ধ্যান যা করে
ধ্যান হ’ল আমাদের জীবনকে রূপান্তরিত করা এবং উন্নতি করার একটা সাধন। কীভাবে? আমাদের জীবন ব্যক্তিত্ব এবং মেজাজের কারণে প্রভাবিত। উক্ত ব্যক্তিত্ব এবং মেজাজ আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, যে মানুষগুলির সাথে আমরা সময় কাটাই এবং আরও অনেক কিছুর কারণে প্রভাবিত হই জীবন সম্পর্কে আমাদের যদি কোনো অভিজ্ঞতা থাকে। আমরা বুঝব যে, কাজকর্ম ধন-সম্পত্তি এবং বন্ধু-বান্ধবদের মতো বাহ্যিক বস্তুর পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও যদি আমাদের মনোভাব এবং মনের অবস্থা একই রকম থাকে তাহলে আমাদের সবসময় একই সমস্যা থাকবে। আমাদের বন্ধু-বান্ধব যতই থাকুক না কেন, আমরা কিন্তু নিরাপত্তাহীন বোধ করব। আমরা সত্যিই ধনী কিনা সেটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়, এমন হওয়া সত্ত্বেও আমরা কিন্তু ক্রোধিত হতে পারি এবং হতাশ হতে পারি। আমাদের বাহ্যিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন হলেও, এই ধরণের জিনিস গুলি পরিবর্তন হয় না।
ধ্যান এখানে সহায়তা করে, কারণ আমাদের জীবনের গুণাবলীতে আসল পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের চিত্তের উপর কাজ করা প্রয়োজন। এটা শুধু বৌদ্ধিক গুণাবলী অথবা আমাদের বিকাশশীল সমাধি এবং অলসতাকে পরিহার করাকে বোঝায় না। কাজ করার জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ তবে আমাদের আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও গভীরতর স্তরে যেতে হবে অর্থাৎ আমাদের জীবন সম্পর্কে মৌলিক নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভ্রান্তি।
বৌদ্ধ প্রসঙ্গে ধ্যান
এখন আমরা দেখতে পাই যে, ধ্যান শুধু বৌদ্ধধর্মে নয় বরং অনেক বিভিন্ন পরম্পরাতেও দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ প্রসঙ্গে ধ্যানের অর্থ হ’ল- পুনরাবৃত্তির একটি পদ্ধতির মাধ্যমে মনের ইতিবাচক অবস্থার বাস্তবায়ন করা। এটা ঠিক ক্রীড়া বিষয়ক প্রশিক্ষণ বা একটা বাদ্যযন্ত্র শেখার মতো, যেখানে আমাদের জিনিস গুলিকে বার-বার পুনরাবৃত্তি করতে হয়; কিন্তু ধ্যানের মধ্যে আমরা মনের ইতিবাচক অবস্থা উৎপন্ন ক’রে তার সাথে নিজেদের পরিচিত করি। শুরুতে এটা বাধ্যতামূলক এবং কৃত্রিম বলে মনে হবে, কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে আমরা মনের অবস্থার সাথে যথেষ্ট পরিচিত হয়ে উঠি যে, এটা আসলে আমাদের প্রকৃত অঙ্গ।
শুধু এইভাবে কিছু উৎপন্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, সেখানে এর সাথে অনুপযুক্ত কিছু আছে। আমরা যদি মনের একটা নতুন অবস্থা বিকাশ করার চেষ্টা করি, আমাদের ভাবা উচিত নয় যে, এটা প্রাকৃতিক না। অনেক লোক মনে করেন যে, নিজেদের পরিবর্তন করার চেষ্টা না ক’রে নিজেরা স্বাভাবিক ভাবে থাকাটাই সবচেয়ে ভালো। তবে আমরা যদি প্রাকৃতিক অবস্থায় থেকে যাই, তাহলে আমরা এখনো প্যান্টে টয়লেট করতে থাকবো। কিন্তু আমাদের জীবনকে উন্নত করতে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত হই। আমরা আমাদের মন দিয়ে একই কাজ করতে পারি এবং করাও উচিত।
