আজকাল মানুষ যে সমস্যায় ভুগছে
কিছু সমস্যা আছে যা দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে অর্থাৎ যখন থেকে এই গ্রহতে মানুষ আছে এবং সম্ভবতঃ আরও আগে থেকে, কেননা মানুষের আগে তো পশুর অস্তিত্ব ছিল। সমস্যা গুলিকে যদি লক্ষ্য করা হয়, আমরা বুঝতে পারব যে, সেখানে ছিল একে-অপরের সাথে সম্পর্ক গড়ার সমস্যা, ক্রোধ জনিত সমস্যা, লড়াই-ঝগড়া থেকে উদ্ভূত সমস্যা ইত্যাদি। প্রায় প্রত্যেকে চিরকালই এই সমস্যা গুলির মুখোমুখি হয়। অতএব এখানে বিশেষ বলতে কিছু নেই যে, আপনি কী ভোগ করেন বা আমিই বা কী ভোগ করি। তারপর অবশ্যই রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা, যুদ্ধের সমস্যা ইত্যাদির মতো সাম্প্রতিক সমস্যা যা বিষয় গুলিকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তাই মানুষ এই সমস্যা গুলি আরও বেশী ভোগ করে। তারা সেই সমস্যা গুলির সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না যে, ব্যক্তিগত স্তরে কীভাবে সেগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে, তার মধ্যে বিশেষ করে তাদের আবেগ, তাদের মনের দিক থেকে। ইতিমধ্যে তাদের কাছে যা কিছু উপলব্ধ আছে তারা এগুলির সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না।
তবে আধুনিক সময়ের একটি আশ্চর্যজনক বিকাশ হ’ল যোগাযোগ। বিশেষতঃ আমরা এখন একে বলি ‘তথ্য-যুগ’ এবং এর সাথে আরও অনেক কিছু জড়িয়ে আছে অর্থাৎ সামাজিক মাধ্যমের যুগ। সুতরাং এর মানে হল বৈকল্পিক পদ্ধতি সম্পর্কে এখন আরও বেশী তথ্য আমাদের কাছে উপলব্ধ থাকে। যেমন- পরম পূজ্য দালাই লামার মতো অনেক মহান বৌদ্ধ নেতারা বিশ্বের চারিদিকে ভ্রমণ করছেন। বহু লোক সাক্ষী আছে এবং তারা নিজের চোখেই দেখছেন যে তারা একটা অসাধারণ স্তর পর্যন্ত বিকাশ করতে প্রয়াস করছেন। ফলে নিজের দেশকে হারানোর মতো কঠিনতম পরিস্থিতির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তারা শান্ত, স্থির এবং মৈত্রীপূর্ণ মন বা ভাবনা বজায় রাখতে সক্ষম। তাই আমরা শুধু ইন্টারনেট বা বই থেকে যে তথ্য অর্জন করতে পারি এমন তথ্য ছাড়াও একজন জীবিত ব্যক্তির কাছ থেকে অনুপ্রেরণার গুণও লাভ করতে পারি। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব মানুষ যে বৌদ্ধধর্মের দিকে অভিমুখ করছে তার মূল কারণ হল- তারা বর্তমানে যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সেই সমস্যার সমাধান তারা বৌদ্ধধর্মের মধ্যে খুঁজছে এবং তারা আশাবাদী যে, বৌদ্ধধর্ম তাদের কোন না কোনও উপায় অবশ্যই দেখাবে যা দিয়ে তারা তাদের জীবনের সাথে মোকাবিলা করতে পারবে। এরজন্য তাদের সমাজের ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্ম বিদেশী কিছু হতে পারে অথবা হতে পারে এটি তাদের লোকেদের একটি পারম্পারিক পদ্ধতি।
বৌদ্ধধর্মের যুক্তিসঙ্গত দিক
বৌদ্ধধর্মকে বিচার করার কাঠামোর মধ্যে সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেও এর বিভিন্ন দিক বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত। আমরা যদি দেখি, পরম পূজ্য দালাই লামা কিসের উপর বেশী জোর দেন, আমরা বুঝতে পারব তিনি যার উপর জোর বেশী দেন, সেটা হল বৌদ্ধধর্মের যুক্তিসঙ্গত, বিশ্লেষণাত্মক এবং ব্যবহারিক দিক। এটাকে অনেক মানুষ অত্যন্ত আবেদনময়ীও মনে করেন। তিনি দেখান যে, বৌদ্ধধর্মের প্রবেশ পথটা অনেকটা বিজ্ঞানের