তিব্বতে মুসলমানদের ইতিহাস

তিব্বতী মুসলমানদের সমীক্ষা

১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে মধ্য তিব্বতে তিন হাজার তিব্বতী মুসলমান বাস করতেন। এরা হলেন কাশ্মীর, লাদাখ, নেপাল ও চীন থেকে আগত মুসলমান ব্যবসায়ীদের উত্তরপুরুষ এবং তারা এখানে বসবাস করতে এসেছিলেন। তারা তিব্বতী মহিলাদের বিবাহ ক’রে তিব্বতেই রয়ে যান। তারা তিব্বতী ভাষায় কথা বলেন এবং অধিকাংশ রীতি-নীতি পালন করেন। তিব্বতী ঘরানার স্থাপত্য অনুযায়ী ওরা লাসায় চারটি, শিগাচেতে দুটি এবং চেতাং-এ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এছাড়াও কোরান ও উর্দূ শেখার জন্য লাসায় ছিল দুটি ইসলামী বিদ্যালয়। অপরটি শিগাচেতে ছিল। ভারতে নির্বাসনে এসেও তিব্বতী বৌদ্ধ ও তিব্বতী মুসলমানগণ পারম্পরিক সৌহার্দ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রেখেছেন।

কাশ্মীর ও লাদাখের মূল নিবাসীগণ

তিব্বতের সঙ্গে কাশ্মীর ও লাদাখীদের দীর্ঘ বাণিজ্যিক ইতিহাস রয়েছে। ঐ সময়ে ব্যবসায়ীগণ মধ্য ও পশ্চিম তিব্বতে বসতী স্থাপন করেন। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে সুফি ধর্মগুরুগণ কাশ্মীরে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রবর্তন করলে তিব্বতে বসবাসরত উক্ত বাসিন্দাগণও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পঞ্চম দালাই লামার শাসন কালে লাদাখ ও কাশ্মীর থেকে এই মুসলমানগণ তিব্বতে বসবাসের জন্য আগমন করেন। সে সময় তাদের তিব্বতে চলে আসার প্রধান কারণ ছিল কাশ্মীরের দুর্ভিক্ষ এবং সেখান থেকে গিয়ে ওরা লাসায় বসতি স্থাপন করেন।

পঞ্চম দালাই লামা কর্তৃক বিশেষ সুবিধা প্রদান

সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের নীতির জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে পঞ্চম দালাই লামা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দেখাশোনা করার জন্য ওরা পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে পারত; তা ছাড়া তাদের মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য শরিয়া আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারত; বিনাশুল্কে তিব্বতের বিভিন্ন শহরে দোকান খুলে ব্যবসা করার জন্য অনুমতি দেওয়া হতো; বৌদ্ধ পবিত্র মাস সাগা দাওয়ার (বুদ্ধ-পূর্ণিমা) সময়ও ওরা মাংস খেতে পারত; এবং মহাপ্রার্থনার অনুষ্ঠানে ভিক্ষু আধিকারিকদের সামনেও মাথার টুপি খোলার প্রয়োজন হতো না। এছাড়াও পঞ্চম দালাই লামা মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য মসজিদ ও কবরস্থান নির্মাণ করার জন্য লাসাতে জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি সমস্ত সরকারী উৎসবাদিতে মুসলমান দলপতিদের আমন্ত্রণ জানাতেন।

লাদাখের সঙ্গে বাণিজ্যিক দৌত্য

১৬৮৪ খ্রীষ্টাব্দে তিব্বতী-লাদাখী শান্তিচুক্তির অংশ হিসাবে তিব্বতী সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি তিন বছর অন্তর লাদাখ থেকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দলের লাসা সফর অনুমোদন করা হতো। তিব্বত যখন অন্যান্য বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল তখনও সেটা চলত। বহু কাশ্মীরী ও লাদাখী মুসলমান এই বাণিজ্য দলের সঙ্গে এসে তিব্বতে ইতিমধ্যে যারা বসবাস করত তাদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করল।

কাশ্মীরী মুসলমান ব্যবসায়ীগণ নেপালেও বসতি স্থাপন করেছিল। ওরা নেপাল ও তিব্বতের মুসলমানদের সঙ্গে ব্যবসা করত। সন্‌ ১৭৬৯ সালে যখন রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু উপত্যকা দখল করেন তখন তিনি উক্ত মুসলমানদের তাড়িয়ে দেন। ফলে তাদের মধ্যে অনেকে তখন তিব্বত চলে আসে। ১৮৫৬ সনে কাশ্মীরের ডোগরা বাহিনী তিব্বত অভিযান করে। ওরা পরাজিত হওয়ার পর বহু লাদাখী ও কাশ্মীরী যোদ্ধা, যাদের বন্দি করা হয়েছিল তারা তিব্বতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর কিছু হিন্দু ডোগরা সৈন্যও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক’রে তিব্বতেই রয়ে যান। তিব্বতে এপ্রিকট (খুবানি) ও আপেল চাষ ওরা শুরু করেছিলেন।

হুই মুসলমান অধিবাসীগণ 

সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে নিংজিয়ার চীনা মুসলমান ব্যবসায়ীগণ উত্তর-পূর্ব তিব্বতের আমদোর সিলিং-এ বসতি স্থাপন করেন। ওরা তিব্বতীদের বিবাহ করেন এবং চীন ও মধ্য তিব্বতের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। তাদের মধ্যে বেশ কিছু লাসায় বসবাস করতে লাগলেন এবং নিজেদের জন্য মসজিদ ও কবরস্থান বানিয়ে আলাদা মুসলমান সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলেন।

প্রজাতন্ত্রী চীনের শাসনে অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটল। বৌদ্ধদের মতো তিব্বতী মুসলমানগণও ভয়ানক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেল না। বর্তমানে আমদোর অধিকাংশ শহরে মুখ্যতঃ চীনা হুই মুসলমানগণ বসবাস করেন। স্থানীয় তিব্বতীদের কোনঠাসা ক’রে পাহাড়ী উচ্চভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মধ্য তিব্বতে বিপুল সংখ্যক হুই মুসলমানগণ বসতি স্থাপন করছেন। ওরা তিব্বতী মুসলমানদের মতো নয় বরং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে অসহযোগীতা করে এবং তাদের চীনা ভাষা ও রীতিনীতি পালনে তৎপর।

Top