আমরা যুক্তি ব্যবহার করতে পারি না যে, আমাদের প্রাকৃতিক অবস্থায় থাকা উচিত, যার কারণে আমাদের সব কিছু ঠিক থাকবে। এর কারণ হ’ল- প্রাকৃতিক হলে সবসময় শ্রেষ্ঠ ফলাফলের সাথে শেষ হয়ে যায় না। এটা হল এমন যে, একটা শিশু কাঁদছে এবং আমি আমার মেজাজ হারিয়ে তাকে চুপ করানোর জন্য আঘাত করছি, সেটা স্বাভাবিক মনে হবে। বেশ, কখনো সেটা খুব ভালো হবে। তাই কি? আমরা জানি যে, এটা আচরণ করার উপযুক্ত পদ্ধতি নয় যদিও শিশুটিকে আঘাত করা স্বাভাবিক ভাবে প্রথম চিন্তা-ভাবনা হতে পারে, যদি সে মধ্য রাত্রে চিৎকার করা শুরু করে।
সুতরাং আমাদের কাছে আছে ধ্যান, যা বৌদ্ধধর্মকে অধ্যয়ন এবং অনুশীলন করতে অবিশ্বাস্য ভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ প্রায়ই এই মনে করে ভুল করে যে, অধ্যয়ন এবং ধ্যান দুটো আলাদা জিনিস। কিন্তু বৌদ্ধ শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা একেবারেই সেরকম নয়।
উপকারী অভ্যাস গুলি বিকাশ করা
উপকারী অভ্যাসগুলি বিকাশ করার জন্য সেটা কী তা আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে। কিন্তু এটা শেখার শেষ নেই এবং নিজেরও শেষ নেই। আমাদের এটা একীভূত করতে হবে এবং এটাকে আমাদের নিজেদের একটা অঙ্গ তৈরি করতে হবে, যে কাজটা ধ্যান করে। আমরা যেমন কোন জিনিসকে মুখে না দিয়ে না চিবালে হজম করতে পারি না, ঠিক তেমনি আমরা যদি শিক্ষাগুলি মনে প্রবেশ করিয়ে সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা না করি তাহলে তাদের ধ্যান দ্বারা হজম করতে সক্ষম হওয়া যায় না। পাশাপাশি শুধু খাবার চিবানোর পর থুথু ফেলে দিলে কোনও কাজ হয় না। আমাদের খাবারটা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সেটাকে গিলে খাওয়ার পর হজম করতে হবে।
আমরা কীভাবে ধ্যান করা শুরু করব? যেমন আমরা দেখেছি ধ্যান হলো তিনটির তিনটি-ধাপ প্রক্রিয়া। এই ধরণের পরিকাঠামো সমস্ত ভারতীয় পরম্পরায় দেখতে পাওয়া যায়, যেমন- হিন্দু পরম্পরার উপনিষদে। অনেকে প্রশংসা করে না যে, আমরা বৌদ্ধধর্মে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করি তার অধিকাংশ পদ্ধতি অন্যান্য বিভিন্ন পারম্পরিক ভারতীয় সিস্টেমের সাথে মিল রয়েছে। হতে পারে পদ্ধতিগুলি সাধারণ, কিন্তু বৌদ্ধধর্মে উল্লিখিত ধ্যান যে অনন্য সেটা নিম্নবত্ নির্ধারিত হয়- আমাদের লক্ষ্য কী, বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের বোধগম্য কী এবং আমাদের অনুপ্রেরণা কী?
