ট্রাফিকে আটকে যাওয়ার সময় শূন্যতার প্রয়োগ

শূন্যতার অর্থ হল অস্তিমান হওয়ার অসম্ভব উপায়গুলির পূর্ণ অনুপস্থিতি। যে কোন বস্তু কোনও কিছুর উপর নির্ভর না ক’রে স্বতঃসিদ্ধভাবে ও স্বতন্ত্রভাবে অস্তিমান হতে পারে না; এটা অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন কোন ব্যক্তিকে সহজাতভাবে মূর্খরূপে প্রতিষ্ঠিত করার বিভ্রান্তিকর আভাসকে বিনির্মাণ করি তখন আমরা বুঝতে পারি যে মূর্খ হওয়াটা পুরোপুরি মূর্খ সম্পর্কিত মানসিক আখ্যা এবং ধারণার উপর নির্ভর করে। এই বোধগম্যতা আমাদের তখন ক্রুদ্ধ না হতে সহায়তা করে, যখন কেউ রাস্তায় তার গাড়ির হর্ণটা ভীষণ জোরে বাজায় এবং আমাদের পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

অসচেতনতা

বুদ্ধ চারটি আর্যসত্যের ভিত্তিতে তাঁর শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। এই চারটি তথ্যকে যেকোন উচ্চ সিদ্ধি প্রাপ্ত সত্ত্বরা সত্য হিসাবে দেখেন। মূলতঃ এগুলি হলঃ

  1. আমরা সকলেই জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হই।
  2. এই সমস্যাগুলি উৎপন্ন হয় কারণ থেকে।
  3. সমস্যাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে নিরোধ করা সম্ভব হয় যে, সেগুলি আর কখনোই ফিরে না আসে।
  4. এই ধরণের নিরোধকে একটি বোধগম্যতার মাধ্যমে অর্জন করা হয় যা সমস্যার কারণগুলি দূর ক’রে দেয়।

আমরা যখন আমাদের সমস্যার গভীরতম কারণ সম্পর্কে আলোচনা করি, তখন যে নিষ্কর্ষটা সামনে আসে সেটাকে সাধারণতঃ “অবিদ্যা” হিসাবে অনুবাদ করা হয়। ইংরেজিতে, “অসচেতনতা” শব্দটা আরও ভাল। অবিদ্যার নিহিতার্থ হল যে আপনি বোকা, সুতরাং এটা একটা ভাল শব্দ নয়। এর অর্থ এই নয় যে আমরা বোকা।

অসচেতনতার দুটি ভিন্ন রূপ আছে। একটি হল, আমরা আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে কারণ এবং ফল সম্পর্কে অসচেতন যে, আমরা যদি ধ্বংসাত্মক ভাবে কাজ করি তাহলে এটা সমস্যার জন্ম দেবে। আরও গভীর স্তরে, আমরা বাস্তবতার অসচেতনতা সম্পর্কে কথা বলে থাকি। যা ঘটে সেটা হ’ল আমরা কল্পনার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে থাকি যে বস্তু সহজাতভাবে অস্তিমান আছে, সেটাকে আমরা স্বতঃ-প্রতিষ্ঠিতরূপে অনুবাদ করতে পারি। এটা হল স্বভাব-সিদ্ধরূপে গ্রহণ করার একটা অভ্যাস। আমাদের এই অভ্যাসের কারণে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে, প্রতিটি মূহূর্তে, আমাদের মন বস্তুকে সহজাতভাবে অস্তিমান হওয়ার আভাস উৎপন্ন করায়। এর অর্থ হ’ল যে, বস্তুর দিক থেকে এমন কিছু থাকে যেটা স্বতন্ত্রভাবে অস্তিমান এবং অন্যের উপর নির্ভর না ক’রে এমন ক’রে বস্তুকে অস্তিমান হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত করে যে সেগুলি আভাসিত হয়। আমরা এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ যে এই ধরণের অস্তিত্ব কোনভাবেই বাস্তবিকতার সাথে মিল খায় না, তবুও আমরা বস্তুকে এইভাবে অস্তিত্বমান ভেবে নিই।

এটাকে বোঝা সহজ নয়। আমরা নিম্নে উদাহরণের সাহায্যে এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারি। ধরা যাক, আমরা আমাদের গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাচ্ছি আর পাশের রাস্তায় কেউ খুব জোরে হর্ণ বাজাতে-বাজাতে আমাদের অতিক্রম ক’রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের কাছে এই ব্যক্তিটি কেমন মনে হয়? আমাদের অতিক্রম ক’রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ব্যক্তিটি আমাদের কাছে মূর্খ মনে হয়। সেই ব্যক্তিটি সহজাতরূপে একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান ব’লে মনে হয়। ঐ ব্যক্তি অন্য কোন জিনিসের থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজেথেকেই মূর্খ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ব’লে মনে হয়। অন্য কথায়, এটা স্পষ্ট যে এই ব্যক্তির মধ্যে নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে, যা তাকে সত্যিই একটা মূর্খ বানিয়ে দেয় যে, সে জোরে আওয়াজ ক’রে হর্ণ বাজিয়ে আমার অতিক্রম ক’রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমরা হর্ণের আওয়াজ শুনি, ব্যক্তিটিকে দেখি এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিন্তা করি, “মূর্খ কোথাকার!” ব্যক্তিটি এইরূপে আভাসিত হয় এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, এই আভাসটি বাস্তবতার সাথে মিল খায়ঃ সে সত্যিই একজন মূর্খ।

শূন্যতা যা খন্ডন করে

মূর্খ হিসাবে এই ব্যক্তির অস্তিত্বের এই কল্পনাগত জ্ঞানের কল্পনাগতভাবে নিহিত বস্তুটি কী? জ্ঞানের কল্পনাগতভাবে নিহিত বস্তু হল একজন ব্যক্তি, যে আসলে একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান; গাড়ির ভিতরে আসলে একটি স্বভাবগত মূর্খ বসে আসে। এই আভাস দ্বারা এবং আমাদের চিত্ত দ্বারা তাকে ঐ রূপে গ্রহণ করার অর্থ নিহিত আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমি যদি মনে করি যে অন্য কক্ষে কেউ আছে, কল্পনাগত ভাবে নিহিত বস্তু হবে যে, অন্য কক্ষে কেউ আছে; এটাই সেই বস্তু যা বাস্তবে ভাবনার অনুরূপ হবে। “কল্পনাগত ভাবে নিহিত বস্তু” হল মধ্যমক (মধ্যমা পথের) শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দাবলী।

যেকোন কল্পনাগত জ্ঞানে অনেক বিষয় জড়িত থাকে। অভিনিবিষ্ট বিষয়ে (শেন-উল) অভিনিবেশ (শেন) নামক শব্দকে অভিনিবেশ করা বা আঁকড়ে ধরে থাকা (শেন-পা) একভাবে একটি ক্রিয়াপদ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-সাক্য পরম্পরায় নিহিত “চার অভিনিবেশ থেকে মুক্তি।” এখানে অভিনিবেশ করার অর্থ হল- কল্পনাগত জ্ঞানে যা আভাসিত হয়, সেটাকে বাস্তবিকতার সাথে যুক্ত ক’রে অভিনিবেশ করাকে বলা হয়। আমরা যখন স্বতঃ-প্রতিষ্ঠিত ও সহজাতভাবে অস্তিমান কোন বস্তুর প্রতি অভিনিবেশ উৎপন্ন করি, তখন কল্পনাগত বস্তুকে বাস্তবিকতার অনুরূপ মনে ক’রে সেটাকে সত্যতঃ অস্তিমান মনে করি। উপরোক্ত উদাহরণ অনুসারে, আমরা কল্পনা করি যে, অন্য গাড়ীর মধ্যে হর্ন বাজানো ব্যক্তিটি স্বভাবগত মূর্খ। এই ধরণের কল্পনা থাকার কারণে ঐ ব্যক্তিটি আমাদের কাছে মূর্খরূপে আভাসিত হয়; অতএব আমরা ধরে নিই সেখানে প্রকৃতপক্ষে একজন মূর্খ ব্যক্তি আছে; আমরা আমাদের অভিক্ষেপের (কল্পনা) উপর বিশ্বাস করি। জ্ঞানের এই কল্পনাগত বিষয় এবং এই আভাস হল গাড়িতে থাকা একজন প্রকৃত মূর্খ ব্যক্তি। 

