ধ্যান এমনই একটা জিনিস যা অনেক পরম্পরাতেই ধ্যান দেখতে পাওয়া যায়, শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে এমনটিও নয়। সমস্ত ভারতীয় পরম্পরা গুলির মধ্যে নানা ধরণের ধ্যান প্রণালী দেখা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যান সম্পর্কে যেমন উপস্থাপিত হয়েছে তাতে আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
ধ্যান কাকে বলে?
“ধ্যান” শব্দটির অর্থ হল নিজেদের অভ্যস্ত করানো। এর তিব্বতী প্রতিশব্দ হ’ল “গোম”। এর তাৎপর্য হল একটি উপকারী অভ্যাসের বিকাশ। মূল সংস্কৃত হ’ল ভাবনা, এর সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ হল প্রকৃতার্থে কোন কিছু ঘটানোর নিশ্চিতকরণ। আমাদের একটি নির্দিষ্ট ধরণের উপকারী মানসিকতা অথবা মনোভাব রয়েছে এবং আমরা চাই সেটা হোক। অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের চিন্তা-ভাবনা এবং জীবনযাত্রায় মনের ওই অবস্থাটি যেন থাকে তা নিশ্চিত করি। কোন্ পরম্পরা নির্ভর ক’রে ধ্যান করা হবে সেই অনুযায়ী নির্দেশাবলী স্থির করে দেবে উপকারী অভ্যাস সমূহ এবং সেগুলির কার্যকর করার লক্ষ্য ও কারণ কী। সকল ভারতীয় পরম্পরায় পদ্ধতিটি ত্রিস্তরীয়ঃ প্রথমে শ্রবণ, তারপর চিন্তন এবং অবশেষে প্রকৃত ধ্যান।
উপদেশ শ্রবণ করা
মনে করুন আমরা করুণার মতো একটি উপকারী অভ্যাস গড়ে তুলতে চাই। করুণার বিকাশ বা যেটুকু করুণার ভাব মনে আছে, তার বিকাশের জন্য প্রথমেই এই বিষয়ে কিছু উপদেশ আমাদের শ্রবণ করা প্রয়োজন। প্রাচীন ভারতে কোন উপদেশই লেখা হয়নি। সে সব ছড়িয়েছে মৌখিক ভাবে। এই কারণে, কেউ যদি ধ্যান শিখতে চান তাহলে তাকে প্রথমে “শ্রবণ” করতে হয়েছে। এই কারণে প্রথম পদক্ষেপকে বলা হয় “শ্রবণ করা”।
বর্তমান কালে আমরা অবশ্যই নানা ধরণের উপদেশ পড়তে পারি। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্তরে কেউ আমাদের বলবে এবং আমরা তা শুনব এমনটি আর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তারপরও এর পিছনে যে মূল নীতিটি রয়েছে তা আজও প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন কালে হতো কি, শ্রোতা যেটুকু শুনতেন তাকে সেটা নিখুঁত ভাবে স্মরণে রাখতে হতো। উপদেশদাতা নিজ স্মৃতি নির্ভর করে যে উপদেশ বলতেন, তাতেও স্মৃতি দৌর্বল্যের কারণে নিখুঁত নাও হতে পারত। কিছু ভুল দেখা দিতেই পারত এবং তা সমস্যা হয়ে দাঁড়াত।
প্রভেদমূলক চেতনা
উপদেশ শ্রবণ করার সময়, আমাদের মধ্যে কিছু বিকাশ ঘটানোর প্রয়োজন যাকে বলা হয় “শ্রবণজনিত প্রভেদমূলক চেতনা” যার বিকাশ ঘটে শ্রবণ থেকে। তিব্বতী শব্দ “শেরাব” (সংস্কৃত- প্রজ্ঞা) প্রজ্ঞা হিসাবে অনুদিত হয়। কিন্তু প্রজ্ঞা শব্দটির ব্যবহার খুবই অস্পষ্ট। এর কোন নির্দিষ্ট অর্থ নেই। একদল লোক যদি এই প্রজ্ঞা শব্দটি শোনে তাহলে এই শব্দ দ্বারা সকলে ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ ধরে নেবেন। সুতরাং “শেরাব” শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে এই প্রজ্ঞা (Wisdom) শব্দটি খুব একটা সাহায্য করে না। এই কারণে আমি “শেরাব” শব্দটির অনুবাদ করার সময় লিখি “প্রভেদমূলক চেতনা।”
পূর্ব থেকেই উপস্থিত এমন মানসিক উপাদানের (চৈত্ত) উপর এই “প্রভেদমূলক চেতনা” নির্ভর করে। একে আমি “পৃথক করণ” হিসাবে অনুবাদ করি। অধিকাংশ মানুষ একে “চিহ্নিতকরণ” শব্দে অনুবাদ করে। কিন্তু “চিহ্নিতকরণ” শব্দটিও যথার্থ নয়। “চিহ্নিত” মানে বিষয়টিকে আপনি আগে থেকেই চেনেন এবং পুনর্বার আপনি তাকে চিনতে পারলেন, এটা সঠিক নয়। “পৃথক” শব্দটি কোনও একটি বিষয়কে “এই” বলে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। অন্য সকল বিষয়ের সঙ্গে পার্থক্য দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সেগুলি “এইটি” নয়। এইটি বা এইটি নয় অথবা এইটি বা ওইটির মধ্যে পার্থক্য আমরা বুঝতে পারি। কারণ সব কিছুর একটি নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে অথবা যখন আমরা কোনও বিষয়বস্তু সম্বন্ধে সচেতন হই তাকে বোঝার মত চিহ্ন থাকে। একটি সহজ উদাহরণ এই যে ছোট্ট শিশুরা “ক্ষুধার্ত ও ক্ষুধার্ত নয়” এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এই দুটি শারীরিক অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য শিশুদের শব্দের প্রয়োজন হয় না। “ক্ষুধার্ত” বা ক্ষুধার্ত নয়” ধারণা গুলি বোঝাতে তাদের গভীর উপলব্ধিরও দরকার হয় না। যাই হোক না কেন, এই দুটি অবস্থার পার্থক্য তারা করতে পারে। কারণ এই দুটি অবস্থার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট রয়েছে, তা হ’ল একধরণের নির্দিষ্ট দৈহিক অনুভূতি।
