বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলামে মৈত্রীর অনুশীলনঃ একটি তুলনা

সব ধর্মই একটা সাধারণ লক্ষ্য আদান-প্রদান করে

সব ধর্মই মৈত্রী, ধৈর্য, ক্ষমা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতার সাধারণ বার্তা আদান-প্রদান করে। এটা এমন একটা বিষয় যা সব ধর্মই সাধারণভাবে শিক্ষা দেয় এবং এটাই আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ভিত্তি। এই গুণাবলী শেখানোর পিছনে তাদের দর্শন এবং পদ্ধতি ভিন্ন থাকতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য একই থাকে। বিশ্বের সব ধর্মের লক্ষ্য হল জীবনের মান উন্নত করা আর ব্যক্তির জীবন এবং সমাজে সুখ নিয়ে আসা। এটাকে সাধারণ ভিত্তি হিসাবে মেনে নিয়ে এবং সেখানে যে দার্শনিক পার্থক্য রয়েছে সেটা স্বীকার করার পর যে প্রশ্নটা সামনে আসে সেটা হল- কীভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতিকে উৎসাহিত এবং বিকাশ করা যায়, যেটা আজ বিশ্বে খুব দরকার।

আমরা যখন বৌদ্ধ এবং ইসলামিক বিশ্বের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাই যে তারা ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, যেমন- ভারত, মধ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ক’রে চলেছে এবং বিভক্ত হয়ে আছে আর এখন অনেক মুসলিম অভিবাসী ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় আসছে। এই সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের অনেক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হচ্ছে। তারা কেবল ইহুদি এবং খ্রীষ্টান পটভূমির মানুষদের সাথেই নয়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাথেও সাক্ষাৎ এবং মিথস্ক্রিয়া করছে। আজ এখানে আমাদের মধ্যে বৌদ্ধ পটভূমি থেকে আগত কেউ কেউ উপস্থিত থাকতে পারে এবং তারা এই দুটি ধর্মের তুলনা কীভাবে করা যায় সেটা জানতেও আগ্রহী হতে পারে।

এটা এমন একটা ক্ষেত্র যা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির পরিপ্রেক্ষিতে পরম পূজ্য দালাই লামা খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি সবসময় এই বিষয়ে জোর দেন যে এই সম্প্রীতির ভিত্তি হল শিক্ষা। মানুষ যখন অজ্ঞ থাকে এবং প্রায়শই অন্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের ভুল তথ্য দেওয়া হয়, তখন সেখানে একধরণের ভয় এবং অবিশ্বাস তৈরী হয়। মানুষ একটা সম্পূর্ণ ধর্মকে একটা খুব ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে চিহ্নিত করার প্রবণতা রাখে, যাকে পরম পূজ্য বলেন, “দুষ্টকর্ম-সৃষ্টিকর্তা।” এগুলি সব সমাজে এবং সব ধর্মেই দেখতে পাওয়া যায়।

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক; অতএব, ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত্তি হল শিক্ষা। শিক্ষার উপর ভিত্তি ক’রে, একে-অপরের সম্মান করা যেতে পারে, যদি কিনা আমরা একে অপরের দর্শন এবং এই ইতিবাচক গুণাবলী গড়ে তোলার উপায়গুলি বুঝতে পারি, যেটা আমরা সবাই আদান-প্রদান করি। আর এগুলি হল, মৈত্রী, করুণা, ক্ষমা ইত্যাদির মতো সার্বজনীন গুণাবলী। এই লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে আসুন এই দুটি ধর্মকে পরীক্ষা ক’রে দেখি এবং দেখা যাক তারা মৈত্রীর বিকাশ সম্পর্কে কী বলে। প্রথমে ইসলাম থেকে শুরু করা যাক।

ইসলামের মূল নীতি

আল্লাহকে অনুসরণ করার বিশুদ্ধ সহজাত প্রেরণা

ইসলামের মতে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হল আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ একটি সহজাত প্রেরণার সাথে পুরুষ ও মহিলাদের সৃষ্টি করেছেন বিশুদ্ধ প্রবণতা, আগ্রহ অথবা আল্লাহর প্রতি আত্ম-নিবেদন এবং আল্লাহর ইচ্ছার অনুসরণ করার জন্য। আমাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এটা কিছুটা অদ্ভূত বলে মনে হতে পারে, তবে আমরা যদি জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আমরা আমাদের পিতা-মাতা দ্বারা সৃষ্ট এবং শিশুর সাথে মায়ের সংযোগ স্থাপনের একটা সহজাত প্রবণতা দেখতে পাব। যেমন একটা শিশু, সে যদি একটি স্তন্যপায়ী জীব হয়, সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্তনে গিয়ে স্তনপান করতে লাগবে, পুষ্টি গ্রহণ করবে ইত্যাদি। আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি আসার জন্য একটা প্রেরণা থাকে।

অতএব, এই প্রেরণা যেটা আমরা ইসলামে দেখতে পাই, যদিও এটা একটা উচ্চস্তরের বিষয়, এটা সহজাত পরিপ্রেক্ষিতে কোন অদ্ভুত ধারণা নয়, বরং এটা প্রায় একটা চুম্বকের মতো, মানুষকে সৃষ্টিকর্তার কাছে টানে এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে অনুসরণ করে। এমনকি আমরা যদি প্রাণী জগতের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব যে শিশু তার মাকে অনুসরণ করে। এটি হল একটি প্রবৃত্তি এবং এখানে এটাই আলোচনা করা হচ্ছে।

যাইহোক, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা ও বুদ্ধি দিয়েও সৃষ্টি করেছেন। বুদ্ধির প্রভাবে, স্বাধীন ইচ্ছার সাথে, আত্মা আল্লাহর প্রতি বাধ্য হওয়া বেছে নিতে পারে অথবা আল্লাহর ইচ্ছার অবাধ্যতার কারণে উদ্ভূত নেতিবাচক আবেগের অধীন হতে পারে। এর কারণে মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। শিশুদের বিকাশের ক্ষেত্রেও এটা থাকে। পিতা-মাতার মধ্যেও স্বেরতা, অবাধ্যতা ইত্যাদি থাকে।

এই প্রবৃত্তিটি আল্লাহ দ্বারা নিষিদ্ধ নেতিবাচক আচরণের দিকে পরিচালিত করে। ফলস্বরূপ, হৃদয়ের চারপাশে কালো দাগ জমা হয়। এটা একজনের হৃদয় এবং মোহম্মদের বাণীর মধ্যে একটা আবরণ তৈরী করে। একজনের হৃদয় আল্লাহর সত্যের সামনে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু এটা আত্মা, যে স্বাধীন ইচ্ছার অনুশীলন করে, তাই হৃদয় থেকে দাগ মুছে ফেলার জন্য আত্মাকে বুদ্ধির স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করতে হয়। বুদ্ধি দিয়ে, আমরা বিচার করি এবং দেখি যে কোনটা আল্লাহর ইচ্ছা অথবা কোনটা নয় এবং আমরা পছন্দ করতে পারি যে সেটা অনুসরণ করব, কি করব না।

হৃদয়কে উন্মুক্ত করার এই প্রচেষ্টাকে একটা কঠিন সংঘর্ষ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এটাই হল “জিহাদ” শব্দের অর্থ। যদিও জিহাদ শব্দটির অনেক স্তর আছে যা ইসলামের বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এর মূল অর্থ হল নেতিবাচক আবেগের প্রভাব ও আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া এবং একটি নৈতিক জীবন অনুসরণ করার জন্য একটি আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ অথবা কঠিন লড়াই। অর্থাৎ আস্থার অভাব অথবা লালসা বা ক্রোধের প্রভাবে যাওয়া থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংঘর্ষ।

ইসলামের তিনটি দিক

আল্লাহর ইচ্ছার অনুসরণ করার অর্থ কী? এর অর্থ আল্লাহর আন্তরিক উপাসনা। ইসলামে, এতে সেই বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত যেটা ইসলামের তিনটি দিক হিসাবে পরিচিত। এগুলি হল আল্লাহর ইচ্ছা, বিশ্বাস এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ইসলামে “শ্রেষ্ঠত্ব” নামক একটি ধারণার কাছে নতিস্বীকার অথবা আত্ম-সমর্পণ।

নতিস্বীকার

নতিস্বীকারের অর্থ হল পরম সত্য হিসাবে স্বীকার করা যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন আল্লাহ নেই এবং মহম্মদ হল আল্লাহর দূত। এর অর্থ হল, আল্লাহর আইন, শরীয়াহ-কে জানা এবং অনুসরণ করা। “শরীয়াহ্‌” হল একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হল জীবন পরিচালনার নৈতিক উপায়। আল্লাহর ইচ্ছা অনুসরণ করার জন্য মূল বিষয়টি হল একটি নৈতিক জীবনযাপন করা যা শরীয়তে বর্ণিত আছে। এটা দিনে পাঁচবার প্রার্থণা করতে বাধ্য করাকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং এটি একটি সমাজের অবিশ্বাস্য শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ শক্তি।

অত্যন্ত কঠোর ইসলামী সমাজে, দিনে পাঁচবার সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। ‘ঠিকনাহাট হান্‌-এর প্লাম’ গ্রামে একটা মাইন্ডফুলনেস বেল (স্মৃতির ঘন্টা) আছে, যেটা মাঝে-মাঝে বাজে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী করছি। এটা অনেক স্তরে বোঝা যায়; কিন্তু এখানে আমাদের কোন ছোট বিচ্ছিন্ন গ্রাম নেই, বরং রয়েছে একটা সম্পূর্ণ সমাজ, যারা আল্লাহর ইচ্ছা অনুসরণ করার জন্য এবং নিজেদেরকে একটা নৈতিক জীবনযাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য দিনে পাঁচবার থামে।

আমি দালাই লামার পক্ষ থেকে আফ্রিকা এবং ইসলামিক বিশ্বে কমবেশী ভ্রমণ করেছি, তাদের কাছ থেকে আরও কী শিখতে পারি তার সম্পর্কে জানতে। জঞ্জিবারে, একটা মজার বিষয় ছিল যে, তারা মাদকাসক্তদের আসক্তি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করার জন্য এই কঠোর ইসলামী অনুশাসন ব্যবহার করেছিল। যদি একজন ব্যক্তির একটা আসক্তময় জীবনের পরিবর্তে, কিছু অনুসরণ করার জন্য খুব কঠোর সময়সূচী থাকে এবং তার একটা নৈতিক ভিত্তি থাকে, তাহলে এটা জীবনকে একটা কাঠামো প্রদান করতে খুব সাহায্য করে। যখন কেউ মাদকাসক্ত হয়, তখন সে তার জীবনের সমস্ত গঠন হারিয়ে ফেলে। এটা একজনকে অনেক চিন্তাশক্তি প্রদান করে। তিব্বতেও এরকম একটি সমস্যা রয়েছে। যদি মাদকাসক্তদের কিছু সাধন করতে বলা হয়, যাকে আমরা তিব্বতী ভাষায় ঙোন্‌ড্রো (আদ্য সাধনা/ পূর্বগমন) বলি, যার মধ্যে রয়েছে ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম ইত্যাদি এবং যদি তাদের একটা কঠোর কাজকর্মের সূচী দেওয়া হয়, তাহলে তাদের জন্য এটা খুব সহায়ক হতে পারে।

