বৌদ্ধধর্মকে আমাদের জীবনে সমাহিত করা

20:30
‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ হল একটি প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা। জীবনের সমস্যা গুলি থেকে বাঁচার জন্য আমরা এই ব্যবস্থা করি।

জীবনের সমস্যা গুলির মোকাবিলা করতে ধর্মের উপযোগীতা

ধর্মের অনুশীলনে নিজেদের যুক্ত করার জন্য আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হল- সর্ব প্রথমে আমাদের জীবনের বিভিন্ন প্রকারের সমস্যা গুলিকে বা অসুবিধা গুলিকে বুঝতে হবে। দ্বিতীয়, আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, ধর্মের অনুশীলনের উদ্দেশ্য, এই সমস্যা গুলি থেকে মুক্ত হতে আমাদের সহযোগীতা করা।

ধর্ম অনুশীলনের অর্থ শুধু স্বস্তি অনুভব করা অথবা একটা সুন্দর শখ থাকা অথবা হাল-ফ্যাশন অনুসরণ করা অথবা এমনই কোনও অন্য কাজ করা নয়। ধর্মের অনুশীলনের উদ্দেশ্য হল আমাদের সমস্যা গুলি থেকে মুক্তি দিতে আমাদের সহযোগীতা করা। এর অর্থ এটাই, বাস্তবানুগ ভাবে ধর্ম অনুশীলন করতে গেলে আমাদের জানতে হবে যে, এটা কিন্তু কোনও আনন্দদায়ক পদ্ধতি নয়। আমরা জীবনে যে অপ্রিয় পরিস্থিতি গুলি ও অসুবিধা গুলি ভোগ করছি প্রকৃত পক্ষে আমাদের সেগুলির মুখোমুখি হতে হবে, তার থেকে পালালে হবে না। বরং এই মনোভাবের দ্বারা তার মুখোমুখি হতে হবে যে, এবারে আমরা এর মোকাবিলা করার প্রয়াস করতে চলেছি।

আমাদের সমস্যা গুলি বিভিন্ন রূপ নিতে পারে। আমরা তাদের বেশীর ভাগের সাথেই পরিচিত- আমরা অনিরাপদ; অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে; আমরা বিচ্ছিন্ন বোধ করি; আমাদের নিজের আবেগ এবং অনুভূতি গুলির সাথে মোকাবিলা করতে অসুবিধা হয়- যে সমস্ত সাধারণ জিনিস আমাদের কাছে আছে। আমাদের পরিবার এবং মাতা-পিতার সাথে মেলামেশা করতে অসুবিধা হয়, কারণ তারা অসুস্থ হয় এবং তারা বৃদ্ধ। আমাদের নিজের অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের সাথে মোকাবিলা করতে অসুবিধা হয় এবং আমরা যদি একজন যুবক হই, তবে আমরা আমাদের জীবন নিয়ে কী করব, কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করব, কোন দিকে যেতে হবে ইত্যাদি বাছাই করতে অসুবিধা হয়। আমাদের এই ধরণের সমস্ত বিষয় লক্ষ্য করা দরকার।

বিভ্রান্তি

বৌদ্ধধর্মের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় হ’ল উপলব্ধি করা, আমরা যে সমস্ত সমস্যা গুলির অনুভব করি, সেগুলি কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। এটা এমন নয় যে, এগুলি অকারণে উৎপন্ন হয়। এই সমস্যা গুলির উৎস আমাদের মধ্যেই আছে। এটা একটা খুব বড় সত্য আর অধিকাংশ মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। এর কারণ, আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষ আমাদের সমস্যা গুলির জন্য অন্যদের দোষারোপ করে অথবা বাহ্যিক পরিস্থিতিকে দোষারোপ করে। আমরা অনুভব করি, “আমি দুঃখী, আপনি যা করেছিলেন তার জন্য; আপনি আমাকে ডাকেননি; আপনি আমাকে ত্যাগ করেছেন; আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, সব দোষ আপনার।” অথবা আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে দোষারোপ করে থাকি অর্থাৎ আমরা যখন ছোট্ট শিশু ছিলাম, তখন তারা আমাদের জন্য কী করেছিলেন বা করেননি। অথবা আমরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদির উপর দোষ চাপিয়ে দিই। এখন অবশ্যই এই সমস্ত কারণ গুলি আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাতে ভূমিকা পালন করে, বৌদ্ধধর্ম এটা অস্বীকার করে না। তবে মূল কারণটি হল, আমাদের সমস্যার গভীর কারণ যেটা আমাদের নিজেদের মধ্যে আছে; এটি আমাদের নিজস্ব মনোভাব, বিশেষতঃ আমাদের বিভ্রান্তি।