প্রভেদমূলক চেতনা ওই “পৃথকীকরণ”-এ নিশ্চয়তা প্রদান করে। “ইহা নিশ্চিতভাবেই এই এবং অন্যটি নয়।” আমরা যখন কোন উপদেশ শ্রবণ করি বা পড়ি এই নিশ্চয়তার প্রয়োজন আছে। জানার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস যে, “এই হ’ল প্রকৃত উপদেশ, এটি মিথ্যা নয়।” “এই হ’ল প্রকৃত উপদেশ,” প্রকৃতপক্ষে এটি বোঝা খুব কটিন। কারণ ধর্মগ্রন্থ গুলি যা বলছে তা অনুধাবন করা সহজ নয়। সাধারণতঃ এগুলির ব্যাখ্যার জন্য আমরা কোন বই বা গুরুর উপর নির্ভর করি। কিন্তু আপনি কী করে বুঝবেন যে, সেই গুরু প্রামাণিক ও নির্ভরযোগ্য কিনা? কেউ হয়তো বৌদ্ধ মতবাদের বিষয়ে উপদেশ দেয়, কেউ দেন মৈত্রী ও করুণার উপদেশ। এমনও হতে পারে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম যা বলে তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে না। তাই এই প্রভেদমূলক চেতনার দ্বারা আমাদের দৃঢ় নিশ্চিত হতে হবে যে, আমরা যে উপদেশ শ্রবণ করি বা পড়ি তা যেমনটি হওয়া উচিত ঠিক তাই; নিশ্চিত হতে হবে এইটিই প্রকৃত উপদেশ।
বৌদ্ধ উপদেশ হিসাবে মান্যতা পেতে গেলে সেই উপদেশের বিশিষ্ট কিছু মাপদন্ড থাকে। খোঁজ খবর নিয়ে আমরা জানতে পারি যে লেখক বা এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি প্রকৃতার্থে যোগ্য কিনা। তা নির্ণয় করার জন্য আমরা অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে পারি। যেমন ধরুন এই ব্যক্তি কোনো সদ্গুরু কর্তৃক আশ্রিত কিনা বা গুরুর সঙ্গে এই ব্যক্তির সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি। এই ব্যক্তির গুরু প্রাচীন কোন বৈধ গুরুকুল পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত কি? খোঁজ নেওয়ার জন্য এই প্রশ্ন গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন বিখ্যাত লেখক লিখেছেন তাই তুলে নিলাম এরকম করা অনুচিত। এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে। ভাষণ শুনতে হলেও একই নীতি প্রযোজ্য হয়।
উপদেশের বিষয় নির্ধারণে প্রভেদের প্রয়োগ
এছাড়া প্রতিটি বৌদ্ধ উপদেশের একটি প্রসঙ্গ রয়েছে, তা একটি দার্শনিক পরম্পরা, যা থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। কিসের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা জানা খুবই মহত্বপূর্ণ। এর কারণ হল যে, একটি পরিভাষা যেমন ধরুন “কর্ম” একে বিভিন্ন বৌদ্ধ পরম্পরা ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তারপরও সেই পরম্পরাটি “বোধ-তত্ত্বের” মতো ধর্মের অন্য বিষয় গুলিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করে তার সঙ্গে কর্মের এইসব ব্যাখ্যাও মিলে যায়। অন্য যে সকল উপদেশ শুনেছি তার সঙ্গে এগুলি যেন যুক্ত করতে পারি, এই কারণে কোন পরম্পরা থেকে এই উপদেশটি এল সে বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ বার্তালাপেও বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত শব্দের ব্যবহার জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে করুন আপনি শুনলেন “বোন”। শব্দটি তিব্বতের প্রাক্ বৌদ্ধ যুগের পরম্পরাকে বোঝায়। কিন্তু ফরাসী ভাষায় “বোন” (Bon) মানে হল ভাল। সুতরাং ভাষার বিষয়টি না জানলে ‘বোন’ শব্দটি শুনলে আপনি বিভ্রান্ত হতে পারেন। লোকটি ফরাসী ভাষায় ‘বোন’ বলছে না তিব্বতী বিষয়ে বলছে। কোন ভাষার অন্তর্গত তা না জেনে শুধু শব্দের উপর নির্ভর করলে তা আপনাকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
বৌদ্ধ পরিভাষা নিয়ে চর্চা করার সময় প্রসঙ্গ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি হয়তো শূন্যতা নিয়ে অধ্যয়ন করছেন। ভারতীয় বৌদ্ধ পরম্পরা শূন্যতাকে একরকম ভাবে ব্যাখ্যা করেছে আর অপর পরম্পরা গুলি ব্যাখ্যা করেছে অন্যভাবে। এমনকী ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শন পরম্পরার একটি শাখাতেও প্রতিটি শাখা শূন্যতার ব্যাখ্যা করেছে নানা ভাবে।
পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে পড়াশুনোর একটি অসুবিধা হল যে, এখানে একটি বিষয়কেই বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই যুগে, বিশেষ করে ইন্টারনেটের যুগে যখন আমরা এশীয়ার সকল বৌদ্ধ পরম্পরাকে একসঙ্গে দেখতে পাই বিষয়টি আরও জটিল ও বিভ্রান্তমূলক হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি একই দেশের বৌদ্ধ পরম্পরাতেও, যেমন তিব্বত সেখানেও নানা বৈচিত্র ও ব্যাখ্যা দেখা যায়।
বিষয়টিকে একটু বিশদে বলা যাক। মনে করুন আমরা কোন একজন গুরুর কাছে কর্মের বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করছি। আমরা যা পড়াশোনা করছি তাতে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য গুরুজী যা ব্যাখ্যা করছেন তা ছাড়া অন্য সব ব্যাখ্যা সরিয়ে রাখতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা বৌদ্ধ ব্যাখ্যা পড়ছি, হিন্দুদের নয়। বৌদ্ধদের মধ্যেও আমরা পড়ছি ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার পরম্পরা, পালি থেরবাদী পরম্পরা নয়। আমরা পড়ছি বৈভাষিক মতবাদ, চিত্তমাত্রের দৃষ্টিকোণে নয়। এছাড়াও পড়ছি বৈভাষিক মতবাদের গেলুগ পরম্পরার ব্যাখ্যা, কাগ্যুদ্ পরম্পরার ব্যাখ্যা নয়। প্রসঙ্গ বা পটভূমিটি কী তা আমাদের ভাল ভাবে জানতে হবে। কারণ দর্শনের ভিত্তিতে কর্মের ব্যাখ্যাও হয় বিভিন্ন। ধর্মের কোন একটি বিষয়ে গেলুগ পরম্পরা যেমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে তা যদি কাগ্যুদ্ পরম্পরার সঙ্গে মেলাতে