অতএব, নিম্নলিখিত আল্লাহর ইচ্ছা অনুসরণ করা এবং একটি নৈতিক জীবনযাপনের অর্থ হলঃ

  • দিনে পাঁচবার নামাজ পড়া।
  • দরিদ্রদের জন্য কর প্রদান করা, এটা এমন একটা বিষয় যেটা সমস্ত মুসলিমরা সমাজের সাধারণ কল্যাণের অংশ হিসাবে করে।
  • রমজান মাসে রোজা রাখা; এটাকেও জিহাদের একটা রূপ হিসাবে দেখা হয়, অর্থাৎ খাদ্য বা পানীয় পদার্থের প্রতি নিজের আসক্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ইত্যাদি। এই সময় প্রত্যেকের জন্য শৃঙ্খলা নির্ধারিত থাকে যে তারা যেন কেবলমাত্র খাবার এবং বিনোদনের প্রতি নিজেদের আসক্তি উৎপন্ন হতে না দেয়, পরিবর্তে আল্লাহর মাস হিসাবে তারা যেন খুব মননশীল জীবনযাপন করে।
  • একটি তীর্থযাত্রাও নির্ধারিত রয়েছে, যেমন ইসলামের পবিত্র স্থানগুলিতে যাওয়া এবং মোহম্মদের জীবনের কিছু ঘটনাকে পুনরায় পুনর্জীবিত করা। অবশ্যই, তিনি কোরানে যে শিক্ষাগুলি প্রকাশ করেছিলেন সেটা প্রত্যেককে স্মরণ করিয়ে দেয়।

আস্থা এবং শ্রেষ্ঠত্ব

দ্বিতীয় দিক, ‘আস্থা’,-এর অর্থ হল ইসলামের মৌলিক সত্য এবং আল্লাহর বাণীরূপে কোরানের আপ্ততা গ্রহণ করা।

তৃতীয়টি আমাদের প্রেমের আলোচনায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটা সাধারণতঃ “প্রেম” হিসাবে অনুবাদ করা হয় এবং এর অর্থ চরিত্র এবং আল্লাহর সেবা উভয় ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহ সমস্ত মানবজাতিকে এই শ্রেষ্ঠত্ব, চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী এবং আল্লাহর সেবা করার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানবজাতির মধ্যে যে শ্রেষ্ঠত্ব সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি তাঁর ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেমের অনুভূতি থাকে। এই শ্রেষ্ঠ গুণগুলির মধ্যে রয়েছে প্রেম এবং অন্যদের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা। আল্লাহর সেবার কাজ মানে আল্লাহর দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত কিছুর প্রতি প্রেমের সাথে কাজ করা এবং এটা করা হল আল্লাহর উপাসনার একটা রূপ।

এটি একটা খুব আকর্ষণীয় ধারণা এবং প্রেমের দ্বার। আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালবাসা এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করা হল আল্লাহ দ্বারা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সৃষ্ট শ্রেষ্টত্বকে পূরণ করার একটা উপায়। প্রেমের জন্য আরবী ভাষার শব্দগুলির মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠত্বের ঘনিষ্ঠতার অনুভূতিকে বোঝায়, আবার অন্য একটি শব্দ অন্যের প্রতি কারও আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপে প্রকাশিত ঘনিষ্টতার অনুভূতিকে বোঝায়। শব্দার্থের উপর ভিত্তি ক’রে এবং শুধুমাত্র কোরানের উপর ভিত্তি ক’রেই কেউ অনেক কিছু শেখে। আমরা প্রেমের জন্য ব্যবহৃত শব্দগুলির দিকে তাকাই এবং সেখানে তাদের এই অর্থ পাই শ্রেষ্ঠত্ব এবং ঘনিষ্টতার অনুভূতি আর অন্যদের প্রতি আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপে প্রকাশিত ঘনিষ্টতা।

অন্যদের প্রতি প্রেম ভাবনার সাথে কাজ করা হল একটি স্বতন্ত্র ইচ্ছার কাজ। মানুষ এইরকম পছন্দ করতে তাদের বুদ্ধির ব্যবহার করতে পারে। তারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ প্রবণতা অনুসরণ করে। এটা খুব আকর্ষণীয়। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদেরকে স্রষ্টার কাছে টানতে এই ধরণের চুম্বক থাকে, বেছে নেওয়ার স্বাধীন ইচ্ছা তৈরী করেছেন আর সেই মতো সমস্ত প্রলোভন এবং বস্তুও আছে। সেই সহজাত প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ করার জন্য যার মাধ্যমে কেউ আল্লাহর নিকটবর্তী হন সেটা হল প্রেম, সেবা এবং অন্যদের সাহায্য করা। এটা হতে পারে দরিদ্রদের জন্য ট্যাক্স প্রদানের ক্ষেত্রে অথবা মুসলিম সমাজের জন্য সামাজিক সাহায্যের অন্যান্য উপায়ে। এছাড়াও, এখানে যেটা খুবই মজার বিষয় সেটা হল যে মানবতার প্রতিটি সদস্য সমানভাবে আল্লাহর সৃষ্টি। সকলের মধ্যে সমতার অনুভূতি আছে। প্রত্যেকেরই একটি আত্মা এবং একটা হৃদয় আছে যাকে এই সহজাত প্রবণতার সাথে মুদ্রাকৃত করা হয়েছে, যেটা প্রতিটি ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে আকৃষ্ট করতে পারে।

বিচারক হিসাবে আল্লাহ এবং শাস্তিদাতা ও করুণাময় সত্তা যিনি ক্ষমা করেন।

এছাড়াও, ইসলামে নৈতিকতার সাথে একত্রিত হয়ে, আল্লাহ প্রত্যেককে সমানভাবে সুবিচার করেন এবং শুধুমাত্র তাদেরই ভালবাসেন যারা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্ম-সমর্পণ করে এবং শরিয়াহ অনুযায়ী এটা তাকে একটা নৈতিক জীবনের দিকে পরিচালিত করে। সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণের জন্য, যারা অবাধ্য এবং অপরের ক্ষতি করে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন। অতএব, আল্লাহর সেবা এবং প্রেমের চিহ্ন হিসাবে, মানবজাতিকে চালু করতে হবে শরীয়তের আইন। এইভাবে, মুসলিম সমাজে আইন ও বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের সমস্ত পশ্চিমী জুডিও-খ্রীষ্টান জগতেও পুরাতন টেস্টামেন্ট (ওল্ড টেস্টামেন্ট) থেকে আসা আইনের শাসন চালু আছে। তাতে বিচার এবং পুরস্কার আছে; যদি আমরা আইন মেনে চলি সমাজ আমাদের ভালবাসে এবং আমাদের যত্ন নেয় আর অমান্য করলে শাস্তি দেয়। পশ্চিমী দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এটা মোটেও একটি বিদেশী ধারণা নয়।

যদি কেউ এই আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এটা নিজের আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ হয়ে যায়, কিন্তু এটা একজনকে আল্লাহ এবং আল্লাহর প্রেম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কিন্তু সে যদি আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়, তাহলে সে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে। ইসলামে এটি একটি প্রধান ভূমিকা; আল্লাহ হলেন করুণাময়, যিনি সর্বদা ক্ষমা করেন। যারা অনুতপ্ত হতে চায়, আল্লাহ তাদের অন্তরে প্রবেশ করেন এবং তাদের অনুতপ্ত হতে সাহায্য করেন আর তারপর তাদের ক্ষমা করেন।

আমরা এটাকে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তুলনা ক’রে দেখতে পারি; অনুতাপ তীব্র অনুশোচনার অনুভূতিরূপে জাগে। আমরা যা করে থাকি সেটার জন্য আমরা অনুতপ্ত হই; এবং যারা আমাদের ক্ষতি করেছে তাদের প্রতি আমাদের ক্ষোভ ত্যাগ করি এবং অনুতপ্ত হই। তারপরে আমরা যে ভুল কাজগুলি করেছি সেটা প্রতিহত করার জন্য কিছু করার মাধ্যমে আমরা পুনরুদ্ধার করি, যেমন একটি পুণ্যকর্ম এবং আমরা আর কখনও ভুল কাজের পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্প করি। এটা সরাসরি কোরানে যা আছে সেটার অনুরূপ।

শরিয়ৎ এবং ক্ষমা

শরীয়াহ্‌ আদালতের আইনে ক্ষমাও জড়িয়ে আছে। এটা শরীয়তের একটি অবিশ্বাস্য দিক যেটা আমরা সত্যিই খুব বেশি শুনতে পাই না। আমরা শুধু শাস্তি সম্পর্কে শুনতে পাই, যেগুলি খুব গুরুতর, তবে অপরাধের শিকার অথবা অপরাধীর পরিবারের একটা পছন্দ থাকে। তদনুসার, তারা সর্বদা কঠোর শাস্তি বেছে নিতে পারে অথবা কোন ধরণের ক্ষতিপূরণ পেতে পারে, যেমন পুরোনো দিনের মতো ছাগল এবং উট অথবা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা ক্ষমা। তারা ক্ষমাও করতে পারে। যদি পরিবার অথবা অপরাধের শিকার এমন ব্যক্তি সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা ক’রে দেয় যে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তাহলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

আইনের প্রেক্ষাপটে ক্ষমা করার এই অনুশীলনটিও আল্লাহর সেবার দিক থেকেও একটা অসাধারণ কাজ। এটা কিছুটা এবং শরীয়াহ আইন আরোপের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয়। কখনো-কখনো পশ্চিমের মানুষ এই নিয়ে খুব বিভ্রান্ত হয়। কেন? কারণ যখন আইনের এত কঠোর রূপ থাকে এবং এই ক্ষমার দিকটি সাধারণতঃ অজানা, একটা সমাজ কেন সেটা চাইবে? সোমালিয়ার মতো জায়গায় যেটা দেখতে হবে, যেখানে সমাজ যুদ্ধবাজ এবং বিশৃঙ্খলায় আচ্ছন্ন আর ভয়ঙ্করভাবে বিপজ্জনক, সেটা হল সেখানকার মানুষ কিছুটা শৃঙ্খলা চায়। তাদের সংস্কৃতি থেকে যেটা আসে সেটা হল শরীয়াহ। যদি তাদের কাছে এটা থাকে তাহলে তারা নিরাপদ বোধ করতে পারে। তারা জানে যে একজন চোর হাত কেটে ফেলতে চলেছে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত করার চেয়ে এই শাস্তিটা চুরিকে নিরুৎসাহিত করে। এটি এমন কিছু আদেশের প্রতিশ্রুতি যেটা খুব মর্মস্পর্শী।

এছাড়াও, আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াতে গিয়ে দেখা যায়, যে ধর্মটি সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হচ্ছে, সেটা হল ইসলাম। আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি, এরকম হচ্ছে কেন? এর কারণ মানুষ যা বলে সেটা হল সমতার একটি ভ্রাতৃত্ববোধ যেখানে সবাই সমান। কিন্তু যখন তারা পশ্চিমের কথা চিন্তা করে তখন তারা ঔপনিবেশিক শক্তির কথা মনে করে, যেখানে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদী এবং আফ্রিকানদের মধ্যে সমতার কোন অনুভূতি ছিল না। এটি আফ্রিকার অনেক দেশে ইসলামের একটি বড় আকর্ষণ এবং আবেদন।