তিনটি অঙ্গ হ’ল- শ্রবণ, চিন্তন এবং তারপর ভাবনা বা ধ্যান করা। আমরা যদি বৌদ্ধ প্রসঙ্গে ধ্যানের অনুশীলন করি তাহলে আমরা বৌদ্ধ শিক্ষা কে হজম করার জন্য এটা ব্যবহার করি।
উপদেশ শ্রবণ করা
আমরা প্রথম অঙ্গটিকে ‘শ্রবণ’ বলি কেন? প্রথমতঃ বুদ্ধের সময় তাঁর কোন উপদেশ বা শিক্ষা লেখা হয়নি। সম্ভবতঃ সেগুলিকে শেখার একমাত্র উপায় ছিল- কারও কাছে শ্রবণ করা, স্মৃতি থেকে সেটাকে আবৃত্তি করা এবং ব্যাখ্যা করা। আজকাল কিন্তু আমরা সমস্ত উপদেশ গুলি পড়তে পারি। সুতরাং, সেগুলি শ্রবণ করে কোন লাভ আছে কি? আচ্ছা, লাভটা হ’ল যে, এটা আমাদের একজন জীবন্ত শিক্ষকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করায়, যার মধ্যে আছে শিক্ষার্থীদের বোঝার ইচ্ছা। তিনি বিষয় গুলি বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করতে পারেন আপনার যদি প্রশ্ন থাকে আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, বইয়ের থেকে আলাদা।
শ্রবণের অসুবিধাটা হ’ল, আপনি যদি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন তাহলে আপনি সেই পৃষ্ঠাটির জন্য আবার ফিরে আসতে পারবেন না বা গুটিয়ে আনতে পারবেন না। আপনি যদি একটি বড় দলে থাকেন তখন সেই শিক্ষককে সেই পৃষ্ঠায় ফিরে গিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে জিজ্ঞাসা করাটা বিব্রতকর হয়ে ওঠে, কারণ আপনি তখন শ্রবণ করছিলেন না। তখন হতে পারে আপনি পিছনে বসেছিলেন এবং তার জন্য ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলেন না; হতে পারে কক্ষটি সত্যিই ছোট ছিল এবং আপনার ঘুম পাচ্ছিল। তাই অসুবিধা সেখানেও আছে। অতএব এর অর্থ হ’ল যে, আপনাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে, যা হ’ল একটি গুণ যেটাকে বৌদ্ধ শিক্ষার মধ্যে দিয়ে উৎপাদন করতে হবে। বৌদ্ধধর্ম শেখা এবং অনুশীলন করা মোটেই একটা নিষ্ক্রিয় পদ্ধতি নয়।
একজন শিক্ষকের নির্দেশাবলী হল- শিক্ষার্থীদের জন্য এটিকে একেবারে সহজ করা উচিত নয় অর্থাৎ প্রথমবারেই বিষয় গুলিকে খুবই স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। আমার মতো কিছু লোকের জন্য এটা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ আমি খুবই স্পষ্ট হতে চাই। আমি যখন আমার শিক্ষক সেরকোঙ্ রিনপোছের অনুবাদক ছিলাম তখন তিনি আমাকে সচেতন ভাবে শিখিয়েছিলেন যে, কেমন করে শিক্ষা প্রদান করতে হয়। আমি তার নির্দেশনা অনুসরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “শুরুতেই কোনো ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে করবে না কারণ আপনার যেটা দরকার সেটা হল তাদের আলাদা করা যে, কারা সত্যিই আগ্রহী এবং কারা অন্য কোনো কারণে সেখানে উপস্থিত থাকে। যারা আগ্রহী তারা বেশি জিজ্ঞাসা করবেন এবং এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, শিক্ষার্থীরা আরও শেখার জন্য তাদের নিজেদের দৃঢ় ইচ্ছা বিকাশ করুক।”
