ধ্যান করার আগে আমাদের যা কিছু জানা উচিত

আমাদের দক্ষতাকে বোঝা

আমরা আসলে এই সমস্ত জিনিস অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করি কিনা এবং আমি এটা অর্জন করতে সক্ষম কিনা সে বিষয়ে বেশি কথা বলিনি। এটা তথাগতগর্ভের মূল আলোচনায় উঠে আসে যা মূলতঃ আমাদের সকলের মধ্যে আছে যা বুদ্ধে রূপান্তরিত করতে সম্মতি দেয় সেটাকে বোঝায়। এটি মূলতঃ আমাদের মনের বৈশিষ্ট্য গুলি নিয়ে কাজ করে।

আমরা কি বস্তুকে বুঝতে সক্ষম? বেশ। আমরা কি সব সময় কোনকিছুর বিষয়ে সচেতন থাকতে সক্ষম? হ্যাঁ, আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য কোন কিছুর বিষয়ে সচেতন থাকতে পারি। তবে এর পরিধি কি বৃদ্ধি করা সম্ভব? হ্যাঁ। ধ্যান ও পরিচিতির মাধ্যমে আমরা এটা বৃদ্ধি করতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সাফল্য নির্ভর করে আমাদের নিজস্ব আগ্রহ ও প্রেরণার উপর। এটা অবশ্যই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হওয়া দরকার।

এটি শপিং করার সময় আপনার কাছে কত অর্থ আছে তার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মতো, কারণ আপনি এর চেয়ে বেশি ব্যয় করতে পারবেন না। অন্য সময় আপনি যখন বাড়িতে বসে থাকেন তখন এতে কিছু যায়-আসে না যে, আপনার কাছে কত টাকা আছে। এটা অপ্রাসঙ্গিক এবং আপনি পাত্তা দেন না। একইভাবে আমরা যখন শিক্ষা গুলি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি, তখন সেগুলি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হওয়া দরকার। সেগুলিকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করার জন্য আমাদেরকে তাদের ক্রিয়াকলাপকে বুঝতে হবে আর বুঝতে হবে যে, সেগুলি কেন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটাকে “যত্নশীল মনোভাব” নামে মনের একটি প্রাথমিক অবস্থায় ফেলতে পারি, যেখানে আমরা নিজেদের সম্পর্কে আর আমাদের সাথে কী ঘটছে এবং আমরা কী অনুভব করি, সেটা সম্পর্কে চিন্তান্বিত।

নিজের সম্পর্কে যত্নশীল হওয়া

আমরা সম্ভবতঃ এই যত্নশীল মনোভাবের কার্যকারিতা আরও সহজে বুঝতে পারি যখন এটি অন্যকে নির্দেশ করে। আমি যদি অন্যের প্রতি যত্নশীল না হই, তাহলে আমি কী করি বা বলি অথবা তারা এটি পছন্দ করে বা না করে তাতে বাস্তবে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমি যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, তাহলে আমার আচরণ তাদেরকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন হব। আমাদের নিজের সম্পর্কে এই যত্নশীল মনোভাবের বিকাশ ঘটানো দরকার অর্থাৎ আমি যদি আমার সমস্ত সময় নষ্ট করি এবং যদি আমার মূল্যবান মানব জীবনের সুযোগ-সুবিধা না নিই, তাহলে একটি পর্যায়ে গিয়ে আমি এই বিশাল ক্ষতির অবিশ্বাস্য অনুতাপ নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বো।

আমরা এটি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয় গুলির দিকেও লক্ষ্য করতে পারি। আমি কীভাবে আমার সন্তানদের লালন-পালন করি, কীভাবে আমরা কাজ করি, সে বিষয়ে আমরা যত্নশীল হই; আমি আমার মানসিক ও শারীরিক কল্যাণের সাধারণ অবস্থান সম্পর্কে যত্নশীল হই। এই ধরণের মনোভাবের সাথে আমরা এই শিক্ষা গুলি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করবো। শিক্ষা গুলি মাথায় রেখে আস্তে-আস্তে আমরা সেগুলি মনে রাখতে সক্ষম হব। যদি সব সময় নাও হয়, তাহলে কমপক্ষে অনেক সময় ধরে। ধ্যান হল- নিজেদেরকে এই শিক্ষা গুলির সাথে বার-বার পরিচিত হওয়ার পদ্ধতি। যাতে এগুলি আমাদের মনের একটি স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে ওঠে। ফলে সেগুলি মনে রাখার জন্য আমাদের কোনো প্রচেষ্টা করার প্রয়োজন হয় না।