প্রবেশ পথের মতো। এর মানে হল আমরা শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাস এবং নিষ্ঠার ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতিকে গ্রহণ করব না বরং আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে অনুসরণ করব অর্থাৎ যুক্তি, কারণ, গভীর বিশ্লেষণ এবং একটা ব্যবহারিক পথ যার দ্বারা আমরা স্বয়ং পরীক্ষা করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারি এই দেখার জন্য যে, বৌদ্ধধর্মে যে পদ্ধতিটা শেখানো হয়েছে বা হয় সেটা আদৌ ফলপ্রসূ কিনা। যেমন বলা হয়- এটা মানসিক শান্তি প্রদান করে যা সমস্যাকে উত্তম উপায়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। আমাদের প্রবেশ পথের ব্যবহারিক জিনিসটা আদর্শবাদী নয়, বরং ব্যবহারিক, যার অর্থ হল, এটা বাস্তবসম্মত যা দৈনন্দিন জীবনে সহায়তা করে।
এগুলি ছাড়াও, যদি পারম্পারিক বৌদ্ধ শিক্ষায় এমন কোনও দিক থাকে- উদাহরণ স্বরূপ, জগতের কাঠামো- যেগুলি বিজ্ঞানের তথ্য দ্বারা ভুল বা বেমানান প্রমাণিত হয়, তাহলে পরম পূজ্য দালাই লামা এগুলি সমস্ত বৌদ্ধ শিক্ষা থেকে বাদ দিতে খুশি হবেন এবং তার পরিবর্তে বিজ্ঞানের দৃষ্টি প্রতিস্থাপিত করবেন। কারণ এরকম করলে কিছুই পরস্পর বিরোধী হবে না। বৌদ্ধধর্ম জোর দেয় বাস্তবতার উপর, কল্পনার উপর নয়। বুদ্ধ এই জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভূগোলের উপর শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয় বরং আমাদের জীবনের সমস্যা গুলির সাথে মোকাবিলা করতে একটি উপায় শেখানোর জন্য। অন্যদিকে, এই গ্রহের আকার আর পৃথিবী থেকে সূর্য এবং চাঁদের দূরত্ব, এই ধরণের বিষয় সম্পর্কিত পারম্পারিক শিক্ষাগুলি পারম্পারিক ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং মানুষ এগুলিকে বুঝতেও পেরেছিল আড়াই হাজার বছর আগে।
অতএব ঐ জিনিস গুলির সম্পর্কে পারম্পারিক শিক্ষাগুলি আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটা বুদ্ধের শিক্ষার মূল উপাদান নয়। পরম পূজ্যজী এটাকে অস্বীকার করার জন্য বৈজ্ঞানিকদের চ্যালেঞ্জ করেন। উদাহরণ স্বরূপ, ‘পুনর্জন্ম’, এই বিষয়টাকে শুধুমাত্র এই কথাটির ভিত্তিতে, “আমি মনে করি না” বিবেচনা করা থেকে খারিজ করেন না। বস্তুটি অস্তিত্বে নেই, এরকম দাবি করার জন্য এই কথাটি, “আমি মনে করি না” একটা বৈধ কারণ নয়।
সুতরাং এটা এমন কিছু যেটা অবশ্যই আরও যুক্তিসঙ্গত চিত্ত দ্বারা মানুষকে আবেদন করা হয়। এই প্রসঙ্গে দালাই লামার নেতৃত্বাধীন বৌদ্ধপক্ষ এবং অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক পক্ষের মধ্যে একটা সততা পরায়ণ আচরণ আছে যাকে আমরা বলি পরনিকেষ। বিশেষকরে ঔষধের ক্ষেত্রে, কারণ এই বিষয়ে বৌদ্ধ শিক্ষা দ্বারা প্রস্তুত একটা অন্যতম বিষয় হল- আমাদের মনের অবস্থার কারণে আমাদের স্বাস্থ্য গুরুতর ভাবে প্রভাবিত হয়। আমরা যদি খুবই হতাশবাদী, নেতিবাচক হই আর সর্বদা ‘আমার, আমার, আমার’ বিষয়ে চিন্তিত হতে থাকি, তাহলে এটা আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। এর কারণে আমাদের অসুস্থতা আরও খারাপ হয়ে যায় আর আমরা তাড়াতাড়ি সুস্থ হই না। পাশাপাশি আমরা যদি আশাবাদী হই এবং অন্য সকলের কথা ভাবি যারা এই ধরণের অসুস্থতায় ভুগছেন; এছাড়াও আমাদের পরিবার এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকি তাহলে আমরা সর্বদা অভিযোগ করি না। আমাদের মন এবং হৃদয় অনেক বেশী শান্তিতে থাকে এবং এটা আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী বানায়। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলির উপর বিভিন্ন অনুসন্ধান করেছেন এবং সেগুলি সত্য হিসাবে প্রদর্শিতও হয়েছে। সুতরাং এই পদ্ধতিগুলি এখন অনেক হাসপাতালে চালু করা হয়েছে।