মানুষ জগৎ এবং মানবতার প্রতি বিশুদ্ধতম পদ্ধতিতে প্রেম বিকাশ করে, কিন্তু ইসলাম ধর্মে, তাদের প্রেম জগতের জন্য, মানবতার জন্য বা নিজের জন্য নয়। ইসলামে, প্রেম হল আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহ দ্বারা সৃষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি। এটাই হল প্রেমের পিছনে দার্শনিক চিন্তা। এইভাবে প্রেম বা মৈত্রীর বিকাশ প্রত্যেকের সমতার উপর ভিত্তি করে যা প্রেমের খুব ব্যাপক বিকাশের অবকাশ প্রদান করে। এটা এমন নয় যে, একজন একজনকে ভালবাসবে, কিন্তু অন্যজনকে নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভাল এবং এই ধরণের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রচেষ্টারত থাকে, ততক্ষণ একজনের ভালবাসা সবার জন্য হয়। আল্লাহ প্রত্যেকের মধ্যে এই অসাধারণ গুণ এবং মঙ্গলময়তা সৃষ্টি করেছেন আর এটা মানুষকে অবকাশ প্রদান করে সকলকে ভালবাসার জন্য। মানুষ যদি ক্রোধ এবং লালসাবশতঃ আর হিংস্রভাবে কাজ করে, প্রথমে, তাকে অনুতপ্ত হতে এবং একপ্রকার নৈতিক জীবনে ফিরে যেতে উৎসাহিত করা হয়। এটাই হল ইসলামে প্রেমের অন্তর্নিহিত দার্শনিক ভিত্তি।

বৌদ্ধধর্মের মৌলিক নীতি

আমরা যখন বৌদ্ধধর্মের দিকে তাকাই, তখন মৈত্রী কীভাবে বিকাশ হয় তার সম্পর্কে আমাদের কাছে বেশ ভিন্ন ধারণা আছে, তবে যেটা বেশ আকর্ষণীয় সেটা হল দুটি ধর্মের মধ্যে কতগুলি বিষয় একইরকম সেটা দেখা।

অনাদি তথাগতগর্ভের সহজাত গুণ অথবা স্রষ্টা আল্লাহ

বৌদ্ধধর্মের মতে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে একটা অনাদি বিশুদ্ধ বুদ্ধ-প্রকৃতি (তথাগতগর্ভ) আছে। এটা তাদের নিজেদেরকে বুদ্ধত্ব লাভ করতে সক্ষম ক’রে তোলে। ইসলাম ধর্মের মতে এই বিশুদ্ধ সহজাত প্রকৃতি মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী ক’রে তোলে। তবে কিছু সুফি ব্যবস্থা অনুযায়ী, যদিও আল্লাহয় বিলীন হয়ে যায় কিন্তু সে কখনো আল্লাহ হতে পারে না। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের মতে তথাগতগর্ভরূপী সহজাত স্বভাব সকলকে বুদ্ধ হতে সক্ষম ক’রে তোলে। এইগুলি হল বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমান প্রকারের তত্ত্বের ব্যাখ্যা।

বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী সত্ত্বের মধ্যে এই তথাগতগর্ভকে কেউ সৃষ্টি করেনি। এটা প্রকৃতির নিয়মে অনাদিকাল থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম ধর্মের মতে এটা আল্লাহ দ্বারা সৃষ্ট। এটাকে অন্যভাবে দেখা যেতে পারে, কারণ আমরা যদি জিজ্ঞাসা করি, আল্লাহর কোন আদি আছে কিনা, সেখানেও আমরা উত্তর পাব আল্লাহও হল অনাদি। এখানেও আমরা অনাদিরূপে এর চূড়ান্ত উত্তর পাই, কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আমাদের সেরকম কোন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মান্যতা নেই।

বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী, মানুষের মধ্যেও ভাল গুণ বিদ্যমান থাকে, যেমন- সহজাত করুণা এবং বুদ্ধি বা বোধশক্তি যা পার্থক্য করতে সক্ষম করে কোনটা লাভদায়ক এবং কোনটা ক্ষতিকর। বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলামধর্ম এরসাথে একমত আর বিজ্ঞানও এতে একমত যে এটা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এটা নিজের যত্ন নেওয়ার এই প্রবৃত্তি- জীবিত থাকার প্রবৃত্তি- এবং প্রজাতির অন্যদের যত্ন নেওয়ার প্রবৃত্তিকে বোঝায়। এটা কোন দ্বন্দ্ব নয়। আমাদের সকলের মধ্যেই লাভদায়ক এবং ক্ষতিকারকের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা আছে।

নৈতিক শৃঙ্খলা

বৌদ্ধধর্মে, নৈতিক শৃঙ্খলা এই বোধগম্যতার উপর ভিত্তি করে যে, কোন কর্মগুলি দুঃখের জন্ম দেয় এবং কোনগুলি সুখের জন্ম দেয়। বুদ্ধ এই শিক্ষাগুলি দিয়েছেন; ইসলাম ধর্মের নৈতিক কারণ ও ফলের আইন আল্লাহর মতো তিনি এগুলি সৃষ্টি করেননি। বৌদ্ধধর্মের মতে প্রভেদমূলক সচেতনতার মাধ্যমে, কোনটা লাভদায়ক এবং কোনটা ক্ষতিকর সেটা বিশ্লেষণ করতে এবং নিজের জন্য বিশ্লেষণ এবং পার্থক্য করতে সক্ষম। এইভাবে বুদ্ধি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে এটা ভিন্নভাবে ধারণা নির্ধারণ করা হয়। সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসতে এবং একটি নৈতিক জীবনযাপন করার জন্য আল্লাহর ইচ্ছাকে মান্য অথবা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিতে বুদ্ধি ব্যবহার করা হয়।

আল্লাহ নৈতিক আচরণের নিয়ম তৈরী করেছেন এবং ইসলাম ধর্মে আল্লাহ পুরস্কার এবং শাস্তি দিয়ে বিচার করেন। বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, দুঃখ কেবল ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে এবং সুখ অনুসরণ করে গঠনমূলক আচরণ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আমরা যদি অশান্তকারী আবেগ এবং অজ্ঞানতার প্রভাবে কাজ করি তাহলে, কারণ এবং ফলের প্রাকৃতিক নিয়মে, এটা দুঃখের জন্ম দেবে; অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে, আল্লাহই আমাদের শাস্তি দেন। এই ফলাফলটি একই ধরণের, কিন্তু এটাকে কেবল ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

একইভাবে, বৌদ্ধধর্মে, কেউ যদি এই অশান্তকারী আবেগের অধীনে কাজ করা থেকে বিরত থাকে, তাহলে এটা গঠনমূলক বলে বিবেচিত হয়। যদি কেউ অন্যকে মৈত্রী এবং করুণার সাথে সাহায্য করে, তাহলে এটা সুখের জন্ম দেয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, আল্লাহ আমাদের পুরস্কৃত করেন; একজন আল্লাহর এবং একজনের সহজাত বিশুদ্ধ স্বভাবের কাছাকাছি পৌঁছয়। এটা সম্পূর্ণ সাদৃশ্য, কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে যে, হেতু এবং ফল কীভাবে কাজ করে। এটা একটা কঠিন প্রশ্ন এবং সত্যিই বোঝার বিষয়। বৌদ্ধধর্মে, এটা কেবল বলে, এটা তেমনই এবং কেউ-কেউ “বুদ্ধ বলেছেন” এরকম কিছুর উপর ভিত্তি ক’রে বুদ্ধকে তথ্যের একটি বৈধ উৎস হিসাবে বিশ্বাস করে। ইসলাম ধর্মে, কেউ কেবল স্বীকার করে যে আল্লাহ এটা তৈরী করেছেন এবং এটা অভ্রান্ত ও সত্য।

বুদ্ধের প্রতি আস্থা এবং শরণ

বাস্তবে বৌদ্ধধর্মের প্রতি আস্থা হল যুক্তি এবং কারণের উপর ভিত্তি ক’রে নিজেকে বোঝানোর জন্য যে, বুদ্ধ হল তথ্যের একটা বৈধ উৎস। সর্বোপরি, বুদ্ধ আমাদের জন্য যা বলেছেন সেটার উপর প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ করতে বলেছেন। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, সবাইকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আস্থার জন্য বলা হয়। এটাই একটু পার্থক্য। যখন কেউ আত্মবিশ্বাসী হয় যে বুদ্ধ হল তথ্যের একটা বৈধ উৎস, তখন সে তাঁর শরণে যায়। ‘শরণ’-এর অর্থ হল একটি নিরাপদ দিক যা আমরা আমাদের জীবনে আত্মসাৎ করি যা মূলতঃ আমাদের তথাগতগর্ভের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এটাই আমাদের ক্ষতি এবং হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।

ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি যে আমাদের জীবনে একধরণের দিকনির্দেশনা দরকার। যাইহোক, ইসলামের বিপরীতে, বুদ্ধের শরণ-গমনের অর্থ এই নয় যে আমরা বুদ্ধের পূজা-অর্চনা করি, যদিও অনেক মানুষ এটাকে সেভাবেই দেখে। আমরা যদি এটিকে শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে দেখি, এটা কোন অন্ধবিশ্বাস নয়, আর শুধুমাত্র “বুদ্ধ, বুদ্ধ, আপনি কত বিস্ময়কর,” এই মনে ক’রে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা নয়, যেমন ইসলাম ধর্মে আছে।

আমরা যদি আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এটা খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, কারণ আসলে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করার অর্থ কী? এর অর্থ হল, নিজের আত্মকেন্দ্রিকতা অথবা স্ব-ইচ্ছাকে কাটিয়া ওঠা, অর্থাৎ এই চিন্তা-ভাবনা যে আমরা সবকিছু জানি, আমরা জানি কোনটা শ্রেষ্ঠ। এটাকে বৌদ্ধধর্মে কী বলে? এটা হল যে, আমরাই হলাম এই জগতের কেন্দ্রবিন্দু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এই ধরণের বিষয় সম্পর্কে এই বড়-অহং-ভ্রমণকে কাটিয়ে উঠতে হবে।

আবার, আমাদের যেটা করতে হবে এটা তার একটি ভিন্ন স্বাদ। আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে, এক অর্থে, আত্মার প্রতি মূর্ত ধারণার আসক্তিকে। বৌদ্ধধর্মে, অবশ্যই সেখানে একটা আত্মা আছে, তবে এটা এমন কোন মূর্ত বস্তু নয় যাকে সর্বদা তার অস্তিত্বে থাকতে হবে, সর্বদা সঠিক হতে হবে, সর্বদা প্রথম হতে হবে, সর্বদা সকলের মনোযোগে থাকতে হবে এবং সেটাই সবকিছু। এটা আমাদের জীবনে অনেক সমস্যা এবং অসুবিধার সৃষ্টি করে। আমাদের এটা পরিত্যাগ করতে হবে এবং এটা আত্মসমর্পণ করতে হবে। এগুলি হল বিভিন্ন দার্শনিক স্বাদ এবং ধারণা, কিন্তু ফলাফলগুলি হল প্রায় একইরকম।