শূন্যতার অর্থ হল অস্তিমান হওয়ার অসম্ভব উপায়গুলির পূর্ণ অনুপস্থিতি। যেকোন বস্তু কোনও কিছুর উপর নির্ভর না ক’রে স্বতঃসিদ্ধভাবে ও স্বতন্ত্রভাবে অস্তিমান হতে পারে না, এটা অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন কোন ব্যক্তিকে স্বভাবগতভাবে মূর্খরূপে প্রতিষ্ঠিত করা বিভ্রান্তিকর আভাসকে বিনির্মাণ করি তখন আমরা বুঝতে পারি যে, মূর্খ হওয়াটা পুরোপুরি মূর্খ সম্পর্কিত মানসিক আখ্যা এবং ধারণার উপর নির্ভরশীল। যদিও সেখানে একজন ব্যক্তি আছে যে গাড়ি চালাচ্ছে, তবুও সে মূর্খ হিসাবে স্বভাবতঃ অস্তিমান নয়। মূর্খ হিসাবে কেউ স্বভাবতঃ অস্তিমান হতে পারে না, কারণ মূর্খের মতো স্বভাবতঃ অস্তিত্বমান বলে কিছু হয় না। সুতরাং, গাড়িতে কোনও স্বভাবতঃ প্রতিষ্ঠিত মূর্খ নেই। এটাই হল সাধারণ ধারণা। আমাদের এটা পরিমার্জিত করতে হবে, কারণ এই ধারণাটি ততটা সঠিক নয়।

আসুন, আমরা একটা সহজ উদাহরণ ব্যবহার করি, যদিও এটা কম সুনির্দিষ্ট। ধরুন, একটি শিশু মনে করে যে তার বিছানার নীচে একটা দানব আছে। কল্পনাগতভাবে নিহিত বস্তুটি হল বিছানার নীচে একটা প্রকৃত দানবের উপস্থিতি। এই শিশুটির মধ্যে যে ভয় আছে তার বাস্তবতার সাথে কোন মিল নেই। সুতরাং, আমরা শূন্যতা নিয়ে যা আলোচনা করছি সেটা হল বেশ সুনির্দিষ্ট কোনও বস্তুর পূর্ণ অনুপস্থিতিকে বোঝায় যার প্রকৃতপক্ষে কোন অস্তিত্বই নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব।

তবে শূন্যতার দৃষ্টিতে আমরা দানবের মতো কোন অসম্ভব বস্তুর অনুপস্থিতির কথা বলছি না। আমরা এমন ধরণের অস্তিত্বের কথা বলছি যার অস্তিত্ব অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, বিছানার নীচে একটি বিড়াল থাকতে পারে যেটাকে শিশুটি একটা দানব ব’লে মনে করে, কিন্তু বিড়ালটা দানবরূপে অস্তিমান নেই, কারণ সেখানে “দানবের মতো অস্তিত্ব” ব’লে কিছু নেই। এখানে শূন্যতা বিড়ালের অস্তিত্বকে খন্ডন করে না, এটা দানবরূপী বিড়ালের অস্তিত্বকে খন্ডন করে।

একটি আখ্যাকে বৈধ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা

আসুন, আমরা আমাদের মূর্খের উদাহরণটি আবার দেখি। সাংবৃতিক বা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে, হতে পারে ঐ ব্যক্তিটি একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু আমরা কীভাবে তাকে আমাদের “একজন মূর্খ” কল্পনার সাথে বৈধভাবে আখ্যা দিতে পারি এবং তাকে একজন মূর্খ বলতে পারি? ভারতীয় আচার্য চন্দ্রকীর্তি একটি বৈধ আখ্যার জন্য তিনটি মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন।

প্রথমতঃ একটা স্থাপিত এবং স্বীকৃত প্রচলন থাকা দরকার যা আখ্যার অনুরূপ হবে। জার্মানিতে, গাড়ি চালানোর জন্য শিষ্টাচারের কিছু নিয়ম আছে এবং হর্ণে হাত দিয়ে গাড়ি চালানো যথাযথ ব’লে বিবেচিত হয় না, কারণ আপনি ক্রমাগত সবাইকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। যে এটা করে তাকে মূর্খ ব’লে মনে করা যেতে পারে। এটা হল আপেক্ষিক। ভারতে, এরকম ভাবে গাড়ী চালানোকে স্বাভাবিক গাড়ি চালানো মনে করা হয়। আমি একবার এক ভারতীয় বন্ধুর সাথে ইউরোপে এসেছিলাম, যেটা ছিল তার প্রথম পাশ্চাত্য ভ্রমণ এবং যা তাকে সবচেয়ে বেশি হতবাক করেছিল সেটা হল, মানুষ হর্ণ না বাজিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল! কারণ পশ্চিমাদেশে আমাদের প্রচলন আছে, যে ব্যক্তি এরকম ভাবে গাড়ি চালায় সে একজন মূর্খ। তাই সেই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এই ব্যক্তিকে মূর্খ বলা ঠিক।

দ্বিতীয় মানদন্ড হল যে, এটাকে এমন একটি মন দ্বারা খন্ডন করা উচিত নয় যেটা বৈধভাবে অগভীর বা সাংবৃতি সত্যকে উপলব্ধি করে। বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে গেলে, ব্যক্তিটি কি মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছে? আমি কি আমার চশমা সঠিক ভাবে পরে আছি? আমি কি আমার শ্রবণ যন্ত্রটা সঠিকভাবে পরে আছি? আমি কি সত্যিই সঠিকভাবে দেখছি ও শুনছি? আশেপাশের প্রত্যেকেও দেখছে যে এই ব্যক্তি সবাইকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে এবং জোরে হর্ণ বাজাচ্ছে। তাই অন্যদের বৈধ দৃষ্টির ভিত্তিতে এই সাংবৃতিক বা ব্যবহারিক দিকটি বিরোধী হয় না।

তৃতীয় মানদন্ড হল যে, এই আখ্যাটি কোন মন দ্বারা খন্ডিত হবে না যা বৈধভাবে গভীরতম সত্যকে দেখে। এটি এমন একটি মনকে নির্দেশ করে যা বৈধভাবে দেখে যে কীভাবে এই ব্যক্তিটি একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান। তিনি কীভাবে একজন মূর্খ?

তিনি কি ব্যবহারিক ভাবে একজন মূর্খ যে, তিনি কোথায় এবং কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন তার উপর নির্ভরশীল, অথবা আমরা কি কেবলমাত্র অনুমান করছি যে এই ব্যক্তিটি স্বভাবতই একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান? যদি আমরা মনে করি যে এই ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে, স্বভাবতঃ একজন মূর্খ, এটা এমন একটা মনের বিপরীতে হবে যা দেখে যে, বস্তুগুলি আসলে কীভাবে অস্তিমান। এই ব্যক্তিটি ব্যবহারিক দৃষ্টিতে একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। এটা সঠিক, এটা হল একটি বৈধ প্রচলন, একটা বৈধ আখ্যা এবং একটি বৈধ অগভীর সত্য। যেটা ঘটে সেটা হল, আমরা কীভাবে একজন মূর্খ হিসাবে তার অস্তিত্বকে অগভীরভাবে দেখছি। তিনি একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান কেবলমাত্র অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে- বিশেষ ক’রে মানসিক আখ্যার উপর নির্ভর করে, যেটা আমরা শীঘ্রই আলোচনা করব।