আমরা যদি এমন একটি বিষয় খুঁজে পেতে চাই যা দৈনন্দিন জীবনে বৌদ্ধধর্ম অনুশীলনের অর্থ সম্পর্কে বৌদ্ধ মনোভাবকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করবে, তাহলে আমার উত্তর এইরকম হবে। যখন আমাদের অসুবিধা হয়, তখন আমরা তার উৎস খোঁজার জন্য নিজেদের ভিতরে দেখব এবং একবার এটি শনাক্ত করার পর আমরা পরিস্থিতিটি ভিতর থেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করব। আমরা যখন আমাদের নিজেদের ভিতরে দেখা এবং সমস্যার উৎস খোঁজার ব্যাপারে কথা বলি, তখন এর অর্থ এটা হয় না যে, আমরা নৈতিক রায় নিয়ে ফেলি যে, আমি একজন খারাপ ব্যক্তি আর স্বয়ং আমাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং ভাল হতে হবে। বৌদ্ধধর্ম নৈতিক রায় দেয় না। আমরা আমাদের সমস্যার উৎস নিজের মধ্যে এই কারণে খোঁজার চেষ্টা করি কারণ, আমরা দুঃখ ভোগ করি এবং আমাদের সমস্যা আর দুঃখ থেকে মুক্ত হতে চাই এবং এগুলির মূল উৎস হল আমাদের নিজস্ব মনোভাব। বিশেষতঃ বুদ্ধ বলেছিলেন যে, আমাদের সমস্যা এবং দুঃখের গভীরতম কারণ হল, আমাদের বিভ্রান্তি। সুতরাং আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হল, আমরা পরিস্থিতিকে নিয়ে কীভাবে বিভ্রান্ত হয়ে আছি সেটাকে আবিষ্কার করা আর কীভাবে আমরা সঠিক বোধশক্তি প্রাপ্ত ক’রে এই বিভ্রান্তিকে দূর করতে পারব।

আমাদের বিভ্রান্তি কী? এটি বেশ কয়েকটি জিনিস নিয়ে হয়। একটা হল- আচরণগত কারণ এবং ফল। আমরা মনে করি যে, আমরা যদি কোনও নির্দিষ্ট ভাবে কাজ করি তাহলে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। উদাহরণ স্বরূপ, “আমার দেরী হতে পারে, আপনাকে উপেক্ষা করতে পারি ইত্যাদি। এতে কিছু যায় আসে না।” এমন ভাবা ভুল; এটা বিভ্রান্তি। অথবা আমরা ভাবি যে, আমরা যা করি বা যেমন ব্যবহার করি, তার একটা নির্দিষ্ট প্রভাব পড়বে যা অযৌক্তিক এবং সম্ভবতঃ ঘটতে নাও পারে। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি আপনার সাথে ভাল ব্যবহার করেছি, তাই আপনি তার প্রত্যুত্তরে আমাকে ভালোবাসবেন। আমি আপনাকে সুন্দর উপহার কিনে দিয়েছি, তাহলে এখন আপনি আমাকে কেন ভালবাসেন না?” এই ধরণের চিন্তা-ভাবনার সাথে আমরা কল্পনা করি যে, আমাদের কর্ম অথবা আচরণে কোনও অসম্ভব প্রভাব পড়বে অথবা আমরা তাদের গর্বিত করে তুলি এই ভেবে যে, তারা বেশী প্রভাব সৃষ্টি করতে চলেছে যতটা প্রভাব পড়ার কথা ছিল। এছাড়াও আমরা ভাবতে পারি যে, নির্দিষ্ট কিছু জিনিস একধরণের প্রভাব আনতে পারে; যদিও প্রকৃতপক্ষে, তারা ঠিক বিপরীত প্রভাব নিয়ে আসে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা সুখী হতে চাই এবং আমরা মনে করি যে, সুখী হওয়ার উপায়টি হ’ল সর্বদা মত্ত হয়ে থাকা। তবে এটি সুখের চেয়ে আরও বেশী সমস্যা উৎপন্ন করে। 

অন্য যে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা বিভ্রান্ত সেটা হ’ল যে, আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, অন্যরা কিভাবে অস্তিত্বে আছে, আর এই বিশ্ব কীভাবে অস্তিত্বে আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা অসুস্থ হওয়া আর বৃদ্ধ হওয়া নিয়ে কষ্ট ভোগ করি এবং দুঃখিত হই। তবে আমরা মানুষ হিসাবে আর কী আশা করি? যদি যুবাবস্থাতে আমাদের মৃত্যু না হয় তাহলে মানুষ অসুস্থ হবে আর বৃদ্ধও হবে- এই বিষয় গুলি কোনও অবাক হওয়ার বিষয় নয়। আমরা যখন আয়নাতে ধূসর চুল দেখতে শুরু করি তখন আমরা দুঃখী হয়ে যাই এবং হতবাক হয়ে যাই। তখন পৃথিবী কীভাবে অস্তিত্বে আছে আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, সেটার সম্পর্কে একটি অবাস্তব এবং বিভ্রান্তি তৈরী হয়।

চলুন বলি, বৃদ্ধ হওয়া নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা আছে। কিন্তু এই সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তির জন্য- বৃদ্ধ হওয়ার বাস্তবিকতাকে স্বীকার না করার কারণে- আমরা বিশৃঙ্খল আবেগ এবং মনোভাবের প্রভাবে ধংসাত্মক ভাবে আচরণ করতে শুরু করে দিই। উদাহরণ স্বরূপ, বাধ্যতা মূলক ভাবে তরুণ এবং আকর্ষনীয় দেখানোর চেষ্টা করা, আমরা আশা করি যে, এই জিনিস গুলি আমাদের সুরক্ষিত করে তুলবে- যেমন অন্যদের মনোযোগ এবং ভালোবাসার মতো, বিশেষতঃ অল্পবয়সীদের যাদের আমরা আকর্ষনীয় মনে করি, সেগুলি পাওয়ার চেষ্টা করার জন্য আকুল আকাঙ্খার সাথে আচরণ করি। এই সিন্ড্রোমের পিছনে সাধারণতঃ এই বিভ্রান্তি থাকে যে, আমি বিশ্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; আমি মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং, প্রত্যেককে আমার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমি দেখতে যেমনই হই না কেন, সকলের উচিত আমাকে আকর্ষনীয় মনে করা এবং আমাকে পছন্দ করা। যদি কেউ আমাকে আকর্ষক না মনে করে এবং তারা আমাদের পছন্দ না করে তাহলে এটি আমাদের পাগল করে তোলে। সেটা আমাদের আরও বেশী পাগল করে তোলে যখন তারা আমাদের উপেক্ষা করে অর্থাৎ আমাদের প্রত্যাশা অনুরূপ তারা যদি আকর্ষক ভাবার জন্য মনোযোগ না দেয়, শারীরিক ভাবে না হলেও, অন্ততঃ অন্য কোনও ভাবে। তবে, শাক্যমুনি বুদ্ধকেও প্রত্যেকে পছন্দ করেননি; তাহলে আমরা কী করে প্রত্যাশা করতে পারি যে সবাই আমাদের পছন্দ করবে!

