চার আর্যসত্য হল মূল তথ্য যা আমাদের সমস্যাগুলি থেকে অতিক্রম করার জন্য একটা মার্গের রূপরেখা তৈরী ক’রে দেয়। এটা হল বুদ্ধের প্রথম উপদেশ যা অন্য সকল বৌদ্ধ উপদেশগুলির জন্য কাঠামো গঠন করে।
প্রথম আর্যসত্য: দুঃখ সত্য
সাধারণত প্রথম সত্যের তাৎপর্য হল জীবনটা অসন্তোষজনক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, প্রচুর আনন্দদায়ক ক্ষণ থাকে, কিন্তু সেগুলি কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, এবং এর সঙ্গে অনেক অপ্রীতিকর সময়ও থাকে :
- দুঃখ- রোগ, হতাশা, একাকীত্ব এবং অসন্তুষ্টি, এগুলিকে সহজে অনুভব করা যায় এবং বোঝা যায়। এটা প্রায়ই, শুধু আমাদের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গেও সম্পর্কিত থাকে না, বরং আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে থেকে প্রিয় খাবার খাওয়া-দাওয়া করি, তা সত্ত্বেও সুখী হই না।
- অল্পকালীন সুখ- আমরা যা কিছু উপভোগ করি, সেটা আসলে কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না বা আমাদের সন্তুষ্ট করে না, এবং সেটা শীঘ্রই দুঃখে পরিণত হয়ে যায়। আমরা যখন ঠান্ডায় জমে যাই, তখন আমরা তাপের জন্য একটা উষ্ণ কক্ষে যাই। কিন্তু অবশেষে সেই তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠে, যার কারণে আমরা আবার শুদ্ধ হাওয়া চাই। এটা ভাল হতো যদি এই সুখটা দীর্ঘস্থায়ী হতো, কিন্তু সমস্যাটা হল যে সেটা কখনও হয় না।
- সতত পুনরাবৃত্তি দুঃখ- সব থেকে খারাপ হল যে জীবনের উত্থান এবং পতনের সঙ্গে যেভাবে আমরা মোকাবিলা করি, সেগুলি কেবল অধিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন- আমরা একটা খারাপ সম্পর্কে আছি এবং আমরা যেভাবে আচরণ করছি সেটি এটাকে আরও বেশী খারাপ করছে। সুতরাং আমরা সম্পর্ক ভেঙ্গে দিই। কিন্তু তারপর যেহেতু আমরা আমাদের খারাপ স্বভাবগুলি বেশী প্রভাবশালী বানিয়েছিলাম, সেই জন্য পরবর্তী সম্পর্কেও সেই নমুনার পুনরাবৃত্তি ঘটাই। সুতরাং এটাও খারাপ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় আর্যসত্য: সমুদয় সত্য
আমাদের সুখ এবং অল্পকালীন সুখ কেবল মাত্র কোন পাতলা বায়ু থেকে উৎপন্ন হয় না, বরং কারণ এবং প্রত্যয়ের প্রশস্ত প্রসর থেকে হয়। বাহ্য কারণ, যেমন- আমরা যে সমাজে বাস করি, সেটি সমস্যাগুলি উৎপন্ন হওয়ার জন্য প্রত্যয়রুপে কাজ করে, কিন্তু আসল কারণ সম্পর্কে বুদ্ধ আমাদের নিজেদের চিত্তকে দেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের নিজস্ব বিশৃঙ্খল আবেগ অর্থাৎ দ্বেষ, ঈর্ষা, লোভ ইত্যাদি- আমাদের বাধ্য করিয়ে চিন্তা-ভাবনা, কথা বলা এবং কাজ করার জন্য পরিচালনা করে যা সর্বশেষে আমরা স্বয়ং ধ্বংস হওয়ার পথে এগিয়ে যাই।
বুদ্ধ গভীরতর ভাবে দেখেছেন এবং আসল কারণটার উন্মোচন করেছেন, যেটা এই আবেগময় অবস্থাগুলির অধীনে থাকে- যেভাবে আমরা বাস্তবকে বুঝি। এটি আমাদের আচরণের দীর্ঘমেয়াদী ফল বিষয়ে অসচেতনতা এবং বিভ্রান্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এছাড়াও আমরা, অন্যরা এবং জগৎটা কী করে টিকে আছে, একেও অন্তর্ভুক্ত করে। প্রত্যেকটা বস্তু পরস্পর-সংযুক্ত, এইভাবে দেখার পরিবর্তে, সব বস্তু নিজের থেকে টিকে আছে, বাহ্যিক কারণে সেগুলি স্বাধীন, এইভাবে দেখার প্রবণতা দেখাই।
তৃতীয় আর্যসত্য: দুঃখ নিরোধসত্য