যাই, বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যদি সব গুলি ব্যাখ্যার খিচুড়ি পাকাই, বিভ্রান্তি বাড়বে বইকি কমবে না। আমার অন্যতম গুরু, গেশে নাওয়াঙ্ ধারগ্যে পাশ্চাত্য দেশবাসীদের বিষয়ে একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- “তোমরা পাশ্চাত্য দেশবাসীরা সব সময় দুটো জিনিসের তুলনা কর। দুটোর একটাকেও ভাল করে বুঝতে পার না। অবশেষে, আরও বেশী বিভ্রান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দাও তোমরা।” এ থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করা খারাপ নয় কিন্তু একটি পদ্ধতি বা পরম্পরা থেকে জানাই ভাল হবে। একটি পদ্ধতি থেকে ভাল করে জানার পর অন্যদিকে দেখা যেতে পারে যে, এর পার্থক্য কোথায়। আর প্রশংসাও করা যাবে, কিন্তু ভাল করে জানার আগে তা হয় না।
অতএব আমরা যদি বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত যেকোন বিষয়, যেমন কর্ম বা শূন্যতা নিয়ে ধ্যান করতে চাই তাহলে শ্রবণ থেকেই প্রভেদমূলক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে।
- এই শব্দগুলিই বলা হয়েছে, অন্য শব্দ নয়।
- বিষয়টির বক্তব্যের উপর বক্তার তথ্য সূত্র নির্ভুল, তিনি অনির্ভরযোগ্য এমন নয়।
- এই হল একটি দার্শনিক ধারা যা থেকে ব্যাখ্যাটি এসেছে, এর অন্যথা নয়।
একবার আমরা যখন শ্রবণ থেকে উদ্ভূত প্রভেদমূলক চেতনা অর্জন করে ফেলি, আমরা তখন পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য এগোতে তৈরী হয়ে যাই।
শ্রুত বিষয়ের উপর চিন্তন
পরবর্তী পর্যায় হ’ল- চিন্তন থেকে উদ্ভূত প্রভেদমূলক চেতনা। ‘চিন্তন’ বলতে কী বোঝায়? এখানে কোন কিছুর অর্থ বোঝার চেষ্টাই হল চিন্তন বা চিন্তা করা। তাহলে ‘কোন কিছুর অর্থ বোঝা’ এর মানে কী? তিব্বতী পরিভাষার সংজ্ঞাকে অনুবাদ করলে ‘বোঝা’ বা ‘অনুধাবন’ এর অর্থ হবে কোন কিছুর বিষয়ে নির্ভূল ও নিশ্চিতকরণ।
ঘটনা চক্রে, মন বা মানসিক কর্ম বিষয়ে পাশ্চাত্য ভাষায় কাজ করার দেখা যায় যে, এর মূল সংস্কৃত এবং তিব্বতী শব্দার্থের সঙ্গে আমাদের ভাষার অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই কারণে মূল এশীয় ভাষা গুলির অধ্যয়ন এবং শব্দার্থের নির্ণয় এশীয় ভাষার দৃষ্টিকোণে করতে পারলে খুবই ভাল হয়। অর্থাৎ শুধু শব্দকোষের অনুবাদ পড়া নয় বরং শব্দার্থ-মর্মার্থ ইত্যাদি বোঝার জন্য ভাষার চর্চা জরুরী। আপনি তা করতে পারলে বৌদ্ধ উপদেশাবলী অনুধাবনের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বিশ্লেষণাত্মক উপায় পেয়ে যাবেন।
কথিত শব্দাবলীর অনুধাবন
“বোঝা” বা “অনুধাবন” শব্দটি উপদেশ শ্রবণের সঙ্গেও যুক্ত করা যেতে পারে। সেইভাবে দেখলে এইভাবে সেটা ব্যক্ত করা যেতে পারেঃ “আপনি ঐ শব্দগুলি বলেছিলেন তা আমি বুঝতে পেরেছি।” এই বাক্যটির মধ্যে যদি ‘আপনি’ শব্দটির উপর জোর দেওয়া হয়, তাহলে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি যে, আপনিই কথাগুলি বলেছেন এবং বাক্যটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও তাই। আমরা মনে করি না যে, আপনি সেটা বলেন নি বা অন্য কেউ বলেছে। আপনি যেটা বলেছেন এ আমরা শুনেছি এবং আমাদের শোনায় কোন ভুল হয়নি।
যদি ‘ঐ শব্দ গুলি’ এর উপর জোর দেওয়া হয় তাহলে “আপনি ঐ শব্দ গুলি বলেছিলেন তা আমি বুঝতে পেরেছি” বাক্যের অর্থ ভিন্ন হতে পারত। “আপনার বলা প্রতিটি শব্দ আমি বুঝেছি। হয়তো আমি শব্দ গুলির অর্থ ও তাৎপর্য ভাল করে বুঝিনি, তা অন্য বিষয়। কিন্তু আমি নির্ভুল ভাবে বুঝেছি যে, আপনি এই শব্দ, বাক্যাংশ এবং এই বাক্যটিই বলেছেন।” যা বলা হয়েছে তা নির্ভুল ভাবে শুনেছি এই বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। যা শুনেছি তা সঠিক কী না জানার জন্য অন্যরাও কী শুনেছেন তা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। রেকর্ড করা হলে তা শুনতে পারি। বক্তার কন্ঠস্বর এবং রেকর্ডিং পরিষ্কার থাকলে আমরা যে নির্ভুল শুনেছি তা নিশ্চিত হওয়া যায় এবং এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আওয়াজ এবং রেকর্ডিং ভাল না হলে, এই বিষয়ে অন্যদের সাহায্য নিতে পারি, জানতে পারি ওরা কী শুনেছে। আমরা যা শুনেছি তার সঙ্গে তাদের শ্রুত বিষয় মিলিয়ে নিতে পারি। আমরা যখন রেকর্ডিং করা উপদেশের উপর নির্ভর করি, তখন বিষয়টি খুবই মহত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। অতএব শ্রবণ থেকে উদ্ভূত প্রভেদমূলক চেতনা ব্যবহার করে আমরা যে শব্দ গুলি শুনেছি তা যে বুঝতে পেরেছি এবং নির্ভুল এই বিষয়ে নিশ্চিত হই।
শব্দার্থ অনুধাবন
এখন দ্বিতীয় পর্যায়- চিন্তন। ত্রিস্তরীয় অনুধাবনের পদ্ধতির দ্বিতীয় পর্যায়। শব্দার্থের সঠিক অনুধাবনের পদ্ধতিটি জানা জরুরী। আমরা যদি কোন একটি উপকারী বিষয়ে অভ্যস্ত হতে চাই সেক্ষেত্রে শুধু শব্দ জানলে হবে না, শব্দার্থও জানতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, কোন-কোন ব্যক্তি তিব্বতী ভাষায় পদ গুলি পাঠ করে কিন্তু এর অর্থের বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। এই ভাবে অর্থ না জেনে পাঠ করলে কীভাবে উপকারী অভ্যাস গড়ে উঠবে?