একজন ছাত্র হিসাবে যদি আপনি অভিযোগ করেন যে, শিক্ষক স্পষ্ট ছিলেন না, তাই আপনি ফিরে যেতে চান না, তাহলে আপনাকে পরীক্ষা করতে হবে শিক্ষকের গুণগত মানকে। শিক্ষকটি কি আসলে অযোগ্য এবং জানেন না কীভাবে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে হয়? এরকম অনেক কিছু আছে। অথবা শিক্ষককে কি আপনার অধ্যবসায় এবং ধৈর্য্য বিকাশ করতে উৎসাহিত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আপনাকে সমস্ত বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন না? শ্রবণ করার পুরো উদ্দেশ্য হ’ল দ্বিতীয় ধাপটার জন্য, যেটা হ’ল শিক্ষা বা উপদেশ গুলি সম্পর্কে চিন্তা করা। অতএব শিক্ষক যদি তাৎক্ষণিক ভাবে উত্তরটি না দেন তাহলে সেটা বেশি উপকারী হয়, কারণ এটা আপনাকে তার সম্পর্কে প্রথমে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য করে দেয়, যা পরীক্ষা করার মান নিজেই বিকাশ করে।
উপদেশ গুলি পরীক্ষা করা
উপদেশ গুলি পরীক্ষা ক’রে দেখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, সেগুলি আপনার জন্য কোনো কাজে লাগবে কিনা। আপনি এর সম্পর্কে কী ভাবেন সেটা দেখুন এবং তারপর আপনার চিন্তা-ভাবনার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানুন। একটা বড় গ্রুপে এটা কঠিন হয়ে যায় এবং বিশেষকরে আপনি যদি আপনার শিক্ষককে বছরে মাত্র একবার দেখেন তাহলে সেটা বেশ কঠিন হয়ে যায়। এখানে আমি কথা বলছি, আদর্শ কী হবে সেই সম্পর্কে। বহু বৌদ্ধ কেন্দ্র গুলিতে যেখানে সবসময় শিক্ষক থাকেন না সেখানে আপনাকে নির্ভর হতে হয় পড়া ও অডিও সামগ্রীর উপর, যা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। আমরা এটা করি তাদের উপন্যাসের মতো মনে না ক’রে অথবা এমন কিছু যা আমরা শৌচালয়ে গিয়ে না পড়ে বরং আমরা মনের শ্রদ্ধাজনক অবস্থার সাথে পড়ি। আমরা সেগুলি আস্তে-আস্তে পড়ি এবং পয়েন্ট গুলোর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। আপনি যদি কোন কেন্দ্রে থাকেন সেখানে কোনো শিক্ষক নেই, আপনি তাও পড়তে পারেন এবং পয়েন্ট গুলি একসাথে আলোচনা করতে পারেন। কিছু লোকের মধ্যে বোধগম্য আরও বেশি থাকতে পারে এবং সেই জন্য তারা অন্যদের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে। আমরা যদি তথাকথিত “গৃহহীন সাধক বা অনুশীলনকারী” হই, এবং আমাদের মধ্যে যারা কোন বৌদ্ধ কেন্দ্রে যায় না বা যারা আমাদের নিকটবর্তী জায়গাকে বাড়ি বলে মনে করেন না, তাদের জন্য একটা অনলাইন বৌদ্ধ আলোচনা মন্ডলীতে যোগদান করা উপকারী হতে পারে যদি আমরা সেটা খুঁজে পাই এবং সেটা আমাদের জন্য খুবই উপযুক্ত হয়।
অন্যদের সাথে এই ধরনের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খুবই উপকারী। অন্যথায় উপদেশ গুলি শেখা খুব বুদ্ধিজীবী হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনকে উল্লেখ না করে। আমাদের এই বিষয়ে গম্ভীর হতে হবে। এর মানে এটা নয় যে, আমরা সেখানে কঠোর ভাবে বসবো আর কখনো হাসবো না, বরং এর অর্থ হ’ল আমরা ধর্ম সম্পর্কে সত্যিই গভীর আলোচনা করব। পাশাপাশি কেউ হাস্যকর কিছু বললে বা ভুল করলে আমরা হাসবো।