ধর্মে শরণ এবং নৈতিক শৃঙ্খলার ভিত্তি

“ধর্ম” শব্দের অর্থ হল একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যা আমাদেরকে দুঃখ থেকে দূরে রাখে। এটা বুদ্ধের শিক্ষা দ্বারা নির্দেশিত। শিক্ষাগুলি এমনকিছু যেটা আমরা বিশ্লেষণ ক’রে তার সত্যকে আবিষ্কার করতে পারি। এটা কোরাণ এবং শরীয়তের মতো কোন প্রশ্নাতীত ধর্ম নয়। ধর্ম কোন পবিত্র গ্রন্থ অথবা আইনী ব্যবস্থা নয়। এটা একটা মজার বিষয় যে, চীনারা “ধর্ম” শব্দটিকে “আইন”-এর জন্য নির্ধারিত চীনা শব্দে অনুবাদ করেছে এবং তারা বৌদ্ধধর্মের দিকে তাকায় যাকে আমরা চাইনিজ চশমা বলতে পারি এবং কনফুসিয়ান সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এটা বুঝতে পারা যায়।

যাইহোক না কেন, আইন ভারতীয় অথবা তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে না, যেমন- পাশ্চাত্যের জুডিও-খ্রীষ্টান-ইসলাম ধর্মে ক’রে থাকে। এমন কোন আইন নেই যা আমরা অনুসরণ করি বা এমন কোন ধারণা নেই যে, আমরা যদি আইন মানি, তাহলে আমরা একজন ভাল মানুষ হয়ে যাব। আমাদের পশ্চিমে এটা শুধুমাত্র বাইবেলের পটভূমি থেকে নয়, আমরা এটা প্রাচীন গ্রীক সমাজ থেকেও পেয়েছি। যদি কেউ আইন অনুসরণ করে, তাহলে সে একজন ভালো নাগরিক হয়। আইনগুলি আল্লাহ দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে অথবা সেগুলি একটা আইনসভা দ্বারা তৈরী করা হয়েছে, কিন্তু তাসত্ত্বেও, নীতিশাস্ত্রের এই ভূমিকাটি খুবই কেন্দ্রীয় এবং এটা আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে।

এর বিপরীতে, বৌদ্ধধর্মে, নীতিশাস্ত্র আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে না। এটা অর্থ বোঝার বিশুদ্ধ প্রভেদতা বা পার্থক্যকরণ ব্যবহার করার উপর ভিত্তি করে যে আমরা যদি ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি তাহলে এটা অনেক সমস্যা তৈরী করবে- সমাজের জন্য সমস্যা এবং নিজেদের জন্য সমস্যা। উদাহরণ স্বরূপ, পোকামাকড় হত্যাঃ আমরা বিশ্লেষণ করি যে, যখন আমাদের চারপাশে কিছু ভন-ভন করে তখন আমাদের মধ্যে প্রথম প্রবৃত্তি জাগে যে সেটাকে চাপড় দিয়ে মেরে ফেলা, তারপর আমাদের সেই প্রথম প্রবৃত্তিটির সম্পর্কে ভাবতে হয়। এটা একটা কুকুরের মতো; আমরা যদি একটা কুকুরকে খোঁচাই, কুকুরটি গর্জন করবে অথবা ঘেউ ঘেউ করবে। আমরা কি কুকুরের মতো? আমরা যাকে পছন্দ করি না, তাকে এমন কিছু দিয়ে আঘাত করা, ব্যথা দেওয়া এবং মেরে ফেলা কি আমাদের প্রথম প্রবৃত্তি? তারপর, আমরা দেখতে পারি যে তার পিছনে কিছু বুদ্ধি আছে যা ধ্বংসাত্মক এবং দুঃখ বা সমস্যার সৃষ্টি করে। এটা অবশ্যই একটা খুব শান্ত এবং প্রশান্ত মনের জন্য সৃষ্টি করে না যে, যখনই কিছু অস্বাভাবিক দেখি, আমরা অবিলম্বে আঘাত করি।

একবার ঐ মনোভাবের কথা ভাবুন, আমরা যখন ঘুমোনোর চেষ্টা করি, তখন যদি একটা মশা আমাদের চারপাশে ভন-ভন করতে থাকে, আমরা কতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি; বেশিরভাগ মানুষ সেটার শিকার করতে এবং সেটাকে ধরতে চায়। এটাই হল সেই ধরণের বিষয় যেটাকে আমরা পার্থক্য করি। এটা এই কারণে নয় যে মশা মারা আইনের বিরোধী, এবং আমরা একজন ভাল নাগরিক, একজন ভাল মুসলিম বা খ্রীষ্টান হব যদি আমরা এটাকে না মারি।

এটি একটি ভিন্ন ধারণা এবং চিন্তা-ভাবনা করার জন্য নীতিশাস্ত্রের এই পদ্ধতিটি আমাদের অনেক কিছু দেয়। আমাদের নৈতিক আচরণের পিছনে কী থাকে? আবার এক জায়গায় আমি যখন বার্লিনে বৌদ্ধ নীতি সম্পর্কে শিক্ষাদান করছিলাম, যেখানে আমি থাকি, আমি আমার ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন তারা চুরি করেনি। কেউ কেউ উত্তর দিয়েছিল যে, এটা আরও খারাপ পুনর্জন্ম লাভ করার ভয়ের কারণে এবং এর মতো কোন কোন কারণে করেনি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, সত্যিই কি এটা তাদের অনুপ্রেরণা ছিল। ঐসময় সত্যিই কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। এটাকে একপাশে রেখে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তোমরা চুরি কর না কেন?” যে উত্তরটা এসেছিল সেটা ছিল, এটা ঠিক বলে মনে হয় না, সেই কারণে।

বৌদ্ধধর্ম ঠিক এটাই বলে যে, নৈতিক আচরণের পিছনে থাকে আত্ম-মর্যাদা এবং স্ব-মূল্যের অনুভূতি, আমাদের নিজেদের জন্য যথেষ্ট সম্মান থাকে যে আমরা সেভাবে কর্ম করব না। এটা আমাদের উপর খারাপভাবে প্রতিফলিত হয়, আমাদের পরিবার, আমাদের মূল্যবোধ, সবকিছুতে খারাপভাবে প্রতিফলিত হয়। বৌদ্ধধর্ম এটাকেই বলে নৈতিক আচরণের ভিত্তি। এটাকে ভিত্তি ক’রে এবং তারপর আমাদের বিস্ময়কর মানবিক বুদ্ধি এবং ক্ষমতা দিয়ে, আমরা প্রভেদ করি এবং বেছে নিই কোনটা লাভদায়ক এবং কোনটা ক্ষতিকর। আমরা ক্ষতিকারক কিছু করতে চাই না, কারণ এইভাবে কাজ করার জন্য আমাদের নিজেদের একটা সম্মান থাকে। এটাই হল চমৎকার পদ্ধতি যা বৌদ্ধধর্মে উপস্থাপিত করা আছে। এটা আনুগত্যের বিষয় নয়। সর্বশেষে, অবশ্যই, আমাদের নৈতিক আচরণ আছে, তবে আমরা কীভাবে সেদিকে অগ্রসর হব সেটাই হল প্রশ্ন। অতএব আমরা বুদ্ধের শরণে, ধর্মের শরণে এবং তারপর সংঘের শরণে যাই।

সংঘের শরণঃ ইসলাম ধর্মের ভাতৃত্ব এবং ভগিণীত্বের সাথে তুলনা

সংঘ বলতে তাদের সমুদয়কে বোঝায় যারা মার্গে আসীন আছেন এবং শুধুমাত্র মঠবাসী সমুদয়ের মাধ্যমে এটির ব্যবহারসিদ্ধ বিবরণ প্রস্তুত করা হয় না, কিন্তু যারা হলেন উচ্চ সিদ্ধি প্রাপ্ত সত্ত্ব। ইসলামে কি এর কোন সমকক্ষ আছে? হয়তো সব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব একটি সহায়ক সমুদয় হিসাবে কাজ করে। সংঘের প্রধান কাজ হল আমাদেরকে উৎসাহ প্রদান করা যে বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত করার পথে অন্যরাও আছেন। বুদ্ধের সমস্ত গুণাবলীর সাথে একজন বুদ্ধের সম্বন্ধ স্থাপন করা খুবই কঠিন, কিন্তু এখানে মানুষ সেই দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়াস করতে থাকে এবং কিছুটা উন্নতিও করেছে, আর এই ক্ষেত্রে আমরা একা নই। এটা একটা সমুদয় হিসাবে আমাদের কিছু সমর্থন জোগায়।

ইসলাম ধর্মে, আমরা দেখতে পাই যে সমস্ত মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব এবং ভগিনীত্ব ভাবনা থাকে। আপনি যতই ধনী বা দরিদ্র হন না কেন, উদাহরণ স্বরূপ, তীর্থযাত্রায় যাওয়ার সময় তারা সকলেই একই পোশাক পরে। এখানে সমতার এই অনুভূতি দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মে, যেটা মজার বিষয় সেটা হল যারা মার্গে আসীন নেই তাদের কোন নৈতিক বিচার নেই; অতএব, তাদের ক্ষমা করার বা তাদের ধর্মান্তরিত করতে চেষ্টা করার কোন প্রয়োজন নেই। ইসলামে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।

আবৃত তথাগতগর্ভঃ ইসলাম এবং সুফীবাদে হৃদয়ের আবরণ সদৃশতা

বৌদ্ধধর্ম মত প্রকাশ করে যে আমাদের মধ্যে বিশুদ্ধ তথাগতগর্ভ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতার সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা অবিদ্যার কারণে মন আবৃত থাকে। আমাদের মধ্যে এই আবরণ আছে এবং তথাগতগর্ভ অবিদ্যার মেঘ দ্বারা আবৃত আছে। এটা ইসলামের মতের মতোই শোনায়। এই সাতটি বিরক্তিকর আবেগ সম্পর্কে কথা বলে এবং হৃদয় আবৃত থাকে আর সেটা বর্ণনা করে যে এই আবরণই হৃদয়কে আবৃত ক’রে রাখে। ইসলামের একটি উপশাখা সুফিবাদ, তারা এই আবরণ উন্মোচনের কথা বলে। এটা একই ধরণের রূপক। এই অবিদ্যা মনকে আত্মকেন্দ্রিকতা, অশান্তকারী নেতিবাচক আবেগ এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের দিকে পরিচালিত করে।

বৌদ্ধধর্মে, যে কেউ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার মাধ্যমে এবং মৈত্রী, করুণা ও বোধিচিত্ত বিকাশের মাধ্যমে এই আবরণগুলি বা এই ওড়গুলিকে আমাদের ধর্মতা থেকে দূরীভূত করতে পারে। বোধিচিত্ত হল এই মন যা আমাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র বোধির উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ রাখে, যেটা এখনও ঘটেনি কিন্তু তথাগতগর্ভের ভিত্তিতে ঘটতে পারে। এটা আল্লাহর উপর ফোকাস করার মতো ভিন্ন নয়। আল্লাহ এবং বুদ্ধ অবশ্যই সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু একজনের সহজাত বিশুদ্ধ স্বভাবের লক্ষ্যের উপর মনোনিবেশ করার এই ধারণাটি যেটার কাছাকাছি আসা এবং অর্জন করার উদ্দেশ্যে করা হয় সেখানে বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয়ের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে।

