপগুলির মাধ্যমে আমরা এই দুটি ধ্যানকে একীভূত করি সেগুলির আলোচনা অত্যন্ত জটিল। আপনারা যদি বিস্তারিত কিছু জানতে চান তাহলে আপনারা আমার ওয়েবসাইটে সেটার সম্পর্কে আরও অধ্যয়ন করতে পারেন।

এছাড়াও আমরা যদি আরও বেশি উন্নত হয়ে যাই তখন আমাদের সেই কাজটা করার প্রয়োজন হয় না যেটাকে বলা হয় “শ্রমিক ধ্যান”। শ্রমিক ধ্যান বলতে এমন একটা ধ্যানকে বোঝায় যেখানে বিচার ধ্যান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যায়গুলি অতিক্রম করা এবং মনের অবস্থা গড়ে তোলা যুক্ত। একটা উন্নত স্তরে আমরা অ-শ্রমিক বিচার ধ্যান অনুশীলন করতে সক্ষম হই। পর্যায়ক্রমে বা যুক্তির লাইনের মাধ্যমে সেটা গড়ে না তুলেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মনের কাঙ্খিত অবস্থা বিকাশ করতে সক্ষম হই। তবে মনোনিবেশের বিষয়কে বিচার করার জন্য আমরা তখনও মনের সেই অবস্থা ব্যবহার করি, যেমনটি আমরা বিচার ধ্যান অনুশীলন করার সময় পরিশ্রম করেছিলাম।

ধ্যানের ভাগ

আমরা প্রায়শই দু-রকমের ধ্যানের কথা শুনে থাকি। সেগুলির জন্য ব্যবহৃত শব্দগুলি হল “শমথ” এবং বিপশ্যনা/বিদর্শন” যা তিব্বতী ভাষায় বলা হয় “শিনে” এবং “ল্‌হাগথোঙ্‌”। এই দুটি শব্দ আসলে মনের দুটি অবস্থাকে বোঝায় যা আমরা ধ্যান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে লক্ষ্য নির্ধারণ করি। শমথ হল মনের একটি শান্ত এবং স্থির অবস্থা। এটি এই অর্থে স্থির যে এর সাহায্যে আমরা সর্বস্তরের মানসিক নিস্তেজতা এবং মনের উড়ন্ত ভাব বা মানসিক কোলাহল (একটা মন যা কোন আকর্ষনীয় বস্তুর দিকে উড়তে থাকে) শান্ত করতে পারি। শমথ এই অর্থে স্থির যে এর কেন্দ্রবিন্দু একটা বস্তুর উপর দৃঢ়ভাবে স্থির হয়। তারপর ধ্যানকে স্থির করার উপর জোর দেওয়া হয়।

আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, একটা দৃশ্যায়ন বুদ্ধ মূর্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ ক’রে আমাদের মনের শান্ত এবং স্থির অবস্থাকে বিকাশ করতে পারি। এর সম্ভাবনার একটি দীর্ঘ তালিকা আছে।

এমনকি শমথ ধ্যানের মাধ্যমে আমাদের নির্দেশাবলী শোনার প্রয়োজন হয় এবং তারপর ধ্যানের পর্যায় সম্পর্কে ভাবতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি একটি বুদ্ধ মূর্তিকে দৃষ্টিগোচর করি তাহলে আমরা ধাপে-ধাপে কীভাবে দৃষ্টিগোচর গড়ে তুলতে হয় তার সম্পর্কে নির্দেশাবলী শুনি। তারপর আমরা প্রথমে, দ্বিতীয় ধাপে ইত্যাদিতে কী করব সেটা নিয়ে ভাবি।