কিছু পাশ্চাত্য লোকদের কাছে একই সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এবং একটু গম্ভীর হয়ে যাওয়া, উভয় জিনিসটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা একটা সূচনা যে, আপনি কীভাবে ঐ উপদেশ গুলিকে আপনার জীবনে একীভূত করতে পারবেন। সর্বোপরি এর উদ্দেশ্য গুলির মধ্যে একটি হ’ল- আপনাকে সুখী করে তোলা। সেনাবাহিনীতে থাকার মতো আমরা যদি এখনও আনুষ্ঠানিক হয়ে থাকি তাহলে সেটা মনের সুখের অবস্থা হয় না। আমরা ভয়ে থাকি যে আমরা নিখুঁত হতে পারব না, আমরা ভুল করব এবং আমাদের শাস্তি দেওয়া হবে। এটা বৌদ্ধধর্ম নয়।
উল্টানো পাত্র, নোংরা পাত্র এবং ফাটল ধরা পাত্র
সুতরাং, আসুন আমরা শ্রবণ করি। উপদেশ গুলি কীভাবে শ্রবণ করতে হবে সেই বিষয়ে আমরা পরামর্শ পেয়েছি। এটা একটা পাত্রের মতো না হওয়ার উপর আধারিত। প্রথমতঃ, আমাদের অবশ্যই একটা উল্টানো পাত্রের মত হওয়া উচিত না, কারণ ঐরকম হলে তখন ভিতরে কিছু প্রবেশ করবে না। এর পরিবর্তে, আমাদের একটা মুক্ত মনের প্রয়োজন। আমাদের একটা ফাটল ধরা বা চিড় খাওয়া পাত্রের মতো হওয়া উচিত না, সেখানে সবকিছু প্রবেশ তো করে কিন্তু পরে ফুটো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। অবশেষে, আমাদের একটা নোংরা পাত্রের মতো হওয়া উচিত নয়, সেখানে আমাদের অনেক পূর্ব ধারণা থাকে এবং যা বৌদ্ধ উপদেশ বা শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ ভাবে মিশ্রিত হয়ে যায়।
আপনি যখন বৌদ্ধ উপদেশ গুলি শ্রবণ করবেন, তখন সেগুলি অন্যান্য মতবাদের সাথে তুলনা করা ত্যাগ করতে হবে। আপনি মনে করতে পারেন, “আচ্ছা, হিন্দুধর্মে এরকম বলে এবং তাওবাদে ঐরকম বলে।” আমার একজন শিক্ষক বলতেন, “তুমি যদি দুটো জিনিস তুলনা কর, তার মধ্যে যেটা তুমি সত্যিই বুঝতে পার না সেটার কোনো অর্থ হবে না। ঐ পরিস্থিতিতে তোমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে রাখবে।” যদি আপনার দুটো মতবাদ সম্পর্কে পুরোপুরি বোধগম্যতা থাকে তাহলে আপনি একটা উপযুক্ত তুলনা করতে পারেন। তবে আপনি যদি বৌদ্ধ উপদেশ গুলি না বোঝেন, তাহলে প্রথমে আপনাকে এই চিন্তা-ভাবনা গুলিকে আলাদা করা উচিত, “এটা এই রকম অথবা এটা কি ওই রকম?”। এর পরিবর্তে বাস্তবে শুধু উপদেশ গুলি শ্রবণ করা উচিত। অন্যথায় আপনি আপনার পূর্ব ধারণা গুলিতে মিশ্রিত হয়ে যাবেন, সেটা না শুধু ভুল হয়ে যাবে বরং অপ্রাসঙ্গিকও।
পরামর্শটি যখন ফাটল ধরা পাত্রের মতো না হওয়ার কথা বলে, তখন এটার অর্থ বোঝায় যে, আমরা যা শিখেছি সেটাকে মনে না করা। অনেকে নোট নেওয়াটা উপকারী মনে করেন। তবে নোট গুলি পরে নিলে দেখার পক্ষে ভালো হয়। যে কোনও ক্ষেত্রে, আমাদের যদি সত্যিই ভালো স্মৃতিশক্তি না থাকে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় গুলি লিখে নেওয়া ভালো।
পাশ্চাত্য দেশে মনোবিজ্ঞানকে দেখা খুবই মজার লাগে। সেখানে যতক্ষণ আমরা একটা পরীক্ষায় বসবো, ততক্ষণ আমরা সাধারণতঃ কিছু শেখার জন্য কোনও চেষ্টা করতে পারবো না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আমরা শিখি এবং আমরা যদি প্রতারণা করতে পারি তাহলে কেন করব না? বেশ, এখানে ওটা কাজ করে না। এখানে না আছে পরীক্ষা, না ভালো গ্রেড বা না লাগে শিক্ষকের অনুমোদন। পুরো বিষয়টি হ’ল আমরা নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা করি; এবং আমাদের মধ্যে যদি সত্যিই বুদ্ধের প্রতি আস্থা থাকে, তাহলে আমাদের জানতে হবে যে, তিনি যা শিখিয়েছিলেন তা ছিল পরোপকারের জন্য। সেখানে অপরের সাথে কোন প্রতিস্পর্ধা নেই; আমাদের উপদেশ গুলির সম্পর্কে ভাবতে হবে শুধু আমাদের নিজেদের প্রসঙ্গে। আমাদের এরকম ভাবলে হবে না, “ওই ব্যক্তির রাগ আছে, আমার নেই।” ধর্মের আয়নাটি নিজের মুখোমুখি হওয়া উচিত, বাইরের নয়।