সকলের দ্বারা পছন্দ করা আমাদের ইচ্ছাটি একটি অবাস্তব প্রত্যাশা। এটা বাস্তবতা নয়। এটি বিভ্রান্তি, লালসা আর আসক্তির ভাবনার উপর আধারিত যে, সকলে আমাদের আকর্ষক ভাবুক এবং আমাদের দিকে মনোযোগ দিক। এর মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে শিশুসুলভ অশান্তকারী মনোভাব। আমরা মনে করি যে, আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রেমময় যে, সকলকেই আমাদের পছন্দ করা উচিত। সুতরাং যদি কোনও ব্যক্তি আমাদের পছন্দ না করে তাহলে সেই ব্যক্তির মধ্যে কিছু দোষ অবশ্যই থাকবে। অথবা এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি তখন হয় যখন আমরাই নিজেদের উপর সন্দেহ করা শুরু করিঃ “অবশ্যই আমার মধ্যেই কোনও দোষ আছে যার কারণে ওই ব্যক্তি আমাকে পছন্দ করেন না,” আর এই কারণে আমাদের খারাপ লাগে অথবা আমরা নিজেদের দোষী মনে করতে থাকি। এই সব হল শিশুসুলভ ভাবনা।

মূল বিষয়টি হ’ল আমাদের নিজেদের উপর কাজ করতে হবে। এটাই হল ধর্মের অনুশীলনের মর্মকথা। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমাদের যদি সমস্যা হয়, অনিরাপদ মনে হয় অথবা যাই হোক না কেন, আমাদের নিজেদের ভিতর দেখতে হবে কী ঘটছে তা দেখার জন্য। আমি যে সব বিশৃঙ্খল আবেগ অনুভব করছি তার পিছনে বিভ্রান্তি কোথায় আছে? তবে আমরা যদি একটা সম্পর্কের দিকে নজর দিই, যা আমাদের সমস্যা তৈরী করছে, আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, বিভ্রান্তি শুধু আমাদের মধ্যে নেই। স্পষ্টতই, অন্য ব্যক্তিটির মধ্যেও বিভ্রান্তি রয়েছে। মূল বক্তব্যটি হ’ল, আমাদের এটা বলা উচিত নয়, “আপনাকে পরিবর্তন হতে হবে। আমি যা কিছু করছি সব কিছুই সুন্দর এবং নিখুঁত; আপনি হলেন সেই ব্যক্তি যাকে পরিবর্তন হতে হবে।” অন্যদিকে আমরা বলি না যে, আমি হলাম একমাত্র যাকে পরিবর্তিত হতে হবে, কারণ এমন করার ফলে নিজেকেই শহীদ মনে হবে। আমরা অন্য ব্যক্তির সাথে সমস্যার ব্যাপারে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করি- যদিও, অবশ্যই ব্যক্তিটিকে আমাদের দৃষ্টিকোণকে বোঝার আর সেটা গ্রহণ করার জন্য তৈরী থাকতে হবে। আমাদের এই বিষয়টি স্বীকার করতে হবে যে, আমরা দুজনেই বিভ্রান্ত। আমাদের আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে কী চলছে সেটা যেমন বুঝতে পারছি সেই বিষয়ে আমাদের উভয়ের মধ্যে একটা সমস্যা আছে। অতএব আমাদের দুজনকেই এই বিভ্রান্তিকে দূর করার প্রয়াস করতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে অগ্রসর হওয়ার জন্য এটাই সর্বাধিক ব্যবহারিক এবং ধর্মসম্মত দিক।

অনুশীলন করার আগে ধর্মকে জানতে হবে 

বৌদ্ধধর্মে বহু রকমের অনুশীলন আছে। তাদের মধ্যে কোনটাকে কেমন ভাবে সম্পাদন করা যায় এবং কোন কৌশল কীভাবে সম্পন্ন করা যায় সে সম্পর্কে নির্দেশনা পাওয়াটাই যথেষ্ট নয়। এটি যে কোনও অনুশীলনের ক্ষেত্রে বোঝা খুব জরুরী যে, এটি কীভাবে আমাদের সমস্যা গুলি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে। আমাদের কেবল এটি জানলেই হবে না যে, এই অনুশীলন গুলি কখন এবং কীভাবে পালন করতে হবে, বরং আমাদের এর পিছনের অনুমান গুলিও জানতে হবে। এর অর্থ হল যে, আমাদের উন্নত স্তরের অনুশীলন গুলির সাথে শুরু করা যাবে না। আমাদেরকে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করতে হবে এবং একটি ভিত তৈরী করতে হবে, যাতে আমরা ধর্মের শিক্ষা গুলি ক্রমবদ্ধ ভাবে বুঝতে পারি, আর এটা জানতে পারি যে, কোন অনুশীলন কেমন হচ্ছে।