আমরা যদি নিশ্চিত হতে পারি যে, আমরা এই অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম তবে আমরা আমাদের পূর্ণ হৃদয়কে সেটা করার জন্য ব্যবহার করব। যদি আমরা নিশ্চিত না হই, তাহলে এটি বাহুতে চাপ দিয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করা মাত্র হবে; আপনি কেন মাথা ঘামাবেন? শুরুতে সম্ভবতঃ আমরা এটাও জানিনা মোক্ষ বা বোধি জিনিসটা কী, তবে আমাদের এটি বোঝার এবং জানার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য রয়েছে, যদিও মৃত্যুর সচেতনতা আমাদের জীবনকে কৃতকার্য হতে সাহায্য করে।

করুণার উপর ধ্যান

এখন আমরা প্রক্রিয়াটির তৃতীয় পদক্ষেপ অর্থাৎ ধ্যানকে দেখার জন্য প্রস্তুত। এই বিষয়টির প্রবর্তনের উপায় হিসাবে মহান তিব্বতী বৌদ্ধ গুরু চোঙ্‌খাপা খুব উপকারী পরামর্শ লিখেছিলেন। তিনি “সূত্র ও তন্ত্র সম্পর্কিত ব্যবহারিক পরামর্শের একটি চিঠি”-তে লিখেছিলেন যে, ধ্যান করার জন্য আমাদের বুঝতে হবে যে, মনের অবস্থার কারণ গুলি কী কী যা আমরা অর্জন করতে চাই। সুতরাং, উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি করুণার বিকাশ করতে চাই, আমাদের জানতে হবে যে, কোন কারণ গুলি এর বিকাশ ঘটাতে পারবে।

এটি নির্ভরতার মূল বক্তব্য অর্থাৎ অন্যরা দুঃখ এবং দুঃখের কারণ গুলি থেকে মুক্ত হোক, এই কামনার বিকাশ করার জন্য (বৌদ্ধ ধর্মে করুণার সংজ্ঞা) আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমরা তাদের সাথে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অন্যথা আমরা তাদের জন্য মোটেও যত্নশীল হব না। সুতরাং আমাদের বিবেচনা করা দরকার যে, কীভাবে আমাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব প্রত্যেকের পরিশ্রম এবং করুণার উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকে পরিশ্রম বলতে যারা আমাদের খাদ্য উৎপাদন করেছেন, রাস্তা নির্মাণ করেছেন এবং এখনো কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরকে বোঝায়। আমাদের জীবনকে সাবলীল করার জন্য তারা যা করছে তা স্মরণ করে আমরা কৃতজ্ঞতা বোধ করি এবং প্রশংসা করি। আন্তরিক এবং গভীর ভাবে অনুভূত হওয়ার পর আমাদের কৃতজ্ঞতার জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবেই মনোজ্ঞ মৈত্রীর জন্ম দেয়। এর সাথে আমরা তাদের গভীরভাবে লালন-পালন করি এবং তাদের সাথে যদি ভয়াবহ কিছু ঘটে তাহলে আমরাও শোকাহত হই। এটি মৈত্রীর দিকে পরিচালনা করে অর্থাৎ তারা সুখ এবং সুখের কারণে যুক্ত হোক, এই কল্পনা করা। কিন্তু আমরা যখন দেখি তারা সুখী নয়, বরং সব রকমের দুঃখে জর্জরিত, তখন আমরা করুণার বিকাশ করি। আমাদের করুণার বিকাশ এই সমস্ত পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার উপর নির্ভর করে।

করুণা ত্যাগের উপরও নির্ভর করে। এর অর্থ আমাদের নিজেদের দুঃখকে চেনা, সেগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংকল্প করা, তারপর উপলব্ধি করা যে, অন্য সকলের মধ্যে এই একই রকম দুঃখ এবং একই রকম কামনা বা ইচ্ছা আছে। ত্যাগের যথাযথ অর্থ হল- দুঃখ থেকে মুক্তির সংকল্প। করুণা অন্যের দুঃখের দিকে একই ভাবে পরিচালিত, আমাদের প্রতি সেই একই সম্পর্ক স্থাপনের উপর নির্ভর করে।