আপনারা দেখবেন অনেক তিব্বতী গুরু তিব্বতীতে প্রার্থনা এবং সাধনা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। অবশ্যই শতাব্দী প্রাচীন একটি বিধিতে অংশগ্রহণ করলে তাতে লাভ আছে। আপনার বোধ হবে যে, আপনি একটি পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন এটি জেনেও ভাল লাগবে যে, বহু দেশের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষ একই বিষয় একই রকম ভাষায় পাঠ করছে। তিব্বতী শব্দ গুলির অর্থ না জানলে, এই শব্দ গুলি যে উপকারী অভ্যাস গড়ে তোলার কথা বলছে তা বোঝা সম্ভব হবে না। এই বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় শুধু পাঠ করলে যথেষ্ট হবে না। তাই আমাদের অর্থ জানতে হবে এবং সেই অর্থ হতে হবে নির্ভুল ও নিশ্চিত। এর মানে হ’ল প্রভেদমূলক চেতনার সাহায্যে কী বোঝায় আর কী বোঝায় না তার পৃথকীকরণ করা। শব্দগুলি প্রকৃতপক্ষে কী বোঝাতে চাইছে তা নিশ্চিত ভাবে অনুধাবনের জন্য আমরা যুক্তি ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি গ্রহণ করি।
উপদেশের শব্দগুলি কী বোঝায় সে বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় লাভ
কোন একটি বিষয়ে কীভাবে সত্যিই আমরা প্রত্যয়ী হব, এরকম নিশ্চিত অনুধাবন লাভের পদ্ধতিটি কঠিন। যা অনুভব দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না, এমন কিছুর উপর প্রত্যয়ী হতে গেলে যুক্তির উপর নির্ভর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি আছেন যারা উত্থাপিত যুক্তি যা প্রমাণ করে, তাতে বিশ্বাস করেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে তো যুক্তিযুক্ত হলেও সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ওরা মানতে চান না। আমরা যদি তাদের মতো হই তাহলে ধর্ম চর্চায় সেটা বহুবিধ বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
তাহলে ধরে নিচ্ছি যে, আমরা যুক্তি-নির্ভর সিদ্ধান্ত মান্য করি। এরপর অনিত্যতাকেই ধরা যাক যুক্তি ও বিশ্লেষণের বিষয় ও পদ্ধতি। এ থেকে আমরা কী প্রমাণ করব? সেটা হল যা কিছু কার্য-কারণ সম্পর্কের ফলে সৃষ্টি হয় অন্তিমে তার নাশ অনিবার্য। সেটা যা কিছু হতে পারে, যেমন- একটি কম্পিউটার, গাড়ি, আমাদের দেহ অথবা এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এসবই কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ভর করে সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু ঐ কারণ ও সহযোগী উপাদান করে বা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু ঐ কারণ ও সহযোগী উপাদান গুলি প্রতি মুহুর্তে নবীকরণ হয় না, তাই এদের উপর নির্ভর করে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেই।
উদাহরণ হিসাবে ভাবতে পারেন যে, আপনি কিছু একটা জিনিস কিনলেন আর অবশেষে তা নষ্ট হল, ভেঙে গেল। যেমন- একটি গাড়ি কিনলেন, একসময় যা ভেঙে যাবে। ফল বা ফুলের চারা লাগালেন তাও একদিন মরে যাবে। এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই। এমন কোন উদাহরণ নেই যা বানানো হয়েছে অথচ কোন দিন তা ভাঙেনি এবং তা শাশ্বত। যদি এটা বানানো হয়ে থাকে অর্থাৎ বস্তুটি আগে ছিল না, পরে বানানো হয়েছে, তাহলে তা ভাঙবেই। কেন হবে? নতুন কিছু সৃষ্টি তখনই সম্ভব, যখন তা হবে কারণ ও তার উপাদান নির্ভর। কিন্তু যে মুহুর্তে নতুন জিনিসটির উদয় হল, সেই মুহুর্তে সেই কারণ ও সহকারী উপাদান গুলি যা বস্তুটির সৃষ্টির সময় সহায়ক হয়েছে, তাদের ভূমিকা পাল্টে গেল। কারণ, তাদেরও সৃষ্টি হয়েছে অন্য কারণ ও সহকারী উপাদান নির্ভর করে। এই কারণে ঐ বস্তুটির নিরবচ্ছিন্ন সৃষ্টির সহায়ক এমন কোন প্রলম্বিত ‘বর্তমান কাল’ নেই। অন্য ভাবে বললে, যখন কোন কিছুর উৎপত্তির জন্য কারণ-সহযোগী উপাদান গুলো দেখা দেয় তারা তখন ‘বর্তমানে’ থাকে না। অতঃপর সেই সহযোগী উপাদান নির্ভর যা কিছু সৃষ্টি হোক না কেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কারণ প্রথমে ঠিক যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক সেরকমই নিরন্তর তা বজায় রাখার জন্য উপাদান গুলির যে রকম নিরন্তর অবদান থাকার প্রয়োজন তা থাকে না। এর অবস্থার পরিবর্তন হবে কারণ বস্তুটি তখন অন্য কারণ ও সহযোগী কারণের দ্বারা প্রভাবিত হবে।