 “বিপশ্যনার” অর্থ হল একটি ব্যতিক্রমী অনুভূতিশীল মনের অবস্থা। এটি মনের একটি অবস্থা যা একটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী উপায়ে বস্তুকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বিপশ্যনা-ধ্যানটি পরীক্ষামূলক বা বিচার ধ্যানের উপর জোর দেয়। আমরা যখন বিপশ্যনার অবস্থা লাভ করার কথা বলি তখন এটি একটি ব্যতিক্রমী উপলব্ধিমূলক মনের অবস্থারূপে লাভ করা যেতে পারে। এটি অনিত্যতা বা শূন্যতাকে বিচার করে কিন্তু এটা কেবল এই দুটির মধ্যে একটা নয়। অনুত্তরযোগ তন্ত্রে অর্থাৎ সর্বোচ্চ তন্ত্র অনুযায়ী বিপশ্যনাকে বিকশিত করার একটি পদ্ধতি আছে, এই ব্যতিক্রমী উপলব্ধিশীল মনের অবস্থা হল নাকের ডগায় একটি ছোট্ট বিন্দুকে বা ফোঁটাকে কেন্দ্রিভূত ক’রে করা হয়। তারপর সেই বিন্দুর কেন্দ্রবিন্দুকে বজায় রাখার সময় আপনাকে পরের সারিতে দুটি বিন্দু কেন্দ্রিভূত করতে হয়, তারপর চারটি, আটটি, ষোলটি, বত্রিশটি ইত্যাদি। আপনাকে অবশ্যই সেগুলিকে নিখুঁতভাবে রাখতে হবে এবং তারপর ধাপে ধাপে আপনার দৃশ্যায়নকে দ্রবীভূত করতে হবে। এই ধরণের দৃশ্যায়নকে অনুশীলন করার মাধ্যমে আপনি একটি তীক্ষ্ণ এবং ব্যতিক্রমীভাবে উপলব্ধিশীল মনের অবস্থা বিকাশ করতে পারেন। আপনি যদি সত্যিই এই মনের অবস্থাটিকে একটি উচ্চস্তরে বিকাশ করতে চান তাহলে এরকম অন্যান্য সাধনা আছে যেখানে আপনি প্রতিটি ফোঁটায় সমস্ত বিবরণসহ সম্পূর্ণ মন্ডলকে কেন্দ্রিভূত করতে পারেন, যার বিষয়ে আপনি সাধনা করছেন। আপনি যদি এটা সম্পন্ন করেন তাহলে আপনার মধ্যে সত্যিই একটি ব্যতিক্রমী উপলব্ধিমূলক মানসিক অবস্থা গড়ে উঠবে।

শমথ এবং বিপশ্যনা, এই দুই ধরণের ধ্যান সমস্ত বৌদ্ধ পরম্পরার সাথে-সাথে অ-বৌদ্ধ ব্যবস্থায়ও বিদ্যমান আছে। থেরবাদ বৌদ্ধ পরম্পরায় এগুলি পালি শব্দাবলীতে ‘সমথ’ এবং ‘বিপস্‌সনা’ নামে পরিচিত। এই দুটি আমরা জেন ব্যবস্থায়ও দেখতে পাই। উদাহরণ স্বরূপ, সোন বৌদ্ধধর্মে, যেটা হল জেনের কোরিয়ান, সেখানে একটা কোয়ান (ধাঁধা) আছেঃ “এটা কী?” আমরা যখন দৃষ্টিনিবদ্ধ করি যে এটা কী, তখন বিষয়টার অর্থ এই হয়ে দাঁড়ায় না যে সেখানে একটা উত্তর আছে, যেমনঃ “এটা একটা টেবিল; এটা একটা গ্লাস ইত্যাদি, ইত্যাদি। এর পরিবর্তে আমরা গভীর সন্দেহের অবস্থায় থাকার জন্য মনকে বিকাশ করি অর্থাৎ সবসময় “এটা কী?”, এর বাস্তবতা সম্পর্কে প্রশ্ন করি। তারপর আমরা মনের অবস্থা সম্পর্কে ব্যতিক্রমীভাবে উপলব্ধিযোগ্য হয়ে উঠি।

একটা মজার গল্প আছে। গল্পটা বোঝায় যে অধিকাংশ তিব্বতী আচার্যরা জেন পরম্পরাকে অধ্যয়ন করেননি; তারা এই বিষয়ে অপরিচিত। একজন জেন আচার্যের সাথে কালু রিনপোছের একটি বিখ্যাত বৈঠক হয়েছিল। জেন আচার্য একটা কমলালেবু ধরে কালু রিনপোছেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এটা কী?” কালু রিনপোছে তাঁর অনুবাদকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার বলতো, ওঁদের দেশে কি কোন কমলালেবু নেই?”