সুতরাং, আমরা যদি আমাদের ধ্যানের মধ্যে করুণার অবস্থান তৈরি করতে এবং চেষ্টা করতে পারি, তাহলে নির্ভরশীলতার এই বিষয়টি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, কারণ যদিও আমরা চমৎকার অনুশীলন এবং পরিস্থিতির সাথে তাৎক্ষণিক ভাবে এটি তৈরি করতে সক্ষম হব কিন্তু শুরুতে একটি উন্নত স্তর তৈরী করার জন্য, আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে, যেখানে আমরা আন্তরিকতার সাথে এটিকে অনুভব করতে পারব। আসলে করুণার উপর ধ্যান করার জন্য আমাদের ধাপগুলি জানতে হবে অথবা কারণ গুলি জানতে হবে যেগুলির উপর এটা নির্ভর করে।

চোংখাপা আরও বলেছেন যে, আমাদের “দিক গুলিও জানা দরকার”, যার অর্থ যদি আমাদের করুণা উৎপন্ন করতে হয়, যদি আমরা চাই যে, সবাই এসব কিছু থেকে মুক্ত হোক। তাহলে আমাদের দুঃখের বিভিন্ন দিক গুলি এবং দুঃখের বিভিন্ন কারণ গুলি জানতে হবে। এটা শুধুমাত্র তাদেরকে কোনও একটা কাজ পেতে সহায়তা করা বা ভাল খাবার খেতে সহযোগীতা করা নয়, বরং এখানে আমরা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের (সংসার) সংস্কার দুঃখতা এবং সেই বাস্তবতার বিষয়ে অসচেতনতা আর বিভ্রান্তির ব্যাপারে কথা বলছি। এর কারণে সংসারের অস্তিত্বের প্রতি নিত্য ভাবনা তৈরী হয়। মৈত্রী ও করুণার উপর ধ্যান করার জন্য আপনি শুধু সেখানে বসে ভাববেন না, “আহা কী সুন্দর, আমি সবাইকে ভালবাসি”। ঐ পথটি খুবই অস্পষ্ট। আমরা মনের যে অবস্থা বিকশিত করতে চাই, সেটা খুবই নির্দিষ্ট। চোংখাপা সমস্ত বিষয়কে নির্দেশ করেছেন, যেগুলি মনের অবস্থাকে নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করতে সক্ষম করে তুলবে, আমরা যার সাথে কাজ করার চেষ্টা করছি।

তারপর এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন আমরা মনের কোনো অবস্থা বিকশিত করার জন্য চেষ্টা করি, তখন আমরা কোন বিষয়ের উপর মনোনিবেশ করি। আমাদের মনের মধ্যে কী জাগা উচিত? করুণার সঙ্গে আমরা অন্য প্রাণীদের উপর এবং তাদের দুঃখের উপর ধ্যান কেন্দ্রিত করি। এখানে এটি শুধুমাত্র করুণা নয়, বরং এটা হল “মহাকরুণা” যা সকলের প্রতি সমানভাবে লক্ষ্য স্থির করা হয়। আর এখানে জীবের সংখ্যাও অনেক বেশী হয়; এখানে সত্যিই সবাই অন্তর্ভুক্ত। এটা অবিশ্বাস্য ভাবে একটা বিশাল বড় লক্ষ্য। আমরা ভাবি, “আমি এই জগতের প্রতিটি জীবকে সাহায্য করতে চলেছি।” আমরা এখানে প্রতিটি স্বতন্ত্র মানসিক সন্ততি সম্পর্কে কথা বলছি, যা তাদের কর্মের কারণে এখন একটি পোকামাকড়ের জীবন ধারণ করেছে। এর অর্থ এই নয় যে, তারা সর্বদা পোকামাকড় হয়ে থাকবে- আমরা সেই জীবকে মুক্ত করতে চলেছি যে, এই জন্মে একটি পোকা-মাকড় রূপে আছে, কিন্তু পূর্বজন্মে আমার মা ছিলেন। আর আমি এই জন্মে আমার মাকে মুক্ত করবো, যিনি সম্ভবতঃ তাঁর পূর্বজন্মে একটি পোকামাকড় হয়ে ছিলেন।

প্রতিটি প্রাণী সম্বন্ধে কল্পনা করা এত সহজ নয়, তবে উদার চিত্ত মহাযান বৌদ্ধ অনুশীলনে আমরা অনুশীলনটি করার সময় আমাদের চারিপাশের প্রাণীদের একটি বিশাল সমূহের কল্পনা করার চেষ্টা করি। আর কল্পনা করি যে, আমরা তাদের প্রত্যেকের দুঃখকে উপশম করার চেষ্টা করছি। বহু মহাযান সূত্রের শুরুতে, শত-কোটি জীবের আশেপাশে থাকার বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়, যার দ্বারা লক্ষ্যের বিশালতার অনুমান করা যায়।