আমরা উপরিতল আভাস এবং অভিক্ষেপ নিয়ে ফাঁপতে থাকি যেটার অস্তিত্ব সেখানে থাকে নাঃ এই ধরণের অস্তিত্ব যেটা বাস্তবে সেখানে থাকে না। আমরা সচেতনভাবে এটা করি না, এটা হল অসচেতন। এটা তো বস্তুকে এইভাবে আমাদের দেখার অভ্যাসের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে। ফাঁপ হল যে, তিনি সহজাতভাবে একজন মূর্খ হিসাবে অস্তিমান। সহজাতভাবে মূর্খরূপী এমন অস্তিত্বের বাস্তবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আবার, এখানেও আমরা একটা অসম্ভবভাবে অস্তিত্বের কথা বলছি, কোন অসম্ভব বস্তুর অনুপস্থিতি সম্পর্কে নয়।

“সহজাত” এবং “স্বভাবতঃ”-এর মধ্যে পার্থক্য

এবার আমরা স্বভাবতঃ বা স্বভাবগত অস্তিত্ব এবং মানসিক আখ্যা বলতে যা বুঝি সেটাকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখব। এরমধ্যে আমাদের সহজাত এবং স্বভাবতঃ-এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।

আমাদের মধ্যে অনেক সহজাত গুণ আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মানসিক সন্ততিতে সহজাতভাবে শরীর, বাক্‌ এবং মন, বোধগম্যতা, আবেগ ইত্যাদি থাকে যা হল আমরা সত্ত্ব হওয়ার অংশ। আমাদের মধ্যে তথাগতগর্ভ এবং তথাগতগর্ভের সব গুণাবলী আছে। তিব্বতী ভাষায় “সহজাত” শব্দটি হল ‘ল্‌হান-স্কেস্‌’ এবং সংস্কৃত ভাষায় হল সহজ, যেটাকে কখনও-কখনও “সহজাত” বা “একইসাথে উদ্ভূত” হিসাবেও অনুবাদ করা হয়। এর মানে হল, এই বস্তুগুলি আমরা সত্ত্ব হওয়ার অংশ এবং এগুলি মনের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে একইসাথে উদ্ভূত হয়। অভিজ্ঞতার প্রতিটি মূহূর্তে, আমাদের সাথে থাকে কায়, বাক্‌ এবং চিত্ত- তাতে আমরা জেগে থাকি বা ঘুমিয়ে থাকি না কেন। হতে পারে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন আমরা কথা বলি না, কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ করার ক্ষমতা থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, অন্যরা আমাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে আমরা ঘুমাচ্ছি। এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা নাক না ডাকলেও, শ্বাস-প্রশ্বাসের একটা নির্দিষ্ট নিয়মনীতি এবং মন্থরতা থাকে যেটা বোঝায় যে আমরা ঘুমিয়ে আছি। এটা হল একটা উদাহরণ যে, আমরা সবসময় কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করে থাকি। যদিও এই গুণটা প্রায়শই “বাক্‌” হিসাবে অনুবাদ করা হয়, তবে এটা শুধু মৌখিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এগুলি হল সহজাত কারক।

“স্বভাবতঃ” (তিব্বতী- রাঙ্‌-শীন) হল এর থেকে একেবারে আলাদা কিছু। যদি কোন কিছু স্বভাবগত হয়, যদি এটা অস্তিমান থাকে, তাহলে এক অর্থে সেটা সহজাত হবে, অর্থাৎ স্বতন্ত্রতঃ বা তার নিজস্ব শক্তি দ্বারা এটা কোন কিছুকে অস্তিত্বমান করবে আর সেটা যে রূপে প্রতীয়মান হয় সেটাকে সেইরূপে অস্তিমান ক’রে তুলবে। কখনও-কখনও এর উল্লেখ কোন বস্তুতে অন্তর্নিহিত এমন বিশেষ গুণ অথবা নির্ধারক গুণরূপে করা হয়, যা সেই বস্তুকে তার স্বরূপ নির্ধারণ করে। এই মূর্খটির বিষয়ে বলতে গেলে, তার মধ্যে বাস্তবে কোন না কোন দোষ আছে, যেটা তার মধ্যে সবসময় দেখতে পাওয়া যায় এবং সেটা স্থায়ীভাবে তার মধ্যে আছে যেটা স্বতন্ত্রভাবে বা তার নিজের শক্তির ভিত্তিতে তাকে মূর্খ বানায়। প্রায়শই আমরা এরকম ভাবিঃ “পাশের বাড়ীর এই ভয়ঙ্কর ব্যক্তিটি সর্বক্ষণ সংগীত বাজান” অথবা “এই অসাধারণ ব্যক্তিটি যাকে আমি এইমাত্র দেখলাম...” যেন সেই ব্যক্তির ভিতরে সর্বদা স্বভাবতঃ কিছু আছে যেটা তাকে সেইভাবে অস্তিমান ক’রে তোলে। আমি এমন উদাহরণ ব্যবহার করেছি যেগুলি আবেগগতভাবে যুক্ত, কিন্তু এটা সব কিছুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আপনার মধ্যে এমন কিছু স্বভাবতঃ অস্তিমান আছে যেটা আপনাকে স্বভাবগত ভাবে মানবীয় ক’রে তোলে।

ওই চালকটির মধ্যে অস্তিমান গুণাবলীগুলি তাকে স্বভাবগত ভাবে মূর্খ হিসাবে অস্তিমান ক’রে তোলে যা তাকে কারও উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিমান মনে হয়। এমন মনে হয় যে আমরা যদি সত্যিই পরীক্ষা ক’রে দেখি তাহলে আমরা এই গুণটা খুঁজে পেতে এবং এটাকে নির্দেশ করতে সক্ষম হব। অবশ্যই, যখন আমরা কাটা-ছেঁড়া ক’রে পরীক্ষা করি, আমরা বিষয়ের ক্ষেত্রে এমন কিছুই খুঁজে পাব না যা এটাকে সেইভাবে অস্তিমান ক’রে তোলে। আপনি যদি গাড়িতে বসে থাকা এই ব্যক্তির বিশ্লেষণ করা শুরু করেন, আপনি প্রচুর পরিমাণে পরমাণু এবং শক্তির দিক দেখতে পাবেন, সেখানে এমন কোনও মূর্ত বস্তু খুঁজে পাবেন না যার মাধ্যমে আপনি সেটাকে নির্দেশ ক’রে বলতে পারবেন এই জিনিসটা তাকে বোকা বানিয়েছে। যদি আমরা সেকেন্ডের ভগ্নাংশের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা তার আঙুলগুলি এক মিলিমিটার একদিকে এবং তারপর এক মিলিমিটার অন্যদিকে যেতে দেখতে পাব, তাহলে সেটা কী যা সেই ব্যক্তিকে মূর্খ বানিয়ে দিচ্ছে? আপনি এমন কোন সেকেন্ডের ভগ্নাংশের আচরণের দিকে ইঙ্গিত করতে পারবেন না, যা তাকে মূর্খ বানিয়ে দিচ্ছে, আপনি কি পারবেন? এইভাবে, আপনি সেই বিষয়ের পক্ষে এমন কোন কিছু খুঁজে পাবেন না যা তার নিজের শক্তিতে বসে আছে এবং তার প্রভাবে তাকে একজন মূর্খরূপে অস্তিমান করে তুলছে- যদিও সে একটি মূর্খের মতো প্রতীয়মান হচ্ছে।