এইভাবে আমাদের কাছে আছে সমতা এবং বিপশ্যনা। সমতা একটা নিখুঁত সমাধি নয়, যা বিভিন্ন ধরণের মনোযোগ ইত্যাদি প্রয়োগ ক’রে নয়টি পর্যায়ের মাধ্যমে বিকশিত হয়। তবে নিখুঁত সমাধি ছাড়াও শমথ একটি “মনের উচ্ছ্বসিত অবস্থা” নামে পরিচিত। “যোগ্যতার অনুভূতি” হল প্রকৃতপক্ষে একটা ব্যবহৃত শব্দাবলী। নিখুঁত সমাধি ছাড়াও সেখানে একটি যোগ্যতার অনুভূতি থাকে যেটা হল একটি শারীরিক এবং মানসিক উচ্ছ্বসিত অবস্থা। “যোগ্যতার অনুভূতি” হল নিখুঁতভাবে প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদ অনুরূপ।

আমার গুরু চেনশাব সেরকোঙ্‌ রিনপোছে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, শমথ সদৃশ মনের অবস্থা হল একটি জাম্বো জেট (প্লেন) থাকার মতোঃ আপনি যদি এটাকে মাটিতে রাখেন তাহলে এটা সেখানে থাকবে আর আপনি যদি এটাকে হাওয়ায় উড়তে পাঠিয়ে দেন তাহলে এটা উড়তে চলে যাবে। তাই সেখানে একটা অর্থ আছে যে আপনি যেকোন সময়ের জন্য যেকোন বিষয়ের উপর মনোনিবেশ করতে পারেন। শরীর ক্লান্ত হবে না; মন ক্লান্ত হবে না; আপনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ অনুভব করবেন; এবং এটা আনন্দদায়ক হতে থাকবে। শমথ একটি অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত, উত্থানকারী এবং আনন্দদায়ক মনের অবস্থা। তবে এটা তেমন আনন্দদায়ক নয়। যেমন- রাস্তায় রাস্তায় গান গাওয়া, সিনেমায় নাচ করার ফলে আনন্দ জাগে, এটা সেরকম নয়। একজন অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদের মতো শমথর কারণে মন সম্পূর্ণভাবে সজ্জিত হয়।

এটা স্পষ্ট করা গুরুত্বপূর্ণ যে বিপশ্যনার একটি মনের অবস্থা হল শমথ অবস্থার অতিরিক্ত অবস্থা। নিখুঁত সমাধি এবং শমথর যোগ্যতার অবস্থা ছাড়াও বিপশ্যনা তার উপরে যোগ্যতার দ্বিতীয় অনুভূতিটি মনের এমন একটি অনুভূতি যুক্ত করে যেটা যেকোন কিছুকে বোঝা এবং উপলব্ধি করার জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও আরও এক ধরণের ধ্যান আছে যাকে অবলোকন ধ্যান বলা হয়। আমরা যখন একটি নির্দিষ্ট ধ্যান অনুশীলন করি তখন আমাদের প্রতি মুহূর্তে সম্পূর্ণ বৌদ্ধপথ পর্যালোচনা করতে হয়। এর উদ্দেশ্য হল আমাদের নিজেদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে আমাদের নির্দিষ্ট ধ্যানের বিষয় সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ছবিতে কোথায় উপযুক্ত, যাতে আমরা একটা বিষয়কে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে অন্যটিকে এড়িয়ে যাই বা অবহেলা না করি। অতএব, অবলোকন ধ্যান হল সম্পূর্ণ পথকে পর্যালোচনা করা; একধরণের পর্যালোচনা।