এখন এটি সত্য যে, আমরা এমন শিক্ষা গুলি পড়ি যা বলে যে, “আপনাকে যদি কোনও ঔষধ দেওয়া হয়, তখন এটি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে প্রশ্ন না করে ঔষধটি খেয়ে নিন!” যদিও এটি পরামর্শের একটি ভাল অংশ, তবুও আমাদের বুঝতে হবে যে, এটি চরমতার বিরুদ্ধে সতর্কতাও বটে। চরমতা হল যে, আমরা উপদেশ গুলিকে পরীক্ষা করা আর শিক্ষা গুলিকে বোঝার চেষ্টা করা, কিন্তু আমরা যা কিছু শিখেছি তা বাস্তবে কখনও প্রয়োগ না করা। আমরা সেই চরমতাকে ত্যাগ করতে চাই। তবে আরও অন্য চরমতা আছে, যা আমাদের সমানভাবে ত্যাগ করা উচিত। সেটা হ’ল, আমাদের যখন কিছু অনুশীলন সম্পর্কিত কিছু ধর্মের নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন আমরা এটা কী করছি এবং কী জন্য করছি কোনও কিছু না ভেবেই অন্ধভাবে বিশ্বাস ক’রে সেটার অনুশীলন করা শুরু করে দিই। এই রকমের চরমতা থেকে যে মূল সমস্যাটি তৈরী হয় সেটা হ’ল আমরা সত্যিই কখনো বুঝতে পারি না যে, কীভাবে এই অনুশীলনকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। যদি আমরা কোনো অনুশীলনের মূল বিন্দুটি বুঝে যাই, যদি আমরা বুঝতে পারি যে, এটি কীভাবে কাজ করে এবং এর প্রয়োজনটা কী, তাহলে আমাদের কীভাবে এটি দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে হবে তা বলার জন্য আমাদের আর কারও প্রয়োজন হয় না। আমরা বুঝতে পেরে যাই এবং আমরা নিজেরাই এটি প্রয়োগ করতে পারি।

যখন আমরা আমাদের সমস্যা গুলি দূর করার বিষয়ে কথা বলি, তখন আমরা শুধু আমাদের নিজস্ব সমস্যা গুলির সমাধানের বিষয়ে কথা বলি না, বরং আমরা অন্যদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে আমাদের যেসব অসুবিধা আছে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়েও কথা বলি। “আমার আলস্যের কারণে বা স্বার্থপরতার কারণে বা অতি ব্যস্ততার কারণে অন্যদের সহায়তা করতে সমস্যা হয়।” অথবা, “আপনার সমস্যাটি কী তা আমি বুঝতে পারি না এবং আপনাকে সহায়তা করার জন্য আমায় কী করতে হবে তার কোনও ধারণা নেই।” আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধাটি হল এটাই, তাই নয় কী? আমাদের বিভ্রান্তির কারণেও অন্যদের সহায়তা করতে অসুবিধা গুলি হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমার মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরী হওয়া যে, আমায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতো হওয়া উচিত এবং আমাকে এমন কিছু করতে হবে যার দ্বারা আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে; আর যদি এটি আপনার সমস্ত সমস্যার সমাধান না করে তাহলে এর অর্থ হবে আপনার মধ্যে কিছু দোষ আছে। আপনি এটা ঠিকভাবে করেননি, তাই আপনি দোষী। অথবা আমি দোষী, কারণ আপনার সমস্যা গুলি সমাধান করতে আমার সক্ষম হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি তা করতে পারিনি। তাই আমি ভালো নয়। আবার এটি কারণ এবং ফল সম্পর্কে বিভ্রান্তি।


ধর্মে বিশ্বাস

আরও একটি বিষয় হ’ল যে, ধর্মকে নন-নিউরোটিক (অবায়ুগ্রস্ত) উপায়ে দৈনন্দিন জীবনে কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমাদেরও এই বিশ্বাস থাকা দরকার যে, আমাদের সমস্যা গুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, মৌলিক বৌদ্ধ পদ্ধতির অনুসরণ ক’রে আমাদের বিভ্রান্তিকে এই ভাবে দূর করা সম্ভব। কোনও কিছু থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দরকার তার কারণকে পরিহার করে দেওয়া যা সেগুলি সৃষ্টি করে। কিন্তু অবশ্যই, যে গভীর এবং দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের সমস্ত বিভ্রান্তি পরিহার করে দেয় সেটাকে অর্জন করা খুবই কঠিন। এটা এমন ভাবে পরিহার করে যাতে সেটা দ্বিতীয়বার উৎপন্ন না হয়। আর এই দৃঢ় বিশ্বাস দ্বারা মুক্তি এবং বোধি লাভ করা সম্ভব। এটা করা তখন আরও কঠিন মনে হয় যখন আমরা এটা বুঝতে পারি না যে, মুক্তি এবং বোধির বাস্তবিক অর্থ কী। সুতরাং আমরা কীভাবে বিবেচনা করব যে, সেটা সত্যিই অর্জন করা সম্ভব অথবা সম্ভব নয়? আমরা যদি ভাবি যে, এটা প্রাপ্ত করা সম্ভব তাহলে এটা একটা ভন্ডামী পূর্ণ কথা হবে না যে, আমরা এমন কোনও লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছি যার বিষয়ে আমরা ভাবি না যে সেটা আদৌ অস্তিত্বে আছে? এই পরিস্থিতিতে এটি একধরণের পাগলামো খেলা হয়ে যায় যা আমরা খেলছি; এরকম হলে আমাদের ধর্ম অনুশীলন তখন আর বাস্তবিক থাকে না।