ইসলাম ধর্মের তুলনায় বৌদ্ধধর্মে মৈত্রীর বিকাশ

মৈত্রীর সংজ্ঞা

বৌদ্ধধর্মে, অন্যরা সুখ এবং সুখের কারণে যুক্ত হোক, এই কামনাকে মৈত্রীর অর্থরূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই ভাবনাটি ভিত্তি ক’রে সমস্ত প্রাণী সমানভাবে সুখী হতে চায়, এই ভাবনার সমতাকে বোধগম্যতা করার উপর। কেউ দুঃখী হতে চায় না। এটাই জীবনের লক্ষ্য অর্থাৎ সুখ সাধন করা। গাছপালা জন্মায় এবং সুখ সাধনের জন্য সূর্যের আলোর কামনা করে; সাধারণ জীবনে সুখের সাধন করা বলতে যা বোঝায় তার কাব্যিক বর্ণনায় আমরা অনেক দূরে যেতে পারি।

মৈত্রীর বিকাশ

বৌদ্ধধর্মে, অন্যরা সুখী হোক, এই কামনাটি এই বোধগম্যতার উপর ভিত্তি করে যে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে সুখী হওয়ার ক্ষমতা আছে কারণ আমাদের মধ্যে তথাগতগর্ভ বিরাজমান আছে। এছাড়াও আমাদের সকলের আছে সমান অধিকার। আবার আমাদের ইসলামে এরকম সদৃশ কিছু আছে। এটা একে অপরের উপর নির্ভরশীলতা এবং আমরা অন্যের কাছ থেকে যে কৃতজ্ঞতা লাভ করেছি তার স্বীকৃতি এবং উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে। ইসলাম ধর্মে, আমরা অন্যের কাছ থেকে যে কৃতজ্ঞতা লাভ করেছি তার উপর বেশি জোর দেওয়া হয় না, পরিবর্তে আল্লাহ, যিনি আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে যে কৃতজ্ঞতা লাভ করেছি তার উপর জোর দেওয়া হয়। একটা সামান্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের সমতার উপর বিচার করা হয়।

বৌদ্ধধর্মের মতে, মৈত্রীর বিকাশ ঘটে পরসুখ বিবেচনার মাধ্যমে। আমরা বোধিলাভের মাধ্যমে সর্বদা তাদের আরও ভালভাবে সাহায্য করার জন্য প্রচেষ্টারত থাকি। অন্যদের ভালোবাসা এবং সেবা করা বুদ্ধের পূজা-অর্চনা করাকে বোঝায় না। অন্যদিকে ইসলামের মতে অন্যদের ভালোবাসা এবং সেবা করা আল্লাহর উপাসনা করার মধ্যে একটা ক্রিয়াকলাপ। তবুও আমরা অন্যের সহযোগিতা করি আর তার পরিণাম একই হয়।

অন্যদের ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা নিজেরাই বুদ্ধত্ব লাভ করার জন্য ইতিবাচক শক্তি গড়ে তুলি। এই অর্থে আমরা বুদ্ধত্বের কাছাকাছি পৌঁছে যাই কিন্তু ইসলামের মতে এটা মান্য নয় যা কাউকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। বুদ্ধত্বের লক্ষ্য, নিজে বুদ্ধ হওয়া এবং নিজে বুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। বৌদ্ধধর্মের মতে আমরা যখন বুদ্ধের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তখন কিন্তু আমরা তাকে একজন ব্যক্তি হিসাবে করি না যা তিনি আগে ছিলেন। একজন শাস্তা (শিক্ষক) হিসাবে বুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে একজন সৃষ্টিকর্তা হিসাবে নয়, যার আমরা পূজা-অর্চনা করি।

আল্লাহর শাস্তির তুলনায় স্বাভাবিক কারণ এবং ফল

অন্যদের ভালোবাসতে আমাদেরকে স্ব-লালন ভাবনা দমন করতে হবে। ইসলাম ধর্মেও একই কথা বলে অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ জিহাদ হল আত্মকেন্দ্রিকতা এবং আল্লাহর ইচ্ছার অবাধ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তবে বৌদ্ধধর্মের মতে আমাদের পাপ, আমাদের অকুশল কর্ম অথবা অজ্ঞতাবশে কৃতকর্মের জন্য আমাদের ক্ষমা করতে বুদ্ধকে প্রার্থনা করার প্রয়োজন হয় না। আমরা যখন অন্যদের নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করতে দেখি, এর অর্থ এই নয় তারা খারাপ বা অবাধ্য। এর কারণ হল তারা অজ্ঞতার কারণে বিভ্রান্ত হয় এবং তারা সত্যিই জানে না যে তারা কী করছে। আর তাদের কর্মের পরিণাম কী হবে? আমরা এটাকে করুণার ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা তাদের ক্ষমা ক’রে দিচ্ছি; এক অর্থে আমরা বুঝতে পারি আর সেইভাবে মৈত্রী ও করুণা বিকাশ করি।

অতএব, যখন ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া-কর্মের ফলে দুঃখের ভোগান্তি হয় তখন সেটা শাস্তিরূপে হয় না বরং হেতু এবং ফলের নিয়মের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে। আমরা অন্যদের শাস্তি দিয়ে সেটাকে ঈশ্বরের আইন প্রণয়ন করার জন্য নিজের উপর তুলে ধরি না। তিব্বত অথবা ভারতে অবশ্যই একটি আইনী ব্যবস্থা ছিল, এমনকি ঐ বৌদ্ধ সমাজেও; তবে সেটা ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট পবিত্র আইনের উপর ভিত্তি ক’রে নয়। আর আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যবহার ক’রে ঈশ্বরের কাজ চালিয়ে যাই না। এটা একেবারে আলাদা।

অনুতাপ সম্পর্কে বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের সমান্তরাল

ইসলাম ধর্মে অনুতাপের যে ব্যবস্থা আছে সেটা বৌদ্ধধর্মেও আছে আর এর সমান্তরালগুলি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়ঃ

  • উভয়ক্ষেত্রে, আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলি স্বীকার করতে হয়, যেগুলি বৌদ্ধধর্মের মতে অজ্ঞতার কারণে করা হয়ে থাকে, ইসলামের মতো অবাধ্যতার কারণে নয়।
  • আমরা অনুতাপ করি, ইসলামেও একইরকম ধারণা নির্ধারিত।
  • আমরা আমাদের অকুশল কর্মের পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্প করি, যেমনটি ইসলামেও উল্লেখ করা আছে।
  • আমরা জীবনে যে ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হই সেটা আমরা পুনরায় নিশ্চিত করি। এটা আমাদের ক্ষমা করার জন্য আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করার মতো নয় বরং কিছু ইতিবাচক বিষয়কে পুনরায় নিশ্চিত করে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে আমরা পুনরায় সেই ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হই।
  • সর্বশেষে, আমরা কিছু ইতিবাচক কর্মের মাধ্যমে আমাদের ভুল-ত্রুটিকে প্রতিহত করি। এটা ইসলামের অনুরূপ।

এটা স্পষ্ট যে বৌদ্ধধর্মে ইসলাম ধর্মের অনুরূপ অনেক কিছু আছে এবং এমন অনেক কিছু আছে যা বৌদ্ধধর্ম থেকে ভিন্ন। সর্বোপরি উভয় ধর্মই মৈত্রী, করুণা, ধৈর্য, ক্ষমা ইত্যাদির শিক্ষা প্রদান করে। আমরা যখন এই দুটি মহান বিশ্বধর্মের উল্লিখিত সমতাগুলিকে চিনতে এবং উপলব্ধি করতে পারি তখন দার্শনিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে সংলাপ, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং একে অপরের কাছ থেকে সম্প্রীতি শেখার একটি ভিত্তি গড়ে ওঠে।

প্রশ্ন এবং উত্তর

একে অপরের কাছ থেকে শেখা

অন্যান্য ধর্মের সাথে কথোপকথনের সময় আমার মনে দালাই লামার একটি স্মৃতি জাগে। তিনি প্রায়শই সুপারিশ করতেন যে আমরা অন্যদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করি না। পরিবর্তে, তাদের নিজস্ব ধর্মে অনুপ্রাণিত করি। তাদের নিজস্ব ধর্মকে অন্যভাবে দেখার জন্য নিজের জ্ঞান প্রয়োগ করা ভাল। আপনি কীভাবে সংলাপে যোগদান করেন?

যেমনকি আমি বলেছি এবং দালাই লামাও এটা বলেন যে এমন অনেক কিছু আছে যা এক ধর্ম অন্য ধর্ম থেকে শিখতে পারে। যেমন- বৌদ্ধধর্ম, সমাধি, মৈত্রী, করুণা ইত্যাদি বিকাশের পদ্ধতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, মননশীল ব্যবস্থা সম্পর্কে বৌদ্ধধর্ম থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। আমরা এটা বিশেষ ক’রে ক্যাথলিক মঠগুলিতে পাই যে মানুষ সেখানে ধ্যানের বিষয় শিখতে আসে যা তারা তাদের নিজস্ব ধর্মে প্রয়োগ করতে পারে।

দালাই লামা সবসময় বলেন, যে তিব্বতী বৌদ্ধরা বিশেষ ক’রে খ্রীষ্টান ধর্মের বিষয়ে মঠের সম্প্রদায় দ্বারা যেভাবে সমাজ সেবা অনুশীলন করা হয়, সেটা তারা শিখতে পারে। এটা এমন একটা অনুশীলন যা বিভিন্ন ভৌগলিক পরিস্থিতির কারণ তিব্বতের ভিক্ষুদের শিক্ষাদান, অনাথ-আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সেবা করার অনুশীলনে খুব বেশি বিকাশ ঘটেনি। আমি দেখতে পাই যে এই জিনিসগুলি আমরা অবশ্যই মাদার টেরেসার কার্যকলাপ থেকে শিখতে পারি।

সেখানে একটা বিনিময়ের ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। যেমনকি আমি বলেছি, আমি জাঞ্জিবারে যে ঘটনাটি দেখেছিলাম সেটা সম্পর্কে আমি রিপোর্ট প্রস্তুত করেছি, মাদকাসক্তদের পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করার জন্য ইসলামে একটা খুবই নির্ধারিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন ব্যবহার করা হয়। এটা এমন ধরণের যেটা খুবই লাভদায়ক। এইভাবে একে অপরকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা না করেই ধর্মের মধ্যে একটা খুবই উপকারী আদান-প্রদান হয়।

দালাই লামা যে বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী সেটা হল প্রতিটি ধর্মের প্রকৃত গুরুতর চিন্তাশীলদের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য এবং তাদের অভিজ্ঞতার মন্তব্য তুলনা করার জন্য বন্ধ ব্যক্তি বৈঠক করা। এটা খুবই আশ্চর্যজনক হবে যদি কিনা সেটা ঘটে।

সার্বজনীন মূল্যবোধ

মনে হচ্ছে, ইসলামের সাথে এই বিশদ তুলনাতে, সম্ভবতঃ আপনি বলছেন যে আমাদের নিজেদের নিয়ে এতটা সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয় আর মনে করা উচিত যে বৌদ্ধধর্মই হল সর্বশ্রেষ্ঠ। এইভাবে, এটা খুব ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে কারণ যেকোন ধরণের আস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে থাকে। ইসলামের দ্বার খুলে দেওয়ার অর্থ হল অন্যান্য জিনিসের দ্বার খোলার একটি উপায়।