অনেক বছর আগে আমি ডঃ তেনজিন ছোডাকের সাথে মস্কোতে এসেছিলাম। তিনি পরম পূজ্য দালাই লামার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। আমরা চেরনোবিল বিকিরণ ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করার জন্য তিব্বতী ওষুধ ব্যবহার করার একটা প্রকল্পে কাজ করছিলাম। আমরা একটা সুন্দর হোটেলে ছিলাম এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের আধিকারিকদের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরক্ষিত ছিলাম। প্রায়শই খাওয়া-দাওয়ার জন্য আমাদের বিখ্যাত রাশিয়ান সেভেন কোর্সে নিয়ে যেতেন। ডঃ তেনজিন ছোডাক ভারতে আসার আগে একটা চীনা বন্দী শিবিরে কুড়ি বছর কাটিয়েছিলেন। আর সেইজন্য সেভেন কোর্সের ভোজন সভায় প্রথম ভোজন পরিবেশন করার সময় আমরা আগে থেকে তাকে যতই সতর্ক করছিলাম না কেন, তিনি যত পরিমাণ সম্ভব ভোজন গ্রহণ করে ফেলেছিলেন। মনে হচ্ছিল এটাই হবে তারজন্য আগামী সপ্তাহের একমাত্র ভোজন। তার পেট ভর্তি হয়ে যাবে আর পরের ছয়টি ক্রমে তিনি আর ভোজন গ্রহণ করবেন না। এটি এমন একটি পরিস্থিতির সাদৃশ্য যেটা আমরা অবলোকন ক’রে ধ্যান সাধনার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা সাতটি ক্রমের সম্পূর্ণ খাদ্যতালিকা পর্যালোচনা করতে এবং মনে রাখতে চাই যাতে আমরা অতিরিক্ত না করে ফেলি এবং একটা বিষয়ের উপর ধ্যান-ভাবনা না করি। এটা হবে প্রথম ক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং অবশিষ্ট ভোজন মিস করার মতো।

উপরে আমি একপ্রকার ধ্যানের বর্ণনা করছিলাম যার মাধ্যমে আমরা একটি নির্দিষ্ট মনের অবস্থা গড়ে তুলি। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে শুধু এই ধরণের ধ্যানের অনুশীলন করা হয় না। উদাহরণ স্বরূপ, কয়েকটি ধ্যান অনুশীলনে, যেমন- কাগ্যু পরম্পরা অনুযায়ী মনের স্বভাবের উপর ধ্যান করা হয় অথবা নির্দিষ্ট জেন সাধনা অনুযায়ী এর একটি ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সেখানে মনের অবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে আমাদের মনের মধ্যে কিছু সহজাত গুণ আছে, যেমন- মৈত্রী অথবা মনের স্বচ্ছতা এবং সেগুলিকে উপলব্ধি করার জন্য আমরা মনের অবস্থাকে শান্ত করি। কিন্তু এই ধরণের ধ্যান করা সত্ত্বেও সর্বপ্রথম আমাদের নির্দেশাবলীগুলিকে শ্রবণ করতে হবে এবং তারপর সঠিকভাবে না বোঝা পর্যন্ত সেগুলি সম্পর্কে চিন্তন করতে হবে। আমাদের এটাও জানতে হবে আমরা মনের যে অবস্থাকে শান্ত করছি তার ভিত্তি কী, আমরা কী লাভ করতে চলেছি, এরজন্য আমাদের প্রথমত, দ্বিতীয়ত ইত্যাদি ধাপে কী করা প্রয়োজন। “শান্ত হওয়া”, এই ধরণের ধ্যানের পরিকাঠামোটি “গড়ে তোলা” নামক ধ্যানের মতোই।