ব্যবহারিক দৃষ্টিতে, তিনি একজন মূর্খের মতো আচরণ করছেন। এখানে আমাদের এই ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে যে, আমাদের উপরিতলের আভাস এবং ঐ ব্যক্তির ব্যবহারিক দৃষ্টিতে আচরণ করার যথার্থতাকে অস্বীকার করলে হবে না। তিনি একজন মূর্খের মতো আচরণ করছেন; এটা সঠিক। সমস্যাটি হল কীভাবে তিনি একটি মূর্খ হিসাবে অস্তিমান ব’লে মনে হয়। তিনি অন্যান্য বিষয়ের উপর ভিত্তি ক’রে একজন মূর্খের মতো আচরণ করছেন; এটা তার নিজের থেকে আলাদা অন্য জিনিসের উপর নির্ভরশীল। এমন নয় যে, এই ব্যক্তিটি তার ভিতরে কোন বস্তুর প্রভাবের কারণে মূর্খের মতো আচরণ করছেন। এই ব্যক্তি আলাদা-আলাদা অংশ (তার হাতটা বিশেষভাবে কাজ করছে, ইত্যাদি)-এর ভিত্তিতে এবং কারণগুলির (সে ট্রাফিকের ভিড়ে ফেঁসে আছে এবং তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে) উপর নির্ভর ক’রে একজন মূর্খের মতো আচরণ করছেন। যদি তিনি স্বভাবগত ভাবে একজন মূর্খ হতেন, তাহলে তিনি যখন গাড়ি না চালান এবং এমনকি যখন তিনি ঘুমিয়ে থাকেন তখনও তাকে মূর্খ হতে হবে। তিনি যে পরিস্থিতিতে আছেন তার উপর নির্ভর ক’রে মূর্খের মতো কাজ করছেন। এমনও হতে পারে যে সেখানে সব ধরণের সাংস্কৃতিক, মনোবৈজ্ঞানিক এবং ব্যক্তিগত কারণ আছে যা তাকে মূর্খের মতো আচরণ করতে বাধ্য করছে। এই সমস্ত কিছুর উপর নির্ভর করে যে, এই ব্যক্তিটি একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালায়।

মানসিক আখ্যা

এছাড়াও, আরও মৌলিকভাবে, আমরা বলতে পারি যে মূর্খের মতো গাড়ি চালানো ব্যক্তির জ্ঞান “মূর্খ” ধারণার উপর নির্ভরশীল। যদি এরকম ধারণা না থাকত, তাহলে আমরা বলতে পারতাম না যে এই ব্যক্তিটি মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছে, আমরা পারতাম কি? এটা আমাদের মানসিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়।

মানসিক আখ্যা বিষয়টি বেশ বিভ্রান্তিকর হতে পারে। আমরা যখন এই ব্যক্তিটিকে মূর্খ বলি, আমাদের বলার কারণে কিন্তু তিনি মূর্খ হয়ে যান না, তাই না? আমরা ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের কথা বলছি না, যারা একে-অপরকে চিৎকার করে বলে, “তুই মূর্খ!” আখ্যা এবং নাম-এর মধ্যে সেই ক্ষমতা থাকে না যে সেটা সেই বস্তুকে সেরকম একটা সত্তা প্রদান করে দেয়, যেমন আমরা বলি। অনেকে মনে করে যে মানসিক আখ্যার অর্থ আমরা শব্দ এবং ধারণা দিয়ে জিনিস তৈরী করি। বৌদ্ধধর্মে মানসিক আখ্যার অর্থ অবশ্যই সেটা নয়।

এটাকে ভেবে দেখুন। আমরা এই ব্যক্তিকে মূর্খরূপে আখ্যা দিই অথবা না দিই, আর আমরা তাকে “মূর্খ” মনে করি অথবা না করি এবং এই ব্যক্তিকে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখার জন্য রাস্তায় অন্য কোন ব্যক্তি থাকুক বা না থাকুক, তখনও কি তিনি কোন মূর্খের মতো গাড়ি চালাতে থাকবেন? যদি তিনি রাস্তায় একা থাকেন এবং তাকে মূর্খ বলার মতো কেউ না থাকে, তখনও কি তিনি কোন মুর্খের মতো গাড়ি চালাতে থাকবেন?

ঠিক আছে, আপনাকে বলতে হবে যে, একটা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এটা আলাদা যাদের মধ্যে মূর্খ-এর ধারণা রয়েছে এবং অন্য একটি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও আলাদা যাদের মধ্যে এই ধারণাটি নেই। সুতরাং, এটা গোষ্ঠী এবং এর কল্পনাগত কাঠামোর উপর নির্ভর করে। আপনি শুধু এইটুকু বলতে পারেন যে এই ব্যক্তিটা একটা নির্দিষ্ট প্রচলন অনুযায়ী একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন, তিনি কিন্তু একবারে মূর্খ এবং স্বভাবগতভাবে একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন না। এটা তো আইন এবং রীতিনীতির উপর নির্ভর করে, তাতে কেউ তাকে দেখুক অথবা না দেখুক। যদি আমরা বলি যে, এটা অন্য কোন কিছু থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কেবল ওই ব্যক্তির গাড়ি চালানোর উপরই আধারিত, তাহলে এটা অসম্ভব। এগুলি হল সেই পয়েন্টগুলি যার কারণে মানুষ মানসিক আখ্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়।

তখন আপনি ভাবতে পারেন, “তাহলে কি আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা বলতে পারি যে, এই ব্যক্তি কীভাবে গাড়ি চালান?” এটা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে একটা নিখুঁত প্রশ্ন। এটাই হল সমস্যা যে, বাস্তবে কী ঘটছে সেটা উপলব্ধি করা। তিনি কি সত্যিই মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন অথবা চালাচ্ছেন না? যখন আমরা এই বিষয়ের ভিতরে প্রবেশ করি যে এটা বাস্তবে কী, তখন আমরা স্বভাবগত অস্তিত্বের ভিতরে থাকি। এই ব্যক্তি “মূর্খ”-এর মতো, পাশ্চাত্য রীতি-নীতি ইত্যাদির উপর নির্ভর ক’রে মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন। এটাকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখার অর্থ হল যে সেই লোকটি বাস্তবেই মূর্খ। এটা হল স্ব-প্রতিষ্ঠিত স্বভাবগত অস্তিত্ব; আর এটা হওয়া অসম্ভব।

আমি মনে করি, এর থেকে নির্দেশ পাওয়া শুরু হয় যে এই বিভ্রান্তির মূলটা কত শক্ত, কারণ আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই প্রকৃতপক্ষে জানতে চায় যে জিনিসগুলি কেমন এবং মনে করে যে এমন একটি পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে সেগুলি বাস্তবিকরূপে অস্তিমান আছে, তাই না? আমরা বলি, “এটা সত্যিই একটা অসাধারণ বাড়ি,” অথবা “আজ সন্ধ্যাটা আমরা সত্যিই খুব ভালোভাবে কাটালাম,” এমন যেন সেটাতে কোন স্বভাবগত কিছু আছে এবং প্রত্যেককেই সেটাকে একইভাবে দেখা উচিত। যেহেতু আমরা এটাতে প্রবলভাবে অভ্যস্ত হয়ে থাকি, সেইজন্য সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেমনই প্রতীয়মান হয় আর আমরা সেটাকে সেভাবেই মেনে নিই। এটাকে “ভ্রমাত্মক আভাস-নির্মাণ” বলা হয়, কখনও-কখনও এটাকে “দ্বয়-আভাস” বলা হয়। এখানে “দ্বয় বা দ্বৈত”-এর অর্থ হল আভাসটা অসঙ্গতিপূর্ণ, প্রকৃতপক্ষে যেমনটা হয় সেরকম নয়। এটা যেভাবে প্রতীয়মান হয় এবং সেটা আসলে যেভাবে অস্তিমান তার থেকে ভিন্ন। গেলুগ-প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ অনুযায়ী এটাই হল “দ্বয় আভাস”-এর অর্থ।

বিষয়টা হল এই ব্যক্তিটি মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন। এটা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে সঠিক। আমরা একটা মূর্খের মতো মতামত রাখতে পারি, যার সাথে কেউ একমত হবেন না, অথবা আমাদের মতামত এমন হবে যার সাথে অন্য লোকজনরা একমত হবেন। এখানে জার্মানীতে অন্য লোকজনরা একমত হবেন যে, এই ব্যক্তিটি একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন, কিন্তু এর কারণে তিনি প্রকৃত মূর্খ হয়ে যান না। আমাদের মতামত থাকতে পারে যে, একটি কুকুর গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু তাতে কেউ একমত হবে না। সেখানে দুই ধরণের মতামত আছে, একটি অবৈধ মতামত এবং একটি বৈধ মতামত।