হ্যাঁ, আমি এরসাথে সম্পূর্ণ একমত। দালাই লামা বলেছেনে যে, প্রত্যেকের জন্য কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ নেই, যেমন প্রত্যেকের জন্য কোন ভোজন শ্রেষ্ঠ হয় না, তবে নিজের জন্য কোনটা শ্রেষ্ঠ, নিজের জন্য কোনটা শ্রেষ্ঠ পথ সেটা নিজেই নির্ধারণ করতে পারে। আমরা এটাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না। এই মৌলিক মানগুলি সমস্ত ধর্মে দেখতে পাওয়া যায় এবং সেটা প্রত্যেকের জন্য বৈধ, এমনকি যারা কোন ধর্ম অনুশীলন করে না। এটাই হল তাই যেটা গুরুত্বপূর্ণ। পরম পূজ্য দালাই লামা যে বিষয়টি নিয়ে এত চিন্তিত সেটা হল মৈত্রী, করুণা, ধৈর্য এবং ক্ষমার মতো এই মৌলিক সার্বজনীন মূল্যবোধগুলিকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যায়, কীভাবে এই সংলাপকে আরও এগিয়ে নেওয়া যায় আর কীভাবে এই সার্বজনীন মূল্যবোধগুলিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবর্তন করা যায়। এই ব্যবস্থাটিকে বিশ্ব ব্যবস্থায় আনার উপায় হল বিদ্যালয়ে ছোট-ছোট তরুণদের এই মৌলিক মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে শুরু করা। উদাহরণ স্বরূপ, এটা সহজ হতে পারেঃ আমরা যদি ক্রোধিত হই অথবা হতাশ হয়ে পড়ি তাহলে এক থেকে দশ পর্যন্ত গণনা করতে হবে, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর তিনবার মনোনিবেশ করতে হবে অথবা লড়াই ঝগড়া করার পরিবর্তে কথা বলতে হবে।

ভারত এবং আমেরিকার কয়েকজন শিক্ষাবিদ ধীরে ধীরে শিক্ষা ব্যবস্থায় এটাকে সম্মানজনকভাবে প্রবর্তন করার জন্য কিছু পাঠক্রম তৈরী করেছেন আর যেমনকি পরম পূজ্যজী বলেছেন “ধর্ম-নিরপেক্ষভাবে”, এর অর্থ হল সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, একটা বা অন্যের সাথে নির্দিষ্ট না হওয়া।

প্রশ্নঃ ইসলাম ধর্মে বোধিলাভের ধারণা আছে কি? 

আপনি ইসলাম ধর্মের জ্ঞান অথবা অনুশীলন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার সময় বলেছেন যে, আমাদের আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী হওয়া অথবা একীভূত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, তাহলে কি ইসলাম ধর্মে বোধিলাভের কোন জ্ঞান উল্লেখ করা আছে, যদি থাকে সেটা কী ক’রে বোঝা যাবে?

উত্তরঃ ইসলামে সাধারণভাবে আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী হওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে আল্লাহ্‌র সাথে একীভূত হওয়া সুফি ব্যবস্থার বিশ্বাস। সুফি হল ইসলামের একটি উপগোষ্ঠী। বোধিলাভের বিষয়টা নির্ভর করে কীভাবে সেটাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। আমরা যদি এটাকে বিশেষ ভাবে বৌদ্ধ পদ্ধতিতে সংজ্ঞায়িত করি তাহলে আমরা বলতে পারি না যে অন্য ধর্মের অনুগামীরা এরজন্য সত্যিই লক্ষ্য স্থাপন করে। আমার একজন শিক্ষক এটাকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ আমরা যদি একটা খ্রীষ্টান ধর্মে স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি তাহলে আমরা বৌদ্ধধর্মের উল্লিখিত স্বর্গে জন্ম নেব না। আর যদি বৌদ্ধধর্মে স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি তাহলে আমরা খ্রীষ্টান ধর্মে উল্লিখিত স্বর্গে অবতরন করব না।

প্রতিটি ধর্মে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় যেটাকে লাভ করার জন্য প্রচেষ্টা করতে হয়, সর্বোত্তম ধরণের ব্যক্তি হতে গেলে নৈতিক, প্রেমময় ব্যক্তি অথবা তারচেয়ে আরও ভাল গুণবান ব্যক্তি হতে হয়। তবে আমরা বলতে পারি না যে এই পথ অনুসরণ করলে আমরা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছব যেটাকে বিশেষভাবে এবং নির্দিষ্টভাবে অন্য ধর্মে বর্ণনা করা আছে।

প্রশ্নঃ এর অর্থ কি এই যে তাদের ধারণা অনুযায়ী যেখানে স্বর্গ অস্তিমান সেখানে বোধিও বিদ্যমান?

উত্তরঃ জীবিত থাকাকালীন সর্বোত্তম ধরণের ব্যক্তি হওয়া এবং তারপর রয়েছে প্রায় একটি অন্তরাভবের মতো অবস্থা অর্থাৎ চূড়ান্ত বিচারের পূর্বে একটি মধ্যবর্তী সময়কাল যেখানে অনাগত অবস্থা থাকে এবং তারপর হয় চূড়ান্ত বিচার। আর এটাই হল জন্নত। এটাই ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।

আমরা যখন বৌদ্ধ কালচক্র সাহিত্য দেখি সেখানে আমরা ইসলামের উল্লেখ দেখতে পাই কারণ সেখানে ইতিমধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া ছিল। তৎকালীন কালচক্র সাহিত্যে মাত্র দুটি জিনিসের উল্লেখ পাওয়া যায় যা অদ্ভূত বলে মনে হয়। ঐ দুটির মধ্যে একটি হল চিরস্থায়ী স্বর্গ ও নরক এবং সেখানে অনিত্যতার কোন ধারণা দেখতে পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী কোন স্বর্গে পুনর্জন্ম অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে কিন্তু তারপর সেটার অবসান ঘটে আর অন্য পুনর্জন্ম অবস্থায় জীবন চলতে থাকে। অন্য আর একটা উল্লিখিত বিষয় যা কালচক্র গ্রন্থ অদ্ভূত বলে মনে করত, মাংসের উদ্দেশ্যে পশু জবাই হিসাবে হালাল করার পদ্ধতি হল আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার একটা রূপ। কারণ পশু জবাই করার সময় তারা বলে “বিসমিল্লাহ, আল্লহর নামে।” বৌদ্ধরা এটাকে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে রক্তাবলী হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল। তারা এটাকে অনুচিত বলে মনে করেছিল। স্পষ্টতই, ইসলামের মধ্যে খাদ্যতালিকাগত নিয়ম সম্পর্কে একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। এছাড়া অন্য আর কিছু ছিল না যা নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল। সেখানে একজন সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, কিছুই না। যেটার বাস্তবে অনেক কিছু বলা হয়।

প্রশ্নঃ সবাই কি বোধিলাভ করতে পারে? 

এরকম অনেক গ্রন্থ আছে যা বিভিন্ন বিবরণ প্রস্তুত করে। তারমধ্যে একটা সূত্র আছে যা উল্লেখ করে যে এমন লোক আছে যাদের মধ্যে তথাগতগর্ভ নেই। অনেক বিষয়বস্তু আছে যা পরিবর্তন হয়, কিন্তু যদি কারও মধ্যে তথাগতগর্ভ না থাকে তাহলে সে পরিবর্তন হতেই পারে না। এমন একটা সময় ছিল যখন আমাদের মধ্যে সেই পরস্পর বিরোধী ধারণা ছিল।

উত্তরঃ আমি যেভাবে এর ব্যাখ্যা শুনেছি তদনুসার এর অর্থ এই নয় যে তাদের মধ্যে তথাগতগর্ভ নেই। প্রথমতঃ, আমাদের দেখতে হবে তথাগতগর্ভ জিনিসটা কী। এটা হল সেই বিষয় যা একজনকে বুদ্ধ হতে উপযুক্ত ক’রে তোলে এবং যেটা বুদ্ধের বিভিন্ন গুণে রূপান্তরিত হয়। এটা ইতিবাচক শক্তির নেটওয়ার্ক, কখনো-কখনো এটা “পুণ্য সম্ভার” হিসাবেও অনুবাদ করা হয়। আর অন্যটি হল গভীর সচেতনতার নেটওয়ার্ক যাকে কখনো-কখনো “জ্ঞেয় সম্ভার” বলা হয়।

ইতিবাচক শক্তির এই নেটওয়ার্কের বিপরীতের কর্মকে আমরা নেতিবাচক কর্ম “নেতিবাচক সম্ভাবনার নেটওয়ার্ক” বলতে পারি। আমরা সমস্ত নেতিবাচক সম্ভাবনা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। তবে পুরো প্রশ্নটি হল, আমরা স্বয়ং কোনভাবে ঐ সমস্ত ইতিবাচক সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাব কি না যাতে আমরা বুদ্ধত্ব লাভ করতে অক্ষম হব, এটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমরা ঐ ইতিবাচক সম্ভাবনার অনেক কিছু হারিয়ে ফেলব কি না তা নিয়ে বিতর্কের সম্ভাবনা আছে, তবে সেখানে সবসময় কিছু না কিছু থাকেই। এটাই হল সেই বিতর্ক।

সেখানে আরও একটা বিতর্ক আছে, আমরা যদি অর্হৎ হিসাবে মুক্তি লাভ করি, তাহলে সেটাই কি প্রাপ্তির শেষ অবস্থা, নাকি আমরা বুদ্ধ হওয়ার জন্য আরও অগ্রগতি করতে পারি? তারা যখন বলে কেউ বুদ্ধ হতে পারে না, তখনই তারা অর্হৎ হওয়াকে প্রাপ্তির শেষ অবস্থা বলে মনে করে।

এটা আসলে কী বোঝায় সেটা জানার জন্য আরও বেশি ক’রে টীকা এবং ব্যাখ্যাগুলি অধ্যয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ হয়তো বলতে পারে যে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়ার জন্য নিন্দিত এবং সে বুদ্ধ হতে পারে না, সে যেন স্বর্গের একজন দরিদ্র অর্হৎ এবং তারজন্য দুঃখিত, এই বিষয়টা অনেকটা বিরক্তিকর। কিন্তু বুদ্ধ খুবই স্পষ্টভাবে বুঝেছেন যে মানুষ ভিন্ন প্রকারের হয়। আমরা যখন বুদ্ধের জীবনের দিকে তাকাই আমরা অবগত হই যে তিনি তার ভিক্ষু সংঘদের নিয়ে গৃহস্থদের বাড়ি-বাড়ি বিচরণ করতেন। ঐ সময় তাকে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ করা হতো। তদনুরূপ, মানুষ বুদ্ধ এবং তার ভিক্ষু সংঘদের জন্য সুস্বাদু মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা করতেন। আর ভোজনের পর তাঁকে শিক্ষা-দানের জন্য অনুরোধ করতেন। তদনুসার, যারা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতেন, বুদ্ধ ঐ মানুষগুলির মানসিকতা এবং আগ্রহ অনুরূপ ধর্মোপদেশ দিতেন যাতে তারা বুঝতে সক্ষম হন।

এইভাবে আমরা যদি সূত্রগুলির নাম দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে এমন অনেক সূত্র আছে যে সূত্রগুলির অংশে ঐ ব্যক্তির নাম জুড়ে আছে যাদের জন্য ঐ সূত্রের উপর উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি একই পটভূমি অথবা একই জ্ঞানের স্তরে ছিলেন না। অতএব, এর অনেক ব্যাখ্যা আছে; এটা একটা খুবই বিচক্ষণতার পরিচয়।

প্রশ্নঃ খুব বেশি লোকজন ইসলাম থেকে বৌদ্ধধর্মে বিমুখ করে না। 

খ্রীষ্টান বা ইহুদি ধর্ম থেকে অনেক লোকজন বৌদ্ধধর্মে যোগদান করছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু ইসলাম থেকে তেমন বেশি হচ্ছে না। ঐ বিষয়ে আপনার কোন ধারণা আছে?