ধ্যানের সবচেয়ে উপযোগী পরিবেশ

কীভাবে একটা ধ্যানের অধিবেশন নির্ধারণ করতে হয়, কীভাবে একটা ধ্যানের স্থান সাজাতে হয়, কীভাবে মেঝেতে ঝাড়ু দিতে হয় এবং ধ্যান কক্ষ পরিষ্কার করতে হয়, ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম করা এবং নৈবেদ্য অর্পন করার নির্দেশাবলীগুলি কী কী ইত্যাদি সম্পর্কিত বিস্তৃত নির্দেশাবলী নির্ধারণ করা আছে এবং এগুলি সবই ধ্যান সাধনা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ। যদিও ধ্যান সাধনা করার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি এবং উপযুক্ত পরিবেশ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ ক’রে একটা উপযুক্ত আসন, একটা শান্ত ও পরিষ্কার পরিবেশ, তা সত্ত্বেও আমাদের চারপাশে একটা বিস্তৃত দৃশ্য ঘটে চলার পরিবেশ থাকার প্রয়োজন হয় না। উপযুক্ত স্বর্ণনির্মিত নিবদ্ধ সামগ্রী, ধূপকাঠি, পটভূমিতে নতুন যুগের সংগীত এবং এইধরণের অন্যান্য জিনিস অর্জন করার জন্য আমাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করার কোন প্রয়োজন নেই। মিলারেপার কাছে অবশ্যই সেসব কিছুই ছিল না, তা সত্ত্বেও তিনি ধ্যান সাধনায় পূর্ণরূপে সফল হয়েছিলেন। আমরা আমাদের ধ্যানের স্থান যতটা সম্ভব সুন্দর করার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু সেটা মঞ্চের মতো না ক’রে এবং জিনিসপত্রগুলিকে শুধুমাত্র প্রদর্শনের জন্য বিস্তৃতভাবে না সাজিয়ে।

এছাড়াও আমাদের যেকোন জায়গায় ধ্যান করতে সক্ষম হতে হবে। আমরা যদি একটি দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় যাই তখন আমরা বললে হবে না, “আমি ট্রেনে ধ্যান সাধনা করতে পারব না, কারণ আমার কাছে আমার জলের বাটি নেই এবং আমি কোন ধূপ জ্বালাতে পারব না, আমি ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে পারব না ইত্যাদি।” বাস্তবে, আমরা একবার যদি এসব কিছুতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারি তাহলে আমরা যেকোন জায়গায় ধ্যান করতে সক্ষম হয়ে উঠব- ট্রেনে, অন্য কোথাও, লাইনে দাঁড়িয়ে ইত্যাদি। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও আনুষ্ঠানিক ধ্যানের অধিবেশনগুলির মধ্যে আমরা অন্যদের সাথে মৈত্রী এবং করুণার সাথে আচরণ করতে চেষ্টা করার কথা মনে রাখতে পারি। এটাই হল ধ্যান, তাই নয় কী?

মনে রাখবেন ধ্যানের সম্পূর্ণ বিষয় হল শিক্ষাগুলিকে একীভূত করা অর্থাৎ সেগুলিকে আমাদের জীবনের অংশ হিসাবে গড়ে তোলা, যাতে আমরা সেগুলিকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে পারি। তবে যখন ধ্যান সাধনা আমাদের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যায় তখন সেটা একটা কেবল শখ হয়ে থেকে যায়। বিশেষ ক’রে যখন আমাদের ধ্যান সাধনা অদ্ভূত তান্ত্রিক দৃশ্যায়নের সাথে জড়িয়ে যায় তখন এটা খুব সহজে ডিসনিল্যান্ডে ভ্রমণের মতো হয়ে উঠতে পারে। ডিসনিল্যান্ড বলতে এমন একটা কাল্পনিক দেশ যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আমরা যদি সেই পথে যাই তাহলে আমরা মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠব এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান সাধনার প্রভাব খুব কম পড়বে। মনে রাখবেন, ধ্যানের পুরো বিষয়টা হল এটাকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা।

আর আমরা যেখানেই থাকি না কেন, যখনই ধ্যান করি না কেন প্রথমেই যেটা করতে হবে সেটা হল আমাদের অনুপ্রেরণাকে স্থির করা, অনুপ্রেরণাকে নিশ্চিত করা এবং একাগ্রতার সাথে ধ্যান করার উদ্দেশ্য থাকা। আমাদের মন যদি বিক্ষিপ্ত হয় তখন সেটাকে আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের যদি ঘুম পায় তাহলে আমাদের নিজেদেরকে জেগে উঠতে হবে। আর সর্বশেষে ইতিবাচক শক্তিকে উৎসর্গ করতে হবে। ধ্যান সাধনার মাধ্যমে আমরা যে ইতিবাচক শক্তি উৎপন্ন করি সেটাকে যদি আমরা উৎসর্গ না করি তাহলে ধ্যানের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সাংসারিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায়। তাই সকলের কল্যাণের জন্য বোধিলাভের উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের ইতিবাচক শক্তিকে উৎসর্গ করতে চাই।