বিষয়টি হল, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে বস্তুর সম্পর্কে জানার জন্য বৈধ জ্ঞান (প্রমাণ) থাকে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন পরম্পরাগুলিতে এই পার্থক্যটির আলাদা-আলাদা ব্যাখ্যা আছে। গেলুগ পরম্পরা সঠিক (সম্যক্‌ সংবৃতি) এবং ত্রুটিপূর্ণ উপরিতল (মিথ্যা সংবৃতি) সত্যের কথা বলে। কোন বস্তুর সম্পর্কে একটি ত্রুটিপূর্ণ উপরিতল সত্য তার সাথে মিল খায় না যেটা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে অস্তিমান। কোন বস্তুর ব্যবহারিক স্বরূপ এবং বাস্তবিক স্বরূপের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে।

স্বাতন্ত্রিক এবং প্রাসঙ্গিক সম্পর্কে গেলুগ আলোচনায় বৈধ আখ্যা

আমরা কীভাবে জানব যে একটা মতামত বৈধ? আমরা বৈধ আখ্যার জন্য চন্দ্রকীর্তির তিনটি মানদন্ড ব্যবহার করি। এখানে স্বাতন্ত্রিক-মাধ্যমিক এবং প্রাসঙ্গিক-মাধ্যমিকের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় যেমনকি গেলুগ পরম্পরা ব্যাখ্যা করে। কাগ্যু পরম্পরা এই দুটি সিদ্ধান্তকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। মাধ্যমিকের মূল বিষয় হল সব কিছুই মানসিক আখ্যার উপর নির্ভর ক’রে অস্তিমান হয়। এর অর্থ এই নয় যে মানসিক আখ্যার কারণে তাদের উৎপত্তি হয়। মাধ্যমিক দ্বারা উপস্থাপিত মানসিক আখ্যা চিত্তমাত্রের মতো কম উন্নত ভারতীয় বৌদ্ধ সিদ্ধান্তগুলির চিত্ত আর বস্তুর মধ্যেকার সম্পর্কে ব্যাখ্যার পরিমার্জিত রূপ। সিদ্ধান্তবাদী সম্পর্কে যথাযথ ভাবে অধ্যয়ন করার অন্যতম প্রধান বিষয় হল চিত্ত এবং বস্তুর সম্পর্ককে উত্তরোত্তর উন্নত স্তরে বোঝা।

গ্রন্থে কোন ব্যক্তিকে “রাজা” রূপে আখ্যা দেওয়ার উদাহরণ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন একজন ব্যক্তি “রাজা” নামক শব্দ এবং ধারণার উপর নির্ভর ক’রে রাজা হিসাবে অস্তিমান হয়। এটা স্পষ্ট যে, যদি রাজাদের কোন সামাজিক পরম্পরা না থাকত তাহলে কেউই রাজা হতে পারত না। এবার প্রশ্ন হলঃ সেটা কী যা ঐ আখ্যাকে বৈধ করে তোলে? স্বাতন্ত্রিকরা বলে যে, বস্তুর মধ্যে স্বভাবগত কিছু সহজলভ্য বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলির মাধ্যমে আমরা সেই বস্তুর উপর তার স্বরূপ অনুযায়ী সঠিক আখ্যা দিতে পারি। রাজার মধ্যে এমন কিছু থাকতে হবে যেটা তাকে রাজকীয় স্বরূপ প্রদান করে, যাতে তাকে সঠিকভাবে “রাজা” হিসাবে আখ্যা দেওয়া যায়। যদি সেগুলি না থাকত, তাহলে আমরা একটি কুকুর অথবা ঝাড়ুদারকে “রাজা” রূপে আখ্যা দিতে পারতাম এবং এরফলে সে রাজা হয়ে যেত। আমরা দেখতে পাই যে, এর পিছনে কিছু রাজনৈতিক ধারণা রয়েছে। আসলে, এটা কোন রসিকতা নয়। এই দর্শনটা ভারতবর্ষে বিকশিত হয়েছিল যেখানে বিষয়টাকে জাতির দৃষ্টিতে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কারণে সেই ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, যার কারণে সে রাজবংশীয় সদস্য হতে পারবে। এটাই হল স্বাতন্ত্রিক।

প্রাসঙ্গিক বলে না, ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে এমন কোন উপযুক্ত গুণই নেই যা তাকে রাজা বানায়। অবশ্যই ব্যবহারিক দৃষ্টিতে, সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য আছে। রাজকীয় ব্যবস্থার অন্তর্গত যে ব্যক্তি কোন দেশকে শাসন করে সে হল রাজা। সেখানে একটা সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য আছে যা নির্দেশ করে যে রাজা বলতে কী বোঝায়। যদি কোন কিছুরই সংজ্ঞা না থাকত, তাহলে বস্তুর ক্রিয়াশক্তি অসম্ভব হয়ে উঠত- তবে সেগুলি হল কেবল ব্যবহারিক। এটা এমন কিছু নয় যে, সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলি বস্তুর ভিতরে খুঁজে পাওয়ার যোগ্য এমন কিছু হিসাবে অস্তিমান, যেটা তার নিজের ক্ষমতা দ্বারা কোন ব্যক্তিকে, উদাহরণ স্বরূপ, রাজা বানিয়ে দেয়।

আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব যে এই আখ্যাটি বৈধ? আবার আমরা চন্দ্রকীর্তির তিনটি মানদন্ডে ফিরে আসি। যেহেতু এগুলিকে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অতএব আমরা আবার সেগুলি অন্য উদাহরণ দিয়েও ব্যাখ্যা করব। প্রথমতঃ, একটি প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মতির উপর আধারিত প্রচলন আছে। আমরা বাড়িতে এসে আমি এবং আমার সঙ্গীর দিকে তাকাই। আলোচনার সুবিধার জন্য, ধরা যাক, আমার সঙ্গী একজন মহিলা। তার মুখমন্ডলের একটি নির্দিষ্ট ভাব আছেঃ তার ভ্রু কুঁচকে আছে, তার মুখ ঝুলে গেছে এবং আমাদের মনে হচ্ছে সে বিরক্ত এবং ক্রোধিত হয়ে আছে। এখানে একটা প্রতিষ্ঠিত প্রচলন থাকা প্রয়োজন। এটাই হল প্রথম মানদন্ড। একটা প্রচলন আছে যে মানুষ, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মানুষ, যখন বিরক্ত হয়, তখন তাদের ভ্রু কুঁচকে যায় এবং মুখ লম্বা হয়ে যায়। কুকুর গর্জন করে, কিন্তু মানুষ তার বিরক্তিভাব এইভাবে প্রকাশ করে। মানুষ যখন ক্রোধিত হয়ে যায় তখন সে যা করে আমার সঙ্গী সেই নিয়ম অনুসরণ করে। আভাসকে বৈধ সিদ্ধ করার এটা একটা উপায়। তার অভিব্যক্তি তার ব্যবহারিক নমুনার সাথে সামঞ্জস্য থাকে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য আমরা এটার তুলনা তার পুরনো ঘটনাগুলির সাথে করতে পারি যখন সে বিরক্ত হয়েছিল।

দ্বিতীয় মানদন্ডটি হল যে, সেটার খন্ডন কোন এমন মন দ্বারা করা হয়নি যে মন উপরিতল সত্যকে (সংবৃতি সত্য) বৈধ মনে করে। আমরা আমাদের চশমা পরি, আলো জ্বালাই এবং নিশ্চিত করি যে আমরা অভিব্যক্তিটি সঠিকভাবে দেখতে পাই। এটা এমন নয় যে এখানে অন্ধকার ছিল, আমরা সঠিকভাবে দেখিনি, অথবা আমরা চশমা পরিনি। এই মানদন্ডটি খুবই ব্যবহারিক এবং যুক্তিসঙ্গত।