বুদ্ধ দেখিয়েছেন যে আমাদের এর সঙ্গে পেশ হওয়া উচিৎ নয়, কেননা আমরা যদি কারণকে উন্মুলন করতে পারি তাহলে ফল উৎপন্ন হবে না। আমরা যদি বাস্তব বিষয়ে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে যাই, তাহলে সমস্যাগুলি কখনও আর ফিরে আসতে পারবে না। তিনি কেবল আমাদের একটা বা দুটো সমস্যার বিষয়ে বলেন নাই, বরং তিনি বলেছেন যে আমরা সম্পূর্ণভাবে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হওয়াকে বন্ধ করতে পারি।
চতুর্থ আর্যসত্য: চিত্তের সত্য মার্গ (মার্গসত্য)
সরলপন এবং অসচেতনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের সেগুলিকে দেখা প্রয়োজন যেগুলি এর সোজা বিরোধিতা করে:
- তাৎক্ষণিক তুষ্টির জন্য অদূরদর্শীভাবে লাফা-লাফি করার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
- জীবনের ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণের উপর কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে বৃহত্তর চিত্রের দিকে দেখা।
- এখন আমাদের জন্য যেটা সহজ কেবল সেটা করার পরিবর্তে আমাদের অবশিষ্ট জীবনের এবং ভাবী প্রজন্মের কর্মের পরিণতির উপর বিচার করা প্রয়োজন।
কখনও-কখনও, জীবনে হতাশার মুখোমুখি হলে আমরা ভাবি যে ঐ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতির কথা না ভেবে মত্ত হয়ে বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিজেকে বিভ্রান্ত করা। আমরা যদি এটাকে একটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলি, তাহলে স্বাস্থ্যের পক্ষে একটা গম্ভীর বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। তাতে না কেবল আমাদের জীবনের প্রতি একটা বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে, বরং আমাদের পরিবারের উপরও একটা সর্বনাশা পরিণতি ডেকে আনবে। এর অধীন হয়ে যাওয়াটাই হল সেই ধারণা, যা আমরা সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের নিজের কর্মের পরিণতি থেকে আলাদা। আমাদের বিভ্রান্তির সবথেকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হল:
- এতদ্ভাবে বোধ করা দরকার যে আমরা অবশিষ্ট মানবতা এবং গ্রহের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে পরস্পর সম্পর্কিত, আর এটা জানাও প্রয়োজন যে আমরা কী করে জীবিত আছি, আমাদের এই কল্পনাগুলি বাস্তবের সঙ্গে মেল খায় না।
পুনরাবৃত্ত ধ্যানের মাধ্যমে আমরা যদি স্বয়ং এই সম্যগদৃষ্টিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে অবশেষে আমরা সব বিভ্রান্তিকে দূরীভূত করতে পারব যা আমাদের শূন্য অভিক্ষেপের সমর্থন করে।
আমরা সবাই সুখের কামনা করি, কিন্তু তাসত্ত্বেও কোন প্রকারে এটি আমাদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে পলায়ন করতে থাকে। সুখের খোঁজ বিষয়ে বুদ্ধের অভিগমন পথটির বিষয়ের উপর বর্ণিত চার আর্যসত্যের মধ্যে রূপরেখা প্রদান করা আছে। এটি সার্বজনীন এবং বুদ্ধ দ্বারা এর উপর উপদেশ দেওয়ার ২৫০০ বছর পরও এর প্রাসঙ্গিকতা আছে।
আমাদের দৈনন্দিন সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য চার আর্যসত্যকে অনুসরণ ক’রে উপকৃত হওয়ার জন্য একজন বৌদ্ধ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এটা সম্ভব নয় যে আমরা যা চাই সে সবকিছু সবসময় একই রকমভাবে আচরণ করবে। কিন্তু তারজন্য বিষন্নতা এবং আশা ত্যাগ করে দেওয়ার কোন কারণ নেই। তাদের মধ্যে যে চার আর্যসত্য বিদ্যমান আছে তাঁর দ্বারা আমাদের আসল সুখকে খোঁজ করা প্রয়োজন এবং আমাদের জীবনকে প্রকৃতপক্ষে সার্থক বানানো প্রয়োজন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, দুঃখসত্যকে জানতে হবে; সমুদয়সত্য থেকে মুক্ত হতে হবে; দুঃখ-নিরোধসত্যকে প্রাপ্ত করতে হবে; এবং চিত্তের মার্গসত্যকে অধিগমন করতে হবে।