ব্যক্তিগত বনাম দলগত ধ্যান

কিছু লোক ব্যক্তিগতভাবে ধ্যান সাধনা করেন। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ তিব্বতীরাই ব্যক্তিগত ধ্যান সাধনা করেন; তারা সত্যিই দলগত ধ্যান সাধনা করেন না, যদিও মঠে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীরা একসাথে দলবদ্ধভাবে প্রার্থনা এবং আচার-গ্রন্থ পাঠ করেন। যাইহোক, পাশ্চাত্য দেশে আমরা দলগত ধ্যান-সাধনা রীতি গড়ে তুলেছি। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দলগত ধ্যান সাধনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল শৃঙ্খলা। আমরা যদি একা হই তাহলে আমাদের কাছে শুধু বসে থাকা এবং ধ্যান সাধনা করার কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে না। আমরা আমাদের ধ্যান অধিবেশন শেষ করার নির্ধারিত সময়ের আগেই উঠে পড়ি; অন্যদিকে, যদি আমাদের চারপাশে অন্য লোকজন থাকে তাহলে আমাদের কাছে বেশি নিয়মশৃঙ্খলা বজায় থাকে। আমরা অনেক কম অস্থির হই, কারণ আমরা অন্যদের সামনে সেটা করতে বিব্রত হই।

কিছু মানুষ দলগত ধ্যান সাধনাকে একেবারে ভয়ঙ্কর বলে মনে করেন, কারণ তারা অন্য লোকজনদের কারণে অন্যমনস্ক হন। বিশেষ ক’রে যখন কেউ কেশে ওঠেন বা অস্থিরতা বোধ করেন তখন তারা সেটাকে তাদের ধ্যানের জন্য ভয়ঙ্কর ব’লে মনে করেন। এই কারণে তারা একান্তে ধ্যান সাধনা করতে পছন্দ করেন। বিশেষ ক’রে যখন ধ্যান সাধকের দল উচ্চস্বরে কিছু পাঠ করেন, যেটা সাধারণতঃ আমরা যেভাবে পাঠ করি তার চেয়ে অনেক বেশি নিম্নস্বরে করা হয়। ফলে আমরা অবিশ্বাস্যভাবে বিরক্ত এবং ক্রোধিত হয়ে উঠি। অন্যদিকে এর পাশাপাশি যদি সেটা খুব দ্রুতভাবে সম্পন্ন করা হয় তাহলেও আমরা ক্রোধিত হয়ে উঠি।

এই ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের বিচার করতে হবে যে কোনটা আমাদের জন্য ভালো- ব্যক্তিগত, না দলগত ধ্যান। তবে আমি একটা মজাদার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি, একটা ছোট দলগত ধ্যানে অংশগ্রহণ করার সময় অর্থাৎ একজন বা দুজন মানুষের সাথে ধ্যান করলে ধ্যানটা ভাল ভাবে সফল হতে পারে। এর কারণ হল, ঐ সময় আপনার সাথে অন্যদের বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ বন্ধন এবং সংযোগ থাকে যেখানে আপনি তাদের সাথে অত্যন্ত সম্প্রীতি অনুভব করেন। মনে হয় আপনার শক্তি একে অপরকে শক্তিশালী ক’রে তোলে। তাদের সাথে ধ্যান করার পরিস্থিতি আপনাকে অনেক বেশি শক্তি এবং স্পষ্টতা প্রদান করে। কিন্তু যখন একটি ছোট গোষ্ঠীতে ধ্যানরত ব্যক্তিদের শক্তি একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন তাদের প্রভাব ঠিক এর বিপরীত হয়ঃ এটি বিরক্তি জাগায় এবং আপনার মনকে অনেক নিস্তেজ ক’রে তোলে। সুতরাং আপনাকে পরীক্ষা ক’রে দেখতে হবে আপনি কার সাথে ধ্যান সাধনা করছেন, যদি কিনা আপনি অন্যের সাথে ধ্যান সাধনা করতে যান।