আর একটি উদাহরণ হ’ল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। অনেক অনেক কারণ ও প্রত্যয়ের উপর একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। যেমন- আমার একটি নির্দিষ্ট বয়স ছিল, অন্য এক জনের ছিল নির্দিষ্ট বয়স, এই বিষয়টি আমার জীবনে ঘটছিল। তেমনই একই বিষয় ঘটছিল অন্য জনের জীবনে এবং এসব ঘটছিল সমাজের মধ্যে। এই সমস্ত বিষয় আমাদের সমর্থন করেছে মিলিত হওয়ার জন্য এবং একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার জন্য। কিন্তু এই সহযোগী বিষয় গুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং ওরা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। আমাদের বয়স বেড়েছে, আমাদের জীবনে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আমরা দীর্ঘদিন এক সঙ্গে থাকলেও আমাদের মধ্যে যে কেউ অন্য জনকে রেখে দেহত্যাগ করতে পারি। কারণ এবং নানাবিধ সহযোগী কারণের উপর নির্ভর হওয়ায় আমাদের মধ্যে যে সম্পর্কটি রয়েছে তা পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং চিরস্থায়ী হতে পারে না। যুক্তি দিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও আমরা এই সত্যকে মেনে নিতে চাই না।
আর একটি উদাহরণ- ধরুণ একটি কম্পিউটার কেনা হল, আমরা আশা করি যে, এটা থাকবে, ভাঙবে না। কিন্তু তা হয় না, ভেঙে যায়। কেন ভাঙে? এটা ভেঙেছে কারণ একে বানানো হয়েছে। এর ভেঙে যাওয়ার মুহুর্তে যাই ঘটুক না কেন, ঐ অবস্থাটিই ছিল এর ভাঙার কারণ। এই ভাঙার প্রকৃত কারণ হল- ওকে বানানো হয়েছিল। যেমন অনেক সময় বলা হয় “এই লোকটির মৃত্যুর কারণ কী? জন্ম গ্রহণই তার মৃত্যুর কারণ।” একটি রসিকতা এই প্রসঙ্গে খেটে যায়- “তুমি কী জানো জীবন কাকে বলে? এটি একটি যৌন সঙ্গম জাত রোগ যাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ।” দুঃখজনক হলেও এটা সত্য। যখন কোন একটি বিষয়, যেমন- অনিত্যতা নিয়ে ভাবি, যুক্তি দ্বারা বুঝতে চেষ্টা করি তখনও একধরণের অবিশ্বাস বা প্রতিরোধ দেখা দেয়। যে তথ্যটি প্রস্তুত করা হয় তা বিশ্বাস করতে চাই না। অনিত্যতা যে জীবনের একটি সত্য তা অস্বীকার করি। এই কারণে বিষয়কে গভীরভাবে বোঝার জন্য বারংবার যুক্তি দিয়ে অনুধাবন করা প্রয়োজন আছে। চিন্তনের মাধ্যমে আমরা একটি ‘অনুধাবন’-এর পর্যায়ে পৌঁছাই একেই বলা হয় প্রভেদমূলক চেতনা; চিন্তন থেকেই সেটা জাগে। শব্দার্থকে আমরা সটিক ভাবে বুঝি এবং সেই বিষয়ে হই নিশ্চিত। অন্যভাবে বললে শব্দটি যা বোঝায় না তা যুক্তির মাধ্যমে দূর করি। অনিত্যতার অর্থ এই নয় যে, আমার কম্পিউটারটি ভাঙতেও পারে। এর অর্থ হল একসময় সেটা ভাঙবেই। সুতরাং যাই হোক না কেন “যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তার নাশ হবেই”, এই বিষয়ে সন্দেহাতীত হয়ে অন্তত বুঝতে পারি অনিত্যতার প্রকৃত অর্থ কী।
যে উপদেশ আমরা শুনলাম তা সত্য এবং উপকারী এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া
তারপর যে শব্দগুলি আমরা শুনলাম শুধু তার অর্থ সম্বন্ধে সন্দেহাতীত হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং বাস্তবে এগুলো কী বোঝায় সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে। অনিত্যতার যে উদাহরণটি আলোচনা করলাম তাতে হয়তো আমরা এর শব্দার্থ বুঝেছি। কিন্তু এটা আসলে সত্য না মিথ্যা তা কি আমরা বিশ্বাস করি? এতে কি আমাদের নিশ্চয়তা জন্মেছে? সত্যিই যদি আমরা অনিত্যতার উপর চিন্তা করি তবে দেখব যে এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই। এইভাবে সত্যিই বিশ্বাস করব যে অনিত্যতা একটি মৌলিক নিয়ম। চিন্তার প্রক্রিয়াটি এভাবেও হতে পারে- “আমি নিশ্চয়ই মরে যাব। যাদের জন্ম হয়েছে সবাই দেহত্যাগ করেছে। কেউ জন্ম নিয়েছেন অথচ মরেননি, এমন কোন উদাহরণ নেই। সুতরাং আমি মরব না এমন বিশ্বাসের কি কোন যৌক্তিকতা আছে? না, তা নেই।”
কোন একসময় আমরা মারা যাব, এই কথাটিতে যদি নিঃসংশয় হতে পারি, তাহলে এই জীবনকে যতটা সম্ভব অর্থবহ করার জন্য আমরা চেষ্টা করব। প্রায়ই দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তাদের একটি অনুভব জাগে। “আরে, আমি বেঁচে আছি! আমি বাকী জীবনটা যথাসম্ভব কাজে লাগাবো।” আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলব, এই বোধের জন্য মৃত্যমুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং চিন্তনের মাধ্যমে আমরা প্রথমে অর্থকে নিশ্চিত ও যথাযথ ভাবে বুঝি। তারপর আমাদের মধ্যে নিশ্চয়তা জাগে যে ‘ইহা সত্য’। তৃতীয়তঃ এই বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস জাগাতে হবে যে, একে যদি আমার জীবনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করে নিই এতে আমার উপকার হবে।
অর্থের অনুধাবন, এটা সত্য এবং তা উপকারী এই সবই চিন্তন জাত প্রভেদমূলক চেতনার অংশ বিশেষ। এই পদ্ধতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সময় সাপেক্ষ। আমরা যে উপদেশ শুনেছি বা পড়েছি তা নিয়ে শান্ত হয়ে বসে গভীর চিন্তা করা প্রয়োজন। না হলে ধরুণ, অনিত্যতার উপরই যদি ধ্যান করতে চেষ্টা করি; কী করণীয় তা জানা নেই, সেই ক্ষেত্রে বসে থাকাই সার হবে। তা অনেকটা হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকা আর তাকেই ভেবে বসি ধ্যান করছি। তা মোটেই ধ্যান সাধনা নয়। তাহলে ধ্যান কাকে বলে?