আমাদের সত্যিকার অর্থে দৃঢ় বিশ্বাসী হতে হবে এবং এর জন্য প্রচুর অধ্যয়ন এবং জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং পাশাপাশি গভীর চিন্তা আর ধ্যানও প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই দৃঢ় বিশ্বাসী হতে হবে যে, মুক্তি এবং বোধি কেবল অস্তিত্বে আছে তা নয়; বরং এগুলি লাভ করা আমার পক্ষেও সম্ভব। এমন নয় যে এটা কেবল শাক্যমুনির পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু আমি এটা করতে পারব না। বরং এই বিশ্বাস জাগাতে হবে যে, আমি এটা লাভ করতে পারি এবং প্রত্যেকে এটা লাভ করতে পারে। বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের কী করতে হবে তা আমাদের বুঝতে হবে। সেটা কী যেটা আমাদের বাস্তবে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেবে? সঠিক প্রজ্ঞাই আমাদের বাস্তবে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেবে, আর এই কারণে আমাদের বুঝতে হবে যে, সঠিক প্রজ্ঞা বিভ্রান্তিকে পরাস্ত করতে পারে আর সেটাকে এমনভাবে পরিহার করে দেয়, যাতে সেটা আবার কখনোই ফিরে না আসে। এর ফলে, আমরা দেখতে পাই যে, ধর্ম অনুশীলনের আসল কর্মস্থল হ’ল দৈনন্দিন জীবন; দৈনন্দিন জীবনে যা আমাদের সমস্যা গুলি, আমাদের বিভ্রান্তি আর আমাদের প্রতি মূহুর্তের অসুবিধা গুলির সঙ্গে মোকাবিলা করে।

ধর্মের অনুশীলনের জন্য অন্তর্মুখীতা হওয়া প্রয়োজন

ধর্মের অনুশীলনের অর্থ জীবনের সমস্যা গুলি থেকে কিছু সময়ের জন্য বেড়িয়ে আসা নয়, অথবা এক সুন্দর শান্ত ধ্যান-গুহায় গেলাম, অথবা জীবনে মোকাবিলা থেকে রেহাই পেতে নিজের ঘরে গিয়ে আসনে বসে পড়লাম। পলায়ন তো ধর্ম অনুশীলনের কেন্দ্রবিন্দু নয়। যখন আমরা ধ্যান করার জন্য কোনও শান্ত জায়গায় যাই, তখন আমরা আমাদের দক্ষতা নির্মাণ করার জন্য সেটা করি যেটা আমাদের জীবনের সমস্যা গুলির মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন হয়। জীবন হল মূল কেন্দ্রবিন্দু। বসে ধ্যান করার কেন্দ্রবিন্দু অলিম্পিক স্বর্ণপদক জেতা নয়! ধর্মকে জীবনের পরিস্থিতি গুলিতে প্রয়োগ করাই হল ধর্ম অনুশীলনের মর্মকথা।

পুনশ্চ, ধর্মের অনুশীলন হ’ল আত্ম-বিশ্লেষণাত্মক। এর সহায়তায় আমরা নিজেদের আবেগময় অবস্থা গুলি, আমাদের অনুপ্রেরণা গুলি, আমাদের মনোভাব, আমাদের আচরণের বাধ্যকারী রূপ গুলির প্রতি সচেতন হওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের বিশেষ ভাবে বিশৃঙ্খল আবেগ গুলি সন্ধান করা প্রয়োজন। বিশৃঙ্খল আবেগ বা মনোভাবের বৈশিষ্ট্য হ’ল এটি যখন উৎপন্ন হয় তখন সেটি আমাদের অথবা অন্যদের অস্বস্তি বোধ করায়। আমাদের চিত্তের শান্তি ভঙ্গ হয়ে যায় আর আমরা এর উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। এটি একটি খুব সহায়ক সংজ্ঞা, কারণ এটি জানার ফলে আমাদের এটা শনাক্ত করতে সক্ষম করে যে, কখন আমরা কোন বিশৃঙ্খল মনোভাবের প্রভাবে কাজ করি। যদি আমরা অস্বস্তি বোধ করি তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের চিত্তে কিছু বিশৃঙ্খল মনোভাব কাজ করছে। এই সময় আমাদের ভিতরে কী চলছে সেটা যাচাই করা উচিত এবং এটিকে সংশোধন করতে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা উচিত।

এই জন্য আমাদের ভিতরে যা চলছে তার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। আর যদি আমাদের নিজেদের আবেগময় স্থিতি বিশৃঙ্খল মনে হয়, তাহলে সেটা বদলানোর জন্য আমাদের এটা বোঝা আবশ্যক যে, যদি আমরা বিশৃঙ্খল এবং ঝঁঞ্ঝাটপূর্ণ আচরণ করি তাহলে স্বয়ং আমাদের জন্য আর অন্যদের জন্য অনেক দুঃখ উৎপন্ন করবে। আমরা সেটা চাই না; আমাদের সেটা যথেষ্ট ছিল। যদি আমরা নিজে বিপর্যস্ত থাকি, তাহলে আমরা কীভাবে অন্য কাউকে সাহায্য করতে পারব?