এছাড়াও বৌদ্ধধর্মে অনেকগুলি পদ্ধতি রয়েছে যা ব্যথা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও খুবই সহায়ক। সাধারণতঃ ব্যথা জিনিসটা নিজের থেকেই যথেষ্ট খারাপ হয়। তবে আমরা যদি এর সাথে ভয় এবং ভিতরে-ভিতরে অত্যন্ত কঠোর আবেগ যোগ করে দিই তাহলে এটি আরও বেশী খারাপ হয়ে যায়। বৌদ্ধধর্ম শ্বাস-প্রশ্বাসের ধ্যান সহ বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা দেয় যা দিয়ে আমরা অনেক ভালোভাবে ব্যথার সাথে মোকাবিলা করতে পারি। এর পদ্ধতি গুলি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে প্রবর্তিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতি গুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে বৌদ্ধ খাম প্রয়োজন হয় না যার মধ্যে এটা বহন করতে পারে। আমাদের বৌদ্ধ শিক্ষা গুলিকে অন্যদের এত বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই যাতে তারা যেন ঐ পদ্ধতি গুলি অনুসরণ করে। এগুলি সার্বজনীন ভাবে উপলব্ধ পদ্ধতি এবং যে কেউ যেকোন বিশ্বাস-ব্যবস্থার মধ্যে গ্রহণ করতে পারে। তবে যেহেতু এগুলি বৌদ্ধ শিক্ষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, সুতরাং মানুষ এর প্রতি কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বেশ, এই বৌদ্ধ শিক্ষাগুলির বিস্তৃত বিবরণ কী? আমরা মার্শাল আর্ট অনুশীলন কারীদের মধ্যে এই ধরণের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। মার্শাল আর্টটি বৌদ্ধ সমাজে বিকশিত হয়েছিল। অতএব বহু মানুষ যারা এর অনুশীলন করেছে, তারা এই শিক্ষাগুলি বৌদ্ধ পটভূমি কী ছিল সেটা জানতে আগ্রহী হয়েছে।
কল্যাণমিত্রের (আধ্যাত্মিক গুরু) কাছ থেকে অনুপ্রেরণা
তবে অবশ্যই, এমন অনেক লোক আছেন যারা ভীষণ ভাবে এবং যুক্তিসঙ্গত ভাবে সমুজ্জল নয়, যারা তাদের জীবন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভাবে খুবই অনুগত নয়, সেইজন্য বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দিকগুলি তাদের আবেদন করেছে অর্থাৎ তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একটা দিক ইতিমধ্যে আমার ইঙ্গিত করা হয়ে গিয়েছে যখন আমি কল্যাণমিত্রের কাছ থেকে অনুপ্রেরণার কথা বলি। বেশী পরিমাণে মহান কল্যাণমিত্রদের সাথে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ এবং ইন্টারনেটে বই, অডিও আর ভিডিও রেকর্ডিংয়ে উপলব্ধ তাদের উপদেশগুলির প্রতি যে সকল মানুষ বেশী ভক্তিমূলক ভাবে অনুগত হয়েছে তারাই ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যখন অনেক মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন নেতাদের বিষয়ে শুনেছেন বা মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাদের প্রতি নিরাশ হয়েছেন, তারা বড় আশা নিয়ে এই বৌদ্ধ আচার্যদের অবলোকন করেছেন যাতে তারা এমন একজনকে খুঁজে পান যিনি বেশী শুদ্ধ।