ওষুধের সাথে সাদৃশ্য
কীভাবে উপদেশ শ্রবণ করতে হয় সে সম্পর্কে আরও একটি নির্দেশনা হ’ল নিজেকে একজন রোগী হিসাবে বিবেচনা করা। বুদ্ধ ও শিক্ষকদের চিকিৎসক হিসেবে আর বুদ্ধ বচনকে ওষুধ হিসাবে। আমরা উচ্চ অনুধাবনকারী ব্যক্তিদের নার্স হিসেবে দেখতে পারি যারা আমাদের সহযোগিতা করেন। এমনকি আরো সহজ কথায়, আমরা বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনে প্রবেশ করি এই স্বীকৃতির সাথে, আমার সমস্যা আছে। আমাদের একটা রোগ আছে যেটা হতে পারে আমাদের স্বার্থপরতা, ক্রোধ বা অন্য যা কিছু হোক না কেন; আমরা এর থেকে নিরাময় পেতে চাই। বুদ্ধ হলেন সর্বোত্তম চিকিৎসক এবং তাঁর আশ্চর্যজনক ওষুধটা আমরা পেতে চলেছি। আমরা সেটা ভুলে যাব না, বরং তার নির্দেশাবলী অনুসারে সেটা সেবন করব। চেষ্টা করব আমরা যাতে একটা দিনও মিস না করি, কিন্তু অবশ্যই পুরো বোতল ধরে একবারে সেবন করব না। বৌদ্ধধর্মে অনুশীলন করা কিছুটা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করার মত। আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেবন করতে হবে এবং সেবন করতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণে। আপনি যদি আধো পথে থেমে যান অথবা আপনি যদি দিন এড়িয়ে যান, তাহলে সেটা খুব বেশি উপকার করবে না। চিকিৎসার পরিস্থিতির পদ্ধতির মতো বৌদ্ধধর্মকে দেখার এটা একটা নির্দেশনা।
আরও একটা নির্দেশনা হ’ল, আমরা যখন উপদেশ গ্রহণ করি, তখন আমরা কল্পনা করতে পারি যে, আমরা একটা শুদ্ধভূমিতে আছি এবং শিক্ষকটি হলেন একজন বুদ্ধ, আমরা শুদ্ধ উপদেশ গ্রহণ করছি। এর মানে এটা নয়, আমাদের শিক্ষককে অগত্যা একজন আসল বুদ্ধ ভাবতে হবে, বরং আমাদের মধ্যে তার প্রতি, নিজেদের প্রতি এবং উপদেশ গুলির প্রতি শ্রদ্ধা বোধ জাগাতে হবে। আমরা গম্ভীর কিছু করতে চলেছি, এর মানে এটা নয় যে, আমরা সেখানে মন মরা হয়ে বসে থাকব। এর পরিবর্তে আমরা উষ্ণ এবং বদ্ধ কক্ষের উপেক্ষা করতে পারি এবং আমাদের যে উপদেশ দেওয়া হয় সেটাকে মুক্ত মনের সাথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি।
একটি মুক্ত মন রাখা
বুদ্ধ দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন যে, আমাদের সোনা কেনার মতো উপদেশ বা শিক্ষা গুলি পরীক্ষা করা উচিত। আমাদের শুধু বিশ্বাস করে নেওয়া উচিত নয়, কারণ তাঁর প্রতি আমাদের আস্থা আছে। এটা করার জন্য আমাদের দরকার একটা মুক্ত মনের। এর সাথে একটা অনুমানেরও প্রয়োজন যে, বুদ্ধ শুধু মজা করার জন্য অর্থহীন এমন কিছু উপদেশ দেননি। এই ধরণের মন দিয়ে আমরা উপদেশ গুলি পরীক্ষা করতে পারি যে, সেগুলি কী বোঝাতে চাইছে। তারপর যেটা সত্য এবং উপকারী মনে হবে সেটা গ্রহণ করতে পারব। আমি পূর্ব এবং পরজন্ম বিষয়ে একটা উদাহরণ প্রস্তুত করব।