নমনীয়তা

ধর্ম অনুশীলনের জন্য একটি বা দুটি নয়, অনেক প্রতিপক্ষ শক্তির সাথে পরিচিত হওয়াও আবশ্যক। আমাদের জীবন খুব জটিল এবং একটি নির্দিষ্ট প্রতিষেধক সবসময় কাজ করে না। একটি নির্দিষ্ট অনুশীলন প্রতিটি একক পরিস্থিতিতে সবসময় কার্যকর হয় না। দৈনন্দিন জীবনে জিনিস গুলি সত্যই প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য নমনীয়তা এবং বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। যদি এটা কাজ না করে, তাহলে আমরা সেটা করি; যদি সেটাও কাজ না করে, তবে আমরা এটা চেষ্টা করি।

আমার শিক্ষক চেনসাব সেরকোঙ্‌ রিনপোছে বলতেন যে, আপনি যখন জীবনে কিছু করার চেষ্টা করছেন তখন সর্বদা দুটি বা তিনটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরী করে রাখুন। তারপর যদি পরিকল্পনা “এ” কাজ না করে, তাহলে আপনি হাল ছাড়বেন না। এর কারণ আপনার একটি বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে, ‘বি’ অথবা ‘সি’। এর মধ্যে একটি অবশেষে কাজ করবে। এটা আমি খুব সহায়ক পরামর্শ বলে মনে করি। ধর্মের ব্যাপারেও একই জিনিস যদি কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ‘এ’ কাজ না করে, আমাদের সবসময় একটি বিকল্প পরিকল্পনা উপলব্ধ রাখতে হয়। আমরা অন্য জিনিসে পাল্টাতে পারি। স্পষ্টতঃ, এই সমস্ত অধ্যয়নের উপর নির্ভর করে, বিভিন্ন পদ্ধতি এবং ধ্যান শেখার উপর ভিত্তি করে, যা আমরা পরে প্রস্তুতিতে অনুশীলন করি, যেমনকি আমরা শারীরিক প্রশিক্ষণের সময় করি। আমরা এই পদ্ধতি গুলির সাথে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য নিজেকে প্রশিক্ষণ দিই যাতে যখনই এর প্রয়োজন হবে, আমরা বাস্তবে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। এর জন্য ধর্ম অনুশীলনকে শখ হিসাবে নয়, বরং পুরো সময়ের দায়বদ্ধতা হিসাবে করা দরকার।

চরমতা ত্যাগ করা

আমরা ধর্ম অনুশীলন আমাদের পরিবারে প্রয়োগ করি। আমরা আমাদের মাতা-পিতার সাথে, আমাদের সন্তানদের সাথে আর কার্যক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় এটা প্রয়োগ করি। এটা করার সময় আমাদের বিভিন্ন চরমতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। আমরা এটার সম্বন্ধে সামান্য কিছু ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। আমাদের সমস্যার দোষ অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বা পুরোপুরি নিজের উপর দোষ চাপানোর চরমতা ত্যাগ করতে হবে- উভয় পক্ষই এতে অবদান রাখে। আমরা অন্য মানুষদের পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারি, তবে নিজেদের পরিবর্তন করা সবচেয়ে সহজ।

এই কারণে স্ব-উন্নতিতে আমাদের লক্ষ্য কেন্দ্রিত হওয়া উচিত; কিন্তু এটা করার সময় আমাদের আত্মরতি মূলক চরমতাকে ত্যাগ দিতে চেষ্টা করতে হবে। আত্ম-তন্ময়তার পরিস্থিতিতে আমরা কেবল নিজেদের জন্যই ভাবি আর অন্য কারও দিকে মনোযোগ দিই না। এটি এই অনুভূতিটিকে আরও জোরদার করতে পারে যে, আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং আমাদের সমস্যা গুলি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্য কারও সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর অন্যদের আঘাতও করে না।

চরমতা আরও একটি দিক হ’ল এই ভাবা যে, আমরা সবাই খারাপ বা আমরা সবাই ভালো। এটা সত্য যে, আমাদের কঠিন পক্ষগুলি শনাক্ত করতে হবে, যে পক্ষগুলির আমাদের কাজ করা দরকার। তবে আমাদের ইতিবাচক দিক গুলি, আমাদের ইতিবাচক গুণ গুলিকেও শনাক্ত করতে হবে, যাতে আমরা সেগুলি আরও বেশী করে বিকাশ করতে পারি। আমাদের অনেক পাশ্চাত্য মানুষদের মধ্যে আত্ম-সম্মান কম থাকে। আমরা যদি আমাদের সমস্যা এবং বিভ্রান্তির দিকে বেশী মনোযোগ দিই তাহলে এটি সহজেই আত্মসম্মানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এটা মোটেও কোন বিন্দু নয়।