প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি সমানরূপে এরকম সার্বজনীন করুণার ভাব রাখতে পারাটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। এই প্রকারের করুণার আধার হল সমতা, যেখানে আমরা অন্য সকল প্রাণীর প্রতি আমাদের মন মুক্ত রাখি। সঠিকভাবে করুণার উপর ধ্যান করতে আমাদের এই সমস্ত জিনিস গুলিকে ক্রমাগত ভাবে জানতে হবে।

এছাড়াও আমাদের জানতে হবে যে, আমরা যার উপর মনোনিবেশ করছি আমাদের মন সেটার সাথে কীভাবে সম্বন্ধ স্থাপন করে। আমরা যদি করুণার উপর ধ্যান করি, তখন আমরা কামনা করি যে, সমস্ত জীব দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যাক এবং তাদের দুঃখের সমস্ত কারণের বিনাশ হয়ে যাক। এই কামনা এমন নয় যে, অন্য কেউ তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে, অথবা দুঃখ সাধারণ ভাবেই সমাপ্ত হয়ে যাবে, বরং আমরা স্বয়ং তাদের সহায়তা করার প্রয়াস করব, যাতে তারা নিজের দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে যায়।

চোংখাপা আরও বলেছেন যে, আমাদের জানতে হবে যে, করুণার ভাব বিকশিত করার জন্য কী উপকারী হতে চলেছে এবং কী আমাদের সহায়তা করতে চলেছে। আর কী কী ক্ষতিকারক এবং কী আমাদের ক্ষতি করতে চলেছে। শুধু তাই নয় যে, করুণার বিকাশ করতে আমাদের কী সহায়তা করবে না, বরং এটার প্রতি আশ্বস্ত হওয়া খুবই আবশ্যক যে, বাস্তবে মানুষের পক্ষে দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। যদি আমরা এটি সম্ভব বলে মনে না করি, তাহলে আমরা কীভাবে এটির জন্য কামনা করব এবং সেটা প্রাপ্ত করার জন্য কী করে কাজ করব? আমি আমার দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারি এবং আমি অন্যদেরকেও তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে সক্ষম, এই দৃঢ় বিশ্বাসই হ’ল এর আধার। আমরা কী করতে সক্ষম এবং এমনকি বুদ্ধ কী করতে সক্ষম, সে সম্পর্কে আমাদের একটি বাস্তবসম্মত বোধগম্য থাকতে হবে। এই কারণে, আমাদের করুণার বিকাশের জন্য কেবল আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতাই বাধা নয়, হতাশা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবও এর জন্য ক্ষতিকারক। সর্বোপরি বুদ্ধও বলেছিলেন যে, দুঃখকে কারও পা থেকে কাঁটা তোলার মতো নিবারণ করা যায় না। এমনকি বুদ্ধ কেবল পথ দেখাতে পারে, কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করতে হবে নিজেদেরকে। আমরা কীভাবে আশা করতে পারি যে, আমরা বুদ্ধের থেকেও ভাল করতে সক্ষম?

সংক্ষেপে যদি আমাদের করুণার মতো কোনো নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থাকে বিকাশ করার প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট বোধগম্য না থাকে, তাহলে আমরা খুব বেশি দূরে অগ্রসর হতে পারব না। এই ভাবে ধ্যান কতটা সূক্ষ্ম ও পরিশীলিত আমরা তার প্রশংসা করা শুরু করতে পারি; এমনকি আমরা এটিকে “মনোবিজ্ঞান” বলতে পারি।

ধ্যানের অধিবেশন গুলির মধ্যেকার সময়কাল

চোংখাপা আরও বলেছেন যে, ধ্যানের অধিবেশন গুলির মধ্যেকার সময়টিও খুবি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যার উপর ধ্যান করছি তিনি তার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসকে নিশ্চিত করবে যে, আমরা সত্যিই সেটা করছি যা বুদ্ধ শিখিয়েছিলেন এবং অন্যদিকে এটা আমাদের উৎসাহিত করবে যে, মহান আচার্যরাও এগুলি পড়েই অর্জন করেছিলেন। এছাড়া চোংখাপা বলেছেন যে, আমাদের শুদ্ধিকরণ অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের ইতিবাচক শক্তি তৈরি করতে হবে এবং নেতিবাচক শক্তি গুলিকে পরিষ্কার করতে হবে।