যদিও এটা গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবুও আমরা এই দ্বিতীয় মানদন্ড সম্পর্কিত অন্যান্য মানদন্ডগুলি পরীক্ষা করতে পারি, যেমন কোন অর্থক্রিয়াশক্তি অর্থাৎ ফল উৎপন্ন করার ক্ষমতা। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন “হ্যালো” বলেছিলাম, তখন সে আমাদের পাল্টা কিছু বলেনি। এটা আরও একটা প্রমাণ যে, তার বিচলিত হওয়ার হাবভাবের আভাসটা সঠিক। তার অন্য আচরণটা প্রমাণ করে যে সে বিরক্ত ছিল, কারণ যখন সে বিরক্ত এবং ক্রোধিত থাকে, তখন সে সাধারণতঃ হ্যালো বলে না। অন্য কথায়, ক্রোধ তার স্বাভাবিক ফল উৎপন্ন করেছে। আমরা যদি সত্যিই পরীক্ষা করতে চাই তাহলে আমরা তাকে আবার জিজ্ঞাসাও করতে পারি যে, সে বিরক্ত কিনা।

যদি আমরা এটাকে ছেড়ে দিই এবং কেবল বলি, “আচ্ছা, সে বিরক্ত এবং ক্রোধিত হয়ে আছে, কারণ সম্ভবতঃ আজ কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে আর এটা অনেক কারণের উপর নির্ভরশীল,” তাহলে আমাদের বোধগম্যতা পুরোপুরি বৈধ হবে। এমন কোন একটি মন দ্বারা এর খন্ডন করা যাবে না যেটা বৈধভাবে গভীরতম সত্যকে দেখে যে, বস্তু কীভাবে অস্তিমান, আমার সঙ্গী কীভাবে ক্রোধিত হয়ে অস্তিমান রয়েছে।

যদি আমাদের মনে হয় যে, আমাদের সঙ্গী শুধু এই বা ওই কারণে ক্রোধিত হয়নি, বরং আমরাই মনে করি, “হে ঈশ্বর, সে আবার ক্রোধিত হয়েছে। সে একজন ক্রোধিত ব্যক্তি, সবসময় এই ব্যাপারে সে বিরক্ত হয়। আমি এটা সামলাতে পারছি না!” তাহলে এটা এমন একটা মন দ্বারা খন্ডন করা হয়ে যায় যেটা বৈধভাবে গভীরতম সত্যকে দেখে। স্বভাবগত ভাবে কারও অস্তিত্ব সেরকম হয় না।

এইভাবে আমরা এই ব্যক্তির নিজের দিক থেকে স্বভাবগত ক্রোধিত হওয়া এবং কোন কিছু না থাকা সত্ত্বেও বিরক্ত বা ক্রোধিত হওয়ার আখ্যাকে বৈধভাবে দেখি। আমরা যখন শূন্যতার কথা বলি, তখন আমরা সেই পরিস্থিতির কথাই বলি যখন আমরা মনে করি সে একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তি। শূন্যতা হল অস্তিমান হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিঃ ঐ ব্যক্তির মধ্যে কোন এমন দোষ বাস্তবে অস্তিমান হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, যার কারণে তার সাথে থাকা বাস্তবে খুব যন্ত্রণাদায়ক। আমরা যখন বিশ্বাস করি যে সে বাস্তবে এই রূপে অস্তিমান, তখন আমরা একটা বিরক্তিকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাই। আমরা তার উপর বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে যাই।

আপনি হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন, “এইরকম পরিস্থিতিতে কি বিচার-বিবেচনা এবং শান্তভাবে আচরণ করাটা এই বোধগম্যতার উপর নির্ভর করে না যে আমাদের সঙ্গীর ক্রোধিত হওয়ার কারণ কী?” ঠিক আছে, যদি আমরা এটা বুঝতে না পারি যে, সে কেন ক্রোধিত, তখনও আমরা এটা বোঝার চেষ্টা করি যে, তার ক্রোধিত হওয়া যুক্তি এবং কারণের উপর নির্ভর করে; এটা এমন নয় যে, সে স্বভাবতঃ সবসময় ক্রোধিত হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে আমাদের এটা বুঝতে সহায়তা করে যে, কোনভাবে এই পরিস্থিতিটাকে পরিবর্তন করা যায়। যাই হোক, এটা বলা সঠিক, “আমার সঙ্গী ক্রোধিত এবং বিরক্ত।” এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি স্বীকার না করি যে আমাদের সঙ্গী ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দুঃখিত, তাহলে আমার কাছে তারজন্য করুণাভাব আর তার সহায়তা করার কী আধার থাকবে? আমরা যখন তাকে হীতকারী ভাবে বুঝতে পারি তখন আমরা শূন্যবাদের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাই।

বাহ্যিক সত্যকে সঠিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উপর জোর দেওয়ার ফলে শুন্যতা এবং করুণার মধ্যে যে একটা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তার বোধগম্যতা তৈরী হয়। এই বোধগম্যতা না থাকলে আমরা অন্যদেরকে এত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি না, আর এর কারণে অন্যদের সমস্যাগুলির সাথে যুক্ত হতে এবং তাদের সহায়তা করতে বাধা উৎপন্ন হয়। এই কথাটি অত্যন্ত গম্ভীর, কিন্তু আমি মনে করি এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং কর্ম

আপনি যদি প্রতীত্যসমুৎপাদকে বোঝেন, তাহলে আপনি অবশ্যই এই বিষয়টির অবহেলা করবেন না যে, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক কর্মগুলি আসলে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক হয়। এটা একেবারে সত্য। আমরা যখন আপেক্ষিকতা সম্পর্কে কথা বলি, তখন আমরা বস্তুকে এমন জায়গায় নিয়ে যাই না যে কোন জিনিসের অর্থ যা কিছু হতে পারে। হত্যা করা হল ধ্বংসাত্মক কর্ম, তাতে প্রেরণা যাই হোক না কেন। এমনকি আমরা যদি অত্যন্ত প্রবল করুণা ভাবনার সাথে হত্যা করি না কেন, যেমন বুদ্ধ সেই নাবিককে হত্যা করেছিলেন, যিনি তার নৌকোর মধ্যে ভ্রাম্যমান ৪৯৯ জন ব্যবসায়ীকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন, তাকে হত্যা করলেও, এটা কিন্তু ধ্বংসাত্মক কর্মই ছিল। এটা দুঃখের বিপাকে পরিণত হয়েছিলঃ বুদ্ধের পায়ে কাঁটা বিধেছিল। এর দুঃখ অর্থাৎ নেতিবাচক পরিণতিটি খুবই অল্প ছিল, কারণ করুণার প্রেরণা অত্যন্ত প্রবল ছিল, তবুও এটা ছিল একটা ধ্বংসাত্মক কর্ম এবং এখানেও কর্মের নিয়ম প্রয়োগ হয়েছিলঃ সেইজন্য যে কোন ধ্বংসাত্মক কর্ম দুঃখেরই কারণ হয়ে ওঠে। নেতিবাচক কর্মের শক্তি হল আপেক্ষিক, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক নয়- একটা ধ্বংসাত্মক কর্ম কখনও এতটা গঠনমূলক হতে পারে না। বৌদ্ধধর্ম এই বিষয়ে সহমত পোষণ করে যে সারা জগত একটা ব্যবস্থা অনুযায়ী গতিমান।