আমাদের বিশৃঙ্খল আবেগ গুলির উপর লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি আমাদের ভাল গুণ গুলি স্মরণ ক’রে এটি ভারসাম্য রক্ষা করে রাখতে হবে। এমনকি ক্রূরতম ব্যক্তিদের মধ্যেও কিছু ভাল গুণের অভিজ্ঞতা থাকে। নিঃসন্দেহে তাদের কোনও কুকুরছানা অথবা বিড়ালছানা কোলে নেওয়ার, আদর করা, এবং তাদের প্রতি কিছুটা উষ্ণতা অনুভব করার অভিজ্ঞতা আছে। প্রায় প্রত্যেকেরই অন্ততঃ এটার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকে। এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, আমরাও অন্যদেরকে একটু স্নেহ করতে পারি, আর এইভাবেই আমরা আমাদের ইতিবাচক দিককেও দেখতে পাই। ধর্মের অনুশীলনের উদ্দেশ্য শুধু আমাদের নেতিবাচক দিক নিয়ে কাজ করা নয়; এর ভারসাম্য অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দিক গুলিকেও শক্তিশালী করার জন্য কাজ করা উচিত।

এটা করার ক্ষেত্রে, আমাদের ত্রুটি গুলি এবং ভালো গুণাবলী দেখার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করার জন্য আমাদের আরও একটি চরমতাকে ত্যাগ দিতে হবে। এই চরমতা হ’ল দোষ, “আমি খারাপ; আমার অনুশীলন করা উচিত এবং যেহেতু আমি অনুশীলন করছি না, তাই আমি আরও খারাপ।” আমাদের ধর্মের অভ্যাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে “উচিত” শব্দটি বাদ দেওয়া দরকার। এটি কখনই “হওয়া উচিত” বিষয় নয়। যদি আমরা আমাদের যে সমস্যা গুলি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে এবং ভবিষ্যতে আরও সমস্যা গুলি ত্যাগ দিতে চাই, তাহলে তার জন্য স্বাস্থ্যকর মনোভাবটি হ’ল আমাদের সহজ ভাবে ভাবতে হবে, “আমি যদি আমার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাই তবে এই অনুশীলনটি এটা করবে।” এখন আমরা অনুশীলন করি বা না করি, এটি আমাদের নিজস্ব পছন্দ। কেউ বলছে না, “আপনার এটা করা উচিত এবং যদি আপনি এটা না করেন, তাহলে আপনি খারাপ।”

তবে আমাদের আরও একটি চরমতা ত্যাগ করতে হবে, যেটা হল- “আমরা সবাই নিখুঁত, শুধু আপনার তথাগতগর্ভকে দেখুন এবং সবকিছুই হল নিখুঁত।” এটি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক চরমতা কারণ এটি আমাদের এমন মনোভাবের দিকে নিয়ে যেতে পারে যে আমাদের পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; আমাদের কোনও নেতিবাচক উপায় বন্ধ করা বা ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই কারণ আমরা ইতিমধ্যেই নিখুঁত। আমাদের নিজেদেরকে খারাপ ভাবা অথবা নিজেদেরকে নিখুঁত ভাবা- এই দুটি চরমতা ত্যাগ করতে হবে। মূলতঃ আমাদের নিজের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মকে সংহত করার জন্য এটিই মূল চাবিকাঠি। অতএব আমাদের জীবনের পরিস্থিতিকে ঠিক করার জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব নিই।

অনুপ্রেরণা

নিজের উপর কাজ করার সময় আমরা আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের পাশাপাশি আমাদের সাথে অনুশীলনকারী অন্যান্য ব্যক্তি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে পারি। তবে বেশীরভাগ লোকের জন্য আকাশে উড়তে সক্ষম বহু শতাব্দী আগের মহান আচার্যদের চমৎকার গল্প গুলি স্থায়ী অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে না। এটা এই জন্য হয় কারণ এই ধরণের গল্পের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করা সত্যিই কঠিন, তারা এইভাবেই আমাদেরকে একটা জাদুই ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। বর্তমানে বেঁচে থাকার উদাহরণ হল, যাদের সাথে আমাদের প্রকৃত পক্ষে কিছু যোগাযোগ রয়েছে, যদিও সেই যোগাযোগটি নূন্যতম।

বুদ্ধ বা সত্যিকারের যোগ্য শিক্ষকেরা আমাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন না, আর না আমাদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন। উদাহরণ স্বরূপ, তারা হল সূর্যের মতো। সূর্য মানুষকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে না; সূর্য প্রাকৃতিক ভাবে অন্যকে উষ্ণ করে রাখে। মহান আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই জিনিস। তারা আমাদের জীবন-যাপনের উপায়, চরিত্র এবং জিনিস গুলির সাথে তাদের আচরণের উপায় থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এবং প্রাকৃতিক ভাবে অনুপ্রাণিত করেন। এটি কোনও যাদু কৌশল নয়; যা সবথেকে বেশী প্রেরণাদায়ী হয় সেটা অত্যধিক বাস্তববাদী এবং ব্যবহারিক হয়।

আমার মনে আছে দুদ্‌জোম রিনপোছের কথা। বহু বছর আগে তিনি মারা গেছেন। তিনি ঞিঙ্‌মা পরম্পরার প্রধান ছিলেন এবং আমার অন্যতম শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ভয়াবহ হাঁপানি রোগ হয়েছিল। আমারও হাঁপানির সমস্যা রয়েছে, তাই আমি জানি যে নিশ্বাস নিতে কত কষ্ট হয়। আমি জানি যে, আপনি যখন স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারেন, তখন উপদেশ দেওয়া কতটা কঠিন হতে পারে, কারণ আপনার সমস্ত শক্তি পর্যাপ্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াতেই খরচ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আপনার শক্তির বাইরে বেরনো খুবই কঠিন। তবুও আমি দেখতাম, দুদ্‌জোম রিনপোছের ভয়াবহ হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও মঞ্চে উঠতেন এবং উপদেশ দিতেন। তিনি হাঁপানির কারণে নুন্যতম বিচলিত হতেন না এবং আশ্চর্যজনক ভাবে উপদেশ দেওয়ার সময় অবিশ্বাস্য উপায়ে এটির মোকাবিলা করতেন। এটি অবিশ্বাস্য রূপে অনুপ্রেরণা মূলক ছিল যথার্থতার সহিত, যাতে কোন জাদু কৌশল ছিল না। এটাই হল জীবনের বাস্তবিক পরিস্থিতির ব্যবহার এবং এটাই হল অনুপ্রেরণা।