উত্তরঃ প্রথমতঃ অনেক ইসলামিক সমাজে যদি একজন ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তাহলে এটাকে খুব খারাপ বলে মনে করা হয়। কিছু সমাজে, তাকে এরজন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। দালাই লামা এই বিষয়ে সঠিক তথ্যের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করতে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আমি বেশির ভাগ বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রীতির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেছি এবং ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি। একবার আমি মিশরের কাইরোতে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। প্রায় তিনশ জন ছাত্র-ছাত্রী স্বেচ্ছায় বৌদ্ধধর্মের উপর প্রদত্ত বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করেছিল। তারা জানিয়েছিল যে তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য ক্ষুধার্ত এবং কিছু শিখতে চায়।

পরম পূজ্য দালাই লামা কিছু মৌলিক বৌদ্ধ শিক্ষা প্রধান ইসলামিক ভাষাগুলিতে উপলব্ধ করতে উৎসাহিত করেছেন। তদনুসার, এটা এখন প্রায় ছয়টি ইসলামিক ভাষায় উপলব্ধ করেছি আর অনেক লোকজন সেগুলি পড়ে। আমাদের নিবদ্ধগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কোনটি সেটা জানতে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন ভাষা বিশ্লেষণ করি। উদাহরণ স্বরূপ, আরবী ভাষায় “কীভাবে ক্রোধের সাথে মোকাবিলা করা যায়।” এটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটা এমন যা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য কাউকে বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বৌদ্ধধর্মে ক্রোধকে কাটিয়ে ওঠার জন্য আর ভয় এবং ঐ ধরণের বিষয়গুলিকে মোকাবিলা করার জন্য অনেক উপকারী পদ্ধতি আছে। ইরানে, ফারসী ভাষায় যে নিবন্ধটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটা হল “কীভাবে ধ্যান করতে হয়।” তারা এই নিবন্ধে খুবই আগ্রহী। ইন্দোনেশিয়ায় যেখানে প্রচুর চীনা বৌদ্ধ জনসংখ্যা রয়েছে তারা দুটি ধর্মের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কিত নিবন্ধগুলিতে আগ্রহী।

স্পষ্টতই, সেখানে এই আগ্রহ আছে। এছাড়াও আমরা পাকিস্তানে যা দেখতে পাই সেটা হল সেখানে অনেক তরুণরা আছে যারা সত্যিই সব রকমের হিংসা এবং সন্ত্রাসের প্রতি বিরক্ত আর তারা মনে করে যে এটা অনেক হয়েছে। তারা এমন কিছুর খোঁজ করছে যা তাদের কিছু মানসিক শান্তি প্রদান করতে পারে। আমরা যতক্ষণ না বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলিকে এমনভাবে উপস্থাপন করব যা কাউকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। কাউকেই ইসলাম বা খ্রীষ্টধর্ম ত্যাগ করতে হবে না। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের কাছে বিশ্বকে দেওয়ার জন্য অনেক কিছু আছে আর আমরা এই কাজটা করার জন্যই চেষ্টা করছি। পরম পূজ্য দালাই লামা সার্বজনীন মূল্যবোধের প্রচারের ক্ষেত্রে এটাই করার চেষ্টা করেন যা প্রত্যেকের জন্য লাভদায়ক।

আমরা যতক্ষণ বৌদ্ধধর্মকে শুধু এই সার্বজনীন মূল্যবোধের ভাবনা থেকে অসীমিত রাখব, যা বৌদ্ধধর্মের প্রতি অন্যায় হবে না, ততক্ষণ এটা সঠিক থাকবে। বুদ্ধের জ্ঞান, তিব্বতের জ্ঞান, হল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং এটাকে যতটা সম্ভব উপলব্ধযোগ্য এবং অব্যাহত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রচেষ্টায় আমি সহ অনেকেই নিয়োজিত।

শূন্যতা এবং সাংবৃতিক বা ব্যবহারিক আত্মা

প্রশ্নঃ এই শিক্ষাগুলির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এবং আমার সহকর্মীরা এই শিক্ষাগুলিতে অংশগ্রহণ করার জন্য আট ঘন্টা ধরে ভ্রমণ করেছি। আপনি উল্লেখ করেছেন যে একটা আত্মা আছে আর সাধারণতঃ আমরা স্বভাব- শূন্যতা ও আত্মার নিঃস্বভাবতা ইত্যাদির কথাও শুনি। আপনি কি এর পার্থক্যের উপর ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তরঃ একটা বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী আত্মার অস্তিত্ব আছে। সেখানে বলে না যে আত্মা নেই তবে সেই আত্মা হল এমন কিছু যা শরীর, মন, আবেগ ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। এই সমস্ত জিনিস সবসময় পরিবর্তন হতে থাকে। আমরা বলতে পারি না যে আত্মা বলতে শুধু এই শরীর, মন, আবেগ, বুদ্ধি অথবা এইরকম বা ঐরকম কিছুকে বোঝায়। যাইহোক, তার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি একটা “আমি” আছে। এইসব বিভিন্ন বিষয়বস্তু, যা এর উপর ভিত্তি ক’রে সবকিছুই সবসময় পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের আবেগগত অবস্থা পরিবর্তন হয়, আমাদের শরীর সবসময় বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমরা যদি শরীরের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাব যে শরীরের প্রত্যেকটি কোষ আলাদা। সবকিছুই পরিবর্তন হয়; আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন আমাদের শরীরে যে কোষ ছিল তখনকার একটা কোষও এখন নেই। একটা আত্মা আছে কিন্তু এটা শরীর এবং মনের উপর নির্ভরশীল হয়ে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে পরিবর্তন হয়েই চলেছে। তবে শরীর, মন, আবেগ ইত্যাদি থেকে স্বাধীন এমন কোন আত্মারূপী বস্তু নেই যা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হয় না কারণ শরীর, মন ইত্যাদি প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হতে থাকে।

প্রশ্নঃ তাহলে এর অর্থ কি এর কোন নিত্যতা নেই?

উত্তরঃ আত্মার কোন আদি এবং অন্ত নেই। তাই, সেই অর্থে প্রত্যেকটি স্বাধীন আত্মা হল শাশ্বত কিন্তু এটা এমন কিছু নয় যা পরিবর্তন হয় না। সমস্যাটি হল যেহেতু তিব্বতী ভাষায় এই “তাগ-পা” শব্দটি “নিত্য” হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে যার দুটি অর্থ আছে। একটা অর্থ হল চিরকাল বা শাশ্বত এবং বৌদ্ধধর্মে সেটাকে মেনে নেয়। এর কোন আদি এবং অন্ত নেই, এমনকি বুদ্ধ হিসাবেও। অন্য অর্থটি হল এটা কখনোই পরিবর্তন হয় না, কিন্তু আত্মা ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তন হতে থাকে। যদিও একজন শিশু হিসাবে এবং একজন বয়স্ক হিসাবে উভয় অবস্থা আপনাকেই বোঝায়, তাহলেও আমরা বলতে পারি না যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে আপনার শিশু অবস্থার সাথে হুবহু মিল আছে। আপনি তো পরিবর্তন হয়ে গেছেন। সেই অর্থে আত্মাও ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তন হয়ে চলেছে। তবে এটা চিরন্তন, কারণ এটা চিরকালের জন্য প্রবাহমান। এটাই হল বিভ্রান্তি। কারণ সংস্কৃত শব্দ থেকে অনুদিত তিব্বতী শব্দের দুটি অর্থ আছে।

সুফীবাদের উপর হিন্দু বা বৌদ্ধ প্রভাব

প্রশ্নঃ আপনি সুফীবাদের কথা বলেছেন। আমি অনুমান করি যে বৌদ্ধধর্মের সাথে এটার আরও সমান্তরাল রয়েছে। মূলধারার ইসলামের সাথে একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ক ও সংযোগ আছে যদিও এটা ইসলামের কাছাকাছি রয়েছে। কিছু লোকজনদের ক্ষেত্রে পূর্বজন্মের ধারণাও নির্ধারণ করা আছে। আপনার কি মনে হয়, এর কোন ধরণের ঐতিহাসিক সংযোগ আছে? কারণ আমার কাছে মধ্য এশিয়ার উত্তর-পূর্ব পারস্য থেকে আগত একজন সুফী শিক্ষক আছেন। ঐ এলাকায় আসার পর ইসলাম শক্তিশালী হয়েছিল। আপনি কি আপনার গবেষণায় সেরকম কোন ঐতিহাসিক যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন?

উত্তরঃ সুফীবাদে, বিশেষ ক’রে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে, হিন্দুধর্ম থেকে কিছুটা পরিষ্কার প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়। যোগ-ব্যায়াম আর এই ধরণের অনুশীলনের ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ছিল। যেমন- শব্দগুচ্ছ নামের পাঠ এবং পুনরাবৃত্তি, কারও মতে এটি একটি মন্ত্রপাঠের মতো যা হিন্দুধর্মেও পাওয়া যায়। সমস্যাগুলি হল প্রভাবটা আসে কোথা থেকে, এটা কি হিন্দু ধর্ম থেকে আসে, নাকি বৌদ্ধ থেকে? প্রমাণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে এটা হিন্দুধর্মের দিকে একটু বেশি নির্দেশ করে। যাইহোক, কিছু-কিছু জিনিস আছে যা বৌদ্ধধর্মকে স্মরণ করিয়ে দেয় তবে এটা সুফী শিক্ষকদের মাজারের ক্ষেত্রে বেশি। কেউ কেউ বলেন এটা এক ধরণের স্তুপ। ধ্যান-পদ্ধতি হিন্দুধর্ম থেকে বেশি গ্রহণ করা হয় বলে মনে হয়।

সুফীবাদে এরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলি খুবই আকর্ষণীয়। আমরা যখন প্রেমের কথা বলি তারা এই প্রেমের জন্য আরও একটি শব্দ ব্যবহার করে যেটা কোরানে পাওয়া যায় না। তবে এটা সৌন্দর্যের অর্থ বেশি প্রকাশ করে। আল্লাহ এবং আল্লাহর সৌন্দর্যের সাথে মিশে যাওয়ার একটা আকাঙ্খা ও অভিলাষা রয়েছে। সৌন্দর্যের প্রতি এই প্রেম সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এটি সুফীবাদে একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এবং এটা বৌদ্ধধর্মে দেখতে পাওয়া যায় না। সেখানে জপ ইত্যাদির উল্লেখ আছে কিন্তু এটা বুদ্ধত্ব লাভের কাছাকাছি আসার একটা যান নয়।

আমাদেরকে সুফীবাদের বিভিন্ন দিক দেখতে হবে যা একইরকম মনে হতে পারেঃ সেখানে ধ্যান এবং মন্ত্রের মতো পাঠ আছে, একজন শিক্ষকের সাথে একটি সম্প্রদায়ে বসবাস করার কথা উল্লেখ আছে। তবে আমাদের হিন্দুধর্মেও সেগুলি রয়েছে। এটা বলা কঠিন তবে মধ্য এশিয়া অবশ্যই একটা গড় হয়ে উঠেছিল যেখানে এই তিনটি সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে উঠেছিল- বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম।

মৃত্যু-প্রক্রিয়ার তুলনা

প্রশ্নঃ আপনি কি কোরান অনুযায়ী বলতে পারেন কীভাবে একজনকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত? একজন ব্যক্তিকে কি আলোর দিকে তাকাতে হবে?