ব্যবহারিক ভাবে, হত্যা একটি ধ্বংসাত্মক কর্ম। কিন্তু সেই তত্ত্বটা কী যা এটাকে ধ্বংসাত্মক করে তোলে? আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হল যে, এতে খুঁজে পাওয়ার মতো এমন কোন তত্ত্ব নেই যেটা নিজের শক্তিতে এটাকে ধ্বংসাত্মক কর্ম তৈরী করে। এটা এই বিষয়ের উপর নির্ভর করে যে, কেউ হত্যাকারী আছে, কেউ আছে যার হত্যা করা হয়, আর একটা মানসিক সন্ততি যেটা এর দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগ করে। অপরাধের মানসিক সন্ততির অংশ হিসাবে এই কর্ম থেকে নেতিবাচক কার্মিক শক্তি অব্যাহত থাকে, যতক্ষণ না হত্যাকারী মানুষটি নিজের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগ না করে। আমরা কোন কর্মের বিষয়ে এটা বলতে পারি না যে, সেটা কারণ এবং ফল থেকে স্বতন্ত্রভাবে “ধ্বংসাত্মক।” এটা কোন আধার ছাড়া ধ্বংসাত্মক হতে পারে না। ধ্বংসাত্মক হওয়ার অর্থ হল কোন একটা নির্দিষ্ট কর্ম যা অপরাধীর জন্য দুঃখ ভোগ করা পরিণত হয়।

তাহলে সেটা কী যা হত্যা-ক্রিয়াকে ধ্বংসাত্মক করে তোলে? এই কর্মটি নিজের থেকে আলাদা কিছু কারণের ভিত্তিতে ধ্বংসাত্মক- এই ক্ষেত্রে এটা কর্মের কার্মিক ফলের উপর আধারিত। এটা এমন নয় যে এই কাজটা নিজের দিক থেকে স্বভাবগতভাবে ধ্বংসাত্মক, নিজের ভিতরের কোন নির্ধারক গুণের কারণে এরকম হয়।

আসুন, আমরা আর একটি উদাহরণ ব্যবহার করি, যেটা বিষয়টিকে প্রতিদিনের পরিস্থিতির আরও কাছে নিয়ে আসে। আমাদের কুকুরটা রান্নাঘরের মেঝেতে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে এবং আমরা ক্রোধিত হয়ে চিৎকার করে বলি, “দুষ্ট কুকুর! তুমি মেঝেটা নোংরা করে ফেললে! তুমি এই খারাপ কাজটা করেছ।” এমন যে এই কর্মটা স্বয়ং সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে নিজে থেকেই খারাপ। এই উদাহরণে, কুকুরটা যে কর্মফল অনুভব করবে তার পরিবর্তে এই “মানব সৃষ্ট” কর্মের ফলাফল সম্পর্কে কল্পনা করা সহজ। অনুগ্রহ করে লক্ষ্য করবেন যে, কোন কার্মিক ফল এবং মানব সৃষ্ট ফলের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। মানব সৃষ্ট অথবা এখানকার পরিপ্রেক্ষিতে কুকুর-সৃষ্ট কর্মের ফল হল এটা যে কুকুরটি মেঝেটাকে নোংরা করেছে এবং আমাদের এটা পরিষ্কার করতে হবে। সেই মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, কুকুরটা মেঝের উপর যেটা করেছে সেটা ভাল ছিল না।

প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং বিকল্প

বৈধ আখ্যা এবং মতামতের এই আলোচনার আলোকে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা কী সুপারিশ করতে পারি? যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলি কারণ জড়িত থাকে। এটা শুধু কোন একটি বা অন্য বিকল্পের সমস্যার উত্তর অথবা সমাধানরূপে চিহ্নিত করার বিষয় নয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত যেটা হবে সেটা নির্ধারণ করার জন্য, উদাহরণ স্বরূপ, ফলাফলকে প্রভাবিত ক’রে এমন বিষয়গুলি যতটা সম্ভব বিবেচনা করার চেষ্টা করতে হবে। যা কিছু ঘটে সেটা কেবল একটি হেতুর কারণে হয় না। এখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, নিজের কর্ম এবং আমাদের যা করা উচিত এই বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্তগুলির গুরুত্বকে অতিরঞ্জিত করে না দেখাই গুরুত্বপুর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি কিছু বলি, আর তার কারণে অন্যজন বিরক্ত হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির বিরক্ত হওয়ার পিছনে আমরা যে কথা বলি তা ছাড়াও আরও অনেক কারণ থাকে।

এটাকে খুবই সহজ ভাবে বলে দেওয়া হয়, “যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য ভাল থাকে, আমরা যা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিই সেটা ঠিক হয়,” কিন্তু ইংরাজীতে একটা অভিব্যক্তি আছেঃ “ভাল উদ্দেশ্যও নরকের রাস্তা প্রশস্ত করে দেয় অর্থাৎ শুধু ভাল উদ্দেশ্য থাকাটা যথেষ্ট নয়, ভাল করে দেখানোটাও আবশ্যক।” তদুপরি, আমাদের প্রতিটি বিকল্প কর্মের পিছনে একটি নয়, অনেকগুলি উদ্দেশ্য এবং প্রেরণা থাকে যা আমরা পছন্দ ক’রে নিতে পারি, তাই এটা খুবই জটিল।

কিছু লোকজন বলে, “স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার কর,” কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করার অর্থ প্রায়শই স্নায়বিকভাবে ব্যবহার করাকে বোঝায়। যদি আমাদের শিশু কাঁদতে লাগে, তখন যে প্রথম বিচার আমাদের মনে আসে সেটা হল যে শিশুটিকে একটা চড় মেরে দিই, তখন আমরা এটা বলতে পারি না যে এটা একটা সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত ছিল কারণ বিষয়টা স্বাভাবিক ছিল। আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে যথাসম্ভব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিবেচনা করার চেষ্টা করতে হবে, বিশেষতঃ কোন সম্পর্ক বিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে অথবা কোন চাকরী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে। আমাদের স্পষ্ট হতে হবে যে, আমার কী করার ইচ্ছা হচ্ছে, আমি কী করতে চাই, আমার কী করা উচিত এবং আমার সহজাত প্রবৃত্তি কী বলছে। এই চারটি বিষয়ই আলাদা-আলাদা হতে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ, আমি আমার ওজন কমানোর উদ্দেশ্যে আহার নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, আমি চাই যে আহারের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকুক, কিন্তু আবার আমার এক টুকরো কেক খেতে ইচ্ছা করছে। আমার সহজাত প্রবৃত্তি আমাকে বলছে যে আমি পরে অপরাধ বোধ করব। আমাদের সিদ্ধান্তের এই চারটি দিক বিশ্লেষণ করতে হবে, পাশাপাশি বিশ্লেষণ করতে হবে প্রত্যেকটির কারণও। হতে পারে, কেকের প্রতি লোভের কারণে আমাদের খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে। আমরা কেন ওজন কমাতে চাই? এটা কি স্বাস্থ্যগত কারণে, আত্মাভিমানের কারণে, অথবা কোনো সঙ্গী খুঁজে পেতে আরও অধিক আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য? আমাদের নিজের কর্মের পরিণতিগুলিরও পরীক্ষা করা দরকার; এক অর্থে বিভিন্ন বিষয়গুলিকে দেখতে হবে কোন্‌ কারণগুলি বৈধ এবং কোন্‌ কারণগুলি বৈধ নয়। উদাহরণ স্বরূপ, “আমি এখন খাবার খেতে চাই না, আমার খাওয়ার ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমি যদি এখন না খাই, তাহলে আবার আমি সম্পূর্ণ দিনটা খাওয়ার সুযোগ পাবো না। এইজন্য আমার এখনই কিছু খাওয়া উচিত।”

এইভাবে, আমাদের সব কারণগুলির প্রতি যথাসম্ভব ভাবে সংবেদনশীল হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যখন এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় যে আমরা কি কালো জামা পরবো। অথবা নীল জামা, অথবা কোন রেঁস্তোরায় খাওয়ার জন্য মেনু থেকে কী পছন্দ করব- আমরা যা খুশি পছন্দ করতে পারি, সেটা কোন ব্যাপার নয়। আমরা খুব বেশি বিশ্লেষণ করতে চাই না। সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। 