আমি যখন প্রথমে বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করতে শুরু করি তখন পূর্ব এবং পরজন্মে আমার কোনো বিশ্বাসই ছিল না, কারণ আমি একটি পাশ্চাত্য ফ্যাশনে বড় হয়েছিলাম। বেশিরভাগ পাশ্চাত্য মানুষের চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে এটি ছিল এলিয়েন। তারা যদি পরকালীন জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, এটা বেশির ভাগ সম্ভবতঃ খ্রিস্টান স্বর্গ বা নরকের মতো স্থান বিশেষ হবে। কিন্তু তারপর সকল প্রাণীর ভাবনা করা যে, তারা পূর্ব জন্মে আমার মা ছিলেন, এইগুলি উপদেশে থাকে যেগুলি কেবল জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলা যায় না।
শুরুতে আমি যেভাবে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম সেটা হল আমাকে ভাবতে হয়েছিল, “আচ্ছা, আমি ধরে নিই যে, পূর্বজন্মের ধারণাটি সত্য, যদিও আমি এখন এটা বুঝতে পারি না। আমি এই বিষয়ে কোন অজুহাত দেখাতে চাই না অথবা কার্পেটের নিচে অতিবাহিত করতে চাই না। এর পরিবর্তে আমি চেষ্টা করতে এবং বুঝতে সময় নেব।” সময়ের সাথে আমি দেখতে পেলাম যে, পূর্বজন্মের ভিত্তিতে যা কিছু তৈরি হয়েছিল সে সব কিছু আসলে উপকারী এবং সঠিক। সুতরাং পূর্বজন্মের ধারণাটি নিজের থেকেই সঠিক বলে মনে হয়।
পরে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি যখন জানেন না বুদ্ধের উপদেশটি কার সাথে সম্পর্কিত, কার পুনর্জন্ম হয়, তাহলে আপনি পুনর্জন্মকেও বুঝতে পারবেন। আপনাকে আরও গভীর স্তরে যেতে হবে, যেখানে নরক প্রেত-যোনি এবং আরও কিছুর বিষয়ে বোধগম্য শুরু হয়। আমরা যদি মনের স্বভাবটা না বুঝতে পারি তাহলে এর কোনোটাই অর্থপূর্ণ হবে না। অতএব আমরা উপদেশগুলি বুঝতে পারি না এবং সেগুলি অদ্ভুত বলে মনে হয় জন্য তার কোন অংশকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রত্যাখ্যান না করা গুরুত্বপূর্ণ। ‘একটি মুক্ত মন থাকা দরকার’, এর মানে হল এটাই এবং প্রভেদমূলক প্রজ্ঞা থাকার মানে হল, “হ্যাঁ এটাই হ’ল তাই বুদ্ধ যা উপদেশ দিয়েছিলেন।” বুদ্ধ পুনর্জন্ম সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন। দুঃখিত, আমরা এটা পছন্দ নাও করতে পারি কিন্তু সেখানে এটা রয়েছে এবং আমি যদি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আরো গভীরে যেতে চাই তাহলে আমাকে এর সাথে মোকাবিলা করতে হবে।
সারাংশ
বৌদ্ধ গ্রন্থ গুলিতে আমরা যে পরামর্শ গুলি দেখতে পাই সেগুলি শুধু আমাদের অধ্যয়নকালে উপকারী হয় না বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও উপকারী হয়। এটা কখনও একটি নোংরা বা চিড় খাওয়া পাত্রের মতো ভালো নয়। আমাদের জীবনে বৌদ্ধধর্মকে প্রয়োগ করা হল একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া যেটা শুরু হয় শ্রবণ করার সাথে।
একবার এটা করা হয়ে গেলে আমরা একটা মুক্ত মন রেখে বাস্তবে উপদেশ সম্পর্কিত ঐ বিষয়গুলি পরীক্ষা করতে পারি, যেগুলি আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, ঠিক যেমন আমরা একটা হীরের আংটি কেনার সময় যেমনটা করি।