আমি “পুণ্য” শব্দের পরিবর্তে “ইতিবাচক শক্তি” শব্দটি ব্যবহার করি। কারণ আমার মনে হয় যে, পুণ্য শব্দটি একটি ভুল ধারণা তৈরী করে। পুণ্য শব্দটি এমন মনে হয় যে, আপনি যেন পয়েন্ট সংগ্রহ করছেন এবং যদি আপনি একশো পয়েন্ট জোগাড় করে নেন তাহলে আপনি জিতে যাবেন। আমাদের যেটা করণীয় সেটা হ’ল- বাস্তবে একপ্রকারের ইতিবাচক শক্তি তৈরি করা, যা থেকে কাজ করার জন্য যথেষ্ট শক্তি পাওয়া যায়, যেমন একটা সেলফোন চার্জ করার মতো। তেমনই আমাদের মনের ব্যাপারে, আমাদেরও নিজেদের মানসিক বাধা গুলিকে অতিক্রম করার জন্য শুদ্ধিকরণ-অনুশীলন গুলি আবশ্যক। কারণ এই বাধা গুলির উৎপন্ন হওয়ার ফলে আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। এছাড়াও আবেগ সংক্রান্ত বাধাও থাকতে পারে। ইতিবাচক শক্তি তৈরি করা এবং বিভিন্ন শুদ্ধিকরণের অনুশীলন করা, এই সমস্ত বাধা গুলিকে ভাঙতে সাহায্য করবে, যাতে আমরা অন্তর্দৃষ্টি ও বোধগম্য প্রাপ্ত করতে পারি।

ব্যবহারিক স্তরে এর অর্থ কী? ব্যবহারিক স্তরে এর অর্থ হ’ল, যখন আমরা এমনকি আমাদের কাজের মধ্যেও কিছু বোঝার চেষ্টা করি এবং সেটা বুঝতে পারি না, তখন আমরা একটু বিরতি নিয়ে থাকি। আমরা পরিবর্তনের জন্য এমন কিছু করার চেষ্টা করি, যা কোনো না কোনো রূপে অন্যদের জন্য উপকারী হয়। এটি করার পরে যখন আমরা ফিরে আসি, তখন আমাদের মন আরও ইতিবাচক থাকবে, প্রসন্ন থাকবে এবং আমাদের হতাশার চেয়ে আত্ম-সম্মানের বোধ আরো বেশী হবে, তখন আমরা কিছুটা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হই। সুতরাং আমরা যেই হই না কেন, কিছু ক্রিয়া-কলাপে নিযুক্ত থাকতে হবে যা অন্যদের জন্য উপকারী, সেটা আমাদের সন্তানদের সাথে আরো বেশি সময় কাটানোও হতে পারে অথবা একাকী জীবন কাটানো কোনো অসুস্থ প্রবীণ আত্মীয়ের সাথে দেখা করা হতে পারে, যাই হোক না কেন। ইতিবাচক কিছু করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আমরা প্রচুর বিধি-অনুশীলন করতে পারি, যেটা বাস্তব জীবনে করা অনুশীলন থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়।

নিজেদের অগ্রগতির পরীক্ষা করা

আমাদের মধ্যে বেশীর ভাগ মানুষের কাছে এমন কোন ব্যক্তিগত শিক্ষক থাকে না, যার দ্বারা আমরা আমাদের অগ্রগতির পরীক্ষা করাতে পারি। তবে লোজোঙ্‌ বা চিত্ত-শোধনের শিক্ষা গুলিতে সবসময় বলে যে, আমরা নিজেরাই আমাদের অগ্রগতির সেরা সাক্ষী। আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে যে, আমরা ভালোভাবে একাগ্র হতে পারছি কিনা, অথবা আমাদের অনেক বেশী মানসিক বিচরণ ঘটছে কিনা, আমাদের হয়ে অন্য কেউ এটার বিচার করতে পারে না। সমস্ত রকমের শিক্ষার এবং অনুশীলনের উদ্দেশ্যই হ’ল- আমাদের নিজের আবেগপ্রবণ অবস্থার উন্নতি করা এবং আমাদের নিজেদের উপর কাজ করা। সুতরাং আমরাই সেরা বিচারক এটা দেখার জন্য যে, আমরা এখনও রাগ করছি কিনা অথবা আমরা কম রাগ করছি কিনা ইত্যাদি।