তিন ধরণের ধ্যান
উপদেশের শ্রবণ ও চিন্তন, এই দুটি বিষয়ের মাধ্যমে আমরা নানা রকম প্রভেদমূলক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হই। এই প্রভেদমূলক চেতনাটি ধ্যানের মাধ্যমে আসে। আমাদের লক্ষ্য- একটি উপকারী মানসিক অবস্থা, এই অবস্থাটি অপরাপর মানসিক অবস্থা থেকে ভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট; এই চেতনা দ্বারা একাগ্রচিত্ত হয়ে তা আমরা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। এই প্রভেদমূলক চেতনা লাভের জন্য কাঙ্খিত এই মানসিক অবস্থটিকে বারবার জাগিয়ে তার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। অনেক রকম ধ্যান রয়েছে, যাদের মাধ্যমে আমরা সেটা করতে পারি। এখানে তিনটি সহজলভ্য ধ্যানের কথা বলা হচ্ছে।
একটি বিষয়ে মনসংযোগ
প্রথম ধ্যানটি কোন একটি বিষয়ের উপর মনসংযোগের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। আমরা যে কোন বিষয়ের উপর মনসংযোগ করতে পারি। আমাদের যেটা দরকার সেটা হ’ল ঐ বিষয়টির উপর যেন পূর্ণ মনসংযোগ বা একাগ্রচিত্ত হতে পারি এবং সেটাই হবে আমাদের প্রচেষ্টা। তা হতে পারে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতি অথবা হতে পারে মনোপটে বুদ্ধমুর্তি, অথবা মনের স্বভাবের উপর একাগ্র হওয়া, এসবই কোন একটি বিষয়ের উপর মনসংযোগ। তিব্বতী পরম্পরায় মনসংযোগ বা একাগ্র হওয়ার জন্য এই তিনটি বিষয় সর্বাপেক্ষা অধিক ব্যবহৃত হয়।
এই ধরণের ধ্যানের ঈষৎ ভিন্নতা আছে, তা হল একটি বিষয়ের উপর একাগ্রচিত্তে মনসংযোগের সময় বিষয়টিকে একটি বিশেষ দিক দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা, যেমন ধরুন অনিত্যতার মতো বিষয়। অনিত্যতার উপর এই উপলব্ধি নিয়ে একাগ্রচিত্ত হলে এ যে সত্যিই অনিত্য তা বোঝা যায়। এইভাবে কোন কিছুকে নিত্য ভেবে আসক্ত না হতে তা সহায়ক হয়। অপর একটি কার্যকর উদাহরণ হ’ল- ধরুণ আপনার কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে বা একটি সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, তিনি আপনাকে ফোন করছেন না বা দেখা করতেও আসছেন না। তাতে আপনার মন খারাপ হয়ে গেল। এই উদাহরণটিতে একটি বিষয় আছে যা আপনাকে ভাল করে বুঝতে হবে এবং হতে হবে নিশ্চিত, এটি সত্য। তা হল “আমার বন্ধুর জীবনে আমিই একমাত্র ব্যক্তি নই।” তার জীবনে আমি ছাড়াও আরও অনেকে রয়েছেন। অতএব তিনি শুধু আমাকেই সময় দেবেন এবং আমিও তার সময়টুকু অন্য কাউকে দিতে দেব না; এরকম ভাবনা ভীষণ অযৌক্তিক।” এখানে আপনি একটি অসম্ভব বিষয় কল্পনা করে তার প্রতি অন্ধ অনুরাগে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন সেটা হ’ল- ‘আমার বন্ধুর জীবনে আমিই একমাত্র ব্যক্তি’। এইভাবে আপনি যখন এই ভেবে বিপর্যস্ত যে, আপনার বন্ধু আপনাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছে না; তখন তাকে আপনি একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবেন- “আমাকে ছাড়াও তার জীবনে অনেক মানুষ ও বিষয় আছে।”
সুতরাং আমরা যখন ধ্যানের কথা বলি আমরা কোন রহস্যময় আদিভৌতিক বিষয়ের কথা বলি না। আমরা কোন কল্পনার রাজ্যে যাত্রা করছি না। বরং ধ্যান হল এমন এক বাস্তব উপায় যা আমাদের জীবনের দুঃখ, কষ্ট ও সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
তাহলে প্রথম পর্যায়ের ধ্যান হল- একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোন একটি বিষয়ের উপর একাগ্র হওয়া, বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে বা বুঝে উপলব্ধির স্তরেও হতে পারে; যেমনটি আমাদের বন্ধুর বিষয়ে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
একটি মানসিক অবস্থার বিকাশ
দ্বিতীয় পর্যায়ের ধ্যান হল একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা। যেমন- ধরুণ মৈত্রী ও করুণার মতো বিষয়ের বিকাশ সাধন। তাতেই মনসংযোগ করে অনুভব করা। এখানে মৈত্রী ও করুণার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে না বরং একটি আবেগ বা অনুভবের বিকাশের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
একটি ঐকান্তিক ইচ্ছার সৃষ্টি
তৃতীয় পর্যায়ের ধ্যান হল একটি বিষয় সম্পর্কিত লক্ষ্য নিয়ে তার প্রাপ্তির জন্য মনসংযোগ। উদাহরণ হিসাবে আমাদের নিজের বোধিলাভের উপর মনসংযোগ হতে পারে। সেটা তো আমরা এখনও পাইনি, তাই ‘আমি সেটা লাভ করতে যাচ্ছি’ এই ইচ্ছা নিয়ে তাতে মনসংযোগ করা, একে বলা হয় ‘বোধিচিত্ত ধ্যান’। আমরা যখন বোধিচিত্তের উপর ধ্যান করি যাকে অনেক সময় ‘আলোকপ্রাপ্ত চিত্ত’ রূপে বলা হয়, তখন আমরা যার উপর একাগ্র হই তা সঠিক বোধ নয়। এমনকি বুদ্ধের বুদ্ধত্বও নয়। বরং আমরা আমাদের নিজস্ব বোধির উপর মনোনিবেশ করি। আমরা এখনও বোধি লাভ করিনি, কিন্তু তা লাভ করতে পারি। আমাদের মধ্যে অবস্থিত বুদ্ধত্বের বীজ (তথাগতগর্ভ) ও কঠোর পরিশ্রমের উপর আস্থা রেখে আমরা নিশ্চিত হই যে, বোধি লাভ করব। সুতরাং এই তৃতীয় পর্যায়ের ধ্যানের সাহায্যে ভবিষ্যতে লাভ করব এমন একটি লক্ষ্য অর্জনে আমরা একাগ্রচিত্ত হই।