অবশ্যই, আমাদের বাস্তববাদী হওয়া প্রয়োজন। বৌদ্ধ পটভূমি থেকে আগত প্রত্যেক কল্যাণমিত্র সম্পূর্ণভাবে শুদ্ধ হয় না। সর্বোপরি তারাও আমাদের মতো মানুষ। সুতরাং তাদের যেমন শক্তিশালী পয়েন্ট আছে, তেমন দুর্বল পয়েন্টও আছে। তবে তাদের বেশিরভাগ সংখ্যক সত্যিই বেশ অসাধারণ। তাই মানুষ ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে- আমি বলব, কিছু মানুষ এই শিক্ষকদের দ্বারা ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যেমনকি আমি আগে বলেছি, এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে আছেন পরম পূজ্য দালাই লামা। সুতরাং তাদের মনে এবং অন্তরে যা জাগে সেটা হলঃ “আমিও যদি এরকম হতে পারতাম!” তারা একটা দৃষ্টান্ত প্রস্তুত করে যা আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে ব্যক্তিগত ভাবে অর্জন করা সম্ভব। কারণ পরম পূজ্য দালাই লামার মতো কেউ সর্বদা বলেন, “আমার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই।” আসলে বুদ্ধও বলেছেন, “আমার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই।” আমি আপনার মতোই শুরু করেছিলাম। আমার কাছে একই কাজের উপকরণ ছিল এবং আছেও আর সেটা হল- মন, হৃদয়, অন্যের যত্ন নেওয়ার জন্য মৌলিক মানবীয় মূল্য ইত্যাদি। আমি সেগুলি বিকাশ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আপনারা যদি কঠোর পরিশ্রম করেন তাহলে আপনারাও তাদের বিকাশ করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং পরম পূজ্য দালাই লামার মতো মহান ব্যক্তিরা তাঁদের পথে চালিত করতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করবেন না, অতি-পবিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন না এবং তাদের সমতুল্য হয়ে ওঠা বা তাদের মতো হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করবেন না যেটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তাই, যারা তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বেশী বৈজ্ঞানিক নয় বরং অতি-নিষ্ঠাবান ভাবে অনুগত, তাদের জন্য এটি খুবই আবেদনময়ী।
বৌদ্ধ সাধনা-পরম্পরার পুনরুজ্জীবন করা
যে সমস্ত জায়গা পারম্পারিক ভাবে বৌদ্ধ হয়ে রয়েছে এবং যেখানে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে বৌদ্ধ অনুশীলনের লভ্যতা হ্রাস পেয়েছে, বর্তমান দিনে বৌদ্ধধর্মের পক্ষ থেকে আরও একটা আবেদন হল যে, সেখানে এর পুনর্জীবনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈধ পদ্ধতি। এর কারণ হল- যেহেতু আমরা আধুনিকীকরণের মোকাবিলার মুখোমুখি হচ্ছি, সুতরাং আত্ম-বিশ্বাস এবং স্ব-মূল্যবোধ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমাদের বলা হয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা যা কিছু বিশ্বাস করতেন সব কিছুই অর্থহীন ছিল এবং আমরা যদি সত্যিই আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করতে চাই তাহলে আমাদের সেসব কিছুই ভুলতে হবে। এরকম করলে আমাদের নিজের এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি একটি নিম্ন বিচার-ধারা তৈরী হয়ে যাবে। এটি আমাদের ভাবাবে যে, আমরা কোনভাবেই ভাল নেই বরং আমরা বোকা। এর সাথে একটা বিশ্বাস, আবেগগত বিশ্বাস হিসাবে আমাদের মধ্যে স্ব-মূল্য বা আত্ম-বিশ্বাসের অনুভূতির অভাব তৈরী হবে। ফলে যার সাথে আমরা বেড়ে উঠতে পারব তাই নিয়ে আমাদের গর্ববোধ করার কোনও আধার থাকবে না। অতএব আমি বিশ্বাস করি যে, আরও বৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের জন্য আমাদের আবেগময় ভিত্তি প্রদানে পারম্পারিক প্রথা এবং বিশ্বাসের দিকে অভিমুখ হওয়া আর সেগুলি পুনর্জীবন বা পুনঃপ্রবর্তন করা একটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ অংশ।