আমাদের যে নীতিটি মনে রাখতে হবে সেটা হ’ল জীবনে ওঠা-নামা আসতেই থাকে এবং এই অগ্রগতি কখনো রৈখিক হয় না। এটা কখনই হওয়ার নয় যে, আমরা প্রতিদিন ভালো থেকে আরও ভালো থাকব। যতক্ষণ না আমরা একটি মুক্ত সত্ত্ব হয়ে উঠতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনে ওঠা-নামা হতেই থাকবে। যদিও আমরা অনেক লম্বা সময় ধরে অনুশীলন করি, এবং সাধারণতঃ আমরা ক্রোধিত হই না, তা সত্ত্বেও মাঝে-মাঝে আমরা ক্রোধিত হয়ে যেতে পারি। কিন্তু এর জন্য নিরুৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। একদিকে যেমন নিজেকে উন্নত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা আবশ্যক, আবার অন্যদিকে যদি আমরা ভুল করে ফেলি তাহলে নিজেকে দোষারোপ করা বা শাস্তি দেওয়া আবশ্যক নয়। পরম পূজ্য দালাই লামা বলেছেন যে, আমরা যে অগ্রগতি করেছি তার অনুমান করার সময় কেবল এক সপ্তাহ নয়, পাঁচ বছরের সময়কালের দিকে নজর দেওয়া উচিত। যদি আমরা দেখি যে, এখনকার তুলনায় পাঁচ বছর আগে পরিস্থিতি গুলির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করেছি, তাহলে আমরা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারব যে, আমরা কতটা প্রগতি করেছি।

সারাংশ

ধ্যান করার জন্য কোন বিশেষ জায়গার প্রয়োজন হয় না, কোনো অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং পরিষ্কার স্থান হলেই হবে, কিন্তু সেটাও যদি উপলব্ধ না থাকে, তাহলেও ঠিক আছে। আমার একটি বন্ধু তার মায়ের সাথে ছোট্ট একটা ঘরে বাস করত। সেখানে মূলতঃ একটি কক্ষ ছিল এবং সেখানে তার মায়ের টেলিভিশন ও রেডিও ছিল। যদি সে ধ্যান করার বা এরকম কিছু করার চেষ্টা করত, তার মায়ের মন খারাপ হয়ে যেত। তার একমাত্র সম্ভাবনা ছিল টয়লেটে বসে ধ্যান করা, সেখানে সে প্রত্যহ অনুশীলন করত এবং তার জন্য সেটাই ঠিক ছিল। মোমবাতি বা ধূপ অথবা এই জাতীয় জিনিস আপনার দরকার নেই; এগুলি কেবল “জিনিস”। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হ’ল যে, আমরা আমাদের মনকে নিয়ে কী করছি এবং ধ্যান হ’ল একটি মনের অবস্থা, যেটা আমরা যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় অনুশীলন করতে পারি। আমরা যখন পাতালরেলে বা বাসে থাকি, তখন অল্প কিছু মানসিক অবস্থার বিকাশ আরও সহজে হতে পারে। আমরা যখন ধৈর্যের বিকাশ এটা দেখার জন্য করতে চাই যে, সবাইকে সুখী দেখতে চাই, অসুখী দেখতে চাই না, তখন জনগণের কল্পনা করার জন্য, আমাদের ঘরে একা বসে থাকার চেয়ে ভীড়ে ঠাসা বাসের চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?

ধ্যান অনুশীলনের জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হ’ল, আমাদের ব্যর্থ না হয়ে প্রতিদিন এটা করা। যেমন আপনি প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করতে বা টয়লেটে যেতে ভুলে যান না, তেমনই আপনি ধ্যান করতেও ভুলবেন না। দিনে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও আমরা এটাকে আমাদের জীবনের একটি স্থির অংশ বানাতে পারি। আমরা যেই হই না কেন, আমরা সবাই এটাকে দৈনিক অনুশীলনে শামিল করার জন্য পাঁচ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠতে পারি। এটার জন্য কিছু অগ্নি পরীক্ষার দরকার নেই, বরং এটার দ্বারা আমাদের জীবনে স্থিতিশীলতা আসতে পারে। দিনটি যতই কঠিন হোক না কেন, আপনার কাছে সর্বদা এই সময়টি থাকবে যা ধারাবাহিকতা প্রদান করবে।

Top