দৈনন্দিন জীবনে তিন প্রকারের ধ্যান
অতঃপর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে সদ্গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে চাই তার জন্য এই তিন প্রকারের ধ্যান সহায়ক হয়। এটি মনে রাখা খুবই মহত্বপূর্ণ যে, ধ্যানকে যেন আমরা জীবনের একটি অতিরিক্ত কাজ এবং সেটা সরাসরি জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন না ভাবি। ধ্যান মানে এক প্রকারের পলায়ন করা নয়; এটা খেলা নয়, এটা কোনও শখ নয়। আমাদের জীবনে যে সদ্গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে প্রতিদিন ব্যবহার করতে চাই, ধ্যান হল তার একটি পদ্ধতি।
এই তিনটি পদ্ধতিকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যখন আমরা প্রথম পর্যায়ের ধ্যান অনুশীলন করি তখন আমরা একটি বিষয়ের উপর করি মনসংযোগ। মনকে শান্ত করতে শিখি এবং মনসংযোগের ক্ষমতাটিকে আরও শক্তিশালী করি। এতে শুধু কাজে মনসংযোগ শিখি না বরং কোন ব্যক্তির সঙ্গে বার্তালাপেও একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। সেই ব্যক্তি এবং তার বক্তব্যের উপর আমরা মনোযোগী হতে চাই, পারিপার্শিক অন্য বিষয়ের উপর নয়। আমরা মনে কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়া; সে কী বলল তার উপর বিচার না করেই শুনতে চাই আর সেই সময়, যেমন- ‘ও সত্যিই একটা নির্বোধ’, ‘ও চুপ করলে বাঁচি’ না আসায় কাম্য। ঐ ধরণের মানসিক ভাবনা থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। লোকটি ও তার বক্তব্যের দোষ-ত্রুটি গুলিকে সরিয়ে রেখে আমরা তার উপর আরও একটু সংবেদনশীল হয়েও মনযোগ দিতে পারি। ভাবতে পারি- “আমার মতো তিনিও মানুষ এবং তারও অনুভূতি রয়েছে। আমি কথা বলার সময় যেমন মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করি, তেমন ভাবেই আপনিও চান আপনার কথা শোনা হোক।” একাগ্রতার ধ্যানের মাধ্যমে এরকম করার জন্য আমরা মনকে প্রশিক্ষণ দিই।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মৈত্রী ও করুণার স্থান রয়েছে। দ্বিতীয় প্রকারের ধ্যানের মাধ্যমে আমরা মৈত্রী ও করুণায় ওতপ্রোত হয়ে একটি মানসিক অবস্থার বিকাশ ঘটাতে চাই। এটি কোন বিষয় নয় যে, কোথায় এবং কাদের সঙ্গে আমরা আছি, আমরা সবাই সুখী হতে চাই- এই কামনায় আমরা মৈত্রী জাগরণের জন্য সাধনা করি। মৈত্রী বলতে এখানে সত্যিই সকলের প্রতি মৈত্রীর জাগরণকে বোঝায়- বাসের মধ্যে সকলের প্রতি, সাবওয়েতে, রয়েছে চলমান জনতার প্রতি, দোকানের সবার মধ্যে, সকল কীটপতঙ্গ-জীবজন্তুর মধ্যে, সবার প্রতি এই মৈত্রীর মনোভাব থাকছে। তাই এর অর্থ হল- সকলের প্রতি সম্মানের বিকাশ। সবাই সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখী হতে চায় না, এই বিষয়ে সকলেই সমান। সুখী হওয়ার অধিকার সকলের, এমনকি একটি মাছিরও সেই অধিকার রয়েছে।
অবশেষে, আমরা এমন একটি অধিমুক্তির (ঐকান্তিক ইচ্ছা) বিকাশ করি যা সারাজীবন পোষণ করি- “আমি এই লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছি। আমার ভুল-ত্রুটি গুলি কমানোর চেষ্টা করছি। সদ্গুণের বিকাশের সঙ্গে মুক্তি এবং বোধি লাভের জন্য প্রয়াসী আমি।” এই ঐকান্তিক ইচ্ছাটি জীবনভর পরিব্যাপ্ত থাকে, এটা আসনে বসে তাৎক্ষণিক আরাম করার মতো বিষয় নয়।
একটি উপকারী মানসিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য আচার্য চোঙ্খাপার উপদেশ
উক্ত তিন ধরণের বিষয়ে আমাদের আসলে কী জানতে হবে, এই বিষয়ে মহান তিব্বতী গুরু চোঙ্খাপা ব্যাখ্যা করেছেন। অন্য কথায় ধ্যানের ভিত হিসাবে কী করে একটি উপকারী মনের বিকাশ করা যায় সেটা তিনি বলেছেন।
কীসের উপর মনোনিবেশ করছেন তা জানুন
কীসের উপর আমরা মনোনিবেশ করতে চাইছি সেই বিষয়টি প্রথমে জানতে হবে। করুণাকেই উদাহরণ হিসাবে দেখা যাক। করুণার উপর মনোনিবেশের মধ্যে আমরা আসলে অপরের দুঃখের উপর মনোনিবেশ করছি। সেটা বোধিচিত্তের থেকে একটু আলাদা। সেটা তো আমাদের নিজেদের বোধিলাভের বিষয় এবং তা অনাগত। কেউ কেউ ভাবেন- আরে ওরা তো বোধিচিত্তের উপর ধ্যান করছে, প্রকৃতপক্ষে ওরা কিন্তু করুণার উপর ধ্যান করছে। করুণা বোধিচিত্তের আধার কিন্তু করুণা আর বোধিচিত্ত এক বিষয় নয়।
বিষয়টির সব দৃষ্টিকোণ জানো
মনসংযোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা পরিষ্কার হওয়ার পর, এই বিষয়টির সবদিক খতিয়ে দেখে জানতে হবে। এখানে যেমন বিষয়টি হল করুণার উপর মন-সংযোগ তবুও প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় হল অপরের দুঃখ। সবাই দুঃখ ভোগ করে। এই দুঃখের নানাবিধ দিক ও কারণ আমরা উন্মোচন করি; যেমন সাধারণ অসুখীতা, সাধারণ সুখ, কর্মফল জনিত দুঃখ এবং জন্ম-জন্মান্তরের আপাত অনিয়ন্ত্রণযোগ্য পুনর্জন্ম। একটি নির্দিষ্ট ধরণের বা কয়েকজনের দুঃখ নিয়ে একাগ্র হওয়ার চেষ্টা করি না; যেমন ধরুণ কতিপয় লোক কর্মচ্যুত হয়ে পড়লেন এবং তৎজনিত দুঃখ কষ্ট। পরম করুণার ক্ষেত্রে জগতের সকল প্রাণী সহ মানুষ যতরকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে তার উপর আমরা মনসংযোগ করি।
এর সঙ্গে আমাদের মন কীভাবে যুক্ত সেটা জানো
তারপর আমাদের জানতে হবে ঐ বিষয়টির সঙ্গে আমাদের মন কীভাবে যুক্ত আছে। আমাদের মহাপরম করুণায় সকলের দুঃখ চিরকালের জন্য দূর হোক। ‘ওহ কী ভয়ানক।’ বিষয়টির ভাব এমন নয়। এদিক দিয়েও এই ভাবনাটি বোধিচিত্ত ভাবনার থেকে অনেকটা আলাদা। বোধিচিত্ত দ্বারা আমাদের অনাগত বোধির উপর একাগ্রচিত্ত হই এবং একটি ঐকান্তিক ইচ্ছা এর সঙ্গে জুড়ে থাকে- “একদিন আমি সেটা লাভ করব এবং তার মাধ্যমে সকলের উপকার করব।” অপরের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে কীভাবে আমরা করুণাকে যুক্ত করি তার সঙ্গে বোধিচিত্ত ভাবনার পার্থক্য আছে।
এর বিকাশে কী সহায়ক হতে পারে তা জানো
এরপর আমাদের জানতে হবে মনের এই অবস্থাটির বিকাশে কী আমাদের সহায়ক হতে পারে। আমাদের উদাহরণে, করুণার সঙ্গে জুড়ে আছে অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি আমাদের সম-মনোভাব এবং নিজেরও দুঃখ মুক্তির ইচ্ছা। তাকেই বলা হয় ‘মুক্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা’ সাধারণতঃ একে ‘পরিত্যাগ’ রূপে অনুবাদ করা হয়। তা আমাদের নিজের দুঃখ, দুঃখ মুক্তি এবং এর কারণের উপর মনসংযোগ করে। দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ হল ক্রোধের মত দুর্দশাগ্রস্থ হওয়ার কারণ গুলিকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হওয়া। আমাদের নিজেদের দুঃখ-মুক্তির জন্য দৃঢ়তা যদি আমরা জাগিয়ে তুলতে পারি তাহলে সেই ইচ্ছা ও মনোভাব অপরের জন্যও চালিত হতে পারে। ঠিক যেমনটি আমরা নিজেদের জন্য করেছি।
এর বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর কী তা জানো
এরকম মানসিক অবস্থার বিকাশে প্রতিবন্ধক কী তাও আমাদের জানা উচিত। অন্য লোকেদের এবং তাদের দুঃখ-কষ্টকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়া হল করুণা জাগরণে প্রধান অন্তরায় বা বাধা। একে আটকানোর জন্য আমাদের ভাবতে হবেঃ “সকলেই সুখী হতে চায়। কেউ দুঃখী হতে চায় না। দুঃখ থেকে মুক্তির কামনায় সকলেই একইরকম মনোভাব রাখে। আমরা সকলেই সমান। আমাদের যেমন অনুভূতি, সকলের অনুভূতিও তেমনই। দুঃখ যেমন আমায় আহত করে সেইভাবে সবাই দুঃখে আহত হয়। আমি যেমন আমার দুঃখ থেকে মুক্তি চাই, এরাও তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি চায়।” এইভাবে আমরা অপরের উপর আমাদের অনুভূতি ও সম্মানের বিকাশ ঘটাই। অপরের প্রতি যদি অনুভূতি ও সম্মান না থাকে তাহলে আমাদের মধ্যে করুণার বিকাশে সেটা হবে বাধা স্বরূপ।
এর প্রয়োগ জানো
আচার্য চোঙ্খাপা আরও বলেছেন- আমরা যখন এরকম মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলব, তখন এনিয়ে কী করব তাও জানা উচিত। অন্য ভাবে বললে- এর কাজ কী? আমি করুণার বিকাশ করলাম, তারপর কী করব? অন্যদের মোকাবিলা করতে এ আমায় সাহায্য করবে। তাদের উপকার করার জন্য এ আমার সহায়ক হবে। আমার অন্তিম লক্ষ্য হ’ল- বোধি। এই বোধিলাভ এবং তার দ্বারা আমি যেন সকলের প্রকৃত উপকার করতে পারি; এর জন্য আমায় অনুপ্রাণিত ক’রে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এ কী দূর করবে জানো
এরপর আমাদের জানতে হবে, এই মানসিক অবস্থা কী দূর করবে বা কী যুক্ত করবে? অন্যদের প্রতি নির্দয়ী উপেক্ষা ভাব এই করুণা দূর করে। আলস্যে অন্যদের সহায়তায় অনীহা বা নিজেরই কাজে আলস্যজনিত অনীহা দূর করতে তা আমায় সাহায্য করবে। অপরের প্রতি শীতল মনোভাব দূর করে আমি তাদের আরও বেশী সাহায্য করতে পারি। এই সমস্ত বিষয় গুলি জেনে আমরা যদি করুণার বিকাশে ধ্যান করি আমরা নিশ্চিত হতে পারব যে, এই ধ্যানটি আমরা সঠিক ভাবে করছি। আমরা যথার্থ ভাবে জানি কী করছি এবং কেন করছি। এই ধ্যানে প্রবেশের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। নইলে সেটা সাঁতার না জেনে গভীর জলে লাফিয়ে পড়ার মতো হবে। যদি বলিঃ “চল ধ্যানে বসা যাক।” কী করতে হবে না জেনে বসলে কাঙ্খিত ফল না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকবে।
একটি আলোচনা সভার প্রতিলিপি, কিয়েভ, ইউক্রেন, সেপ্টেম্বর, ২০১১। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন, সঞ্জীব কুমার দাস, রামকৃষ্ণ দাস (কর্মা জ্ঞানবজ্র) এবং দেবজিৎ চ্যাটার্জী।