অবশ্য পরম্পরা যেটাই হোক না কেন, তার মধ্যে শক্তিশালী পয়েন্টও থাকবে আর দুর্বল পয়েন্টও থাকবে। সময়ের সাথে সম্ভবতঃ দুর্বল পয়েন্ট গুলিকে অপব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী পয়েন্ট গুলির উপর জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। একটা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের স্কুলে বিশ্বস্ত বা আনুগত্য নীতির উপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়। প্রত্যেকের মধ্যে তাদের পরিবার, তাদের বংশ, তাদের ধর্ম, যাই হোক না কেন তার প্রতি অনুগত হওয়ার একটা উদ্যম আছে। আনুগত্য দুদিকে যেতে পারে- ইতিবাচক গুণাবলীর প্রতি অনুগত হওয়া অথবা নেতিবাচক গুণাবলীর প্রতি অনুগত হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, যদি একটি পরম্পরায় অন্য পরম্পরার প্রতি অসহিষ্ণুতার মতো নেতিবাচক গুণ থাকত এবং অন্য পরম্পরায় যদি এর উপর জোর দেওয়া হতো তাহলে, যে সমস্ত মানুষ ঐ পরম্পরাকে প্রত্যাখ্যান করবেন তারা এখনও অসহিষ্ণুতার মতো মনোভাবের প্রতি অনুগত থাকবেন। সুতরাং তারা এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পাশাপাশি কেউ যদি কোনভাবে সেটির উপর বিশ্বাস করেছে তার প্রতি তারা ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। এটা নেতিবাচক আনুগত্য অথবা অস্থানে স্থাপিত আনুগত্য। অন্যদিকে কেউ যদি দুর্বলতা অর্থাৎ একটি পরম্পরার দুর্বল পয়েন্টকে অস্বীকার করার পরিবর্তে তার ইতিবাচক দিকগুলির উপর জোর দেয় তাহলে সেই মানুষ গুলি দুর্বল পয়েন্ট গুলির প্রতি অন্ধ চোখ ব্যতীত সেই ইতিবাচক দিকগুলির প্রতি আনুগত্য হবে। এটি তাদের সেটাকে পুনরাবৃত্তি করতে প্রেরিত করতে পারে। অতএব এটা বৌদ্ধধর্মের আরও একটা আবেদন, বিশেষ করে ঐ অঞ্চল গুলিতে যেখানে এটি তাদের পারম্পারিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এমন একটা অঞ্চলে পরিণত হয়েছে যেখানে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের নিজেদের সম্পর্কে পুনর্জীবন করতে এবং স্ব-মূল্যবোধ বিকাশ করতে সহায়তা করা প্রয়োজন।
বৌদ্ধ ধর্মের বহিরাগত দিক
আরও একটা শ্রেণী আছে যারা তাদের নিজেদের কল্পনার উপর ভিত্তি ক’রে বৌদ্ধধর্মকে আবেদন করতে দেখে। তাদের জীবনে সমস্যা আছে এবং সেই সমস্যা গুলির জন্য ঐন্দ্রজালিক বা বহিরাগত সমাধানের খোঁজ করে। বৌদ্ধধর্মে, তার মধ্যে বিশেষকরে তিব্বতী, মঙ্গোলিয় এবং কাল্মিক সংস্করণ গুলি সব রকমের বহিরাগত জিনিসে পরিপূর্ণ অর্থাৎ বিভিন্ন দেব-দেবী এবং তাদের মুখ, হাত আর পা, তাদের সমস্ত মন্ত্র ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মতে এগুলি কিছুটা ঐন্দ্রজালিক শব্দের মতো মনে হয়, যাকে মিলিয়ন বার জপ করলে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তাদের মতে হাত এবং পা সহ এই সমস্ত আকৃতি বা প্রতিমা গুলিকে অবশ্যই কিছুটা ঐন্দ্রজালিক হতে হবে। এইভাবে এগুলিকে অর্থাৎ যেমন আমি বলেছিলাম, ঐ ঐন্দ্রজালিক ধরণের পদ্ধতি গুলিকে তারা সুখ অর্জনের উপায় হিসাবে দেখে বৌদ্ধধর্মের দিকে অভিমুখ হয়।