আমরা যখন আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে চলি এবং উন্নতি করি, আমরা নিজের থেকেও অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি। এটিও অনুপ্রেরণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আমরা আমাদের নিজস্ব উন্নতির থেকে অনুপ্রেরণা পাই। তবে এটি করার ক্ষেত্রে আমাদের খুব নিপুন হতে হবে। বেশীরভাগ মানুষ এই বিষয়টিকে আবেগগত ভাবে পরিচালনা করতে পারেন না, কারণ আমরা যখন কিছুটা উন্নতি করে ফেলি, তখন আমাদের ভিতরে অহংকার এবং স্ব-গর্বের প্রবৃত্তির জন্ম হয়। সুতরাং আমাদের উন্নতির পরিভাষা সাবধানে নির্ধারণ করতে হবে।

পথের অগ্রগতি

প্রথমতঃ আমাদের বুঝতে হবে যে, উন্নতি কখনই রৈখিক হয় না; এটি সবসময় উপর-নীচ করতে থাকে। এটাই সংসারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, আর এটি কেবল উচ্চ বা নিম্ন পুনর্জন্মের কথা বলে না। উপরে বা নীচে করা দৈনন্দিন জীবনকেও বোঝায়। এখন আমি খুশি অনুভব করছি, পরক্ষণে আমি দুঃখ অনুভব করব। আমাদের মেজাজ উপর-নীচে করতে থাকে। কখনও অনুশীলন করার ইচ্ছা হয়, কখনও ইচ্ছা হয় না- এটা সারাক্ষণ উপর-নীচে করতে থাকে, তাই অবাক হবেন না। প্রকৃতপক্ষে এটি চলতেই থাকবে  যতক্ষণ না আমরা অর্হৎ হয়ে উঠি, একজন মুক্ত মানুষ, যিনি সংসার থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছেন। সেই স্তর অর্থাৎ অবিশ্বাস্য ভাবে উন্নত স্তর অবধি পৌঁছনো পর্যন্ত সংসারে অবিরত ভাবে উপর-নীচে ওঠা-নামা হতে থাকবে। অতএব, যখন খুব দীর্ঘ সময় অনুশীলন করার পরে, হঠাৎ করেই আমরা ব্যক্তিগত আবেগ জড়িত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ি, তখন হতাশ হবেন না। হঠাৎ আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি- এটা ঘটে! এর অর্থ এই নয় যে, আমরা খুব খারাপ অনুশীলনকারী। আমাদের সাংসারিক পরিস্থিতির বাস্তবিকতা দেখলে এটা তো স্বাভাবিক।

ধর্ম অনুশীলনে সাধারণতঃ অলৌকিক ঘটনা ঘটে না। আমরা যদি দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম প্রয়োগ করতে চাই তাহলে অলৌকিকতার আশা না করা উচিত, বিশেষতঃ আমাদের উন্নতিতে তো নয়ই। আমরা বাস্তবিক ভাবে উন্নতিকে কীভাবে পরিমাপ করব? পরম পূজ্য দালাই লামা বলেছেন যে, ধর্ম অনুশীলনকে এক বা দুই বছর পরে না দেখে পাঁচ বা দশ বছরের অনুশীলনের পরে পরীক্ষা করুন, “আমি পাঁচ বা দশ বছর আগে যা ছিলাম তার তুলনায় একজন অধিক শান্ত ব্যক্তি হয়েছি কী? আমি কি বিচলিত না হয়ে কঠিন পরিস্থিতি গুলি পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছি কি এবং মন খারাপ হওয়া বা তাদের দ্বারা ছুড়ে ফেলা হয়েছে কি?” যদি এমন হয় তবে আমরা কিছুটা উন্নতি করেছি এবং এটি অনুপ্রেরনা মূলক। আমাদের এখনও সমস্যা আছে, তবে এটি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। ফলে যখন পরিস্থিতি খারাপ হয় তখন আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে এতটা বিচলিত হই না। আমরা দ্রুত ভাল হতে সক্ষম হই।

আমরা যখন অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে নিজেকে দেখি, তখন মূল বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় যে, এই অনুপ্রেরণাটি আমাদের পথে এগিয়ে চলার শক্তি প্রদান করে। কারণ আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি এবং আমাদের নিজের সঠিক দিকে যাওয়ার বিষয়ে বিশ্বাস তখনই হয় যখন আমাদের এই পথের সম্পর্কে বাস্তবিক ধারণা থাকে, যথা- এই সাধারণ দিকটিতে যাওয়ার সময় আমরা ক্রমাগত ওঠা-নামা করে যাব।

ধর্মের অনুশীলনকে কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে একীভূত করা যায় সে সম্পর্কে এগুলি কয়েকটি সাধারণ ধারণা। আমি আশা করি এগুলি আপনাদের জন্য উপযোগী মনে হবে। ধন্যবাদ!

Top