এটা বেশ মজাদার যে ছয়টি মূল অশান্তকারী আবেগ (ক্লেশ) এবং মনোভাবের মধ্যে একটি হল দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত, আমাদের মন ঠিক করতে না পারা। মনের এই দুর্বল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য, আমরা ধর্মে বর্ণিত সেই কারকগুলির বিশ্লেষণের সহায়তা নিতে পারি, যেগুলি আমাদের কোন কর্ম করতে প্রবৃত্ত করে। কর্ম এবং চিত্তের প্রক্রিয়া সম্বন্ধিত শিক্ষাগুলি থেকে আমরা এই কারণগুলির উৎপত্তির বিষয়ে অনেক উন্নত ব্যাখ্যা লাভ করতে পারি। এর মধ্যে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি যে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন পরম্পরাগুলির মতে কোন্‌ কারণটা বৈধ এবং কোন্‌ কারণটা অবৈধ।

তাহলে আমরা কীভাবে জানতে পারি যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি? যতক্ষণ না আমরা স্বয়ং বুদ্ধ না হয়ে যাব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা জানতে পারব না যে আমরা সত্যিই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিনা। আমাদের মধ্যে আমাদের কর্মের ফল সম্পর্কে জ্ঞান নেই। এছাড়াও, সম্ভাব্য পরিবর্তনের জন্য আমাদের উন্মুক্ত থাকতে হবে, বিশেষ ক’রে একটি সম্পর্ক বিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে। এটা সত্যিই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। যতদূর সম্ভব কারণগুলিকে দেখার পরে আমাদের অন্য সেই ব্যক্তির সাথে আলোচনা ক’রে দেখতে হবে যে আলোচনা কোন্‌ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এখানে আমাদের শূন্যতার আলোচনায়, এই পরিপ্রেক্ষিতে শূন্যতার অর্থ কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন কোন জিনিস অনুপস্থিত থাকবে, যা নিজের দিক থেকে সিদ্ধান্তকে সঠিক তৈরী করে। এটা সেই ভাবে অস্তিত্বে নেই; এটা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এমন নয় যে কোন একটা জিনিস যেটা আমরা সিদ্ধান্ত নিই অথবা বলি, সে তার নিজ শক্তিতে ঘটিত ফলকে উৎপন্ন করবে। যা কিছু ঘটে সেটা লক্ষ লক্ষ ভিন্ন কারণ থেকে উদ্ভূত হয়, শুধু আমরা যেটা করি সেটা থেকে নয়।

মনে হতে পারে আমরা যে কাজটা করেছি সেখানে কিছু গোলমাল হয়েছে যার কারণে আমরা দোষী হয়ে গিয়েছি। এমন যেন আমাদের কাজটি স্বভাবগতভাবে অস্তিমান ছিল এবং সেটা তার নিজস্ব শক্তি দ্বারা জিনিসগুলিকে এলোমেলো ক’রে দিয়েছে। এটা আমাদের কাছে এমনই মনে হয় এবং আমরা এটা বিশ্বাস করে বসি, আর সেইজন্য নিজেকে দোষী মনে করি। ব্যবহারিকভাবে, আমরা হয়তো এই গোলমালের জন্য দায়ী, কিন্তু নিশ্চিতভাবে, আমরা যেটা করেছি সেটা তার নিজের শক্তির কারণে স্বাধীনভাবে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি। এর পিছনে অনেক কারণ ছিল। বুদ্ধ যেমন বলেছেন যে, একটি বালতি কখনও জলের প্রথম ফোঁটা অথবা শেষ ফোঁটার কারণে পূর্ণ হয় না; এটা তো সমস্ত জলের ফোঁটার সংগ্রহের কারণে পূর্ণ হয়। কোন ফলকে উৎপন্ন করার পিছনে হাজার-হাজার কারণ থাকে যা ঘটিত ঘটনাগুলির জন্য দায়ী থাকে।

দায়িত্ব এবং অপরাধ

উদাহরণ স্বরূপ, আমি এক গ্লাস জল ফেলে দিয়ে মেঝে নোংরা করে দিলাম। কেবল আমার দ্বারা গ্লাসটি ফেলে দেওয়ার কারণেই মেঝে নোংরা হয়নি, বরং সেই ব্যক্তির কারণেও হয়েছে, যিনি গ্লাসটি টেবিলের শেষ প্রান্তে রেখেছিলেন; সেই ব্যক্তির কারণেও হয়েছে যিনি এই টেবিলটা বানিয়েছিলেন, তার জন্যও হয়েছে কারণ সেটা একটা উচ্চতায় রাখা হয়েছিল; আর আলোটা এমনভাবে ছিল যে আমি গ্লাসটি দেখতে পাইনি-এর পিছনে লক্ষ লক্ষ কারণ ছিল।

এখন আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে এই গোলমালের জন্য টেবিল প্রস্তুতকারক বা গ্লাসটা যিনি টেবিলের শেষ প্রান্তে রেখেছিলেন তিনিই দায়ী। আমরা এরজন্য দায়ী, কিন্তু তা হলেও আমরা দোষী নই। আমি গ্লাসটা ফেলে দিয়েছি, কিন্তু এর কারণে আমি স্বভাবগতভাবে একজন বোকা মূর্খ হয়ে যাই না। এমন হতে পারে না যে আমি জিনিস ফেলে দেব সেইজন্য আপনি আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারবেন না। মানুষ এই জিনিসগুলিকে নিজের পরিচয় মনে করেঃ “আমি হলাম বোকা” অথবা “আমি লাইট বাল্ব না ভেঙে সেটা পরিবর্তন করতে পারব না, তাই আমাকে সাহায্য করুন।” এগুলি হল খুবই সাধারণ চিন্তা-ভাবনা। আমরা সবাই এরকমই ভাবি। আমরা এখানে কোন জটিল দার্শনিক বিষয়ের উপর চর্চা করছি না; এখানে আমরা সামান্য দৈনন্দিন জীবনের উপর চর্চা করছি।

অতএব “অপরাধবোধ”-এর অর্থ হল- আমাদের মধ্যে স্বভাবগতভাবে এমন কিছু অস্তিমান আছে যা আমাদের খারাপ মানুষ বানিয়ে দেয় আর আমরা যাই করি সেটা স্বভাবগতভাবেই খারাপ হয়ে যায়। আমরা যখন কিছু করি তখন সেটাকে স্বভাবগতভাবে খারাপ ব’লে ধরে নিই আর স্বভাবগতভাবে নিজেকেও খারাপ মানুষ ভেবে ফেলি এবং তারপর সেই পরিচয়ের সাথে আটকে থাকি এবং সেটা থেকে পার হই না। শূন্যতার বোধগম্যতার সাথে আমরা এটা বুঝতে পারি যে এমন কেউ নেই আর এমন কিছু নেই যা স্বভাবগতভাবে “খারাপ” রূপে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিমান থাকতে পারে। আমরা যখন এটার গভীর বোধগম্যতা অর্জন করে নিই তখন আমাদের মধ্যে অপরাধবোধ থাকবে না, আমরা যদি বিষয়গুলি গভীরভাবে বুঝতে পারি, তবে আমরা যদি শূন্যতাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি, তাহলে আমরা এটাও বুঝতে পারব যে আমাদের কর্মের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।

সারাংশ

শূন্যতার বোধগম্যতার সাথে-সাথে আমাদের জ্ঞাত হয়ে যায় যে, যদিও আমাদের পাশে যে লোকটি গাড়ি চালাচ্ছে, গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আমাদের অতিক্রম করার চেষ্টা করছে, সে আমাদের কাছে প্রকৃত মূর্খের মতো প্রতীয়মান হচ্ছে, কিন্তু আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি না যে এটা বাস্তবতার সাথে মিল খায়। আমরা বুঝে যাই যে “এই” বা “ঐ” রূপে উৎপন্ন বস্তু কীভাবে একটি ধারণা এবং “মূর্খ” নামক শব্দ ও আরও অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এই বোধগম্যতার কারণে আমরা আমাদের ধৈর্য হারাই না এবং ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হই না। জার্মান দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি ব্যবহারিকভাবে একজন মূর্খের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন, কিন্তু এটা তাকে স্বভাবগতভাবে খারাপ ব্যক্তি হিসাবে দোষী সাব্যস্ত করে না।

Top