যদিও তারা এই পদ্ধতি গুলি অনুশীলন করে কিছু লাভ অর্জন করতে পারে (এটা অস্বীকার করা যায় না যে এতে কিছু লাভ আছে, এমনকি এই বাস্তব পদ্ধতিতে নয় বরং আদর্শবাদী পদ্ধতিতে যদি বৌদ্ধধর্মের দিকে অভিমুখ করি), কিন্তু পরম পূজ্য দালাই লামা সব সময় জোর দেন যে, এটা আসলে বাস্তববাদী নয়। এতে অবশ্যই কিছু লাভ থাকতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের নিরাশ হতে হবে। কারণ দুর্ভাগ্যবশতঃ এতে কোন ঐন্দ্রজালিক সমাধান নেই। আমরা যদি সত্যিই মনের শান্তি অর্জন করতে চাই এবং আমাদের জীবনের সমস্যা গুলি নিবারণ করতে সক্ষম হতে চাই তাহলে আমাদের নিজেদেরকে সেই দিকগুলির মুখোমুখি হতে হবে যেটার মুখোমুখি হওয়া খুব সুন্দর বা আরামদায়ক নয়। আমাদের মুখোমুখি হতে হবে এবং মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ক্রোধ, স্বার্থপরতা, লোভ, আসক্তি ইত্যাদির সাথে। এর পরিবর্তে শুধু ঐন্দ্রজালিক সমাধানের খোঁজ করলে এবং এই ব্যক্তিগত বিষয় গুলির অবহেলা করলে সত্যিই বেশী লাভ অর্জন করা যায় না। তবে অবশ্যই বর্তমানে সমাজে এখনও অনেক লোক আছে যারা বেশী করে এই বহিরাগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের আবেদন সন্ধান করে।
সারাংশ
সংক্ষেপে আমরা দেখতে পাই যে, বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দিক রয়েছে যেগুলি মানুষ আকর্ষণীয় এবং আবেদনময়ী মনে করে। তবে এসব কিছু বৌদ্ধধর্মে উল্লিখিত পদ্ধতি খুঁজে পাওয়ার মৌলিক ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয় যা আমাদের জীবনের সমস্যা এবং দুঃখকে দূর করতে সহায়তা করে। যাই হোক না কেন, এটি বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে আমাদের মোকাবিলা করার কিছু উপায় খুঁজতে আকর্ষিত করে। বুদ্ধের উপদেশে যে অদ্ভুত জিনিস আছে যা সকলেই পছন্দ করে সেটা হল, এই ধর্মটা আসলে সমস্যার নিবারণের জন্য আমাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে অনুসরণ করার পদ্ধতি গুলি প্রদান করে।
এটি আড়াই হাজার বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি জীবন্ত পরম্পরা এবং এখনও মানুষ এটার অনুশীলন করেন এবং ফল প্রাপ্ত করেন। সুতরাং এটি হল শুধু এই পদ্ধতি গুলি বাস্তবে অনুশীলন করার বিষয়; এইজন্য এটা প্রবর্তিত করা হয়েছে। এটা শুধু একটি পদ্ধতি নয় বরং অনেক এবং বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি। এর সম্পর্কে বুদ্ধ এই উপলব্ধি ক’রে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, প্রত্যেকে একটা পৃথক এবং বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন পদ্ধতিকে বেশী উপযোগী মনে করেন। এটা এমন কিছু যা মানুষ খুবই আশ্চর্যজনক মনে করেন। এর কারণ হল- রেঁস্তোরায় একটা বিশাল মেনু রাখার মতো। বৌদ্ধ পদ্ধতি গুলির সম্পূর্ণ বিবিধতার মধ্যে আমরা সাধারণতঃ এমন কিছু খুঁজে পেতে পারি যা আমাদের জন্য উপযুক্ত। আর আমরা যদি একটা জিনিসের জন্য চেষ্টা করি এবং সেটা আমাদের জন্য মানানসই না হয় তাহলে অন্যান্য অনেক জিনিস উপলব্ধ আছে যেটা আমরা অনুসরণ করতে পারি। প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে আমরা তথ্যযুগে বাস করি যার অর্থ, আমরা যেখানেই থাকি না কেন এই পদ্ধতি গুলি আমাদের জন্য বৃহত্তর সংখ্যায় উপলব্ধ থাকে।