প্রচেষ্টার গুরুত্ব

পরামর্শের শেষ অংশটি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা হল সংসারের স্বভাব সম্পর্কিত পরামর্শ যার উত্থান এবং পতন হতেই থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ধ্যানেরও উত্থান এবং পতন হয়। এটা কখনোই একটি রৈখিক প্রক্রিয়ায় সীমিত থাকে না যা প্রতিদিন ভালো থেকে আরও ভালো হয়। কিছুদিন আমাদের ধ্যান ভালো হয় আবার অন্যদিনগুলিতে ভালো হয় না। কিছুদিন আমরা ধ্যান করতে চাই আবার অন্যদিনগুলিতে আমাদের ধ্যান করতে ভালো লাগে না। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সহজাত- এটাই সংসারের স্বভাব। মূল বিষয়টি হল আপনি যা কিছুই অনুভব করেন না কেন আপনাকে চেষ্টারত থাকতে হবে এবং সেটা চালিয়ে যেতে হবে। আপনার মনে যদি এই ভাবনা জাগেঃ “আমি ধ্যান করছি বলে মনে হচ্ছে না,” তাতে কী হয়েছে? যেভাবেই হোক ধ্যান সাধনা করুন। ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন; প্রতিদিন এটা করুন, এমনকি যদি শুধুমাত্র দুই বা তিন মিনিটের জন্যেও সম্ভব হয়। আপনার পথে স্থিরতা আনার ক্ষেত্রে ঐ ধারাবাহিকতাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়াও ধ্যান সাধনার অধিবেশনের সময়কে বেশি দীর্ঘ করবেন না, বিশেষ ক’রে শুরুতে। এরজন্য তিন থেকে পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। তা না হলে আপনি ভাবতে লাগবেন, “আমি এটা শেষ হওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছি না।” আর তখন আপনারা আপনাদের ধ্যান সাধনায় ফিরে যেতে চাইবেন না। যদি ধ্যান-সাধনাকে ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়ে আপনারা সেটাকে সমাপ্ত করে দেন, তাহলে আপনারা পুনরায় ঐ ধ্যান অনুশীলনে ফিরে যেতে আনন্দ বোধ করবেন। যেমন, আপনারা কোনও ব্যক্তির সাথে আছেন এবং তার সাথে আরও কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনারা বিশেষ কারণে তার থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যান, তখন কী হয়, আপনারা খুব শীঘ্রই পুনরায় তার সাথে দেখা করতে পছন্দ করবেন। কিন্তু যদি ঐ ব্যক্তি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও আপনার সাথে থাকতে চান, তাহলে আপনারা তাকে পুনরায় আর দেখতে চাইবেন না।

আর সর্বশেষে, আপনারা যে সময় ধ্যান অনুশীলন করেন সেই সময়ের পরিমাণটাকে ক্রমাগতভাবে বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা নম্র হবেন- নম্র হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমনকি আমি বলেছিঃ একদিনের জন্য হলেও ধ্যান অনুশীলন মিস করবেন না। আপনারা যদি প্রতিদিন ধ্যান অনুশীলন করেন তাহলে আপনারা স্থিরতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বাস অর্জন করবেন। তবে নম্র হবেনঃ কখনো-কখনো আপনারা পূর্ণ ধ্যান অনুশীলন করতে পারবেন যেটা আপনারা করতে চান, আর অন্য সময় যখন আপনাদের কাছে সময় থাকবে না, তখন অল্প সময়ের জন্য করবেন। তবে অল্প হলেও প্রতিদিন কিছু করবেন। তবে ধর্মান্ধ হবেন না; নিজেদেরকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেবেন না। আমার প্রিয় জেন ধাঁধা হলঃ “মৃত্যু যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে। শান্ত হন!”

Top