উত্তরঃ আমি কোন কিছুর সাথে পরিচিত নই এবং আমি অবশ্যই একজন কোরানের পন্ডিতও নই। আমি কল্পনা করতে পারি যে এটা কেবল আল্লাহকে স্মরণ করা। আমি জানি না মৃত্যুর প্রক্রিয়াকালে আসলে কী ঘটে যদিও আমরা বিশেষ ক’রে বৌদ্ধধর্মের তন্ত্র শিক্ষায় দেখতে পাই যা সেখানে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। আমি যা দেখিনি সেটা আমি বলতে পারব না। যদিও এর অর্থ এই নয় যে এটা সেখানে নেই। এর অর্থ হল আমি এটা দেখিনি।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কারণ আমি অনেক ছাত্রদের সাথে দুবাইতে থাকতাম এবং আমি দেখেছিলাম যে এটা সত্যিই একটা গম্ভীর ইসলামী সংস্কৃতির কাছাকাছি। আমি মহিলাদের পিতার প্রতি পূর্ণ ভক্তি এবং স্বামীর কাছে পরায়ণ হওয়ার জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুত হওয়া ছাড়া কিছুই দেখিনি। তারপর থেকে এমনকি এখনও সেখানে যে সমস্ত ছাত্র এবং অন্যান্য শিক্ষকরা রয়েছে যারা এর মতো সত্যিই অনুগত ছিলেন তারা মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে কখনোই আলোচনা করেনি যখন সেই বিষয়টা সামনে আসে। এটা এমন ছিলঃ পারলে জীবনে সেরা হন তাহলে জন্নত-এ যেতে পারবেন। এমনকি সেখানে পৌঁছনো একটা বড় বিষয় এবং মৃত্যুর জন্য এইভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। আমি একটা খ্রীষ্টান পরিবারে বড় হয়েছি এবং মৃত্যুর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্ম যে পথ প্রদর্শন করতে পারে, সেরকম কোন সমান্তরাল কোথাও আছে বলে মনে হয় না।

বৌদ্ধধর্ম বলে যে মৃত্যুর প্রস্তুতির সময় সর্বোত্তম চিন্তা-ভাবনাটি হল শরণ-গমন করা, আমরা কোনদিকে গমন করতে চাই, বোধিচিত্ত, বোধিলাভের লক্ষ্য স্থাপন করা এবং ধর্ম, গুরু ইত্যাদির সাথে সাক্ষাৎ হওয়া আর আধ্যাত্মিক পথে নিয়মিতভাবে অগ্রসর হতে সক্ষম হওয়া। আমাদের বুদ্ধ অথবা আমাদের আধ্যাত্মিক গুরুর কথা ভেবে মরে যাওয়া ভাল। একইভাবে ইসলাম ধর্মের মতে মৃত্যুকালে আল্লাহর কথা ভাবাটা আসলে বেশ সমান্তরাল হয়।

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী আমাদের মৃত্যুর পর যা কিছু ঘটে সে বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা নির্ধারণ করা রয়েছে। আমাদের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক কর্মের একটা রেকর্ড রাখা হয় আর মৃত্যুর পর সেটা দেখা হয়। তারপর আমাদের বিচারের দিন না আসা পর্যন্ত আমাদের যেতে হয় এক ধরণের অধিষ্ঠিত স্থানে সেটা ভয়ানক অথবা সুন্দর হতে পারে। তারপর মৃত ব্যক্তিরা সবাই আবার কবর থেকে উঠে আসে আল্লাহর সামনে, আর তারপর হয় চূড়ান্ত বিচার। তখন এটাই হয় চিরন্তন স্বর্গ বা চিরন্তন নরক।

ইসলাম ধর্ম মতে এই পরিপ্রেক্ষিতে ভাবতে হবেঃ কেউ যদি একজন ভাল মুসলিম হতে থাকে তাহলে কারও দ্বারা কৃত কোন নেতিবাচক কর্মের জন্য অনুতাপ করাও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য বেশি জোর দেওয়া হয়। এটা বৌদ্ধধর্মেও করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কেউ বোধিসত্ত্ব অথবা তান্ত্রিক, সংবর (ব্রত) ইত্যাদি লঙ্ঘন ক’রে থাকে তাহলে মৃত্যুর আগে সে সেটাকে পুনর্নবীকরণ করতে চাইবে যাতে সে শুদ্ধ সংবরের সাথে মৃত্যু লাভ করতে পারে। এটা অবশ্যই সেখানে আছে। আমাদের মৃত্যুর আগে অনুশোচনা করা এবং নিজের স্লেট পরিষ্কার করার একই ধারণা রয়েছে। আমি মনে করি যে একজন আন্তরিক ধর্মের অনুশীলনকারী হলে বৌদ্ধ এবং ইসলাম উভয়ের মধ্যেই এটাই বেশ সমান্তরাল দেখতে পাই। অবশ্যই অধিকাংশ লোকজন সেরকম হয় না, তবে একজন ব্যক্তি সেরকম হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই সেরকম করতে হবে।

আমাদের কাছে যা কিছু আছে সেটাকে ছেড়ে দিতে না চাওয়ার বিপরীতে পরবর্তীতে কী হবে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করি। অবশ্যই সেখানে শাহাদাত আছে তবে সেটা অন্য আর একটা বিষয়।

প্রশ্নঃ আমি অসলোর একটা স্কুলে শিক্ষকরূপে কর্মরত আছি যেখানে প্রায় ৬০% ইসলামিক ছাত্র আছে। আপনি কি আমাকে এই স্কুলের, বিশেষ ক’রে ছেলেদের আচরণে ক্রোধ সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন? ইসলামী বিশ্বে প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে এবং তার কারণে প্রচুর ক্ষোভ তৈরী হচ্ছে। আমার কন্যা মেয়েদের সাথে একটি মসজিদে গিয়েছিল সেখানে ভয়াবহ পরচর্চা এবং খারাপ আচরণ করা হচ্ছিল। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং সিরিয়া থেকে আগত দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের নিয়ে এরা তাদের জন্মভূমিতে আর বসবাস করে না। আমি আমার কন্যাকে কী বলব? এটা সত্যিই একটা কঠিন কাজ। আপনি এই আগ্রাসন এবং ক্ষোভ সম্পর্কে কী ভাবেন?

উত্তরঃ এটা স্পষ্টতই, বিশ্বের যে প্রান্তে প্রচুর দুর্ভোগ এবং রক্তপাত চলছে সেটাকে দেখতে এবং ঐ প্রান্তগুলি থেকে কাউকে কারও কাছাকাছি আসা খুবই হতাশাজনক, এমনকি তারা দ্বিতীয় প্রজন্মের হলেও। অবশ্যই এটা তরুণদের ক্ষেত্রে খুবই বিরক্তিকর; তাই তাদের মধ্যে সত্যিই তাদের আবেগগুলিকে পরিচালনা করার ক্ষমতার অভাব থাকে। ফলে তারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে একটা মানসিক সমস্যা থাকে, তাতে সে মুসলিম হোক বা অন্য কোন অভিবাসী, সেটা হল আনুগত্যের সমস্যা। একদিকে আয়োজক দেশ তাদের দেশের মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্যের কামনা করে, তাসত্ত্বেও নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ধর্ম থাকে যার প্রতি তারা অনুগত থাকার প্রয়োজন বোধ করে।

বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়া আনুগত্যের বিষয়টির খুব মিল আছে। তারা হয়তো ভাবে, যদি তারা মায়ের প্রতি অনুগত হয় তাহলে তার সাথে তারা তাদের পিতার প্রতিও অনুগত হবে। প্রশ্ন হল, কীভাবে সেই সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় যা তাদের উভয়ের প্রতি অনুগত করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, যা ঘটে সেটা হল আমরা যদি বলি কেবল একজনকে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত হওয়া উচিত, মূল সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রতি নয়, তাহলে অসচেতনভাবে অনুগত হওয়ার এই কামনার কারণে কেউ মূল সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলির প্রতি অনুগত হয়ে পড়ে। এটা আগ্রাসন ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশ পায়।

থেরাপিউটিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, তাদের সংস্কৃতির পটভূমিতে যে ইতিবাচক বিষয়গুলির প্রতি অনুগত থাকতে পারে সেটা গ্রহণ করতে সক্ষম হওয়া সহায়ক অথবা এটা নির্বিরোধ যৌথ আনুগত্যে অবকাশ প্রদান করে। এটাকে এক বা অন্য হতে হয় না। এটা এমন কিছু যেটাকে সত্যিই সমাজে খোঁজ করা দরকার। ইউরোপের কিছু সমাজে এমন বলা হয় যে নারীরা বোরখা পরতে পারবে না ইত্যাদি। তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এটা ভয়ঙ্কর এবং এটা সত্যিই ক্রোধের জন্ম দেয়।

বোরখা নিয়ে বড় সমস্যা কী আছে? যদি তাদের মুখ সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখা হয় এবং তারা একটি আদালতে বিচারে থাকে তখন কী হবে? উদাহরণ স্বরূপ, আমেরিকাতে এটিই একমাত্র পরিস্থিতি যেখানে অবশ্যই তাদের বোরখা মুখ থেকে সরানো হয় অথবা গাড়ি চালানোর সময় সরানোর প্রয়োজন হয়।

আমাদের দেখতে হবে যে কোন মূল্যবোধগুলি মানুষের সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হয় যা খুব ভালভাবে সমাজের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়ে ওঠে আর এটা নিয়ে কোন সমস্যা বা সংঘাত হয় না। এটা এই আগ্রাসনের সমাধান করতে সাহায্য করে। একটা শিশুর ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই বোঝা কঠিন। সম্ভবতঃ আপনি আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, যখন সে একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যায় তখন কি সে হতাশ ও ক্রোধিত হয় না আর আপনি কি লোকদের খারাপ কথা বলেন না যে আপনি এই নিয়ে কিছু মনে করেননি? আপনি তাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারেন যে তারা এই নিয়ে কিছু মনে করেননি। মানুষ যখন বিরক্ত হয় তখন তারা প্রায়শই এরকম কিছু বলে। এটা কখনো-কখনো সাহায্যও করতে পারে, তবে এটা শিশুর বয়স কত তার উপর নির্ভর করে।

সবাইকে ধন্যবাদ! আপনার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে পেরে আনন্দিত হয়েছি আশা করি এটা আপনাকে ভাববার জন্য কিছু সহযোগিতা করবে।

Top